পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-১৫+১৬

0
36
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৫

রুমঝুমকে বিশ্রাম নিতে বলে রান্নাঘরের যে কাজগুলো বাকি ছিল সেগুলো চটপটে হাতে শেষ করল আদিয়ান। পরনের আবায়া ছাড়িয়ে রুমঝুম অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। শরীর খুব দুর্বল ও ক্লান্ত থাকায় রান্নার দিকে খেয়ালই ছিল না তার। আদিয়ানের গলার আওয়াজ শোনে ধীরেসুস্থে বিছানা ছেড়ে ডাইনিয়ে এসে দেখল সব পরিপাটি। লজ্জিত হেসে বলল,

‘স্যরি ভাইয়া। তোমার কাজ বাড়িয়ে দিয়েছি।’

জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি তুলে আদিয়ান বলল,
‘রোজ তো তুই করিস। আজ আমি করলাম। ক্ষতি কী? তুই এক কাজ কর, খাওয়ার আগে কী কী ঔষধ আছে সেগুলো খেয়ে তারপর খেতে বোস্।’

ঘাড় নেড়ে তাই করল রুমঝুম। খাওয়ার আগের ঔষধগুলো খেয়ে চেয়ারে বসল। প্লেটে খাবার তুলতে গিয়ে খেয়াল করল আদিয়ানের মুখটা ভীষণ মলিন। বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না সে-ই চিন্তা চেপে বসল মাথায়। জানতে চাইল,

‘কী ভাবছ?’

বুকের ভেতর ঘুর্ণিঝড় বইছে। সেই ঝড় তাকে ভেতর থেকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে। ভালোবেসে ভালোবাসার কথা চেপে রাখা, সময়মতো প্রকাশ করতে না পারা ও নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে সর্বহারা আবিষ্কার করে, কিছু সুখসুন্দর অনুভূতিকে বুকে আগলে নিয়ে সুখসাগরে দুঃখের বৈঠা টেনে নেয়ার যন্ত্রণা তাকে দিবানিশি ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে হৃদপিণ্ডটা কেউ আগলা করে নিয়েছে। এত জ্বলুনি, এত কষ্ট অনুভব হচ্ছে, নিঃশ্বাসটাও যেন থেমে যাচ্ছে তার। অনেকক্ষণ ধরে নিজের মনের সাথে একাকী দ্বন্দ করছিল সে। সেই দ্বন্দের যথোপযুক্ত কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছিল না। রুমঝুমের কথায় হঠাৎই সব কষ্টগুলো একজায়গায় জড়ো হয়ে গেল। কোনোমতে উচ্চারণ করল,

‘ওই মেয়েটা কে জানিস?’

রুমঝুম ঠোঁট উল্টাল। এতটা রাস্তা মেয়েটার সাথে এলো, সাহায্য নিল, বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনল, অথচ নাম জিজ্ঞেস করা হলো না, এ কেমন মুর্খতা? কেমন বোকামি? নিজের আহাম্মকির কথা মনে হতেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,

‘এইরে, নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হয়নি।’

‘এটাই নওমী…।’

ব্যস, আর কিন্তু বলতে হলো না আদিয়ানকে। নওমী এখানে এসেছে, তাকে ও আদিয়ানকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জেনেছে, এইটুকু চটজলদি মাথায় ঢুকে গেল। সে আতঙ্কিত স্বরে বলল,

‘আমি একদম চিনতে পারিনি।’

আদিয়ান হেসে বলল,
‘চিনবি কী করে? তুই তো শুধু নামটাই জানিস। ছবি দেখিসনি। তাছাড়া তার কোনো ছবি আমার কাছেও নেই যে তোকে চেনাব।’

‘ও তো ভুল জানল। যদি তোমাকে ভুল বুঝে?’

‘তাতে কী আসে যায়?’

‘এটা কেমন কথা? তুমি তার ভুল ভাঙাবে না? নিজেকে প্রকাশ করবে না? এটা কোন ধরনের মুর্খতা, ভাইয়া? একটা মানুষকে ভালোবাসো তুমি। সেটা তাকে জানতে দিবে না? না জানলে কেউ তোমাকে কেন বুঝতে চাইবে? কীভাবেই বা বুঝবে?’

আদিয়ান কোনো কথা খুঁজে পেল না। সে নিজেই জানে না, তার আসলে করণীয় কী! যেখানে একবার তোফাজ্জল হোসেন তাকে অপমান করেছেন, সেখানে জেনে-বুঝে নিজেকে প্রকাশ করবে? আর করলেই, কেউ কেন তার মূল্যায়ন করবে? কতক্ষণ চুপ থেকে আদিয়ান বলল,

‘বলে কোনো লাভ নেই, ঝুম। এমনিতেই কয়েকমাস পর সে চলে যাবে। যে যাওয়ার, সে তো যাবেই তাই না? তাকে কী দিয়ে আটকে রাখি বল তো? তাছাড়া আমার যদি দু’হাতভরা টাকা থাকত, দামী গাড়ি-বাড়ি থাকত, আমি আজই ওর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতাম। কিন্তু আমার তো কিছু নেই। নিজের বানানো বাড়ি নেই। দামী চাকরি নেই। নিজস্ব ব্যবসা নেই। বাবার আমলের যে বাড়ি সেখানে তো এখন ফকিরও থাকবে না। এই কোটিপতি বাবার মেয়েকে বিয়ে করে জায়গা দিব কোথায়? খাওয়াব কী? পরতে দেব কী? ভেবে দেখেছিস এসব? ভাবিসনি।’

রুমঝুম নীরবে শুনল। আদিয়ান ফের বলল,
‘ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয় না রে, ঝুম। ভালোবাসার মানুষটাকে সুখী রাখার কথাও ভাবতে হয়। যার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন লন্ডনে সেটেল্ড হওয়া, সে সামান্য ভালোবাসার লোভে আমার মতো ভিখারির কাছে আসবে বলে মনে হয় তোর?’

‘তবুও একবার নিজেকে প্রকাশ করে দেখো। সবাই তো আর বিলাসবহুল জীবন চায় না। কেউ কেউ সুন্দর, পরিচ্ছন্ন জীবন চায়। টাকা-পয়সার অভাব থাকলেও যেখানে ভালোবাসার কোনো অভাব থাকবে না।’

‘জীবনটাকে নাটক-সিনামার মতো ভাবিস না, ঝুম। জীবন বড়ো জটিল। বড়ো অদ্ভুত। যদি সহজ হতো, খুব সহজেই ভালোবাসার কুরবানী হয়ে যেত।’

‘মানে!’

‘মা কেন দ্বিতীয়বার নিজের কথা ভাবেনি জানিস?’

‘নিশ্চয় ফুপাকে খুব বেশি ভালোবাসত।’

‘শুধু ভালোবাসাটাই মুখ্য নয়, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধটাই আসল। বাবার মৃত্যুর পর চাচ্চু যেদিন মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, সেদিনই কিন্তু মা ওই ভিটা ছেড়ে চলে এসেছিলেন। তার একটাই কারণ, দ্বিতীয়বার আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয় বলে। আমার জীবনটাও এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে আমি দ্বিতীয়বার কাউকে মন দেয়ার কথা ভাবতেও পারব না।’

‘এজন্যই বলছি, তাকে একবার নিজের মনের কথা বোলো। দেখো, বুঝে কি না।’

‘যদি না বুঝে? যদি ফিরিয়ে দেয়? তার বাবার মতো সে-ও যদি বলে, আমি ছোটোলোক। তখন?’

এই একটা জায়গায় এসে আটকে আছে আদিয়ান। রুমঝুম ভাবতেও পারল না, এরকম একটা জটিল সমস্যার সমাধান কী! সে ভেবেচিন্তে বলল,

‘বাবা এমন হলে কি মেয়েও এমন হবে? হতেও তো পারে নওমীপুর মনটা অন্যরকম! পজেটিভ ভাবতে দোষ কী বোলো? আমার কী মনে হয় জানো, সবকিছু তাকে বলা উচিত। তোমার ও আমার ব্যাপারটাও। এতে অন্তত আপু তোমাকে ভুল বুঝবে না।’

আদিয়ান উত্তর দিল না। নিশ্চুপে খেতে লাগল। রুমঝুম বলল,
‘নওমী আপুর ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে? কিংবা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট জানা আছে?’

‘না… কিছুই নেই।’

‘তুমি একটা…।’

গাধা বলতে গিয়েও থেমে গেল রুমঝুম। বেয়াদবি হয়ে যাবে। বলা যায় না, চড়থাপ্পড় মেরে দিতে পারে। কথার মাঝখানে থেমে যাওয়াতে আদিয়ান চোখ তুলে তাকালে রুমঝুম কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘তুমি এক কাজ কোরো, শুভর কাছ থেকে কিছু টিপস্ নাও। কীভাবে প্রপোজ করে, কীভাবে মেয়েদের মন বুঝতে হয়, রাগলে বা অভিমান করলে কীভাবে সে-ই রাগ ও অভিমান ভাঙাতে হয়, সেসব কিছু শিখে রাখো। প্রয়োজনে কাজে লাগবে।’

আদিয়ান কড়া শাসনের চোখে তাকালে রুমঝুম মুখ নামিয়ে খাওয়াতে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আদিয়ান বলল,

‘মনে হচ্ছে প্রেমের ওপর পিএইচডি করে বসে আছিস। ভুলে যাস না, তোর এই সাকসেসের পিছনে আমার হাত আছে। আমি না থাকলে কিছুই হতো না।’

***

সপ্তাহে তিনদিন আইইএলটিএস এর কোচিং হয় নওমীর। বিকেলে শুরু হয়ে সেই কোচিং শেষ হয় সন্ধ্যা সাতটায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোচিং শেষ করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই অসুস্থ মেয়েটাকে দেখে এগিয়ে আসে। এরপর তাকে তার বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে যা দেখল, জানল, তাতে তার মাথায় না চাইতেও একটা প্রশ্নের উদয় হলো, আদিয়ান বিবাহিত? কখনও তো বলেনি! বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ যাবৎ এটাই ভাবছিল নওমী। ঠিকমতো পড়া কান্টিনিউ করতে পারেনি। সারাক্ষণ এক চিন্তায় অস্থির হয়ে কাটিয়ে দিল। হুট করেই মনে হলো, আদিয়ানের সম্পর্কে যা কিছু জানার সেটা নিজের মামাতো বোনদের থেকে জেনে নিবে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বড়ো মামীকে ফোন দিয়ে বসল। রিসিভ করতেই ভালোমন্দ দু’চারটে কথা জিজ্ঞেস করে রিংকির সাথে কথা বলতে চাইল। ফোন কানেই ছিল। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

‘কিছু দরকার আপু? এত রাতে ফোন করলে?’

উশখুশ মন নিয়ে নওমী বলল,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘হ্যাঁ, বোলো।’

‘তোর গণিতের স্যার… আই মিন, আদিয়ান ফারুকী। ওই লোকটার সম্পর্কে কী কী জানিস তুই?’

‘বেশিকিছু জানি না। শুধু জানি, ওনার বাড়ি রাঙামাটি। থাকেন নানুবাড়ি নরসিংদীতে।’

‘উনি কি বিবাহিত?’

‘এটা তো জানি না। জিজ্ঞেস করিনি। কেন? তুমি জেনে কী করবে? প্রেমে পড়েছ?’

‘আরেহ্ না, আজ একটা মেয়ের সাথে রাস্তায় দেখা হলো। বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে জানলাম, ওই মেয়েটা আদিয়ান ফারুকীর স্ত্রী।’

‘ও মাই গড, স্যার বিবাহিত! মেয়েটা দেখতে কেমন আপু?’

‘সুন্দর। খুব সুন্দর।’

‘আর কিছু বলবে? ফোন রাখি? আমার আগামীকাল ক্লাস টেস্ট আছে।’

‘ওকে, ভালো থাক।’

কথা বলতে গিয়ে আনমনা হয়ে গেল নওমী। আস্তেধীরে আবিষ্কার করল তার ভীষণ মন খারাপ। কেন খারাপ কে জানে! মনের এই জটিল ব্যামো ধরতে পারল না। বইপত্র ফেলে উঠে দাঁড়াল। রুম ছেড়ে বের হতেই কিটি এসে পায়ের কাছে মুখ ঘষতে লাগল। দু’হাতে তাকে কোলে তুলে মায়ের কাছে যেতেই শুনল, তার মা ভিডিওকলে কথা বলছেন। পাশে দাঁড়িয়ে দেখল, নুজাইফা আমীন বলছেন,

‘পাত্র পেয়েছেন? কী বলছেন, আপা? কোথায় থাকে?’

‘পাত্র’ শব্দটা কানে আসতে ভ্রু কুঁচকে এলো নওমীর। ইশারায় জানতে চাইল, কীসের পাত্র? কার পাত্র? নুজাইফা আমীন ঠোঁট গোল করে বললেন,

‘তোর জন্য।’

নওমী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। নুজাইফা আমীন ফোন হাতে নিয়ে স্বামীর পাশে গিয়ে লাউড স্পিকার বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘তোমার বোন কথা বলবে, নাও। ‘

তোফাজ্জল হোসেন ফোন হাতে নিয়ে বোনকে সালাম দিলেন। ওপাশ থেকে তওফিকা হোসেন ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বললেন,

‘তোরা তো চাইছিস নওমী লন্ডনে আসুক। আমি বলি কি, ও আমার কাছেই আসুক। আমাদের পাশেই, এক দম্পতি থাকেন। ওনাদের দুটো ছেলেমেয়ে। দেশের বাড়ি সিলেটে। পাত্র ডাক্তারী পড়া শেষ করে এখন একটা হসপিটালে আছে। ওর বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছেন। তুই যদি রাজি থাকিস আমি আলাপ করে রাখি। নওমীর রেজাল্টের পর না হয় কথাবার্তা এগোবে।’

হাতে আসমান পাওয়ার মতো খুশি দেখাল তোফাজ্জল হোসেনকে। নওমী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনল। কখন যে তার দু’চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল টেরই পেল না। ফোন রাখার পর ভদ্রলোক যখন মেয়েকে ডাকলেন, কেঁপে উঠল সে। ক্রমাগত জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ঝটপট দু’চোখের পানি মুছে ফেলল। বিড়বিড়িয়ে আওড়াল,

‘আশ্চর্য! আমি কাঁদছি কেন? এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। লন্ডনের ভিসা, সেটেল্ড হওয়া… তাহলে! অথচ এমন মনে হচ্ছে যেন, যা হচ্ছে সব ভুল। কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না। কেন?’

ভালোমতো চোখমুখ মুছে বাবার পাশে গিয়ে বসলো নওমী। ভদ্রলোক মেয়েকে দেখে হাসিমুখে কাছে টেনে বললেন,
‘ব্যস, আর কোনো চিন্তা নেই। এবার ঠিকঠাকমতো এ্যাক্সাম দাও। রেজাল্টের পরপরই বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল করব।’

হাসতে চেয়েও জোর করে মুখে হাসি টেনে আনতে পারল না নওমী। চেপে রাখতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল। অনেকদিন পর আদুরে বাচ্চার ন্যায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে, তার বুকে মাথা রেখে কাঁদল সে। ভদ্রলোক ভাবলেন, ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে হয়তো মেয়ের চোখে পানি। তিনি মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,

‘দেখো অবস্থা! এখুনি বিয়ে দিচ্ছি না কি! এখনও কয়েক মাস বাকি। শুনেছ তো, তোমার ফুপি বলেছেন, পাত্র ডাক্তার? আমার রাজকন্যার জন্য তো এমন রাজপুত্রই চাই। স্ট্যাটাস ও শিক্ষা-দীক্ষা, সবকিছুই পারফেক্ট। যার-তার হাতে তো আমার হীরের টুকরো মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। তাই না?’

ভেতরের অনুভূতিটা কাউকে বুঝাতে পারল না নওমী। তার কেমন অনুভব হচ্ছে, সেটা তো নিজেও জানে না। এরকম হওয়ার ব্যাখ্যা কী, তা-ও তার জানা নেই। শুধু দমবন্ধ হয়ে যাওয়া কষ্টেরা চারপাশে ভীড় জমাচ্ছে। এসব কষ্টের চাপে পড়ে ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। সবকিছু শূণ্য কেবল। কেউ নেই, কিচ্ছু নেই।

***

পরদিন দুপুরেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল। কাউকে কোনোকিছু না জানিয়ে মেজো ভাইয়ের বড়ো ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসে উপস্থিত হয়েছেন আলেয়া বেগম। কলিংবেল চাপলে আদিয়ানই দরজা খুলে দিল। ওপাশে তার আম্মিকে ঢোক গিলে বলল,

‘আম্মি, তুমি!’

তিনি এখনও জানেন না, আদিয়ান চাকরি ছেড়ে টিউশনি করছে। বর্তমান পরিস্থিতি কিছুই বলেনি ছেলে। অসময়ে ছেলেকে বাসায় দেখে বললেন,

‘তোর অফিস নেই? বাসায় কী করছিস? ছুটি নিয়েছিস না কি? রুমঝুম কই?’

একসাথে এত প্রশ্ন করাতে কোনোটারই ঠিকঠাক উত্তর দিল না আদিয়ান। সোফায় আধশোয়া হয়ে রুমঝুম টেলিভিশন দেখছিল। দরজার সামনে ফুপিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে এলো কাছে। অনেকদিন পর কাছের মানুষদের দেখে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল আগে। চাচাতো ভাইকে দেখে বাড়ির সবার ভালোমন্দের খবর জানতে চাইল। আলেয়া বেগম আদুরে গলায় বললেন,

‘ছেলেমেয়েকে দূরে পাঠিয়ে ভালো থাকা যায়? দিনরাত টেনশন। কী খাস না খাস, উফফ! ঢাকা শহরে এত গরম। তোরা থাকিস কী করে?’

টেনশনে গলা শুকিয়ে গেল আদিয়ানের। এখন উপায় কী হবে? যেভাবে ব্যাগপত্র সাথে এনেছেন, এক মাসের আগে যাবেন বলে তো মনে হচ্ছে না। তার অসহায় চেহারা দেখে রুমঝুম চোখ নাচাল। আদিয়ান দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘যা ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আয়। দেখছিস না, আম্মির গরম লাগছে। শাশুড়ির সেবা কর জলদি। বেয়াদব কোথাকার।’

উপুর্যুপরি বকার ধরনে রুমঝুম অবাক, হতবাক। কাঁদোকাঁদো মুখ। আদিয়ানের খুব মায়া হলো। মেয়েটাকে বকাও যায় না। চোখের সামনে হাত নেড়ে বলল,

‘ধরা পড়লে শেষ।’

রুমঝুম কী বুঝল কে জানে! নাটুকে কান্না জুড়ে দিল। আলেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘দেখেছ ফুপি? তোমার সামনে আমাকে ধমকাল। রোজ এমন করে। ঠিকঠাক কাজ না করলে খালি বকাঝকা করে। আমার কী এমন বয়স বোলো, সব কাজ কী আমি পারি?’

আলেয়া বেগমের বড্ড মায়া হলো শোনে। ছেলের দিকে শাসনের চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘সুযোগ পেয়ে আমার বউমার ওপর অত্যাচার করছিস তুই? এত অত্যাচার করা ভালো না, আদি। ধরে রাখতে পারবি না।’

এরপর একাধারে অনেকগুলো বকা আদিয়ানের ওপর পড়ল। পেট-পিঠ শক্ত করে শুধু হজম করে গেল। পালটা কোনো কথাই তুলল না। তর্কেও গেল না। রুমঝুম ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এলো। এসির টেম্পারেচার বাড়িয়ে দিল। কৌশলে জিজ্ঞেস করল,

‘আমাদের দেখতে এই প্রথম এলে, ক’দিন থাকবে তো ফুপি?’

‘হ্যাঁ থাকব তো। রুমেল বিকেলেই রওনা দিবে।’

‘ওহ, ঠিক আছে। তোমার যতদিন মন চায়, তুমি ততদিন থাকবে। এখন চলো, ফ্রেশ হয়ে নিবে।’

ফ্রেশ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনল রুমঝুম। দু’জনের রুম আলাদা। ভেতরে পা রেখে মালপত্র কম দেখে তিনি অবাকই হলেন। বিশেষ করে ছোটো সাইজের ওয়ারড্রব ও ড্রেসিংটেবিল দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। এখানে সব মেয়েদের জিনিসপত্র। মনে সন্দেহ জাগলেও কিছু বললেন না। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল শেষ করে এলেন। ভেজা কাপড় বেলকনিতে মেলে দিল রুমঝুম। হঠাৎই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘তুই ভালো আছিস তো, মা?’

মায়ের আদরের ভাগটুকু এই নারীর সংস্পর্শে থেকে পেয়েছে রুমঝুম। মা মা গন্ধটা এই নারীর আঁচলের মাঝেই লুকোনো। অথচ এই নারীর কাছ থেকেই ক্রমশ সত্যকে গোপন করে যাচ্ছে তারা। আর কতদিন লুকোবে কে জানে! মনের গোপন ভাবনা গোপনে রেখে মাথা নেড়ে বলল,

‘হ্যাঁ তো, খুব ভালো আছি।’

‘আদি তোর খেয়াল রাখে?’

‘হুম…।’

আলেয়া বেগম আরও কিছু বলতে গেলে রুমঝুম বাঁধা দিয়ে বলল,
‘কতদূর থেকে এসেছ। এসো, খেয়ে নাও। আমরা এখনও খাইনি।’

‘সেকী রে। এতক্ষণ ধরে না খেয়ে আছিস কেন?’

‘এমনিই। ক্ষিধে পায়নি।’

ভদ্রমহিলা গোসলে থাকতেই বুদ্ধি করে আরও কিছু বাড়তি খাবার রান্না করে নিয়েছে রুমঝুম। সেটুকুই পরিবেশন করে, সবাই একসাথে খেতে বসলো। খাওয়া শেষে রুমেলকে এগিয়ে দিতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগোলো আদিয়ান। বের হওয়ার আগে নিজের রুমে গিয়ে মানিব্যাগ হাতে নিয়েছিল সে। সেটুকু খুব সুক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করলেন আলেয়া বেগম। ওরা দু’জনে বেরিয়ে গেলে গল্পের ছলে তিনি রুমঝুমকে বললেন,

‘তোরা কি আলাদা আলাদা থাকিস?’

আচমকা এই কথায় থতমত খেয়ে গেল রুমঝুম। কী বলবে, কীভাবে বলবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। হঠাৎ করে তার কী হলো কে জানে! মিথ্যেটাকে আর চেপে রাখতে পারল না। আলেয়া বেগমের হাতদুটো ধরে অনুশোচনায় ভরা কণ্ঠে বলল,

‘আমাদের মাফ করে দাও, ফুপি। আমরা তোমাদেরকে মিথ্যে বলেছি। আসলে আমরা বিয়ে করিনি। আমার ছোট্ট ভুলে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কোনো সমাধানই খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। এরমধ্যেই হুট করেই প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পারি। আর তারপর…।’

একাধারে সব সত্যি বলে গেল রুমঝুম। শুভর সাথে তার সম্পর্ক, বিয়ে, বাচ্চা, কিছুই লুকালো না। বলা শেষ হলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। আলেয়া বেগম নিঃশব্দে শুধু শোনে গেলেন। কোনো কথাই বললেন না। সময় পের হলো। সেকেন্ড, মিনিট এরপর ঘণ্টা। রুমেলকে নরসিংদীর বাসে তুলে দিয়ে সন্ধ্যের আগে আগে বাসায় ফিরল আদিয়ান। ঘরে পা রাখা মাত্রই মায়ের আদুরে হাতের শক্তপোক্ত একটা চড় খেল। জ্ঞান হওয়ার পর মা কবে তার গায়ে হাত তুলেছেন মনে করতে পারল না। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। রুমঝুম অসহায় চোখে তাকাল। ভদ্রমহিলা ছেলেকে আবার আঘাত কর‍তে চাইলে ছুটে গিয়ে তাঁকে আটকাল রুমঝুম। কেঁদেকেটে বলল,

‘ভুল আমার, ফুপি। ভাইয়ার না। আমার ভুলের শাস্তি তুমি আমাকে দাও। ভাইয়াকে মেরো না, প্লিজ।’

আলেয়া বেগম শান্ত হতে পারলেন না। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এলো তাঁর। ছেলের দিকে শক্ত চোখে চেয়ে শুধু বললেন,
‘ভাইজান তোকে ভরসা করেছিল রে, আদি। এটা তুই কী করলি? এই মা’মরা মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করে দিলি? আমি ভাইজানকে কী বলব? কী করে মুখ দেখাব? কোলেপিঠে করে মানুষ করার এই প্রতিদান দিলি? ওই মানুষটা তোকে যে স্নেহ-মায়া-মমতা দিয়ে এতগুলো বছর যত্নে রাখল, তার মূল্য এই? আমি কত বড়ো মুখ করে বলতাম, আমার ছেলেটাকে আমি মানুষ বানিয়েছি। কিন্তু তুই তো আমার সব গর্বে বিষ ঢেলে দিয়েছিস। তুই মানুষ হোসনি। একটা অসভ্য, অমানুষ ও মিথ্যেবাদী হয়েছিস। তুই আর কখনও, কোনোদিন আমাকে মা ডাকবি না। আজ থেকে তোর মা মৃত। মনে রাখিস।’

যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, সেভাবেই মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল আদিয়ান। দু’হাতে দুটো পা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমি ভুল করেছি, আম্মি। তোমাদের মিথ্যে বলে অন্যায় করেছি। তোমার যত খুশি আমাকে মারো, শাস্তি দাও, কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দাও, তবুও তোমাকে মা ডাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত কোরো না, প্লিজ। আমার পুরো পৃথিবীই তো তুমি। তোমাকে যদি মা ডাকতে না পারি তাহলে বেঁচে থেকে কী করব? তুমি আমাকে মারো আম্মি, মারো। কঠিন শাস্তি দাও। এমন শাস্তি দাও, যেন আর কোনোদিন তোমাকে মিথ্যে বলার সাহস না হয়!’

***

চলবে…

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৬

আলেয়া বেগমকে তাঁর কথা ও সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না আদিয়ান। এত করে মাফ চাইল, পা জড়িয়ে ধরে কত-শত কাকুতিমিনতি করল, তবুও তিনি মুখ ফিরিয়ে রইলেন। এত অনুরোধের পরেও কাজ হলো না দেখে রুমঝুমও ফুপির কাছে মাফ চাইল। ভাঙাগলায় বলল,

‘আমাদের ভুলটা ক্ষমা করে দাও না, ফুপি।’

ভদ্রমহিলার রাগ ও ঘৃণা যেন উথলে উঠল আরও। তিনি রুক্ষস্বরে বললেন,
‘ওর মতো ধোঁকাবাজ, মিথ্যেবাদীকে ক্ষমা করার প্রশ্নই আসে না। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে ভাইজান। সে-ই সাপ এখন তারই পায়ে ছোবল মেরেছে। আমার তো ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে, ওর মতো একটা অমানুষকে আমি জন্ম দিয়েছি। দু’হাতে আদর-যত্ন করে বড়ো হয়েছি। ওর বাবার মৃত্যুর সময় কথা দিয়েছিলাম, আমি ওকে মানুষ করব। অথচ ও অমানুষ হয়ে মৃত মানুষটার কাছেও আমাকে অপরাধী করে ছাড়ল। জীবনে কী এমন পাপ আমি করেছিলাম জানি না যে, ওর মতো একটা সন্তানের মা হয়েছি। ছিঃ ছিঃ, সমাজের দশজনের সামনে আমি মুখ দেখাব কী করে?’

এত কথা বলেও দমে গেলেন না আলেয়া বেগম। গলায় আরও তেজ ও জোর এনে বললেন,
‘পা ছাড় আমার। ভুল করার আগে মনে হয়নি, মাকে সত্যিটা জানাই? এখন কেন মাফ চাইছিস? আমি তোকে মাফ করব না। কোনোদিনও না।’

‘আম্মি প্লিজ… তুমি এত কঠিন হয়ো না। তুমি ছাড়া আমার কে আছে বোলো?’

‘বন্ধু আছে তো। ও-ই সব। ওর কাছে যা। আমি তোর কেউ না, কিচ্ছু না। পা ছাড় আদি… ভালো হচ্ছে না এটা।’

মায়ের এরকম কঠিন কঠিন কথা পাহাড়সম ব্যথা হয়ে আদিয়ানের বুকে চেপে বসল। পা জড়িয়ে রেখে বলল,
‘ছাড়ব না। যতক্ষণ না ক্ষমা করবে, ততক্ষণ এভাবেই থাকব।’

‘আমি মরে গেলেও তোকে ক্ষমা করব না। তুই শুধু ভুলই করিসনি, ভয়ংকর অন্যায় করেছিস। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া একটা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিস, সেই মেয়েটা এখন অন্তঃসত্ত্বা। তুই জানিস না, সবকিছুর সহজ সমাধান ভাবতে গিয়ে তুই কত বড়ো পাপে জড়িয়ে গিয়েছিস। তোকে ক্ষমা করার চেয়ে আমার মরে যাওয়াই শ্রেয়। অন্তত তোর মতো সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে হবে না।’

‘ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছে, তা-ই হোক।’

মায়ের কথা রাখার ভূত চাপলো আদিয়ানের মাথায়। পা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একছুটে রান্নাঘরে গেল। সবচেয়ে বড়ো যে ধারালো ছুরি ছিল, সেটা নিয়ে আসলো। মায়ের হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘আজ, এক্ষুণি, এইমুহূর্তে আমার গলায় এই ছুরি চালাবে তুমি। এরপর সোজা আমার লাশের ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তোমারও কোনো সন্তান থাকল না, আমিও কাউকে আম্মি ডাকলাম না। মৃত্যুর আগে এটা অন্তত জেনে যাব যে, পৃথিবীর বুকে যাকে রেখে যাচ্ছি, সে আমার আম্মি নয়। অন্য কোনো নারী। যার কাছে, ভুলের সামান্য ক্ষমার চেয়ে সন্তানের মৃত্যুটাও সুখের।’

মায়ের হাতে ছুরি দিয়ে হাঁটুভেঙে ফ্লোরে বসলো আদিয়ান। মুখ নামিয়ে বলল,
‘মারো আম্মি, দেরী কোরো না। দেরী করলে তোমার হাত কেঁপে উঠবে। এক কোপে তুমি আজ সমস্ত পাপের অবসান ঘটিয়ে দাও।’

এ কোন পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়ালেন বুঝতে পারলেন না আলেয়া বেগম। যে সন্তানকে মাসের পর মাস নিজের গর্ভে রেখেছেন, জন্মের পর বুকের দুধ খাইয়ে বড়ো করেছেন, ছোটো ছোটো আঙুলের ফাঁকে নিজের স্নেহ-মায়ার হাত গলিয়ে পথ চলতে শিখিয়েছেন, সে-ই সন্তানকে কীভাবে নিজ হাতে মেরে ফেলার মতো ঘৃণিত অপরাধ করবেন? কোনো মা কি কখনও এত নিষ্ঠুর হতে পারে? কিন্তু যে ভুল আদিয়ান করেছে, সেটাও তো ক্ষমা করার মতো নয়। আজ একটা ভুল যদি এত সহজে তিনি ক্ষমা করে দেন, সুযোগ পেয়ে আরেকটা ভুল সে করবে। এরপর আবার ক্ষমাকেই সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নিবে। না… এক্ষুণি, এত সহজে সন্তানকে ক্ষমা করে দিয়ে আবারও অন্যায় করার সুযোগ দিবেন না। ভেবেচিন্তে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরপর অনেকবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ছুরিটা হাতের মুঠোয় চেপে বললেন,

‘একটা শর্তে ক্ষমা করব।’

আদিয়ান চোখ তুলে বলল,
‘কী শর্ত?’

‘সব সত্যি স্বীকার করে তোকে তোর মামার কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে।’

‘আমি এখুনি মামাকে ফোন করছি।’

আদিয়ান মোবাইল হাতে নিতে চাইলে আলেয়া বেগম বললেন,
‘এখুনি না। আমি গ্রামে যাব। ভাইজানের সাথে কথা বলব। এরপর তুই তার সামনে গিয়ে ক্ষমা চাইবি। রুমঝুমকে সুস্থ এবং পরিচ্ছন্ন একটা জীবন দিয়ে, তারপর। সেদিন তোর মামা যদি তোকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলেই আমি তোকে ক্ষমা করব। আর ততদিন, তুই আমার সাথে কথা বলবি না, দেখা করবি না, আমার ভালোমন্দের খোঁজখবর নিবি না।’

মায়ের কথা শোনে আঁৎকে উঠল আদিয়ান। বলল,
‘এটা কেমন শর্ত? তোমার সাথে কথা না বলে থাকব কী করে আমি?’

‘সেটা তো আমি জানি না। তুই কীভাবে থাকবি, তুই জানিস। আমার সাথে কথা বলতেই হবে কেন? আমি কে তোর?’

‘আম্মি!’

অনেক কষ্টে আলেয়া বেগম নিজেকে শক্ত রাখলেন। ছেলের অসহায় চোখমুখের দিকে করুণা ও মায়ার চোখে তাকালেন না। সব মায়া উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে বললেন,

‘তুই শুভকে ডাক। আমি ওর সাথে কথা বলব। ভেবেছিলাম অনেকদিন থাকব, কিন্তু এখন আর সেই ইচ্ছে নেই। শুভর সাথে কথা বলে নরসিংদীর বাস ধরব আমি।’

আদিয়ান মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। হাতের ছুরি সরিয়ে দু’হাতে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
‘আজই নয়, আম্মি। প্লিজ…। দুটোদিন থাকো।’

‘সম্ভব নয়।’

‘প্লিজ…।’

‘শুভকে ফোন কর, এখুনি।’

মায়ের হুংকারে রীতিমতো বিস্মিত আদিয়ান। এত রাগ দেখাচ্ছেন আজ। আদেশ পালন করতে ঝটপট ফোন হাতে নিয়ে শুভর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। একাধারে তিন থেকে চারবার কল দেয়ার পর ম্যাসেজ এলো, ‘বিজি আছি। পরে কলব্যাক করব।’ শুভ কোন পরিস্থিতিতে আছে সেটা খুব ভালোমতো জানে সে। তা-ই এই ম্যাসেজের পর দ্বিতীয়বার আর কল দেয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। ম্যাসেজটা মাকে দেখিয়ে বলল,

‘ও ব্যস্ত। সময় হলে ঠিকই কল দিবে।’

‘কী এমন রাজকার্য উদ্ধার করছে সে, প্রয়োজনের সময় তাকে পাওয়া যায় না? এরকম একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন বন্ধুর হয়ে ওকালতি করতে এসেছিস? সর আমার সামনে থেকে। তোর মুখ দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

আদিয়ান মাকে জড়িয়ে ধরল, শক্ত করে। এত জোরে ধরল যে আলেয়া বেগম বেকায়দায় ফেঁসে গেলেন। জোরপূর্বক ছাড়িয়েও নিতে পারলেন না। পণ করলেন, আজ তিনি মুখ ফিরিয়েই থাকবেন। তা-ই ছেলেকে ছোঁলেন না, মাথায় হাত রাখলেন না। শুধু মেজাজি স্বরে বললেন,

‘তুই ভাবিস না, এসব মনভুলানো আদর দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করে দিবি। প্রয়োজনে আমি কত নিষ্ঠুর হতে পারি সেটা তুই জানিস।’

মায়ের বকাঝকা ও রাগ শোনেও হাসলো আদিয়ান। বলল,
‘তুমি আমাকে ছুঁয়ো না, জড়িয়ে ধরো না, আদর কোরো না, এমনকি আমার চেহারাটাও দেখো না, এতে আমার কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু দিনশেষে তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিও, তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে দিও, তোমার দিকে তাকানোর সুযোগ দিও, আর তোমাকে একটু আদর করার অনুমতি দিও, আমার তাতেই চলবে। ঠিক আছে?’

এইবলে টুপ করে মায়ের কপালে চুমু দিয়ে দৌড় দিল আদিয়ান। আলেয়া বেগম চরম বিস্ময় নিয়ে ছেলের দৌড়ের দিকে তাকালেন। রুমঝুম খিলখিলিয়ে হেসে বলল,

‘আর রেগে থেকো না, ফুপি। তোমার এই ছেলে আস্তো একটা ড্রামাবাজ। কোনদিক দিয়ে যে তোমার মান ভাঙিয়ে ছাড়বে, তুমি তা টেরও পাবে না।’

চোখ কটমট করে রুমঝুমকে দেখলেন আলেয়া বেগম। রুমঝুম ঢোক গিলে গালে অকারণ হাত ঘষে বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিনি চড়া গলায় বললেন,

‘চিনি ছাড়া এক কাপ চা দে জলদি।’

***

মাঝখানে কেটে গেল আরও তিন-চার দিন। আলেয়া বেগম এখনও মেজাজ দেখিয়েই চলেন। একসাথে চা-নাশতা করেন, দুপুরে ও রাতের খাবার খান, অথচ ভুল করেও একবার ছেলের সাথে যেচে কথা বলেন না। ছেলে কিছু বললে খুব অল্প শব্দে উত্তর দেন। আজ সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে আছে আদিয়ান। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকেই মাথাব্যথাটা একটু বেশি। ঘনঘন ব্যথা হয়, একাধারে কয়েকঘণ্টা খুবই ভোগায়। ওই সময়টা না চাইতেও ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। চাকরির টান নেই বলে একটু বেলা অবধি ঘুমিয়েছে সে। সকাল থেকে ছেলেকে চোখের সামনে না দেখে ভদ্রমহিলা চিন্তায় পড়ে গেলেন। বার বার ছেলের রুমের দিকে উঁকিঝুঁকি মারলেন। ভেতর থেকে দরজা আটকানো। রাগ ও অভিমান এতটাই যে, দরজার সামনে গিয়ে ছেলেকে ডাকতেও পারছেন না। ডাইনিংয়ে পায়চারী করছেন। রুমঝুম সবকিছুই খেয়াল করছিল সকাল থেকে। ফুপিকে চিন্তিত দেখে বলল,

‘বার বার ওদিকে উঁকি দিচ্ছ কেন? ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক। এত টেনশন করার দরকার নেই।’

বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন তিনি। রুমঝুম ঠোঁট মুড়ে হাসল। ফুপির মনের অবস্থা বুঝেই তার হাসি পাচ্ছে। তাকে এত হাসতে দেখে আলেয়া বেগম বললেন,

‘মাথায় কি জ্ঞানবুদ্ধি নেই? এতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছে, শরীর খারাপ হলো কি না দেখবি না? একবার তো ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস কর, এতবেলা অবধি কেন ঘুমাচ্ছে!’

‘তেমন কিছু না, ফুপি। মাঝেমধ্যেই বেলা অবধি ঘুমায়। ঘুমাতে দাও তো। খামোখা বিরক্ত কোরো না।’

‘তুই বুঝবি কী করে? মা তো হোসনি, তা-ই বুঝবি না, মায়ের কত চিন্তা হয়!’

‘ও চিন্তা হয়!’

ঠাট্টারছলে ফুপির কথাই রিপিট করল রুমঝুম। কাছে এসে বলল,
‘তোমার মনে আছে, ও তোমার ছেলে?’

‘কী বলতে চাস তুই?’

‘ওমা, বুঝলে না? ওইদিনই তো বললে, ওর মতো ছেলের মা…।’

আলেয়া বেগম চোখ গরম করে তাকালে কথা শেষ করার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল। রুমঝুম ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঝটপট ডোর খুলে দিল। অন্য সময় হলে, ভীষণ আবেগে শুভকে জড়িয়ে ধরে, চুপটি করে তার বুকে মাথা রাখত সে। কিন্তু আজ ফুপি সামনে, তাই ইচ্ছেকে দূরে ঠেলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ডাইনিংয়ের দিকে ইশারা করল। চুপিচুপি পা ফেলে আলেয়া বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে, তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে শুভ বলল,

‘আন্টি! কতদিন পর তোমাকে দেখছি। ইশ, তুমি তো দেখি একদম শুকিয়ে গেছো। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কোরো না, না? আহা, খাবারে অনিয়ম করলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমনিতেই বয়স হচ্ছে, পরে দেখবে নাতি-নাতনীর মুখ দেখার আগেই উপরে চলে গেছো। যদিও আমি তোমাকে এত তাড়াতাড়ি উপরে যেতে দিব না। শেষ পর্যন্ত তোমার পা ধরে লটকে থাকব।’

ছেলের আদরে গলে যাননি, শুভর আদরেও গললেন না। হাতের ঠেলায় শুভকে দূরে সরিয়ে পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বললেন,

‘এ্যাই তোরা বড়ো না কি ছোটো হচ্ছিস দিনদিন? বোকার মতো এসব কী কাজ করিস? কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করিস না। তোদের কাছে আমাদের কোনো গুরুত্ব নেই, কেন? এই দিন দেখার জন্য তোকে বড়ো করেছিলাম? মায়ের আদর-শাসন দিয়ে বুকে আগলে রেখেছিলাম?’

নিশ্চুপে ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল শুভ। পিছনে যত সুখস্মৃতি, আদর-শাসন, মায়া-মমতা, সব তো এই নারীর কাছে। কোথা থেকে কোথায় এসে পড়াশোনা করেছিল সে। মানুষের মতো মানুষ হতে গিয়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল। সব কথা মনে করে উপলব্ধি করল, তাদের তিন জনেরই ভুল। তার, রুমঝুমের, আদিয়ানের। সবচেয়ে বড়ো ভুল তার নিজের। সে আলেয়া বেগমকে শান্ত করতে বলল,

‘আন্টি, আমরা যদি ভুল না করতাম, দু’জন-দু’জনকে হারিয়ে ফেলতাম। কারণ তোমার ভাই, কোনোদিন আমাদের সম্পর্ক মেনে নিত না। মেজো আন্টি ছোটো আন্টি, তারাও কিন্তু ভালোবেসেছিল। তার পরিণতি কী হয়েছিল, সেটা তো জানোই তুমি। মনে একজনকে পুষে রেখে, অন্য একজনকে বিয়ে করা সহজ আন্টি, তবে মনে থেকে ভালোবাসা বোধহয় অসম্ভব। হ্যাঁ, দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায়। কেউ কেউ বাসে। তবুও পিছনের অধ্যায়ের জন্য একটা সুক্ষ্ণ টান থেকে যায়। হয়তো ঝুমের অন্যত্র বিয়ে হতে পারত, হয়তো আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করতে পারতাম, কিন্তু আমাদের প্রতিনিয়ত বেঁচে থেকেও মৃত্যু-যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে হতো। এই বেঁচে থাকার কোনো মানে থাকত, আন্টি? তুমি-ই বোলো, এভাবে বাঁচা যায়?’

ছেলেকে যেভাবে দূরে সরিয়েছেন, শুভকেও দূরে সরিয়ে আলেয়া বেগম বললেন,
‘আমি এত কথা জানি না। আমি শুধু জানি, ভাইজানকে ম্যানেজ করতে হবে। সেটা কী করে করবি, তোরা ভালো জানিস। তোদের একটাকেও ক্ষমা করলাম না আমি। দূরে যা তোরা।’

‘আন্টি…।’

আলেয়া বেগম চারপাশে কিছু একটা খুঁজলেন। পেয়েও গেলেন। মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে না পেরে হাতে তুলে নিলেন ঝাড়ু। শুভ আঁৎকে উঠে বলল,

‘আন্টি, এটা দিয়ে কী করবে? রেখে দাও না।’

‘আয় আমার সামনে। আয় বলছি। আজ তোর পিঠে এটা দেব। আরেকটাকে দেখ, মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে এখনও ঘুমিয়ে আছে। মেজাজ কিন্তু একদম খারাপ। দুটোকে একসাথে পিটিয়ে শান্ত হব।’

শুভ ভয় না পেয়ে আস্তেধীরে সামনে এগিয়ে ঝাড়ু সরাতে গেলেই ভদ্রমহিলা সেটা উপরে তুলে মারতে গেলেন, ভয়ে সম্পূর্ণ ড্রয়িংরুমে ছোটাছুটি শুরু করে দিল সে। রুমঝুম ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে এসব দেখছে। কতদিন পর পুরনো দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে তার। আনন্দে সে আত্মহারা। যত রাগ থাকুক, ধীরেধীরে সেই রাগে ভাটা পড়বে। এই দৃশ্যটা দেখানোর জন্য চুপিসারে দরজায় আওয়াজ তুলে আদিয়ানকে ডাকল রুমঝুম। হুড়মুড় ও দরজার ঠকঠক শব্দ শোনে মাথাব্যথা নিয়েই বিছানা ছাড়ল আদিয়ান। বাইরে এসে দেখল, তখনও তার সেই ছোটোবেলার মতো শুভর পিছনে ছুটছেন। শুভও কম যায় না। ভদ্রমহিলাকে ইচ্ছেমতো নাকানিচুাবানী খাওয়াচ্ছে। একটা সময় হাল ছেড়ে দিলেন আলেয়া বেগম। হাঁপাতে হাঁপাতে সোফায় বসলেন। রুমঝুম পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘এইটুকুতেই ক্লান্ত?’

আলেয়া বেগম পানি খেয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে বললেন,
‘তোরা আর মানুষ হবি না।’

শুভ নিজেও এক গ্লাস পানি খেল। এরপর আলেয়া বেগমের পাশে বসে বলল,
‘কী করতে হবে বোলো? কানে ধরে ওঠবস করতে হবে? তুমি বললে সেটাও করব।’

‘সবকিছুকে হাসিঠাট্টা ভাবিস না।’

‘আচ্ছা বোলো, যে ভুল করেছি তার জন্য কী শাস্তি বরাদ্দ?’

আলেয়া বেগম শুভর জন্যও শাস্তি ভেবে রেখেছেন। শুভ যখন নিজে থেকেই শাস্তি মেনে নিতে রাজি হলো, তিনি সাথে সাথেই বললেন,

‘আদিকে একটা কঠিন শাস্তি দিয়েছি। তোর জন্যও একটা বাঁচিয়ে রেখেছি। কথামতো কাজ করবি তো?’

‘হুম…।’

‘আমায় ছুঁয়ে কথা দে।’

সুযোগে হাত বাড়িয়ে দিলেন আলেয়া বেগম। শুভ সেই হাতকেই পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে বলল,
‘তোমার সব আদেশ-নিষেধ আমি মাথা পেতে নেব। বোলো, কী করতে হবে আমায়?’

‘ভাইজানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগে তোর বাবা-মাকে পাঠিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিবি। তোদের বিয়েটা আইনত শুদ্ধ হলেও ধর্মমতে এখনও অশুদ্ধ, ভুলই। কোনো উপযুক্ত মেয়ের গার্ডিয়ান ছাড়া বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ। ভুল যেহেতু হয়ে গেছে, সেটাকে শোধরে নেয়ার সুযোগ একটাই, আবার বিয়ে করা। সমাজের দশজন মুরব্বি ও পরিবারের লোকজনকে সাক্ষী রেখে।’

শুভ এটা জানত। কিন্তু তবুও ভুল হয়ে গেছে। হারানোর ভয়েই এই ভুলের পথে পা দিয়েছে। দূরেও থাকতে পারেনি। সে নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়ে বলল,

‘আর?’

‘ঝুমের কাছাকাছি আসবি না আর। পিছনে যে ভুল করেছিস, সে-ই ভুল দ্বিতীয়বার করবি না।’

‘দেখা করতে পারব না?’

‘দেখা করবি, কিন্তু দূরত্ব মেনে চলে।’

‘বিয়ের প্রস্তাব কবে পাঠাব?’

‘এখুনি না। ভাইজান চটে যাবেন। আগে তোদের বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক, তারপর বাকি কাজ হবে।’

‘ততদিন দূরে থাকতে হবে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ…।’

শুভ দু’হাতে আলেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘এই তোমায় ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, এরপর আর কোনো ভুল করব না।’

‘ঠিক আছে। কথা যেদিন রাখতে পারবি, সেদিন ক্ষমা পাবি। ততদিন নিজেদের ভুলের হিসেব-নিকেশ করে পাপের বোঝা হালকা কর তোরা।’

সব আলাপ-আলোচনার সমাপ্তি টেনে ছেলের দিকে একপলক তাকিয়ে আলেয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন। রুমে গিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে, বোরখা পরে বেরিয়ে এসে আদিয়ানকে বললেন,

‘নরসিংদীর বাস পাওয়া যাবে এখন? আমাকে গাড়িতে তুলে দিবি, আয়। এখানে আর একমুহূর্তও থাকতে পারব না।’

দু’জনকে সাথে নিয়েই বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলে এলেন আলেয়া বেগম। দুটো টিকিট কেটে আদিয়ান বলল,
‘আমি সাথে আসি?’

‘না…। ওখানেই দাঁড়া। পা বাড়ালেই বাড়ন্ত পা ভেঙে ফেলব।’

আদিয়ান কথা বাড়াল না আর। মায়ের রাগ এখনও পড়েনি এটা সে বুঝে গেছে। মানানোর আর কোনো উপায়ও নেই। মাথার যন্ত্রণাটা ক্রমশ বাড়ছে। আলগোছে ঘাড়ে ও কপালে হাত বুলাল সে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাস এলে, মাকে গাড়িতে তুলে দিল আদিয়ান। দশমিনিট গাড়ি ওখানেই দাঁড়াল। দুইবন্ধু বেঞ্চে বসে রইল। বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তে বন্ধুর হাত থেকে টিকিট কেড়ে নিয়ে দৌড়ের ওপর বাসে উঠল শুভ। এরমধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিল। মুখ লুকিয়ে সামনের একটা সিটে বসে গুনগুনিয়ে গান ধরল সে। আলেয়া বেগম খেয়ালই করলেন না, এক ছেলেকে বকে আটকে দিলেও আরেক ছেলে তাকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে যাত্রাপথের সঙ্গী হয়েছে।

শুভর এই পাগলামিগুলো বড্ড ভালো লাগে আদিয়ানের। নির্ভার হেসে নিশ্চিন্তমনে বেঞ্চ ছেড়ে সামনের দোকানে এলো সে। পানি কিনে, প্যান্টের পকেট থেকে ঔষধ বের করে ঝটপট গিলে ফেলল সেটা। এরপর উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে এসে চুপটি করে বসে রইল। ক্লান্ত লাগছে। চোখজুড়ে ঘুম নেমে এসেছে তার। মাথার ওপর একটা ভরসার হাতের বড্ড অভাব টের পেল আজ। চোখবুঁজে বেঞ্চে হেলান দিল। তখুনি শুনল নওমীর গলা। একঝাঁক বাচ্চাদের কিচিরমিচির, সেইসাথে মেয়েটার ছোটাছুটি। কানামাছি খেলার বাহানায় সম্পূর্ণ পার্কের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি। দৃশ্যটায় এতটাই শান্তি অনুভব হলো তার, আপনমনেই হেসে উঠল। পরক্ষণেই মন খারাপ করে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বিড়বিড়াল। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আওড়াল,

‘যা তোর নয়, হবেও না কোনোদিন, তার দিকেই কেন ফিরে ফিরে তাকাস? তুই তো চরম বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস, আদি। ধনী-গরীবের মধ্যে মন দেয়া-নেয়া চরম নিষিদ্ধ। ভুল করেও পিছনে ফিরিস না আর। আশেপাশে যা কিছু দেখছিস সবটাই ভুল, মোহ ও ছলনা।’

***

চলবে…