#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৭
সকালের নাশতা শেষ করে বাইকের চাবি হাতে তুলে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি টপকে নিচে নামছিল জাদীদ। তিনতলায় এসে একটা দৃশ্য দেখে তার চোখদুটোতে বিস্ময়, রাগ, ঘৃণা ও লজ্জা, সবকিছু একসাথে চেপে বসে। যা দেখছিল, সবটাই তার সাথে মিথ্যে স্বপ্ন মনে হলো। রুমঝুমের মতো সুন্দর মনের মেয়ে এত খারাপ! ভাবতেই পারল না। এতদিনে এই মেয়েটার প্রতি যত সম্মান ও শ্রদ্ধা জন্ম নিয়েছিল, আজ তা নিমিষেই ঘৃণায় রূপ নিল। ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আস্তেধীরে ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে শুভর দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল,
‘এখুনি চলে যাচ্ছেন?’
রুমঝুম দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। জাদীদের রুক্ষস্বর ও চেহারার থমথমে ভাবটা ভীষণ অবাক করল তাকে। শুভ সেইসব খেয়াল করল না কি না কে জানে। সে-ও হাত বাড়িয়ে বলল,
‘হ্যাঁ…।’
‘আপনার বন্ধু কোথায়?’
‘ঘুমাচ্ছে এখন।’
‘বাহ্, উনি তো বিন্দাস লাইফ কাটাচ্ছেন। চাকরি-বাকরির চিন্তা নেই। আর আমাদের… টেনশনে রাতের ঘুমটাও হারাম হয়ে গেছে। এরকম একটা বিন্দাস লাইফ তো আমিও ডিজার্ভ করি।’
শুভ হেসে বলল,
‘অবশ্যই করেন। একদিন আপনারও এরকম একটা দিন আসবে নিশ্চয়ই। ওর কথা বাদ দিন। চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।’
দু’জনে একসাথে নিচে নামার পথে অগ্রসর হলো। জাদীদকে ভাবনারত অবস্থায় দেখে শুভ বলল,
‘কোনো খোঁজ পেয়েছেন?’
সেদিনের পর আদিয়ান নিজেই বন্ধুর ব্যাপারে সব কথা ও জাহাঙ্গীরের দেয়া টোপে কীভাবে নওমীর ক্ষতি হতে পারে, সবটাই জানিয়েছে। এই কারণে জাহাঙ্গীরের লোকের চোখের আড়ালে থেকে জাদীদের কাজে সাহায্য করছে শুভ। জাদীদ জানে, শুভর কাছে একটা রিভলবার আছে এবং সেটা সে নিজের নিরাপত্তা ও নওমীকে বাঁচানোর অন্যতম উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে যেন জাহাঙ্গীর কিছু ধরতে ও বুঝতে না পারে। তাই সরাসরি শুভর সাথে জাদীদের দেখা হয় না। ফোনে খুব কম কথা হয়, তা-ও প্রয়োজনীয় আলাপ। গতকাল রাতে শুভ এসেছিল, জাহাঙ্গীরের পরিচিত একজনের লোকেশনের খোঁজ নিয়ে। যে সেদিন নওমীকে গুলি করতে চেয়েছিল, তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট, পরিচয় ও ঠিকানা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই ঠিকানায় গিয়ে লোকটাকে পাওয়া যায়নি। শুভ ওই লোকটারই অন্য একটা ঠিকানা নিয়ে এসেছিল। ফোনে বেশি কথা বলা রিস্ক দেখে গভীররাতে এসেছে দেখা করতে। সেটাই তাদের প্রথম দেখা ও সাক্ষাৎ ছিল। আর এখন যাচ্ছে। জাদীদের ভাবনা এখানেই যে, শুভ যদি আদিয়ানের বন্ধু হয়, তাহলে রুমঝুমের সাথে তার এত মাখোমাখো সম্পর্ক কেন? ব্যাপারটা গতকাল রাতেই কিছুটা চোখে পড়েছিল। শুভকে নিয়ে কিছু বিষয়ে রুমঝুম খুব বেশি চিন্তিত ও কেয়ারিং। কিছুক্ষণ আগেও দেখল, বিদায় নিতে গিয়ে শুভ মেয়েটার কপালে আলগোছে একটা চুমু খেয়েছে। এরপর থেকে মাথায় শুধু একটা প্রশ্নই খেলা করছে, কোথাও রুমঝুম পরকীয়া করছে না তো? হতে পারে আদিয়ানকে ঠকিয়ে তারই বন্ধুর প্রেমে পড়েছে! এইসব জটিল বিষয়াদি নিয়ে ভাবতে গিয়ে শুভর কথায় ঠিকঠাক মনোযোগ দিতে পারল না জাদীদ। শুধু বলল,
‘কোন বিষয়ে?’
প্রশ্ন শোনে শুভ একপলক তাকিয়ে বলল,
‘গতকাল রাতে কী বলেছিলাম?’
‘লোক পাঠিয়েছি রাতেই। কতটা কী খোঁজ মিলেছে জানি না। থানায় যাই, তারপর বুঝতে পারব বাকিটা। তবে আপনি যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেই ঠিকানায় রাসেলকে পাওয়া যায়নি। হয়তো কোথাও লুকিয়ে পড়েছে।’
‘ওরা কি আগে থেকে বুঝতে পারছে?’
‘ওদের লোক সবসময় আপনাকে ফলো করছে, সেটা তো জানেনই। আপনি যতই লুকিয়ে-চুরিয়ে আসুন, ওরা কিন্তু ঠিকই জানবে।’
‘তা জানবে। কিন্তু আমি ভাবছি, এই লোকটা আর কত পালাবে? নাম ও চেহারা যেহেতু মিলেছে, দেখা-সাক্ষাৎও একদিন মিলে যাবে নিশ্চিত।’
‘হয়তো…। আসলে এই জাহাঙ্গীর গভীর জলের মাছ, বুঝলেন। সে প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলছে হিসেব করে। জানে, একটা ভুল সব নষ্ট করে দিবে।’
‘আমার একটাই খটকা, লোকটা তোফাজ্জল হোসেনের মেয়েটাকে মারতে চাইছে কেন?’
জাদীদ মুচকি হেসে বলল,
‘পারিবারিক অনেক জটিলতা আছে, ভাই।’
‘আপনি জানেন?’
উপরনিচ মাথা নেড়ে চাবি বসিয়ে বাইক স্টার্ট করে জাদীদ বলল,
‘সাবধানে থাকবেন। ওরা যদি জানে আপনি আমাকে ওদের সব ইনফরমেশন দিয়ে হেল্প করছেন, আপনার ক্ষতি করতে পারে।’
‘আমার জন্য ভাববার কিছু নেই। কপালে মৃত্যু যেদিন লেখা থাকবে, সেদিন মৃত্যু হবেই।’
‘তবুও আমরা বাঁচতে চাই। সুন্দর একটা জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। আপনজনদের নিয়ে বেঁচে থাকাতে শান্তি খুঁজে পাই।’
বিনিময়ে শুভ একটুকরো স্বচ্ছ হাসি ফিরিয়ে দিল। জাদীদ মুহূর্তের মধ্যেই চোখের আড়াল হলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্যাপের সাহায্যে মুখ ঢেকে প্রাচীর টপকে উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল শুভ।
***
শুক্রবারদিন বিকেলে সাত-আট বছরের ছোটো একটা মেয়েকে নিয়ে শপিংমলে এসেছে নওমী। মেয়েটির পরিবারের লোকজনকে কিছু পোশাক কিনে দিবে বলে। টোলে বসে প্রয়োজনীয় পোশাক পছন্দ করছিল সে, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এগুলো দেখছিল। ঠিক ওই সময়েই একই মলে আদিয়ান এসে দাঁড়াল। সে নওমীকে খেয়াল করেনি, নওমীও তাকে দেখেনি। দু’জনই দুইদিকে। দোকানীকে উদ্দেশ্য করে আদিয়ান বলল,
‘ভালো মানের কয়েকটা মেক্সি ও মেডি দেখান তো, ওড়নাসহ।’
দোকানী নানান রঙের ও ডিজাইনের মেক্সি-মেডি বের করে দিল। চকচকে রং ভালো লাগে না দেখে হালকা রঙের চাইল আদিয়ান। দোকানী তা-ই দেখাল। এগুলো পছন্দ করা হলে চারটে আলাদা সরিয়ে আম্মির জন্য দুটো শাড়ি নেয়ার ইচ্ছে জাগল মনে। আম্মি ভীষণ অভিমানী, এতদিন হয়ে গেল তবুও তিনি ছেলেকে ক্ষমা করতে পারলেন না। এদিক-ওদিক থেকে ইন্টারভিউর সময় আসে, ছুট দিতে হয়, আবার প্রতিদিন রুমঝুমকে নিয়ে ভার্সিটিতে যেতে হয়, টিউশনি করাতে হয়, সবমিলিয়ে ব্যস্ততায় আর নরসিংদীতে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারছে না সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রুমঝুমকে কটাদিন মাজেদা খাতুনের কাছে রেখে মামার সাথে দেখা করতে যাবে। সেই সময়টা কবে পাবে এখনও নিশ্চিত নয়। সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝেই দোকানী বেশ সুন্দর সুন্দর রং ও ডিজাইনের শাড়ি বের করল। আদিয়ান যেহেতু বয়স বলেনি, তাই লোকটা ভাবল বউয়ের জন্য নিবে, এজন্য বয়স আন্দাজ করে বেশকিছু শাড়ি বের করল। তারপর আদিয়ানকে বলল,
‘দেখুন ভাই, কোনটা নিবেন?’
শাড়ির দিকে তাকিয়ে আদিয়ান অবাক হয়ে গেল। প্রত্যেকটা শাড়ি এত সুন্দর, এত দৃষ্টিনন্দন যে মনে হলো ভবিষ্যৎ বউয়ের জন্য সবগুলো শাড়ি সে কিনে নিক। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসলো। কোনো ইয়াং মেয়ের জন্য নয় বরং নিজের মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে চাইছে, এইটুকু বলতে চাওয়ার আগেই ওপাশ থেকে মেয়েলী স্বরে ভেসে এলো,
‘ভাইয়া, ওই শাড়িটা একটু দেখান তো, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট।’
আদিয়ান চেয়ে দেখল মেয়েটা নওমী। চট করেই মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চলে এলো। দোকানী শাড়িটা নওমীর দিকে ঠেলে দেয়ার আগেই হাত বাড়িয়ে সেটা আটকে নিল আদিয়ান। বলল,
‘আমি এটাই নিব, প্যাক করে দিন। আর মধ্যবয়সী মহিলার জন্য দুটো শাড়ি নিব। এটা বাদ দিয়ে, আপনি সবগুলো রেখে অন্য ডিজাইনের শাড়ি বের করুন।’
নওমী ক্ষুব্ধচোখে তাকাল। বাচ্চাটাকে বিদায় দিয়ে তেড়ে এলো আদিয়ানের সামনে। দূর থেকেই দেখছিল, শাড়িটা ভীষণ সুন্দর। কালো ও সাদা দুটো রংই তার এত পছন্দ বলে বেশিরভাগ পোশাকই কালো-সাদা কিনে। আজ নিজের জন্য কিছু নেয়ার প্রয়োজন ছিল না বলে, এতকিছু ঘাটেনি। হঠাৎই চোখ পরাতে শাড়িটা ভালো লেগে গেল, তাই নিজের জন্য নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিল। আদিয়ান যে এমন কাজ করবে ভাবেইনি সে। কাছে এসে রেগেমেগে বলল,
‘এটা আমি আগে পছন্দ করেছি, এটা আমার।’
আদিয়ান পাল্টা জবাবে বলল,
‘একদম নয়। এটা আমার। আমি ওনাকে শাড়ি দেখাতে বলেছি।’
‘কিন্তু আপনি তো চুজ করেননি। ভালোমতো দেখেননি পর্যন্ত। এখন কেন মিথ্যে বলছেন?’
অবাক হলো আদিয়ান। বুঝতে পারল, নওমী তাকে খেয়াল করেছিল। এত সহজে শাড়িটা দিবে না এবং কোনোমতেই হার মেনে নিবে না, ভেবে নিয়ে বলল,
‘কে বলেছে দেখিনি? দেখেছি, মনের চোখ দিয়ে। পছন্দও করেছি। এটা আমার।’
‘আপনি শাড়ি দিয়ে কী করবেন? পরবেন? না কি খাবেন?’
‘আমি পরব কেন? আমার বউ পরবে। এটা তো বউয়ের জন্য।’
নওমী হাত বাড়িয়ে জোরপূর্বক শাড়িটা কেড়ে নিতে চাইছিল, আদিয়ানের এই কথা শোনে কী ভেবে যেন হাত সরিয়ে নিল সে। বলল,
‘ওহ, ঠিক আছে। নিয়ে যান। এই শাড়িতে আপনার বউকে দারুণ মানাবে।’
ছোটো ছোটো চোখে তাকাল আদিয়ান। ভেতর ফাটা হাসি আটকে ঠোঁট চেপে বলল,
‘বলছেন?’
‘হুম…।’
‘আপনার কালো রং পছন্দ?’
উপরনিচ মাথা নেড়ে উত্তর দিল নওমী। আদিয়ান বলল,
‘তাহলে এটা আপনি রেখে দিন।’
‘না না, এটা আপনার স্ত্রীকেই দিন। আমি অন্যকিছু নিয়ে নেব।’
নওমী দোকানীকে বলে সেইম ডিজাইন ও রঙের আলাদা আরেকটা শাড়ি চাইল। অনেক খুঁজেও একই রঙের শাড়ি পেল না, তবে অন্য রঙের পেল। তা-ও আবার হলুদ ও গোলাপি। দেখেই নওমী বলল,
‘আরেহ্ এগুলো না। বেশি চকচক করছে। আমার সাথে মানাবেই না।’
দোকানী বলল,
‘কী করব আপা? এই ডিজাইনের তো আর নেই।’
‘তাহলে বাদ দিন। অন্যদিন নিব।’
ছোটো মেয়েটিকে কিনে দেয়া পোশাকের দাম মিটিয়ে শপিংমলের বাইরে এলো নওমী। আদিয়ান পিছনে থেকে হাসলো। শাড়িটা হাতে রেখে বিড়বিড়াল,
‘কে যে আমার বউ হবে, সেটাই তো জানি না মিস। তবে ভাগ্য যদি সহায় হয়, কোনো একদিন এই শাড়িতে আপনাকে দু’চোখ ভরে দেখার একবুক তৃষ্ণা নিয়েই সামনে দাঁড়াব। সেদিন আমায় ফিরিয়ে দিবেন না তো?’
***
ফুটপাত ধরে হেঁটে হেঁটে একটা চটপটির দোকানে এসে বসলো নওমী। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। শাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছিল। ছোটোবেলায় তার মায়ের শাড়ি পরে যখন বউ সাজত, তখন তিনি খুব প্রশংসা করতেন আর বলতেন,
‘মেয়েরা শাড়িতেই সুন্দর। তাদের অন্য পোশাকে যতটা সুন্দর লাগে, শাড়ি পরলে তারচে দ্বিগুণ সুন্দর লাগে।’
এই কারণে ভার্সিটির প্রোগ্রামে মাঝেমধ্যে শাড়ি পরে যেত নওমী। এ পর্যন্ত তার যতগুলো শাড়ি হয়েছে, সবগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ শাড়ি তার মাম্মি কিনে দিয়েছেন। সে নিজে পছন্দ করে খুব কম শাড়িই কিনেছে। সবসময় পরা হয় না বলে, কেনার ইচ্ছেও হয় না। আজ হঠাৎ কী হয়েছিল কে জানে, ওই শাড়িটা কিনে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল। তা তো আর হলো না, অকারণ মন খারাপ ভাবটাকে দূরে সরিয়ে খুব বেশি বোম্বাই মরিচসহ চটপটি অর্ডার করল সে। খেতে গিয়ে টুপটুপ করে চোখ থেকে পানি ঝরে পড়ল। ঝাল খুব একটা পছন্দ নয় নওমীর। তবে মাঝেমধ্যে যখন খুব বেশি কষ্ট পায়, তখনই নিজেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট দিতে অতিরিক্ত ঝাল খায়। সহ্যের বাইরে চলে গেলেও থামে না। একটানা দু’প্লেট ঝাল চটপটি খেয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল তার। ঠোঁট, নাক ও চোখ লাল হয়ে গেছে। তবুও একফোঁটা পানি মুখে দিচ্ছে না। হুট করেই পাশ থেকে আওয়াজ এলো,
‘আশ্চর্য! আপনি পানি খাচ্ছেন না কেন?’
এইবলে একটা পানির বোতল বাড়িয়ে দিল কেউ। নওমী চোখ তুলে তাকিয়ে সেদিনের সেই হেলমেটপরা ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। ছেলেটার দাঁড়ানোর ভঙ্গি, গলার আওয়াজ ও চোখের চশমা। সবকিছু দেখে, বুঝে ও চিনে বলল,
‘আপনি সেই লোকটা না, ওইদিন আমাদের বাসার সামনে গিয়েছিলেন?’
শুভ মাথা নেড়ে আলাদা চেয়ারে বসে বলল,
‘পানি খান আগে। আপনার সাথে জরুরী কিছু কথা আছে আমার।’
ঝালে মুখের অবস্থা খারাপ নওমীর। এরকম অবস্থায় কথা বলতে ভালো না লাগলেও লোকটার সন্দিহান আচরণটা বুঝতে চাইল সে। বোতল থেকে পানি নিয়ে মুখ পরিষ্কার করে, ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ভালোমতো মুখ মুছে নিয়ে বলল,
‘আমার সাথে আবার কী কথা? আমি তো আপনাকে চিনি না।’
‘জানি, চিনেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। এবং এই কয়েক মাস ধরে খুব ভালোমতো ফলো করছি। শুধু তাই নয়, আপনি কখন কোথায় যান, কী করেন, কার সাথে কথা বলেন, মেলামেশা করেন, সবটাই নোটিশ করেছি।’
কথাগুলো বড্ড হাস্যকর শুনালেও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল নওমী। ভূত দেখার মতো অবস্থা হলো তার। সে কি এত নামীদামী কেউ? কেউ কেন তাকে এতদিক থেকে নোটিশ করবে? বিশ্বাস হলো না। আচমকাই বড্ড হাসি পেল তার। আটকে রাখতে না পেরে একসময় মুখে হাত চেপে হেসেই ফেলল। বলল,
‘তাই না কি? কেন? আমাকে ফলো করার কারণ কী?’
শুভ জানে, চারপাশে জাহাঙ্গীরের লোকজন আছে। এরপর আবার জাদীদের পাঠানো পুলিশও আছে। এইমুহূর্তে সে যতটা ঝুঁকিতে, নওমী ততটাই নিরাপদে। কোনোমতেই জাহাঙ্গীরকে জিতে যেতে দিবে না বলেই ইমতিয়াজের শেখানো কথা ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘কেন আবার? আমি আপনাকে ভালোবাসি তাই। বিয়ে করবেন আমায়?’
মুহূর্তেই নওমীর দৃষ্টি পালটে গেল। একটু আগে যে চেহারায় হাসি ছিল, এখন তাতে রাগ দেখা গেল। এটাই স্বাভাবিক কিন্তু তবুও শুভ বলল,
‘রাগ করছেন কেন? ভালোবাসা কি খারাপ কিছু? আপনি কাউকে ভালোবাসেননি কোনোদিন?’
নওমী উত্তর দিল না। রাগত দৃষ্টিতেই চেয়ে রইল। শুভ বলল,
‘আচ্ছা বাদ দিন। আপনার আর কাউকে ভালোবাসার দরকার নেই। আপনি আমাকেই ভালোবাসুন। হবে না?’
মেজাজে জ্বালাময়ী আগুন নিয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠল নওমী। হাতে থাকা পানির বোতল শুভর কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
‘আপনি ভালোবেসেছেন তো আমি কী করব? আপনার ভালোবাসা নিয়ে আপনি স্বপ্নরাজ্যে ভাসুন। আমাকে এসব বলতে আসবেন না।’
‘কেন? আপনি কি প্রেম-ভালোবাসার বিরুদ্ধে?’
‘সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই। নেক্সট টাইম আমাকে আর ফলো করবেন না। এতে কিন্তু আপনারই ক্ষতি হবে।’
চেয়ারে ব্যাগ রেখে চটপটির টাকা পরিশোধ করল নওমী। ঝাল কমাতে একটা জুস কিনল। টাকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে আরেকদফা অবাক হলো। ছেলেটা নেই। আশ্চর্য! এরমধ্যেই গেল কোথায়? মনে প্রশ্ন নিয়ে চারিদিকে ভালোমতো চোখ বুলালো। কোথাও তার নজরে আর সেই ছেলেটা এলো না। ভ্যানিটিব্যাগটা পূণরায় হাতে তুলতে গিয়ে দেখল ব্যাগের তলায় একটা কাগজ। কৌতূহলী মনে সেটা হাতে তুলে ভাঁজ খুলে দেখল তাতে লেখা,
‘মাফ করবেন। আপনার সাথে এতক্ষণ ফান করছিলাম। আমি বিবাহিত। তবে একটা কথা সত্যি যে, গত কয়েক মাস ধরে আমি আপনাকে ফলো করছি। তার কারণ একটাই, জাহাঙ্গীরের হাত থেকে আপনাকে বাঁচানো। জানি না ওই লোকটার সাথে আপনাদের কী দ্বন্দ। সেই দ্বন্দের কারণে তাঁর একমাত্র টার্গেট হয়ে গেছেন আপনি। যেকোনোদিন আপনাকে মেরে ফেলবেন উনি। মনে আছে আপনার, ওইদিন ক্যাম্পাসে আদিয়ান ফারুকী আপনাকে টেনে সরিয়েছিল? ওইদিন যদি আমার বন্ধু আপনাকে না সরাতো, রাসেলের হাতে জীবন চলে যেত আপনার। তবে এইমুহূর্তে আপনার আর ভয়ের কিছু নেই। পুলিশ অফিসার জাদীদ ও তার সম্পূর্ণ ফোর্স আপনার সঙ্গে আছে সবসময়। এমনকি আমিও।’
এইটুকুর পর নিচে ছোট্ট করে লেখা, আরাফাত জামান শুভ। চিরকুটটি পরে আবারও চারপাশে তাকাল নওমী। চটপটির দোকানের সামনেই সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন লোককে দেখল। দু’জনেই আলাপে মশগুল। তবে তাদের কানে ব্লুটুথ। নিশ্চিত হলো, এরা পুলিশের লোক। দুঃশ্চিন্তায় মাথার ভেতর ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হলো। হাত বাড়িয়ে একটা রিকশা থামিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে। পিছনে দৃষ্টি দিয়ে দেখল, সাদা পোশাকের দু’জনেই বাইক নিয়ে তাকে ফলো করছে। মনে সন্দেহ ঢুকে গেল, বিড়বিড়াল,
‘এরা পুলিশ তো?’
তৎক্ষনাৎ জাদীদের নম্বরে ডায়াল করল। সেদিন তার বাপি এই নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, ‘রাস্তায় কোনো বিপদ-আপদ দেখলে এই নম্বরে কল কোরো। এটা ইন্সপেক্টর জাদীদের নম্বর।’ বাপির কথা মেনেই নম্বরটা ফোনে সেইভ করেছিল সে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই জানতে চাইল,
‘শুভ নামের কেউ একজন জানাল, জাহাঙ্গীর আমাকে মেরে ফেলতে চায়। প্রতিদিন না কি আমার ওপর নজরদারি করত সবাই। আপনি কি জানেন?’
ওপাশ থেকে জাদীদ বলল,
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম। সব জানি। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনার পিছনে আমাদের দু’জন লোক আছে। আপনি আপনার বাড়ির সীমানায় পা রাখার পর ওদের ডিউটি শেষ।’
‘ওহ।’
‘আপনার এ্যাক্সাম কবে?’
‘সামনের মাসে।’
‘ভালো একটা রেজাল্ট আনুন, ম্যাডাম। এই রেজাল্টের ওপরই নির্ভর করছে আপনার লন্ডনের ভিসা।’
পড়াশোনায় ভালো-খারাপ রেজাল্ট নিয়ে কোনোদিন কোনো মাথাব্যথা ছিল না নওমীর। কিন্তু এখন শুরু হলো। মন বলল, যেভাবেই হোক ভালো রেজাল্ট করতে হবে। বাঁচতে হবে তাকে। পালাতে হবে দেশ থেকে। তার আগে জানতে হবে, কে এই জাহাঙ্গীর? কেন তার ক্ষতি চায়? জাদীদকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিল নওমী। এরপর সম্পূর্ণ রাস্তা আনমনা হয়েই বাড়ি ফিরল।
***
চলবে…
এই সুরে কাছে দূরে | ই-বুক
⚫ খণ্ডাংশ –
-‘তুমি তো জানোই, ওর বাবার সম্পর্কে। আইনের চোখে যেহেতু একবার পড়েছে, এত সহজে মুক্তি পাবে না। যদি টাকার জোরে বেরিয়ে আসে, মেয়েটার ক্ষতি করবে। বলা যায় না, আমার সাথেও খারাপ ব্যবহার করতে পারে।’
নড়েচড়ে বসলো তাশদীদ। কী বলতে চান নয়নতারা? কোনো বিষয়ে সাহায্য লাগবে? সে গভীরচিত্তে চেয়ে রইল। নয়নতারা ফের বললেন,
-‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মেয়েকে নিয়ে ওই বাসায় আর উঠব না। এমনিতে আমার আত্মীয়স্বজন যারা আছে, তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। তাছাড়া আমি চাইছি না, কোনো খারাপ মানুষের কাছেপাশে থেকে জীবনের বাকি দিনগুলো অশান্তি ও যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে।’
-‘আমাকে কি করতে হবে, আন্টি?’
-‘এই বয়সে চাকরি খোঁজা হয়তো ঝামেলা। কোনো কর্ম না করলে কেউ যে দু’হাতে দান করবে এমন পরিস্থিতিও নেই। দানের টাকা দিয়ে আর কতদিন-ই বা চলা যায়? আমি চাইছি, ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন নিতে। সেই টাকা দিয়ে কোনো একটা কাজ করতে। এ ব্যাপারে তুমি যদি আমাকে সাহায্য করতে।’
নয়নতারার সমস্ত দুঃশ্চিন্তা দূর করে দিতে তাশদীদ বলল,
-‘আপনি টেনশন নিবেন না, আন্টি। আমি ব্যাংকে কথা বলে রাখব। আপনি কত টাকা লোন নিতে চান, সেটা জানাবেন।’
এই কথায় কিছুটা শান্তি ও মনের জোর পেলেন নয়নতারা। ফ্লাস্কে থাকা চা থেকে এক কাপ চা বাড়িয়ে দিলেন তাশদীদের দিকে। উশখুশ ভাব নিয়ে চা শেষ করল তাশদীদ। বিদায় নিয়ে চলে গেলে, অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
-‘সাহায্যের জন্য আর কাউকে পাওনি, তুমি? তাশদীদ শিকদারই কেন?’
মেয়ের কথায় খানিকটা রেগে গেলেন নয়নতারা। তবুও সেই রাগ প্রকাশ করলেন না। শুধু বললেন,
-‘জমের দুয়ার থেকে একবার যখন বেরিয়ে আসার সাহস করেছি, তখন আর মরে গেলেও ওখানে ফিরে যাব না। জীবনে বাঁচতে হলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। এগুলো কেউ ফ্রিতে দিবে না। ইনকাম করতে হবে। তোর বাবার পাপের টাকা আমার ব্যবসায় লাগাব না। এবার যা করব, নিজে করব। এখনও শরীরে শক্তি আছে। একটা না একটা উপায় ঠিকই হয়ে যাবে। তাছাড়া, আমি তো তাশদীদের কাছে টাকা চাইনি। সাহায্য চেয়েছি। ওর সেটা করার ক্ষমতা আছে। ব্যাংক এমনি এমনি তো ঋণ দেবে না।’
মায়ের যুক্তি ঠিক মেনে নিয়ে চুপ করে রইল মাহরীন। কিন্তু কোনোভাবেই মনকে শান্ত করতে পারল না। কেবলই একটা নাম, একটা অস্তিত্ব তার চোখের পর্দায় নেচে নেচে বেড়াল। ঠেলে সরাতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘তোমার যা খুশি তুমি তাই কোরো। আমাকে এসবে টেনো না। আমি কারও কাছে হাত পাততে পারব না।’
***
চলবে।