#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৮
সঙ্গে বেশকিছু পুরনো দৈনিক পত্রিকা ও গরম গরম এককাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে বাড়ির ছাদে এসেছে জাদীদ। বিকেলের শেষ সময়ে ঝিরিঝিরি বাতাসে শরীর ও মনকে চাঙ্গা করতে করতে কাজে ডুবে থাকার ইচ্ছেপোষণ থেকেই এখানে আসা। কিছুক্ষণ আগেই চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল। এখন আরামসে কফিতে চুমুক দিয়ে পত্রিকায় ছাপানো গুরুত্বপূর্ণ নিখোঁজ সংবাদটির দিকে দৃষ্টি নামিয়ে রাখল সে। সেদিন তোফাজ্জল হোসেন যখন জানিয়েছেন, আজ থেকে বহুবছর আগে এক শীতের সকালে জাহাঙ্গীর হোসেনের নামে একটা হারানোর বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়েছিলেন তিনি। সেই বিজ্ঞপ্তিটাই এখন তার হাতে। যেহেতু তাদের ঘরে জাহাঙ্গীরের অতীতের ও বর্তমানের কোনো ছবিই নেই, তা-ই জাহাঙ্গীরের মুখচ্ছবির জন্য এই দৈনিক পত্রিকাটা খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজন ছিল। এতদিন ধরে পত্রিকা অফিসে ঘুরতে ঘুরতে, পরিত্যক্ত জায়গা থেকে এই পত্রিকাটা খুঁজে বের করা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটি দেখছিল জাদীদ। দেখা শেষ হলে পরিচিত একজন আর্টিস্টের কাছে ছবিটা পাঠিয়ে দিল সে। ফোন দিয়ে প্রশ্ন করল,
‘এই ছবি ব্যবহার করে পঞ্চাশ বা ষাট বছর, এরকম কাছাকাছি বয়সে গিয়ে চেহারার কতটুকু পরিবর্তন হতে পারে, সেরকম কোনো পরিবর্তিত ছবি তৈরী করা যাবে?’
ওপাশ থেকে আর্টিস্ট বলল,
‘কাছাকাছি আর্ট করা যাবে। তবে সম্পূর্ণ হয়তো হবে না। আমরা জাস্ট একটা ধারণা নিয়ে ছবির কাজ শুরু করব।’
‘ওকে…। তুমি কয়েকটা ছবি তৈরী করবে, কয়েক ধরনের।’
‘ঠিক আছে। হয়ে যাবে।’
ফোন রেখে আবারও পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে, গভীরচিত্তে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল সে। রেলিঙের কাছ থেকে তখন দুটো মেয়ের গলার আওয়াজ এলো। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, রুমঝুম ও চার তলার সাত নম্বর ফ্ল্যাটের একটি মেয়ে। খুব ভাব হয়েছে দু’জনার। ইদানীং, দিনের বেশিরভাগ সময়ে একসাথে গল্প করতে ও আড্ডা দিতে দেখা যায় দু’জনকে। কাজে মনোযোগ থাকায় ওইদিকে আর বেশিক্ষণ তাকাল না জাদীদ। সময় অতিবাহিত হলো আরও কয়েক মিনিট। সন্ধ্যে হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগে সবকিছু গুছিয়ে নিচে নামতে গিয়ে আবারও রেলিঙে চোখ পড়লে দেখল, ওখানে রুমঝুম এখন একা। কারও সাথে ফোনে কথা বলছে মেয়েটা। আদুরে বাচ্চাটার গল্প শুনাচ্ছে। এরমধ্যেই রুমঝুম বলে উঠল,
‘আমি জানি, ও একদম তোমার মতো দেখতে হবে। আর ওর স্বভাব হবে আমার মতো।’
ওপাশ থেকে শুভ বলল,
‘কে বলেছে সন্তানরা মায়ের মতো হয়? ও তো আমার মতো হবে।’
রুমঝুম ক্ষ্যাপেটেপে বলল,
‘বললেই হলো। মায়ের বাচ্চা, মায়ের স্বভাব পাবে। বাবারটা নয়। তুমি হচ্ছ একটা স্বার্থপর মানুষ। আমার সন্তানকে আমি তোমার স্বভাবের হতে দিবই না।’
এরপর আরও কিছু হাস্যরসের কথা শুনাল শুভ। বলল,
‘আমাদের সন্তান এলেই দেখবে, ও কার মতো হয়েছে।’
রুমঝুম চোখমুখ শক্ত করে বলল,
‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল।’
‘আমার তো গোঁফ নেই। তেল দিব কোথায়?’
‘তোমার মাথায়।’
‘সে তো রোজ দিই। নয়তো চুল পড়ে যাবে না?’
‘পড়ে যাক চুল। ন্যাড়া হয়ে যাও একেবারে। শেষে তোমার বাচ্চা তোমাকে ন্যাড়াবাবা বলে ডাকবে।’
ওপাশে শুভ শব্দ করে হেসে উঠল। এপাশে রুমঝুমও হাসলো। বলল,
‘তুমি কবে আসবে?’
‘সময় পেলেই আসব। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।’
এরমধ্যেই চঞ্চল বাচ্চাটা পেটের ভেতর নড়েচড়ে উঠল। অস্ফুটস্বরে একটু আর্তনাদ করল রুমঝুম। সঙ্গে সঙ্গে হাত রাখল পেটে। আদুরে বাচ্চাটাকে স্পর্শ দিয়ে ছুঁয়ে দিল যেন। কণ্ঠে একরাঁশ আবেগ-অনুভূতি মিশিয়ে বলল,
‘পুচকু তোমাকে দেখতে চাইছে, শুভ।’
‘তাই? শীঘ্রই দেখবে।’
‘একটু তাড়াতাড়ি এসো প্লিজ। আমরা দু’জনেই তোমাকে মিস করছি।’
আরও টুকটাক ভাব-ভালোবাসা বিনিময় করে ফোন রেখে দিল রুমঝুম। পাশ ফিরিয়ে পা ফেলতে গিয়ে জাদীদের মুখোমুখি পড়ে গেল। ছেলেটা বুকের মাঝখানে হাত বেঁধে স্থিরচোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন ভয় লাগল রুমঝুমের। কিছু বলার আগেই জাদীদ বলল,
‘একসাথে দু নৌকায় পা দিয়ে চলছেন?’
কথাগুলো শোনার ইচ্ছে ছিল না জাদীদের। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কানে চলে এসেছে। এই বিল্ডিংয়ের সবাই সৎ, নির্ভীক। নিজেদের ও নিজেদের পরিবার নিয়ে প্রত্যেকেই ভীষণ বিশুদ্ধ মনোভাবাপন্ন আচরণের অধিকারী। পরকীয়াকারী ও চরিত্রহীনের জায়গা এখানে নয়। রুমঝুমের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে শক্তকণ্ঠে জাদীদ বলল,
‘বাচ্চাটা আসলে কার? আদিয়ানের না কি শুভর?’
ভয়ে ঢোক গিলল রুমঝুম। এখন উপায় কী? সব শোনে ফেলল এই লোক? সে কেন আরেকটু সতর্ক হলো না? এই শুভর সাথে কথা বলতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। কোনোদিকেই আর হুঁশ থাকে না। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবছিল রুমঝুম। জাদীদ ফের বলল,
‘আপনার স্বামী ফিরলে বলবেন, এই বিল্ডিংয়ের সবারই মান-সম্মান আছে। এখানে কোনো চরিত্রহীনাকে থাকতে দেয়া হয় না। দু’দিনের মধ্যে বাসা ছাড়বেন।’
রুমঝুম শুধু হাসলো। কেন যেন জাদীদের ভুল ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। মিথ্যে তো তারা বলেছে, মানুষগুলোকে ঠকিয়েছে, বোকা বানিয়েছে। এখন এই কলঙ্ক লাগলে, তাদেরই বা দোষ কোথায়? যতটুকু ভয় মনে বাসা বেঁধেছিল, সেটুকুও মুছে গেল এখন। এই কথার পরেও রুমঝুমের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। জাদীদ অবাক হয়ে বলল,
‘আপনি শুনেছেন তো আমার কথা?’
‘জি শুনেছি।’
‘তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনাকে দু’চোখে দেখাও পাপ।’
দুশ্চরিত্রা শব্দটা নিজের চরিত্রের সাথে লেগে গেলেও খারাপ লাগল না রুমঝুমের। কিন্তু এখনকার কথায় ভেতর কেমন জ্বালা করে উঠল। এমন কি ভুল করেছে সে, যার জন্য তার চেহারা দেখাও কারও কাছে পাপ সমতুল্য? কষ্ট পেলেও সেটাকে প্রকাশ করল না রুমঝুম। শুধু বলল,
‘কলঙ্ক কিন্তু মানুষের চেহারায় লেখা থাকে না।’
‘অথচ একটা মানুষের গোটা অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে। সুন্দর চেহারা দিয়ে তো আর পাপ ঢাকা যায় না।’
কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না রুমঝুমের। প্রতুত্তরে শুধু একটু হেসে নিচে নেমে এলো। জাদীদ দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। চোখ দিয়ে আগুন বের হলো। কী জঘন্য! দোষ করে আবার গলা উঁচিয়ে কথা বলতে আসে। আফসোস, এতদিন এমন মানুষকে সে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে এসেছে।
***
আদিয়ান টিউশনিতে ছিল। বিকেলের পুরো ঘটনা ফোন করে তাকে জানাল রুমঝুম। সেই থেকে টেনশনে দিশেহারা অবস্থা তার। এইমুহূর্তে নতুন বাসা কীভাবে ম্যানেজ হবে? জাদীদ যেভাবে বিষয়টা ভেবেছে, তাতে তার রি’অ্যাক্ট করাটা স্বাভাবিক। যে কেউ শুনলে এইভাবেই রি’অ্যাক্ট করবে, কথা শুনাবে। কিন্তু এখন, তার কী করা উচিত? পড়ানো শেষ হলে রাস্তায় এসে আশেপাশের বেশকিছু অ্যাপার্টমেন্ট চেক করল সে। কয়েকদিন আগে এখানকার একটা বাসায় ‘টু লেট’ লেখা দেখেছিলেন। মনে পড়াতে সেদিকেই গেল। লেখাটা আজও আছে। সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইল না আদিয়ান। ভেতরে প্রবেশ করে বাড়িওয়ালার খোঁজ করলে একটি মেয়ে বাইরে এসে তাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিল। ভেতরে গেলে একজন ষাটোর্ধ ব্যক্তি ড্রয়িংরুমে এলে আদিয়ান তাকে সালাম দিল। কুশল বিনিময় করে বাসাভাড়া সম্পর্কে যাবতীয় আলাপ-আলোচনা শুরু করল। বলল,
‘আংকেল, ইমিডিয়েট আমার একটা থাকার জায়গার দরকার। ভাড়া আপনি যা চাইবেন, তা-ই দিব। আমরা দু’জন মাত্র। আমি এবং আমার ছোটোবোন।’
মোজাম্মেল হক্ব বললেন,
‘আগে যে বাসায় ছিলে ছাড়ছ কেন?’
‘আমার বোনের ভার্সিটিটা এখান থেকে কাছে। আর ও একটু অসুস্থ। দূরের রাস্তায় প্রতিদিন জার্নি করে ক্যাম্পাসে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই।’
‘বাবা-মা কেউ নেই?’
‘আমার বাবা নেই। ছোটোবেলাতেই মারা গেছেন। মা আছেন। নরসিংদীতে মামার কাছে থাকেন।’
‘ওহ, ঠিক আছে। চলে এসো তোমার বোনকে নিয়ে।’
এখানে ব্যাচেলর, ফ্যামিলি কোনো রুলস্ নেই। যার কারণে হুটহাট সময়ে আশ্চর্যজনকভাবে এই বাসাটা পেয়ে গেল আদিয়ান। বাড়িওয়ালার মেয়েটি চা নিয়ে এলে, চা খেয়ে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরল সে। ফিরেই দেখল, রুমঝুমের চোখমুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই ওই কথাগুলোর জন্যই এতক্ষণ কেঁদেছে। তাকে দেখেই রুমঝুম বলল,
‘বাসা পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি। কালকেই যাব।’
‘সত্যিই?’
‘হুম…।’
অনেকক্ষণ পর রুমঝুমের ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি ফুটে উঠল। দরজা আটকে বলল,
‘তখন যে কী খারাপ লেগেছিল আমার, বলে বুঝাতে পারব না।’
‘ভুলটা আমাদেরই। আমরাই মিথ্যে বলেছিলাম। যাইহোক, এসব নিয়ে আর মন খারাপ করিস না। এখন সবকিছু গুছিয়ে নে। কাল সকালেই রওনা দিব।’
‘ওখানে কী বলেছ?’
‘সত্যি কথাই বলেছি।’
রুমঝুম নির্ভার হেসে প্রথমে রাতের খাবার সাজাল। দুই ভাই-বোন মিলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে যখন মালপত্র গুছাচ্ছিল, তখুনি কলিংবেল বেজে উঠল। আদিয়ান দরজা খুলে দেখল, জাদীদ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে প্রবেশ করে সবকিছু এলোমেলো দেখে অবাক হয়ে জাদীদ বলল,
‘মালপত্র এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কেন?’
আদিয়ান বলল,
‘ভালোই হয়েছে, এখন এসেছ। নয়তো একটু পর আমি-ই যেতাম।’
‘কেন?’
‘নতুন বাসা পেয়েছি। কালকে চলে যাচ্ছি।’
‘কী বলছ? হঠাৎই? আগে কিছু বলোনি কেন?’
কাজের চাপে বিকেলের কথা ভুলেই গিয়েছিল জাদীদ। এখন এই কথা বলে, ওদের মালপত্র সব এলোমেলো দেখে সব কথা মনে পড়ে গেল তার। দৃষ্টি ঘুরিয়ে রুমঝুমকে একনজর দেখে বলল,
‘আমিই বোধহয় ঝামেলাটা তৈরী করেছি। আসলে তখন…।’
আদিয়ান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ভুলটা তোমার নয়। তুমি যা করেছ, ঠিকই করেছ। ভুল আমাদের। শুধু মিথ্যেই বলিনি, দিনের পর দিন তোমাদের সরলতার সুযোগ নিয়েছি।’
জাদীদ থমকে থাকা দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘কী বলছ?’
‘হ্যাঁ…। সত্যি এটাই যে, আমরা স্বামী-স্ত্রী নই। কাজিন। ওর সিচুয়েশনটার জন্য আমি-ই দায়ী। অসময়ে প্রেগন্যান্সি ও মামার জোরাজুরি, সবমিলিয়ে মনে হলো, একটা ছোট্ট মিথ্যে ঝুম ও ওর বাচ্চাকে বদমানের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। তা-ই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো আমাদের। শুধু বাড়িতেই নয়, এখানেও। তুমি তো জানোই, ব্যাচেলর ভাড়ায় কতশত সমস্যা। এরমধ্যে আবার ফ্যামিলি ছাড়া বাসাভাড়া পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে আমরা মিথ্যে বলেছি। ওর এই সিচুয়েশনে কোথায় যাব, কোথায় থাকব, পাগলপ্রায় অবস্থা হয়েছিল আমার। পারলে আমাদের এই ভুলটা ক্ষমা করে দিও।’
আশ্চর্যজনক মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল জাদীদ। সব কথা শোনে বলল,
‘তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রী না হও, তাহলে রুমঝুমের স্বামী কে?’
‘শুভ। যার সাথে ফোনে কথা বলতে দেখে তোমার ধারণা হয়েছিল, ও পরকীয়া করছে।’
রুমঝুম একমনে কাজ করছে। জাদীদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ওরা যে কথা বলছে, সেটুকুও শুনছে না। কাজ দেখিয়ে নিজেকে এই জটিল ও লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে সরিয়ে নিয়েছে। তার এই এড়িয়ে চলাটা ঠিকই বুঝতে পারল জাদীদ। মনের কোথাও কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা ও অনুশোচনা জন্মাল। রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি খুব দুঃখিত, রুমঝুম। তখন ওভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি।’
ক্ষমা চাওয়ার কথা শোনে স্থিরচোখে একবার তাকিয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুমঝুম। জাদীদ দাঁড়িয়ে থেকে আদিয়ানকে বলল,
‘এখানেই থেকে যাও, প্লিজ।’
তৎক্ষনাৎ রুমঝুম বলল,
‘সেটা আর সম্ভব নয়, জাদীদ ভাইয়া। ওই বাসায় কথাবার্তা ফাইনাল হয়ে গেছে।’
‘আমার কথায় রাগ করে চলে যাচ্ছ তোমরা।’
‘ঠিক তা নয়। তবে যাওয়াটা উচিত মনে হচ্ছে। কারণ আমাকে দেখলে আবার কারও নেকির পাল্লা হালকা হয়ে যেতে পারে। একজন নেককার বান্দাকে কী করে পাপী বানাই বলুন তো?’
‘তখন সিচুয়েশনটা অন্যরকম ছিল, রুমঝুম।’
‘যেমনই হোক, আপনি খারাপ ও অযৌক্তিক কিছু বলেননি। আসলেই তো, পাপী মানুষের চেহারা দেখাও পাপ। আমি এমন কেউ নই যে, আমাকে আপনার দেখতেই হবে।’
রুমঝুম এতো কথা কবে শিখল? আদিয়ান তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। যখন দু’জনের কথাবার্তা ঝগড়ার দিকে টার্ণ করার সম্ভাবনা দেখল, তখুনি বলল,
‘এক টপিক নিয়ে পড়ে আছো কেন তোমরা? বাদ দাও। এ্যাই ঝুম, যা তো, তুই তোর কাজ কর।’
রুমঝুম দাঁড়াল আর না। চলেই গেল। জাদীদকে বসতে বলে তারজন্য এক কাপ চা তৈরী করল আদিয়ান। হাত বাড়িয়ে কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। মাথার স্ক্রু সব ঢিলে হয়ে গেছে তো, তাই উল্টাপাল্টা বকছে।’
জাদীদ কোনো উত্তর দিল না। নিশ্চুপে চায়ে চুমুক দিল। আদিয়ান বলল,
‘কেইস নিয়ে যত ইনফরমেশন তোমার দরকার পড়বে, সবকিছুতে শুভ তোমাকে হেল্প করবে। এই নিয়ে কোনো টেনশন কোরো না তুমি।’
***
নতুন বাসায় আসবাবপত্র টেনে তুলছিল আদিয়ান। তাকে এই কাজে সাহায্য করছিল, এই বাসার দারোয়ান। সবকিছু সাজানো-গোছানো শেষ। এবার ওয়ারড্রব টেনে নিচ্ছিল দু’জনে। এই অ্যাপার্টমেন্টে লিফটের কাজ চলছে সবে। এখনও ঠিকঠাক হয়নি। সিঁড়ি দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। পিছন দিকে পা দিয়ে উপরের দিকে উঠছিল আদিয়ান। এতটাই বেখেয়ালি ছিল যে, উল্টোদিক থেকে কেউ আসছে কি না দেখেনি। যে মুহূর্তে ধাক্কা লাগবে, নওমী চেঁচিয়ে উঠে সামনে থাকা ব্যক্তিটির পিছনে হাত রেখে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আরেহ্ সাবধানে। মানুষ মেরে ফেলছেন তো। দেখে কাজ করুন।’
পিঠে হাত পড়তেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আদিয়ান। নওমীর গলার আওয়াজ শোনে ভেবেছিল মনের ভুল। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে তো সে অবাক। এই মেয়েটা এখানেও? সে কিছু বলার আগেই নওমী বলল,
‘আপনি! এই বাসায়।’
‘জি, আজই এসেছি।’
ঝটপট উত্তর দিয়ে নওমীকে পাশ কাটিয়ে ওয়ারড্রব নিয়ে চলে গেল আদিয়ান। এরমধ্যেই বান্ধবীকে আটকাতে ছুটে এলো মৌমি। তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বলল,
‘কী রে, আয় ভেতরে। যাস না প্লিজ। সোনা দোস্ত।’
মৌমি ভার্সিটি যাবে না। কেন যাবে না, এটা জানতেই এসেছিল নওমী। এদিকে দুটো ক্লাস অলরেডি মিস হয়ে গেছে। সামনে এ্যাক্সাম। এরপর আবার আইইএলটিএস’এর এ্যাক্সাম। সবমিলিয়ে মাথার ভেতর শুধু পড়া আর পড়া। এখন চলতে পথে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে নওমী। এ-ও খেয়াল রাখে, আশেপাশে পুলিশের লোকজন আছে কি না। দু’জন তো নিয়মিতই থাকে। পাহারায় রাখে। অথচ সামনে এসে কিছু বলে না। দূর থেকেই চোখে চোখে রাখে। সে এখানে আসার পর, জাদীদও দু’জনকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওরা নিচেই আছে। বের না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে। নওমীর তাড়া ছিল। চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে বলল,
‘তোদের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে?’
‘হ্যাঁ, পাঁচ তলায়। কেন?’
‘ওরা কারা জানিস?’
‘তা জানি না। বলেছে তো মামাতো-ফুপাতো কাজিন। ওদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী।’
‘কী? কাজিন?’
নওমী যেন আকাশ থেকে পড়ল। চেহারায় এত বিস্ময় নেমে এলো যে, মুখটা হা হয়ে গেল তার। বিস্ময় ধরে রেখে জানতে চাইল,
‘ওরা স্বামী-স্ত্রী না?’
‘দূর মাথামোটা। স্বামী-স্ত্রী হলে তো বলতোই। রুমঝুম নামের মেয়েটার সাথে কথা হয়েছে আমার। বলেছে, তার স্বামীর নাম শুভ।’
‘ওহ।’
ঠোঁট গোল করে শুধু এই শব্দটাই উচ্চারণ করল নওমী। চিরকুট রেখে যাওয়া সেদিনের সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ল। নাম বলেছিল শুভ, এ-ও বলেছিল, সে আদিয়ানের বন্ধু। হঠাৎ করে খেয়াল করল, তার সব তাড়া ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে। আনমনেই কিছু একটা ভাবছিল সে। ফের মনে পড়ল, সেদিন ক্যাম্পাসে আদিয়ান তাকে বাঁচিয়েছিল, বিনিময়ে তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি, উলটে বকাঝকা দিয়ে আহত করেছে। আচানক এই সুযোগ চলে আসাতে ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরল সে। বলল,
‘আজ ভার্সিটি যাওয়া ক্যান্সেল। চল, তোদের নতুন ভাড়াটিয়ার সাথে ভাব জমিয়ে আসি।’
মৌমি অবাক হয়ে বলল,
‘এতক্ষণ তো খুব বললি, ক্লাস আছে ক্লাস আছে। এখন ক্লাস নাই হয়ে গেল?’
নওমী বান্ধবীর গালে একটা চিমটি দিয়ে বলল,
‘তুই বুঝবি না রে। ক’দিন ধরে অদৃশ্য এক যন্ত্রণা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল। অথচ এখন, মনে হচ্ছে সেটা আর নেই। এর কারণ তো জানতেই হবে। নয়তো শান্তি পাব না।’
‘তোর কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলাম না আমি।’
‘বুঝতে হবে না। আয় আমার সাথে।’
দুই বান্ধবী সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠল। পাশ দিয়ে সেই সময় আবারও নিচে নামল আদিয়ান। ড্রাইভারের ভাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যেই নিচে আসা। তাকে নেমে যেতে দেখেও ফ্ল্যাটের ভেতরে পা রাখল নওমী। দরজা খোলাই ছিল। অসুস্থ শরীর নিয়ে ধীরপায়ে রুম ঝাড়ু দিচ্ছিল রুমঝুম। হঠাৎ করে নওমীকে দেখে চমকে গিয়ে বলল,
‘আরেহ্ আপু, আপনি! কেমন আছেন?’
নওমী হেসে হেসে বলল,
‘আমি তো খুব ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তোমাকে তুমি করে বলছি, রাগ করছ না তো?’
ঝটপট দু’দিকে মাথা নেড়ে নওমীকে জড়িয়ে ধরল রুমঝুম। বলল,
‘একদমই না। বয়সে আমি আপনার ছোটোই হব। আপনি-আজ্ঞে না করলেও চলবে। বসুন আপনারা।’
দু’জনকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে রুমঝুম জানতে চাইল,
‘আপনি এখানেই থাকেন, আপু?’
‘না না, এটা আমার বান্ধবীর বাসা। আজ তো ক্লাসে যাইনি। ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি।’
‘কেন?’
নওমী বান্ধবীর মাথায় ঠোকা মেরে বলল,
‘এই ফাঁকিবাজটার জন্য।’
মৌমি অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। খিটমিটিয়ে থাকাল বান্ধবীর দিকে। দৃষ্টিটা আমলেই নিল না নওমী। রুমঝুম বলল,
‘আপনারা বসুন, আমি একটু আসছি।’
এখনও হাতের কাজ বাকি। রান্নাবান্না কিচ্ছু হয়নি। এই দুই মেহমানকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করাবে ভেবে পেল না রুমঝুম। হঠাৎ খেয়াল হলো মিটসেফে অরেঞ্জ ট্যাং আছে। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে দু’জনের জন্য আপাতত জুস তৈরী করল সে। একটা ছোটো নাশতার প্লেটে চানাচুর ঢেলে নিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে চলে এলো। বাইরের যাবতীয় ঝামেলা মিটিয়ে ঘরে এলো আদিয়ান। দরজায় পা রেখেই রুমঝুমকে ডেকে বলল,
‘এ্যাই ঝুম, এখন আর কিছু রান্না করিস না। অসুস্থ হয়ে পড়বি। কী খাবি বল, আমি নিচে থেকে নিয়ে আসছি।’
বলতে বলতে চোখ ফেলল ড্রয়িংরুমে। মৌমির সাথে অন্যজনকে দেখে একটু অবাকই হলো। রুমঝুম কী খেতে চায়, আপাতত সেটা দেখা জরুরী। তা-ই সে রুমঝুমের জবাবের অপেক্ষায় রইল। বেশিকিছু খেতে চাইল না রুমঝুম। বাইরের খাবার খুব কম খায় সে। উপায় নেই বলেই মাঝেমধ্যে খায়। তাই অল্পকিছু পছন্দের খাবার আনতে বলে, ঘরে প্রয়োজনীয় আর কী কী লাগবে সেটা চেক করতেই রান্নাঘরে দৌড় দিল সে। আদিয়ান ডাইনিং থেকে একগ্লাস পানি খেল। না চাইতেও চোখ পড়ল নওমীর দিকে। নওমী কেমন করে যেন হাসলো। বোকা বোকা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে বিষম খেল সে। শুনল নওমীর গলা। মেয়েটি হঠাৎ করেই তাকে চমকে দিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’
অসময়ে এই থ্যাংকস’এর কারণ বুঝল না আদিয়ান। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নওমী বলল,
‘সেদিন আমাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলেন বলে।’
বুঝতে পেরে হাসলো আদিয়ান নিজেও। কৌতুকের সুরে বলল,
‘সেদিন তো কেউ ইচ্ছেমতো গালিবকা দিয়েছিল।’
আলতো করে কানে হাত ছুঁয়ে নওমী বলল,
‘স্যরি।’
‘আমিও স্যরি।’
‘কেন?’
‘আপনার স্যরিটা গ্রহণ করতে পারলাম না বলে।’
‘এটা কেমন কথা?’
‘জি, এটাই কথা। শুধু স্যরিতেই মানব না। আমার যা লস হয়েছে, সেটার ক্ষতিপূরণ দিলে তারপর স্যরি গ্রহণ করব।’
নওমী হতবাক হয়ে সামনে এসে বলল,
‘কী ক্ষতি হয়েছে?’
দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আদিয়ান বলল,
‘বিনা অপরাধে কয়েকফোঁটা রক্ত ঝরেছিল। কিছু রক্ত শরীর থেকে আর কিছু…।’
কথার মাঝখানে থেমে গেল আদিয়ান। হুঁশ হারিয়ে কী বলতে যাচ্ছিল সে? মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল তার? মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে কথা এড়িয়ে রুমঝুমকে ডাকল,
‘এ্যাই ঝুম, দেরী হচ্ছে আমার। তাড়াতাড়ি আয়।’
নওমী নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। কী বলতে গিয়ে থেমে গেল ছেলেটা? কেন থামল? কথাটা সম্পূর্ণ করল না কেন? সে কি ইচ্ছে করে রক্ত ঝরিয়েছে? ওটা তো অনিচ্ছাকৃত ছিল। হুট করে যদি বিব্রতকর পরিস্থিতি সামনে এসে দাঁড়ায়, যে কেউ রি’অ্যাক্ট করবে। সে-ও করেছে। অনুতপ্ত হয়ে এখন ক্ষমাও চাইছে। তাতেও হচ্ছে না। কেন?
***
চলবে…
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১৯
মাজেদা খাতুন খুব অভিমান করেছিলেন রুমঝুমের ওপর। হুট করে দু’জনের এইভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি তিনি এবং সত্যিটা জেনে খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তাই প্রথম কয়েকদিন অভিমান দেখিয়ে চললেও সপ্তাহ পেরোনোর পর তিনি নিজেই রুমঝুমকে দেখতে নতুন বাসায় চলে এলেন। জাদীদ মাকে নামিয়ে দিয়ে ডিউটিতে চলে গেছে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে ফ্ল্যাটে এসে বেল চাপতেই ডোর খুলে চমকে গেল রুমঝুম। কতক্ষণ শূণ্য দৃষ্টিতে মা ও মেয়ের মান-অভিমান চলল। রক্তের সম্পর্ক না হলেও গত কয়েকমাসে এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে রুমঝুমের যে আত্মার সম্পর্ক তৈরী হয়েছে সেটাকে সে অস্বীকার করতে পারছে না। কোনোদিন পারবেও না। তা-ই শত অভিমান, দুঃখ-কষ্ট মনে আগলে নিয়েও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে অনুশোচনার স্বরে বলল,
‘আমায় ক্ষমা করে দাও, আন্টি।’
মাজেদা খাতুন মুখভরা হাসি নিয়ে বললেন,
‘আমার নাতি-নাতনীদের কেউ একজন যদি আমার কাছে ক্ষমা চায়, তাহলেই ক্ষমা করব। এর আগে নয়।’
‘তাহলে আমাকে দেখতে এসেছ কেন?’
‘মন পুড়ছে যে। এইজন্য।’
‘আমি তো তোমার কেউ না। কেন আসবে তুমি এখানে?’
‘বারে, কেউ না বললেই হলো? তোকে আমি পেটে না ধরলেও আত্মার সাথে বেঁধে নিয়েছি রে মা, তাই না এসে থাকতে পারলাম না।’
ভদ্রমহিলার কথা শোনে রুমঝুমের মুখেও হাসি নেমে এলো। হাত ধরে তাকে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। বসতে বলে হঠাৎ খেয়াল হতেই বলল,
‘তুমি ঠিকানা পেলে কোথায়?’
‘আদিয়ান চোরা দিয়েছে। মিথ্যুকটা কোথায় এখন? ডাক দে দেখি।’
মাজেদা খাতুনের গলার আওয়াজ শোনে রুমে টিকে থাকতে পারল না আদিয়ান। সামনে এসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার আগেই ভদ্রমহিলা খুব শক্ত করে তার কান মলে দিয়ে বললেন,
‘আর জীবনে মিথ্যে বলবি?’
দুটো হাত জোর করে আদিয়ান বলল,
‘আন্টি, ছেড়ে দাও। ব্যথা পাচ্ছি।’
‘শুধু তো কানমলা দিলাম। তোদেরকে এরচেয়ে বড়ো শাস্তি দেয়া উচিত মনে হচ্ছে।’
কান ছাড়তেই আহ্লাদী হয়ে ভদ্রমহিলার গলা জড়িয়ে ধরে আদিয়ান বলল,
‘তোমরা মায়েরা এত কঠিন মনের হও কী করে বোলো তো? আজ কতদিন হয়েছে জানো, আম্মি ঠিকঠাক কথা বলে না? আমরা না হয় ভুল করে ফেলেছি, তাইবলে ফোন দিলে সেটা ধরবে না? ধরলেও কথা বলবে না? এ কেমন রাগ-অভিমান ও শাস্তি আন্টি?’
মাজেদা খাতুনের মনটা খারাপ হয়ে এলো। তিনি সোফাতে বসে আস্তেধীরে বললেন,
‘তুমি বরং কয়েকটাদিন ওখানে গিয়ে থেকে এসো।’
‘সেটা কী করে হয়, আন্টি? ঝুমকে একা ফেলে যেতে পারব না। এদিকে ছাত্রছাত্রীদের এ্যাক্সাম সামনে। ওদের পড়াশোনার চাপ। এইমুহূর্তে দুটোদিন টিউশনি বন্ধ দেয়া মানে ওদের মনের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দেয়া।’
‘তাহলে কী করবে? মায়ের রাগ তো ভাঙাতে হবে, না কি?’
‘সেটাই তো ভাবছি, আন্টি। কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।’
ভারী শরীর নিয়ে টুকটুক করে মাজেদা খাতুনের জন্য চা তৈরী করল রুমঝুম। আদিয়ান চলে গেল বাইরে। শীত পড়তে শুরু করেছে। ঝুমের জন্য কিছু শীতের কাপড়চোপড় কেনা দরকার। সে বের হওয়ার পর মাজেদা খাতুনকে নিয়ে গল্পের আসর জমাল রুমঝুম। গল্পের ফাঁকে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হলো। পুরোদিন শেষ হলো কোনদিক দিয়ে কেউ টেরই পেল না। আসরের পর আবারও কলিংবেলের আওয়াজ এলো। রুমঝুম ভাবল, আদিয়ান এসেছে। কিন্তু না। তার ধারণাকে ভুল প্রমান করে দিল দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘মা কোথায়?’
রুমঝুম কিছু বলল না। সামান্য সরে এসে ভেতরের রুমটা দেখাল। ভদ্রমহিলা এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। জাদীদের যথেষ্ট তাড়া। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে ভেবেছিল, মাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ডিউটিতে চলে যাবে। এই কয়েকটাদিন রুমঝুমের জন্য কী যে ছটফট করেছিলেন তিনি, সেটা তো জাদীদ নিজে দেখেছে। এখন এত নিশ্চিন্তমনে ঘুমাতে দেখে জাগাতে ইচ্ছে হলো না। কিন্তু উপায় নেই। ডিউটি বাকি। অনেক ছোটাছুটি বাকি। সে অসহায় চোখে রুমঝুমকে বলল,
‘মাকে একটু ডেকে দিবে?’
বয়সে ছোটো হওয়ায় রুমঝুমকে তুমি বলেই সম্বোধন করে জাদীদ। প্রথম কয়েকদিন আপনি-আজ্ঞে করলেও এরপর আর কেন যেন আপনিটা আসেনি। আদিয়ানের সাথে তুমিতে নেমে সম্পর্কটা সহজ হয়ে যাওয়াতে রুমঝুমের ক্ষেত্রেও সেটা তুমি হয়ে গেল। শান্ত কথার এই অনুরোধ শোনে ঘাড় নেড়ে রুমঝুম বলল,
‘আপনি বসুন, আমি আন্টিকে ডেকে দিচ্ছি।’
রুমঝুম এখনও রেগে আছে সেটা তার কথাবার্তাতেই স্পষ্ট বুঝে নিতে পারল জাদীদ। কিছু মেয়েরা এত রাগী ও অভিমানী কেন হয় আজও তার উত্তর জানে না সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ড্রয়িংরুমে এসে বসতে হলো তাকে। মাজেদা খাতুনকে ডেকে জাদীদের জন্যও চা তৈরী করল রুমঝুম। চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলে জাদীদ বলল,
‘এখনও রেগে আছো?’
কেমন যেন শুনাল কথাটা। রুমঝুম শুধু একটু হেসে বলল,
‘আমি যার-তার ওপর রাগ করি না।’
‘ওয়েল…। যদি সেটা না-ই হয়, আমি রিকুয়েস্ট করার পরও চলে এলে কেন? ওখানেই তো থাকতে পারতে।’
‘উত্তরটা তো সেদিনই জানিয়েছি। আমি চাই না আমার জন্য কারও নেকীর পাল্লা হালকা হয়ে যাক। আমরা যারা অপরাধী, পাপী, তারা তো খুব খারাপ ও ছোঁয়াছে হই। এজন্য আমাদের আশেপাশে যে বা যারা আসে, তারাও একইরকম হয়ে যায়।’
‘তুমি আমার একটা কথাই ধরে বসে আছো।’
‘ফেলে দেয়ার মতো কথা ছিল না ওটা, তাই মনে গেঁথে আছে আরকি।’
‘এটা সামান্য একটা কথা। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এমনটাই ভাবত। হুট করে তো কোনোকিছু বোঝা যায় না, তাই না? সন্দেহটা এসেই যায়।’
‘কিছু মানুষের কিছু কথা আপনার কলিজায় এমনভাবে আঘাত করবে, মুহূর্তেই আপনি টের পাবেন, ঠিক ততখানি রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে আপনার কলিজা খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেছে। অথচ…। থাক… বাদ দিন। এটা এমন সিরিয়াস কিছু না।’
ঝটপট কথা গিলে নিল রুমঝুম। ফ্রেশ হয়ে বোরখা পরে বাইরে এলেন মাজেদা খাতুন। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তোকে বলেছিলাম না, এই মেয়েটা আমার নিজের মেয়ের মতোই? দেখলি তো, ওর কাছে আসাতে কত শান্তি পেলাম আজকে।’
মায়ের কথা শোনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জাদীদ। সম্পূর্ণ চা আর শেষ করার আগ্রহ পেল না। কাপ রেখে উঠে দাঁড়িয়ে রুমঝুমকে বলল,
‘মা যদি মাঝেমধ্যে আসেন, তুমি বিরক্ত হবে?’
রুমঝুম বলল,
‘সেকী, না না, বিরক্ত কেন হব? আন্টি আসলে আমার নিজেরও অনেক ভালো লাগবে। সময় পেলে আমি নিজেই হয়তো আন্টিকে দেখতে যেতাম।’
এ পর্যায়ে জাদীদ বলল,
‘সময় পেলে সত্যিই যাবে?’
রুমঝুম একটু থমকাল। পরক্ষণেই জাদীদের কথার মানে বুঝতে পেরে একা একাই হাসল। ও বাসায় আর পা ফেলবে না কোনোদিন। প্রয়োজনে না, অপ্রয়োজনে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সে কথা এড়িয়ে গিয়ে মাজেদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দিয়ে বলল,
‘যখনই সময় পাবে, চলে এসো তুমি। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।’
***
সেদিনের সেই ছবি নিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়েছিল জাদীদ। যেহেতু জাহাঙ্গীর হোসেন দীর্ঘদিন অ্যামেরিকাতে ছিলেন, কবে তিনি দেশ ছেড়েছেন এবং কত তারিখে ফিরে এসেছিলেন, এই নির্দিষ্ট তথ্যের প্রয়োজন ছিল তার। আর্টিস্ট বেশকিছু ছবি দিয়েছে তাকে। যেগুলো নিয়ে তোফাজ্জল হোসেনের বাসায় গিয়েছিল জাদীদ। নিশ্চিত না হলেও ধরে নেয়া যায়, জাহাঙ্গীরের চেহারা এরকমই হতে পারে বা এর কাছেপাশে। নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য ইমিগ্রেশন অফিসার খুবই সাহায্য করল জাদীদকে। নাম ও পত্রিকার ছবি দিয়ে লোকটার পাসপোর্টের কপি খুঁজে বের করল সে। সেখান থেকে পাসপোর্ট নম্বর দেখে দেশ ছাড়া ও দেশে ফেরা, দুটো তারিখই জেনে গেল সহজেই। এমনকি এ-ও জানল, লোকটা এইমুহূর্তে কোন শহরে আছে বা থাকতে পারে। এইটুকু তথ্য সঙ্গে নিয়ে যখন সে থানার দিকে রওনা দিবে, তখুনি শুভর নম্বর থেকে ফোন এলো। রিসিভ করে ঝটপট বলল,
‘তুমি আধঘণ্টা লোকটাকে ভুলিয়ে রাখো। আমি এরমধ্যেই চলে আসব।’
দীর্ঘদিন পর ইমতিয়াজ আজ আবারও শুভকে ডেকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে। আসার পর থেকে একাধারে শুভকে থ্রেট দিচ্ছে। এতদিন ধরে কেন মেয়েটাকে সে খুন করছে না, কেন বার বার সুযোগ হাতছাড়া করছে, এতসব কথা বলে ইনিয়েবিনিয়ে গালাগালি করছে। শুভও কম যায় না। সে নিজের মতো করে একেকটা যুক্তি দেখিয়েই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে ইমতিয়াজ হুংকার দিয়ে বলল,
‘আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কাজটা করতে না পারলে, জাহাঙ্গীরের আসল রূপ তুমি দেখবে।’
‘কী করবে জাহাঙ্গীর? তাকে একবার আমার সামনে আসতে বলুন। তার মুখটা দেখি। যদি প্রকাশ্যে এসব কাজ করার সাহসই না থাকে তাহলে আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে তিনি কী করছেন শুনি? এটাকে উনি কোন ধরনের বাহাদুরি ও সাহসিকতা বলবেন? দিনের পর দিন লুকিয়ে থেকে সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে অন্যায় কাজ করাবেন আর নিচে কাঁথার নিচে লুকিয়ে থাকবেন, তা তো হবে না। এই জাহাঙ্গীরকে না দেখার আগ পর্যন্ত নওমীকে খুন করছি না।’
‘তোমার সিদ্ধান্ত কি এটাই?’
‘অবশ্যই।’
‘তুমি খামোখাই সময় নষ্ট করছ। তারচে বোলো, এই কাজ তোমাকে দিয়ে হবে না, আমরা অন্য কাউকে খুঁজে নেব।’
‘তাহলে খুঁজে নিন। দেখছেন যখন আমাকে দিয়ে কাজটা হচ্ছে না, কেন খামোখা ঝুলিয়ে রাখছেন?’
ইমতিয়াজ হেসে বলল,
‘এতদিনে তুমি অনেককিছুই জেনে গেছো। এত সহজে ছাড়া পেয়ে যাবে?’
‘পাব না বলছেন? তিনি কী করবেন আমার শুনি?’
‘তোমার সবকিছুই কেড়ে নিবে।’
শুভ খুব সহজভাবে বলল,
‘ওহ, আচ্ছা। এই ব্যাপার। দেখি, উনি আমার থেকে ঠিক কী কী কেড়ে নিতে পারেন।’
নির্বিঘ্নে চায়ে চুমুক বসালো শুভ। ইমতিয়াজ রেগেমেগে শার্টের কলার টেনে ধরে বলল,
‘কাজটা একদম ঠিক করছ না তুমি। তুমি ভাবতেও পারছ না তোমার এই ‘না’ বলা, এড়িয়ে যাওয়া, তোমার স্ত্রীর জন্য কতখানি বিপদ ডেকে আনতে পারে। জাহাঙ্গীর তোমার স্ত্রীকে নিয়ে দারুণ দারুণ সব খেলা খেলবে। বুঝেছ?’
হাত ধরে কলার ছাড়িয়ে ইমতিয়াজের নাক বরাবর একটা ঘুষি দিল শুভ। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার নিয়ে উলটে পড়ল লোকটা। একদম ফ্লোরে পড়ে নাকেমুখে আরও ব্যথা পেল। ঝটপট দু’হাতে তাকে টেনে তুলে আবারও গালে আরেকটা ঘুষি দিয়ে রেস্টুরেন্টের দরজার সামনে ফেলল। শক্ত মেজাজে বলল,
‘আমাকে নিয়ে যা খুশি বল ছেড়ে দেব কিন্তু আমার স্ত্রীকে নিয়ে একটা নোংরা কথা বললে তোর মুখ আমি থেতলে দেব জানোয়ার।’
সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এলো রেস্টুরেন্টের সামনে। ইমতিয়াজ পালাতে চাইলে তাকে শক্ত হাতে ধরে রাখল শুভ। মুহূর্তেই হাতকড়া পড়ল হাতে। হতবাক ইমতিয়াজ বলে উঠল,
‘আমার কী দোষ? আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? দোষ তো করল শুভ। এত মার মারল, তবুও তাকে আপনাদের চোখে পড়ল না?’
‘আপনাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে।’
এইবলে আলগোছে ইমতিয়াজের প্যান্টের ফাঁকে আটকে থাকা রিভলবার বের করে জাদীদ বলল,
‘সঙ্গে এসব নিয়ে ঘুরেন? লাইসেন্স আছে?’
ইমতিয়াজ ঢোক গিলে শুভর দিকে আঙুল দিয়ে বলল,
‘ওর কাছেও আছে।’
শুভ দুটো হাত আলগোছে উপরে তুললে তার কাছে কিছুই পাওয়া গেল না। মিটমিটিয়ে হেসে বলল,
‘দেখলি তো, আমি তোদের মতো ধান্ধাবাজ নই। তাই আমার কাছে এসব সস্তা জিনিস থাকে না।’
হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রইল ইমতিয়াজ। শুভর পিস্তল গেল কোথায়? সারাক্ষণই তো সাথে থাকে ওটা। আড়ালে জাহাঙ্গীরের যতগুলো লোক ছিল, সবাই সরে পড়ল ততক্ষণে। কাছেপিঠে সন্দেহজনক আরকিছু না পেয়ে ইমতিয়াজকে গাড়িতে তুলে শুভর সাথে হ্যান্ডশেক করে জাদীদ বলল,
‘থ্যাংক ইউ, শুভ। আমি নিশ্চিত, এরপর জাহাঙ্গীর তোমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে চাইবে। নিজের খেয়াল রেখো।’
‘লোকটার ঠিকানা পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ পেয়েছি। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের কোথাও একটা আছেন। আমি ওই থানার এস আই এর সাথে যোগাযোগ করব। এরপর ওখানে যাব।’
ইমতিয়াজকে নিয়ে পুলিশের লোকজন চলে গেলে রাস্তার ফুটপাত ধরে একা একাই হাঁটতে লাগল শুভ। ঠোঁটের কোণে নির্ভার একটা হাসি খেলে গেল। কতদিন রুমঝুমকে দেখে না। বাচ্চার সাথে ফিসফিসিয়ে গল্প করে না। দূরে থাকতে থাকতে ভেতরটা তার যন্ত্রণার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তো মাত্রই কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। এরপর একটা ছোট্ট প্রাণ তার কাছে থাকবে। একদম বুকের মাঝে। আদুরে হাতে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দিবে সে। মুহূর্তটাকে উপলব্ধি করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার তৃষ্ণার্ত বুক। হাঁটতে হাঁটতেই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে জুতোর ফাঁকে লুকিয়ে রাখা রিভলবার বের করে নদীতে ফেলে দিল। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে রুমঝুমের নম্বরে ডায়াল করল। রিসিভ হতেই বলল,
‘তোমরা অপেক্ষা করছ, তাই না? আমি আসছি, ঝুম। আজই। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই।’
***
রাত তখন সাড়ে আটটা। সঙ্গে থাকা বেশকিছু প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে তোফাজ্জল হোসেনের বাড়িতে এলো জাদীদ। ছবি, পাসপোর্টের ফটোকপি, টিকেটের ফটোকপি ও জাহাঙ্গীর হোসেনের বর্তমান ছবিসহ আরও যা কিছু টুকিটাকি তথ্য জোগাড় করেছে, সবকিছু সামনে রেখে, ছবি দেখিয়ে বলল,
‘এটাই তার বর্তমান চেহারা।’
তোফাজ্জল হোসেন ছবি হাতে নিলেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। এত বছরে একটুও পাল্টায়নি। শুধু মুখের চারপাশে লম্বা লম্বা দাড়িগোঁফ গজিয়েছে। চেহারাই যেন বলে দিল, এটাই তার সৎভাই। তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে টিকেটের কাগজও দেখে নিয়ে বললেন,
‘যতদ্রুত সম্ভব তাকে অ্যারেস্ট করুন, অফিসার।’
জাদীদ স্থিরস্বরে বলল,
‘সেটা তো করবই। তবে নিশ্চিত হতে আরও কিছু প্রমাণ আমাদের দরকার। অতীতের যেহেতু কোনো প্রমাণ আর বেঁচে নেই, হুট করে সেসব কথার ভিত্তিতে তাকে অ্যারেস্ট করাও পসিবল না।’
‘সে আমার মেয়ের ক্ষতি করতে চায়, এইটুকুই কি যথেষ্ট নয় অফিসার?’
এইটুকুর ভিত্তিতে যদি অ্যারেস্ট করে, তারপরও নির্দিষ্ট কিছুদিন পর জাহাঙ্গীর হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে যাবে। সে দোষী, খুনী, এমন কোনো প্রমাণ আপাতত নেই। এসব লুটপাট, চোরাকারবারি হচ্ছে, সেসবেও জাহাঙ্গীরের কোনো নাম নেই। সব জায়গায় শহর জানে, কানা জব্বার এসব করছে। অথচ এই কানা জব্বার আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ। কোনো ধরনের খারাপ কাজের সাথে এই লোকটা জড়িতই নয়। হিসেব ঠিক মিলাতে পারল না জাদীদ। ভেবেচিন্তে বলল,
‘কানা জব্বার নামে কাউকে চিনেন আপনি?’
স্মৃতির পাতা হাতড়ে কানা জব্বার নামটা খুঁজে ফিরলেন তোফাজ্জল হোসেন। কোথাও এই নাম শোনেছেন বলে মনে পড়ল না। বললেন,
‘তার কোনো ছবি আছে?’
নিজের ফোন থেকে একটা ছবি বের করে ভদ্রলোকের সামনে রাখল জাদীদ। শুভর সাথে এ পর্যন্ত যা যা হলো, সবটাই বলল। কীভাবে তাকে গাড়িতে ফাঁসানো হলো, কীভাবে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে আবারও জাহাঙ্গীরের নিকট পাঠানো হলো, সবটাই অল্পস্বল্প বলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সময় ছবির দিকে তাকিয়ে তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘এই লোকটার নাম কানা জব্বার, সেটা আপনি জানলেন কী করে?’
‘রাজশাহীর এক এস আই জানিয়েছিলেন।’
তোফাজ্জল হোসেন মুচকি হেসে বলল,
‘এই লোকটার নাম আব্বুল জব্বার। আমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ না। তবে এই জব্বার আমার ভাই জাহাঙ্গীরের বাল্যবন্ধু।’
এরকম একটা খবর শুনবে ভাবেনি জাদীদ। সে বিস্মিত চোখে চেয়ে এই আব্বুল জব্বারের সম্পর্কে অতীতের সবকিছু জেনে নিল। বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো একসময় ছিঁড় ধরেছিল। এরপর দীর্ঘদিন, দীর্ঘবছর কোনো যোগাযোগ হয়নি। হয়তো দেশে ফিরেই জাহাঙ্গীর তার সাথে যোগাযোগ করেছে। যদি এরকমটা হয়, তাহলে এতগুলো বছর ধরে কানা জব্বারের নাম নিয়ে অন্যায়টা করছে কে? ভাবতে গিয়ে নিজে নিজেই কিছু যুক্তি সে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘আমার মনে হয়, জাহাঙ্গীর দেশের বাইরে গেলেও নিজের বিশ্বস্ত লোকদের তিনি দেশে রেখে গেছেন। নয়তো এরকমও হতে পারে, কোনো নির্দিষ্ট একদল গ্যাংয়ের সাথে তিনি যুক্ত। বিদেশ বিভুইয়ে থেকে বন্ধুর ওপর শোধ তুলতেই কানা জব্বার নামটা ব্যবহার করেছেন।’
তোফাজ্জল হোসেনও সম্মতি জানালেন। জাদীদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আবারও কানা জব্বারের সাথে দেখা করতে যাবে। জানতে হবে, বন্ধুত্বের সম্পর্কে সেই দ্বন্দ্বটা কতটা গভীর ছিল! সে যখন এতসব জটিল বিষয়াদি নিয়ে ভাবছিল, তখুনি তার নম্বরে ফোন এলো। স্ক্রিনে আদিয়ানের নম্বর দেখে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদিয়ান বলল,
‘তুমি কোথায়, জাদীদ?’
‘আমি তো একটু বিজি। তোফাজ্জল হোসেনের বাসায় আছি এখন। জরুরী কিছু বলবে?’
‘আজ শুভর সাথে দেখা বা কথা হয়েছে তোমার?’
‘হ্যাঁ, সন্ধ্যার দিকেই দেখা হলো।’
‘ওর ফোন সুইচড অফ আসছে। বলেছিল এখানে আসবে। এখনও আসেনি। ফোন নম্বর বন্ধ পাচ্ছি। এদিকে টেনশনে ঝুম একেবারে অস্থির হয়ে যাচ্ছে।’
জাদীদ ঘড়ি দেখল। এখনও খুব একটা রাত হয়নি। সে আদিয়ানকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘চিন্তা কোরো না, আমি ওর নম্বরটা ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করছি। যদি অন হয়, লোকেশন জানতে পারব।’
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল জাদীদ। শুভর সাথে যেখানে দেখা হয়েছিল, সেখানেই এলো। আশেপাশে যাকে পেল, তাকেই ছবি বের করে দেখাল। কেউ কিছু দেখেনি, জানে না, এমন সব নিশ্চয়তা পেয়ে সম্পূর্ণ টিমকে পুরো শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিল। যেভাবে হোক, যেখান থেকে হোক, শুভকে জীবিত খুঁজে পেতেই হবে। যেখানে যেখানে সন্দেহ হলো, সেখানেই খুঁজল। কিন্তু কোথাও শুভর চিহ্নটি খুঁজে পেল না। এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎই ব্রিজের ওপর এসে দাঁড়াল জাদীদ। পায়ের নিচে চ্যাপ্টা কিছু পড়াতে হাতে তুলে দেখল, শুভর ফোন। সুইচড অফ হয়ে পড়ে আছে। চেক করতে গিয়ে দেখল, শেষ কল এসেছে সন্ধ্যা সাতটায়। রুমঝুমের নম্বর থেকে। কিন্তু সেটা রিসিভ হয়নি। তারমানে যা কিছু অঘটন ঘটার ছিল, সেটা ওই সময়ের আগেই হয়েছে। সে তার টিমের সবাইকে আরও সতর্ক করে দিল। সবার আগে সিদ্ধান্ত নিল, নদীটা দেখবে। আশেপাশে কোনো সিসিটিভি নেই। হুট করে কোথায় যেতে পারে সেরকম কোনো আইডিয়াও করতে পারল না। যেখানে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে যায়নি। আদিয়ানকে জানালে আধঘণ্টার মধ্যে সে-ও ব্রিজের ওপর এসে উপস্থিত হলো। জাদীদ তার মোবাইল দেখিয়ে বলল,
‘এটা এখানেই পড়েছিল। সন্ধ্যায় ইমতিয়াজকে অ্যারেস্ট করেছিলাম। আমার মনে হয়, জাহাঙ্গীর কিছু একটা করেছে। আগে নদীটা চেক করে নিই, এরপর নিখোঁজ সংবাদ ছাপাব। তার আগে, ইমতিয়াজের পেটের ভেতর থেকে সব কথা বের করতে হবে, নয়তো শুভকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’
দু’হাতে চোখমুখ মুছে আদিয়ান বলল,
‘আমার খুব টেনশন হচ্ছে, জাদীদ। মাথা কাজ করছে না। বার বার ওর সাথেই কেন এমন হচ্ছে?’
***
চলবে…