পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-২০+২১

0
40
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২০

আজ এক সপ্তাহ ধরে রুমঝুম অসুস্থ। পায়ে পানি আসা থেকে শুরু করে, আট মাসের শেষে এসে ব্লিডিং শুরু হয়েছে। এরমধ্যে মাঝখানে দু’দিন হসপিটালে থেকে ব্লাড দিতে হয়েছে। ডাক্তার তাকে সম্পূর্ণ বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন। সেদিনের পর থেকে শুভ আবারও নিখোঁজ। নদী থেকে শুরু করে শহরের প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় শুভকে খোঁজা হচ্ছে। কোথাও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের সবাইকে এই খবর জানানো হলে, শুভর বাবা-মা আসবেন বলে আজও আসেননি। এদিকে জাদীদ খুব চেষ্টা করছে জাহাঙ্গীরের দলবলসহ সবাইকে একসাথে গ্রেফতার করতে। কিন্তু সক্ষম হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জে গিয়ে সেখানেও কোনো খোঁজ পায়নি লোকটার। আশেপাশের মানুষের থেকে খবরাখবর জানার জন্য নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে এসেছে। নারায়ণগঞ্জ থানার কেউ জাহাঙ্গীরকে চিনে না। সেখানে তার ছবিসহ যাবতীয় তথ্য দিয়েছে। ওই থানার পুলিশ ডিপার্টমেন্টও এখন মরিয়া হয়ে খুঁজছে তাকে। ইমতিয়াজকে আধমরা করেও কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে জাদীদ যথেষ্ট পেরেশানিতে আছে। থানায় বসে এই কেইস নিয়েই ভাবছিল সে। মাঝখানে যত কেইস এসেছে, সমাধান হয়েছে কিন্তু এই জাহাঙ্গীর ও কানা জব্বার সমস্যাটা এখনও ঝুলেই আছে। গত পরশু সে রাজশাহী গিয়েছিল কানা জব্বারের কাছে। ভদ্রলোক তাকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। প্রয়োজনে যোগাযোগ কর‍তে বলেছেন আবার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভাঙনের কারণও জানিয়েছেন। তাদের দুই বন্ধুর মধ্যকার দ্বন্দ ছিল আব্বুল জব্বারের প্রেমিকা অন্তরাকে নিয়ে। কেন সে জাহাঙ্গীরকে ভালোবাসলো না, কেন সে জব্বারকে বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করল, এসবই মেনে নিতে পারেননি জাহাঙ্গীর। এই থেকে জাদীদ একটা সূত্রই স্পষ্টভাবে পেল, সেটা হচ্ছে, একতরফা অনুভূতিকে হেরে যেতে দেখে রাগ, ক্ষোভ ও প্রতিশোধের নেশা থেকে জাহাঙ্গীর এখন কানা জব্বার নাম ব্যবহার করে বন্ধুকেই ফাঁসাতে চাইছে। অথচ আব্দুল জব্বার লোকটা মোটেও খারাপ নয়। এতসব চিন্তাভাবনার মাঝখানে হঠাৎই তার কনস্টেবল বাবুল এসে বলল,

‘স্যার, পনেরো মিনিট আগে বুড়িগঙ্গার কাছে একজন ব্যক্তির আধপোড়া দেহ পাওয়া গেছে। তাকে এখন ইমার্জেন্সিতে নেয়া হয়েছে।’

জাদীদ বলল,
‘নাম-পরিচয় কিছু পাওয়া যায়নি?’

‘আইডেন্টিটি পাওয়া গেছে, স্যার। তবে চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মুখের অর্ধেক অংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।’

এরপর একটা আইডেন্টিটি বের করে দিল কনস্টেবল। হতবাক জাদীদ সেটা দেখে সবকিছু ফেলে রেখে দ্রুত ছুটল হসপিটালে। যাওয়ার পথে আদিয়ানকে জানিয়ে দিল ঘটনা। সে যখন হসপিটালে গিয়ে অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ জানতে চাইল, তখন কর্তব্যরত ডাক্তার একটা কেবিন দেখিয়ে দিলে সেখানে গিয়ে পুড়ে যাওয়া মুখটার কাছে গিয়ে আলতো করে হাতে হাত রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল,

‘শুভ…। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’

জোরপূর্বক চোখদুটো টেনে খুলল শুভ। নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছে তার। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হতে চাইছে না, চাইলেও পারছে না। শরীরের প্রত্যেকটা অংশে আঘাতের চিহ্ন। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল,

‘ঝুমকে একটু আসতে বলবেন, ভাই?’

‘আমি আদিকে জানিয়েছি, ওরা আসছে। কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন? পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। ব্রিজের ওপর আপনার মোবাইল পেয়ে সম্পূর্ণ নদীতে জাল ফেলেছি। অথচ কোত্থাও পাইনি।’

সেদিন রাতে জাহাঙ্গীরের লোকজন শুভকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। রুমঝুমের নতুন বাসার ঠিকানা জানতে চাইছিল বার বার। নতুন বাসায় যাওয়ার পর সেই ঠিকানায় গিয়ে বউয়ের সাথে দেখা করেনি শুভ। যাওয়ার সময়-সুযোগ পায়নি। তাই জেনেও ঠিকানার কথা বলেনি। এই কারণেই জ্বলন্ত রড দিয়ে সমস্ত শরীরে আঘাত করেছে জাহাঙ্গীরের লোকজন। শরীর পুড়িয়েছে, মুখ পুড়িয়েছে, হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। মারতে মারতে যখন অজ্ঞান হয়ে গেছে, ওরা হয়তো ধরে নিয়েছে, সে মারা গেছে, তাই রাস্তায় ফেলে গেছে। আস্তেধীরে এতটুকু জানার পর জাদীদ খুব দ্রুতই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। সব ধরনের চিকিৎসা ও অপারেশন শেষ হতে হতে রাত হলো দশটা। অসুস্থ শরীর নিয়ে রুমঝুমও এলো হসপিটালে। সেখানেই রাত কাটল। রাতের শেষপ্রহরে শুভর বাবা-মা এলেন। ছেলের অসুস্থতা ও অপারেশনের খবর জানলেন। সকালেই চোখ মেলল শুভ। ঘোলাটে চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে কেউ। এত যন্ত্রণার মধ্যেও খানিকটা শান্তি পেল সে। অস্ফুটস্বরে বলল,

‘ঝুম… একটু পানি খাওয়াবে?’

রুমঝুম সতর্ক হয়ে তড়িঘড়ি বোতল থেকে গ্লাসে অল্প পানি ঢেলে, শুভকে পানি খাওয়াতে চাইল, কিন্তু পারল না। সামান্য পানিও গিলতে পারল না শুভ। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল সব পানি। রুমঝুম ঘাবড়ে গেল। দুর্বল শরীর নিয়ে দু’হাতে ধরে বসাতে চাইল, তা-ও পারল না। জাদীদ কেবিনের বাইরেই ছিল। সামান্য গলা বাড়িয়ে রুমঝুম তাকেই ডাক দিল,

‘জাদীদ ভাই, একটু ভেতরে আসুন না।’

শুভর বাবা-মা দু’জনেই জাদীদের সাথে ছিলেন। ডাক শোনে একসাথে ভেতরে ঢুকলেন। সবাইকে দেখে রুমঝুম বলল,
‘ও একটু পানি খেতে চেয়েছে। একটু হেল্প করুন না, প্লিজ।’

জাদীদ পাশে বসে শুভকে দু’হাতে শক্ত করে ধরে রাখল। ছেলেটার সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে জখম হয়নি। ধরতে গেলেই ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল শুভ। জাদীদ আস্তে করে ধরে রাখলে, চামচ দিয়ে কয়েকফোঁটা পানি খাওয়াতে গেলে ভেতর থেকে বড়ো করে একটা ঢেঁকুর ছাড়ল শুভ। ঝিমিয়ে পড়া দেহ ও ব্যথাতুর হাত নিয়ে কোনোমতে রুমঝুমের হাতটা ধরে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দরজার দিকে দৃষ্টি ঘোলা চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ওখানে কে?’

দরজায় কেউ নেই। অথচ শুভ আবছায়া কিছু দেখতে পেল। সেই মুহূর্তেই আদিয়ান এসে দাঁড়াল দরজায়। আচানক বন্ধুকে দেখে শুভ যেন গলায় জোর ফিরে পেল। বলল,

‘আদি, দরজা থেকে সর। ওখানে কেউ আছে। ভেতরে আসতে দে তাকে।’

আদিয়ান ডানে-বামে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বলল,
‘কেউ নেই, দোস্ত। ভুল দেখছিস।’

এরপর দু’পা এগিয়ে বেডের কাছে গিয়ে শুভকে আগলে নিয়ে একপাশে বসলো। শুভর মা ততক্ষণে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করেছেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে শুভ বলল,

‘তুমি কাঁদছ কেন? আমার কিছুই হয়নি। আমি ঠিক আছি, আম্মা।’

আবারও দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলল শুভ। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে রুমঝুমের হাত ধরে, বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি, ক্ষমা করে দিও, আব্বু।’

শুভর বাবা আতাউল্লাহ ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘তুই ঘুমা, বাপ। উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। আমরা আছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। আমরা থানায় ডায়েরি করব। আদালতের কাছে ওই অমানুষটার বিচার চাইব।’

শুভ একপলক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে জোরেশোরে নিঃশ্বাস নিয়ে টেনে টেনে বলল,
‘আমি জানি তোর মনের খবর। জানি, তুই কী চাস। তবুও বলছি, যদি পারিস, ঝুমের খেয়াল রাখিস।’

আদিয়ান কিছুই বলতে পারল না। শুধু শুভর হাতটা ধরে রইল। রুমঝুম শব্দ করে কেঁদে উঠল। শুভকে বুঝানোর বাহানায় বলল,
‘তুমি একটু শান্ত হও। একটু ঘুমানোর চেষ্টা কোরো।’

শুভ ক্লান্তভঙ্গিতে জাদীদকে বলল,
‘ওরা ঝুমের খোঁজ করবে। হয়তো ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। ঝুম ও আমার বাচ্চার একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ভীষণ প্রয়োজন, জাদীদ ভাই। আমার বাচ্চাটাকে দেখে রাখবেন প্লিজ…।’

গলা দিয়ে পরবর্তী আওয়াজ টেনে আনতে পারল না শুভ। জোরপূর্বক চোখদুটো টেনে টেনে আলগোছে রুমঝুমের স্ফিত উদোরে হাত রাখতেই বেবির মুভমেন্ট অনুভব করতে পারল। প্রশান্তির সাথে কিছু একটা বিড়বিড় করে জাদীদের কাঁধেই মাথা হেলিয়ে দিল সে। ঠোঁটের কোণে স্পষ্ট হাসিটা দেখা যাচ্ছিল তখনও। হাসিহাসি মুখ দেখে রুমঝুম তখনও বুঝল না, কী হলো। জাদীদকে বলল,

‘আপনি ওকে একটু শুইয়ে দিন না, ভাই। ইনজেকশনের প্রভাবে মনে হয় ঘুম চলে এসেছে।’

ছেলের শরীর ছুঁয়ে ও তাকে একবার দেখে শুভর মা মোমেনা বেগম গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে আশেপাশের কেবিনের অন্যান্য রোগী ও মানুষজন জড়ো করে ফেললেন। রুমঝুম হতভম্ব হয়ে গেল। জাদীদ একহাতে শুভর নিভু নিভু চোখ বুঁজে দিয়ে শব্দ করে আওড়াল,

‘শুভ আর নেই, রুমঝুম।’

এইটুকু বলতে গিয়ে জাদীদ টের পেল ওর কণ্ঠস্বর কাঁপছে। চোখের কোণে অশ্রুরা ভীড় জমিয়েছে। শুভর নিথর দেহখানি বেডে শুইয়ে, সাদা চাদরে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে দিল। রুমঝুম কেমন করে যেন আদিয়ানের দিকে একবার তাকাল। হয়তো জাদীদের কথার নিশ্চয়তা চাইল, হয়তো না। আদিয়ান বোনকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,

‘সব শেষ হয়ে গেল রে, ঝুম। ওরা ওকে বাঁচতে দিল না।’

দুর্বল শরীরের সবটুকু ভর ছেড়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল রুমঝুম। ফ্লোরে পড়ার আগেই জাদীদ তাকে ধরে ফেলল। তড়িঘড়ি অন্য একটা বেডে শুইয়ে ডাক্তার ও নার্সকে ডেকে আনতে বাইরে গেল।

***

পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না রুমঝুম। জ্ঞান ফেরার পর অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে সে। চোখ খুলেছে দুপুরে। চোখ খোলা মাত্রই, শুভর মা একেবারে তেড়ে এলেন ছেলের বউয়ের দিকে। ডিসচার্জ ও অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করতে রিসিপশনে গিয়েছিল জাদীদ ও আদিয়ান। সেই ফাঁকেই অসুস্থ মেয়েটার গলা টিপে ধরলেন তিনি। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে গেল রুমঝুম। আশেপাশে যারা ছিল, ছুটে এসে আটকাল। শুভর বাবা আতাউল্লাহ স্ত্রীর গালে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে বললেন,

‘অমানুষ হয়ে গেছো তুমি? মেয়েটা অসুস্থ। যা হয়েছে সবকিছু রবের ইচ্ছেতে হয়েছে। এখানে ওর কোনো দোষ নেই।’

শুভর মা মোমেনা বেগম এই কথায় আরও ফুঁসে উঠলেন। বললেন,
‘ওই কালনাগিনীকে বিয়ে করার পর থেকে শুভ বিপদে পড়েছে। যা হয়েছে সবকিছুর জন্য ও দায়ী। নষ্টা মেয়ে, কার না কার বাচ্চা পেটে নিয়ে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।’

একাধারে আরও অনেক গালিগালাজ করার পরও শান্ত হচ্ছিলেন না তিনি। রুমঝুম দুর্বল শরীর নিয়ে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আছে। এখনও সবকিছু তার কাছে অবিশ্বাস্য ও দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। শুভ আর নেই, এইটুকু সে মানতে পারেনি তখনও। মনে ও শরীরে একফোঁটা জোর নেই আর। কারও সাথে তর্কবিতর্ক করার মতোও ইচ্ছে কিংবা সামান্যতম আগ্রহ নেই। কেবলই নিজের নিষ্ঠুর নিয়তি নিয়ে ভেবে চলেছে সে। জীবন তাকে আর ঠিক কী কী দেখাবে সেটাই ভাবছিল। অদৃষ্টের এই লিখন যেন তার সবকিছু ধ্বংস করতেই ঘনকালো অমাবস্যা হয়ে নেমে এসেছে জীবনে। তার এই মনমরা মুখ দেখে মোমেনা বেগম আরও জোর পেলেন বেশি। বললেন,

‘দেখো একবার তাকিয়ে, চোখে একফোঁটা পানিও নেই। এই মেয়ে না কি আমার ছেলেকে ভালোবেসে। মিথ্যেবাদী, ডাইনী, ছোটোলোক, সব ওর ধান্ধাবাজি। আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে আমাদের সম্পত্তির দিকে নজর দিতে চায় ও। আমি ওকে ঘরে তুলব না। রাস্তার বেশ্যা…।’

ঠিক সেই সময়ই দরজায় এসে দাঁড়াল আদিয়ান। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল,
‘অনেক কথা বলে ফেলেছেন, আন্টি। আর বলবেন না। একটা নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী সাজিয়ে নিজের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। আপনি যদি ওকে আপনার পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে না পারেন, সেটা আপনার ব্যর্থতা। কিন্তু তাই বলে, আমার সামনে আমার বোনকে আপনি যা নয় তাই বলে যাবেন, আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনব? ওকে এতটাও ভীতু ভাবার কোনো কারণ দেখছি না। যেখানে আমি আছি, আমাদের গার্ডিয়ান আছে, সেখানে আপনার দ্বারে গিয়ে হা-হুতাশ করার মতো ইচ্ছা ও লোভ কোনোকিছুই আমাদের নেই। আমরা কোনো অমানুষের দ্বারে গিয়ে ভিক্ষা করি না। করবও না। খাদ্য-বস্ত্র, বাসস্থান অন্বেষণের জন্য রব আমাদের পর্যাপ্ত শারিরীক ও মানসিক শক্তির পাশাপাশি যথেষ্ট জ্ঞানবুদ্ধিও দিয়েছেন। সেটুকুই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’

কিছুতেই মেজাজের এই ওঠানামাকে কন্ট্রোলে আনতে পারছে না আদিয়ান। মোমেনা বেগমের এই রূপ, এই ভিন্ন আচরণ কেমন যেন অবিশ্বাস্য ঠেকল! মায়েরা এত নিষ্ঠুর মনের হতে পারে, এটা ধারণারও বাইরে ছিল তার। অথচ এই মা-ই শুভর দূরে থাকার সময়ে সবসময় তাকে বলতেন, ‘আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো বাবা। ওতদূরে গিয়ে পড়াশোনা করছে, কী খায় না খায়, কিছুই দেখি না।’ বিপদের দিনে যাদের আপন ভেবেছিলেন, যাদের কাঁধে ছেলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তুলে দিয়ে নির্ভার থাকতে পেরেছিলেন, আজ তাদেরই ঘাড়ের বোঝা ভাবতে শুরু করেছেন! মানুষ এরকমও হয়? এত স্বার্থপর? আদিয়ানের কথাগুলো যেন বোলতার হুলের মতো যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলল। তিনি সমানতালে চেঁচিয়ে বললেন,

‘বেয়াদব ছেলে, বড়োদের মুখে মুখে কথা বলছ, লজ্জা করে না তোমার?’

‘না আন্টি, আমার লাজলজ্জা একদমই নেই। উচিত কথা বলতে গেলে আমার লজ্জা আসে না। আজ যে কথাগুলো আপনি ঝুমকে বললেন, কাল সে-ই কথাই যদি আপনার মেয়ের ওপর দিয়ে যায়, মা হিসেবে নিশ্চয়ই আপনার গর্ব হবে না! লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাবে। এতকিছুর পরও আপনি এটা ভাববেন না যে, আপনার ওই বাড়িতে আমি ঝুমকে যেতে দেব। ও কিংবা ওর বাচ্চার ওপর আপনাদের কোনো অধিকার ও দাবী রইল না। আপনারা মুক্ত।’

মোমেনা বেগম খুশিই হলেন। যাক, বোঝা আর টেনে নিতে হবে না। তার আরও দুটো ছেলে আছে, মেয়ে আছে। তাদেরও সন্তান আছে। সম্পত্তির ভাগ থেকে একজন ভাগিদার কমে গেলে তাদেরই শান্তি। যেখানে শুভ নেই, সেখানে এই অহেতুক বোঝা টেনে নেয়ার কোনো প্রয়োজনই তিনি দেখছেন না। মুখ ঝাপটা মেরে তিনি আতাউল্লাহকে বললেন,

‘যাও শুভর বাপ, লাশটাকে রাজশাহী নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কোরো। আধঘণ্টার মধ্যেই রওনা দিতে চাই আমরা। এই অপয়া মেয়ে আমার ছেলেকে খেয়েছে, কোনদিন না আবার আমাদেরও খেয়ে ফেলে।’

আতাউল্লাহ ঘৃণিত দৃষ্টি নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। পারলেন না শুধু এতগুলো মানুষের সামনে স্ত্রীর চুলমুঠো ধরে টান দিতে। এমন বহুরূপী মানুষ তার দু’চোখের বিষ। অথচ এই বিষ নিয়েই তিনি এতগুলো বছর কাটিয়েছেন, ভাবতে গিয়েই রাগে-ঘৃণায় মুখের ভাবভঙ্গি পালটে গেল। তিনি জোর গলায় স্ত্রীকে কিছু বলতে গেলেই আদিয়ান বলল,

‘আংকেল, অ্যাম্বুলেন্স রেডি। লাশ নিয়ে যেতে হবে।’

‘লাশ’ শব্দটা মুখ দিয়ে বের করা মাত্রই বুকের ভেতর একটা হাহাকার টের পেল আদিয়ান। বন্ধুর ঢেকে রাখা মুখটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। মুহূর্তেই একটা মানুষ ‘লাশ’ হয়ে গেছে, এটা বিশ্বাস করা যায়? যেহেতু আঘাত ছিল শরীরে, তাই পোস্টমর্টেম করতে হয়েছিল। তার চোখের সামনে দিয়ে হসপিটালের কয়েকজন নার্স মর্গ থেকে স্ট্রেচারে করে শুভর নিথর দেহখানি নিয়ে বাইরে চলে গেল। এতক্ষণ নীরব থাকলেও চোখের সামনে দিয়ে শুভর আড়াল হওয়ার দৃশ্য দেখা মাত্রই রুমঝুমের চিৎকার, কান্না ও আহাজারি বেড়ে গেল। আদিয়ান বোনের কাছে গিয়ে দু’হাতে তাকে সামলে নিয়ে বলল,

‘আর কোনো দাবী রাখিস না, ঝুম। বিদায় দে।’

রুমঝুম কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে বলল,
‘এটা কী হয়ে গেল, ভাইয়া? কেন হলো? আমি এই বাচ্চাটার কাছে কী জবাব দিব? কীভাবে বলব, তার মাথার ওপর ছায়াটা আর নেই? ও আল্লাহ! তুমি এত নিষ্ঠুর কেন হলে? কেড়েই যদি নিবে তবে কেন আমার জীবনে তাকে পাঠিয়েছিলে তুমি? কেন পাঠিয়েছিলে, মাবুদ? কেন?’

এখনও বিল পেমেন্ট বাকি ছিল। নিজের পকেটের অবস্থা করুণ। মাঝখানে রুমঝুমের ডাক্তারির পিছনে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে। একসাথে এত টাকা এখন কোথায় পাবে? দিশেহারা অবস্থা আদিয়ানের। এরমধ্যে রুমঝুমের এই কান্নাকাটি। এতসব চিন্তার মধ্যে যখন অস্বস্তিকর একটা মুহূর্ত যাচ্ছিল, তখুনি মৌমিকে নিয়ে হসপিটালে এলো নওমী। শুভর মৃত্যুর খবরটা বান্ধবীর মুখ থেকে শুনেছে সে। এরপরই ছুটে এসেছে দেখতে। যদিও নিচে দেখেছে, লাশ নিয়ে অলরেডি রাজশাহীর পথে রওনা দিয়েছে শুভর বাবা-মা, তবুও রুমঝুমের অবস্থা জানার জন্যই কেবিনে আসা। দুই বান্ধবী রুমঝুমকে সাহস ও ভরসা দিয়ে দাঁড়ালে আদিয়ান একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পকেট থেকে ফোন বের করে, প্রথমে মৃত্যুর খবর তার মেজো মামাকে জানাল। বড়ো মামা ও তার আম্মি ফোন ধরছেন না। সকাল থেকে অনেকবার মাকে ফোন দিয়েছে, লাভ হয়নি। তাই অন্যজনকে জানিয়ে নিজের চাচ্চুর ফোনে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করলেন তার চাচ্চুর স্ত্রী নাদিরা ফেরদৌসী। চাচির কণ্ঠ শোনেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আদিয়ান বলল,

‘চাচ্চু কোথায়, ছোটাম্মি?’

ভদ্রমহিলা বললেন,
‘বাসায় নেই, আদি। ফার্মে গিয়েছেন। তোমার কিছু দরকার?’

‘চাচ্চুকে বোলো, দু’দিনের মধ্যে আমার অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা ট্রান্সফার করতে। খুব বিপদে আছি, ছোটাম্মি।’

‘কী হয়েছে তোমার? গলার স্বর এমন লাগছে কেন?’

‘শুভ আর নেই, ছোটাম্মি। জাহাঙ্গীরের লোকজন ওকে…।’

কথা বলতে গিয়ে হাঁসফাঁস শুরু করল আদিয়ান। নাদিরা ফেরদৌসী তাকে একটু শান্ত হতে বললেন। শুভ নেই, এই কথা শোনে তিনিও পাথর হয়ে গেলেন। দেড় বছর আগে তার বড়ো মেয়ে রূপাঞ্জনার বিয়েতে এসেছিল শুভ। কত ভালো একটা ছেলে। এইভাবে না-ই হয়ে গেল! তিনি আদিয়ানকে বললেন,

‘তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তোমার বিকাশ অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা দিচ্ছি। এই টাকাগুলো এখন খরচ কোরো। বাকিটা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করছি।’

বাবার পর ওপর চাচ্চুর কাছে সমস্ত আবদার আদিয়ানের। যদিও তার জন্য তার বড়ো মামা যথেষ্ট ছিলেন, তবুও বাড়ি গেলে তার চাচ্চু সবসময়ই ভরসার হাত বাড়িয়ে ভাতিজাকে আগলে নিয়েছেন। বাড়ির যত সম্পত্তি, তারমধ্যে আদিয়ানের অংশটুকু তিনি আলাদা রেখে দিয়েছেন। এমনকি ফার্মে আদিয়ানের যতটা হক্ব, প্রতিমাসে সেই অনুযায়ী টাকা তিনি আলাদা একটা অ্যাকাউন্টে রেখে দেন। যখনই আদিয়ানের প্রয়োজন হয়, সেখান থেকেই টাকা তার অ্যাকাউন্টে চলে যায়। খুব বেশি বিপদ না দেখলে আদিয়ান এই টাকায় হাত দেয় না। একা মানুষ, খরচ কম। মায়ের, মামার, নিজের ও ঝুমের যতটুকু প্রয়োজন হয়, ততটুকুই সে খরচ করে। আজও টাকা চাইত না। কিন্তু চাকরি হচ্ছে না দেখে জমানো টাকাগুলোও ফুরিয়ে এসেছে। না চাইলে চলতে পথে দশবার হোঁচট খাবে বলেই বাড়িতে জানানো। ছোটাম্মির কথায় সুস্থির নিঃশ্বাস ফেলে আদিয়ান বলল,

‘এখন রাখি, ছোটাম্মি। প্রয়োজনে ফোন করব।’

‘ঠিক আছে। নিজের খেয়াল রেখো। মন খারাপ কোরো না, সবটাই আল্লাহর ইচ্ছা।’

‘হুম।’

‘ভাবীকে জানিয়েছ?’

‘মেজো মামাকে বলেছি। আম্মি ফোন তুলছে না।’

‘আচ্ছা, আমি কথা বলছি। তুমি রুমঝুমের খেয়াল রাখো।’

ফোন রেখে রুমঝুমের পাশে দাঁড়াল আদিয়ান। নওমী খুব দ্রুততার সাথেই রুমঝুমকে সামলে নিয়েছে। এখানে আর কোনো প্রয়োজন নেই। মেয়েটার বিশ্রামের দরকার। তাকে পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে নওমী বলল,

‘আমার মনে হয়, আপনাদের এখন বাসায় চলে যাওয়া উচিত। এখানে হসপিটালে থাকলে রুমঝুম আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’

আদিয়ান বলল,
‘আপনারা পারবেন ওকে নিচে নিয়ে আসতে? আমি একটা উবার ম্যানেজ করি।’

‘ঠিক আছে। আপনি যান।’

আদিয়ান নিচে আসতেই ইমার্জেন্সির সামনে জাদীদকে পেল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ব্যাপারেই কিছু একটা কথা বলছিল জাদীদ। আদিয়ানের ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখ দেখে বলল,

‘তোমরা বাসায় চলে যাও, আদি।’

‘যাব।’

বিষণ্ণমনেই উত্তর দিল আদিয়ান। জাদীদ তা খেয়াল করল। বলল,
‘এই কাজের জন্য জাহাঙ্গীর অবশ্যই শাস্তি পাবে। আজ না হোক কাল, আইন তাকে তার অন্যায়ের শাস্তি ঠিকই দিবে।’

‘শুভ তো আর ফিরবে না।’

সঠিক কোনো কথা খুঁজে পেল না জাদীদ। আদিয়ান বলল,
‘ঝুমের কী হবে, ভাই? আমি মামাকে কী বলব? এরকম একটা কঠিন পরিস্থিতির সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে শুভ এইভাবে চলে গেল!’

রুমঝুমের মায়াবী মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। জাদীদ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে, মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। বলল,
‘আজকের এই পরিস্থিতির জন্য যে বা যারা দায়ী, তাদের একজনকেও আমি বাঁচতে দেব না, আদি। জাহাঙ্গীরের এই পাপের সাম্রাজ্য আইনের হাতে নয় আমার হাতে ধ্বংস হবে, নিশ্চিত থাকো।’

***

চলবে…

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২১

হাতে এককা মোটা সাইজের লাঠি নিয়ে লকাপের ভেতরে প্রবেশ করল জাদীদ। ইমতিয়াজকে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। এতদিন অনেক সুযোগ দিয়েছে, তবুও মুখফুটে কিছুই বলছে না লোকটা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কেউ তার জামিন করাতেও আসছে না। এতে যে জাহাঙ্গীরের লোকজন সম্পর্কে আইন জেনে যাবে, সেই ভয়েই হয়তো দূরে আছে সবাই। কাছে গিয়ে লাঠির সাহায্যে ইমতিয়াজের মুখটা উপরে তুলে জাদীদ বলল,

‘জাহাঙ্গীর কোথায়?’

ইমতিয়াজ বলল,
‘আমি জানি না।’

সঙ্গে সঙ্গেই হাত ও পেট বরাবর একটা আঘাত দিল জাদীদ। ইমতিয়াজ আর্তনাদ করে উঠল। জাদীদ আবারও বলল,

‘এখনও সময় আছে, ওর ঠিকানা দিয়ে দে। নয়তো তোকে আমি জানে মেরে ফেলব।’

ইমতিয়াজ হেসে বলল,
‘আমি জানি, ততক্ষণ আপনি আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন, যতক্ষণ না জাহাঙ্গীর ভাইয়ের খোঁজ পাচ্ছেন। মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই আর। মারুন আমাকে।’

জাদীদ ধৈর্য্য ও মেজাজ কোনোকিছুকেই আর ধরে রাখতে পারল না। হাতের লাঠির সাহায্যে পরপর অনেকগুলো আঘাত বসাল ইমতিয়াজের শরীরে। হাত-পা ফেটে রক্ত বের হলো, তবুও বোকা লোকটা একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। উপায় না পেয়ে লোকটার গলা টিপে ধরে বলল,

‘ঠিকানাটা বল জানোয়ার।’

মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে ইমতিয়াজের। রক্তাক্ত মুখেই জবাব দিল,
‘জানি না।’

হাল ছেড়ে দিয়ে রিভলভার হাতে নিল জাদীদ। গুলি লোড করাই ছিল। শুধু চেক করে সেটা ইমতিয়াজের মাথায় ঠেকাল। কাউন্টডাউন শুরু করার আগে বলল,

‘তিন সেকেন্ড সময়। এরমধ্যে যদি সত্যি স্বীকার না করিস, বেঁচে ফিরতে পারবি না।’

মাথার সাথে রিভলবার দেখে আঁৎকে উঠল ইমতিয়াজ। সত্যিই গুলি করে দিবে না তো? তার বাচ্চাকাচ্চার কী হবে? বউয়ের কী হবে? জাদীদের চোখমুখই বলে দিচ্ছে, সে আজ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতদিন অনেক অত্যাচার করলেও লিমিট মেপে করেছে, যেন প্রাণে না মরে। কিন্তু আজ! অতিরিক্ত ক্ষোভ থেকে গুলি ছুঁড়তে দু’বার ভাববে না। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল ইমতিয়াজ। বলল,

‘আমার কাছে কোনো ঠিকানা নেই। আমি জানি না উনি কোথায় থাকেন।’

জাদীদ হাসলো। ট্রিগারে আঙুল চেপে বলল,
‘মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ। ওয়ান, টূ…।’

ইমতিয়াজ এরমধ্যেই বলল,
‘একটা ক্লু দিতে পারি আমি।’

চোরা হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে জাদীদ বলল,
‘কী?’

‘আমাদের বেশকিছু ফেইক আইডি আছে। ফেসবুকে একটা প্রাইভেট গ্রুপ আছে। সেখানে আমরা চোরাচালানের কাজ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, এগুলো নিয়ে আলোচনা করে থাকি। আমি আমার ফেইক আইডির পাসওয়ার্ড ও ইমেইল অ্যাড্রেস দিচ্ছি। আমার মনে হয়, এর মাধ্যমেই আপনি জাহাঙ্গীর ভাইকে খুঁজে পাবেন। সত্যি বলতে, ভাইকে সরাসরি আমরা কেউই দেখিনি। বিশ্বস্ত কেউ না হলে ভাই কারও সামনে আসেন না।’

‘চাঁদাবাজি করার সময় সাধারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দেস কী করে?’

‘আমরা মুখোশ পরে যাই। সঙ্গে সবসময়ই ধারালো অস্ত্র থাকে। তাই কেউ সাহস নিয়ে কিছু বলতে পারে না। প্রাণের মায়া সবারই আছে।’

নিজের ফোন থেকে ফেইসবুক অ্যাপে ইমতিয়াজের দেয়া ইমেইল ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করল জাদীদ। একটা ফেইক আইডি শো করল। নাম দেখা গেল, অচিনপুরের রাজকুমার। মুখভরা হাসি নিয়ে জাদীদ বলল,

‘নিজেকে এখনও রাজকুমার ভাবিস?’

মারামারি বাদ দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে আরামসে চেয়ারে বসল জাদীদ। ফেইসবুক আইডি থেকে ম্যাসেঞ্জারে লগইন করল। ভেতরে থাকা চ্যাটবক্স ওপেন করে আগেপিছে আসা বেশকিছু চ্যাট দেখে নিশ্চিত হলো, তথ্যটা ভুল নয়। প্রাণে বাঁচার একটা সুযোগ দিয়ে হাতের বাঁধন খুলে তার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করে বাড়ির পথে রওনা দিল জাদীদ। ইচ্ছে ছিল, রাতের বাসে রাজশাহী গিয়ে শুভর জানাযায় শরীক হবে। সাথে আদিয়ানকেও নিবে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে, ইমতিয়াজের সাথে তর্কবিতর্ক করতে গিয়েই রাত হয়ে গেল দশটা। সে বাড়ি ফিরে দেখল, মাজেদা খাতুন বাসায় নেই। তার বাবা রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। বাবাকে খুব বেশি ঘাটাল না। বিরক্ত করল না। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে অল্প একটু খেয়ে বাইক নিয়ে তড়িঘড়ি আদিয়ানের ফ্লাটে রওনা দেয়ার আগে বাবাকে বলল,

‘ঘণ্টাখানেক একা থাকতে পারবে না?’

জাদীদের বাবা জুনায়েদ আহমেদ সম্মতি জানালে দেরী করে সময় নষ্ট করল না জাদীদ। কয়েক মিনিটের ড্রাইভে দ্রুতই চলে এলো মোজাম্মেল হক্বের অ্যাপার্টমেন্টে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কলিংবেল চাপার আর দরকার হলো না। সম্পূর্ণ দরজা খোলা। আশেপাশের ফ্লাটের মেয়ে ও প্রৌঢ়বয়সী নারীরা আসছেন, রুমঝুমকে দেখছেন, কিছুসময় বসে মুখভার করে দু’একটা দুঃখের গল্প শোনাচ্ছেন। ফের চলে যাচ্ছেন। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই রুমঝুমের রুমের দিকে চোখ গেল তার। সদ্যবিধবা রমণীর ঘরে উঁকি দেয়া অনুচিত। পরপুরষের সেখানে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। আদিয়ান নিজেও মোজাম্মেল হক্বকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তবে দূর থেকে একপলক সাদা পোশাকের আস্তরণে বন্দী থাকা অল্পবয়সী এই মেয়েটাকে দেখে বহুদিন পর স্মৃতির পর্দায় আরও একটা চেহারা উঁকি দিল। যে ছিল তার প্রথম বিশ্বাস, প্রথম ভরসা, প্রথম ভালোবাসা। বেকার ছিল বলে সেই ভালোবাসাকে ধরে রাখার ক্ষমতা তার ছিল না। ট্রেনিং শেষ করে যখন বাবা-মাকে সাথে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে গেল, সেদিন জানল তার ভালোবাসার মানুষটা প্রেগন্যান্ট। অন্যকারও স্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি তার বাচ্চার হবু মা-ও। বুকের পাজর সেদিনই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল তার। প্রিয়জন এই সত্যিটা একবার তাকে জানাল না পর্যন্ত! কী নিষ্ঠুর নিয়তি! এরপর আর এই দু’চোখে কোনো নারীই ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে আসতে পারেনি। তাদের ফ্লাটে রুমঝুমকে দেখে প্রথমেই তার হারিয়ে যাওয়া প্রাক্তনের কথা মনে পড়েছিল। দুটো চেহারায় কী অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিল সে! প্রথমে তো বোকা হয়ে গিয়েছিল রুমঝুমকে দেখে। পরক্ষণেই আস্তেধীরে সম্পূর্ণ চেহারা দেখে, রঙের তারতম্য আবিষ্কার করে, এবং কণ্ঠস্বরের পার্থক্য বুঝতে পেরে নিজেকেই একগাদা বকে দিয়েছিল। অথচ আজ, না চাইতেও অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে রইল জাদীদ। এক আকাশসম বিষাদ, বেদনা, যন্ত্রণা ও হাহাকারেভরা অপ্রাপ্তি যেন ওই মায়াবী মুখের সাথে মানানসই নয়। বুকছিঁড়ে কিছু আর্তনাদ বেরিয়ে এলে সেসবকে অতি সন্তর্পণে লুকিয়ে, দূরে থেকেই মাজেদা খাতুনকে ডাকল,

‘মা… একটু এদিকে আসবে?’

মৌমিতা তখনও রুমঝুমের পাশে বসে আছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাইরে থেকে পুরুষের গলার আওয়াজ শোনেই ওড়না দিয়ে মাথার চুলগুলো ঢেকে দিল সে। বড়োসড়ো একটা চাদর দিয়ে সম্পূর্ণ শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ ঢেকে দিল। তবুও দূর থেকে স্পষ্ট দেখল, রুমঝুমের হাতে চুড়ি নেই, নাকে নাকফুল নেই, সম্পূর্ণ মুখটা মলিন হয়ে আছে। চোখদুটো ফুলে ঢোল। চোখের ঘনকালো পাপড়ি ভিজে একাকার। বেখেয়ালিতে আজ একটু বেশি-ই সদ্যবিধবা রমণীকে দেখছিল জাদীদ। হুঁশে ফিরতেই চট করে সরে পড়ল। বিরক্তিতে কপাল চেপে ধরতেই মাজেদা খাতুন ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘ডাকলি কেন?’

জাদীদ বলল,
‘বাবা বাসায় একা।’

‘বকাবকি করেছে?’

‘না… বকবে কেন? যদি কিছুর প্রয়োজন হয়? জানোই তো, মাঝেমধ্যে বাবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। এই ঠাণ্ডায়…।’

মাজেদা খাতুন বিষণ্ণমনে বললেন,
‘ঝুমকে একা ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না।’

জাদীদ ভেবে দেখল, রুমঝুমকে একা ফেলে যাওয়া রিস্কের। যদি তার বোনের মতো এই মেয়েটাও এখন ভুল স্টেপ নেয়? সে ভেবেচিন্তে বলল,

‘ঠিক আছে, তুমি থাকো। আমি চলে যাচ্ছি।’

‘এসেছিলি কেন?’

‘আদির সাথে দরকার।’

জাদীদ মাকে রুমঝুমের পাশে পাঠিয়ে আদিয়ানের পাশে এসে বসলো। নিজের মোবাইলে লগইন করা ইমতিয়াজের ফেইক অ্যাকাউন্ট দেখিয়ে ও ম্যাসেঞ্জারের সব কথাবার্তা দেখিয়ে বলল,

‘একটা দারুণ প্লান এসেছে মাথায়।’

রাত হওয়াতে মোজাম্মেল হক্ব বিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজের ফ্লাটে। আদিয়ান ও জাদীদ আলোচনায় মনোযোগ দিল। অ্যাকাউন্ট দেখিয়ে জাদীদ বলল,

‘এখানে টোটাল বিশটা ফেইক আইডি। ধরে নিতে হবে, এই বিশটা আইডির আড়ালে বিশজন আছে। এই বিশজনকে হাতের নাগালে আনতে হলে, ছোট্ট একটা টোপ ফেলতে হবে।’

‘যেমন?’

জাদীদ নিজের প্লান শেয়ার করলে আদিয়ান বিস্মিত দৃষ্টি নিয়েই সব কথা শুনল। এরপর জানতে চাইল,
‘আমাকে দিয়ে এই কাজটা হবে? ওরা যদি কেউ সন্দেহ করে?’

‘করবে না। আমি আছি। আমাদের প্রথম টার্গেট রাসেল। মনে সাহস রাখো। পারতেই হবে। এই একটা প্লানের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরের সম্পূর্ণ দলকে ছিঁটকে দিতে পারব।’

‘ঠিক আছে। তুমি যা বলবে।’

জাদীদের কাছে পুরনো, অব্যবহৃত বেশকিছু সিম ছিল। তারমধ্যে কয়েকটা সিম আদিয়ানকে দিল, কিছু নিজে রাখল। যতক্ষণ ওখানে বসেছিল, ততক্ষণই বিভিন্ন নাম ও এলাকার ঠিকানা দিয়ে, কয়েকটা ফেইক আইডি খুলে ফেলল।

***

পরদিন সকালেই রুমেলকে নিয়ে আদিয়ানের নতুন ফ্লাটে এসে উপস্থিত হলেন আলেয়া বেগম। ছেলের দিকে ফিরেও তাকালেন না তিনি। সোজা রুমঝুমের কাছে গেলেন। অসুস্থ শরীর বলে রাতের শেষপ্রহরে তাকে জোরপূর্বক ঘুম পাড়িয়েছেন মাজেদা খাতুন। আলেয়া বেগমকে দেখে জানতে চাইলেন,

‘আপনার আসতে এত দেরী হলো, আপা? মেয়েটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না।’

আলেয়া বেগম রাগে ফুঁসছিলেন। ছেলের এসব বোকাবোকা কাণ্ড তিনি ক্ষমার চোখে দেখতে তো পারছেন না, এরমধ্যে রুমঝুমের এই দশা। তারমধ্যে আবার রাশেদুজ্জামান সব সত্যি জেনে একটা কথাই বলেছেন, এই মেয়েকে তিনি ত্যাজ্য করেছেন। মেয়ে যদি কোনোদিন মরেও যায়, তবুও তার লাশ তিনি দেখবেন না। পুরোদিনেও ভাইজানকে বোঝাতে পারেননি তিনি। কিছু বললেই, রাগারাগি করেন, গালাগালি করেন। আলেয়া বেগম ভাইকে এ-ও বলেছেন, এই অপরাধের জন্য আদিয়ানকে তিনি যথেষ্ট শাস্তি দিচ্ছেন, প্রয়োজনে আরও দিবেন। তখুনি রাশেদুজ্জামান বলেছিলেন,

‘এই দুটোর অপরাধ ক্ষমা করার মতো নয়। দু’জনেই আমার বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছে। আমার সম্মান নষ্ট করেছে। ক্ষমা করা তো দূর, ওদেরকে আমি আর এই বাড়িতেই জায়গা দেব না।’

ভাই যে এক কথার মানুষ সেটা আলেয়া বেগম জানেন। এরপর আর তিনি কীভাবে ভাইকে বুঝাবেন, কোনো পথ খুঁজে পাননি। তাই রুমেল কাজ থেকে ফিরলে, সব কথা তার সাথে আলোচনা করে, রুমঝুমকে দেখতে এসেছেন। মাজেদা খাতুনের কথার উত্তরে এত কথা না বলে তিনি শুধু বললেন,

‘অভাগী, নিজের কপাল নিজেই পুড়িয়েছে। ভাইজানের কত ইচ্ছে ছিল, আদির সাথে ওর বিয়ে দিবেন। কিন্তু দুটোয়, সব ইচ্ছে ও আশাতে জল ঢেলে দিল। শুধু জল ঢালেনি, মানইজ্জত সবকিছু নষ্ট করে দিয়েছে। বাড়ির মানুষের কাছেই মুখ দেখানো লজ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমিও আসতাম না, শুধু রুমঝুমের জন্য এলাম। মেয়েটাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি, এই অবস্থায় একা ছাড়তে পারি না। মা তো, কলিজায় লাগে।’

কথা বলে তিনি আলগোছে রুমঝুমের গায়ে হাত রাখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলেন। ঔষধের কারণে ঘুম চোখে গাঢ় হয়ে গেছে। তাই ফুপির এই আদর টের পেল না রুমঝুম। আদিয়ান মায়ের কাছে এসে বলল,

‘তুমি এখনও আমার ওপর কেন এত রেগে আছো, আম্মি? আর কতবার তোমার কাছে ক্ষমা চাইব আমি? মানুষ মাত্রই তো ভুল হয়, তাই না? আমাদেরও হয়েছে। আমরা সেটা স্বীকার করে নিয়েছি। তারপরও তোমার এত কীসের অভিমান বলবে?’

আলেয়া বেগম ছেলের কথার উত্তর দিলেন না। মুখ ফিরিয়ে রুমঝুমের দিকেই তাকিয়ে রইলেন। আদিয়ান মায়ের পাশে বসে দু’হাত আলগোছে আঁকড়ে ধরে বলল,

‘প্লিজ, আম্মি। এমন করে মুখ ফিরিয়ে থেকো না। আমি তোমায় ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন এমন কোনো কাজ করব না, যা তোমার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ট্রাস্ট মি…।’

এবার ছেলের দিকে তাকালেন আলেয়া বেগম। কতদিন পর, আদরের সন্তানের চোখমুখ দেখে তার ভেতরের অনুতাপ বুঝতে পেরে চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

‘তোর বড়ো মামা খুব কষ্ট পেয়েছেন। রুমঝুমকে ত্যাজ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর বলেছেন, তোরা কেউ যেন আর ওই বাড়িতে পা না রাখিস।’

‘ঠিক আছে, রাখব না।’

‘বললেই তো হয় না। ঝুমের এখন কী হবে? দায়িত্ব নিবি ওর? বিয়ে করবি ওকে? সারাজীবন পাশে থাকবি ওর?’

আদিয়ান আঁৎকে উঠে মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘এই অসম্ভব কাজ আমাকে করতে বোলো না, আম্মি। আমি মরে যাব তা-ও ঝুমকে…। ছিঃ… ও আমার ছোটো বোনের মতো। সেই ছোটোবেলা থেকে ওকে আমি ভাইয়ের মতো স্নেহ-মমতা দিয়ে আগলে রেখেছি, খারাপ চোখে তাকাইনি, আর আজ… তুমি এটা কী করে বলছ? তুমি তো জানো, ঝুমকে নিয়ে এসব ভাবনাকে মনে ঠাঁই দিতে পারি না।’

‘কিন্তু তারপরও আমি চাইব…।’

‘না আম্মি, তোমাদের চাওয়া তোমরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না। আমরা কী চাই, সেটা কোনোদিন বুঝোনি, এবার অন্তত বুঝো। ঝুম ও আমি, আমরা কেউ কাউকে চাই না। আমাদের মধ্যে এরকম চিন্তাভাবনা নেই। বরাবরই দুটো মানুষ দু’জনকে চেয়ে এসেছি। কখনও…।’

‘তাহলে ওর কী হবে?’

‘তুমি যদি চাও, আমি সারাজীবন ওর ভালো বন্ধু ও একজন ভরসার সঙ্গী হয়ে পাশে থেকে যাব, কিন্তু বিয়ে করতে পারব না, আম্মি। প্রয়োজনে ভালো পাত্র খুঁজে আবার বিয়ে দেব, তবুও আমি আমার মনের সাথে বেঈমানী করতে পারব না।’

ছেলের মনের খবর অজানা ছিল না আলেয়া বেগমের। অনেকদিন আগেই বলেছিল, ‘আম্মি, আমার একটা মেয়েকে পছন্দ।’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘পছন্দ তো ভালোবাসি জানিয়ে দে। দেরী করছিস কেন?’ আদিয়ান বলেছিল, ‘বলে দেয়া এত সহজ নয়, আম্মি। তার ও আমার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।’ এজন্যই ছেলে যেদিন রুমঝুমকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে বলেছিল, তারা বিয়ে করেছে, তিনি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু এরপর ভেবেছেন, হয়তো মন পরিবর্তন হয়েছে তাই ঝুমকেই বিয়ে করেছে। ছেলে এখনও মনের কথা মুখফুটে বলতে পারেনি, আর পারবেও না। এতদিন ছেলের সাথে কথা না হলেও রুমঝুমের সাথে কথা হতো। তোফাজ্জল হোসেন কীভাবে তার ছেলেকে অপমান করেছেন, সেটাও তিনি জানেন। তাই জেনে-বুঝে ছেলের জীবন তিনি নষ্ট হতে দিবেন না, এবং ওই বড়োলোক বাবার মেয়েকেও তিনি পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিবেন না। ছেলেকে তিনি অমানুষ, কাপুরুষ ও ভীতু বানাননি যে, ভালোবাসার মানুষকে না পেলে তারজন্য হাহাকার করবে। প্রয়োজনে চিরদিন না পাওয়ার দুঃখ বুকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিবে, তবুও নিজের সম্মানে ছিঁড় ধরতে দিবে না। তাই তিনি শীঘ্রই ছেলের মন ফিরানোর ব্যবস্থা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ভেবেচিন্তে বললেন,

‘ঠিক আছে, ঝুমকে নিয়ে তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি, সেটাই হবে। আমি আর কোনো দ্বিমত করব না। কিন্তু আজ তুই আমাকে একটা কথা দিবি। এতে তুই খুব সহজেই ক্ষমা পেয়ে যাবি।’

‘কী?’

‘আমি চাই, তুই খুব শীঘ্রই রাঙামাটি চলে যা। সবসময়ের জন্য। ঢাকার এই চাকরি-বাকরির কোনো দরকার নেই।’

‘কেন আম্মি?’

‘আমি তোর ছোটাম্মির সাথে অনেক আগেই আলাপ করে রেখেছি।’

‘কোন বিষয়ে?’

‘তোর বিয়ে নিয়ে।’

আদিয়ান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আলেয়া বেগম ছেলের হাত নিজের মাথার ওপর রেখে বললেন,
‘আমার মাথায় হাত ছুঁয়ে একটা কথা দিবি এখন।’

‘কী কথা, আম্মি?’

‘খুব শীঘ্রই তুই বিয়ে করবি। রাঙামাটিতেই ঘর-সংসার শুরু করবি। যার মায়ায় তুই ডুবে আছিস, তাকে সারাজীবনের জন্য ভুলে যাবি। বল, আমার কথা মেনে নিবি? যদি না মানিস, আমি মরে-পঁচে গেলেও তুই আমার সামনে যাবি না।’

‘এ কেমন শাস্তি, আম্মি? একটা ভুলের জন্য তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারছ?’

‘আমার সন্তানের সুখের জন্য আমি সব করতে পারি।’

‘কিন্তু আমার সুখটা যে ওই একজনের মাঝেই।’

‘এটা তোর ভুল ধারণা। সাময়িক মোহ। বিয়ের পর এই মোহ কেটে যাবে। তুই রাঙামাটি যাওয়ার পরপরই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।’

আদিয়ান হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘এখন এসব কথা থাক, আম্মি। পরে কোনো একসময় এই নিয়ে কথা হবে।’

‘আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত তোর। তুই যদি ওই মেয়েকে চাস, আমাকে ত্যাগ কর। আর যদি তোর আম্মিকে চাস, তাহলে ওই মেয়েটাকে ত্যাগ কর।’

এরকম একটা পরিস্থিতিতে মায়ের এই কথাগুলো বিষাক্ত কাঁটার যন্ত্রণার চেয়েও দ্বিগুণ যন্ত্রণা হয়ে বুকে চেপে বসলো। তার মন তো জানে, নওমীকে সে ভালোবাসলেও, তার ভালোবাসা কখনওই হতে পারেনি, পারবেও না। দু’জনের মধ্যে যে পার্থক্য, যে দূরত্ব, সেটুকু ডিঙিয়ে এক হওয়া সম্ভব নয়। তখনই সম্ভব হতো, যদি নওমী তাকে চাইত। কিন্তু…। মনকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও মাকে আর হারাতে ইচ্ছে হলো না আদিয়ানের। জীবনে বাবার আদর খুব কমই পেয়েছে। যতটুকু পেয়েছে, সেটুকুও আবছা। মায়ের আদর-শাসনের খুব প্রয়োজন এখন। যাক না ভালোবাসা দূরে, হারিয়ে যাক চিরতরে, মনের এককোণে সে না হয়, ভীষণ যত্নে আমৃত্যু থেকে যাবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে দু’হাতে মাকে জড়িয়ে ধরল আদিয়ান। ভাঙাগলায় বলল,

‘তুমি যা চাইবে, তা-ই হবে, আম্মি। তোমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করব আমি। তবে একটা কথা, যদি কোনোদিন দেখো, মানসিক বন্ধনটা পাকাপোক্ত হয়নি বলে, ছেলে অসুখী, সেদিন আফসোস কোরো না।’

আলেয়া বেগম শান্তস্বরে বললেন,
‘এমন দিন না আসুক আমার ছেলের জীবনে। এখন বল, যাবি তো রাঙামাটি?’

‘হ্যাঁ, যাব। কিন্তু এখুনি নয়। এখানে জাদীদের সাথে কিছু কাজ আছে, সেসব শেষ করে, ঝুমকে একটা সুস্থ ও সুন্দর জীবন দিয়ে, ওর বাচ্চাকে নিরাপদ একটা আশ্রয় দিয়ে, তারপর যাব।’

***

সারারাত এক অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করেছে নওমী। ঘুম হয়নি। যতবার চোখ লেগেছে, ততবারই শুভর মৃতদেহ, রুমঝুমের কান্না চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে বুকের ব্যথা বাড়িয়েছে। মানুষ দুটো তার আপন কেউ নয়, তবুও ওই দুটো মানুষের কথা ভাবতে গিয়ে মনের শান্তি হারিয়ে ফেলেছে। সেদিন শুভর দেয়া সেই চিরকুট সামনে ধরলেই মন বার বার বলছে, যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য সে দায়ী। আর এইটুকুই মনের সব স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। একটা মানুষ তারজন্য, তাকে বাঁচানোর জন্যই এতদিন জাহাঙ্গীরের লোকজনের চোখে ধুলো দিচ্ছিল। ফল কী দাঁড়াল? তার নিজের প্রাণটাই না-ই হয়ে গেল। সকাল হতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে, রুমঝুমকে দেখতে যাবে। এজন্য নাশতা না করেই তৈরী হয়ে বের হতে যাবে, তখুনি বাবার কড়া শাসনের সামনে পড়ে গেল নওমী। তোফাজ্জল হোসেন মেয়েকে এত তড়িঘড়ি বাইরে যেতে দেখে বললেন,

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘রুমঝুমকে দেখতে।’

‘কোনো প্রয়োজন দেখছি না। ঘরে থাকো। পড়াশোনা কোরো। সামনে তোমার এ্যাক্সাম।’

‘মানুষ কি শুধু প্রয়োজনের জন্যই? ওই মেয়েটা কেউ নয় আমার। ওর স্বামীও আমার কেউ হয় না। কিন্তু তবুও, ওই মানুষটা আমার জন্য যা করেছে, তার ঋণ একজীবনে শেষ হওয়ার নয়, বাপি।’

‘তুমি আমার একমাত্র মেয়ে। আমাকে তোমার কথা ভাবতে হবে। আমি তো তোমাকে হারিয়ে ফেলতে পারব না। যখন-তখন বাইরে বের হওয়া বাদ দাও। আর কতদিন পুলিশ তোমাকে পাহারা দেবে?’

‘আমি কোনো পাহারার প্রয়োজন দেখছি না। কেউ যদি আমাকে মেরে ফেলতে চায়, মারুক। আমার মৃত্যু যদি ওইভাবে লেখা থাকে, হোক। যে জীবনে চলতে পথে প্রতিমুহূর্ত পাহারা নিয়ে বাঁচতে হয়, সেই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ আমার চলে গেছে। কে এই জাহাঙ্গীর তুমি বলবে না। কেন আমাকে মারতে চায়, এ-ও বলবে না। অথচ প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ ডানে-বামে পুলিশ নিয়ে চলতে হবে। কেন? আমার অন্যায়টা কী? কেন ওই লোকটা আমায় মারতে চায়? তার যদি এতই শখ, বাড়ি এসে মারুক আমাকে। মেরে ফেলুক। আমাকে মারলে তো তার সব খেলা শেষ হয়ে যাবে, তাই না? আর কোনো নিষ্পাপ প্রাণকে কেড়ে নিতে হবে না। আর কোনো অবুঝ মেয়েকে বিধবা হতে হবে না। আমাকেই মারুক। এতে যদি লোকটা শান্ত হয়।’

এরপর বাপির দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘খবরদার বাপি, আজ যদি আমার আশেপাশে সিকিউরিটি দিয়েছ তো, ভালো হবে না।’

রেগেমেগে ওই অবস্থাতেই বেরিয়ে গেল নওমী। তোফাজ্জল হোসেন তড়িঘড়ি জাদীদকে বিষয়টা জানিয়ে রাখলেন। জাদীদও যথাযথ ব্যবস্থা নিবে বলে তাঁকে নিশ্চয়তা দিল।

সকাল নয়টার দিকেই বান্ধবীর বাসায় পা রাখল নওমী। মৌমিকে সাথে নিয়েই রুমঝুমকে দেখতে এলো। ফ্লাটে এখন বেশি কেউ নেই। জাদীদ, তার মা, আদিয়ান ও আলেয়া বেগম। এনারাই। রুমঝুম ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। ফোলা ফোলা মুখটা পানিতে ভিজিয়ে এসে বসেছে সবে। এখনও খায়নি। নওমী তার পাশে বসে ভালোমন্দ দু’একটা কথা চালিয়ে গেল। গল্পের ছলে রুমঝুমের মন খারাপ ভাব দূর করার চেষ্টা করল। মাজেদা খাতুন নাশতা নিয়ে এলে, রুমঝুম বলল,

‘খাব না আন্টি, ক্ষিধে নেই আমার।’

ভদ্রমহিলা জোরাজুরি করলেও কিছুই মুখে তুলল না রুমঝুম। নওমী খাবার রেখে তাকে বুঝানোর বাহানায় বলল,
‘না খেলে বাচ্চাকে ভালো রাখতে পারবে? ওর কথা ভাবতে হবে তো তোমায়। ওর জন্যই বাঁচতে হবে তোমাকে।’

রুমঝুম আবারও কান্না জুড়ে দিল। নওমী তাকে বুঝিয়ে, নিজেই মুখে তুলে খাইয়ে দিল। ঔষধ খাওয়াল। অচেনা এই মেয়েটির এত আদর-যত্ন ও অন্যের প্রতি মায়া-মমতা দেখে আলেয়া বেগম যথেষ্ট অবাক। নাশতা খাওয়ানো শেষ হলে হাতের ঘড়ি দেখে নওমী বলল,

‘আমার গ্রুপ স্টাডি আছে। নয়তো আরও অনেকক্ষণ বসতাম। এখন আমি যাই। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।’

মনমরা মুখ নিয়ে রুমঝুম মাথা নাড়ল শুধু। মৌমিতা, জাদীদ ও আদিয়ানের সাথে বসে গল্প করছিল। নওমী ড্রয়িংরুমে এসে বান্ধবীকে এসে বলল,
‘দেরী হয়ে যাচ্ছে, চল যাই।’

ওরা উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে পা রাখলে, আলেয়া বেগম এসে আদিয়ানের কাছে জানতে চাইলেন,

‘ওই মেয়েটা কে রে, আদি?’

আদিয়ান বলল,
‘মৌমির বেস্টফ্রেন্ড।’

‘শুধু কি এই কারণেই এলো?’

‘রুমঝুমের সাথে তার ভালো সম্পর্ক আছে, আম্মি।’

‘ওহ, নাম কী মেয়েটার? ভীষণ মায়াবী।’

নওমী নাম শুনলেই যে আলেয়া বেগম চ্যাঁত করে উঠবেন, সেটা আদিয়ান খুব ভালোমতোই বুঝল। আম্মি যেন কোনোকিছু সন্দেহ না করেন, এজন্য বলল,

‘তানজিদা হোসেন।’

আলেয়া বেগম আর কিছু জানতে চাইলেন না। থানায় যেতে হবে, তাই জাদীদ বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালে, কী ভেবে যেন আদিয়ানও উঠল। দু’জনে একসাথে নিচে এসে দেখল, দুই বান্ধবী তখনও গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। জাদীদ এরমধ্যেই বাইক নিয়ে চলে গেল। আদিয়ান গেটের কাছে এসে নওমীকে উদ্দেশ্য করে ডাকল,

‘একটু শুনবেন?’

অসময়ে আদিয়ানকে দেখে খানিকটা অবাকই হলো নওমী। দু’পা হেঁটে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘কিছু বলবেন?’

আদিয়ান উপরনিচ মাথা নেড়ে মায়ের কথাগুলো মাথায় রেখে বলল,
‘আপনি আর এখানে আসবেন না, প্লিজ।’

চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে এলো নওমী। বিস্মিয় নিয়ে বলল,
‘কেন? এটা আমার বান্ধবীর বাসা। আমি এখানে আসব কি আসব না, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’

‘হ্যাঁ আপনার বান্ধবীর বাসায় আপনি আসতেই পারেন। এটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু বলছি যে, আপনি আমাদের ফ্লাটে যাবেন না।’

মা কোনোভাবে নওমীকে সন্দেহ করেন, তাকে খারাপ ভাবেন, গালিগালাজ করে অপমান করেন, এটা আদিয়ান চায় না। মায়ের কাছে নওমী শুধু তার নামেই পরিচিত, চেহারায় নয়। এজন্যই আজ চিনতে পারেননি। সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘জাহাঙ্গীরের লোকজন আপনাকে সবসময় চোখে চোখে রাখছে, এটা তো আপনি জানেন। কেন খামোখা ওদের সন্দেহ বাড়াতে ঝুমের কাছে আসবেন? এতে আপনার ও ঝুমের, দু’জনেরই বিপদ।’

‘শুধু কি এটাই কারণ?’

‘হুম…।’

‘আমার মৃত্যু যদি ওভাবে লেখাই থাকে, সেটা আমি আটকাব কী করে? আজ না হোক কাল, মরতে তো হবেই।’

কথা শেষ করতে পারল না নওমী। মুহূর্তেই তার ঠোঁটের ওপর হাত চেপে রাখল আদিয়ান। আঙুলের সাহায্যে কথা বলা বন্ধ করে দিল। অভাবনীয় এই কাণ্ডে নিজেও বিব্রতবোধ করল আদিয়ান। চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,

‘স্যরি…। প্রতিটা মানুষেরই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। আপনি কেন অযথাই সবকিছুকে জটিল করতে চাইছেন? এখানে আসলে আপনি বিপদে পড়বেন। নিজের জীবনের প্রতি মায়া নেই আপনার? আপনাকে বাঁচতে হবে, এটা আপনি বুঝতে পারছেন না?’

নওমী তখনও অবাক, হতবাক। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে সে। এত কথার উত্তরে কী বলা উচিত, সেটাও যেন তার মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারল না। কেমন করে তাকিয়ে রইল। একদৃষ্টিতে। তবুও ওই দু’চোখের ভাষা মন দিয়ে পড়তে পারল না। ওভাবে চেয়ে থেকেই বলল,

‘কেন বাঁচতে হবে? মরে গেলে কী হবে?’

আদিয়ান নিজেও যেন আর নিজের মধ্যে নেই। প্রশ্নের উত্তরে একইভাবে বলল,
‘কেউ একজন আছে, যে প্রতিমুহূর্তে প্রার্থনা করে, আপনি একটা সুন্দর জীবনের দিকে এগিয়ে যান। এই দেশে এটা সম্ভব নয়, তাই পরিপূর্ণ একটা সুন্দর জীবন গঠনের জন্য, শীঘ্রই আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। আপনার যদি কিছু হয়, তার অনেক কষ্ট হবে। বেঁচে থাকাটাও বৃথা হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষই চায়, তার প্রিয়জন ভালো থাকুক। সে-ও চায়, দূরে গিয়ে হলেও আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ ও সুন্দর জীবন নিয়ে বেঁচে থাকুন।’

‘কে সে? কোথায় থাকে? কী নাম তার? আমি দেখতে চাই তাকে। বুঝতে চাই। আমার জন্য কেন তার কষ্ট হবে, এটাও জানতে চাই। বলুন আমাকে। কে হয় সে আমার? আমার জন্য এত কীসের চিন্তা তার? কেন এত টান?’

দিকদিশা হারিয়ে ফেলার মতো যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে গেল আদিয়ান। মনের কথা মুখফুটে বলার কষ্টের চেয়ে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলার কষ্টটা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল তার হৃদপিণ্ডকে। একটা সময় চেপে রাখতে না পেরে নওমীর চোখের তারায় চেয়ে চেয়ে স্পষ্টবাক্যে উচ্চারণ করল,

‘হি লাভস্ ইউ, নওমী। লাভ্ লাইক ক্রেইজি। বাট ইউ ডোন্ট নোও হিম। ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হিজ লাভ্। ইফ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড লাভ্ দ্যান ইউ ক্যান নোও হিম ঠু।’

***

চলবে…