#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২২
কেউ তাকে ভালোবাসতে পারে, তার জন্য প্রার্থনা করতে পারে, তার সুখ ও সুন্দর জীবন চাইতে গিয়ে দূরে সরিয়ে দিতে পারে, এই কথাগুলো বোধগম্য হওয়ার পরই সেই মানুষটাকে আরও ভালোভাবে জানার জন্য, বোঝার জন্য, চেনার জন্য, মরিয়া হয়ে উঠল নওমী। তারমধ্যেই আদিয়ানের ওই কথাগুলো তার হৃদপিণ্ডকে ছলকে দিল একদম। না জানলে মন শান্ত হবে না, এটা বুঝতে পেরে সে-ও ঠিকই একই স্বরে জেদ ধরে বলল,
‘এতকিছু যখন জানেন, তাহলে তার নামটাও নিশ্চয়ই জানেন।’
আদিয়ান বলল,
‘হ্যাঁ, জানি।’
‘বলছেন না কেন?’
‘বলা নিষেধ।’
‘কেন?’
‘সে চায় না আপনি তাকে চিনতে পারুন।’
‘না চিনলে তাকে জানব কী করে, বুঝব কী করে?’
‘জানতে হবে না, বুঝতেও হবে না।’
নওমী অধৈর্য্য হয়ে বলল,
‘সে কোথায় থাকে সেটা অন্তত বলুন।’
আদিয়ান বেশ মজা পেল নওমীর এই ছেলেমানুষী কথাবার্তা শোনে। দুষ্টুমি করে বলল,
‘সে তো আপনার আশেপাশেই থাকে, আপনি মনের চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন না বলেই চিনতে পারছেন না।’
চট করে নিজের চারপাশে ভালোমতো চোখ বুলিয়ে কাউকে না পেয়েই রেগে গেল নওমী। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ইয়ার্কি মারছেন আমার সাথে?’
মুখ ফুলানো এই অভিমানী কথাটা ভীষণ আনন্দ দিল আদিয়ানকে। শব্দ করে হেসে উঠল সে। নওমী অবাক হয়ে বলল,
‘আশ্চর্য! আপনি হাসছেন?’
‘আপনি যেভাবে তাকে খুঁজছেন, যেন সে এখানেই আছে।’
‘আপনিই তো বললেন, সে আমার আশেপাশে আছে।’
‘হুম বলেছি। কিন্তু এখানে আছে সেটা তো বলিনি।’
নওমীর খুব রাগ হলো। ছেলেটা ইচ্ছে করেই তাকে বোকা বানাচ্ছে। কতক্ষণ রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে মুখ ভেংচিঙে বলল,
‘ভীতু লোকটাকে জানার দরকারও নেই আমার। বোঝারও দরকার নেই। আপনার সাথে যদি তার দেখা হয়, বলবেন সে যেন আমার অপেক্ষা না করে।’
আদিয়ান ঠিক একইভাবে বলল,
‘করবে না তো। অপেক্ষা করার সব পথ বন্ধ।’
মজা করে বললেও, এই কথা শোনে বড্ড মন খারাপ হলো নওমীর। জানতে চাইল,
‘কেন?’
‘একদিকে মন, অন্যদিকে দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিছু ইচ্ছাকৃত ভুল, কিছু অপরাধবোধ, এই সবকিছুর চাপে পড়ে আপনার প্রেমিক মহোদয় বর্তমানে চ্যাপ্টা হয়ে আছেন। তাই আপনাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে তিনি দেবদাস হওয়ার মনস্থির করেছেন।’
আদিয়ান এমনভাবে রসিয়ে রসিয়ে বলছিল, বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না নওমীর। সব কথা শোনে নওমী বলল,
‘ওহ।’
আরও কিছু বলতে চাইছিল নওমী, এরমধ্যেই মৌমিতা ডাক দিল তাকে। রিকশা থামিয়েছে সে। ভার্সিটি পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে দেখে কোনো কথাই আর বলতে পারল না নওমী। রিকশায় উঠে দূর থেকেই বলল,
‘তাকে বলবেন, তিনি যদি সাহস করে আমার বাপির কাছে আমাকে চাইতে পারেন, তাহলে তাকে আর দেবদাস হতে হবে না। পারু নিজেই তাকে চ্যাপ্টা হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিবে।’
‘কিন্তু, সবকিছুর পরও দেবদাস ও পার্বতী কিন্তু আলাদাই ছিল। এক হতে পারেনি।’
নওমী কী রি’অ্যাক্ট করবে বুঝতে পারল না। দাঁতে দাঁত চেপে একটু জোরে বলল,
‘তার মনে যদি সাহসই না থাকে, তাহলে তাকে বলে দিন, সে যেন আমাকে ভুলে যায়। আমি কোনো ভীতু পুরুষের পার্বতী হতে রাজি নই।’
উপরনিচ মাথা নেড়ে কেবল একটুকরো হাসিই উপহার দিল আদিয়ান। ওই হাসি দিয়ে যে বুকের ভেতরের যন্ত্রণাগুলো লুকিয়ে ফেলল, বোকা মেয়ে তা জানতেও পারল না। রিকশা চোখের আড়াল হলে, অকারণ সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের ফ্লাটের দিকে পা বাড়াল সে।
***
গ্রুপ স্টাডি করতে এসে সেখানেও ঠিকঠাক মনোযোগ দিতে পারল না নওমী। আদিয়ানের কথাগুলোর চেয়ে ওর চেহারার ভাবভঙ্গির মধ্যে রহস্য ছিল বেশি। যতক্ষণ কথা বলছিল, বোঝা যাচ্ছিল, সে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু আড়াল করছে। গত কয়েকদিন আগেও যখন মৌমিতাদের ফ্লাটে দেখা হয়েছিল, সেদিনই আদিয়ান কিছু বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল। এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে সেই প্রথমদিনে ফিরে গেল নওমী। আশ্চর্যজনকভাবে আবিষ্কার করল, সেদিন দেখা হওয়ার পর থেকে ছেলেটার আচরণ অদ্ভুত হতে শুরু করেছে। শুধু অদ্ভুতই না, একটুবেশিই অদ্ভুত। এরপর রিংকি-পিংকির সামনে, সেখানেও রহস্যময় কথাবার্তা বলছিল। সেদিনের সেসব সহজ কথাগুলো যেন আজ দ্বিগুণ রহস্য হয়ে ধরা দিল নওমীর চোখের পর্দায়। অথচ প্রথমদিন কী উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল তাকে। দুর্ঘটনার পরও শরীরে ব্যথা নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে ছিল, হাসছিল। এত ভাবনার কারণে পড়াশোনার দিকে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারল না নওমী। যতক্ষণ বই সামনে ছিল, সে শুধু হু, না, হ্যাঁ, এরকম শর্টকাটে উত্তর দিয়েছে। পড়াশোনা নিয়ে এত অমনোযোগী আগে কখনও হয়নি সে। হুট করে প্রাণের বান্ধবীর কী হলো, ঠিক বুঝল না মৌমিতা। আড়ালে সবই খেয়াল করল সে। পড়াশোনা শেষে যখন ফেরার পথ ধরল, ফুটপাত ধরে একসাথে হাঁটতে শুরু করল দু’জনে। মৌমিতা বলল,
‘তোকে আজ একটুবেশিই অন্যমনস্ক লাগছে, নওমী।’
নখ কামড়ানোর অভ্যাস কোনোকালেই ছিল না নওমীর। আজ ভাবতে গিয়ে নিজেও যেন খুব বেশি অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বেখেয়ালিতে হাতের নখ কামড়ে হাঁটছিল সে। মৌমিতার কথা কানে আসাতে, আনমনেই বলল,
‘কেউ তোকে ভালোবাসে কি না এটা তুই বুঝবি কী করে?’
প্রেম-ভালোবাসা থেকে শতহাত দূরে থাকে যে মেয়ে, সে-ই মেয়ে এই কথা বলছে? শোনে মাথায় হাত চলে গেল মৌমিতার। অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘তুই বলছিস এই কথা?’
‘হ্যাঁ রে, বাবা। জানতে ইচ্ছে হয়েছে।’
‘আমার কাছে জানতে চাইছিস কেন? আমি যেন একশো একটা প্রেম করেছি!’
নওমী হতাশ হলো বান্ধবীর এই কথায়। চুপ থেকে হাঁটতে থাকল। মৌমিতা আবার বলল,
‘শুনেছি, চোখ না কি মনের আয়না। অনেক সময় মুখের কথা কেউ যদি মুখফুটে বলতে না পারে তাহলে তার চোখের ভাষায় অপ্রকাশ্য অনুভূতির তীব্রতা প্রকাশ পেয়ে থাকে। যদি মন দিয়ে তাকানো যায় আরকি। তবে সবার ক্ষেত্রে এমন হয় কি না, এটারও নিশ্চয়তা নেই। সব চোখ কি কথাবলা চোখ যে দেখা মাত্রই মনের ভাষা বুঝে নিতে পারবে? বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই বলে বেশিকিছু বলতে পারলাম না, দোস্ত।’
বান্ধবীর কথা শোনে আরও বেশকিছু পুরনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছিল নওমী। কোথাও যেন সবকিছুর মধ্যে একটা ছোট্ট ‘কিন্তু’ লুকানো, অথচ সে ধরতে পারছে না। কেউ তাকে ভালোবাসে, সেটা যে ভালোবাসে তার এসে বলা উচিত, আদিয়ানের মাধ্যমেই কেন বলবে? আবার কেনই বা আড়ালে থাকবে? উত্তর খুঁজতে মরিয়া নওমী পূণরায় আদিয়ানের কথার অর্থ ধরার চেষ্টায় ডুব দিল। মৃত্যুর কথা শোনে ছেলেটা তার ঠোঁটে হাত রেখেছিল, ওই সময় তার নিজেরও অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল, ঠিক সেদিনের মতো যেদিন প্রথম ট্রিটমেন্টের মুহূর্তে আদিয়ানকে ছুঁয়েছিল সে। নিজের মনের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে, মন কাউকে নিয়ে ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়ে আনন্দ পাচ্ছে, এটা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিল। মন তো আর পোষ মানে না, সে নিজের মতো করে ভাবনা সাজায়। সেই ভাবনায় কখনও হাসে, কখনও কাঁদে। সুখ সুখ ভাবনার কারণে, মনের আকাশে রঙ-বেরঙের শতশত প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় রোজ। কখনও কখনও সেই ভাবনাগুলোও মলিন হয়ে যায়, যদি কোনো কারণে মনের আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। নির্দিষ্ট একজনকে ঘিরে এই সুখ সুখ ভাবনা, হাসি-কান্নার নানান মিশ্রণের অনুভূতি কি ভালোবাসা? কে জানে! ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি নিয়ে নওমী নিজের বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি যদি বলি, কাউকে ভালোবাসি, তুই বিশ্বাস করবি?’
মৌমিতা এবার আকাশ থেকে টপকাল। বান্ধবীটার আজ হলোটা কী? কীসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শোনাচ্ছে। সে ঠোঁট উলটে বলল,
‘জীবনেও বিশ্বাস করব না।’
‘কেন?’
‘কারণ তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তোর না হওয়া বর, তোর জন্য অপেক্ষা করছে। এখন এই ভুলভাল চিন্তা বাদ দিয়ে, পড়াশোনায় মনোযোগ দে। লন্ডনে গিয়ে ওখানে সেটেল্ড হতে গেলে কিন্তু ভালো রেজাল্ট জরুরী।’
মনের আকাশে এবার সত্যি সত্যিই একখণ্ড কালোমেঘ এসে জমা হলো নওমীর। না তাকে সরানো গেল আর না গ্রহণ করা গেল। অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি ঘিরে ধরল তাকে। বলল,
‘মানুষ নিজের চাইতেও কি অন্য কাউকে বেশি ভালোবাসতে পারে?’
‘যারা ভালোবাসে তারাই জানে এর উত্তর।’
‘জানিস মৌমি, কেউ একজন চায়, দূরে গিয়েও আমি যেন বেঁচে থাকি, ভালো থাকি, সুন্দর জীবন নিয়ে সুখী থাকি। অথচ মুখফুটে নিজের মনের কথা বলতে পারে না। কোনো এক অজানা কারণে মনের কথা গোপন রেখে দিচ্ছে।’
ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে গেল মৌমিতা। নওমীর চেহারাটা ভালোমতো দেখল। এরমধ্যেই মুখটা মলিন হয়ে গেছে মেয়েটার। কেন? এত কীসের ভাবনা? দু’হাতে বান্ধবীর কাঁধ ছুঁয়ে বলল,
‘কে সে?’
নওমী উত্তর দিতে পারল না। এখনও অনিশ্চিত সে। কিন্তু ভাবনাটা খুব জটিল। যদি উত্তর সঠিক হয়, চোখই যদি মনের কথা বলে দেয়, যদি ওই আতঙ্কিত চোখজোড়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা অনুভূতি ভালোবাসা হয়, যদি মনের কথা লুকিয়ে রাখা, এড়িয়ে যাওয়া, নিজেকে লুকানোর কারণ হয়, তাহলে তো আশেপাশে থাকা ছেলেটা আর কেউ নয়, আদিয়ান নিজে। যখনই এই জটিল ভাবনার সূত্র মিলাতে গেল, চোখের সামনে জলজ্যান্ত উত্তর খুঁজে পেল, তখনই দু’হাতে মুখ ডেকে ডুকরে কেঁদে উঠল নওমী। মৌমিতা তাকে আগলে নিয়ে দাঁড়াতেই ভরসার আশ্রয় হিসেবে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরল সে। মৌমিতা বলল,
‘তোর সমস্যাটা কী বলবি? কাঁদছিস কেন এখন?’
কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে নওমী বলল,
‘জেনে-বুঝে কেউ কেন নিজের ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে দেয়, মৌমি? কেন তার থেকে দূরে থাকতে চায়? কেন এড়িয়ে চলে? ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার চেয়ে তাকে অন্যের হতে দেখার ইচ্ছেটা কেন এত তীব্র? এতসব জটিল প্রশ্নের উত্তর আমি কোথায় পাব, বলবি?’
***
নিজের অনাগত বাচ্চার সাথে বকবক করছে রুমঝুম। চোখের কোণে পানি নেই, তবে তার মুখটায়ও হাসি নেই। দুঃখের বিষয়, তার শ্বশুর-শাশুড়ি আর কোনো খোঁজ নেননি। আদিয়ান সকাল থেকে দু’বার ফোন করেছে। কিছু লাগে কি না সেটা জানতে চেয়েছে। দাফন-কাফন সব ঠিকমতো হয়েছে কি না, এসব জানতে চেয়েছে। এই কারণে মোমেনা বেগম একপ্রকার ধমকে উঠেছিলেন তাকে। যেন সবকিছুর জন্য সে দায়ী। পরিস্থিতি যেমনই হোক, রুমঝুমের কী হবে, এটা ভাবতে গেলেই দিশেহারা হয়ে যায় আদিয়ান। নিজের বোন না হলেও সেই ছোটোবেলা থেকে রুমঝুমের পাশে সে ছায়ার মতোই ছিল। কখনও রুমঝুমকে একা থাকার কষ্টটা অনুভব করতে দেয়নি। শত ঝড়তুফান, বিপদ-আপদ, গালিবকা সবকিছু থেকে আগলে নিয়েছে। অথচ এত বড়ো বিপদের দিনে রুমঝুম আজ একা, এ কথা ভাবলেই খারাপ লাগা বেড়ে যায়। তার আম্মি হয়তো এসব ভেবেই রুমঝুমের দায়িত্ব নিতে বলেছেল, কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। রুমঝুমও এটা মেনে নিবে না। শুভকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। এত কথা ভাবতে গিয়ে ঘড়ি দেখল আদিয়ান। টিউশনির সময় হয়ে গেছে। আজ বাসাতেই থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিল। বলল,
‘আম্মি, আমি যাচ্ছি। ঝুমের খেয়াল রেখো। যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, আমাকে ফোন কোরো।’
আদিয়ান চলে গেলে, সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে যেতে চাইল আলেয়া বেগমের। একে তো রাতের জার্নি, তারমধ্যে দিনেও বিশ্রাম নেননি। চোখজুড়ে ঘুম নেমে এসেছে তাঁর। তিনি আলাদা একটা রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাজেদা খাতুন নিজেও যথেষ্ট ক্লান্ত ছিলেন। কিন্তু একসাথে তো দু’জন ঘুমাতে পারবেন না। রুমঝুমের খেয়াল রাখতে হবে। তিনি রুমঝুমকে রুমে দেখে বিরক্ত করলেন না, চা খেয়ে শরীরকে একটু তাজা করতে রান্নাঘরে গেলেন। চা তৈরীর ফাঁকে নিজের স্বামীকে ফোন করলেন। কিছু লাগবে কি না, এসব টুকিটাকি ভালোমন্দ কিছু আলাপ-সালাপ করে ফোন রেখে দুটো কাপে চা ঢেলে রুমে এসে রুমঝুমকে খুঁজে পেলেন না। তিনটে রুম, বারান্দা, বেলকনি, বাথরুম সব চেক করে কোথাও না পেয়ে ভয় ঢুকে গেল মনে। ফ্লাটের এ মাথা, ও মাথা খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, মেইন ডোর খোলা। আঁৎকে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে। দৌড়ে বের হলেন ফ্লাট ছেড়ে। ডানে-বামে আরও ফ্লাট আছে। কোথায় যাবেন, কোথায় খুঁজবেন, বুঝে উঠতে পারলেন না। আলেয়া বেগমকে ডেকে বললেন,
‘আপা, একটু উঠুন। রুমঝুমকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।’
আলেয়া বেগম দ্রুত বিছানা ছাড়লেন। ভয়ে-আতঙ্কে জমে গেলেও মাজেদা খাতুনকে কথা শুনাতে ছাড় দিলেন না। বললেন,
‘আমি নাহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আপনি খেয়াল রাখবেন না? না কি আপনি নিজেও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলেন? আশ্চর্য, এত দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ করেন কী করে আপনি?’
বিছানা ছাড়তে গিয়ে তিনি সুযোগে আরও কথা শুনালেন। মাজেদা খাতুন কিছুই বললেন না। শুধু মনে মনে কিছু একটা আওড়ে গেলেন। এরপর ফ্লাট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে একদিকে আলেয়া বেগমকে পাঠিয়ে অন্যদিকে তিনি এগোলেন। খুঁজতে খুঁজতে তিনি জাদীদ ও আদিয়ানকেও জানিয়ে রাখলেন। এই অ্যাপার্টমেন্ট ভীষণ বড়ো। প্রতি তলায় ছ’টা করে ফ্লাট। তারমধ্যে উপরের দিকের কাজ এখনও বাকি। মোজাম্মেল হক্বকে জানালে, মৌমিতা নিজেও দৌড়ের ওপর যেদিক পারে, সেদিকে গেল রুমঝুমকে খুঁজতে। তার মাথায় প্রথমেই এলো, ছাদের কথা। এখনও ছাদে কার্ণিশ দেয়া হয়নি, দরজা লাগানো হয়নি। তারমধ্যে লিফটও নেই। তা-ই ওদিকে কেউ যায় না। যাওয়া নিষেধও। কিন্তু তবুও যদি গিয়ে থাকে। এলোমেলো ইট-পাথরের ফাঁক দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ছাদে উঠল মৌমিতা। দূর থেকেই দেখল, সাদা পোশাক পরিহিত নারী ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে ওখান থেকেই চিৎকার দিল,
‘রুমঝুম, ওখানেই দাঁড়াও। আর সামনে যেও না। পড়ে যাবে।’
মৌমিতা আর নিঃশ্বাস নিতেও পারল না যেন। ছুটে গিয়ে রুমঝুমকে আটকাতে চাইল, কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। রুমঝুম তার ডাক শুনল না। সে ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে কিনারে চলে এলো। পড়ে যাওয়ার আগে কীভাবে যেন মৌমিতা তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, কিছুটা দূরে সরিয়ে নিরাপদ একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে বলল,
‘কী করছিলে তুমি? এখুনি নিচে পড়ে যেতে।’
রুমঝুম ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইল। মৌমিতা হাতের ইশারায় নিচের দিক দেখিয়ে বলল,
‘দেখো, এখান থেকে যদি নিচে পড়ে যাও, বাঁচবে না। তোমার কি সামান্য কাণ্ডজ্ঞান নেই? এই শরীর নিয়ে তুমি এখানে এসেছ? বাসার সবাইকে পেরেশানিতে রাখতে ভালো লাগে তোমার?’
বেকুবের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রুমঝুম। মৌমিতা দু’হাত ধরে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
‘এই বেহুঁশ মেয়ে, বাঁচার ইচ্ছে নেই তোমার? নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলতে চাইছ? এখানে এসেছ কেন তুমি? তুমি না মা, মায়েদের এত নিষ্ঠুর হতে হয় না, এটা জানো না? ঘরে এসো বলছি।’
রুমঝুমের হুঁশ ফিরল তাতেই। একবার চারপাশে তাকাল, আরেকবার নিচের দিকে। আঁৎকে উঠে বলল,
‘আমি এখানে এলাম কী করে?’
মৌমিতা কী বলবে ভেবে পেল না। তবে এইটুকু বুঝল, রুমঝুম ইচ্ছে করে এখানে আসেনি। সবটাই অজ্ঞানে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে শুভর চিন্তাতে এমনিতেই সে মানসিকভাবে যথেষ্ট অসুস্থ ছিল, তারমধ্যে গতকালকের মৃত্যু, মন থেকে মেনে নিতেই পারেনি। এই দুর্ঘটনা, এই যন্ত্রণা শরীরের চেয়ে মনকে প্রভাবিত করেছে বেশি। যার কারণে, বেহুঁশের মতো চলতে চলতে, একধ্যানে থাকতে থাকতে এখানে চলে এসেছে। সে আর বকাবকি করল না। বলল,
‘বাদ দাও। এসো। ঘরে বসে চুপচাপ বিশ্রাম নিবে। এরপর আর ঘর থেকে বের হবে না। কোথাও বের হলে, কাউকে না কাউকে জানিয়ে, তারপর বের হয়ো। বাসার সবাই টেনশনে পড়ে গেছে।’
বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রুমঝুমকে নিয়ে নিচে নেমে এলো মৌমিতা। সবাইকে টেনশন মুক্ত করে, রুমঝুমকে ঘরে রেখে আদিয়ানকে ফোন করতেই দেখল, আদিয়ান দরজায়। বেচারা শান্তিই পায়নি। এতটা রাস্তা কীভাবে ছুটে এসেছে, সে নিজেও হয়তো জানে না। ঘরে এসে রুমঝুমকে সুস্থ দেখে আম্মি ও মাজেদা খাতুনের কাছে জানতে চাইল,
‘ও বাইরে গেল কী করে?’
মাজেদা খাতুন কিছু বলার আগেই আলেয়া বেগম বললেন,
‘ডিউটি করার জন্য একজনকে রেখেছিস না? তাকে জিজ্ঞেস কর। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছু দেখিনি। আমার তো মনে হচ্ছে, ওই মহিলাটাই রুমঝুমকে ভুলভাল কিছু বুঝিয়ে সুইসাইডের ভূত মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
আদিয়ান চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘আম্মি, যাকে ভালোমতো চিনো না, তার বিষয়ে উল্টাপাল্টা কথা বোলো না।’
‘কী বলতে চাস তুই? আমি ঝুমকে দেখে রাখিনি? আজ যা হলো, তারজন্য আমি দায়ী?’
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদিয়ান বলল,
‘আমি সেটা বলিনি, আম্মি। আমি তো তোমাকে বলেছিলাম ওর খেয়াল রাখতে। আন্টির দিক থেকে কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করার কথা নয়, তবুও উনি যতটা করছেন, সেটুকুই অনেক। আপনজনও এইটুকু করে না।’
‘তাহলে তো আমার আর এখানে থাকার কোনো দরকারই নেই। দেখাশোনা করার জন্য মানুষ যেহেতু আছে, আমি চলে যাই। তোদের জীবনে যে আমরা অপ্রয়োজনীয় সেটা আরও আগেই বুঝা উচিত ছিল।’
‘আম্মি, তুমি ভুল বুঝছ। কথাটা সেভাবে বলিনি আমি।’
‘আমার যা বোঝার ছিল, বুঝে নিয়েছি। মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি প্রয়োজন এখন। মা কে? কেউ না।’
ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মায়ের কাছে ভীড়ল আদিয়ান। আর কোনো মান-অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্কে টেনে আনতে চায় না সে। বার বার আম্মি দূরে সরে যাচ্ছেন, এটা তার জন্য ভীষণ যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়াল। সে মায়ের হাতদুটো ধরে বলল,
‘তুমি মা। সন্তানের জীবনে তোমার প্রয়োজন সবার আগে। এখন এসব নিয়ে ঝগড়া করার সময় নয়, আম্মি। আমার মনে হচ্ছে, ঝুমের এই সমস্যার জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেয়া উচিত।’
আলেয়া বেগম একটু শান্ত হয়ে রুমঝুমকে নিয়ে আলাদা রুমে সরে গেলেন। জাদীদ এলো সন্ধ্যের দিকে। পুরো ঘটনা শোনে টেনশনে পড়ে গেল। রুমঝুমকে এভাবে রাখা রিস্কই। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে কাছের মানুষদের সাপোর্ট ও ভালোবাসা ওর জন্য ভীষণ জরুরী এখন। যেন পিছনের ধাক্কাটা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার করণীয় কী? সে আদিয়ানের সঙ্গে এই বিষয় নিয়েই আলাপ করছিল। এরমধ্যে মাজেদা খাতুন পরনে বোরখা ছাপিয়ে এসে ছেলেকে বললেন,
‘চল, বাবা… আমরা যাই। রাত বাড়লে তোর বাবা আবার চিন্তা করবেন।’
সকালেই মা এক কথা বললেন, এখন আরেক কথা বলছেন, রুমঝুম একটা কঠিন পরিস্থিতিতে আছে জেনেও তিনি চলে যাওয়ার নাম নিলেন, শোনে অবাক না হয়ে পারল না জাদীদ। বলল,
‘তুমিই তো বলছিলে, রুমঝুমকে একা রেখে যেতে পারবে না। তুমি থাকো অসুবিধা নেই। আমি ও বাবা সবকিছু দেখে রাখব।’
ছেলেকে কোনোকিছুই বুঝতে দিতে চাইলেন না মাজেদা খাতুন। বললেন,
‘এখন তো ওর ফুপি এসেছেন, আমি না থাকলেও চলবে। আপন মানুষদের ভালোবাসা পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তাঁর জন্য মা ও সন্তানদের মধ্যে কোনোপ্রকার দ্বন্দ হোক, সেটা চাইলেন না মাজেদা খাতুন। এমনিতেও আদিয়ান অনেক ভুগেছে। মায়ের কাছ থেকে ক্ষমা পেতে নিজের সবচেয়ে দামী সম্পদ ও অনুভূতির সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে রাজি হয়েছে। এরপর যদি দূরত্ব আসে, সেটা আর শেষ হবে না। তিনি পর মানুষ, এত কাছে ভীড়ে কেন মা ও ছেলের মধ্যে দ্বন্দ টেনে আনবেন? এত কথা ভেবে কষ্টই পেলেন তিনি। দরজা আটকানো দেখে রুমঝুমকে শেষবেলা একটু দেখতেও পারলেন না। আদিয়ানকে বললেন,
‘ভালো থেকো, বাবা। যদি কখনও আমাকে প্রয়োজন মনে হয়, ডেকো।’
আলেয়া বেগমের কথাগুলোর জন্যই যে মাজেদা খাতুন কষ্ট পেয়েছেন, সেটা যথেষ্ট বুঝল আদিয়ান। কিন্তু ভদ্রমহিলার ইশারার কারণে এই নিয়ে আর কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল,
‘আপনার ঋণ আমরা শোধ করতে পারব না, আন্টি। এই শহরে কেউ যদি আমাদের আপন হয়ে থাকে, সেটা আপনিই। তাই আপনি না চাইলেও সময়ে-অসময়ে আমরা আপনাকে বিরক্ত করবই।’
জাদীদ ও মাজেদা খাতুনকে বিদায় দিয়ে একটু রিল্যাক্স হতে সোফায় বসলো আদিয়ান। তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী, সেই ভাবনা মনে উদয় হওয়া মাত্রই একদলা বিষাদময় অনুভূতি ছুঁয়ে গেল তাকে। হঠাৎ করেই নওমীর কথা মনে পড়ল আর তাতেই, হৃদপিণ্ডে হাজার টনের পাথর চাপলো। এত কষ্ট কেন জীবনে ভেবে পেল না। হারাতে হারাতে মন আজ ভীষণ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। সুখ তার কোন জনমের শত্রু? কেন ধরা দিচ্ছে না? তার সাথে সুখের এত শত্রুতা কীসের?
***
চলবে…
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৩
দু’হাতভরে লাল টুকটুকে রঙের মেহেদী পরে হাত রাঙিয়েছে নওমী। একেবারে কনুই থেকে আঙুলের প্রতিটা ফাঁকে ফাঁকে। ভার্সিটি থেকে ফিরে হুট করেই মনের আনন্দকে প্রকাশ করতে আজকের এই রংঢং। মাঝেমধ্যেই এমন পাগলামি করে সে। যেদিন খুব বেশি খুশি থাকে, সেদিনই দু’হাতে মেহেদীর ডিজাইন তুলে। আজ, মেয়ের এই সুখ সুখ মুখ ও ঠোঁটের কোণের হাসিটা প্রশান্তির ছোঁয়া বইয়ে দিল মায়ের অন্তরে। বেশ কিছুদিন ধরেই মেয়েকে অন্যমনস্ক হতে দেখেছেন তিনি। বিশেষ করে, সেদিন – যেদিন তার ফুপির সাথে ফোনালাপের পর বাবাকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নীরব কান্নায় বুক ভাসিয়েছিল মেয়েটা। সেই কান্নাতেই মায়ের মন কেঁপে উঠেছিল। কোথাও কিছু একটার গণ্ডগোল টের পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু গণ্ডগোলটা ঠিক কী, সেটাই ধরতে পারছিলেন না। এরপর থেকে মেয়ের প্রতিটা পদক্ষেপকে গভীর মনোযোগ দিয়ে নোটিশ করেছেন তিনি। ফলাফল হিসেবে পেয়েছেন, প্রেমের বৈরী হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে মেয়েটাকে। সে হাওয়ায় দিকবিদিক ভুলে, একাকী সুখসমুদ্রে ভাসতে গিয়ে কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে। দুনিয়ার সবার চোখ ফাঁকি দিলেও মায়ের চোখকে কোনোদিন ফাঁকি দিতে পারেনি নওমী। আজও পারল না। মেহেদী রাঙা হাত নিয়ে যখন স্টাডি টেবিলে বসে গুনগুন করছিল, তখুনি মেয়ের জন্য কফি হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন নুজাইফা আমীন। ডানে-বামে খেয়াল ছিল না বলেই মায়ের এই আগমন টের পায়নি সে। বার বার হাতে ফুঁ দিচ্ছে আবার ঠোঁট নাড়িয়ে গান গাইছে। তিনি বেশ নিঃশব্দেই মেয়ের সামনে এসে কফির কাপ রেখে আদুরে হাতে মাথা ছুঁইয়ে দিলেন। তাতেই চমকে উঠে মা’কে দেখে একগাল হেসে মোলায়েম স্বরে নওমী বলল,
‘তুমি!’
নুজাইফা আমীন মেয়ের মেহেদীরাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ডিজাইনটা তো খুব সুন্দর হয়েছে। আজ হঠাৎ মেহেদী পরলে যে!’
‘এমনিই ইচ্ছে হলো।’
মাঝেমধ্যেই মেহেদী পরে বলে এই নিয়ে আর কোনো বাড়তি প্রশ্ন করলেন না নুজাইফা আমীন। মেয়ের মন পরীক্ষা করার জন্য বললেন,
‘পাত্রের বাবা-মা তোমার জন্মদিনের আগেই দেশে ফিরছেন। ওনারা অলরেডি বিয়ের শপিং শুরু করে দিয়েছেন। তোমার যদি কিছু পছন্দ থাকে, তোমার ফুপিকে জানিয়ে রাখতে পারো।’
এতক্ষণের সুখ সুখ সব অনুভূতিতে তিতকুটে করলার রস পড়ে গেল। মুখ ভেংচিঙে বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখল নওমী। নুজাইফা আমীন বললেন,
‘কী হলো? কিছু লাগবে না?’
মন খারাপের সুরে নওমী বলল,
‘আমি যদি বলি, এই বিয়েটা করতে চাই না, খুব রাগ করবে তোমরা?’
সন্দেহ যে সত্যি, সেটা বুঝেই হালকা হলেন নুজাইফা আমীন। ঠোঁটের কোণে লুকোচুরি হাসিটা মেয়েকে দেখালেন না। উলটে গম্ভীর মেজাজে বললেন,
‘কেন? পাত্র পছন্দ নয়? এত ভালো পাত্র হাতছাড়া করলে তোমার ফুপি ও বাপি দু’জনেই খুব রাগ করবেন। কষ্ট পাবেন।’
‘আর আমি যে কষ্ট পাচ্ছি, সেটা বুঝি কিছু না?’
নতমুখেই কথাগুলো বলে গালিবকা খাওয়ার ভয়ে মুখ লুকিয়ে বসে রইল নওমী। নুজাইফা আমীন মেয়ের কাঁধে হাত রেখে আলতোস্বরে জানতে চাইলেন,
‘তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ? এই ভিসাটা তোমার স্বপ্ন।’
‘আমি স্বপ্নকে ছুঁতে চাই মাম্মি, কিন্তু এভাবে নয়।’
একইভাবে উত্তর দিল নওমী। নুজাইফা আমীন আবারও বললেন,
‘কারণটা স্পষ্ট করে বোলো।’
‘আমি আসলে কী চাই, সেটা নিয়ে নিজেও এইমুহূর্তে ভীষণ কনফিউজড, মাম্মি। আমাকে কিছুদিন সময় দাও।’
‘সময়টা কীসের জন্য? নিজেকে তুমি চিনো, নিজের লক্ষ্য কী তা-ও জানো, তাহলে সেই লক্ষ্য থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলছ কেন?’
‘আমি জানি না, মাম্মি।’
ভয়ের কারণেই মনের কথা মুখফুটে বলতে পারছিল না নওমী। তাছাড়া, এখনও আদিয়ানকে ভালোভাবে বুঝতেই পারেনি, ছেলেটা ধরা দিয়েও দিচ্ছে না, দূরে সরে যাচ্ছে। এগুলো ঠিক কেন, সেই কারণটা খুঁজে বের করতে না পারলে নিজেকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট ভাবতে হবে তাকে। আর তারজন্য, আদিয়ানের মুখোমুখি হওয়াটা জরুরী। তাকে আরও ভালোভাবে জানা জরুরী, বোঝা জরুরী। এতকিছু তাড়াহুড়ো করে হবে না, বরং ধীরেসুস্থে, কৌশল অবলম্বন করে জানতে হবে। যতক্ষণ না আদিয়ান নিজের মুখে মনের ভেতর গোপন রাখা দামী অথচ স্বচ্ছ-সুন্দর অনুভূতি প্রকাশ না করছে, ততক্ষণ সে-ও কিচ্ছুটি জানতে ও বুঝতে দিবে না। মনের কথা লুকিয়েই রাখবে, অপ্রকাশ্যেই রাখবে। এতকিছু ভাবতে গিয়ে আবারও দুপুরের মতো চোখের কোণ ভারী হয়ে উঠল নওমীর। প্রতিফোঁটা পানি বুঝিয়ে দিল, না বলা কথার প্রখরতা ঠিক কতখানি গভীরত্ব নিয়ে জমা হচ্ছে অন্তরে! নুজাইফা আমীন বিচলিত হলেও মেয়ের মনোভাব বুঝতে বললেন,
‘আমি জানি, তোমার এই কনফিউশনের কারণ।’
নওমী অবাক হলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে মায়ের দিকে তাকাল। নুজাইফা আমীন হেসে পাশাপাশি একটা চেয়ারে বসে মেয়ের মেহেদীরাঙা হাতদুটো আলতোস্পর্শে কাছে টেনে বললেন,
‘অনেক আগেই, একদিন তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে শুধু মা নও, তোমার বন্ধু ভেবো। যেন তোমার সব কান্না-হাসির গল্প শেয়ার করতে পারো।’
নওমী উত্তরে বলল,
‘আমি তো সব কথা তোমার সাথে শেয়ার করি, মাম্মি।’
‘হ্যাঁ, কোরো। কিন্তু ইদানীং করছ না। কেন করছ না, সেটাও আমি জানি।’
আঁৎকে উঠে ভীতুগ্রস্থ চাহনিতে মায়ের মুখ দেখল নওমী। কোনো উত্তর দিতে পারল না, প্রশ্নও করতে পারল না। নুজাইফা আমীন আদুরে হাতে মেয়ের মুখখানি ছুঁয়ে বললেন,
‘প্রেম-ভালোবাসা প্রতিটা মানুষের জীবনেই আসে। কেউ তা ভুল হিসেবে জানে, কেউ জানে ঠিক। কেউ আঁকড়ে ধরে বাঁচে আর কেউ হারিয়ে ফেলে দিশেহারা হয়ে যায়। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তুমি আমার একটামাত্র মেয়ে। তোমার এই কঠিন সময়ে যদি তোমাকে সঠিক পথের দিশা দিতে না পারি, মা হিসেবে সারাজীবন এই ব্যর্থতা নিয়েই বাঁচতে হবে আমাকে।’
নিজেকে ধরে রাখতে পারল না নওমী। শব্দহীন কান্নায় গাল ভাসিয়ে দিল। নুজাইফা আমীন সময় নিয়ে মেয়ের কান্না থামার অপেক্ষায় বসে রইলেন। মেয়ে একটু শান্ত হয়ে এলে আস্তেধীরে বললেন,
‘মনকে শক্ত কোরো। কনফিউশন নয়, কনফিডেন্টের সাথে বোলো যে, তোমার মন কী চায়। মন যা চায়, যা করতে বলে, সেটা কোরো। আমাদের কথা ভেবে, নিজের জীবনকে নষ্ট কোরো না। এমনকি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে, আফসোস কোরো না। মনে রেখো, জীবনে সঠিক মানুষ যেমন বার বার আসবে না, তেমনই একই সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না।’
নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নওমীর মনে যত ভয় ও দ্বিধা ছিল, সেটুকু পালিয়ে গেল। কান্নারত মুখ নিয়েই হাসলো সে। মায়ের বুকে মাথা রেখে আহ্লাদী স্বরে বলল,
‘আমি আদিয়ানকে ভালোবাসি, মাম্মি। জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার শুধু তাকেই চাই।’
মেয়ের এই আদুরে বায়নাটা অদ্ভুত হলেও নুজাইফা আমীন নির্ভার হেসে বললেন,
‘ঠিক আছে। বাপিকে বলে ফেলো।’
নওমী মুখভার করে বলল,
‘সম্ভব নয়।’
‘কেন?’
‘আদিয়ানের ধারণা জাহাঙ্গীরের লোকজন আমাকে মেরে ফেলবে। তাই এই লোকটার হাত থেকে বাঁচতে হলে দেশ ছাড়া আবশ্যক। সে চায়, আমি যেন দূরে চলে যাই। লন্ডনে গিয়ে সেটেল্ড হই। ভালো থাকি, সুখী থাকি।’
‘তুমিও তো সেটাই চাও।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু একা নয়…।
ফিসফিসিয়ে আরও কিছু বলে আহ্লাদী হয়ে অনুরোধের সুরে নওমী বলল,
‘প্লিজ মাম্মি…।’
‘প্লিজ মাম্মি… মামাবাড়ির আবদার তো।’
চট করে মায়ের বুক থেকে মাথা সরিয়ে ভেংচি কেটে নওমী বলল,
‘একটু আগেই বলছিলে, আমি যেন তোমাকে বন্ধু ভেবে কান্না-হাসির গল্প শেয়ার করি। এখন যখন কান্না-হাসির কারণ বললাম, অমনি সবকিছু মামাবাড়ির আবদার হয়ে গেল? যাও, কথা নেই তোমার সাথে। পেটের ভেতর থেকে সব কথা বের করে নিয়ে… দূর… আর কিচ্ছু বলব না তোমায়। কোনো হেল্প চাইব না তোমার কাছে। যা করার, সেটা আমি নিজেই করব।’
নুজাইফা আমীন ভ্রু নাচিয়ে কৌতুকের স্বরে বললেন,
‘তাই বুঝি? কী করবে তুমি?’
ভাববার বিষয়। কী করবে নওমী? মায়ের কাছে যত সহজে আদিয়ানকে চাইতে পারল, বাপির কাছে তত সহজে চাইতে পারবে না। তার বাপি সাধারণ ঘরের এই ছেলেটাকে পাত্তাই দিবেন না, এটা খুব ভালোভাবেই জানে সে। এজন্য তাকেই, এমনকিছু করতে হবে, যেন বাপির সম্মানটাও থাকে আর ভালোবাসাও সুখ-সুন্দর অনুভব হয়ে শীঘ্রই ধরা দেয় জীবনে। কিন্তু করবেটা কী? ভাবতে গিয়ে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলার মতো জঘন্য ইচ্ছে হলো নওমীর। দিশেহারা মন নিয়েই দু’হাতে নিজের চুল টেনে ধরল, তাতেই নুজাইফা আমীন শব্দ করে হেসে উঠলেন। মেয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে না হেসে থাকতে পারলেন না তিনি। নওমী প্রথমে মায়ের হাসির কারণ বুঝল না। কিন্তু যখনই বুঝল, নিজের নষ্ট হওয়া মেহেদীর ডিজাইনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে আফসোসের সাথে বলল,
‘ইয়া আল্লাহ, আমার এত কষ্টের ডিজাইন নষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তুমি হাসছ, মাম্মি? দূর… আমার মেহেদী…।’
***
রাতে খাবার টেবিলে মাজেদা খাতুনকে না পেয়ে উনি ঘুমিয়েছেন ভেবে ভালোমতো প্রতিটা রুমের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত হেঁটে, কোত্থাও ভদ্রমহিলার চিহ্নটি খুঁজে না পেয়ে ধীরপায়েই ফুপির কাছে এসে দাঁড়াল রুমঝুম। জানতে চাইল,
‘আন্টি কোথায়, ফুপি?’
আলেয়া বেগম টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন। ভাইঝির কথা শোনে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন,
‘চলে গেছেন।’
‘আমাকে না বলেই?’
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রশ্ন করল রুমঝুম। আলেয়া বেগম সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন। দুঃখেভরা মনে আরও দুঃখ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘তুই এত গুরুত্বপূর্ণ কেউ না যে তোকে জিজ্ঞেস করে যাবেন। তাছাড়া তুই তখন ঘুমাচ্ছিলি। আমি-ই ডাকতে নিষেধ করেছি।’
‘ওহ।’
মনে খুব ব্যথা পেল রুমঝুম। দীর্ঘদিন একই সাথে পাশাপাশি থাকার কারণে যে মায়া জন্ম নিয়েছে মনে সেটুকুকে তুচ্ছ ভাবতে গিয়ে কান্না পেল তার। মুখ ঘুরিয়ে রুমে যেতে গিয়ে খেয়াল করল, ড্রয়িংরুমের সোফায় অন্যমনস্ক ও উদাসী মনোভাব নিয়ে বসে আছে আদিয়ান। কোনো এক অজানা কারণেই রুমঝুমের মনে হলো, মন খারাপ হয়ে থাকতে পারে তার। এই কারণেই হয়তো উদাস। রুমঝুম পাশের খালি জায়গায় বসল। কিছু বলতে যাবে, তার আগেই আলেয়া বেগম ছেলেকে ডাকতে এসে বললেন,
‘খেতে আয়, আদি।’
হঠাৎ করে ‘আম্মি’ কেন এত নিষ্ঠুর হয়ে গেলেন, সেসবই ভাবছিল আদিয়ান। নিজের ছেলের সাথে দূরত্ব, তার পছন্দকে নাকোচ করা, অকারণ অন্যের ওপর দোষ চাপানো, এই সবকিছু তার মায়ের সাথে একদমই মানানসই নয়, তবুও কেন ‘আম্মি’ এমন হয়ে গেলেন, সেটাই ক্ষণে ক্ষণে তার মনের ভেতর হাজারও প্রশ্নের ডালপালা মেলে অশান্তির সৃষ্টি করছিল। এখন মায়ের এই কণ্ঠস্বর শোনে অভিমানী মনে বলল,
‘না খেলে খুব একটা ক্ষতি হবে না।’
‘সেকী কথা? খাবি না কেন? খাবারের ওপর এত কীসের রাগ?’
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে প্রশ্ন করলেন আলেয়া বেগম। আদিয়ান হতাশ চোখে তাকাল। আম্মি তাকে বুঝতেই চাইছেন না। তার কোনো কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। জানে অন্যায় হবে, তবুও মায়ের দুর্বল জায়গা বুঝে প্রশ্ন করল,
‘একটা কথা বোলো তো, আম্মি। দ্বিতীয়বার কাউকে মন দেয়া কি অন্যায়? দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখা কি অন্যায়?’
‘কেন? অন্যায় হবে কেন?’
‘তাহলে তুমি কেন নিজেকে দ্বিতীয় সুযোগ দাওনি? কেন চাচ্চুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলে?’
আলেয়া বেগম শুধু চোখদুটো গরম করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নির্দিষ্ট কোনো কথা ফিরিয়ে দিলেন না। আদিয়ানের বাবার মৃত্যুর মাস ছ’য়েক পর তার চাচ্চু নাদিরা ফেরদৌসীকে বিয়ের আগেই আদিয়ানকে নিজের কাছে রেখে দেয়ার জন্য বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে আলেয়া বেগমকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি তার আম্মি। এরপর অনেকবার স্বামীর কবর জেয়ারত করতে রাঙামাটি গেলেও দেবরের সাথে টু’শব্দটিও করতেন না। শ্বশুর-শাশুড়ি ও জায়ের সাথে গল্পগুজব করে নরসিংদী ফিরে আসতেন। সেদিনের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার একমাত্র কারণ যে তার ‘বাবা’ সেটা খুব ভালোমতোই বুঝতে পারে আদিয়ান। তবুও মাকে আবারও বলল,
‘প্রথম ভালোবাসা ভুলে দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যদি সহজই হয়, তোমার সেই সুযোগ হাতছাড়া করার কথা ছিল না। কেন হাতছাড়া করলে?’
রেগেমেগে গর্জে উঠে আলেয়া বেগম বললেন,
‘এসব কী ধরনের কথাবার্তা বলছিস, আদি? কাকে, কী বলছিস ভুলে যাচ্ছিস, তুই? আমি তোর মা। আমাকে এই ধরনের কথা বলা সাজে না তোর।’
‘মাফ কোরো, আম্মি। এভাবে বলা উচিত হয়নি আমার। নিজের বেলা যা ঠিক বলে জানো, অন্যের বেলায় তা ভুল হয়ে যাচ্ছে। কেন আমার ভালোবাসা তোমার কাছে সাময়িক মোহ মনে হলো, প্রশ্ন আসলে এটাই।’
‘কোনটা মোহ কোনটা ভালোবাসা সেটা বোঝার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান আমার আছে। তাছাড়া তুই কথা দিয়ে ফেলেছিস। ওয়াদা ভঙ্গকারী কিন্তু মুনাফিক। আমি আশা করব, তুই তোর ওয়াদা রক্ষা করে চলবি।’
‘আমি এতটাও খারাপ নই যে, দ্বিতীয়বার তোমার কথা অমান্য করব। একবার যখন তোমাকে কথা দিয়েছি, তখন নিজেকে মেরে ফেলে হলেও তোমার কথার মূল্যায়ন করব।’
এতসব জটিল কথাবার্তায় রুমঝুমের শুধু কান্নাই পাচ্ছিল রুমঝুমের। কী এক সমস্যা শুরু হলো! মা-ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দূরত্ব, মান-অভিমান চলে এলো! এসবের কি কোনো দরকার ছিল? সে এত প্যাঁচ বুঝে না, এত দাঙ্গাহাঙ্গামা বুঝে না, কিন্তু তবুও নিজের অবুঝ মনের সায় থেকে দু’জনের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ফুপি, তুমি কিন্তু অন্যায় করছ। জেনে-বুঝে একটা মানুষের ওপর অবিচার করছ। ভুল করেছি, ভুলের শাস্তি দিয়েছ, এখন দু’জনার মধ্যিখানে ঝামেলার কারণ হয়ে যাচ্ছ কেন? প্রতিটা মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। তোমরা বার বার তোমাদের জেদ, সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছ। আমরা সেটা মেনে নিতে পারিনি বলেই অন্যায় করেছি। তবে এখন তুমি যা করছ, সেটাও ঠিক করছ না। তোমার নিজের জেদ ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে ভাইয়াকে জীবন্ত মেরে ফেলতে চাইছ। মা হিসেবে একবার অন্তত চেষ্টা করতে, দু’জনকে সুখী জীবন দেয়ার! তা না করে…।’
‘তোকে এত কথা বলতে কে বলেছে? আমাদের মা-ছেলের মধ্যে নাক গলাচ্ছিস কেন এত? তুই কে? বেশি পাকনামি করবি না। নিজেকে তো শেষ করেছিস, এখন আমার ছেলেকেও শেষ করবি। তোর মতলব কী?’
আলেয়া বেগম প্রায় চেঁচিয়ে উঠেই রুমঝুমকে এই কথাগুলো শুনালেন। রুমঝুম বিস্মিত চোখে ফুপির দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে অস্ফুটস্বরে বলল,
‘আসলেই তো! আমি তোমার কে! কেউ না। কিন্তু তুমি! তুমি তো আমার আরেক মা ছিলে। মা হারিয়ে তোমার কোলেই বড়ো হয়েছি তো, তা-ই একটু অধিকার দেখিয়ে ফেলি। অথচ আজ… আজ তুমি বুঝিয়ে দিলে, তোমার সব ভালোবাসা লোকদেখানো ছিল। ফুপার মৃত্যুর পর একটা নিরাপদ আশ্রয়ের দরকার ছিল তোমার। সেই আশ্রয় পেয়ে, আমার জন্য যা কিছু করেছ, সবটাই কি তাহলে মিথ্যে ছিল, ফুপি? অভিনয় ছিল? এই ভালোবাসা, এই আদর, এই স্নেহ-মায়া-মমতা সবকিছু স্বার্থের জন্য ছিল?’
আলেয়া বেগম নিজেও বিচলিতবোধ করলেন। রুমঝুমকে এইভাবে কথা শুনাতে চাননি তিনি। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল, মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না। ছেলের ওপর রাগ থেকে হুটহাট মেজাজ হারিয়ে এইভাবে বলে ফেলেছেন। মাথা ঠাণ্ডা রেখে যখন ভাবতে গেলেন, নিজের ভুল তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন। রুমঝুমকে দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই মনে এক অদৃশ্য চাবুকের আঘাত নিয়ে সোফা ছেড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল রুমঝুম। আদিয়ান মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এবার শান্তি পেয়েছ তুমি? জানো, ঝুমের মনের অবস্থা ভালো না। তবুও এইভাবে বললে? মরে মরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা মানুষদের যে কেন এত কষ্ট দিচ্ছ তুমি, সেটারই নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না, আম্মি।’
মায়ের দিক থেকে জবাবের অপেক্ষা করল না আদিয়ান। উঠে দাঁড়িয়ে রুমঝুমের রুমের সামনে গেল। দরজায় নক দিয়ে ডাকল,
‘ঝুম… বাইরে আয়। ক্ষিধে পেয়েছে।’
ভেতর থেকে কাঁদোকাঁদো গলায় রুমঝুম বলল,
‘আমি খাব না, ভাইয়া। তোমরা খেয়ে নাও।’
‘মারব চড়। আয় বলছি। ঔষধ খেতে হবে না?’
‘খাব না বলছি তো।’
‘তুই কি বাইরে আসবি? না কি আমি এই রাতে আন্টিকে এখানে টেনে নিয়ে আসব? কী করব? ফোন দিই?’
‘জোর কোরো না তো। খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘জানি, ইচ্ছে করছে না। কিন্তু খেতে হবে। অল্প হলেও খাবি। তুই না খেলে কিন্তু তোর বাচ্চাটাও না খেয়ে থাকবে। ওইটুকু প্রাণকে এত কষ্ট দিস না, ঝুম। প্লিজ…।’
অনাগত বাচ্চার কথা ভেবে মনের ক্ষতকে দূরে সরিয়ে দরজা খুলে বাইরে এলো রুমঝুম। আলেয়া বেগম তখনও সোফাতেই বসে আছেন। একপলক ফুপির দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে খাবার টেবিলের সামনে এসে, ভদ্রমহিলার জন্য খাবার সাজিয়ে রেখে নিজেরা নিজেরা চুপটি করে খেতে বসলো। আলেয়া বেগম অবাক হয়ে ওদের দুই ভাই-বোনের কাণ্ডকারখানা দেখলেন। খুব ছোটোবেলা থেকেই ওরা এমন করে। কারও ওপর রাগ-অভিমান হলে, তর্কবিতর্ক হলে প্রথমে খাবে না বলে মুখ ফিরিয়ে থাকবে। এরপর একজন, অন্যজনকে ম্যানেজ করে ঠিকই খেতে বসে যাবে। যার ওপর রাগ-অভিমান জন্মাবে, তাকে তখন আর পাত্তাও দিবে না। ফিরেও তাকাবে। খাবার জন্য ডাকবেও না। রুমঝুমের এই বাঁকানো মুখ দেখে তিনিও দূরে না থেকে কাছে এসে চেয়ারে বসে নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করলেন। ওদের দু’জনের মধ্যে নীরবে চোখাচোখি হলো। দুটোতেই হাসছে কিন্তু হাসিটা চেপে রাখছে। কেউই শব্দ করছে না। কারও মুখে কোনো কথা নেই দেখে আলেয়া বেগম বললেন,
‘নওমী কি এই শহরেই থাকে? কাছেপাশে বাড়ি হলে তাকে একবার আসতে বলিস, আদি। দেখব, আমার ছেলের মন কোথায় ডুবেছে। সে যদি আমার মনমতো না হয়, তাহলে কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব না। আর সে আমার মনমতো মেয়ে কি না সেটা বুঝতে তার কিছু পরীক্ষা নিব। প্রস্তাব আমি তখুনি পাঠাব, যখন সে আমার দেয়া পরীক্ষায় আশির ওপরে মার্কস পেয়ে পাশ করবে। শহুরে মেয়ে আমার পছন্দ না। তারমধ্যে ওর বাবা রাগী মানুষ। সাধারণ মানুষদের অপছন্দ করেন। এমন মানুষের সাথে আত্মীয়তা করার কথা ভাবতে গেলেই খারাপ লাগছে। তবুও তোর কথা ভেবে সম্মতি দিচ্ছি।’
আদিয়ান নিজের বাম মাথায় হাত দিয়ে রুমঝুমের দিকে অসহায় চোখে তাকাল। ঠোঁটের কোণে বিড়াবিড়ানি তুলে বলল,
‘এ কেমন শাশুড়ি! সামান্য পছন্দের জন্য কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিতে চাইছে। দুই অদেখা-অচেনা মানুষকে মুখোমুখি করব কী করে এখন? নওমী যদি এসব টের পায়! কী হবেরে, ঝুম?’
***
চলবে…