#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৪
রাসেলকে নিয়ে দারুণ একটা প্লান সাজিয়েছিল জাদীদ। ভাবেনি, সেই ফাঁদে রাসেল খুব দ্রুতই পা দিতে। নারীসঙ্গ উপভোগ করতে পছন্দ করে না, এমন পুরুষ সমাজে নেই বললেই চলে। সব পুরুষই শখের নারীর সঙ্গ উপভোগ করে বেশি। আর এই কারণেই নারী ইনভেস্টিগেটর দীপালীকে মাঠে নামিয়েছে। সাথে রেখেছে আদিয়ানকে। ওদের ওই প্লানের অংশ হিসেবে দীপালী আজ কলেজ স্টুডেন্ট সেজে এসেছে ক্যাম্পাসে। নওমীর ফাইনাল এ্যাক্সাম শুরু হয়েছে। এই এ্যাক্সাম শেষ হওয়ার মাঝখানেই আবার আইইএলটিএস এর এ্যাক্সাম পড়বে। দুটো একসাথে হওয়াতে সে খুব চাপে আছে। পড়াশোনা ছাড়া আপাতত আর কোনোদিকে মন নেই তার। এ্যাক্সাম শেষ করে যখন বের হয়ে একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য রেস্টুরেন্টে পা রাখল, অমনি শুনল আদিয়ানের গলা,
‘তোমার এতবড়ো সাহস, তুমি আমার চোখকে ধুলো দিয়ে পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়েছ। ছিঃ, ছিঃ, আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছ তুমি। এখুনি আমি তোমাদের দু’জনের নামে থানায় মামলা করব।’
সেদিন যখন রাসেলের হাত থেকে আদিয়ান নওমীকে বাঁচিয়ে নিয়েছিল, ওইদিন একপলকের জন্য রাসেল আদিয়ানকে দেখেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেদিনের চেহারার সাথে আজকের আদিয়ানের কোনো মিল নেই। গালভরা দাঁড়ি ও লম্বা গোঁফ দেখে নওমী যারপরনাই অবাক। তবে কণ্ঠস্বর বলে দিল, ওটা আদিয়ানই। কী হচ্ছে বুঝতে চাইল সে। এই কারণে সামনে দু’পা এগোলো। অমনি দেখল, চেয়ারে বসে থাকা একজন মেয়ের ফোন চেক করছে আদিয়ান। চেক করেই রোমান্টিক সব ম্যাসেজ বের করে সোজা রাসেলের কলার চেপে ধরে তাকে হিড়হিড়িয়ে টেনে নিয়ে এলো রেস্টুরেন্টের বাইরে। দু’একটা কিল-ঘুষি দিলে দীপালী এসে আদিয়ানের পা ধরে লটকে গিয়ে বলল,
‘তোমার দোহাই লাগে ওকে ছেড়ে দাও। আর মেরো না। ও মরে যাবে।’
আদিয়ান থামলো না। হাতের ধাক্কায় দীপালীকে দূরে সরিয়ে বলল,
‘কোনো ছাড়াছাড়ি নাই। ওকে আজ আমি জানে মেরে ফেলব। আর তোমাকেও ডিভোর্স দিব।’
নওমীর মুখ হা হয়ে গেল। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। পরপর কয়েকবার ঢোক গিলে অস্থির হয়ে চলা মনকে সামলে নিতে চাইল। রাসেলও আদিয়ানের পা ধরে ক্ষমা চাইতে গেল। কিন্তু আদিয়ান কাউকেই ছাড় দিল না। দু’জনকে একসাথে জড়ো করে বার বার থানায় নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিল। মিনিট পাঁচেক পেরোনোর আগেই ফোর্স নিয়ে সেখানে চলে এলো জাদীদ। আদিয়ান তার বয়ান শুনাল। দীপালী ও রাসেলের সব কনভারসেশন দেখিয়ে বলল,
‘আমার স্ত্রী পরকীয়া করেছে। আমি ওর প্রেমিক ও ওর নামে মামলা করতে চাইছি। আপনি এখুনি ওই দুটোকে অ্যারেস্ট করুন, অফিসার।’
সব প্রমাণ দেখে জাদীদ দু’জনকেই অ্যারেস্ট করল। নারী কনস্টেবল অন্যজনকে ডেকে এনে, দীপালীকে চোখ মেরে মিথ্যে মিথ্যে অ্যারেস্টের নাটক করল। এদিকে রাসেলকে অ্যারেস্ট করে, আদিয়ানকে বলল,
‘আপনি থানায় আসুন। আমরা আপনার বয়ান শুনব।’
মুহূর্তেই রাসেলকে একটা জিপে তুলে থানার দিকে রওনা দিল জাদীদ। এই পরিস্থিতির কারণে আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল। তারা সবাই কানাঘুঁষা করতে করতে চলে গেল। দীপালী জিপে উঠল না। সবার চোখের অলক্ষ্যে গিয়ে নিজের বেশভূষা চেঞ্জ করে এসে আদিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আপনি কিন্তু দারুণ অভিনয় করেছেন। ডায়লগ ডেলিভারি একেবারে খাপে খাপ।’
আদিয়ান মুচকি হেসে মুখে লাগানো বাড়তি দাড়িগোঁফ খুলে বলল,
‘এই সিনের জন্য টানা এক সপ্তাহ প্রাকটিস করেছি। ভাগ্যিস রাসেল আমাকে চিনতে পারেনি।’
‘এখন পরবর্তী প্লান শুনুন।’
হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল ওরা। নওমীও সন্দেহের কারণে ওদের পিছন পিছন এসেছিল। দাড়িগোঁফ খুলে ফেলার পর, পরবর্তী দৃশ্য ও ওদের দু’জনার কথাবার্তা শোনে রেগে ব্যোম হয়ে গেল নওমী। ঝটপট আদিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে গম্ভীরস্বরে বলল,
‘আপনার বউ কয়টা?’
নওমীকে আগে থেকেই চিনে দীপালী। পুলিশের লোক এখনও নওমীকে চোখে চোখে রাখছে, সেটা সবাই জানে। সে-ও জানে। তাই হুট করে নওমীকে এই প্রশ্ন করতে দেখে চমকে গেল। আদিয়ানের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল, তার মুখটা বাংলার পাঁচের মতো। মনে হয় এই শকটার জন্য বেচারা প্রস্তুত ছিল না। সে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
‘বউ…। আমার আবার বউ এলো কোথা থেকে? আমি তো বিয়েই করিনি।’
নওমীর মেজাজ আপাতত ঝগড়াঝাটির দিকে। এত সহজে ঘুঘুকে ছেড়ে দেয়া যাবে না। ফাঁদে তাকে ফেলতেই হবে আজ। নাছোরবান্দা মেয়ের মতো সে-ও বলল,
‘রুমঝুম আপনার, বউ। এই পুলিশও আপনার বউ। সেদিন মার্কেটে বললেন, বউয়ের জন্য শাড়ি নিচ্ছেন। সেটা কোন বউ? এই বউ, না কি ও-ই বউ?’
এরকম আশ্চর্যরকমের কৌতুকপূর্ণ কথা শোনে শব্দ করে হেসে উঠল দীপালী। বলল,
‘আই থিংক, আপনি ওনাকে ভুল ভাবছেন নওমী। রুমঝুম ওনার বন্ধুর বউ। আর আমি ওনার নকল বউ।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি প্রশ্নটা ওনাকে করেছি, উত্তরটা উনিই দিবেন।’
এরপর আদিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বলুন, আপনার বউ কয়টা?’
আদিয়ানও কম যায় না। নওমীর নাকের ডগায় রাগ ঝুলে থাকতে দেখে বেশ মজা লাগল। কেন কে জানে, নওমীকে রাগানোর এই সুযোগটা সে হাতছাড়া করতে চাইল না। বলল,
‘আমার বউ কয়টা সেটা দিয়ে আপনার কাজ কী? আপনি তো আমার বউ নোন। আপনার এত মাথাব্যথা হওয়ার কথাও নয়। আমাকে নিয়ে আপনার এত কৌতূহলের কারণ কি জানতে পারি?’
‘না… পারেন না। কোনো মিথ্যুক ও একশো মেয়ের জামাইকে আমি কোনো কৈফিয়ত দেব না।’
দীপালী মেয়ে বলেই বোধহয় নওমীর এই ধরনের কথাবার্তার ইঙ্গিত সে বুঝে গেল। একটু হেসে বলল,
‘আদিয়ান ভাইয়া, আপনি ওনার সাথে কথা বলুন। আমি বরং থানায় যাই। দেখি, রাসেলের কী অবস্থা। দেরী দেখলে স্যার আবার ফোন করে কারণ জানতে চাইবেন।’
আদিয়ান ইশারায় মাথা নাড়লে, পার্কিং এড়িয়া থেকে নিজের স্কুটার নিয়ে থানার দিকে রওনা দিল দীপালী। নওমী তখনও রাগত্ব দৃষ্টিতে আশেপাশের দৃশ্যের দিকে চোখ ঘুরিয়ে রেখেছে। অনেকক্ষণ মুগ্ধ চোখে সেই দৃষ্টিতেই আটকে রইল আদিয়ান। মায়া মায়া চোখ, অভিমানী মুখ, এত কেন ডাকছিল তাকে, বুঝতে পারছিল না। মনের মধ্যে তীব্র ইচ্ছে জেগে উঠল, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রাগ-অভিমান মুছে দেয়ার জন্য। কিন্তু একপাক্ষিক অনুভূতির কারণে সুখ-সুন্দর ইচ্ছেটাও মাটিচাপা দিয়ে দিল। সামান্য কেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলল,
‘এটা একটা নাটকের সিন ছিল।’
নওমী সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘আপনি কি অভিনয়ে নাম লিখিয়েছেন?’
‘না… কিন্তু কখনও কখনও অভিনয় করতে হয় আমাদের। শুরু থেকেই আমি যা করছি, আমাকে যা জানছেন, সবটাই মিথ্যে। এই এক ঝুমের জন্য কতকিছু যে করতে হচ্ছে আমাকে। সব জানেন কি না জানি না, তবে এইটুকু জেনে রাখুন যে, খালি চোখে যা দেখছেন, তা সবসময় সত্যি হয় না।’
সব না জানলেও রুমঝুমের দিকের একটু-আধটু কথা নওমী জানে। আদিয়ান ও রুমঝুম যে স্বামী-স্ত্রী নয়, তা-ও জানে। তা-ই এই বিষয় নিয়ে আর কিছু বলতে চাইল না। আজকের ঘটনা মনে প্রশ্ন জাগিয়েছে, ওদের নাটক তাকে চমকে দিয়েছে, এই কারণে এটা নিয়েই কৌতূহল তার। তা-ই জানতে চাইল,
‘আজকের এই নাটকটা কীসের জন্য?’
আদিয়ান মন খারাপের সুরে বলল,
‘শুভকে যারা মেরে ফেলেছে তাদের খুঁজে বের করার জন্য।’
শব্দহীন পায়ে হাঁটা শুরু করল আদিয়ান। নওমীও পাশাপাশি এগোলো। হাঁটতে গিয়ে অদ্ভুত ইচ্ছে জেগে উঠল নওমীর। আঙুল ফাঁকে আঙুল আটকাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সাহসে কুলালো না। অযথাই আঙুল ফোটাতে ফোটাতে হাঁটছিল। পাশে একটা ফুচকার দোকান ছিল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এ্যাক্সাম শেষ হয়েছিল পাঁচটার পর। বাকিসব কাহিনী দেখতে গিয়ে দিন ফুরিয়ে গেল। সন্ধ্যের এই আলো-আঁধারির শহরটাকে আরেকটু গভীরভাবে ছুঁয়ে দেখার আগ্রহ জাগল নওমীর। পাশে থাকা ফুচকার দোকান দেখিয়ে বলল,
‘এখানে একটু বসবেন?’
তৃষ্ণার্ত স্বরের এই আওয়াজ ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল আদিয়ানকে। অনুমতি চেয়ে আগ্রহী চোখে চেয়ে রইল নওমী। এই দৃষ্টি, এই অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারল না আদিয়ান মাথা নেড়ে বলল,
‘শিওর।’
‘ফুচকা পছন্দ?’
‘মেয়েদের মতো এতবেশি নয়, তবে মাঝেমধ্যে চলে।’
নওমী হেসে ফেলল। দুটো ফুচকা অর্ডার দিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল,
‘তারপর বলুন, এই নকল বর-বউ কাহিনী আর কতদিন চলবে?’
চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করে মিটিমিটি হাসলো নওমী। আদিয়ান নিজেও হেসে উঠল। টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে, শেষ বিকেলের মায়াবী আলোয় নওমীর চোখের দিকে চেয়ে চেয়ে উত্তর দিল,
‘যতদিন না আসল বউ খুঁজে পাচ্ছি, ততদিন।’
আচমকা এই কথায় কাশি শুরু হলো নওমীর। কাশতে কাশতে বোতল থেকে পানি খেল। চোরাচোখে নওমীর এই কাশি, লুকোচুরি চেহারা দেখে আদিয়ান বলল,
‘আমার বউ খোঁজা নিয়ে আপনার এত চিন্তা কেন?’
প্রশ্ন করে ভ্রু নাচিয়ে চেয়ে থাকল আদিয়ান। নওমী বিব্রতবোধ করল। আসল কথা চেপে রেখে বলল,
‘তেমন কোনো কারণ নেই। না পেলে আমি ঘটকালি করে হেল্প করার চেষ্টা করতাম।’
‘তা-ই?’
শান্তস্বরের এই কথায় আবার কাশি শুরু হলো নওমীর। মুখে হাত চেপে রেখে কাশি এড়িয়ে বলল,
‘কেন? বিশ্বাস হয় না?’
‘আপনি আমার জন্য বউ খুঁজবেন কেন? যদি আপনার পছন্দের মেয়েকে আমার পছন্দ না হয়? তখন কী করবেন? নিজে এসে ফাঁকা জায়গা পূরণ করে দিবেন?’
শ্যাষ! কাশি-হাসি কিছুই সামাল দিতে পারল না নওমী। নিজেকে লুকোতে পানির বোতল হাতে নিয়ে দূরে সরে গেল। চোখেমুখে পানিঝাপটা দিয়ে মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে বলল,
‘আমি কি একবারও বলেছি, ফাঁকা জায়গা ভরাট করার দায়িত্ব নিতে চাইছি?’
‘না… সেটা বলেননি। কিন্তু যেভাবে ঘটকালি করার কথা বললেন, শোনে মনে হলো – পাত্রী না পেলে আপনি নিজেই ওখানে বসে যাবেন।’
নওমী মুখ ভেংচিঙে বলল,
‘এ্যাহ্, আসছে। যেন আপনার বউ হওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি আমি।’
দুষ্টুমিষ্টি কথার জাল বিছানো মুহূর্তটা দু’জনেই উপভোগ করছিল। তবুও কেউ মুখফুটে মনের কথা বলতে পারছিল না। শেষ বিকেলের আকাশে তখন অর্ধগোলকের চাঁদ ভেসে উঠল। ছোটো ছোটো অসংখ্য তারকারাজি জ্বলে ওঠে পৃথিবীর একপাশে অন্ধকার নামিয়ে দিল। সে মুহূর্তেও মুখ নামিয়ে রাখা নওমীর ঠোঁটের কোণের হাসিটা হৃদয়ে সুখের বাতাস বইয়ে দিল। ফুচকা চলে এলে, টক ও ঝাল মিশিয়ে ফুচকার স্বাদ ছেঁকে দেখল নওমী। আদিয়ান তখনও তাকিয়ে রইল। এমন উদাস বিকেলের রঙিন মুহূর্তকে আপন করতে গিয়ে দিক হারিয়ে গুনগুনিয়ে সুর তুলে গাইল,
মাঝে মাঝে তোর কাছে জেনেশুনে হেরে যাই…
কিছু কথা বলে ফেলি, কিছু কথা ছেড়ে যাই।
অচেনা সকাল হোক, উদাসী বিকেল হোক।
বারে বারে মনে হয়, তোর হাতে মরে যাই…
আজকে হাওয়া ছন্নছাড়া, আজকে হাওয়া বেবাগী…
আজকে সময় খোশমেজাজী, আজকে সময় সোহাগী…
এরপর হঠাৎ করেই পাশ থেকে এক ফুলওয়ালীর কাছ থেকে একগুচ্ছ লালগোলাপ কিনে নিয়ে নওমীকে চমকে দিয়ে হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো তার চোখের সামনে ধরে বলল,
‘ফুল পছন্দ?’
বিস্মিত চোখে সামনে চেয়ে থেকে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বলল,
‘ফুল অপছন্দ এমন মানুষ আছে?’
‘জানা নেই আসলে। তবে থাকতেও তো পারে।’
তরতাজা ফুলগুলো ফেরত দিল না নওমী। হাত বাড়িয়ে নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘কী উপলক্ষে এটা?’
‘এমনিই দিলাম। ফুল দিতে আবার উপলক্ষ লাগে?’
‘এমনি-এমনি কেউ কাউকে কেন ফুল দিবে?’
উত্তর খুঁজে পেল না আদিয়ান। ‘ভালোবাসি’ কথাটা মুখ থেকে বেরই হচ্ছে না। কী এক যন্ত্রণা। এদিকে ‘আম্মি’ তাড়া দিচ্ছেন। প্রতিদিন একবার করে বলছেন, ‘নওমীকে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে আয়, নয়তো আমার পছন্দের মেয়েকে গলায় ঝুলিয়ে দেব’। আর সে, আজ নয়, কাল। কাল নয়, পরশু। এসব বলে ইনিয়েবিনিয়ে কথা ঘুরাচ্ছে ও মায়ের অপেক্ষাকে লম্বা করে দিচ্ছে। নওমী কি তার হবে, এই ভয়টা সে এতদিনেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখনও পারল না। কেন সময়মতো যুতসই কথারা হারিয়ে যায়, কে জানে! সে চুপ করে রইলে নওমী বলল,
‘আপনার তো আবার নকল বউয়ের অভাব নেই। তাদেরকে কি কখনও এমন হাতভরা ফুল দিয়েছেন?’
আদিয়ান আঁৎকে উঠে বলল,
‘ছিঃ… পরের বউদের আমি কেন ফুল দিতে যাব?’
‘ওহ, তাহলে আমি পরের বউ হইনি বলেই কি আমাকে দিলেন?’
ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে আদিয়ানের পেটের ভেতরের কথাগুলো বের করতে চাইছিল নওমী। কিন্তু সে হার মেনে নিল। বুঝে নিল, এই গাধাটাকে দিয়ে এসব প্রপোজ-ট্রপোজ হবে না। সে-ও এত সহজে ধরা দিবে না। ভাবনাগুলো ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে দিল তার। আদিয়ান দেখল। মুগ্ধ হলো। বলল,
‘আপনি যদি কখনও পরের বউ হয়ে যান, তখন আর দেব না।’
‘ওহ…। আর নিজের বউকে? তাকে কি দিবেন?’
‘তাকে তো নিয়মিত দেব। চাইলেও দেব, না চাইলেও দেব।’
‘আর কী দিবেন?’
আদিয়ান ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,
‘হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দেব।’
‘আর?’
‘সময়ে-অসময়ে তারাভরা রাত উপহার দেব। মাঝে মাঝে একফালি রোদ্দুর উপহার দেব। কখনও কখনও মেঘমুক্ত আকাশ উপহার দেব।’
‘আর?’
নওমীর শুধু জানতে ইচ্ছে করছিল আদিয়ানের মনের ভেতরের চাওয়াগুলো। এজন্য একইভাবে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল শুধু। আদিয়ানও বিরক্ত হলো না। মুচকি হেসে উত্তর দিল,
‘আরও অনেককিছু আছে। কিন্তু সেসব আপনাকে বলা যাবে না।’
আহত চোখে চেয়ে নওমী বলল,
‘কেন?’
‘আপনাকে কেন বলব?’
দাঁত কিড়মিড় করে শক্তচোখে তাকাল নওমী। ফুচকা ফেলে রেখে ফুল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পার্স কাঁধে ঝুলিয়ে আদেশমাখা স্বরে বলল,
‘বিল পেমেন্ট করে তারপর বাসায় যাবেন। গাধা, হনুমান, জংলী ভূত কোথাকার। আপনার জীবনে বিয়েই হবে না।’
শেষটুকু একটু বিড়বিড়িয়েই বলল নওমী। এরপরই একটা সিএনজি থামিয়ে চলে গেল। আদিয়ান আহাম্মক বনে চেয়ে চেয়ে তার চলে যাওয়া দেখল। লিপসিং আন্দাজ করে বিড়বিড়াল,
‘আশ্চর্য! হুট করে মেয়েটা এত ক্ষ্যাপে গেল কেন? গালি আর অভিশাপ-ই বা দিল কেন? গাধা, হনুমান, জংলী ভূত, এগুলো কি আমার সাথে যায়?’
***
চলবে…
🟣 খণ্ডাংশ –
-‘আপনি যে এত লজ্জাবতী আমার জানা ছিল না। এখন এই লজ্জাবতীর লজ্জাটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতে চাইছি। প্রস্তুত তো আপনি সবকিছুর জন্য?’
লজ্জায় বড্ড বিব্রতবোধ করল দোয়েল। বুকের কাছে আলতো করে পাঞ্চ দিয়ে বলল,
-‘চুপ থাকুন। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, খেতে হবে।’
সাজানো খাবার-দাবারে একনজর চোখ বুলিয়ে রুদাইভ বলল,
-‘ক্ষিধে নেই আগেই বলেছি।’
-‘উঁহু, তখন মন ভালো ছিল না।’
-‘এখন কি মন ভালো হয়েছে, বলতে চাইছেন?’
উপরনিচ মাথা নেড়ে উত্তর দিল দোয়েল। রুদাইভ হেসে বলল,
-‘স্বীকার করছি। আপনার দেয়া প্রথম চুমু দারুণ প্রভাব ফেলেছে। একেবারে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে আমাকে। দেখুন, হার্ট কত দ্রুত বিট করছে? এভাবে চলতে থাকলে নির্ঘাত আপনার বিষাক্ত ঠোঁটের ছোবলে একদিন মৃত্যু হবে আমার।’
-‘ছিঃ। ঠোঁটে আবার বিষ থাকে না-কি!’
-‘খুব থাকে। একটা চুমু যেভাবে সমস্ত শরীরে কম্পন জাগিয়ে এতদিনের ঘুমন্ত অনুভূতিকে জাগিয়ে দিতে পারে, তাকে অনায়াসে বিষের সাথে তুলনা করা যায়। এই বিষ এখন আমার দেহ-মনে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছে। ট্রাস্ট মি, ছুঁয়ে দেখুন আবার।’
***
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৫
প্রেগন্যান্সির শেষ সময়ে এসেও লেবার পেইনের কোনো লক্ষ্মণ টের পাচ্ছিল না রুমঝুম। ডাক্তারের দেয়া সময় পেরিয়ে এক সপ্তাহ হতে চলল, অথচ এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের শারিরীক ত্রুটি দেখা যাচ্ছে না। তাই সকালেই ডাক্তার দেখিয়েছে। রিপোর্টে জানা গেছে আরও চার থেকে পাঁচদিন দেরী আছে। এই সময়ের মধ্যে যদি ব্যথা না আসে তাহলে ক্লিনিকে অ্যাডমিট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ডাক্তার দেখিয়ে মাজেদা খাতুনকে দেখতে এসেছে সে। সঙ্গে এসেছে মৌমিতা। পুরোটা সময় পাশে ছিল তার। ভরসার সঙ্গী হিসেবে। যেহেতু আজ শুক্রবার, মৌমিতার পড়াশোনার ও এ্যাক্সামের প্যারাটা ছিল না। অনেকদিন মাজেদা খাতুনকে না দেখে প্রাণ যাই যাই করছিল রুমঝুমের। কত ছটফটানি, কত দুঃশ্চিন্তা। আজ তাকে স্ব-শরীরে দেখে মৃতপ্রায় দেহে প্রাণ ফিরে পেল। অসুস্থ শরীরের রুমঝুমকে দেখে মাজেদা খাতুন অবাক হলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘একী মা, তুই! এই শরীর নিয়ে আসতে গেলি কেন? আমাকে ফোন করলেই ছুটে যেতাম।’
রুমঝুম হাসিমুখে বলল,
‘বার বার তুমি কেন যাবে? একদিন আমি এলে ক্ষতি কী?’
আলেয়া বেগম রাগারাগি করলেও সেই রাগ ধরে বসে থাকেননি মাজেদা খাতুন। নিজের বিবেক তাঁকে যা করতে বলেছে, তিনি সেটাই করেছেন। ইচ্ছে হয়েছে, ছুটে গিয়ে দেখে এসেছেন। পাশে বসে যত্ন করে খাইয়ে এসেছেন। ফলমূল কিনে দিয়ে এসেছেন। রুমঝুমের এই কথা শোনে হেসে উঠে বললেন,
‘ক্ষতি কিছু নেই। কিন্তু তুই অসুস্থ। রাস্তাঘাটে কী না কি দুর্ঘটনা ঘটে! তোকে নিয়ে আমার ভয় বড্ড হয়, মা।’
রুমঝুম বলল,
‘তুমি খামোখাই টেনশন কোরো আমাকে নিয়ে। এত টেনশন না করে একটু দোয়া কোরো তো। যেকোনো বিপদ-আপদে দোয়াটাই কাজে দেয়, টেনশন নয়। বুঝেছ?’
মাজেদা খাতুন দু’হাতে রুমঝুমকে ধরে নিয়ে গেলেন। বললেন,
‘টেনশন হোক কি দোয়া, তুই এইভাবে রাস্তাঘাটে বের হোস না।’
মৌমিতা বলল,
‘আমি অনেক বুঝিয়েছি আন্টি, কিন্তু রুমঝুম আমার কথা শুনলে তো। ওর একটাই কথা, বের হয়েছে যখন তখন আপনাকে না দেখে ফিরবে না। কাছেই যেহেতু তাই আমি আর বাঁধা দিলাম না।’
ওদের দু’জনকে বসিয়ে কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ঝটপট কিছু নাশতা পানির ব্যবস্থা পানির ব্যবস্থা করলেন মাজেদা খাতুন। গল্প হলো, আড্ডা হলো, বেশ খানিকক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো। এরমধ্যেই কলিংবেল বাজলো। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিতেই জাদীদ এসে বাসায় ঢুকল। অসময়ে ছেলেকে দেখে মাজেদা খাতুন বললেন,
‘আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরলি যে?’
‘গুরুত্বপূর্ণ কাজটা শেষ হয়ে গেল, তাই ফিরে এলাম।’
ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে রুমঝুম ও মৌমিতাকে দেখে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল জাদীদ। ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসতেই তারজন্যও চা এলো। রুমঝুম জানতে চাইল,
‘কেইস কতদূর এগোলো, ভাই?’
জাদীদ চায়ের কাপ হাতে নিয়েছিল সবে। রুমঝুমের প্রশ্ন শোনে মুচকি হেসে বলল,
‘অনেকদূর।’
‘ওদের শাস্তি দিতে পারবেন তো?’
‘শাস্তির কাজ অলরেডি শুরু হয়েছে। আজ একজনের বারোটা বাজিয়ে এসেছি।’
বারোটা বাজানোর কথা শুনে আঁৎকে উঠল রুমঝুম। মুখে হাত রেখে বলল,
‘হায় আল্লাহ! কার?’
‘ইমতিয়াজের।’
‘কী শাস্তি?’
‘আগামীকাল সকালের ব্রেকিং নিউজটায় চোখ রাখলেই দেখতে পাবে।’
কথার মধ্যে রহস্য রেখে দিল জাদীদ। ইমতিয়াজের যে কী হয়েছে, সেটা শুধু সে-ই জানে। আগামীকাল সকালে মিডিয়ার লোকজন জানবে, এরপর পুরো দেশ জানবে। কিন্তু আসল সত্যতা কেউই কোনোদিন জানতে পারবে না। ভাবতেই হাসি পেল তার। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ওখানে বসে বসেই আদিয়ানের সাথে প্রয়োজনীয় একটা আলোচনা শুরু করল। রুমঝুম সব শুনলেও কিছু বুঝল না। শুধু বুঝল, জাদীদ ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়ের মতোই ক্ষ্যাপে আছে। জাহাঙ্গীরের লোকজনকে পর্যাপ্ত শাস্তি না দিয়ে থামবে না। শক্তিশালী দানবের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে গেছে। কারণ ও যত কথা ফোনের ওপাশের ব্যক্তির সাথে সারছিল, বেশিরভাগ সময়ই তার কপালের রগটা ফুলে-ফুলে উঠছিল। আইনের লোক হলেও কখনও জাদীদকে এত রেগেমেগে কথা বলতে দেখেনি অথচ শুভর খুনীদের খুঁজে বের করতে গিয়ে সে যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর তার এই বেপরোয়া রূপটা বড্ড অচেনা ও ভয়ানক ঠেকল রুমঝুমের কাছে। মৌমিতার হাত খামচে ধরে বলল,
‘এই লোকটা এত রাগী, আগে তো বোঝা যায়নি।’
জাদীদের কথাগুলো মৌমিতাও শুনছিল। সেদিনের সেই প্ল্যান সম্পর্কে কিছু না জানলেও এইমুহূর্তে তার মুখে রাসেলকে নিয়ে যতগুলো কথাবার্তা হলো, সব কথাতেই জাদীদ বেশ রেগে রেগে রাসেল ও তাদের সঙ্গীসাথীদের ব্যাপারে কথা বলছিল। সবশেষে যখন বলে উঠল,
‘ওই জানোয়ারটা মুখ খুলছে না। মুখ না খুললে ওর অবস্থাও ইমতিয়াজের মতোই হবে। আমার সাথে গলাবাজি করছিল। আমার সাথে…। আইনের লোকের সাথে। ও জানে না, আমি ওর কী করতে পারি। ওকে মেরে ফেলার জন্য আমার রিভলবারের একটা গুলিই যথেষ্ট।’
রুমঝুমের কথার উত্তরে মৌমিতা বলল,
‘এই ব্যাপারটা মানুষের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় না, ঝুম।’
‘তাও ঠিক। তুমি বোসো, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।’
জাদীদ তখনও ফোনে কথা বলছিল, মৌমিতা ও মাজেদা খাতুন গল্প জামালেন আবারও। সবাইকে রেখে রুমঝুম ওয়াশরুমে ঢুকল। যেহেতু প্রাইভেসি প্রয়োজন তা-ই দরজা লক করেই ভেতরে গেল। কিন্তু বের হওয়ার সময় সে অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল। পা ফেলতে গিয়ে মনে হলো, পড়ে যাবে। অথচ তার মাথা ঘুরছে না। কিন্তু পা স্লিপ কাটছে। ঢোলা মিডির সাথে পরা পায়জামাটা ভেজা ভেজা লাগছে। চিন্তিত মনে নিচ থেকে পায়জামা সামান্য উঠিয়ে দেখল, পা বেয়ে তরল পদার্থ পড়ছে, সাথে অল্পস্বল্প রক্ত। চমকে গিয়ে কোনোমতে দরজা খুলে আতঙ্কিত স্বরে ডাক দিল,
‘আন্টি, এদিকে একটু এসো।’
রুমঝুমের আতঙ্কিত স্বর জাদীদ ও মৌমিতার কানে এলো। দু’জনেই ছুটে গেল সামনে। দেয়ালে হাত দিয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে রুমঝুম। জোরেশোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মৌমিতা তার হাত ধরতেই বলল,
‘ভাইয়াকে একটা ফোন কোরো, আপু। হসপিটালে যেতে হবে।’
যেভাবে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, পা ফেলার শক্তি পাচ্ছে না। পা ফেলতে গেলেই স্লিপ কাটছে বার বার। সাহসে কুলাচ্ছে না আর। কোমর ধরে ব্যথাটা যেন আরেকটু গাঢ় হচ্ছে। দু’দিন ধরে পেট থেকে উরুর অংশে ব্যথা থাকলেও এটা লেবার পেইন কি না নিশ্চিত হতে পারেনি সে। আবার ডাক্তারও জানিয়েছেন, সময় এখনও বাকি আছে। ভয় বা তাড়াহুড়োর কিছু নেই। অথচ এখানে আসার থেকে রুমঝুম টের পাচ্ছিল, ব্যথা যেন গেঁথে বসতে চাইছে, অথচ চাপছে না। মাজেদা খাতুন দৌড়ে আসতেই রুমঝুম নিজের পায়ের পাতা দেখাল, রক্ত ও পানিভাঙা দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জাদীদকে বললেন,
‘গাড়ি বের কর, জাদীদ। হসপিটালে যেতে হবে।’
নিচে নামতে নামতে ঝটপট আবারও আদিয়ানকে ফোন করল জাদীদ। রুমঝুমের অবস্থা জানালো। নিচের গ্যারেজ থেকে নিজেদের গাড়ি বের করে দৌড়ের ওপর নিজেদের ফ্লাটে এলো। রুমঝুম আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে তাকে ধরে রেখেছেন মাজেদা খাতুন, আরেকহাতে মৌমিতা। দু’জনে মিলে ধরাধরি করে যখন এগোচ্ছিলেন, তাতেও পা ফেলে এগোতে পারছিল না রুমঝুম। ব্যথা ক্রমশ বেড়ে গিয়ে হাঁটাচলার শক্তি কেড়ে নিচ্ছিল। কোনোরকম লিফটের কাছাকাছি এলে, মাজেদা খাতুন বললেন,
‘কিছু পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় নিতে হবে, জাদীদ। আমি ব্যাগ গোছাচ্ছি। তুই ওকে গাড়িতে তোল। মেয়েটা হাঁটতে পারছে না।’
জাদীদের অস্বস্তি শুরু হলো। মায়ের হুকুম পেয়েও পা টলিয়ে সাহস করতে পারছিল না। দাঁড়িয়েই ছিল। সবকিছু গোছাতে সময় লাগছিল, এদিকে রুমঝুমও ব্যথায় চিৎকার শুরু করেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামা কষ্ট, একা তাকে ধরে নিয়ে এগোবে সেই শক্তি মৌমিতার নেই। সাত-পাঁচ ভেবে সে হাত বাড়িয়ে রুমঝুমের হাত ধরে বলল,
‘আমি ছুঁলে অসুবিধা?’
রুমঝুমের ইচ্ছে হলো, শক্ত কিছু দিয়ে জাদীদের মাথাটাই ফাটিয়ে দিক। তার মনোভাব এমন যে, আরেহ ভাই দেখছিস বিপদে, কোথায় হেল্প করবি, তা না করে অনুমতি নিয়ে হিরোগিরি দেখাচ্ছিস। মুখে কিছু বলতে না পারলেও, নীরবতা ও কটমট দৃষ্টি দিয়ে সেটা বোধহয় বুঝিয়ে দিল রুমঝুম। অসহনীয় ব্যথা চেপে আসতেই অনিচ্ছাকৃতভাবে শক্ত করে জাদীদের কাঁধ খামছে ধরল। আর তাতেই মাথা থেকে সবকিছু বেরিয়ে গেল বেচারার। ঝটপট দু’হাতের শূণ্যে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে লিফটে পা রাখল। মৌমিতা লিফটের বাটন টিপলে মুহূর্তেই দরজা আটকে তিনজনকে নিয়ে লিফটটা নিচে এসে পৌঁছাল। রুমঝুমকে গাড়িতে বসিয়ে, মৌমিতাকেও পিছনে বসতে বলল। মৌমিতা রুমঝুমকে মাঝখানে রেখে ডানপাশে বসলো। এরমধ্যেই হাতের নাগালে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে ছুটে এলেন মাজেদা খাতুন। বামপাশে বসে রুমঝুমকে ভরসা দিয়ে জড়িয়ে রাখলেন। জাদীদ ড্রাইভ শুরু করল। কাছেপিঠে যে হসপিটাল সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও আদিয়ানের নম্বরে ডায়াল করে বলল,
‘বের হয়েছ? যতদ্রুত পারো চলে এসো। আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব।’
***
রাত আটটায় ফুটফুটে এক সুস্থ-স্বাভাবিক কন্যা সন্তানের জন্ম দিল রুমঝুম। যার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসববেদনার যন্ত্রণাটুকু ভুলে গেল সে। নার্স যখন তার সদ্যোজাত শিশুকে বুকের মাঝখানে জড়িয়ে দিল, আনন্দে চোখদুটো ভরে উঠল তার। অজস্র চুমু খেল আদুরে বাচ্চার চোখেমুখে। বিয়েটা যেভাবেই হোক, যেমন করেই হোক, এই বাচ্চাটা তার ও শুভর অংশ, এইটুকু ভাবনা তার এতগুলো দিনের কষ্ট ও জ্বালাময়ী মুহূর্তগুলোকে ভুলিয়ে দিল। সব ধরনের ঝুটঝামেলা শেষে নিরাপদ একটা কেবিনে রাখা হলো মা ও মেয়েকে। আদিয়ান ছোট্ট বাচ্চার কানের কাছে আযানের প্রতিটা সুমধুর লাইন স্পষ্ট উচ্চারণ করে সদ্যোজাতকে আযান শুনিয়ে, রিসেপশনে গেল। আলেয়া বেগম ও মাজেদা খাতুন দু’জনেই রুমঝুমের পাশে আছেন। বাচ্চাটাকে আলাদা বেডে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আলেয়া বেগম বললেন,
‘ওর নাম কী রাখবি, ঝুম?’
রুমঝুম নিচুস্বরে বলল,
‘শুভ ওর নাম ঠিক করে রেখেছিল।’
‘কী?’
‘রুমাইসা জামান শামা।’
নাম নিয়ে আর কোনো মতামত প্রকাশ করলেন না আলেয়া বেগম। রাতের খাবার কিছু আনতে হবে কি না সেটা নিয়েই মৌমিতার সাথে কথা বলতে বারান্দায় এলেন তিনি। মৌমিতা ফোনে কথা বলছিল। ভদ্রমহিলাকে দেখে ফোন রেখে বলল,
‘আন্টি কিছু লাগবে?’
‘না… মা। বলছিলাম, আমাকে তো বাসায় যেতে হবে। দু’দিন যেহেতু এখানে থাকতে হবে, রাতের খাবার-দাবার কিছু তৈরী করা লাগবে। তাড়াহুড়োয় তো তখন এতকিছু মাথায় ছিল না।’
মৌমিতা বলল,
‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমার ফ্রেন্ড খাবার নিয়ে আসছে।’
‘কে?’
‘নওমী।’
‘তাকে আবার কষ্ট করতে বললে কেন?’
‘আমি বলিনি। রুমঝুমের খবর জানানোর পরই ও জানতে চাইল, রাতে এখানে থাকতে হবে কি না। তখন বললাম, দু’দিন থাকা লাগবে। এরপর ও নিজেই বলল, খাবার-দাবার নিয়ে ঝামেলা করার দরকার নেই। ও একটু পর রুমঝুম আর তার বাচ্চাকে দেখতে আসবে। আসার সময় বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে আসবে।’
‘তবুও তোমার বন্ধুটিকে বারণ করা উচিত ছিল, মা।’
‘বারণ করলেও ও বারণ শুনত না, আন্টি।’
‘এই রাতের বেলা!’
‘ঢাকা শহরে এই রাত কিছুই না, আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না। ও এলে আমরা একসাথে চলে যাব। আপনারা দু’জন রাতে এখানেই থাকুন।’
মেয়ে মানুষের এত রাত অবধি বাইরে চলাফেরা করাটা আলেয়া বেগমের পছন্দ নয়। একে তো শহুরে মেয়ে অপছন্দ, তারমধ্যে নওমীর এই স্বভাব জেনে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিতেও হিমশিম খাচ্ছেন। বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে অপমানিত হতে হবে না তো? বিয়ের পর মেয়েটা ঘরমুখো হবে তো? স্বামী-সংসার আগলে রাখতে পারবে তো? দুঃশ্চিন্তায় তিনি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। শুধু বললেন,
‘তোমাদের কষ্ট দিয়ে ফেলছি। এরকম একটা বিপদের দিনে…।’
মৌমিতা তড়িঘড়ি বলে উঠল,
‘না না, আন্টি। এতে আমাদের কোনো অসুবিধা কিংবা কষ্ট হচ্ছে না। বরং আমাদের খুব ভালো লাগছে। তাছাড়া আমরা এসবে অভ্যস্ত।’
ভেতরে একটা খচখচানি নিয়ে আবারও কেবিনে প্রবেশ করলেন তিনি। মৌমিতা বান্ধবীর অপেক্ষায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। নওমী এলো আরও ঘণ্টাখানেক পর। বারান্দায় প্রিয় বন্ধুটিকে দেখে বলল,
‘রুমঝুমের কী অবস্থা?’
‘ভালো আছে এখন।’
‘আর বেবি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, সম্পূর্ণ সুস্থ।’
‘শুভ ভাইয়া থাকলে আজ খুব খুশি হতো, তাই না?’
‘তা আর বলতে।’
কথা বলতে বলতে কেবিনের দিকে এগোলো ওরা। মৌমিতা বলল,
‘তোকে একা আসতে দেখে আংকেল কিছু বলেননি?’
‘চোখ রাঙিয়েছেন শুধু। কিন্তু তুই তো জানিস, ওনার এই চোখ রাঙানি মোটেও ভয় পাই না আমি। তাই পিছন ফিরে তাকাইনি। মাম্মিকে বলে চলে এসেছি।’
ততক্ষণে ওরা কেবিনের সামনে পৌঁছে গেছে। কথাবার্তার ইতি টেনে ভেতরে প্রবেশ করে টিফিন ক্যারিয়ারটা ছোট্ট কেবিনেটে রেখে, রুমঝুমের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে নওমী বলল,
‘এখন কেমন আছো?’
রুমঝুম আধশোয়া হয়ে বসেছিল। নওমীকে দেখে দুর্বল শরীর নিয়ে সোজা হয়ে বসে বাচ্চাটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,
‘আমার মেয়ে।’
নওমী চারপাশে তাকিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসটা হাতের কাছে না পেয়ে একজন নার্সকে ডেকে বলল,
‘একটা হ্যান্ড সেনিটাইজার হবে?’
নার্স বলল,
‘ওয়াশরুমে রাখা আছে।’
প্রথমে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে স্যাবলন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করল নওমী। যদিও হাত পরিষ্কার, তবুও বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা। হাত ধুয়ে সামান্য হ্যান্ড সেনিটাইজার হাতে মেখে হাতটা ভালোমতো শুকিয়ে তারপর পরিষ্কার কাপড়ের সাহায্যে ছোট্ট শামাকে যত্ন করে কোলে তুলে নিল। ওর এই বাড়তি সতর্কতা দেখে আলেয়া বেগম নাকমুখ কুঁচকে নিয়ে বললেন,
‘তুমি কি খুঁতখুঁতে স্বভাবের মেয়ে?’
সরাসরি এই কথাতে বড্ড বিব্রতবোধ করল নওমী। কথার অর্থ স্পষ্ট না বুঝাতে প্রশ্ন করল,
‘কেন আন্টি?’
‘একটা বাচ্চাকে ধরতে গিয়ে এত সময় নিয়ে হাত ধুতে হলো তোমার, তাই মনে হলো আরকি।’
‘আমি তো আমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য হাত ধুইনি আন্টি, ধুয়েছি ওর নিরাপত্তার কথা ভেবে। আমি বাইরে থেকে এসেছি। হাতে অনেক ধুলোবালি উড়ে এসেছে, যেটুকু ওর অসুস্থতার কারণ হতে পারে। এইটুকু বাচ্চা, তাকে ধরতে গেলে একটু-আধটু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলেই মনে হয় আমার। আমি বাচ্চাদের এভাবেই ধরি।’
আলেয়া বেগম ফের নাকমুখ কুঁচকে পাশেই বসে রইলেন। মাজেদা খাতুন বললেন,
‘ডাক্তারেরাও কিন্তু এসব পরামর্শ নিয়মিত দিয়ে থাকেন। ছোট্ট বাচ্চাদের ধরাছোঁয়ার ক্ষেত্রে আমাদের একটু সতর্ক থাকা উচিত। হাতে ও নখে অদৃশ্য কত জীবাণু থাকে। এই জীবাণু, ছোটো ছোটো বাচ্চাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর।’
নওমী একটু শান্তি পেল এই কথা শোনে। আলতোস্পর্শে ঠোঁট ছোঁয়ালো ছোট্ট শামার কপালে। বলল,
‘মাশা’আল্লাহ, দীর্ঘায়ু হও, মা। অনেক অনেক দোয়া ও আদর রইলো তোমার জন্য।’
ফার্মেসি থেকে কিছু ঔষধপত্র নিয়ে ফিরল আদিয়ান। দরজার পাশ থেকে এরকম একটা দৃশ্য দেখে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। নওমী এখানে আসবে, ভাবতেই পারেনি। খানিকটা চমক ও বেশ কিছুটা ভালো লাগা নিয়ে ভেতরে পা রেখে মায়ের দিকে তাকিয়েই ভরকে গেল। কীরকম বিরক্তিকর একটা দৃষ্টি নিয়ে নওমীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। অথচ বিরক্ত হওয়ার মতো দৃশ্য এটা ছিল না। ঔষধপত্র রেখে মাকে বলল,
‘আম্মি, আমরা চলে যাচ্ছি। রাতে যদি কিছু প্রয়োজন হয়, নার্সকে ডাক দিও। এখানে দু’জন নার্স প্রতিমুহূর্ত ঝুম ও বাচ্চার দেখাশোনা করতে আসবে।’
রুমঝুমের প্রয়োজনীয় ঔষধ বুঝিয়ে দিয়ে, আম্মির হাতে কিছু টাকা দিয়ে, কেবিন ত্যাগ করল আদিয়ান। জাদীদ নিচেই আছে। অতিরিক্ত মানুষ ভীড় করা অনুচিত ভেবেই সে আর ভেতরে আসেনি। তাছাড়া অদ্ভুতরকম একটা অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরেছে। রুমঝুমের মুখোমুখি হতে বুক কাঁপছে। তখন হয়তো সাহায্যের প্রয়োজন ছিল বলেই সে-ও কোনো দ্বিধা ও জড়তাহীনভাবে তাকে বিশ্বস্ত ভেবে আঁকড়ে ধরেছিল, কিন্তু এখন চোখে চোখ পড়াটাও যথেষ্ট লজ্জার হয়ে দাঁড়াল। নিজেকে অহেতুক লজ্জার মুখে দাঁড় করাতে নারাজ জাদীদ দূরেই সরে থাকল। কাছে ভীড়ল না, দেখলও না। দূর থেকে শুধু একবার বাচ্চাকে দেখে রবের নিকট শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছিল। এ-ই ঢের। আদিয়ান নিচে এলে দু’জনে হসপিটালের সীমানা ত্যাগ করে গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল। ওরা বাইরে আসার সাথে সাথে নওমী ও মৌমিতাও চলে এলো। ওদের একেকজনের গন্তব্য একেকদিকে হলেও আদিয়ান ও নওমীর গন্তব্য প্রায় কাছাকাছি। একই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে ওদেরকে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মৌমিতা নিজের বান্ধবীকে বলল,
‘তুই একা যেতে পারবি?’
নওমী বলল,
‘হ্যাঁ, পারব। অসুবিধা নেই। তুই চলে যা।’
মৌমিতার বাসা যেহেতু কাছেই, সে একটা রিকশায় উঠে বিদায় নিল। জাদীদ নিজের গাড়িতে বসে নওমীকে বলল,
‘আমি ড্রপ করে দিই?’
দু’দিকে মাথা নেড়ে নওমী বলল,
‘এসবের দরকার নেই। আপনার অনেকটা পথ ঘুরতে হবে আবার। আমি চলে যেতে পারব।’
জাদীদের দু’বার চক্কর পড়বে দেখে আদিয়ানও যেতে রাজি হলো না। উলটে জাদীদকে জোরপূর্বক বাসার দিকে রওনা দিতে বাধ্য করল। অবশেষে ওদের দু’জনকে রেখে জাদীদ ও মৌমিতা দু’দিকে চলে গেল। এতক্ষণ বোধহয় এইটুকু ফাঁক খুঁজছিল নওমী। সুযোগ পেয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
‘আমরা তো একইপথে যাব। একসাথে যেতে পারি?’
কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আদিয়ান বলল,
‘আমি তো আবার গাধা, হনুমান, জংলী ভূত, কারও কি আমার সাথে যাওয়ার আগ্রহ জন্মাবে?’
‘আগ্রহ না থাকলে কি একসাথে যাওয়ার প্রস্তাব রাখতাম?’
‘হুট করে এই আগ্রহ জন্মানোর কারণ কী জানতে পারি?’
নওমী লাজুক হেসে বলল,
‘সব কারণ তো বলতে পারব না। তবে একটা কারণ বলি, আপাতত এই আধভেজা পরিবেশে, ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইছি, যেন এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে পারি।’
একটু কুয়াশা আবার একটু-আধটু বৃষ্টির ফোঁটাও রাতের অন্ধকারকে অন্যরকম এক সৌন্দর্য দিয়ে রহস্যময় করে তুলেছে। সেই রহস্যময় সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে নওমীকেও আজ এক রহস্যময় মানবী মনে হচ্ছে তার। তাই আদিয়ানও কণ্ঠে যথেষ্ট রহস্য রেখে বলল,
‘এই আধভেজা রাতে, সঙ্গী হিসেবে অন্যকেউও তো থাকতে পারত, আমি-ই কেন?’
নওমী উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার বিশ্বাস ছিল, আদিয়ান এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিবে না। সেদিনের দৃশ্যটা রিপিট করবে আবারও। কিন্তু হলো উলটো। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তাকে রাগিয়ে দিল গাধাটা। মেঘে ঢাকা চাঁদ, কুয়াশার বুক ছিঁড়ে ঝরে পড়া ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, হুটহাট বিদ্যুৎ চমকানো, মৃদু শব্দে বজ্রপাতের গুঞ্জন ও মন খারাপকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল সে। তখুনি পিছন থেকে ভেসে এলো গানের লিরিক। হাঁটার গতি ধীর করে ফুটপাতেই দাঁড়িয়ে গেল নওমী। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, হাঁটি হাঁটি পা পা করে তার দিকেই এগোচ্ছে আদিয়ান। মেঘমেদুর আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে গাইছে –
Ik Pal Tujhko Na Dekhun to,
Chain Mujhe Nahi Aata Hai.
Na Jaane Ye Kyun Hota Hai,
Dil Mera Ghabraata Hai.
Haan Tere Siva Kisi Aur Ko Dekhun,
Ye Dil Sah Nahi Paata Hai.
Tere Bina Mere Saanson Se Rishta,
Toot Jaata Hai…
Ham Itna Paagal Ho Gaye,
Sab Log Ye Kahte Hain…
Baaton Hi Baaton Me,
Ham Tera Naam Lete Hai…
Baaton Hi Baaton Me,
Ham Tera Naam Lete Hai…
***
চলবে।