পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-২৬

0
32
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৬

গানের প্রতিটা লাইন, প্রতিটা শব্দ নওমীর মনে ঝড় তুলছিল। জানতে ইচ্ছে করছিল, এই গানটা তার উদ্দেশ্যেই গেয়েছে কি না। কিন্তু কিছু সংকোচ, কিছু জড়তা ও কিছু লজ্জা আষ্টেপৃষ্ঠে তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেল। চোখে চোখ রেখে আদিয়ান যখন তার মুখোমুখি দাঁড়াল, তখনও হাত-পায়ের অস্বাভাবিক কম্পনকে ঠেকাতে পারছিল না সে। ঝড়হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে তিরতির করে কাঁপছিল তার লাল টুকটুকে ঠোঁটজোড়া। বুক ধড়ফড় ভাবটা ক্রমাগত বেড়ে গিয়েছিল বলে, শরীরের কম্পন থামাতে স্ববেগে নিজের পরনের কূর্তিকে খামছে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ঘনঘন চোখের পাপড়ি ফেলে নিঃশ্বাসটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল নওমী। এই সবকিছুই আদিয়ান লক্ষ্য করছিল। ঠোঁট কামড়ে হাসছিলও সে। কেন হাসছিল কে জানে। তবে নওমীর এই নতমুখী ও লুকোচুরি ভাবসাব বড্ড ভালো লাগছিল তার। সেইসাথে ঠোঁটের কম্পন অস্থির করে তুলছিল তাকে। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে শান্তস্বরে জানতে চাইল,

‘ওভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? সামনে হাঁটুন।’

নওমী হুঁশে ফিরে ঝটপট স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে বলল,
‘হঠাৎ গান গাইলেন কেন?’

আদিয়ানের ইচ্ছে হলো বলে দিক, এই গানের প্রতিটা কথা, প্রতিটা শব্দ আপনাকে ডেডিকেট করে গাওয়া। কোনো এক অজানা কারণে আজও মনের কথা মুখে এলো না। শুধু বলল,

‘এই গানটা আমার খুব প্রিয়। তাই মাঝেমধ্যে গাই।’

বিরক্তির চোখে তাকিয়ে নওমী সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। বুঝে নিল, এই স্টুপিডকে দিয়ে প্রপোজের আশা করা বৃথা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গিয়ে আকাশের কোণে জ্বলে ওটা চাঁদটা নিজের স্বরূপে ফিরে এসেছে। মেঘ সরে গিয়ে আকাশটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। হাঁটার ফাঁকেই আদিয়ান বলল,

‘গানটা কি খারাপ? শুনতে ভালো লাগেনি?’

নিজের অনুভূতি ঠিক কেমন, তা বুঝাতে চাইছিল না নওমী। তাই নিশ্চুপ থেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হেঁটে যাচ্ছিল সে। উত্তর না পেয়ে বাড়তি কোনো প্রশ্ন করল না আদিয়ান নিজেও। নিজেকে বুঝাতে সে ব্যর্থ, এইটুকু মেনে নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছিল সে-ও। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছিল ওরা। ফুটপাত ধরে হাঁটলেও হঠাৎ করেই ঝড়েরবেগে খুব কাছ দিয়ে একটা বাইক ছুটে এলে বাইকে থাকা দু’জন যুবকের মধ্যে পিছনের জন ছুরি বের করে নওমীকে আঘাত করতে গেলে মুহূর্তের মধ্যেই আদিয়ান নিজের হাতের টানে ফুটপাতের দিকে টেনে নিল মেয়েটিকে। অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাতটা তার হাতের কনুইয়ের নিচের দিকে দেবে গিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা কেটে গেল। টি’শার্ট পরনে ছিল বিধায় আঘাতটা গাঢ় হলো বেশি। নওমী তখনও ব্যাপারটা বুঝল না। ধাক্কা খেয়ে দূরে সরে গিয়ে হোঁচট খেল। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, বাইক আরোহী অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে। সড়কে দাঁড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে ঝটপট কিছু একটা টাইপ করছে আদিয়ান। মুখোমুখি এসে যখন বকতে যাবে, তখুনি আদিয়ানের হাতের রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেল নওমী। কী করবে ভেবে পেল না। বুদ্ধিশুদ্ধি লুপ পেল তার। রক্ত বন্ধ করার উপায় হিসেবে তড়িঘড়ি নিজের স্কার্ফ খুলে রক্তাক্ত হাতে শক্ত বাঁধন আটকে বলল,

‘আপনার হাতে সেলাই দরকার। অনেক রক্ত ঝরছে। ওরা কারা? কেন আপনাকে আঘাত করল?’

ততক্ষণে বাইকে থাকা যুবকেরা এই সীমানা ত্যাগ করেছে। জাদীদের ফোনে টেক্সট করে গাড়ি নম্বর পাঠিয়ে মোবাইল প্যান্টের পকেটে রেখে আদিয়ান বলল,
‘ওরা আমাকে নয়, আপনাকে মারতে এসেছিল।’

‘কী…!’

সম্পূর্ণ ঘটনাটা পূণরায় কল্পনা করে আঁৎকে উঠল নওমী। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আদিয়ান নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দিচ্ছিল! কী হতো, যদি ছুরিটা হাতে না ঢুকে পেটে ঢুকত? ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠল তার মন-প্রাণ। দু’হাতে রক্তাক্ত হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল,

‘আমার জন্য কেন নিজের এই ক্ষতি ডেকে আনলেন আপনি? কত রক্ত ঝরে গেল! ইশ্, এক্ষুণি ট্রিটমেন্ট না নিলে মারাত্মক ইনফেকশন হয়ে যাবে। খুব কষ্ট হচ্ছে না?’

নওমীর ভয়মিশ্রিত কণ্ঠস্বর ও উৎকণ্ঠিত মনের প্রগাঢ় অনুভব নিমিষেই ছুঁয়ে গেল আদিয়ানের অন্তর। হাতের মধ্যে আগলে রাখা হাতটা ছুঁয়ে নির্দ্বিধায় বলল,

‘কিছুই হবে না। এইটুকু আঘাতে কষ্ট হয় না, নওমী। এটা তো সামান্য আঘাত। আপনার জন্য বিনাবাক্যে আমি নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। বিশ্বাস করুন, তাতেও আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না।’

এত রক্ত ঝরছে, এতটা জায়গা জখম হয়েছে, ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না, তবুও এই ছেলে বলছে, এই আঘাত কিছুই না। নিজের অনুভূতিকে সবসময় লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত নওমী খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কঠিন আবরণ থেকে মুক্ত করল নিজেকে। রক্তাক্ত হাতের তালু আলগোছে নিজের গালে ঠেকিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে চেয়ে থেকে, কণ্ঠে অজস্র উৎকণ্ঠা ও আকুলতা মিশিয়ে বলল,

‘কেন? আমি কে হই আপনার?

সময় ও পরিস্থিতি সবকিছু ভুলে গেল আদিয়ান নিজেও। ভুলে গেল হাতের ব্যথা ও যন্ত্রণার কথা। সে একজন অতি সাধারণ মানুষ, অথচ তার জন্য এই মেয়েটার চোখ থেকে পানি ঝরছে, তার জন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, বিষয়টা একরাঁশ সুখ এনে দেয়ার পাশাপাশি মনের কোণের প্রশ্নদের জাগিয়ে দিল। উত্তরটা সত্য ও সুন্দর জেনেও মনের ভয় দূর হলো না। নওমীর চোখ থেকে তখনও টপটপ করে পানি পড়ছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সোডিয়াম আলোয় চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিদের তার দামী মুক্তোদানার মতো মনে হলো। হাত বাড়িয়ে মুক্তোদানাদের ছুঁয়ে দেখার লোভ সে সামলাতে পারল না। আঙুলের আলতোস্পর্শে দামী সব মুক্তোদানাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলল,

‘আশ্চর্য! আপনি কাঁদছেন কেন? টেইক ইট ইজি।’

আদিয়ানের একটা হাত নওমীর বামগালে ছিল, চোখের পানি ছোঁয়াতে অন্যহাতটাও ডানগাল ছুঁলো। দুটো হাতকেই নিজের হাত দ্বারা গালের সাথে চেপে রাখল নওমী। জড়ানো গলায় বলল,

‘এই দুটো হাত, এই মানুষ, আমার খুব কাছের, খুব আপন। একদম হৃদয়ের মধ্যিখানে থাকা আপন মানুষ। আপন মানুষের শরীরে রক্ত দেখে কষ্ট হচ্ছে তো, তাই কাঁদছি।’

এই সরল ও সাহসী স্বীকারোক্তি শোনে আদিয়ান ভীষণ চমকাল। এতটাই চমক যে, মুখের শব্দেরা হারিয়ে গেল তার। মনের অভিব্যক্তি বুঝাতে না পেরে কোনোমতে বলল,

‘আমি…?’

স্থান, কাল, পাত্র – কোনোকিছুর দিকেই আর হুঁশ রইল না নওমীর। উপরনিচ মাথা নেড়ে অস্ফুটস্বরে ‘হু’ শব্দটা উচ্চারণ করে, শরীরের সবটুকু শক্তিকে একত্রে করে, দু’হাতে ভীষণ আবেগে আদিয়ানকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। এতক্ষণ শব্দহীন কান্নায় নিজেকে দমিয়ে রাখলেও প্রিয় মানুষকে আঁকড়ে ধরে ছোট্ট বাচ্চার ন্যায় গালমুখ ভাসিয়ে কাঁদল বেচারী। নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে বলল,

‘কেন বার বার আমার জন্য নিজের বিপদ টেনে আনছেন আপনি? যদি খারাপ কিছু হতো? যদি এই আঘাতের মাত্রা আরও বেশি হতো? আমার কী হতো? আপনি একবারও কি ভেবে দেখেছেন আমার কথা? কেন নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করছেন আপনি? কেন এত রক্ত ঝরাচ্ছেন? এই নিয়ে কতবার আমার জন্য আপনার শরীর থেকে রক্ত ঝরেছে, সেই হিসেব কি রেখেছেন আপনি?’

ঘটনার আকস্মিকতায় আদিয়ান এতটাই হকচকিয়ে গিয়েছিল যে, মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের করতে পারল না। বুঝতে পারল না, নিজের শরীরের এই জখম দেখে কষ্ট পাবে না কি এই মেয়েটার চমৎকার প্রকাশভঙ্গী দেখে নিজের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন ভাববে। আসলে ওর কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছিল না। তখনও দুটো হাতকে শূণ্যে ধরে রেখেছিল সে। সাহস নিয়ে নওমীকে ছুঁতে পারছিল না। এই কান্না ও আহাজারি যখন তার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিচ্ছিল, নিজেকে আটকে রাখতে, দমিয়ে রাখতে খুব বেগ পেতে হচ্ছিল তার। সবকিছু কেবলই ঘুমঘোর ঘটে চলা সুখকর স্বপ্নেদের মতো মনে হচ্ছিল। অনেকটা সময় পর যখন সম্পূর্ণ পরিস্থিতি, নওমীর কান্না, কথা ও স্পর্শ তার কাছে সত্যি মনে হলো, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে, চোখ বন্ধ করে, সবটুকু দূরত্ব, দ্বিধা ও সংকোচকে দূরে সরিয়ে দু’হাতে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল আদিয়ান। আর তাতেই দু’চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রুরা ভীড় জমিয়ে গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সেটুকু আজ লুকাতে ইচ্ছে হলো না। শুধু প্রিয়জনকে ঘিরে থাকা এইমুহূর্তটাকে খুব করে উপলব্ধি করতে ইচ্ছে হলো। সময় বয়ে চললে আস্তেধীরে নওমীর ফুঁপানি থেমে এলো। হুঁশে ফিরে দূরে সর‍তে গিয়ে শক্ত হাতের বাঁধনে আটকা পড়ে বুকের কাছেই মুখ গুঁজে রাখল নওমী। ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আপনার ট্রিটমেন্ট দরকার।’

নড়াচড়া টের পেয়ে হাতের বাঁধন ঢিলে করে, একহাতে নওমীর ভেজা ভেজা গাল ছুঁয়ে, চোখেমুখে লেপটে থাকা এলোমেলো চুল সরিয়ে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে আদিয়ান বলল,

‘ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই আর। আপনি ছুঁয়ে দিয়েছেন তো। সব যন্ত্রণা কমে যাবে এবার।’

চোখভরা আনন্দাশ্রু নিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো নওমী। ঘাড়ে চেপে রাখা হাত তুলে আদিয়ানের মাথার চুলগুলো নেড়েচেড়ে, কতক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। নিচুস্বরে বলল,

‘ছুঁয়ে দিলে যদি যন্ত্রণা কমে যেত, তাহলে এত ডাক্তার ও চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন পড়ত না।’

নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে থেকে দু’হাতের পাতায় মায়াভরা মুখখানি আগলে নিয়ে আদিয়ান বলল,

‘প্রতিটা মানুষের একজন নিজস্ব সেবক-সেবিকা থাকলে বাড়তি কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। আপনি আমার সর্বরোগের ঔষধ হয়ে যান। কথা দিচ্ছি, আমি একদম ফিট এন্ড স্ট্রং থাকব সবসময়।’

নওমী খুব মজা পেল এই কথা শোনে। হেসে হেসে বলল,
‘ঠিক আছে। আমি আপনার সর্বরোগের ঔষধ হতে রাজি আছি। তা এখন কোন রোগের ট্রিটমেন্ট দিতে হবে?’

চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করে হাসছিল নওমী। সেই হাসিতে তাল মিলিয়ে হাসলো আদিয়ান নিজেও। স্কার্ফের সাহায্যে বেঁধে রাখা হাতের ব্যথাতুর অংশ দেখিয়ে বলল,
‘এখানে একটা ছোট্ট ট্রিটমেন্ট লাগবে।’

আদিয়ান যেভাবে বলল, সেভাবেই ট্রিটমেন্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলতোস্পর্শে ব্যথাতুর জায়গায় ঠোঁট ছুঁইয়ে নওমী বলল,

‘এখন মনে হচ্ছে সেরে যাবে। কী, সারবে তো?’

নওমীর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় এনে আঙুলের ভাঁজে আঙুল আটকে, হাঁটতে হাঁটতে আদিয়ান বলল,
‘দিন তিনবেলা এই ট্রিটমেন্ট পড়লে সেরে যাবে, পাক্কা।’

‘বাপরে…। তিনবেলা! কিন্তু মিস্টার… আপনার ব্যক্তিগত সেবিকা তিনবেলা আপনাকে এই ট্রিটমেন্ট দিতে পারবে না।’

‘কেন?’

‘রাস্তা ও সময়ের পর্যাপ্ত ব্যবধান হিসেব করুন।’

কাঁধ নাচিয়ে আদিয়ান বলল,
‘তাহলে আর কী? আমার আর সুস্থ হওয়া হবে না। এই কাটাছেঁড়া হাত নিয়েই জীবন কাটাতে হবে। এই জীবনে বউ পাব কি না সেটাও যথেষ্ট দুঃশ্চিতার কারণ হয়ে দাঁড়াল।’

মধ্যরাত হওয়াতে আশেপাশে মানুষের আনাগোনা নেই খুব একটা। দু’একটা রিকশা, অটোরিকশা গেলে হর্ণের আওয়াজেই শুধু সামান্য শব্দ হচ্ছে। নয়তো সম্পূর্ণ রাস্তা শুনশানই। এরকম একটা পরিস্থিতিতে আদিয়ানের এই কথা শোনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নওমী। শব্দহীন সময়ে নওমীর এই হাসি ঝুনঝুনির মতো ঝঙ্কার তুলল কানে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে সেই হাসিটাকে হৃদয়ে লালন করে পায়ে পা মিলিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল আদিয়ান। বলল,

‘আপনি তো ভীষণ স্বার্থপর মানুষ। সময়মতো পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট দিয়ে সুস্থ করার দায়িত্ব নিতে চাইছেন না ভালো কথা, তাইবলে মাঝরাতে এইভাবে হাসবেন? আশেপাশে থাকা পুরুষের যে অসুবিধা হচ্ছে, তার যে রাতের ঘুমের বারোটা বেজে যাচ্ছে, সেদিকে কি খেয়াল রাখা উচিত না আপনার?’

নওমী হাসি এমনিতেও থামছিল না। আদিয়ানের এই কথায় হাসি থামার বদলে আরও বেড়ে গেল। সে হাসতে হাসতে মুখে একটা হাত চেপে বলল,

‘তিনবেলা পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট দিতে না পারলেও আশেপাশে থাকা পুরুষের রাতের ঘুমের বারোটা যেন না বাজে, প্রতিরাতে তার যেন পর্যাপ্ত ঘুম হয়, সেই দায়িত্ব নিতে পারি।’

ততক্ষণে হাতের ব্যথা দিব্যি ভুলে গেছে আদিয়ান। তার শুধু মনে হলো, এই মায়াবী মুখ, মিষ্টি মিষ্টি কথার ফুলঝুরি ও খিলখিল হাসিতে আজ নিজেকে না ডুবালে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। মুগ্ধতার চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে গন্তব্যে এসে পৌঁছাল ওরা, কেউই টের পেল না। মুহূর্তটা শুধু উপলব্ধির ছিল বলেই, নীরবে, চুপিসারে একজন-অন্যজনকে উপলব্ধি করছিল। এরপর আর বাড়তি কোনো কথা কেউ বলেনি। হয়তো লজ্জা ও সংকোচের কারণেই নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে একেকজন। তবে হাঁটার সময় যতবার হাত ছাড়াতে গিয়েছিল নওমী, ততবারই তার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল আদিয়ান। একবার শুধু ধমক দিয়ে বলেছিল,

‘অদ্ভুত তো। বার বার হাত সরিয়ে নিচ্ছেন কেন?’

তাতেই হয়েছে। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে হাতে-হাত রেখে বাড়ির কাছাকাছি এসে হাঁটার গতি ধীর করে নওমী বলল,
‘আবার কখন দেখা হবে?’

আদিয়ান স্পষ্টকণ্ঠে বলল,
‘যখন আপনি চাইবেন, তখন।’

‘আপনার ফোন নম্বরটা দিন।’

মোবাইল বের করে নম্বর আদান-প্রদান করল দু’জনে। আদিয়ান নিজেই বলেছে, সে বাড়ির ভেতরে পা রাখবে না। তাই বার বার বাড়ির বেলকনির দিকে তাকাল নওমী। তার বদরাগী বাবার চোখে এই দৃশ্য পড়লে প্রেমের পাঠ চুকে যাবে। খুব ইচ্ছে ছিল, আজ আদিয়ানকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করবে। মাম্মির সাথে পরিচয় করাবে। কিন্তু বাবার ভয়ানক তর্জন-গর্জনের কথা ভেবে, এবং আদিয়ানের কথার মূল্যায়ন করতেই তাকে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে গিয়ে মন আনচান করে উঠল তার। দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় বলল,

‘ভেতরে আসবেন না?’

খুব আবেশ নিয়ে একহাতে নওমীর গাল ছুঁলো আদিয়ান। বলল,
‘আজ নয়… যেদিন আমার হবু শ্বশুর আমাকে স্ব-সম্মানে এখানে আসার জন্য ইনভাইট করবেন, সেদিনই ভেতরে পা রাখব।’

নওমী সব কথা জানে না বলেই জানতে চাইল,
‘বাপির ওপর রাগ?’

‘ঠিক রাগ নয়। আত্মসম্মানের ব্যাপার।’

‘তাহলে আর জোর করব না। সাবধানে যাবেন। যেতে পারবেন তো?’

আদিয়ানের হাতের কথা ভেবেই শেষোক্ত কথাগুলো বলেছিল নওমী। তা শোনে আদিয়ান হেসে বলল,
‘না পারলে কী আর করব? ঘুমপরীকে পাহারা দিতে দিতে এখানেই ঘুমানোর ব্যবস্থা করে নেব। আপনার দারোয়ান আবার চোর বলে পেটাবে না তো?’

না চাইতেও আবারও শব্দ করে হেসে উঠল নওমী। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় নিতে গিয়ে বুক কেঁপে উঠল তার। ফের ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল। আদিয়ান দাঁড়িয়েই ছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখের ইশারায় জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে’। নওমী উত্তর না দিকে দু’দিকে মাথা নেড়ে, দূর থেকে বলল,

‘পৌঁছে ফোন করবেন তো?’

দুঃশ্চিতার কারণ বুঝতে পেরে মুচকি হেসে উপরনিচ মাথা নাড়ল আদিয়ান। ঝটপট ফোনের স্ক্রিনে কিছু একটা টাইপ করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নওমীর ফোনে ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠল। স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে দেখল, তাতে লেখা –

‘মাই লাভ, টু ডে আই প্রমিস ইউ, ইফ ইউ গিভ মি অ্যা লিটল স্মাইল, আই উইল গিভ ইউ হার্ট-ব্রোকেন লাভ ইন রিটার্ন।’

ম্যাসেজটাই নওমীর ঠোঁটের কোণে নির্ভার এক স্বচ্ছ হাসির রেখা টেনে দিল। হাসিমুখে বিদায় নিয়ে গেটের ভেতরে পা রাখল সে। দূরে থেকে তাকে নিরাপদে বাড়ির সীমানায় পা রাখতে দেখে, ঘুরে দাঁড়াল আদিয়ান। রাস্তায় এসে একটা সিএনজি নিয়ে নিজের ফ্লাটের দিকে রওনা দিল। অনেকদিন পর নিজেকে তার ভীষণ হালকা ও ফুরফুরে মনে হলো। ব্যথাতুর অংশে হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে সুখকর মুহূর্তটাকে উপলব্ধি করে আওড়ে করল,

‘কে জানত, আজকের রাত এত সুন্দর হবে। এই রাত আমার জীবনের সবচে স্মরণীয় রাত হয়ে থাকবে, নওমী। এরকম একটা রাত উপহার দিয়েছেন বলে শুধু ধন্যবাদ দিয়ে আপনার অনুভূতির অপমান করব না। এইটুকুর বিনিময়ে আজ থেকে আমার গোটা জীবনের সবটুকু সুখকর মুহূর্তকে আপনার নামে উৎসর্গ করে দেব। প্রমিস…।’

***

চলবে…