#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২
উঠোনে এসে সিএনজি থামলে, ভয়ে গাড়ি থেকে নামার সাহস পাচ্ছিল না রুমঝুম। বসে থেকে দোয়াদরুদ জপছিল শুধু। আদিয়ান আগেভাগে নেমে গাড়ি থেকে অনেকগুলো দইমিষ্টি নামিয়ে হাঁক ছেড়ে ডাক দিল,
‘বড়ো মামা, ছোটো মামা, আম্মি, মেজো খালা, ছোটো খালা, তাড়াতাড়ি বাইরে এসো। বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছি।’
একাধারে ডেকে ডেকে সবাইকে বাইরে আসার তাড়া দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে হাত বাড়িয়ে রুমঝুমকে ডাকল,
‘কী হলো? নেমে আয়। বসে আছিস কেন?’
রুমঝুম ঢোক গিলল। বাবা যে কী রাগী! এখন যদি বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেয়! এই ছেলে ম্যানেজ করতে পারবে তো? বিয়ের আলাপ তোলা মাত্রই বিয়ে করে ফেলল। এটা কতটা প্রভাব ফেলবে সবার ওপর? সে ভয়ে ভয়েই বলল,
‘বাবা যদি বকে?’
‘হজম করবি। তবে আমার বিশ্বাস বকবে না।’
সবাই যখন উঠোনে এসে জড়ো হওয়া শুরু করল, চোখ দিয়ে টিপ্পনী কেটে হাত ধরে রুমঝুমকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল আদিয়ান। পাঁচ মামা পাঁচ দিক থেকে বেরিয়ে এসে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন সবাই। দুই খালা ও মা, বিয়ের জরুরী আলাপ-আলোচনাতে যোগ দিতে এসেছিলেন আজ সকালে, তারাও রীতিমতো অবাক। সবার বিস্ময় বাড়িয়ে দিতে হাতে-হাত রেখে সম্মুখে এসে দাঁড়াল দু’জনে। বড়ো মামা রাশেদুজ্জামানকে কদমবুসি করে বলল,
‘আমরা বিয়ে করে নিয়েছি, মামা। দোয়া কোরো আমাদের জন্য।’
আদিয়ানের মা আলেয়া বেগম দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। ভাই-বোনদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে একনজর ভালোমতো দেখলেন। ভাইঝির ভয়মিশ্রিত মুখ দেখে বললেন,
‘তোরা বিয়ে করেছিস?’
রুমঝুম উপরনিচ মাথা নাড়ল। আদিয়ান সামান্য ইশারা দিতেই ঝটপট ফুপি ও বাবা-চাচাদের কদমবুসি করল। নতমুখে বলল,
‘তোমরাই তো চাইছিলে আমরা বিয়ে করে সুখী হই।’
অন্য দুই ফুপি সালেহা বেগম ও রাহেলা বেগম কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নিতে পারলেন না। রাগে-দুঃখে চিড়বিড়িয়ে সালেহা বেগম বলে উঠলেন,
‘ভাইজান, তোমাকে তো আমি বলেছিলাম, আদির সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছি। এরমধ্যেই তুমি এটা কী সিদ্ধান্ত নিলে?’
আদিয়ান ঘাবড়ে গেল। এ কী শুনলো? সালেহা খালা নিজের মেয়ের জন্য তাকে বাছাই করে রেখেছিলেন! সর্বনাশ। এত জ্যান্ত একটা খেঁকশিয়াল। সামনে পেলে ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে পারে। যেমন দৃষ্টি, তেমন আচরণ। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। এরমধ্যে তার ছোটো খালা রাহেলা বেগম আদিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমার জায়ের মেয়ে কত সুন্দরী। রূপে-গুণে অনন্যা। আমি কতবার তোর মাকে বলেছি, বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তোর মা নড়েচড়ে না। এখন তুই মামাতো বোনকে বিয়ে করলি কী দেখে? ঝুম কি অতিরিক্ত সুন্দর? তোর বয়সের তুলনায় ও একটা বাচ্চা মেয়ে। বিয়ের বয়সই তো হয়নি। এখনও নাক টিপলে দুধ বের হবে।’
ছোটো খালার এই কথায় আদিয়ান ক্ষ্যাপে গিয়ে বলল,
‘তুমি আমাকে বুড়ো বললে? আটাশে কেউ বুড়ো হয়? তোমার জায়ের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য আমি যেন হাত-পা ধরে লটকে আছি। বিয়ে আমি একটাই করেছি, এই আমার বউ, ঝুম।’
রুমঝুমের তখন দিশেহারা অবস্থা। এতকথার মাঝখানে রাশেদুজ্জামান নির্বিকার। আলেয়া বেগম ভাইয়ের মনোভাব না বুঝে বললেন,
‘কী করবে, ভাইজান?’
দু’জনকে ভালোমতো পরখ করলেন রাশেদুজ্জামান। আদিয়ানের সাহসী পদক্ষেপে অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হয়েছেন। মা মরা মেয়েকে বড়ো কষ্টে লালন-পালন করেছেন তিনি। সবরকম সুখ-স্বাধীনতা দিয়েছেন। উত্তম জীবনসঙ্গী খোঁজার মতো বোধবুদ্ধি তার হয়নি। যদি কোনোদিন তিনি না থাকেন, কে দেখবে এই মেয়েকে? কার কাছে দিয়ে যাবেন মেয়ের দায়িত্ব? সবাই যে নিজ নিজ জায়গার ভাগ নিয়ে কবেই আলাদা হয়ে গেছে। তাঁর নিজেরও বয়স হয়েছে। আদিয়ানের মতো একজন সৎ, সাহসী, বিশ্বস্ত ও পরোপকারী মনোভাবের যোগ্য জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন ছিল মেয়ের জীবনে। এজন্যই চাইছিলেন, মেয়েটাকে ভাগনের হাতে তুলে দিয়ে শান্তিতে চোখ বুঁজবেন। তিনি রাগ-অভিমান না দেখিয়ে খুশি হয়ে বললেন,
‘তোর এই সাহসী কাজে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, মাত্রই বিয়ের কথা তুললাম। এরমধ্যেই তোরা বিয়ে করে নিলি? একটুবেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? আমরা তো তোদের বিয়ে দিতামই। নিজেরা নিজেরা বিয়ে করার কী দরকার ছিল?’
আদিয়ান খুব চতুরতার সাথে বলল,
‘লাইফে অ্যাডভেঞ্চারের প্রয়োজন আছে, বড়ো মামা। ধরে নাও এটা সেরকমই একটা কাজ। তাছাড়া লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ে করলে আলাদা একটা আনন্দ পাওয়া যায়। নায়ক নায়ক ফিল আসে। এই বাহাদুরি দেখাতে পেরে নিজেকে সিনেমার হিরো মনে হচ্ছে আজ। উফফ, দু’একটা ভিলেন থাকলে ভালো হতো।’
আদিয়ানের কথায় দুই খালা মুখ বাঁকালেও আলেয়া বেগম ছেলের কান মলে দিয়ে বললেন,
‘নির্লজ্জ ছেলে, কী বলিস এসব?’
মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আহ্লাদী স্বরে আদিয়ান বলল,
‘রাগ কোরো কেন? দোয়া কোরো। বউ নিয়ে যেন সুখী জীবন কাটাই।’
সালেহা বেগম গম্ভীরমুখে দুটোর দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
‘কী নির্লজ্জ ছেলেরে বাবা। মুখে যা আসে বলে যায়।’
এরপর ছোটোবোন রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘চল ছোটো আমরা যাই। আমাদের এখানে কাজ নেই।’
দুইবোন দুইদিক থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে এসে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সীমানা ত্যাগ করলেন। আদিয়ান কিছুই বুঝল না। হঠাৎ করে এই দু’জন এত রাগ-অভিমান দেখাতে গেল কেন? বিয়েতে কি তারা অখুশি? এতকিছু ভাববার আর সময় হলো না, ক্ষিধেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে টের পেয়ে বলল,
‘আম্মি প্লিজ, খেতে দাও।’
আদিয়ান প্রায় দশকেজি মিষ্টি নিয়ে এসেছে, সাথে পাঁচ কেজি জিলাপি, পাঁচ কেজি নিমকি ও দই। দুটোকে দুপুরের খাবার খেতে বসিয়ে আশেপাশের যে কয়টা ঘর ছিল, সবাইকেই মিষ্টি বিতরণ শেষ করে, হাসিমুখে বলে এলেন,
‘আমার ছেলে আদির সাথে বড়ো ভাইজানের মেয়ে রুমঝুমের বিয়ে হয়েছে। তোমরা দোয়া কোরো ওদের জন্য।’
***
বাকি মামাদের ঘরের যত কাজিনেরা ছিল, ছোটো-বড়ো সবাই হুড়মুড়িয়ে এই ঘরে চলে এলো। সেজো মামা ও ছোটো মামার ঘরে আরও দুটো মামাতো বোন আছে আদিয়ানের। সব ঘরের ভাই-বোনদের মোটামুটি বিয়ের কাজ কমপ্লিট। যারা ছোটো, স্কুলে পড়ে, তারাই বাকি আছে। রাশেদুজ্জামান বড়ো হলেও বিয়ের প্রথম পনেরো বছরে কোনো সন্তানের মুখ দেখেননি তিনি। নানান জায়গায় কবিরাজি করিয়েছেন, ভালো ভালো ডাক্তার দেখিয়েছেন, তবুও সন্তানের বাবা হওয়ার মতো সুখ দু’হাতের মুঠোয় ধরতে পারছিলেন না তিনি। স্ত্রীর একেবারে প্রৌঢ়ত্বের দিকের শেষে এসে রুমঝুমের জন্ম হয়। একটা সন্তানই ভদ্রলোকের স্ত্রীর জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত ব্লিডিং ও যথাসময়ে হসপিটালে না নেয়ার ফলে, সন্তান জন্মদানের পরপরই মৃত্যুকে খুব নীরবে আপন করে নেন রুমঝুমের মা। সেই থেকে মা মরা মেয়েকে, একা হাতেই মানুষ করেছেন রাশেদুজ্জামান। যখন যে বোন বেড়াতে এসেছে, দেখেছে, খেয়াল রেখেছে। তবে জন্মের প্রথম কয়েক বছর আলেয়া বেগমই ছিলেন, রুমঝুমের মা। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি এখানেই থাকেন, বাবার বাড়িতে। আদিয়ান এই বাড়িতেই বড়ো হয়েছে, এখানে থেকেই পড়াশোনা করেছে। মাস্টার্স কমপ্লিট করে, দীর্ঘদিন বেকার ঘুরে ছ’মাস আগেই একটা বড়োসড়ো মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। সেটা দিয়েই এখন বেকারত্ব দূর হয়েছে তার।
আদিয়ানের মাধ্যমেই শুভর সাথে পরিচয় হয়েছিল রুমঝুমের। একই স্কুল, একই ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করার সুবাদে, একে-অন্যের সাথে চলাফেরাটা ছিল বেশি। মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে ঘুরতে আসত শুভ, আড্ডা দিত, হৈচৈ করত, কোনো কোনোদিন রাতে এখানেই থেকে যেত। তার আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হতেন আলেয়া বেগম ও রাশেদুজ্জামান। আর আদিয়ান, সে তো বন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এত ভালো বন্ধু পাওয়া না-কি সৌভাগ্যের ব্যাপার। এই বাড়িতে ঘনঘন যাওয়া-আসার কারণেই রুমঝুমের সাথে শুভর কথাবার্তা, গল্পগুজব স্বাভাবিক নিয়মে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎই মোড় ঘুরিয়ে প্রেমের পথে চলতে শুরু করে। প্রথম যেদিন শুভ নিজের মনের কথা রুমঝুমকে জানিয়েছিল, ভয়ে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গিয়েছিল রুমঝুম। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে, ঘরবন্দী থাকতে শুরু করেছিল। কেউ তার মনের ব্যামো ধরতে পারছিল না। আদিয়ানের চোখে পড়াতে সে জানতে চেয়েছিল,
‘কী রে, সারাদিন ঘরে বসে থাকিস কেন? পশ্চিমের মাঠে পাড়ার ছেলেমেলেরা দলবেঁধে খেলতে নামে। তোকে দেখা যায় না কেন?’
ভাঙা গলায় রুমঝুম বলেছিল,
‘আমি ওখানে খেলতে যাব না আর।’
‘কেন?’
‘শুভ ভাইয়া সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিন আমার পথ আটকে প্রপোজ করেছে। তুমি-ই বোলো, এখন কি আমার প্রেম করার বয়স?’
বন্ধুর কাছে এই ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে, শুভ কিছুই লুকালো না। সব বলে গেল। আদিয়ান বুঝল না, এখানে সে কী ভূমিকা পালন করবে? নীরব থাকবে না-কি বন্ধুর পাশে দাঁড়াবে? সব হিসাব-নিকাশ করে সে বন্ধুকে বলেছিল,
‘ঝুম অনেক ছোটো, শুভ। এটা কী করে হয়?’
উত্তরে শুভ জানিয়েছিল,
‘ছোটো তো আমিও জানি। আমি শুধু আমার মনের কথা জানিয়েছি মাত্র। এখুনি তো বিয়ে করছি না। বড়ো হোক, আমিও চাকরি-বাকরি করি। নিজের পায়ে দাঁড়াই। প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।’
‘ঠিক আছে তাই হোক। ততদিনে ও আরেকটু বড়ো হোক।’
তখন রুমঝুম সবে এসএসসি দিচ্ছিল। এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম প্রেমপ্রস্তাব। সায় দেয়ার মতো মনের জোর ছিল না। তবে কিশোরী মন, বেশিদিন সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। বন্ধুবান্ধবদের প্রেমকাহিনী শোনে তারও শখ জাগল, প্রেম করবে, লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেমিকের সাথে প্রেমালাপ করবে। ব্যস, মনের সবটুকু আবেগ অনুভূতিকে একসাথে করে শুভকে জানিয়ে দিল, সে তার প্রস্তাবে রাজি। সরলতা, চঞ্চলতা, নতুন নতুন অনুভূতি আদতে ভালোবাসা না-কি মোহ, বুঝে ওঠার আগেই অবুঝ মনে গেঁথে গেল, জীবনের প্রথম ও শেষ পুরুষ শুভ। সে ছাড়া আর কেউ নেই, আসবেও না।
***
মামাতো ভাই, তাদের বউ, আরও ছোটো ছোটো ভাই-বোন মিলে রাতের মধ্যেই বাসরঘর সাজিয়ে ফেলল। এসব দেখে আদিয়ানের মাথায় হাত। কোন ফাঁক দিয়ে যে পালাবে, সেই পথই সে খুঁজতে ব্যস্ত। রাত গভীর হলে, রুমঝুমের রুমটাই দু’জনের জন্য ছেড়ে দেয়া হলো। রুমঝুমের তখন হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদার অবস্থা। কাউকে কিছু বলা যাচ্ছে না আবার পরিস্থিতি গ্রহণ করে নেওয়া যাচ্ছে না। এটা মেনে নেয়া যায়? দুটো অবিবাহিত পুরুষ একসাথে, এক রুমে, ভাবতে গিয়েই দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল রুমঝুম। মিনমিনে স্বরে আলেয়া বেগমকে বলল,
‘আমি তোমার সাথে ঘুমাই ফুপি?’
আলেয়া বেগম মুচকি হেসে ভাইঝির কপালে আদর দিয়ে বললেন,
‘আর ফুপি ডেকে কাজ নেই। এখন থেকে আম্মি বলেই ডাকিস।’
‘না না ফুপিই তো ঠিক আছে। আম্মি ডাকতে হবে কেন?’
‘এখন কি তুই আমার ভাইঝি আছিস আর? ছেলের বউ হয়ে গিয়েছিস। শাশুড়ি তো মা-ই হয়। আম্মি ডাকতে অসুবিধা কী?’
‘কী অসুবিধা সেটা যদি বুঝানো যেত’ বিড়বিড়িয়ে আদিয়ানের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিল রুমঝুম। আলেয়া বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,
‘যা ঘরে যা। আমি আদিকে পাঠাচ্ছি।’
বিরক্তিতে রুমঝুম বলে উঠল,
‘তোমার ছেলেকে তোমার কোলেই রেখে দেও না, ফুপি।’
আলেয়া বেগম এই কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন। রুমঝুম রুমে গেল। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই চিড়বিড়িয়ে সব রাগ মাথায় উঠে গেল। একাধারে আদিয়ানকে বকতে শুরু করল,
‘বাসর করবে, বাসর। অন্যের বিয়ে করা বউয়ের সাথে বাসর করবে। আসো আজকে। বাসর করাচ্ছি।’
মামা ও মায়ের জোরাজুরিতে রুমঝুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আদিয়ান। এরমধ্যেই তার বকবকানি কানে আসছিল। শোনে বলল,
‘বকাবকি শেষ?’
কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়াল রুমঝুম। রগরগে মেজাজে বলল,
‘শেষ না, শুরু।’
এই বলে হাতের কাছে যা পেল, তা দিয়েই আদিয়ানকে উরাধুরা মারতে শুরু করল। চিরুনী, লিপস্টিক, মেকাপ বক্স, নিজের সাজগোছের সরঞ্জাম যা ছিল সামনে, সব ছুঁড়ে মেরেও ক্ষান্ত হওয়ার নাম নিল না। ছোঁড়াছুড়ি শেষে একসময় ঠোঁটমুখ ফুলিয়ে বলল,
‘অসভ্য কোথাকার। লজ্জা করে না তোমার? আমার রুমে কেন এসেছ তুমি?’
রুমঝুম নিজের মধ্যে নেই, হয়তো শুভর স্মৃতি ওকে আহত করছে বার বার। এজন্য ঠাণ্ডা মাথায় সামলানো পরিস্থিতি বিগড়ে দিচ্ছে। আদিয়ান রুমে এসে জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে বলল,
‘এত জোরে চেঁচামেচি করছিস কেন? সবাই শুনবে তো।’
‘শুনুক, আমি সবাইকে শুনিয়েই বলছি। আমি শুভকে ভালোবাসি।’
চটজলদি রুমঝুমের মুখের ওপর হাত রাখল আদিয়ান। তাকে শান্ত রাখতে বলল,
‘পাগল হলি না-কি? কেউ শুনলে এত চমৎকার একটা প্ল্যানের বারোটা বেজে যাবে। তুই এত বোকা কেন, ঝুম?’
জোরপূর্বক হাত ছাড়িয়ে সুস্থির নিঃশ্বাস ফেলে রুমঝুম বলল,
‘তুমি তো দেখি সবার কথায় নাচছ। আমার কথা চিন্তাও করছ না। বের হও এখান থেকে। এক্ষুণি। আর একমিনিটও যদি আমার রুমে তোমাকে দেখেছি, সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দেব।’
হাতের ইশারায় রুমঝুমকে শান্ত হতে বলল আদিয়ান। দরজার কাছে গিয়ে, ছিটকিনি না আটকিয়ে আলগোছে শুধু বন্ধ করে রাখল, বাড়ির সবাইকে বুঝাল, সে রুমঝুমের রুমেই আছে। এরপর রুমঝুমের স্টাডি-টেবিলের চেয়ারে বসে, ফেসবুক স্ক্রল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রুমঝুম তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল,
‘বসে পড়লে কেন তুমি? যাও না।’
আদিয়ান ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
‘যাব, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, তবেই। এখুনি গেলে ধরা পড়ে যাব। সবাই বুঝে ফেলবে, আমরা মিথ্যে বলেছি। দেখ ঝুম, তোকে বিয়ে করা, বাসর করা, তোর সাথে ঘর-সংসার করা, তোকে নিয়ে এরকম থার্ডক্লাশ চিন্তাভাবনা আমার মাথায় আসে না। তুই রিল্যাক্স হয়ে ঘুমা। ঘর নীরব হলেই আমি আমার রুমে ব্যাক করব।’
‘ঠিক তো?’
এত করে বুঝানোর পরও কেউ কীভাবে অবিশ্বাস করতে পারে? রুমঝুমের এই কথা সহ্য হলো না আদিয়ানের। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ইচ্ছে করছে তোর মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠেসে দিই একদম। বেকুব কোথাকার। তুই আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিস না? এত বছর ধরে একসাথে আছি, কোনোদিন তোর সাথে বাজে আচরণ করেছি? খারাপ কথা বলেছি? তোর অসম্মান হয়, এমন কিছু বলেছি আমি? এত অবিশ্বাস! আই কা’ন্ট বিলিভ্ ইট, ঝুম। এই তোর জন্যই আমি এতবড়ো রিস্ক নিয়েছি! সবাইকে মিথ্যে বলেছি! কেন? তুই আমার কে? তোর প্রতি কীসের এত দায়বদ্ধতা আমার?’
***
চলবে…