পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-২৭+২৮

0
22
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৭

সকাল আটটায় কলিংবেলের আওয়াজ শোনে ঘুম ভাঙল আদিয়ানের। হাতে এখনও যথেষ্ট ব্যথা আছে। রাতে ফেরার পথে পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট নিয়ে তারপরই ফিরেছে। আঘাতের জায়গাটা যথেষ্ট দেবে গিয়েছিল। ভেবেছিল, সেলাই লাগবে। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। ব্যথার চুটে ঔষধ খেয়ে অলস শরীর নিয়ে যেভাবে বিছানায় ধপাস করে পড়েছিল, সেই ঘুম এখন ভাঙল। ঘড়িতে সময় দেখে দুর্বল ও ক্ষুধার্ত শরীর টেনে নিয়ে দরজা খুলে ওপাশে মায়ের ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখ দেখে বলল,

‘এত সকালে তুমি? ঝুম ঠিক আছে? বেবি?’

আলেয়া বেগম কটমট চোখে চেয়ে থেকে বললেন,
‘সবাই ঠিক আছে। রাতে খেয়েছিলি কিছু?’

অলস ভঙ্গিমায় দু’দিকে মাথা নাড়ল আদিয়ান। আলেয়া বেগম বললেন,
‘কেন? না খেয়ে ঘুমানোর কারণ কী?’

‘ক্ষিধে ছিল না।’

কথার ফাঁকে নিজের ব্যান্ডেজ করা হাত যথেষ্ট চালাকির সাথে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিল আদিয়ান। কিন্তু পারল না। মায়ের কড়া চোখ সেদিকে পড়েই গেল। তিনি হাতের ব্যান্ডেজ দেখে আঁৎকে উঠে জানতে চাইলেন,

‘হাতে কী হয়েছে?’

গোমড়ামুখে আদিয়ান বলল,
‘একটু কেটে গেছে।’

‘কীভাবে? ফেরার পথে গুন্ডামাস্তানদের সাথে লড়াই করেছিস না কি?’

‘সেরকমই কিছু একটা।’

‘মানে?’

‘তেমন কিছু না, আম্মি। একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটেছে। হাতে একটু লেগেছে। তুমি নাশতা বানাও তো। আমার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে।’

আধোঘুমে দুলতে দুলতে আবারও নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে বিছানায় শুয়ে পড়ল আদিয়ান। গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিল। জ্বরজ্বর লাগছে। আলেয়া বেগম ছেলের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে সকালের চা-নাশতা তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মাথার মধ্যে গেঁথে রাখলেন, তানজিদা হোসেন নাম ও নওমী নামটাকে। ছেলে কি তাকে সেদিন মিথ্যে বলল, এই সন্দেহটাই ঘুণপোকার খুঁড়ে খুঁড়ে মনের জ্বালা বাড়াচ্ছিল। এমনিতেই শহুরে মেয়েদের আচরণ ও চলাফেরা তাঁর অপছন্দ, তারমধ্যে নওমী মধ্যরাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করে। এই মেয়েকে ঘরণী করে ছেলের জীবনে সুখ এনে দিতে গিয়ে দুর্গতি ডেকে আনবেন না তো? মনের ভয় কাটিয়ে উঠতে পারলেন না তিনি। চিন্তিতমনে রান্নাবান্না শেষ করলেন। টিফিনবাক্সে সব খাবার গুছিয়ে টেবিলে নাশতা সাজিয়ে ছেলেকে ডাক দিলেন। ঘুম চোখে থাকলেও পেটের ক্ষিধের কারণে মায়ের এক ডাকেই ফ্রেশ হয়ে বাইরে এলো আদিয়ান। চেয়ারে বসে গরম চায়ে একটা তৃপ্তির চুমুক দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার দেখে বলল,

‘তুমি কি আবারও হসপিটালে যাবে, আম্মি?’

আলেয়া বেগম বললেন,
‘আমি বিকেলে যাব। এগুলো এখন তুই নিয়ে যাবি।’

আদিয়ান দ্বিরুক্তি করলো না। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মনোযোগ দিয়ে নাশতাপর্ব শুরু করল। তখুনি ফোনের স্ক্রিনে লেখা উঠল,

‘গুড মর্নিং। ঘুম ভেঙেছে?’

সেইভ করা নম্বরের চিহ্নিত অংশে লেখা, মাই লাভ। এটা নওমীই লিখে রেখেছে। নিজের নামের বদলে এইটুকু সম্বোধন। না চাইতেও সেদিকে চোখ পড়ে গেল আলেয়া বেগমের। সরু চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আদিয়ান অবশ্য মায়ের এই দৃষ্টি খেয়াল করল না। সে ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি নিয়ে ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়ে ফোন একপাশে রেখে ফের খাওয়া শুরু করল। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ঝুম ও বেবির খবরটা শুভর বাবা-মাকে জানিয়েছিলাম রাতে। ওনারা এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে রাজি নোন। যদিও আমি দায়িত্ব দেয়ার জন্য ফোন করিনি। শুধু জানানো প্রয়োজন মনে হয়েছিল বলে জানিয়েছি। এইটুকু তাদের নিশ্চিত করলাম যে, তাদের একজন বংশধর বেড়েছে।’

শুভর বাবা-মা যে এই বাচ্চার দায়িত্ব নিবেন না সেটা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন আলেয়া বেগম। ছেলে হারিয়ে তারা যেন আরও খুশিই হয়েছেন। রুমঝুম ও তার বাচ্চাটা তো এখন বাড়তি ঝামেলা। এসব ঝামেলা যত দূরে সরিয়ে রাখা যায়, ততই মঙ্গল। তাই তিনি নিজেও চাননি, ঝুমের বাচ্চার দায়িত্ব তাদের দাদা-দাদী নিক কিংবা এই বাচ্চার খবর তারা জানুক। তিনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন,

‘তুই আর ওনাদের ফোন করিস না, আদি। ওনারা এই বাচ্চা ও ঝুমকে ঝামেলাই ভাবছেন।’

‘ঠিকই বলেছ।’

আলেয়া বেগম টপিক ঘুরিয়ে ছেলের মনের অবস্থা জানতে চেয়ে বললেন,
‘তুই আমাকে মিথ্যে বললি কেন?’

আদিয়ান ঠোঁট উলটে বলল,
‘কী মিথ্যে বলেছি?’

‘ওই মেয়েটার নাম তানজিদা হোসেন বলেছিলি না?’

‘হ্যাঁ…।’

‘গতকাল মৌমিতা বলল, ওর নাম নওমী।’

আদিয়ান জিহ্বায় কামড় দিয়ে শব্দ করে হেসে ফেলল। আলেয়া বেগম রেগে গিয়ে ছেলের কান মলে দিয়ে বললেন,
‘হাসছিস কেন?’

‘ওটাই নওমী, ওটাই তানজিদা।’

‘মানে!’

‘কান ছাড়ো, তারপর বলছি।’

কান ছেড়ে সন্দিহান মনোভাব নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলে, আদিয়ান উত্তর দিল,
‘নওমী ওর ডাকনাম। আর তানজিদা হোসেন ওর ভোটার আইডেন্টিটির নাম।’

আলেয়া বেগম কিছুটা গম্ভীরমুখে বললেন,
‘আমি কিন্তু বলেছিলাম, ওর পরীক্ষা নেব। পাশ করলে তবেই ওর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাব।’

‘তুমি কি টিপিক্যাল শাশুড়ি হতে চাইছ না কি? এই যুগে এসে কেউ ছেলের বউ পছন্দ করতে পরীক্ষা নেয়? এটা একটা মানুষের আত্মসম্মানে আঘাত করবে। আম্মি, মানুষ পছন্দ করতে হয় তার আচার-ব্যবহার দেখে, তার অভ্যন্তরীণ গুণ দেখে, তার মধ্যকার মনুষ্যত্ব দেখে। বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের চেয়ে অভ্যন্তরীণ গুণাবলীটা কিন্তু বেশি জরুরী। আর এই দিকটা, নওমীর মধ্যে আছে। আছে বলেই, তোমার ছেলে তাকে ভালোবেসেছে।’

‘কিন্তু আদি… আমি একটা ঘরণী চাই। যার হাতে আমি শুধু তোকে নয়, গোটা ঘর-সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়ে নির্ভার হব।’

‘নওমীর মধ্যে কী সমস্যা?’

‘সে যেভাবে মাঝরাতে বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরি করে, নিজের মর্জিমতো চলে। তাকে ঘরবন্দী জীবনে অভ্যস্ত করতে সমস্যা হবে। তাছাড়া ওর বাবা-মাকেও আমার খুব একটা দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। ওনারা মেয়ের এই ধরনের চলাফেরাকে সাপোর্ট করছেন কী করে? এই ধরনের মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে পেলেও ঘরণী হিসেবে পাওয়া যায় না।’

মায়ের অপছন্দের কারণ বুঝতে পেরে আদিয়ান বলল,
‘এইটুকু দিয়ে তুমি একটা মানুষকে বিচার করে ফেললে? তোমার কাছে তার এই ছুটে আসার কোনো মূল্য নেই? ঝুম ওর কেউ না। ওর জন্য এই রাত্রে ছুটে আসাটাও নওমীর দায়িত্ব নয়। কিন্তু নওমী যা করেছে, সেটা মানবতার খাতিরে করেছে। ঝুমকে ভালোবেসে করেছে। এখানে দোষের কী?’

‘আমি বলতে চাইছি, ও যদি ঘর-সংসারের কাজে অভ্যস্ত না হয়ে বিয়ের পরও এরকম থাকে, মানে যখন-তখন নিজের মর্জিমতো চলাফেরা করে, নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জীবন কাটাতে চায়, কিংবা এমন যে, দিনরাত মানুষের ভালোর জন্য ছুটতে গিয়ে, ঘরের দায়িত্ব-কর্তব্য অবহেলা করে, তাহলে তাকে বউ করে লাভ কী? সে তো ঘর বুঝবে না। দিনরাত বাইরে ছুটবে। দান-খয়রাত করবে। বেহিসাবী খরচ ও চলাফেরা করবে। এমন মেয়েকে দিয়ে কি ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করানো যায়?’

‘আম্মি, কেউ যদি আত্মতুষ্টির জন্য এই ধরনের কাজ করতে চায়, এতে তোমার আপত্তি থাকবে কেন? প্রতিটা মানুষের নিজস্ব ইচ্ছে থাকে, চিন্তাভাবনা থাকে, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকে, নিজের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা থাকে। একটা মানুষ যতক্ষণ বাঁচে, ততক্ষণ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চায়। নিজের মতো করে সাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে চায়। এসবের পরও মানুষ বিয়ে করে, ঘর-সংসার সামলায়, বাচ্চাকাচ্চা লালন-পালন করে আবার চাকরি-বাকরিও করে। এরজন্য অবশ্যই সেই মানুষটাকে কিছু নিয়ম মেইনটেইন করে চলতে হয়। যেন কোনোদিকে কোনো ত্রুটি বা ভুলচুক না থাকে।’

‘কী বলতে চাস তুই? বিয়ের পর ও চাকরি করবে, এমন কোনো ইচ্ছে বা স্বপ্ন আছে? বলেছে তোকে?’

‘তুমি যদি ওর মাঝে একজন পারফেক্ট ঘরণীর গুণ খুঁজতে যাও, তাহলে ভুল করবে। এই পৃথিবীতে পারফেক্ট কেউ নয়। প্রত্যেকেই দোষে-গুণে মানুষ। ঘর-সংসার সামলানোর ক্ষমতা কারও বেশি আছে, কারও কম। তাই এসব নিয়ে আমি তোমার সাথে কোনো দ্বন্দ বা তর্ক করব না। এগুলো ছাড়া তার অন্য কোনো দোষ তুমি দেখাতে পারো, এমন যে – সে চরিত্রহীন, বেয়াদব, অকৃতজ্ঞ কিংবা আর কিছু, যা তাকে মানুষের কাতারে ফেলবে না। যদি এসবের মধ্যে কোনো দোষ খুঁজে পাও, আমাকে বোলো, আমি তাকে ভুলে যাব। আর যদি না পাও, তাহলে এই বিষয় নিয়ে আমাকে আর জোরাজুরি কোরো না। অকারণ কোনো ধরনের নেগেটিভ দিক টেনে আনার চেষ্টা কোরো না। আমি চাই না, আমার ঘরণী হতে গিয়ে ও নিজের স্বপ্নপূরণের দ্বার থেকে ছিঁটকে পড়ুক। আমি চাই, স্বাধীন দেশের একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে ও নিজের ইচ্ছে ও স্বপ্নদের মেলে ধরে বাঁচতে শিখুক।’

‘তার মানে তুই বলতে চাস, বিয়ের পরও যদি ও এরকম থাকে, তুই তাকে সাপোর্ট করবি?’

খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আদিয়ান স্পষ্টস্বরে বলল,
‘যদি আমার ভাগ্যে সে থাকে, যদি সে আমার জীবনসঙ্গিনী হয়, তাহলে তার প্রত্যেকটা ভালো কাজে, আমি তার পাশে থাকব, ইনশা’আল্লাহ্। আর যদি সে আমার ভাগ্যে না থাকে, তাহলে চাইব, দূরে গিয়েও সে যেন নিজের মতো করে বাঁচতে পারে। একটা স্বস্তির জীবন যদি আমি তাকে উপহার দিতে না পারি, সারাক্ষণ যদি দমবন্ধ করা মুহূর্ত দিতে গিয়ে, ঘরকন্নার কাজে তাকে আটকে রাখতে গিয়ে, তার ইচ্ছেদের গলাটিপে হত্যা করে ফেলি, তার ওপর মানসিক টর্চার করি, তাহলে তো আমার মধ্যে আমি আর আমাকে খুঁজে পাব না। খুঁজে পাব এক স্বার্থপর মানুষকে। যে নিজে ভালো থাকতে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটার ভালো থাকার কথা ভুলে যায়, কীসে তার সুখ, কীসে তার দুঃখ সেটা বুঝতে না পারে, তাহলে জীবনসঙ্গী হিসেবে আমারই অবদান থাকল কোথায়? স্বার্থপরতা, প্রতিহিংসা, লোভ, এগুলোকে আমি ভীষণ ভয় পাই, আম্মি। তাই জেনে-বুঝে এমন কোনো অন্যায় কাজ আমি করব না, যে অন্যায় কাউকে সুস্থ-সুন্দর জীবনের সুখ থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য করবে।’

ঠাণ্ডা মাথায় অনেকগুলো কথা বলে রুমে প্রবেশ করল আদিয়ান। পরনের টিশার্ট ও ট্রাউজার পালটে হুডি ও জিন্স পরে নিজের মানিব্যাগ প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার একটা ব্যাগে ভরে, হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোলো। আলেয়া বেগম তখনও ডাইনিংয়ের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। মায়ের এই অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা ও রাগে দাঁত কিড়মিড় করে থাকা অবস্থা দেখে পিছন ঘুরে আবারও মায়ের সামনে দাঁড়াল। এতগুলো কথাতে মা যে থাকে ভুল বুঝেছেন, সে বিষয়ে যথেষ্ট পরিষ্কার সে। তাই মায়ের ভুল ভাঙাতে, দু’হাতে মায়ের কাঁধ ছুঁয়ে ভরসায় ন্যায় নিজের দিক স্পষ্ট করে বলল,

‘আম্মি… তুমি না চাইলে আমি তাকে নিয়ে পালিয়ে যাব, কিংবা তোমাকে ছেড়ে গিয়ে তাকে নিয়ে সুখের জগৎ সাজাব, এতটা অকৃতজ্ঞ আমি হতে পারব না কোনোদিন। সব জেনে ও মেনে তুমি যদি চাও, তবেই সে তোমার ছেলের বউ হবে। নয়তো… তার ইচ্ছে ও স্বপ্নেদের মেরে ফেলে শুধু ঘরণী করতে তাকে আমার জীবনে আনব না। আমি তার সুন্দর জীবনের পথের কাঁটাও হব না। এখন তোমার মনে হতে পারে, আমি শুধু তার দিকটা ভাবছি, তোমার কথা ভাবছি না। আমি তোমার কথা ভাবি বলেই, তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি বলেই, এত সুযোগ থাকার পরও মুখফুটে কখনও বলিনি, ভালোবাসি। অথচ নওমী… কীভাবে যেন বুঝে গেল সবকিছু। পারফেক্ট জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনী দিয়ে কী হবে আম্মি, যদি দিনশেষে একটু স্বস্তি না মিলে? একটু শান্তি না মিলে?’

এত কথার পরও আলেয়া বেগম পাথরের মূর্তির ন্যায় অনড় হয়েই রইলেন। মাকে বুঝানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ, এইটুকু বুঝতে পেরে আদিয়ান একটা নাটকীয় হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,

‘বাদ দিই এসব কথা। এগুলো নিয়ে কথা বলে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি যাচ্ছি… তুমি বিশ্রাম নাও। কিছু প্রয়োজন হলে ফোন কোরো।’

যাওয়ার আগে মায়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল আদিয়ান। আলেয়া বেগম চেয়ারে বসলেন। ছেলের সব কথা পূণরায় কল্পনা করে, বহুদিন আগের পুরনো এক স্মরণীয় দিনে ফিরে গেলেন। আদিয়ানের মধ্যে আজ যেন তার বাবা আফনান ফারুকীর প্রতিবিম্বকে খুঁজে পেলেন তিনি। উনিও ঠিক এইভাবেই কথা বলতেন। বেশিরভাগ সময় তাঁকে কাছে টেনে বলতেন,

‘প্রতিটা মানুষের মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম হচ্ছে সঙ্গী/সঙ্গিনী। জীবনে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না, যদি ভরসার একজন মানুষ থেকে যায়। তুমি আমার জীবনের তেমনই একজন মানুষ, যাকে পেয়ে গোটা জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো মুছে গেছে।’

ঠিক একই কারণেই দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধেননি আলেয়া বেগম। দ্বিতীয়বার জীবনে কাউকে জড়াতে চাননি। কতশতবার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। সব প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়ে একাকী জীবন বেছে নিয়েছেন। ইহকালে যাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন, পরকালে যেন জান্নাতটা তার সাথে হয়, এই অপেক্ষায় জীবনের এতগুলো দিন কেটে গেল। আর কত অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! কবে সেইদিন আসবে, যেদিন তিনি নির্ভার হাসি ঠোঁটে নিয়ে এই জীবনের মায়া ত্যাগ করে অন্ধকার কবরের বাসিন্দা হবেন!

গাড়িতে ওঠার পরই আদিয়ানের ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে নওমী প্রথমে বলল,
‘হাতের ব্যথা কমেছে?’

রাতে বাসায় পৌঁছে আদিয়ান নিজেই তাকে ফোন করে নিশ্চিত করেছিল, সে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেছে এবং পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট নিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ ফোনালাপ না হলেও ম্যাসেজের মাধ্যমে টুকরো টুকরো কথার আদান-প্রদান হয়েছে। তাতেই হাতের ব্যথার খবর জেনেছিল নওমী। এজন্যই ফোন করার পরপরই তার প্রথম প্রশ্ন ছিল অসুস্থতা নিয়ে। রাতের চেয়ে ব্যথা এখন যথেষ্ট কম বলেই আদিয়ানও নিশ্চয়তা দিয়ে উত্তর দিল,

‘হ্যাঁ, অনেকটা কমেছে।’

তবুও মনের ভয় দূর করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল না নওমী। খানিকটা মনমরা কণ্ঠে বলল,
‘একটা গুডনিউজ আছে।’

বিষণ্ণতায় ভরা কণ্ঠস্বরও ছুঁয়ে গেল আদিয়ানকে। বুঝতে পেরে বলল,
‘গুডনিউজ কেউ মন খারাপের সুরে শুনাতে চায়?’

কিছুটা অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশি হলো নওমী। চোখের সামনে না থাকলেও মনের অবস্থা টের পাওয়া যায়, কথা বলার মাধ্যমেই ভেতরের উৎকণ্ঠা বুঝানো যায়, এমন একটা মানুষকে জীবনে পেয়ে, নিজেকে তার পরম ভাগ্যবতীদের একজন মনে হলো। স্টাডি টেবিলের সামনে রাখা ধবধবে সাদা পৃষ্ঠার খাতায় আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,

‘নিউজটা যতটা খুশির, ততটা মন খারাপেরও।’

‘শুনি আপনার নিউজ…।’

নওমী খুব স্লো-মোশনে বলল,
‘গতকাল রাত থেকে মাম্মি আমাকে সন্দেহ করছে।’

‘কেন?’

‘তাঁর ধারণা, আমাদের মধ্যে কিছু একটা হয়ে গেছে।’

এইটুকু বলে লজ্জায় চুপ হয়ে গেল নওমী। আদিয়ান প্রথমে চমকাল। তারপর বলল,
‘আন্টি জানতেন?’

‘হ্যাঁ, আমি মাম্মির সাথে সব কথাই শেয়ার করি। আপনার কথাও জানিয়েছিলাম। আর গতকাল রাতে, বাড়ির মেইন ডোরে মাম্মি আপনাকে দেখেছেন। তারপর থেকে জানতে চাইছেন, জল কতদূর গড়িয়েছে।’

নওমীর ফিসফিস শোনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো আদিয়ান। তার হাসি দেখে গাড়ির ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকাল। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আদিয়ান জানতে চাইল,

‘এরপর কী হলো?’

‘আমাদের সম্পর্ক নিয়ে মাম্মির কোনো আপত্তি নেই। তিনি একপায়ে খাড়া। আর বাপি…।’

বাবার কথা আসতেই মন খারাপের ঢল নেমে এলো নওমীর চেহারায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দম নিয়ে বলল,
‘বাপি নিজের পছন্দের ছেলের হাতে আমাকে তুলে দিতে চান। কথাবার্তা একরকম ফাইনালই। একমাস পর পাত্র দেশে আসবে, বিয়ের দিনতারিখ পাকা করার জন্য। আই মিন, আমার জন্মদিনেই এ্যানগেজমেন্ট হবে, এটাই বাপির সিদ্ধান্ত। আমি এখন কী করব, আদি? বাপিকে কী করে আপনার কথা জানাবো? ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে।’

দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করা নওমীর এতদিনের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার সুযোগ তার হাতের মুঠোয় এখন। মনের ডাকে সাড়া দিয়ে সে আজ কঠিন পরিস্থিতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, এটা বুঝতে পেরে বুকের জ্বালা-যন্ত্রণা বেড়ে গেল আদিয়ানের। চুপ থেকে নওমীর ফোঁপানি শুনল। তার আম্মিও কঠিন সিদ্ধান্তে অটল। তাকে টলানোই যাচ্ছে না। শত চেষ্টাও নিজের মনের বেগতিক অবস্থা বুঝাতে ব্যর্থ সে। ভালোবাসা জীবনে এসেও তাকে অল্পের জন্যে হাতছাড়া করে ফেলবে, এইটুকু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল আদিয়ানের। সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে নীরব থেকে নওমীর কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছিল। একটা সময় ধীরস্থিরভাবে বলল,

‘আপনার মন কী চায়?’

‘এই প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা। তবুও জানতে চাইছেন?’

আদিয়ান খুব আস্তেধীরে বলল,
‘হ্যাঁ, চাইছি।’

‘তাহলে শুনুন, বেঁচে থাকার আরেক নাম যদি অক্সিজেন হয়, আপনি আমার সে-ই অক্সিজেন, যাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাসটাও বন্ধ হয়ে যাবে। আমি যেমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, তেমনই আমার স্বপ্নগুলোকেও পূরণ করার চেষ্টায় নামতে ভালোবাসি। আমার প্রত্যেকটা স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার জন্য বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। আর বাঁচতে হলে, প্রতিমুহূর্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে হলে, আমার আপনাকে প্রয়োজন।’

নিমিষেই বুকের যন্ত্রণা কমে এলো আদিয়ানের। একটুকরো স্নিগ্ধ-শীতল ও শান্তিময় স্পর্শ এসে অশান্ত মনকে শান্ত করে দিল। তবুও খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,

‘কিন্তু ম্যাডাম, আপনি জানেন কি, আমাদের মধ্যিখানে একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে? স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নিতে হলে সে-ই দেয়াল ভাঙতে হবে। আপনি কি তা পারবেন?’

অদৃশ্য দেয়াল ঠিক কী, সেটুকু সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো ধারণা মনের মধ্যে না থাকলেও চোখের পানি মুছে নওমী প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল,

‘ইয়েস, আই ক্যান!’

***

চলবে…

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৮

শামা ঘুমাচ্ছে। পাশে থেকে তার দিকে মুগ্ধ ও মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে রুমঝুম। মাজেদা খাতুন বসে বসে পান খাচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে টুকরো টুকরো গল্প করছিলেন। খাবার রেখে নিজের ফোনের ভিডিও নিউজটা রুমঝুমের চোখের সামনে রেখে দিল আদিয়ান। হসপিটালে থাকায় বাইরের কোনো খবর সম্পর্কে কোনো খোঁজ নিতে পারেনি রুমঝুম। যদিও তার খোঁজ নেয়ার কথা নয়। তবে প্রতিনিয়ত শুভর খুনীদের দেখার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে সে। চোখের সামনে থাকা ভিডিও প্রথমে কৌতূহল বাড়াল, এরপর ইমতিয়াজের ফুলে ফেঁপে ওঠা বিভৎস শরীর দেখে আঁৎকে উঠে বলল,

‘লোকটার কী হয়েছিল? থানায় ছিল না?’

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে পুলিশের লোকজন ইমতিয়াজের মরা-পঁচা, ভেজা দেহখানি নাকমুখ কুঁচকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে। পাশেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাদীদের সাথে কথা বলছেন। একজন সাংবাদিক জাদীদের কাছে এই লোকটার পরিচয় ও মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে জাদীদ বলল,

‘গতকাল রাতে আসামীকে জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় আসামী ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানায় পালাতে চেয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিয়েছিল সে। আমাদের টিম তাকে ধরার জন্য পিছনে ছুটে এলেও ধরতে পারেনি। সে ব্রিজের কাছে এসে লাফ দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আরও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নেয়। আজ সকালেই আমরা তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হই।’

ভিডিও দেখা শেষ হলে, হসপিটালে বসেই জাদীদকে ফোন করল আদিয়ান। ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইল। জাদীদ শুধু হাসলো ওপাশ থেকে। তাতেই আদিয়ানের সন্দেহ গাঢ় হলো। আদিয়ান চুপ করে কিছু একটা ভাবতে থাকলে জাদীদ বলল,

‘তুমি একটু আমার সাথে দেখা করো।’

‘এখুনি?’

‘হ্যাঁ। কোথায় আছো?’

‘আমি হসপিটালে আছি।’

‘আচ্ছা, তাহলে গেটের সামনে এসো। আমি আসছি।’

মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে টিম মেম্বারদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে হসপিটালের সামনে এলো জাদীদ। সাংবাদিকদের এই কথা বললেও ঘটনা ঘটেছে পুরো উলটো। জাদীদ এইখানে ছোট্ট একটা মিথ্যে বলেছে। ইমতিয়াজ ব্রিজ থেকে লাফ দেয়নি। ঘটনা ঘটেছে অন্য জায়গায়। একদম লোকচক্ষুর অন্তরালে। পরবর্তীতে লাশটা এনে শুধু ব্রিজ ওপর থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। জাদীদ নিজেই তাকে মেরেছে। মুখের ভেতর রিভলবার ঢুকিয়ে পরপর কয়েকটা গুলি একসাথে। বাইক থেকে নামতেই দেখল, আদিয়ানও গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ভেতরে না গিয়ে গেট থেকেই বলল,

‘বেবির কী অবস্থা?’

‘ভালো আছে।’

জাদীদ একটা ঠিকানা বের করে আদিয়ানের চোখের সামনে মেলে ধরল। আদিয়ান বলল,
‘এটা কার ঠিকানা?’

‘বাইক আরোহী। যে গতকাল তোমার ওপর আক্রমণ করেছিল।’

‘দু’জন ছিল।’

‘হ্যাঁ। বাইকটা এনার। আর সঙ্গের জন না কি তার অপরিচিত। তোমাদের পিছনের জন আঘাত করেছিল তাই তো?’

‘হ্যাঁ…।’

‘পিছনের জন হয়তো জাহাঙ্গীর, নয়তো তার পরিচিত কেউ ছিল। তাকে খুঁজে বের করতে পারলে আমরা জাহাঙ্গীরকে খুব শীঘ্রই খুঁজে পাব আশা রাখি।’

‘এই লোকটা পরিচয় দেয়নি?’

‘ওনার বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম।’

বাইক নম্বর দিয়ে আরোহীর ঠিকানা খুঁজে পেতে খুব একটা দেরী হয়নি জাদীদের। গতকাল আদিয়ানের ম্যাসেজ পেয়েই কাজে লেগেছিল সে। শো-রুমে গিয়ে বাইকের নম্বর দেখাতেই সব তথ্য জেনে গিয়েছিল। এরপর সেই লোকটার ঠিকানায় গেলে লোকটা বলেছিল,

‘গতকাল রাতে আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন মাস্ক পরা একটা লোক, আমার কাছে ইমার্জেন্সি লিফট চাইল। আমি ভাবলাম, বিপদে পড়েছে তাই হেল্প চাইছে। বিপদ বুঝে হেল্প করতে গিয়ে যখন দেখলাম, ভদ্রলোক রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া দু’জন মানুষকে কেন্দ্র করে ছুরি চালাতে গিয়েছেন, তখনই খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মাঝপথে নামিয়ে দিতে চাইলে লোকটা আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে ওদের মধ্যে একজনকে আহত করে ফেলে। শেষে শহরের শেষ মাথায় থাকা একটা পুরনো আমলের ভাঙাচোরা বাড়ির সামনে নেমে গিয়েছিল। আমি আড্রেসটা আপনাকে দিচ্ছি।’

এরপর বাইক আরোহী অ্যাড্রেস দিলে জাদীদ বলেছিল,
‘আপনি কি শিওর লোকটা ওখানেই নেমেছে?’

‘জি…। এরপর জান বাঁচাতে আমি প্রায় ছুটে এসেছি ওখান থেকে।’

সব শোনে আদিয়ান বলল,
‘এই কেইসটা অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে, জাদীদ।’

‘হ্যাঁ, তবুও শেষ জানতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্লান কী, মনে আছে? রাসেলকে যেভাবে ধরেছি, সেভাবে বাকিদেরও ধরব।’

‘মনে আছে। রাসেলের কী খবর?’

‘জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। স্টুপিডটা মুখ খুলছে না। একটা ব্যাপার আমি ভেবে পাচ্ছি না, ওদের হয়ে কেউ কেন জামিন নিতে আসছে না? ওদের সবার ফ্যামিলি আছে। বাচ্চা-কাচ্চা আছে। অথচ স্ত্রী-সন্তান কেউ ওদেরকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।’

‘এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। হয়তো জাহাঙ্গীর টাকা-পয়সা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ রাখতে চাইছে।’

কথার ফাঁকে বাইকের সামনে বেঁধে রাখা বড়ো সাইজের একটা প্যাকেট আদিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিল জাদীদ। এরপর বাইকে চাপতেই আদিয়ান বলল,

‘এগুলো কী?’

‘বেবির সব প্রয়োজনীয় জিনিস। নিয়ে যাও।’

‘তুমি শামাকে দেখে যাবে না?’

‘পরে একসময় দেখব। এখন আসছি। কাজ আছে। এই ঠিকানায় গিয়ে খোঁজ নিতে হবে।’

জাদীদের এই পালিয়ে যাওয়ার কারণ আদিয়ান বুঝতে পারল না। বাচ্চার জন্য কেনাকাটা সে নিজেও করেছে। এইটুকুর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু জাদীদের এই সহানুভূতি, কিছু আত্মিক টান ও দায়িত্ব পালনের ধরনটা তার ভালো লাগল। মুচকি হেসে তাকে বিদায় দিয়ে পূণরায় হসপিটালে পা রাখল আদিয়ান।

***

বিকেলের মধ্যেই সমস্ত মান-অভিমান ও রাগ ভুলে, মেয়ে ও নাতনীকে দেখতে নরসিংদী থেকে ঢাকায় ছুটে এলেন রুমঝুমের বাবা রাশেদুজ্জামান। মেয়ের জীবনের চরম দুর্ঘটনার সময় পাশে থাকেননি, মেয়েকে সান্ত্বনা দেননি, বাবা হিসেবে তাঁর যা করণীয়, তিনি তা করেননি বলেই ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত শূণ্যতা ও যন্ত্রণা নিয়ে এতদিন নিজের অহমিকাকে মনের ভেতর পুষে দিন কাটাচ্ছিলেন। গতকাল রাতে যখন শুনলেন একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা হয়েছে রুমঝুম, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অভিমান ঝেড়ে ফেলে, মেয়ে ও নাতনীর জন্য জমিয়ে কেনাকাটা করে ঢাকায় ছুটে এসেছেন। হসপিটালে পা রেখে কেবিনে আদিয়ান ও মাজেদা খাতুনকে দেখে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে থাকার ভান ধরলেন। চরম বিস্ময় নিয়ে যখন মামার দিকে তাকিয়েছিল আদিয়ান, তখনও দৃশ্যটা স্বপ্ন না কি বাস্তব, বুঝতে বড্ড দেরী হচ্ছিল তার। একসময় যখন আদিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘এ্যাই বেয়াদব, তুই আমার চোখের সামনে থেকে সর।’

আদিয়ান দূরে সরবে কী, সমস্ত বিস্ময়কে দূরে ঠেলে দিয়ে ছুটে এসে বড়ো মামাকে জাপটে ধরল। ভদ্রলোক বিপাকে পড়ে গিয়ে বললেন,

‘বাচ্চাদের মতো কী ঢং করিস এগুলো? সর…। তোর সাথে ভাব জমাতে আসিনি এখানে। আমি আমার নাতনীকে দেখতে এসেছি।’

আদিয়ান হাসিমুখে বলল,
‘যে কারণেই আসো, তুমি এসেছ, এরচেয়ে আনন্দের আর কিচ্ছু হয় না, বড়ো মামা।’

‘হয়েছে ছাড়। বাচ্চাটাকে দেখতে দে।’

রাশেদুজ্জামান বেডের দিকে এগোলে, রুমঝুম যত না অবাক হলো, তারচেয়ে বেশি খুশি হলো। সেই খুশিটা প্রকাশ করতে গিয়ে দু’হাতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। তিনি বড্ড বিব্রতবোধ করলেন। কিন্তু তবুও মেয়েকে দূরে সরালেন না। অনেকদিন পর ঔরসজাত সন্তানকে ছুঁয়ে তাঁর কণ্ঠরোধ হয়ে এলো সীমাহীন সুখে। মেয়েকে বুকে নিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,

‘কত বড়ো হয়ে গিয়েছিস, মা। এখন বুঝবি, সন্তানদের জন্য বাবা-মায়ের ভালোবাসা কেমন। দু’হাতে যত্ন করে বড়ো করে তোলা সন্তান বাবা-মাকে কষ্ট দিলে কেমন লাগে, এটাও একদিন বুঝবি।’

রুমঝুম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
‘আমাদের ক্ষমা করে দাও, আব্বু।’

রাশেদুজ্জামান নির্ভার হেসে মেয়েকে ছেড়ে নাতনীকে কোলে নিলেন। স্ত্রীকে দেয়া তাঁর বহুদিন আগের ছোট্ট উপহার, স্বর্ণের চেইনটা বাক্স থেকে বের করে নাতনীর গলায় পরিয়ে দিলেন। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘শুধু ওর জন্যই তোদেরকে ক্ষমা করলাম।’

কান্নারত মুখ নিয়েও হেসে ফেলল রুমঝুম। আদুরে হাতে বাচ্চাটাকে বাবার কোলে তুলে দিল। রাশেদুজ্জামান নাতনীকে আদর দিয়ে মেয়েকে বললেন,

‘এখানে কী হচ্ছে, না হচ্ছে সব শুনেছি। ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিয়েও ঠিকমতো ক্লাস করিসনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোকে গ্রামে নিয়ে যাব। ফাইনাল এ্যাক্সামের আগে কিছুদিন গ্রামের আলো-ছায়ায় থাকলে মন-মেজাজ ভালো থাকবে। যাবি, মা?’

বাবার আদেশ হোক কি হুকুম, ফেলে দেয়ার সাহস পেল না রুমঝুম। এমনিতেও এই শহরে তার কোনো পিছুটান নেই। পড়াশোনা যতটুকু এগিয়েছিল, শামার আগমণে সেদিকে আপাতত নজর দেয়ার সময় নেই। এ্যাক্সাম দেবে না, আর পড়াশোনা করবে না, এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছিল রুমঝুম। তবে কাউকে কিছু বলেনি। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মাঝখানে যে কয়েকমাস ক্লাস করেছিল, তাতে খুব একটা উন্নতি হয়নি। শুভ মারা যাওয়ার পর, সব ইচ্ছে-স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আপাতত এই শহরে তারজন্য আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। তাই বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে, আব্বু। আমি তোমার সাথেই যাব।’

মাজেদা খাতুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সুখকর এই মুহূর্তকে মনের খাঁচায় যত্ন করে তালাবন্দী রেখে, মনে মনে একটা অভাবনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। রাশেদুজ্জামানকে বললেন,

‘ভাইজান, এই সুখের দিনে আমি একটা অনুরোধ করব আপনার কাছে। আমার অনুরোধটা ফিরিয়ে দিবেন না তো?’

রাশেদুজ্জামান মুখভরা হাসি নিয়ে বললেন,
‘কী অনুরোধ, আপা?’

‘বলার সময় এটা নয়। কিন্তু তবুও বলছি, যদি আপনি চান তো, ঝুমকে আমি আমার কাছে রেখে দিতে চাই। চিরদিনের জন্য। আপনি কোনো আপত্তি করবেন?’

সরাসরি এই প্রস্তাবে রাশেদুজ্জামান অবাক হলেও রুমঝুম ভীষণ কষ্ট পেল। কেন কে জানে! কলজে নিংড়ে কান্না বেরিয়ে এলো। জল টইটম্বুর হওয়া চোখদুটো লুকাতে নতমুখে বসিয়ে রইল সে। আদিয়ান এই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল,

‘আন্টি, আমার মনে হয় এসব নিয়ে কথা বলার সময় এটা নয়। আসলে… এখনও ওর ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হতে অনেক সময় বাকি। আর ও…।’

কথা আটকে আটকে এলো আদিয়ানের। রুমঝুমের মনের অবস্থা সে বুঝে। প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে, দ্বিতীয়বার এত সহজে কারও ঘরণী হওয়াটা সহজ নয় ওর জন্য। বিশেষ করে যে সময় রুমঝুম পার করছে, সেটা অনেক কঠিন ও কষ্টকর। এই সময়ে মানসিক শান্তির দরকার বেশি। বাড়তি চাপ তার কষ্ট বাড়িয়ে দিবে দ্বিগুণ। সেসব ভেবেই স্পষ্টভাবে কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু পারল না। রাশেদুজ্জামান কড়া চোখে ভাগনের দিকে তাকিয়ে, মাজেদা খাতুনকে বললেন,

‘আপনার অনুরোধ আমি মাথায় রাখব, আপা। আগে মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে যাই। মেয়ে সুস্থ হোক, বাচ্চাটা আরেকটু শক্তপোক্ত হোক, তখন ভেবে দেখব।’

অসহায় চোখে বাবাকে একনজর দেখল রুমঝুম। এরপর আদিয়ানের দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় আদিয়ান তাকে আশ্বস্ত করল। শান্ত থাকার ইঙ্গিত দিল। আর তাতেই চিন্তা খানিকটা দূর হলো তার। মুরব্বিদের মাঝে তর্কবিতর্কে না জড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে বাইরে চলে এলো আদিয়ান। এই বিষয় নিয়ে আগে জাদীদের মনোভাব, ইচ্ছা-অনিচ্ছা জানাটা জরুরী। মাজেদা খাতুনের অনুরোধ রাখতে গিয়ে, দুটো মনের ওপর কঠিন দায়বদ্ধতা চাপিয়ে দেয়ার কোনো মানেই হয় না। বাইরে এসে দু’বার জাদীদের নম্বরে ফোন দিল কিন্তু রিসিভ হলো না। ব্যস্ততা ভেবে সে-ও আর বিরক্ত করার সাহস পেল না।

***

বাইক আরোহীর কথায় শহরের শেষ মাথার সেই পুরনো বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো জাদীদ। ভাঙাচোরা বাঁশের ঘর। খড়ের চাল। এই শহরে এমন একটা বাড়ি কেউ ব্যবহার করতে পারে, ধারণায়ও আনেনি সে। বাড়িতে প্রবেশ করে খুব সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। এরমধ্যেই কলপাড়ে পানির আওয়াজ শোনে গুটিকয়েক পা ফেলে বাড়ির পিছনের দিকে এগোলো। হাতে থাকা রিভলবার সামনের দিকে তাক করে রাখল। পিছনে গিয়ে কলপাড়ে দাঁড়াতেই সামনে থাকা লোকটা ভেজা লুঙ্গি পরেই দৌড়ে পালাতে চাইল। জাদীদ তাকে সেই সুযোগ দিল না। একদম জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে প্রথমে কয়েকটা কিল-ঘুষি দিল। লোকটাকে একদম দুর্বল করে, দু’হাতের চাপে গলা চেপে রেখে বলল,

‘গতরাতে তোফাজ্জল হোসেনের মেয়েকে মারতে গিয়েছিলি কেন?’

ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে লোকটা বলল,
‘আমি মারতে চাইনি। আমাকে মোটা অংকের টাকা দেয়া হয়েছিল। টাকার বিনিময়ে কাজ করেছি।’

‘টাকা কে দিয়েছে?’

‘পরশু রাতে এক লোক এসে আমার দরজায় ঠোকা দিয়ে ব্যাগভর্তি টাকা ও একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, তোফাজ্জল হোসেনের মেয়েকে মারতে হবে। কে ওই লোক সেটা আমি জানি না। আমি শুধু টাকা পেলে খুন করি।’

‘মাই গড! তুইও খুনি?’

‘কী করব স্যার? পেটে ভাত ও কপালে চাকরি না থাকলে খুন করে টাকা কামানো ছাড়া উপায় থাকে না।’

‘তারমানে তোর কাছে অনেক টাকা! এত টাকা থাকতে কুঁড়েঘরে থাকিস কেন?’

‘এখানে থাকলে পুলিশের দৃষ্টিসীমার আড়ালে থাকা যায়।’

‘গুড। চল তাহলে শ্বশুরবাড়ি। তার আগে ওই চিঠিটা দেখা। খোঁজ নিয়ে দেখি, তোর দ্বারে কার আগমন ঘটেছিল।’

ভয় ও প্রাণ হারানোর চিন্তায় ঘরে থাকা সেদিনের সেই চিঠি বের করে দিল লোকটা। জাদীদ সেটা নিজের কাছে রেখে টিম মেম্বারদের একজনকে কল করে, পুলিশের গাড়ি নিয়ে আসতে বলে লোকটার হাত বেঁধে রেখে বাকিদের আসার অপেক্ষায় রইল।

***

রাতে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছে জাদীদ। মাজেদা খাতুন বিষণ্ণমনে ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে পাশেই বসে রইলেন। জাদীদ একপলক মাকে দেখল। মায়ের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল। মন খারাপ ও দীর্ঘশ্বাসের কারণ খুঁজে না পেয়ে জানতে চাইল,

‘সব ঠিক আছে? কী নিয়ে তুমি এত দুঃশ্চিন্তা করছ?’

ছেলের মনের খবর, ভালোবাসা হারিয়ে নিঃস্ব ও প্রিয়জনকে ঘিরে তার বিশ্বাস ভাঙার খবর আর কেউ না জানলেও তিনি জানেন। ছেলের পছন্দকে সম্মান জানিয়ে একসময় বিয়ের প্রস্তাবও নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন খালি হাতে। শূণ্য ও নিঃস্ব হয়ে। ভাঙা মন আবারও জোড়া লাগবে কি না সেই নিয়ে তার দুঃশ্চিতার শেষ নেই। মৃত্যুর আগে ছেলেকে সুখী জীবন দিয়ে যেতে না পারলে আফসোস নিয়ে মরতে হবে, এসব ভেবেচিন্তেই রুমঝুমকে নিজের ঘরের একজন হিসেবে চাইছিলেন। যেহেতু রুমঝুম ও তার বাচ্চার জীবন এখন অনিশ্চিত, মন ভাঙার কষ্ট মেয়েটা বুঝবে, সর্বপরি মেয়েটাকে তিনি নিজের আত্মারও আপন মনে করেন বলেই প্রস্তাব রেখেছেন। যারা ঘর হারায়, আপন মানুষ হারায়, তারাই হারানোর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে বলেই খড়কুটোর আশ্রয়ের আশায় পথচেয়ে থাকে। তিনি রুমঝুমকে আর কিছু দিতে না পারলেও জাদীদের মতো একজন ভরসা ও বিশ্বস্ত সঙ্গী দিতে পারবেন ভেবেই, অসময়ে প্রস্তাব রাখা ঠিক হচ্ছে না জেনেও মুখফস্কে নিজের চাওয়াটাকে তুলে ধরেছিলেন। রাশেদুজ্জামানের কথাতে বোঝা গেছে, এখানে তার আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তিটা রুমঝুমের। মুখফুটে না বললেও মেয়েটার মুখে যে নিদারুণ কষ্টের ছাপ ও সময়ের ওপর আকাশসম অভিযোগ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটুকুর পর আর সাহস পাচ্ছেন না। কেবলই একটা শূণ্যতা ও হাহাকার তার নিঃশ্বাসের সাথে জড়িয়ে গেছে। তিনি যতই নিজেকে হালকা করতে চান, ততই ভারী শ্বাস নামছে। এসব কথা ছেলেকে বলতে পারছেন না আবার ছেলের নিঃসঙ্গ জীবনের চিন্তায় তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না, সবমিলিয়ে যথেষ্ট পেরেশানিতে পড়ে গেলেন। ছেলের মুখ থেকে প্রশ্ন শোনে খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

‘তুই বিয়ে করবি কবে?’

কিছু সময়ের বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল জাদীদের চেহারায়। মায়ের কথায় কান না দিয়ে হেসে বলল,
‘হঠাৎ বিয়ের কথা বলছ?’

‘আর কতদিন এভাবে থাকবি? কেন পিছনের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বসে আছিস?’

মায়ের চিন্তা ও অস্থিরতা সবই বুঝে জাদীদ। তাই অকারণ রাগ না দেখিয়ে যথেষ্ট শান্ত মেজাজে বলল,
‘আমি পিছনের স্মৃতি আঁকড়ে বসে নেই, মা।’

‘তাহলে বিয়ের জন্য মত দিচ্ছিস না কেন?’

‘তুমি আজ বিয়ে নিয়ে কথা তুলছ কেন?’

‘আমি না থাকলে ঘর সামলাবে কে? তোকে আগলে রাখবে কে?’

‘আমার জন্য আমি একাই যথেষ্ট, মা।’

‘যত যাই বলিস, উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করা বাধ্যতামূলক।’

‘যদি না করি?’

‘না করলে আর কী? একজীবনে ছেলের বউ ও নাতি-নাতনী নিয়ে আমার যত আফসোস, সব থেকে যাবে। বুকভরা আফসোস ও ছেলেকে সুখী জীবন দেয়ার ব্যর্থতা নিয়েই একদিন পরপারে চলে যাব।’

অভিমানী মন নিয়ে তিনি চলে যেতে চাইলে, মায়ের হাত ধরে তাঁকে আটকে পূণরায় চেয়ারে বসিয়ে জাদীদ বলল,
‘তোমার জন্য আমি সব পারব, মা। পিছনের স্মৃতিও ভুলে যেতে পারব। বলো, কী করতে হবে?’

মাজেদা খাতুন জানেন, স্মৃতি ভুলা এত সহজ নয়। যদি সহজ হতো, এতদিনে জাদীদ নিজেকে ঠিকই গুছিয়ে নিত। তিনি তো মা, আর কতদিন ছেলের এই কষ্ট সহ্য করবেন? সন্তানের সুখ চাওয়া, তাকে সুখী জীবন দিতে চাওয়া, এসব তো আর অপরাধ নয়। ছেলের মন ফেরাতে, তিনি মুখভার করে বললেন,

‘আগামীকাল সকালে ঝুমের ডিসচার্জ।’

‘তো? এখানে রুমঝুম কেন আসছে?’

‘ডিসচার্জের পর বাবার সাথে গ্রামের বাড়ি চলে যাবে।’

‘যাক, নিজের বাড়িতে যাবে না?’

‘সেটা নয়। গেলেও আবার ফিরে আসুক, আমি এটাই চাই।’

মায়ের মনোভাব না বুঝে জাদীদ বলল,
‘দাওয়াত দিয়ে আনতে চাও?’

‘না…। বউমা বানিয়ে আনতে চাই।’

খানিক সময়ের জন্য জাদীদ অনুভব করল সে শূণ্যে ভাসছে। মায়ের কথা ও সিদ্ধান্ত তার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। সে বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বলল,

‘তুমি কী চাইছ, সেটা তুমি জানো তো?’

‘জানি। জেনেই বলছি।’

‘এটা অসম্ভব, মা।’

‘কেন? ঝুম বিধবা বলে? ওর একটা বাচ্চা আছে বলে?’

এসব তো কোনো সমস্যা নয়! সবচেয়ে বড়ো সমস্যা তো মনে। যন্ত্রণার ছাপটা তো অন্তরে। যতই দ্বিতীয়বার স্বপ্ন দেখুক, আদতে প্রথম ভালোবাসা ভুলে দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসা কি খুব সহজ? রুমঝুমই বা মানবে কেন? চিন্তায় ঠিকমতো গলা দিয়ে খাবার নামল না জাদীদের। স্পষ্টকণ্ঠে বলল,

‘এসব নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না, মা। প্লিজ, জোর করো না। মনের ওপর জোর চাপিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না। কাউকে জোরাজুরি করাও উচিত না।’

মাজেদা খাতুন গম্ভীরমুখে বললেন,
‘আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।’

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এইমুহূর্তে বিয়ের প্রস্তাব কেউ দেয়? মেয়েটার সিচুয়েশন বুঝা উচিত ছিল না তোমার? সে এখন আমাদের স্বার্থপর ভাববে। ভাববে আমরা ওর বাচ্চা আর ওকে করুণা করতে চাইছি।’

‘এত কথা আমি জানি না, জাদীদ। আমি শুধু জানি, ঝুমকে এই ঘরে চাই। আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি। ওর ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হলেই আমি রাশেদ ভাইয়ের সাথে কথা বলে দিন-তারিখ পাকা করব।’

স্থিরচোখে মাকে দেখে, মায়ের কথার স্পষ্টতা ও সিদ্ধান্ত বুঝে জাদীদ বলল,
‘রুমঝুমের সিদ্ধান্ত না নিয়ে এই বিষয়ে আর একটা কথাও তুমি বলবে না। যদি বলেছ, আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

খাওয়ার ফেলে রেখে উঠে গেল জাদীদ। মাজেদা খাতুন ছেলের হম্বিতম্বিকে পাত্তা দিলেন না। ছেলেকে বিয়ে করালে বউ এ ঘরে আসবে, সেটা স্বাভাবিক। অন্য মেয়ে আসলে যা, রুমঝুম আসলেও তা। তাছাড়া অন্য মেয়ে এলেও ঝুমের মায়া তিনি ভুলতে পারবেন না, তাকে হারিয়ে যেতেও দিবেন না। এক মেয়ে হারানোর কষ্ট সহ্য করে নিয়েছেন, আরেক মেয়েকে কোনোভাবেই এত সহজে হারিয়ে যেতে দিবেন না। ছেলের রাগ ও মেজাজ দেখে তিনি নিজের কথাকে পাকাপোক্ত বুঝাতে খানিকটা চেঁচিয়েই বললে,

‘যত যা-ই বল, সিদ্ধান্ত আমি স্থির করে ফেলেছি। এ ঘরে তোর বউ হয়ে যদি কেউ আসে, তবে সেটা ঝুমই হবে, অন্যকেউ একদমই নয়।’

***

চলবে…

‘গাছের দিকে তাকিয়ে আছো কেন?’

সুনাইরা ঢোক গিলল। নীহারিকা বলেছে, আশেপাশে কেউ আসে কি না, সেটা যেন খেয়াল রাখে। পাকা আম খাওয়ার আনন্দে এটাই ভুলে গিয়েছিল সে। তাহরীমের কণ্ঠস্বর শোনে চমকে গিয়ে বুকে ফুঁ দিল। তখুনি টুপ করে দুটো আম পড়ল ছাদে। তাহরীম অবাক হলো, ঝড়তুফান কিছুই নেই, অথচ আম এসে পড়ল! সে আস্তো দুটো রসালো আম হাতে তুলে নিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আম পড়ল কী করে?’

সন্দিহান চোখে গাছের দিকে তাকিয়ে রইল তাহরীম। কিছুই দেখতে পেল না। তবে নিশ্চিতও হতে পারল না। নীহারিকার গাছে ছড়ার অভ্যাস আছে। বিয়ের পর প্রথমবার যখন গাছে চড়েছিল, পিচ্ছিল গাছ থেকে দড়াম করে পড়ে গিয়েছিল। হাত-পা না ভাঙলেও কোমরে বেশ জখম হয়েছিল। এখনও মাঝেমধ্যে সেই ব্যথাটা তার উপস্থিতি জানান দিলে, ব্যথার যন্ত্রণায় ঘুম হয় না মেয়েটার। তাই সন্দেহ মনে নিয়েই গাছের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখল সে। তাহরীমের ভীরু চাহনি ও প্রশ্ন শোনে সুনাইরা বলল,

‘কাঠবেড়ালী এসেছে বোধহয়।’

‘এই গাছে কাঠবেড়ালী আসে না।’

উপরের দিকে দৃষ্টি দিয়েই বলল তাহরীম। সুনাইরা গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে নীহারিকাকে খুঁজল। মেয়েটা বড্ড চালাক। পরেছে সবুজ জামা। লুকিয়ে সবুজ পাতার ভীড়ে। তাহরীম দেখেও দেখল না। সুনাইরা বলে উঠল,

‘বললেই হলো। গাছে আম আছে আর কাঠবেড়ালী আসবে না, এটাও যেন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।’

‘আসে না রে বাবা। বিশ্বাস কোরো। এদিকে আর কোনো গাছ নেই। একটাই আমগাছ। কাঠবেড়ালী আসবে কী করে?’

‘আরেহ্, ওসব ছাড়ো। চলো, আম খাই। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ ইয়াম্মি হবে। নীহার বলছিল, এই গাছের আম অনেক টেস্টি।’

তাহরীম ছোটো ছোটো চোখে সুনাইরাকে দেখে বলল,
‘নীহার বলেছিল এই কথা?’

সুনাইরা না বুঝেই উপরনিচ মাথা নাড়ল। আম ফেলে গাছের ডালের দিকে পা বাড়াল তাহরীম। ফটাফট এদিক থেকে ওদিক উঠে ফাঁকফোকরে নীহারিকাকে খুঁজতে শুরু করল। সুনাইরা বলল,

‘তুমি গাছে উঠলে কেন?’

‘নীহার গাছে আছে। স্টুপিড মেয়েটা বিপদ বাড়াবে।’

***
চলবে।