#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২৯
রুমঝুমের সব কাপড়চোপড় গোছাচ্ছেন আলেয়া বেগম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নরসিংদীর পথে রওনা দিবেন। এখন চাইলেও ঢাকা শহরে থাকতে পারবেন না তিনি। তাই মা ও নবজাতকের সাথে তিনিও এই শহর ছাড়বেন। রুমঝুম তার আদুরে বাচ্চাকে নিয়ে রুমে বসে একা একাই বকবক করছিল। এরমধ্যেই নওমী ও মৌমিতা এসে উপস্থিত হলো। আদিয়ানের কাছ থেকেই রুমঝুমের শহর ছাড়ার খবর পেয়েছে সে। তাই শেষবেলা দেখতে আসা। তাদের দেখে একগাল হাসলো রুমঝুম। নওমীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কেমন আছেন, আপু?’
নওমী ঝটপট উত্তর দিল,
‘বিন্দাস আছি। তুমি?’
নওমীর এত ভালো থাকার কারণ রুমঝুম জানে না। সে বিষয়ে জানতেও ইচ্ছে হলো না। শুধু তাকে এত আনন্দিত দেখে নিজেও সামান্য হেসে বলল,
‘এইতো, আছি একরকম।’
তিনজনে টুকটুক করে গল্প জমিয়েছিল সবে, সেই সময় রুমের দরজায় নক দিয়ে আদিয়ান বলল,
‘আন্টি এসেছেন, ঝুম।’
মুহূর্তেই রুমঝুমের চেহারায় একরাঁশ কালোমেঘ নেমে এলো। নওমী সেটা খেয়াল করলেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। তার আগেই মাজেদা খাতুন ভেতরে প্রবেশ করে শামাকে দু’হাতে কোলে তুলে নিয়েছেন। আদিয়ান ড্রয়িংরুমে এসে জাদীদের সাথে আলাপ জমালো। ওখানে রাশেদুজ্জামানও বসেছিলেন। জাদীদ একটা চিঠি পকেট থেকে বের করে আদিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটায় জাহাঙ্গীরের হাতের ছাপ আছে।’
আদিয়ান চমকে তাকাল। চিঠিতে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘এতকিছু নাগালে আসছে অথচ যাকে দরকার তাকেই এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘পেয়ে যাব। কতদিন আর লুকিয়ে থাকবে?’
দু’জনে এই বিষয় ও পরবর্তী প্লান নিয়ে আলোচনা শুরু করলে, আলেয়া বেগম সবার জন্য সামান্য চা-নাশতার ব্যবস্থা করলেন। বিদায়বেলা তিনি আর মনমালিন্য চান না। হাসিমুখেই বিদায় নিতে চান। টেবিলে নাশতা সাজিয়ে তিনি রুমঝুমের রুমে প্রবেশ করে মৌমিতাকে বললেন,
‘যাও তো মা, ডাইনিয়ে গিয়ে বসো। আমি একটু নাশতা বানিয়েছি।’
মৌমিতা ঝটপট বলল,
‘আন্টি, এখন এসব ঝামেলা করতে গেলেন কেন?’
‘চলে যাব তো। আর কবে তোমাদের সবাইকে একসাথে খাওয়ানোর সুযোগ পাব? যাও…। আমি দেখি, আর কী কী গুছানো বাকি।’
মৌমিতা চলে গেলে, শামার সব প্রয়োজনীয় জিনিস লাগেজে গুছিয়ে, আদিয়ানকে ডেকে মালপত্র গাড়িতে তুলার ব্যবস্থা করলেন আলেয়া বেগম। এরপর নওমীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুমি একটু রান্নাঘরে এসো। দরকারী কথা আছে।’
নওমী ভীষণ চমকাল। ভয়ও পেল। আমতা-আমতা কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘কী কথা, আন্টি?’
এখানে মাজেদা খাতুন ও রুমঝুম বসা। তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কথাটা আমি শুধু তোমাকে বলব।’
আঁচলের তলায় কিছু একটা নিয়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালেন আলেয়া বেগম। পিছন পিছন নওমীও এলো। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আন্টি, কিছু ভুল করেছি? আপনি এত গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমার কিন্তু ভয় করছে। হাত-পা কাঁপছে দেখুন।’
কম্পনরত দুটো হাত আলেয়া বেগমের সামনে তুলে ধরল নওমী। তিনি গম্ভীর মেজাজেই বললেন,
‘এত ভয় নিয়ে ভালোবাসতে গেলে কেন?’
কী বলবে ভেবে পেল না নওমী। ভয়ের কারণে কোনো কথাও এলো না মুখ দিয়ে। আলেয়া বেগম কতক্ষণ এই ভয়মিশ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
‘হাত বাড়াও।’
নওমীর হাত সামনেই ছিল। আরেকটু উপরে তুলে আলেয়া বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তিনি ফের গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘একটা নয়, দুটো।’
বুকে ফুঁ দিয়ে দুটো হাত একসাথে উপরে তুলে ধরল নওমী। আলেয়া বেগম আঁচলের নিচ থেকে জুয়েলারি বক্সটা বের করে, ভেতরে থাকা স্বর্ণের দুটো বালা নওমীর দু’হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এগুলো যত্নে রাখবে। হারালে তোমার শাস্তি নিশ্চিত।’
নওমীর হাতের কম্পন বেড়ে গেল। সে নিজের দু’হাতের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। আলেয়া বেগম তার অবাককরা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
‘আমার ছেলেকে ভালোবাসো তো?’
কোনোমতে উপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে নওমী বলল, ‘ভীষণ।’
‘তোমার মায়ের নম্বরটা দাও। কথা বলব।’
নিজের ছোট্ট ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন আলেয়া বেগম। নওমী বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে মায়ের নম্বর টুকে দিয়ে বলল,
‘এখন কথা বলবেন?’
‘এখন না, বাড়ি পৌঁছে ফোন দিব। এখন আমার হাতে সময় নেই বেশি।’
মনে ভয় নিয়ে তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে রইল নওমী। কী হলো সেটাই যেন বুঝতে পারল না। যা হলো, সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। কেবলই মিছে স্বপ্নের মতো মনে হলো সবকিছু। দুরুদুরু মন নিয়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে যখন ভাবছিল, তখুনি টের পেল মাথার মধ্যে একটা নির্ভরতার হাত। এরপরই ভেসে এলো,
‘আমার ছেলেকে বিশ্বাস করো তো?’
নওমী শুধু উপরনিচ মাথা নাড়লো। আলেয়া বেগম বললেন,
‘গ্রামের মানুষ বলেই হয়তো শহুরে মেয়েদের প্রতি আমার একটা অনাগ্রহ কাজ করত সবসময়। তবে এই ক’দিনে আদির মুখ থেকে তোমার সম্পর্কে যা শুনেছি, তাতে শুধু মনে হয়েছে, আমার ছেলে ভুল মানুষকে ভালোবাসেনি। তুমি অনেক ম্যাচিওর একটা মেয়ে। যে সম্পর্কে তোমরা জড়িয়েছ, আশা করি, শেষপর্যন্ত সেই সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়। কখন কী হয়, বলা মুশকিল। আমি শুনেছি, তুমি দেশের বাইরে যেতে চাও। এই নিয়ে আমার কোনো আপত্তি বা নিষেধাজ্ঞা নেই। তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটতেই পারো। তবে একটা কথা, তোমাদের সামনের পথ অনেক কঠিন। কেন কঠিন সেটা আমি বলব না। শুধু বলব, পরিস্থিতি যেমনই হোক, তোমরা সম্পর্কে বিচ্ছেদ টেনে আনবে না। মনে রেখো, একটা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস না থাকলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।’
নওমী ভাষাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আলেয়া বেগম তার সম্পূর্ণ মুখজুড়ে হাত ছুঁইয়ে কপালে স্নেহমাখা আদর দিয়ে বললেন,
‘চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু সাবধানে চলাফেরা করো। আর রাত-বিরেতে একা একা বের হয়ো না। বিপদ কোনদিক থেকে আসবে, টের পাবে না।’
‘আপনি শুধু দোয়ায় রাখবেন আমাদের।’
‘বাবা-মা সবসময়ই সন্তানদের দোয়ায় রাখে। এখন, আসি। বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে।’
নওমীর কী হলো কে জানে, এমন আদর ও স্নেহের মায়ায় পড়ে দু’হাতে সে জড়িয়ে ধরল আলেয়া বেগমকে। বলল,
‘বাপি আমার অ্যানগেজমেন্ট ঠিক করেছে। আগামীমাসে। আমি কী করব, আন্টি?’
আলেয়া বেগম তাকে ভরসা দিয়ে বললেন,
‘কী করবে, সেটা সময় বলবে। এখুনি এত ডিস্টার্ব হওয়ার কিছু নেই। এখনও অনেকদিন বাকি।’
‘আপনি আর আসবেন না?’
‘অবশ্যই আসব। আমার ছেলের বউকে ঘরে তুলতে হবে না?’
লজ্জায় এইটুকুন হয়ে গিয়ে ঝটপট দূরে সরে এলো নওমী। আলেয়া বেগম গয়নার বাক্সটা নওমীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এটা তোমার কাছে রেখে দাও। যেদিন বউ সাজবে, সেদিন পরো।’
নওমীর হাত ধরেই রান্নাঘর থেকে বাইরে এলেন তিনি। সব গাড়িতে তোলা শেষ। এখন বিদায় নিতে হবে। তিনি রুমে এসে শামাকে নিজের কোলে নিয়ে মাজেদা খাতুনকে বললেন,
‘মনে কোনো রাগ-অভিমান রাখবেন না, আপা। মানুষ মাত্রই ভুল।’
মাজেদা খাতুন নির্ভার মন নিয়ে বললেন,
‘রাগ-অভিমান থাকলে আজ আমি এখানে আসতাম না, আপা।’
কোনো কারণে রুমঝুম তখনও মুখভার করে রেখেছিল। আলেয়া বেগম সেটা লক্ষ্য করে বললেন,
‘তোর আবার কী হলো? এখনও তৈরী হোসনি কেন? পরনের মিডি চেঞ্জ কর।’
হুকুম করে তিনি বেরিয়ে গেলেন ঠিকই তবে রুমঝুম ঠিক হলো না। তখনও মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। নওমীও তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। বলল,
‘ঝুম, চেঞ্জ করে নাও। আন্টি আবার তাড়া দিবেন।’
বিছানার একপাশে রাখা মিডিটা রুমঝুমের দিকে এগিয়ে দিল নওমী। রুমঝুম সেভাবেই বসে রইল। মাজেদা খাতুন বললেন,
‘বিদায়বেলা আমার ওপর অভিমান নিয়ে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে।’
মাজেদা খাতুন এসেছেন অনেকক্ষণ। অথচ এখন অবধি রুমঝুম একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কতক্ষণ চোখমুখ ফুলিয়ে কেঁদেছে শুধু। এখন অবশ্য কান্নার রেশটা নেই তবে মুখেও হাসি নেই। এখনও কথার কোনো উত্তর দিল না দেখে সন্দিহান মনে নওমী বলল,
‘কী হয়েছে, আন্টি? ঝুম এমন গালমুখ ফুলিয়ে আছে কেন?’
মাজেদা খাতুন মনমরা মুখে বললেন,
‘তেমন কিছু না। অবাঞ্ছনীয় আবদার করে ফেলেছি কি না। তাই শোধ তুলছে। এতক্ষণ ধরে বসেবসে অভিশাপ দিচ্ছে।’
‘কী আবদার, আন্টি?’
‘কী আর, জাদীদের বউ হিসেবে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তো মারাত্মক অভিমানী। গতকাল থেকে আমার সাথে কথাই বলেনি। এখানে এসেছি, আধঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। অথচ ও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।’
নওমী মুখে হাত চেপে রুমঝুমের পাশে বসে, দু’হাতে তাকে আগলে নিয়ে বলল,
‘মুরব্বি মানুষ, নিজের চাওয়াটা জানিয়েছেন শুধু, এতে এত রাগ বা অভিমানের কী আছে, ঝুম? তোমার দ্বিমত থাকলে তুমি সেটা জানাতে পারো। সবারই ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। কেউ তো তোমার মতের ওপর জোর কাটাচ্ছে না, তাই না?’
এই কথা শোনে মনে একটু সাহস পেল রুমঝুম। কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল,
‘আমি পারব না, আপু। কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। শুভকে ভুলে গিয়ে… অন্যকাউকে, মরে যাব।’
‘এইতো, তুমি যদি মনে করো এটাই তোমার সিদ্ধান্ত, তাহলে এই বিষয় নিয়ে কেউ তোমাকে জোর করবে না। এখন হাসিমুখে আন্টির কাছ থেকে বিদায় নাও। তোমার এই চুপ থাকাতে উনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন।’
নিজের ভুল বুঝতে পেরে দু’হাতে মাজেদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে অবুঝ বাচ্চার ন্যায় ডুকরে কেঁদে উঠল রুমঝুম। বলল,
‘আমাকে মাফ করে দাও, আন্টি।’
মাজেদা খাতুন চোখভর্তি পানি নিয়েও হেসে ফেললেন। রুমঝুমকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
‘ছাড়… ওসব ভুলে যা। আমাদের মা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন আছে, তেমনই থাকুক। এই নিয়ে আর কোনো কথা আমি বলব না।’
‘তুমি কষ্ট পাওনি?’
‘তোকে সুখী দেখলে আমার সব কষ্ট মুছে যাবে। নিজেকে ভালো রাখিস, মা।’
ড্রয়িংরুম থেকে তাড়া দিলেন রাশেদুজ্জামান। বাবার ককণ্ঠস্বর শোনে মাজেদা খাতুনকে ছেড়ে ঝটপট তৈরী হলো রুমঝুম। যেহেতু রিজার্ভ গাড়ি, বোরখা বা আবায়ার প্রয়োজন নেই। সে পরনের পোশাক পালটে মিডিটা গায়ে জড়িয়ে, ওড়না পেঁচিয়ে সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে বের হলো। মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিতে গেলে মৌমিতা বলল,
‘তোমাকে খুব মিস করব, ঝুম।’
রুমঝুম হেসে বলল,
‘আমিও আপনাদেরকে খুব মিস করব।’
মাজেদা খাতুনের হাত ধরে আস্তেধীরে নিচে এসে গাড়িতে উঠল রুমঝুম। রাশেদুজ্জামান সামনে বসলে আলেয়া বেগম বাচ্চাকে নিয়ে পিছনে বসলেন। সবাই তাদের বিদায় জানালেও এই বিদায়ী মুহূর্তে জাদীদকে কোথাও দেখা গেল না। কোন ফাঁক দিয়ে যে সে এই জায়গা ত্যাগ করেছে, সেটা কেউ-ই টের পায়নি। শুধু রুমঝুম দেখল, হেলমেট মাথায় চাপিয়ে বাইক স্টার্ট করে মুহূর্তের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল কেউ। ভেতর থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার।
গাড়ি দৃষ্টিসীমার বাইরে যাওয়ার পর মাজেদা খাতুন আদিয়ানকে বললেন,
‘একটা রিকশা ডেকে দাও তো, বাবা।’
আদিয়ান সামনে এসে বলল,
‘এখুনি চলে যাবেন?’
‘যেতে হবে। জাদীদ সকালে খায়নি কিছু। ওর জন্য রান্না বসাতে হবে।’
খেয়াল হতেই আশেপাশে চোখ দিয়ে নওমী ও মৌমিতা ব্যতীত কাউকে দেখল না আদিয়ান। না পেয়ে একটা অটোরিকশা থামিয়ে ভদ্রমহিলাকে সেটায় তুলে দিয়ে বলল,
‘একা যেতে পারবেন? আমি আসব?’
‘না, না। একাই যেতে পারব।’
তিনি রিকশাকে তাড়া দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চোখের আড়ালে চলে গেলেন। নওমী নিজেও বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাস্তায় এসে আদিয়ানের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল,
‘মন খারাপ?’
মুচকি হেসে দু’দিকে মাথা নাড়ল আদিয়ান। হাত বাড়িয়ে নওমীর মায়াভরা মুখটা ছুঁয়ে দিল। চোখের পাতায় আঙুল ছুঁয়ে বলল,
‘আপনাকে হারানোর ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছি না।’
আদিয়ানের হাতের ওপর হাত রেখে প্রশ্ন করল নওমী,
‘কেন?’
‘জানি না। কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে! অথচ আমি কিছু করতে পারছি না। সবকিছু নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঝুমের জীবনটা গুছিয়ে দিব বলে ওকে এই শহরে এনেছিলাম, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি।’
‘সবটাই হয়তো ভাগ্য। তাই না?’
‘হুম…।’
টপিক চেঞ্জ করে নওমী বলল,
‘আপনি আন্টিকে আমার কথা বলেছিলেন?’
উপরনিচ মাথা নেড়ে আদিয়ান বলল,
‘বলেছিলাম তো। আম্মির সিদ্ধান্ত কী, এখনও কিছু জানি না। এই কারণেই ভয় থেকে বের হতে পারছি না।’
নওমী মুখ টিপে হেসে দুটো হাত উপরে তুলে বলল,
‘দেখুন তো, চুড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?’
নওমীর হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো আদিয়ান। দুটো হাত আঁকড়ে ধরে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘এটা তো আম্মির। আপনি এটা কোথায় পেলেন?’
‘শাশুড়ি মা তার বউমাকে বরণ করে নিয়েছেন, এবার শুধু ঘর বাঁধা বাকি। কবে ঘর হবে?’
আদিয়ানের চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সে নিষ্পলক চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘সিরিয়াসলি? আম্মি এটা স্বেচ্ছায় আপনাকে দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, দিয়েছেনই তো। আপনার কি মনে হচ্ছে, আমি এটা চুরি করেছি?’
‘ধ্যাৎ, কী বলেন এসব? চুরি হতে যাবে কেন? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
চমক বাড়িয়ে দিতে দু’হাতে আদিয়ানকে জড়িয়ে ধরল নওমী। আশেপাশে কেউ আছে কি নেই, সব ভুলে গিয়ে ভীষণ আবেগে বলল,
‘আমার হাতে সময় খুব কম, আদি। প্লিজ, কিছু করুন। আপনাকে হারিয়ে ফেললে আমি পাগল হয়ে যাব। পৃথিবীর কোনো অপশক্তিকে ভয় পাই না, শুধু নিজের বাপিকে ভয় পাই। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে উনি যা খুশি তাই করতে পারেন। আমি আমার বাপিকে চিনি। স্বেচ্ছায় মত না দিলে উনি জোর করে হলেও বার্থডে পার্টিতে অ্যানগেজমেন্ট করিয়ে ছাড়বেন। আমার এই হাতে আমি অন্য কোনো পুরুষকে আর ছুঁতে পারব না। কোনোভাবেই পারব না।’
আদিয়ানের নিঃশ্বাসটা আটকে এলো। হারানোর ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। দু’হাতে জড়িয়ে রেখে নওমীর কপালে ভরসার ন্যায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
‘আমি ছুঁয়ে দিয়েছি তো। আর কোনো পুরুষের সাহস নেই আপনার দিকে হাত বাড়ায়। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। একটু রিল্যাক্স হোন।’
‘বাপি যদি জোর করে কিছু করতে চান?’
আদিয়ান একইভাবে বলল,
‘আমি আছি তো। কক্ষনও একা ছাড়ব না। একটু ভরসা করুন আমায়।’
***
চলবে…
মন খারাপের পরমুহূর্ত বোধহয় মানুষ নীরবতাকেই সবচেয়ে আপন, বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। রাত্রির এই নিস্তব্ধতাকে আলিঙ্গন করতে পেরে খুব বেশি খারাপ লাগছে না মাইসারার। চোখে ঘুম নেই আজ! মাঝেমধ্যেই তার এমন হয়! অকারণ নির্ঘুম রাত কা’টা’তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। কখনো কখনো ডিউটির ফাঁকে রিপার সাথে চায়ের কাপে আড্ডা জমতো। সেই আড্ডা চলতো ভোররাত্রি পর্যন্ত। আজও যদি আড্ডার মধ্য দিয়ে রাত পেরিয়ে ভোরকে স্পর্শ করা যেত, তবে মন্দ হতো না। সময়টা আরও বেশি উপভোগ্য হতো, যদি পাশাপাশি কেউ থাকতো। একাকী জীবন অতিবাহিত করতে গিয়ে সে অনুভব করেছে, আসলে সে একা নয়! তার পিছনে এই যে কিছু মানুষের এতটা ভালোবাসা, যত্ন, খেয়াল, খুশি জড়িয়ে আছে তাতে কোনোভাবেই প্রমাণ হয় না সে একা। আজ তো জীবনটা পুরোপুরি ঘুরে গেল। তার ভরসা হয়ে কেউ একজন জড়িয়ে গেল জীবনে, চাইলেও এই মানুষটার চোখের আড়াল সে কখনোই হবে না। একাকীত্ব আসা সে তো অনেক দূরের চিন্তাভাবনা!
কত-শত আজেবা’জে চিন্তায় ডুবেছিল সে। ঘোর ভাঙ’লো কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে। অনিক পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
-“রাত জেগে অকারণ দুঃশ্চিন্তা করিস না, সারা। অসুস্থ হয়ে পড়বি। ডাক্তারদের অসুস্থ হওয়া সাজে না। তাদের সবসময় ফিট এন্ড স্ট্রং থাকতে হয়! নয়তো, অন্যদের তারা সামলাবে কী করে?”
-“ঘুম আসছে না!”
অনিক হয়তো বুঝলো, তার ঘুম না আসার কারণ। তাই কথা ঘুরাতে বলল,
-“রিটার্ন টিকিট কে’টে এসেছিলি?”
মাইসারা মাথা নাড়লো। পরমুহূর্তেই চমকে গেল পুরোটাই! আচমকাই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করে ভয়ে কেঁ’পে উঠলো! দু’হাতে টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। অনিক বাঁধা দিল না। আলগোছে তাকে বিছানায় শুয়ালো। চুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বলল,
-“চোখ বন্ধ কর। ঘুম আসবে। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি!”
অনেকদিন পর মাইসারা টের পেল সে ছোটো বাচ্চার মতো আবেগী, আহ্লাদী হয়ে গেছে! তার পাশে বটবৃক্ষের ন্যায় বিশাল সাইজের ছায়া পড়েছে। সে ছায়া তাকে আগলে রাখছে, যত্ন নিচ্ছে, দুঃখ-সুখের ভাগিদার হচ্ছে। যার সংস্পর্শে এখন সে পুরোটাই নিরাপদ! হাত উলটে আঙুলের ভরে চোখের পানি মুছে নিল সে। সামান্যতম উষ্ণ স্পর্শের জন্য, শান্তিতে মাথা গুঁজে দু’চোখে প্রশান্তির ঘুম টে’নে আনতে খানিকটা এগোলো সে। যেভাবে টি-শার্ট আঁকড়ে ধরেছিল, সেভাবে আবারও আঁকড়ে ধরে পরম শান্তির জায়গায় মাথা ঠে’কা’লো। বলল,
-“আমি এখানে ঘুমাই?”
মাইসারার দিকে দৃষ্টি দিল সে। তার চোখের চাহনি বলে, এটা ছোটোখাটো কোনো আবদার নয়। সারাজীবন ভরসা করার, পাশে থাকার সহজ অথচ নীরব স্বীকারোক্তির কথা শুনবে বলেই নিশ্চুপে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ভরসা হওয়া উচিত তো তার। এখন তো আর তাদের সম্পর্ক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর নয়, বরং সানন্দে তা গ্রহণ করার সময়। এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটার জন্যই বুঝি, এতদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনেছিল সে। বুঝতে পেরে অনিক জবাবটা মুখে আট’কে নিল। নির্দ্বিধায় অধর ছুঁইয়ে দিলো কপালে! স্পর্শের গভীরতা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, কতখানি অনুভূতি বাঁচিয়ে রেখেছিল সে। পরক্ষণেই দু’হাতের বাঁধনে বুকে আগলে নিল। ক্ষীণস্বরে বলল,
-“এইখানে মাথা রাখার অধিকার শুধু তোর! সারাজীবন থাকবি, যত্নে!”
***
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩০
‘কোনটা পাবলিক প্লেস আর কোনটা পার্সোনাল রুম, সেটা বোধহয় ভুলে যাচ্ছ তুমি। আমার মেয়ে হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’পয়সার একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে তোমার লজ্জা হলো না? এই দিন দেখার জন্যই কি তোমাকে এত বড়ো করা?’
বাসায় ফেরার পরই তোফাজ্জল হোসেনের প্রথম কথা ছিল এটা। বাপিকে অসময়ে বাসায় দেখে নওমী ভীষণ অবাক হলো পরপরই লজ্জায় মুখ নামিয়ে রাখল। না… সে ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরে লজ্জিত নয়, লজ্জিত তার বাপির মুখ থেকে এরকম একটা অহংকারী, দেমাগি কথা শোনে। ‘দু’পয়সার ছেলে’ বারকয়েক শব্দদুটো আওড়ে বাপির মেজাজী চেহারার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘না… তো, একদমই লজ্জা হয়নি। কারণ ওই দু’পয়সার ছেলেকেই আমি ভালোবাসি।’
তোফাজ্জল হোসেন ধমকে উঠে বললেন,
‘তুমি কি একবারও বুঝতে পারছ না, আমার মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছ? তখন আমার সাথে অফিসের ম্যানেজার ছিল, অন্য কোম্পানির নামীদামী লোকজন ছিল। আমি কতটা বিব্রতবোধ করছিলাম জানো? আর কেউ না চিনলেও ম্যানেজার তো আদিয়ানকে চিনে। উনি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটা এখন দশজনকে জানাবেন। এতে আমার নাক-কান কাঁটা যাবে না?’
‘হ্যাঁ, প্রিয়জনকে জড়িয়ে ধরার আগে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝা উচিত ছিল যে, ডানে-বামে কোনো ক্ষুব্ধ দৃষ্টি আছে কি নেই। মন তো আর সবসময় নিজের বশে থাকে না। মাঝেমধ্যে একটু আবেগ ও চঞ্চলতা ভর করে। এতে যদি লজ্জায় তোমার নাক-কান কাঁটা যায় তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আজ যা বলছি, আগামীকালও তা-ই বলব। এতে তুমি আমাকে মারতে পারো, বকতে পারো, বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দিতে পারো। তাতেও খুব একটা ক্ষতি হবে না। এই বয়সে এসে আমি তোমার এসব হুমকি-ধমকির তোয়াক্কা করব না। আমি যথেষ্ট ম্যাচিওর। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার বয়স আমার হয়েছে। কোনোভাবেই তোমরা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারো না।’
তোফাজ্জল হোসেন মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না। সোফা ছেড়ে উঠে এসে মেয়েকে থাপ্পড় মেরে কড়া শাসনের সুরে বললেন,
‘তুমি কোনোভাবেই ওই ছেলেকে ভালোবাসতে পারো না। আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম ওর চালাকি। ও তোমাকে ফাঁদে ফেলে আমার সব সম্পত্তি ভোগ করতে চাইছে। আমাকে রাস্তায় নামাতে চাইছে। সেদিন তো খুব গলাবাজি করছিল আমার সাথে। এজন্যই রিজাইন ধরিয়ে দিয়েছিলাম।’
নওমী গালে হাত রেখে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। তোফাজ্জল হোসেন একে-একে সব ঘটনার বিবৃতি দিয়ে গেলেন। শোনে নওমীর কাছে সবটাই কেমন অবিশ্বাস্য লাগল। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,
‘এতগুলো দিন তোমার অফিসে খেটে মরার পরও তার সম্পর্কে তোমার এই ধারণা জন্মাল, বাপি? ভীষণ ভুল করলে। তুমি আজও আদিকে চিনতে পারোনি। জানোই না, ওই মানুষটা কেমন। আমি জানি, আর জানি বলেই, তাকে ভালোবেসেছি। তার ভালোবাসায় বাঁচতে শিখেছি।’
‘এসব বস্তাপঁচা ভালোবাসার বুলি না কপচিয়ে বিয়ের প্রিপারেশন নাও। আগামী মাসেই বিয়ে।’
মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল নওমী। সামান্য একটা দৃশ্য যে বিয়ের ব্যাপারটাকে এতদ্রুত সামনে নিয়ে আসবে ভাবেওনি সে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপে বাপির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই কোথা থেকে যেন মনের মধ্যে সাহস এসে ভীড় জমাল তার। অহংকারী বাপির অহংকারকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে বলল,
‘ওইদিন তুমি বলেছিলে না, টাকার অভাব ও ক্ষিধের বুঝতে শিখতে? তুমি বলেছিলে না, এক সপ্তাহের জন্য সাধারণ জীবনযাপন করতে?’
‘হ্যাঁ বলেছিলাম। যেন তুমি টাকার মূল্য বুঝতে শিখো। যেন তুমি যার-তার জন্য দু’হাতে বেহিসেবী খরচ না কোরো।’
‘প্রত্যেকটা জিনিসের নেগেটিভ ও পজেটিভ দিক দুটোই থাকে। তুমি ব্যাপারটা নেগেটিভভাবে দেখলেও আমি গ্রহণ করেছিলাম পজেটিভ হিসেবে। কারণ, তুমি ভেবেছিলে, দু’হাতভরা টাকা দিয়ে তুমি আমাকে সুখ এনে দিয়েছ। ভেবেছ, সেই সুখের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপনের সিদ্ধান্তকে কোনোদিন গ্রহণ করব না। ক্ষিধের অভাব টের পেয়ে ঠিকই রাজপ্রাসাদে ফিরে আসব। এবং এটাকেই বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করব। অথচ হয়ে গেল ঠিক উলটো। এরপর থেকে শুধু একটা সপ্তাহ নয়, জীবনের প্রতিটাদিন, প্রতিটামুহূর্তই আমি খুবই সাধারণ ও সাদামাটা জীবনযাপন করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কেন নিয়েছিলাম জানো? তোমার মতো অহংকারী বাপিকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, টাকাই কাউকে সম্পূর্ণ সুখ ও পরিপূর্ণতা এনে দেয় না। তুমি সেদিন ওইসব কথা বলেছিলে তার একটাই কারণ, আমি যেন কখনও কাউকে সাহায্য করতে না পারি। তুমি চাও না, তোমার টাকার পাহাড়টা হতদরিদ্র মানুষের বিপদের বন্ধু হোক। ওই মানুষগুলোকে তো তুমি মানুষই ভাবো না। তাই তুমি চেয়েছ, আমার ক্রেডিট কার্ড ব্লক করে দিয়ে ইমোশনটাকে মেরে ফেলতে। টাকার মূল্য বুঝাতে গিয়ে তুমি আমার ইচ্ছেদের গলাটিপে হত্যা করেছ, বাপি। শেষ করে দিয়েছ আমাকে।’
তোফাজ্জল হোসেন দমে না গিয়ে চড়া গলায় বললেন,
‘তুমি উলটো হিসেব করছ। আমি কখনওই চাই না তুমি কষ্টে থাকো। সাধারণ জীবনযাপন তোমাকে দিয়ে হবে না।’
‘হবে কি হবে না, সেটা তো সময় বলবে। এই কয়েকটা মাস যদি আমি ক্রেডিট কার্ড ছাড়া থাকতে পারি, লক্ষ টাকার গাড়িতে শান্তি না খুঁজে রিকশা চড়ে স্বস্তি পেতে পারি, তাহলে বাকিজীবনও ওই তিনচাকার রিকশাকেই নাহয় চলার পথের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিব। এতে আমার খুব একটা কষ্ট হবে না। কারণ আমি এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। আপাতত সবকিছুর জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাপি, তোমার ওই কথাগুলোকে আদেশ হিসেবে গ্রহণ করেছি বলেই, কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। জীবনের বাকি দিনগুলো আমি একজন সাধারণ পরিবারের মানুষ হয়েই বাঁচতে চাই। তোমার ভাষায় যে পুরুষ ‘দু’পয়সার ছেলে’, আমি তার জীবনসঙ্গী হতে চাই।’
গর্জে উঠে মেয়েকে আবারও মারতে যাবেন, অমনি তাঁর ধরে ফেললেন নুজাইফা আমীন। অসুস্থ মাকে দেখে মাত্রই বাসায় ফিরলেন তিনি। ঘরে পা রেখে বাবা-মেয়ের এই দ্বন্দ দেখে এগিয়ে এলেন। কিছু বলার আগেই স্বামীর হাতকে মেয়ের ওপর চড়াও হতে দেখে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘গায়ে হাত তুলছ কেন? ও কি ছোটো বাচ্চা? বোধবুদ্ধি নেই? সারাজীবন তো টাকার অহংকার দেখিয়ে এসেছ। এবার অন্তত মেয়ের মনটা বুঝতে শিখো। ওর ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দাও। সবসময় মেজাজ ও দাম্ভিকতা দেখিয়ে কি সন্তানকে দিয়ে জোরপূর্বক মতের বিরুদ্ধে কাজ করাবে? এটা তো ওর সাথে অন্যায় হচ্ছে।’
তোফাজ্জল হোসেন হাত নামিয়ে বললেন,
‘তুমি এসবের মধ্যে ঢুকো না।’
‘কেন? ঢুকলে কী করবে? মেয়ে কি তোমার একার? দশমাস শারিরীক-মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে যে সন্তানকে জন্ম দিলাম, মা হয়ে সে-ই মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত কি আমি নিতে পারি না? না কি সব সিদ্ধান্ত শুধু বাবাদেরই নিতে হয়? বাবার আদেশ-নিষেধ ও হুকুম সব, মায়ের কথার বুঝি কোনো মূল্য নেই?’
‘মেজাজ গরম কোরো না। বাইরে থেকে এসেছ। ফ্রেশ হও, যাও…।’
নুজাইফা আমীন না গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে কাছে টেনে মাথায় আদর দিয়ে বললেন,
‘নিজের রুমে যাও। আমি কথা বলছি।’
নওমী চলে যেতে নিলে তোফাজ্জল হোসেন চওড়া কণ্ঠে বললেন,
‘আমার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। আগামীমাসেই বিয়ে।’
হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নওমী। বাপির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তাহলে আমাকে কবর দেয়ার জন্য তৈরী হয়ে যাও।’
‘কী বললে তুমি?’
‘ঠিকই তো বলেছি। মরে মরে বেঁচে থাকার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়া ভালো। এতে যদি তোমার প্রাচুর্যের দেয়ালে ফাটল ধরে।’
‘তোমার কাছে কি আমার আদর-ভালোবাসা, স্নেহ-মায়া, মমতা, কোনোকিছুরই মূল্য নেই? এতগুলো দিন তাহলে কার জন্য এসব করেছি আমি? আমার পরিশ্রম, ত্যাগ, কিচ্ছুর দাম নেই? এত বছরের আত্মিক ও রক্তের সম্পর্কের চেয়ে কয়েকদিন আগে গড়ে ওঠা সম্পর্ক তোমার কাছে দামী হয়ে গেল? আর আমার, কোনো মূল্য রইল না?’
বাপির আবেগজড়ানো কথায় কেঁপে উঠল নওমী। এমনটা তো সে কোনোকালেই ভাবতে পারে না। বাবা-মায়ের চেয়ে কেউ কীভাবে দামী হয়? বাবা-মায়ের কাছে কত ঋণ জমা, সেসব কি একজীবনে শোধ করা সম্ভব? ভাবতে গিয়ে ভেতর কেমন হাহাকার করে উঠল তার। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমি এতকিছু মিন করিনি, বাপি। তোমাদের ভালোবাসা তো সব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে। তার সাথে কি অন্য কোনো সম্পর্কের কম্পেয়ার করা যায়? আমি তো শুধু একটু মানসিক শান্তি চাই।’
‘আমি কি তোমাকে মানসিক অশান্তি দিচ্ছি?’
‘এমনটা নয়, বাপি। ভালোবাসাবিহীন সম্পর্ক টেনে নেয়া অনেক কষ্টের। যাকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারব না, তাকে জীবনসঙ্গী বানিয়ে কেন মিছেমিছি ভালোবাসার নাটক করব? এটা তো অন্যায় হবে তাই না? মনে একজন আর সংসারে একজন। এভাবে বাঁচতে পারব? সম্ভব বলো?’
‘আমি এতকিছু বুঝি না। আমি শুধু চাই, ওই ডাক্তারকে বিয়ে করে তুমি শীঘ্রই দেশ ছাড়ো। এ দেশে তুমি নিরাপদ নও। আর আদিয়ানও তোমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। তাই বলছি, সবকিছুকে একটা ড্রামা ভেবে ভুলে যাও। নয়তো…।’
এ পর্যায়ে তোফাজ্জল হোসেনের চেহারার ভাবভঙ্গি পুরোটাই পালটে গেল। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে রাখলেন। এই রুক্ষমূর্তি ভীষণ ভয়ের ঠেকল নওমীর কাছে। ঢোক গিলে বলল,
‘নয়তো কী?’
তোফাজ্জল হোসেন স্পষ্টকণ্ঠে বললেন,
‘ওই দু’পয়সার ছেলেকে লাশ বানিয়ে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না।’
বাবার দৌড় সম্পর্কে যথেষ্টই ধারণা আছে নওমীর। তাই নিজের স্পষ্টতা জানিয়ে বলল,
‘মেয়েকে তুমি ভালোবাসো ঠিকই কিন্তু মেয়ের ভালো থাকার কারণটাকে নিজের আত্ম-অহমিকার কারণে গ্রহণ করতে পারছ না। অসুবিধা নেই। কবে তাকে লাশ বানাবে জানিও। একইদিনে আমিও নাহয় লাশ হয়ে যাব। এরপর দুজনকে পাশাপাশি কবরে দাফন কোরো। দুনিয়াতে তো এক হওয়ার সুযোগ নেই, আখেরাতে যেন এক হতে পারি। এই জগতে বাধা থাকলেও ওই জগতে আর কোনো বাধা না থাকুক।’
নওমী নিজের রুমে চলে গেলে তোফাজ্জল হোসেন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে, কণ্ঠে রাগ ধরে রেখে শক্ত মেজাজে বললেন,
‘মেয়েকে মানুষ করতে পারোনি।’
নুজাইফা আমীন নির্ভার হেসে বললেন,
‘ভুল বললে। মেয়ে মানুষ ঠিকই হয়েছে শুধু তোমার মতো অহংকারী হয়নি। সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতে জানে বলেই, তোমার তাকে অমানুষ মনে হচ্ছে। অথচ ওই সাধারণ মানুষের পরিশ্রমকে হাতিয়ার বানিয়ে রাজপ্রাসাদ তৈরী করেছ। তুমি কী ভাবো, যে টাকার বড়াই তুমি দেখাও, সেসব তোমার একার অর্জন? না….। ওই সাধারণ ছেলেপেলেরা কষ্ট করে, মেধা খাটিয়ে তোমার কোম্পানির পিছনে সময় ব্যয় করে সাকসেস এনে দিচ্ছে দেখেই তুমি দু’হাতে মোটা অংকের অ্যামাউন্ট পাচ্ছ। পরিশ্রমের বিনিময়ে তুমি তাদেরকে নির্দিষ্ট মূল্য দিলেও কখনও মানুষ ভাবোনি। চাকর ভেবেছ। ‘অহংকার পতনের মূল’ এটা ভুলে যেও না।’
‘তুমি কি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছ?’
‘মোটেও না। অভিশাপ দিচ্ছি না। স্বামী হও তুমি আমার। তোমাকে অভিশাপ দিতে পারি? শুধু মনে করিয়ে দিলাম। মাঝেমধ্যে তো তুমি সত্য ভুলে যাও। তাই স্মরণ করাতেই হয়।’
‘কী বলতে চাইছ তুমি?’
নুজাইফা আমীন গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘তোমার সাথে আমি কোনো তর্কে যেতে চাই না। শুধু বলে রাখি, আমাদের জীবনে যা হয়েছে, সেসব যেন মেয়ের জীবনে না হয়। ওর জীবনটা সাজানোর দায়িত্ব আমাদের দু’জনার। অথচ তুমি বাবা হয়ে মেয়ের জীবনটাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছ। জাহাঙ্গীর এখন এই শহরে আছে। কখন কী হয়, জানি না। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। আর সবটাই হচ্ছে তোমার জন্য। অতীতের দৃশ্য আর রিপিট না হোক। এখনও সময় আছে, মেয়ের কাছে যদি সৎ থাকতে চাও, ও সব সত্য জানার আগে ওকে আদির হাতে তুলে দাও। এই দেশ ছেড়ে চলে যাক। জাহাঙ্গীরের বোঝাপড়া তোমার সাথে হোক, মেয়ের সাথে না। অহংকার ও টাকার পাহাড়ে থাকতে গিয়ে মেয়ের জীবনটা নষ্ট কোরো না। অনুরোধ করছি তোমায়, প্লিজ।’
তোফাজ্জল হোসেন যেন বোবা হয়ে গেলেন। মুখের কথারা হারিয়ে গেল তাঁর। তিনি বিরসবদনে চেয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। এরপর নিচুস্বরে বললেন,
‘আদিয়ানের সাথে মেয়েটা সুখী থাকবে না।’
‘আমি কি তোমার সাথে সুখে আছি?’
সংসারজীবনের এতবছর একসাথে থাকার পর আজ হঠাৎ স্ত্রীর মুখে এমন একটা প্রশ্ন শোনে প্রচণ্ড বিব্রতবোধ করলেন তোফাজ্জল হোসেন। নিষ্পলক চোখে চেয়ে থেকে নিজেও পালটা প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘তুমি আমার সাথে সুখী নও? এতবছর পর এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করালে কেন?’
‘কেন সেটা তুমিই ভালো জানো। বাদ দাও এসব। জীবন অনেকটা এগিয়ে গেছে। পিছনে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি থাকত, সেই নিঃসঙ্গ জীবনে ফিরে যেতাম, যেখানে তোমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। অথচ এটা অসম্ভব। আমার সাথে যা হয়েছে, মেনে নিয়েছি। মেয়ের সাথে এমনকিছু করো না, যার কারণে ওর জীবন থেকে মানসিক শান্তিটা হারিয়ে যায়। এখনও নিমু তোমাকে ভালো বাবা হিসেবে জানে। শেষ বয়সে এসে মেয়ের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ো না। ওর কাছে সারাজীবন ভালো বাবা হয়েই থেকে যাও।’
অনেকদিন পর নিজের ভেতরে চেপে রাখা কথাগুলো প্রকাশ করতে পেরে একটু স্বস্তিবোধ করলেন নুজাইফা আমীন। স্বামীকে হাজারও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। তোফাজ্জল হোসেন সোফায় বসে স্মৃতির অন্দরে প্রবেশ করতে চাইলেন। একটা সময় বুকের ভেতর যন্ত্রণার পাহাড় জমলো। পিছনে যা কিছুই থাকুক, সবকিছুর হিসেব কষেও আদিয়ানের সাথে মেয়েকে সুখী দেখবেন, এই সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারলেন না।
নওমী নিজের রুমে প্রথমে নিজের ফুপিকে কল দিয়ে, ফুপাতো বোনের কাছে লন্ডনে থাকা সেই নামীদামী ডাক্তারের নম্বর চাইল। তার ফুপাতো বোন নম্বর দিতে পারল না তবে তার কাছে থাকা ইমেইল এড্রেস দিল। মনে সাহস সঞ্চয় করে নওমী ইংরেজিতে লিখল –
‘আই এ্যাম ভের্যি স্যরি। দেয়ার ইজ নো ওয়ে, আই ক্যান ম্যারি ইউ। আই লাভ এ্যানাদার পারসন এন্ড ওয়ান্ট হিম এ্যাজ মাই লাইফ পার্টনার।’ – তানজিদা হোসেন।
এই ইমেইলের ঠিক আধঘণ্টা পর রিপ্লাই এলো,
‘আই ডো’ন্ট ওয়ান্ট ঠু টক অ্যাবাউট ইট নাও। রিটার্নিং হোম নেক্সট মান্থ। এ্যাভ্রিথিং উইল বি হ্যাপেন দ্যান।’ – ড. সাইমুম।
***
চলবে…
“ভাইয়া একটু বাইরে এসো তো। কেউ একজন আপুর সাথে দেখা করতে চান।”
এক ডাকেই কাজ হলো। ঘর থেকে বাইরে এলো উসাইদ। ফারশাদের দুর্ঘটনা ও উজমার অসুস্থতার সুযোগে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে সে। তাই আজ বাড়িতেই। সে বাইরে এসে বাড়ির মূল গেটের সামনে দামী ও গর্জিয়াস সাজপোশাকের মুনমুন হক্বকে দেখে সামনে এগিয়ে বলল, “ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। অবশেষে আমার মতো দু’পয়সার ছেলের দ্বারে আসতে হলো আপনাকে। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন…।”
মুনমুন হক্ব মেজাজ দেখাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। সব অপমানের জবাব দিবেন। কিন্তু এইমুহূর্তে একটু নাটক করতে পারলেই ফারশাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য উজমাকে নাই করে দিতে পারবেন। তিনি ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, “কী করব বলো? আসতেই হতো। শত হলেও আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ি এটা। আমি না এসে পারি?”
উষা সরে দাঁড়ালে মুনমুন হক্ব ভেতরে পা রাখলেন। সাকিবও আসতে চাইল। হাত তুলে উসাইদ তাকে ওখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল, “এ্যাই রাস্তার কুকুর, তুই ভেতরে আসছিস কেন? বাইরে থাক।”
সাকিবের মুখের ওপর গেট আটকে দিল উসাইদ। মুনমুন হক্ব হতভম্ব হয়ে গেলেন। চার আনার ছেলের এত দাম্ভিকতা তাকে অবাক করে দিল। তিনি চমকে তাকালে উসাইদ বলল, “আপনি হা করে দেখছেন কী? ভেতরে আসুন।”
উসাইদের এই মেজাজ মুনমুন হক্বের সহ্য হচ্ছে না, তবুও তিনি দাঁতে দাঁত চেপে ভেতরে প্রবেশ করলেন। উসাইদ তাকে ড্রয়িংরুমে এনে বসাল। মিশকাতকে ডেকে চা-নাশতার কথা বলল। মুনমুন হক্ব জানালেন, “আমি কিছু খাব না। আমার বউমাকে ডাকো। তাকে দেখেই চলে যাব।”
উসাইদ বলল, “এত তাড়া কীসের? এসেছেন, বসেন, নাশতা-পানি খান, তারপর উজমার সাথে দেখা করবেন। আপনি এমন কোনো প্রেসিডেন্ট না যে, চাওয়া মাত্রই আমার বোন আপনার সামনে আসতে বাধ্য।”
“দেখো, তুমি এখনও পিছনের কথা ধরে রেখে বসে আছো। আমি ওসব কথা মনে রাখতে চাইছি না। সুসম্পর্কে কোনো ধরনের রাগ-অভিমান থাকা উচিত না।”
“আপনি মানেন এটা সুসম্পর্ক? মনে তো হয় না।”
“আমি এখানে বেশিক্ষণ বসব না, উসাইদ। উজমাকে ডাকো।”
নিচে নামতে এসে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল উজমা। সব কথা শুনছিল। এই মহিলা যে একটা স্বার্থপর ও ভীষণরকম চালাক সেটা উসাইদ এখনও আন্দাজ করতে পারেনি। তবে সে ভীষণ অবাক হলো, ভদ্রমহিলাকে এত তাড়াতাড়ি এমন একটা কুঁড়েঘরে আসতে দেখে। দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে ড্রয়িংরুমে এলো। কয়েক হাত দূরে থেকে বলল, “আমাকে খুঁজে বের করার জন্য এত কষ্ট করলেন আপনি? রাজপ্রাসাদ থেকে সোজা পর্ণকুটিরে চলে এলেন? কী সৌভাগ্য আমার। রীতিমতো বিস্মিত আমি। তা, কী চাই এখানে?”
মুনমুন হক্ব মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, “দূরে দাঁড়িয়ে কেন, মা? কাছে এসে বসো। তোমাকে একটু দেখি।”
উজমা ঝটপট বলল, “দুঃখিত…। আমি কোনো অচ্যুত ও নোংরা কাদামাটিতে মাখামাখি করা ব্যক্তির পাশে বসি না। ওসব ছোঁয়াচে কি না। যদি আপনার শরীরের কাদামাটি আমাকে স্পর্শ করে ফেলে তবে তো আমিও অচ্যুত হয়ে যাব। দূরে আছি, বেশ আছি। কী বলতে চান, ওখান থেকেই বলুন।”
ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মেজাজের ওঠানামাকে সামলে নিলেন মুনমুন হক্ব। এখুনি রি’অ্যাক্ট করলে সব প্লান মাঠে মারা যাবে। আপাতত কিছু বলা যাবে না। তিনি চুপ থেকে নিঃশ্বাস ফেলে উসাইদকে বললেন, “আমি শুধু আমার বউমার সাথে কথা বলতে চাই। তোমরা একটু দূরে যাও।”
উসাইদ বলল, “অসম্ভব। আমরা কেউ এক পা-ও দূরে যাব না। যা বলার আমাদের সামনেই বলুন।”
এরা এত সহজে তাকে একা ছাড়বে না, বেশ বুঝে নিলেন মুনমুন হক্ব। ব্যাগ থেকে মোটা বান্ডেলের অনেকগুলো হাজার টাকার নোট উজমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এগুলো রাখো। কাজে লাগবে। শুনেছি তুমিও অসুস্থ।”
উজমা ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, “কিনতে চান না কি দূরে সরাতে চান? ঠিক কী জন্য এতগুলো টাকা দিচ্ছেন?”
“বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুঝে ফেলেছ। কিনতে চাইছি, তোমার ভালোবাসা। বিক্রি করে দাও, আমার বোনঝির নামে।”
“এত সস্তা? সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে আমার এত দিনের দামী অনুভূতি ও সম্পর্ককে তুচ্ছ করে দেব, তা-ও একটা উচ্ছিষ্টের নামে, ভাবলেন কী করে?”
“তোমাদের মতো মেয়েদের জন্য অসম্ভব কিছু না।”
“ঠিকই বলেছেন অসম্ভব কিছু না। আমরা চাইলে সব করতে পারি।”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে টাকার বান্ডেলগুলো হিসেব করল উজমা। গুটিকয়েক পা ফেলে রান্নাঘরে গেল। দিয়াশলাই হাতের মুঠোয় নিয়ে ফিরে এসে বলল, “হাতে নিই?”
মুনমুন হক্ব বিজয়ীর হাসি ঠোঁটে এনে বললেন, “অবশ্যই। এইসব টাকা তোমার।”
উজমা সামান্য হাসলো। সবগুলো বান্ডেল ফ্লোরে ফেলে হাতের মুঠোয় থাকা দিয়াশলাই দিয়ে একেকটা বান্ডেলে আগুন ধরিয়ে বলল, “এগুলো তো পাপের টাকা। পাপের টাকার অংক যদি লাখ ছাড়িয়ে কোটিতেও পৌঁছায়, আমি আমার ভালোবাসাকে বিক্রি করব না। তাছাড়া ভালোবাসা কোনো বিক্রিত পণ্য নয় যে, তাকে কাগজের কিছু সস্তা নোটের কাছে বিক্রি করে দেব। আপনি হয়তো জানেন না, আপনার ছেলে ও আমি, মনের বিনিময়ে আমরা একে-অন্যের মন কিনেছি, তাই টাকার কাছে মনের লেনদেন ও দামী অনুভূতিটাকে তুচ্ছ করে দিতে পারছি না। পারবও না। একবার এসেছেন, সম্মানের সাথে বলছি। এক্ষুণি বেরিয়ে যান। দ্বিতীয়বার যদি এই বাড়িতে আপনার ওই অচ্যুত শরীর দেখেছি, এই টাকার মতোই আপনার গায়েও আগুন ধরিয়ে দেব। দরজা খোলা আছে। যান… বেরিয়ে যান।”
***
চলবে।