#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩১
নওমী একদম ঘরবন্দী এখন। বাপির হুকুম ও প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে পা ফেলার অনুমতি নেই। এ্যাক্সামের প্যারা নেই বলেই, সারাটাক্ষণ একই জায়গায়, বন্দীপাখির মতো থাকতে হচ্ছে তাকে। একদিকে নিরাপদ থাকলেও অন্যদিক থেকে মনের মধ্যে কেবলই তার অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। ক’দিন ধরে আদিয়ানের সাথে দেখা হচ্ছে না। কথা যতটুকু হচ্ছে, সেটুকুও মেপে মেপে হয়। যখন সে নির্ঘুম রাত কাটায়, তখনই চ্যাটের মাধ্যমে অল্পক্ষণের জন্য কথা হয়। বাপির এই আদেশ-নিষেধ ও কড়া শাসনের কথা আদিয়ানকে বলার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই হয়নি। যতক্ষণ কথা হয়, ততক্ষণই একটু শান্তি পায় নওমী। মনের ভেতরের কষ্টকে চেপে রেখে হাসিমুখে আলাপ চালিয়ে যায়।
সারাদিন ধরে ঘরে থেকে বোর হচ্ছিল নওমী। বিকেলের দিকে নানুর ফোন পেয়ে ঝটপট তৈরী হলো। বাইরে বের হওয়ার জন্য হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে তার। এইটুকু তার বাপি বুঝবেন না। অথচ তিনি জেনে-বুঝে মেয়েকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়ার বাহানায় একেবারে ঘরবন্দী করে ফেলেছেন। আটকে দিয়েছেন আদিয়ানের সাথে দেখার করার সব সুযোগ ও ইচ্ছেকে।
মেয়েকে বাইরে বের হতে দেখে তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘অসময়ে কোথায় যাচ্ছ?’
নওমী চোখ গরম করে কাটকাট গলায় বলল,
‘নানু ফোন করেছেন। দেখতে যাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে যাও। আমি থানায় ফোন করে তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি।’
‘বাপি প্লিজ… আর না। তোমার এই টর্চার আমার সহ্য হচ্ছে না। পাগল পাগল লাগছে। কতদিন আমি ঠিকমতো নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারছি না, জানো? এভাবে একঘরে থাকতে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। তুমি আমাকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে মেন্টালি টর্চার করছ। আর এটা তুমি জেনে-বুঝে করছ। কী ভেবেছ? এসব করলে অনুভূতিকে গলাটিপে হত্যা করে ফেলব? ভুলে যাব আদিকে? ভুল ভেবেছ তুমি।’
‘এসব ছাড়া আর কিছু বুঝো না? সাইমুম দেশে আসছে, জানো তো? না কি ভুলে বসে আছো?’
নওমী তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বলল,
‘ও তো আরেকটা গাধা। ওর দেশে আসা না আসা নিয়ে আমার এত জ্ঞান রেখে কাজ কী? আমি কি ওর গলায় ঝুলছি?’
‘তুমি দিনদিন তর্ক করা শিখে যাচ্ছ, নওমী। রাস্তার একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে তুমি ভুলে যাচ্ছ, তোমার অবস্থানটা ঠিক কোথায়!’
দু’পা হেঁটে বাপির সামনে এলো নওমী। বলল,
‘হ্যাঁ, দু’জনের অবস্থান আলাদা। জানি। জেনে-বুঝেই তাকে ভালোবেসেছি। তবে সত্য কি জানো বাপি? এতসব অর্থ ও দালানকোঠা সাড়ে তিন হাত মাটির কাছে একদম তুচ্ছ। ওই মাটিতেই কিন্তু উঁচুনিচু সব ধরনের মানুষের চিরস্থায়ী ঘর হবে। যে ঘরে ধনী-গরিবের ভেদাভেদটা একদমই নেই। আই থিংক, এই সত্য-সুন্দর সমাপ্তি তুমি এখনও উপলব্ধি করোনি। তোমার ধারণা, মৃত্যুর পরও তুমি এই দালানকোঠায় থাকবে।’
নওমী যে চোখে আঙুল দিয়ে এই কঠিন সত্যির সামনে দাঁড় করাবে, সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি তোফাজ্জল হোসেন। তিনি সবসময়ই দুনিয়াবি সুখ-শান্তি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে এসেছেন। এবং এই দুনিয়ার সুখটাতে আপাদমস্তক ডুবে থাকতে ধন, সম্পদের পাহাড় জমিয়েছেন। আদতে এসবের দরকার আছে? বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের পর অধিক মাত্রার এই সম্পদ তাহলে কেন? ভেবে-ভেবে তিনি নিজেকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করালেও মেয়েকে কিছুই বললেন না। শুধু গম্ভীরমুখে আদেশ করলেন,
‘তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’
‘যদি না ফিরি?’
‘কী বলতে চাও তুমি?’
‘বলতে চাই এটাই যে, পথিমধ্যে আমার মৃত্যুও তো হতে পারে। তাই জানতে চাইলাম, না ফিরলে কী করবে? হায়াত ফুরিয়ে গেলে তোমার এই সম্পদ দিয়ে তুমি কি আমাকে বাঁচিয়ে আনতে পারবে?’
‘আমি এসব যুক্তি শুনতে চাইছি না। যেখানে যাচ্ছ, তাড়াতাড়ি ফিরো। এটাই আমার শেষ কথা।’
উত্তর না দিয়েই ড্রয়িংরুম থেকে কিটিকে কোলে তুলে রাস্তায় এসে, গাড়ি রিজার্ভ করে নানুবাড়ির দিকে রওনা দিল নওমী। সেখানে পৌঁছে সোজা নানুর রুমে ঢুকে বৃদ্ধার পাশে চুপটি করে পড়ে থাকল। কারও সাথেই কোনো কথা বলল না। নওমীর বড়ো মামী রুমের ভেতরে এসে তাকে ওইভাবে মুখ ফুলিয়ে একপাশে পড়ে থাকতে দেখে বললেন,
‘একী নিমু, কী হয়েছে? মন খারাপ কেন? তোর মামা ডাকছেন তো, মা। একটু উঠে আয়।’
নওমী চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে, কিটিকে কোলে নিয়ে মশিউর রহমানের সামনে এসে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল। তিনি তাকে পাশে বসিয়ে বললেন,
‘কী হয়েছে? তোমার মামী বলছেন, একেবারেই না কি ঘরবন্দী হয়ে আছো?’
নতমুখে নওমী বলল,
‘বাপির ইচ্ছে তাই।’
‘হঠাৎ করেই?’
‘কারা যেন আমাকে খুঁজছে মারার জন্য, সেটা তো জানোই। তারমধ্যে বাপি আমার বিয়ের দিন-তারিখ পাকা করে ফেলেছে।’
‘হ্যাঁ শুনেছি। ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এতে এত মন খারাপের কী আছে?’
নওমী একপলক বড়ো মামীর দিকে তাকাল। তিনি আশ্বস্ত করলে সাহস নিয়ে বলল,
‘আমি একজনকে পছন্দ করি, বড়ো মামা।’
মশিউর রহমান বিস্মিত স্বরে বললেন,
‘তাই না কি? কাকে?’
‘আদিয়ান ফারুকী। রিংকি-পিংকির ম্যাথ টিচার।’
‘বাপিকে জানিয়েছ?’
‘হুঁ… কিন্তু বাপি মানতে নারাজ।’
‘কেন?’
‘মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বলে।’
‘তোমার বাপি আবারও ভুল করতে যাচ্ছে। একভুলে আমার বোনের জীবন নরক হয়েছে, আরেক ভুলে তোমার।’
নওমী এই নরকের অর্থ জানে না। জানার আগ্রহ নেই। মনের মধ্যে ভয় থাকায় বলল,
‘আমি কী করব, বড়ো মামা? ডক্টর সাইমুমকে বলেছিলাম, এই বিয়েটা করা সম্ভব নয়। তিনি তো আমার কথা পাত্তাই দিলেন না।’
‘চিন্তা করো না।’
ভাগনীকে আশ্বস্ত করে মশিউর রহমান দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন,
‘আদিয়ান আসবে না আজকে?’
ভদ্রমহিলা উপরনিচ মাথা নেড়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, আজই শেষ ক্লাস নিবে। একটু পর আসবে হয়তো। গতদিন বলেছিল, আগামী সপ্তাহে নতুন জবে জয়েন করবে।’
‘তুমি ওকে বলো, যাওয়ার আগে যেন আমার সাথে দেখা করে।’
এরপর নিমুকে বললেন,
‘যাও…। আম্মার পাশে বসে গল্প করব।’
***
আদিয়ান বাড়ির সামনের গেটে আসতেই সেদিনের মতো আজও কিটি তার সামনে পড়ে গেল। যদিও আজ আর খামচি দেয়নি, শুধু দরজার সামনে ঘুরঘুর করছিল। আদিয়ান ঝটপট দু’হাতের সাহায্যে কিটিকে কোলে নিয়ে বলল,
‘কী রে আজ আবার খামচি দিতে এলি, না কি ওয়েলকাম করতে? কোনটা?’
কিটি শুধু মুখ ঘষে ‘ম্যাঁও’ শব্দটা উচ্চারণ করতে। আদিয়ান তার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘তুই একা এসেছিস? রাজকন্যাকে সাথে আনিসনি?’
আবারও ‘ম্যাঁও, ম্যাঁও’ শব্দ করল কিটি। আদিয়ান বলল,
‘তুই এই ম্যাঁও-ম্যাঁও ছাড়া আর কিছু পারিস না? দাঁড়া, রাজকন্যার সাথে দেখা হোক। বলে দেব তোকে যেন স্কুলে ভর্তি করে। শিক্ষাদীক্ষা ছাড়া কিছু হয় বল? ভালো একটা চাকরিও তো পাবি না। আমার মতো এদিক-ওদিক ঘুরেই দিন যাবে শেষে।’
বকবক করতে করতে কিটিকে নিয়ে রিংকি-পিংকির সামনে এলো আদিয়ান। দুটোই বই মেলে রেখে গল্প জমিয়েছে। সে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
‘কী করছ তোমরা? এখনও শুরু করোনি?’
সোজা হয়ে বসে সালাম দিয়ে আদিয়ানের কোলে কিটিকে দেখে অবাক হলো দু’জনে। রিংকি ঝটপট বলল,
‘আজও কি আপনাকে খামচি দিয়েছে, স্যার?’
আদিয়ান হেসে বলল,
‘আরেহ্ না। ভদ্রতা শিখে গেছে। তাই ওয়েলকাম জানিয়েছে। তোমরা শুরু করো। হোমওয়ার্ক বের করো আগে।’
অংকের খাতা বের করে দিয়ে অনুরোধের সুরে পিংকি বলল,
‘স্যার, আপনি থেকে যান না। এক্ষুণি টিউশনি ছাড়ার কী দরকার?’
‘দরকার নাহলেও ছাড়তে হবে, পিংকি।’
বেকারত্ব কত বড়ো সমস্যা, সেটা রিংকি-পিংকি এখনও বুঝেনি। তা-ই এই বিষয়টা তাদেরকে বুঝাতেও গেল না আদিয়ান। পড়াশোনার দিকেই সম্পূর্ণ মনোযোগ ঢেলে দিল।
দশ থেকে পনেরো মিনিট পর কিটিকে খুঁজতে বের হলো নওমী। সারাবাড়ি খুঁজে না পেয়ে, রান্নাঘরে গেলে তার মামী চায়ের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘স্যারের চা’টা নিয়ে যা, নিমু। আর আদিয়ানকে বলিস, যাওয়ার আগে যেন তোর মামার সাথে দেখা করে যায়।’
ট্রে হাতে নিয়ে নওমী বলল,
‘কিটিকে দেখেছ?’
‘আদিয়ানের কাছে আছে।’
‘কী বলো?’
বড়ো মামী শুধু হাসলেন। নওমী এই হাসির রহস্য উদ্ধার করতে পারল না। তবে ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। চা নিয়ে রুমে এসে দেখল, কিটি আদিয়ানের পায়ে মুখ ঘষছে। হুট করে এই আহ্লাদ দেখানোর কারণ খুঁজে না পেয়ে বলল,
‘এ্যাই বেয়াদব, তোকে আমি সারাবাড়ি খুঁজে মরছি। তুই এখানে কী করছিস রে?’
কিটি জবাব দিল না। মুখ ঘষা চালিয়ে গেল। নওমী চায়ের ট্রে টেবিলের ওপর রেখে রিংকি-পিংকিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘তোরা একটু নানুর রুমে যা।’
রিংকি বলল,
‘কেন?’
‘যেতে বলেছি, যাবি। প্রশ্ন করবি না। আমি ডাকার পর আসবি।’
‘আজকেই শেষ ক্লাস, নওমীপু। বিরক্ত না করলে হয় না?’
‘আমি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি আর তুই বলছিস বিরক্ত। তবেরে শয়তান…।’
নওমীর যে মন-মেজাজ ভালো নেই সেটা দুইবোন ভালোমতোই জানে। কিন্তু কেন ভালো নেই, সেটা কেউ-ই জানে না। ধমক খেয়ে কেউ আর দাঁড়িয়ে থাকল না। হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল। ওরা চলে গেলে আদিয়ান বলল,
‘ওদের ওপর মেজাজ দেখানোর কী দরকার ছিল?’
প্রশ্ন করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই ঝড়েরবেগে নওমী তার বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আদিয়ান হতচকিত ভাব নিয়ে, নওমীর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
‘সব ঠিক আছে না?’
‘কিচ্ছু ঠিক নেই।’
‘কেন?’
‘সময় ফুরিয়ে আসছে। এদিকে আমি ঘরবন্দী। কোনো উপায় জানা নেই আমার। আমরা পালিয়ে যেতে পারি না?’
আদিয়ানের বুকের ভেতরটায়ও কম্পন সৃষ্টি হলো। অনেক দৌড়ঝাঁপের পর চাকরির খোঁজ পেয়েছে। এখনও জয়েনই করতে পারেনি। এরমধ্যে হাতেগোনা দিন যেন হাওয়ার বেগে উড়ে পালাচ্ছে। এতদ্রুত দিন-মাস ফুরিয়ে যায় কেন, বুঝল না। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠল। বলল,
‘পালানোই কোনো সমাধান নয়, সুইটি। চাইলেই হয়তো হাত ধরে রাস্তায় নেমে পড়া যায়। কিন্তু রাস্তায় নামার পর টের পাবেন, ওই রাস্তায় পা ফেলে জীবনের বাকি দিনগুলো এগিয়ে নেয়া কতটা কঠিন।’
‘তাহলে? আর কীভাবে আটকাব?’
‘আর কিছুদিন ধৈর্য্য ধরুন। চাকরিতে জয়েনের পর আমি আম্মিকে পাঠাব।’
‘ততদিনে অনেক দেরী হয়ে যাবে, আদি। বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে।
আলগোছে নওমীর মুখটা তুলে আঙুলের সাহায্যে চোখের পানি মুছে দিল আদিয়ান। বলল,
‘আসুক। আমার প্রাণ থাকতে আমি এত সহজে আপনার বিয়ে হতে দিব না। এটা মাথায় রাখুন আর নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করুন।’
নওমী ফোলাফোলা মুখে বলল,
‘কী করবেন আপনি?’
‘সেটা সময় বলবে। এখন যান। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।’
‘সবাই জানে।’
চোখদুটো গোলগোল করে আদিয়ান বলল,
‘কী জানে?’
‘আমাদের মনের কথা।’
‘মানে কী? কীভাবে?’
‘আমি বলেছি। বড়ো মামা বলেছেন, যাওয়ার আগে তাঁর সাথে দেখা করে যেতে।’
‘আমি?’
‘জি, আপনি। কেন, ভয় পাচ্ছেন?’
আদিয়ান মুচকি হেসে নওমীর নাকের ডগা চেপে ধরে, টুপ করে একটা চুমু খেল কপালে। বলল,
‘ভয়কে জয় করে নেব শীঘ্রই। শুধু আপনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকুন। এখন যান, আমার ছাত্রীদের পাঠান। দুই বিচ্চু কী ভাবছে, কে জানে!’
নওমী খিলখিলিয়ে হেসে উঠে কিটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘চা শেষ করুন। আমি ওদের পাঠাচ্ছি।’
***
মশিউর রহমানের মুখোমুখি বসে আছে আদিয়ান। নওমী আশেপাশেও নেই। ভয়ে তার কলিজা কাঁপছে। বাবা যেভাবে রাগারাগি করেছেন, সেরকম কিছু হলে সে এখুনি হার্টঅ্যাটাক করবে এমনই একটা অনুভূতি হচ্ছে শুধু। এজন্য নানুর পাশে বসে দোয়াদরুদ জপছে।
অনেকক্ষণ যাবৎ আদিয়ানকে বসিয়ে রেখে, খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখলেন মশিউর রহমান। নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে আদিয়ান সম্পর্কে অনেক তথ্যই সংগ্রহ করেছেন। তিনি সরাসরি কথা বলা মানুষ, অযথা ত্যানাপ্যাঁচানো পছন্দ নয়। তা-ই খুব ধীর অথচ শান্ত স্বরে বললেন,
‘নওমী যে এই শহরে নিরাপদ নয়, সেটা কি তুমি জানো না?’
আদিয়ান স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘জানি আংকেল।’
‘ওর আইইএলটিএস কমপ্লিট সেটাও তো জানো।’
‘জি…।’
‘ওর চাচ্চু, জাহাঙ্গীর সম্পর্কে শুনেছ?’
‘ইনস্পেকটর জাদীদকে হয়তো আপনি চিনেন। ওর মাধ্যমেই জেনেছিলাম, জাহাঙ্গীর নামের কেউ একজন নওমীকে মারতে চাইছে।’
‘কেন মারতে চাইছে জানো না?’
‘জাদীদ বলেছিল, রাতের অন্ধকারে জাহাঙ্গীর না কি নিজের বাবাকে খুন করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।’
মশিউর রহমান উপরনিচ মাথা নেড়ে বললেন,
‘জাহাঙ্গীর ও তোফাজ্জল দু’জনে আপন ভাই নয়। সৎ ভাই। আর যে দুর্ঘটনা রাতে ঘটেছে, সেই ঘটনার ভয়াবহতা কতখানি সেটা শুধু আমার বোন জানে।’
আদিয়ান চমকে গিয়ে, নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল ভদ্রলোকের দিকে। তিনি অসহায় চোখে আদিয়ানকে দেখে, নিজের বোনকে ডাক পাঠালেন। ভাইয়ের গলার আওয়াজ শোনে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন নুজাইফা আমীন। একটু আগেই এসেছেন, মেয়েকে নিতে। তিনি সামনে এসে দাঁড়ালে মশিউর রহমান বললেন,
‘তোফাজ্জল আইনকে সব সত্য জানায়নি। জানালে ও নিজে ফেঁসে যাবে।’
‘বুঝলাম না, আংকেল। উনি কেন ফেঁসে যাবেন?’
‘কারণ ওইদিন রাতের খুনটা জাহাঙ্গীর নয়, নওমীর বাপি করেছে।’
আদিয়ানের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। মুখে হাত চেপে বলল,
‘কী বলছেন, আংকেল? জাদীদ তো বলল…।’
‘জাদীদ ভুল জানে। ওকে শুধু ঘুরানো হচ্ছে।’
‘কিন্তু কেন?’
‘আইনের ভয়, ফাঁসির ভয়, সবার মধ্যেই আছে। যে অপরাধ জাহাঙ্গীর করেনি, সেই অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল সে। এতগুলো বছর পর ফিরে এসেছে শুধু প্রতিশোধ নিতে। নওমী এসবের কিছুই জানে না। ও জানে, ওর বাপি নিষ্পাপ।’
মশিউর রহমান আস্তে-ধীরে পিছনের গল্পটা বলে গেলেন। সৎ ভাই হলেও বাবা-মাকে নিয়ে দু’জনেই বেশ সুখে-শান্তিতে ছিল। তাদের পরিবারে কোনো দাঙ্গাহাঙ্গামা ছিল না। কিন্তু হঠাৎই একদিন, নওমীর বাপি ভুলের পথে পা দেন। দু’হাতে টাকা খরচ করতে গিয়ে দিনরাত নেশায় ডুবে থাকতে শুরু করলেন। মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতেন। নুজাইফা আমীন প্রতিবাদ করতে চাইলে তাকে মারধর করতেন। জাহাঙ্গীর হোসেন বাধা দিতে গেলে ভাইয়ের গায়ে হাত তুলতেন। কারও কোনো কথাই শুনতেন না। এক রাতে টালমাটাল অবস্থায় শয্যাসঙ্গী নিয়ে বাড়ি ফিরেন তিনি। এই নিয়ে দুই ভাইয়ে মিলে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তর্কাতর্কি, কথা কাটাকাটি। একসময় ভাইয়ে-ভাইয়ে হাতাহাতি, মারামারি শুরু হয়। নওমী তখন অনেক ছোটো। আর নুজাইফা আমীন স্বামী সংসারে সবে মানিয়ে নেয়া শুরু করেছেন। এমন দুর্ঘটনা ঘটবে কেউ-ই ভাবতে পারেনি। ওদের মারামারি থামিয়েছিলেন, নওমীর দাদা। বয়স হলেও শরীরে যথেষ্ট জোর ছিল তাঁর। ছেলেদের এই দাঙ্গাহাঙ্গামা তার ভালো লাগত না। তাই বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তোফাজ্জল হোসেনকে সম্পত্তির একটা অংশ লিখে দিয়ে বাড়িছাড়া করেন। আর জাহাঙ্গীরকে নিজের কাছে রাখেন। কিন্তু এতে তোফাজ্জল হোসেনের মন ভরেনি। সময়ের ব্যবধানে নিজের ভাগের সম্পত্তিও তিনি খুইয়ে ফেলেছিলেন। এরপর বাবার কাছে হাত পাতলে নওমীর দাদা তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন। এতে আরও রাগে-আক্রোশে ক্ষ্যাপে যান ভদ্রলোক। সবার অলক্ষ্যে রাতের অন্ধকারে, মুখোশ পরে দেয়াল টপকে নিজেদের বাড়িতে এসে, লুকিয়ে থাকেন বাবা-মায়ের রুমে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘুমন্ত অবস্থায় নিজের সৎ মা ও বাবাকে একসাথে বালিশচাপা দিয়ে মেরে রেখে, আলমারির ভেতরে থাকা যাবতীয় গয়নাগাটি ও টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যান। পরদিন পুলিশ এলে পুলিশের লোকজন জাহাঙ্গীরকেই সন্দেহ করে। যেহেতু বাড়িতে সে একা। অপরাধী সে-ই। জাহাঙ্গীর প্রমাণ দিতে চাইলেও হয়ে উঠে না। কীভাবে যেন তোফাজ্জল হোসেন সবার চোখকে ধুলো দিয়ে জাহাঙ্গীরকেই ফাঁসিয়ে দেন। এদিকে জাহাঙ্গীর দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সবে। বিদেশ গিয়ে কিছু একটা করবে, এই ছিল তার উদ্দেশ্য। পুলিশ এসব জেনে তাকেই আসামির দলে টেনে নেয়। ভেবে নেয়, খুন করে পালিয়ে যাওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। জাহাঙ্গীর চালাকি করে নিজেকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অসম্ভব হয়ে পড়লে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে একভোরে দেশ ত্যাগ করে। সেই সুযোগে তোফাজ্জল হোসেন বাড়িতে আসেন। সবকিছু দখল করে বসে জাহাঙ্গীরের নামে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপান। মাস খানেক পর অজ্ঞাত এক মৃতদেহকে জাহাঙ্গীরের নামে চালিয়ে দিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন। সবাই তখন বিশ্বাস করে নেয়, জাহাঙ্গীর হোসেন বলতে আর কেউ নেই। কিচ্ছু নেই।
আদিয়ানের মুখের কথা হারিয়ে গেল। কতক্ষণ নিশ্চুপে বসে রইল সে। এরপর নুজাইফা আমীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি কেন চুপ ছিলেন, আন্টি?’
নুজাইফা আমীন বললেন,
‘নিমুর জন্য। ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে চুপ থাকতে হয়েছে আমাকে। চাইলেই হয়তো ওই সংসার ত্যাগ করতে পারতাম, এতে মুক্তি নিশ্চিত হলেও মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যেত। ও তো তখন বাবা ছাড়া কিছুই বুঝত না। একদিন চোখের আড়াল হলেই অসুস্থ হয়ে পড়ত। এদিকে নিমুর বাপির হুকুম, সত্য সবার সামনে এলে তিনি সব ধ্বংস করে দিবেন। নিজের পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে এতগুলো বছর পাপের সাম্রাজ্যে দিন কাটিয়েছি। বাবার কলঙ্ক যেন মেয়েকে না ছোঁয়, সেজন্য পিছনের জঘন্য অধ্যায়কে মুছে দিয়ে নতুনভাবে সব শুরু করেছি।’
অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন মশিউর রহমান। বললেন,
‘তুমি তোমার মাকে ফোন করতে পারবে?’
আদিয়ান জানতে চাইল,
‘এখুনি?’
‘হ্যাঁ, উনি তোমার লিগ্যাল গার্ডিয়ান?’
‘আম্মিই আমার সব।’
‘আর কে কে আছে?’
‘মামা ও চাচ্চু আছেন। চাচাতো ভাই-বোনেরা আছে।’
‘তোমার আম্মিকে ফোনটা ধরিয়ে দাও।’
আদিয়ান ফোন ধরিয়ে দিয়ে চিন্তিতমনে বসে রইল। মশিউর রহমান খুবই অমায়িকতার সাথে আলেয়া বেগমের সাথে কথা বললেন। আগামীকাল এখানে আসার দাওয়াত দিয়ে ফোনটা আদিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
‘চাকরি ছোটো হোক বা বড়ো কোনো অসুবিধা নেই। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সৎ ও ন্যায়ের পথে থেকো, সুখী হবে।’
***
চলবে…
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩২
পরদিন বিকেলে আলেয়া বেগম ও রাশেদুজ্জামান নওমীর মামার কথা অনুযায়ী শহরে এলেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত করতে ও নিজেদের সম্মান বজায় রেখে যতটুকু পারা যায় ততটুকু মিষ্টান্ন নিয়ে এলেন। মা ও মামার সাথে আসতে হলো আদিয়ানকেও। সাথে আবার মাজেদা খাতুন ও জাদীদও এসেছে। অতিথি আপ্যায়ন শেষে নওমীর মামা মশিউর রহমান বললেন,
‘আপনাদের দাওয়াত দিয়ে আনার উদ্দেশ্য আমার একটাই, দুই উপযুক্ত ছেলেমেয়েকে এক করে দেয়া। আপনারা যদি আমার সিদ্ধান্তকে যথোপযুক্ত মনে করেন, তাহলে আমি আজকেই কাজী ডেকে ওদের চারহাত এক করে দিতে চাই।’
নওমীকে ছেলের বউ করে নিতে আলেয়া বেগমের এখন আর কোনো আপত্তি নেই। তবুও তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করলেন আর নিজের মনের অবস্থা বুঝাতে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। রাশেদুজ্জামান বোনকে আশ্বস্ত করে মশিউর রহমানকে বললেন,
‘আপনার বোন ও বোন জামাই কি এসেছেন?’
মশিউর রহমান তড়িৎ বোন, ছোটো ভাই ও বাড়ির দুই কর্ত্রীকে ডাক দিলেন। সবাই এসে উপস্থিত হলে তিনি বললেন,
‘এখানে অনুপস্থিত কেবল নওমীর বাপি, তোফাজ্জল হোসেন।’
‘মেয়ের বাবা এখানে নেই কেন?’ প্রশ্ন করলেন রাশেদুজ্জামান।
মশিউর রহমান বললেন,
‘এইমুহূর্তে মেয়ের বাবার এখানে উপস্থিত থাকাটা ঝামেলার। তবে আমি ডাকলে সে আসবেই। মন থেকে অনুমতি দিবে না তবে লজ্জা থেকে বাঁচতে এই বিয়েতে সম্মতি দিবে।’
‘এটা কেমন করে হয় ভাইজান? গার্ডিয়ানের অনুমতি ছাড়া?’
‘আপনারা শুধু অনুমতি দিন। গার্ডিয়ানের অনুমতি নেয়ার সকল দায়িত্ব আমি নেব।’
‘উনি কি স্বশরীরে উপস্থিত থাকবেন?’
‘সেটা সময় বলবে।’
আলেয়া বেগম আদিয়ানের মনোভাব বুঝতে না পেরে আস্তেধীরে বললেন,
‘কী করব, আদি?’
‘আমি কী বলব, আম্মি? তোমার যা ভালো মনে হয় তুমি সেটাই কোরো।’
নওমী এখানে ছিল না। কাজিনদের নিয়ে নিজের নানুর পাশে বসে দুরুদুরু বুকের কাঁপন সামাল দিচ্ছিল। তাই তাকে আশেপাশে না দেখে আলেয়া বেগম হবু বেয়াইন নুজাইফা আমীনকে বললেন,
‘বেয়াইন, আমি আপনার মেয়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই।’
নুজাইফা আমীন বললেন,
‘আপনি বসুন, আমি নিমুকে ডাকছি।’
‘ডাকতে হবে না। সে কোথায় আছে, আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন। এখানে সব পুরুষের সামনে তাকে লজ্জায় ফেলা উচিত হবে না।’
‘ঠিক আছে। আসুন আমার সাথে।’
নুজাইফা আমীন হবু বেয়াইনকে নিয়ে নিজের মায়ের রুমে গেলেন। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর আলেয়া বেগম নিজ আগ্রহেই নওমীকে পাশে বসিয়ে টুকটুক করে গল্প শুরু করলেন। সাথে নিজের বউমার জন্য নতুনভাবে কিনে আনা জুয়েলারি বুঝিয়ে দিয়ে, পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে এটা-সেটা জানতে চাইলেন।
মশিউর রহমান সবাইকে বসিয়ে রেখে কয়েক মিনিটের জন্য একটু রুমে গিয়ে নওমীর বাপিকে ফোন করলেন। কথা শেষ করে পরিচিত কাজীকেও ফোন করলেন। হুলস্থুলকাণ্ড হতে যাচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে আদিয়ান মুরব্বিদের অনুমতি নিতে নওমীর মামাকে বলল,
‘মামা, আমি একঘণ্টার জন্য বাইরে যেতে চাইছি। কিছু জরুরী জিনিস ফেলে এসেছি।’
মশিউর রহমান বললেন,
‘ঠিক আছে। তুমি যাও। সন্ধ্যার পরপরই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।’
তোফাজ্জল হোসেন রাজি আছেন কি নেই, এইমুহূর্তে এসব কিছুই ভাবতে গেল না আদিয়ান। সে একছুটে বাসায় গেল। সেদিনের কেনা সেই শাড়ি নিয়ে, ফেরার পথে শপিংমলে ঢুকল। দামী বেনারসি কেনার সাধ্য নেই, তবে সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব কেনাকাটা করল। মেহেদী কিনতেও বাদ রাখল না। কিছু ব্যাগ নিজের ফ্লাটে রাখতে আবারও উলটো ঘুরল।
কেনাকাটা শেষে ফিরে এসে, সেসব মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, সবার অলক্ষ্যে নওমীর নম্বরে একটা ম্যাসেজ পাঠাল। এর একটু পরই কাজী এলো। উপস্থিত সবাইকে রেখে সাধ্য অনুযায়ী দেনমোহর লিখে কাবিননামা প্রস্তুত করে নওমীর বাবার অপেক্ষায় বসে রইলেন সবাই। আদিয়ানের টেনশন বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত এই লোকটা আসবে তো? জাদীদও ঘড়ি দেখতে দেখতে জানতে চাইল,
‘উনি এখনও আসছেন না কেন, মামা?’
মশিউর রহমান সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন,
‘চিন্তার কিছু নেই। চলে আসবে। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগছে হয়তো।’
আরও দশ থেকে পনেরো মিনিট পর তোফাজ্জল হোসেন গম্ভীরমুখ নিয়ে উপস্থিত হলেন সবার সামনে। বোনের কাছে কীভাবে মুখ দেখবেন, সাইমুমকে কী বলবেন আর মেয়ের কাছে আর কতদিন ঠিক কীভাবে সত্যিটা লুকিয়ে রাখবেন, এইসব ভাবতে ভাবতেই সময় কাটিয়েছেন তিনি। সবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান বাঁচিয়ে রেখে মেয়ে যদি পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে সুখী হতে চায়, হোক। তিনি আর আপত্তি করবেন না। শেষে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসবে। এতগুলো মানুষের সামনে নিজের এতদিনের সম্মানকে ধূলিসাৎ হতে দিবেন না বলেই এসেছেন। ড্রয়িংরুমে পা ফেলে সবাইকে একনজর দেখে নিজ দায়িত্বে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন। এরপর আদিয়ানের দিকে তাকালে, আদিয়ান নিজেই ভদ্রতাস্বরূপ সালাম দিল আগে। তিনি সালামের জবাব নিয়ে মশিউর রহমানকে বললেন,
‘বিয়ের কাজ শুরু করতে পারেন, ভাইজান।’
নুজাইফা আমীন মুখ লুকিয়ে হাসলেও কারও সামনে কিছু বলতে পারলেন না। কাজী কনের এ্যাজিন নিতে প্রস্তুত হলে, নওমীর বড়ো মামী রাবেয়া খানম, রুমে এসে আগে নওমীর প্রস্তুতি দেখলেন। বিয়ের দিন কনেরা বেনারসি পরে কিন্তু নওমী পরেছে কালো ও সাদা রঙের সেই শাড়ি, যেটা নিয়ে দোকানে একদিন দু’জনের মধ্যে প্রচুর ঝামেলা হয়েছিল। আজ শপিং করে ফিরে যখন সবগুলো আলেয়া বেগমের মাধ্যমে এখানে এলো, তখনই আদিয়ানের নম্বর থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছিল – “ব্যাগে একটা স্পেশাল শাড়ি আছে, যেটা আমার হবু বউয়ের জন্য কিনেছিলাম। আপনার যদি মনে হয়, বেনারসীর বদলে এই শাড়িটা পরা উচিত, সাথে ম্যাচিং করা কিছু জুয়েলারি পরে বধূ সাজা উচিত, তাহলেই এই শাড়িটা পরবেন। আমি আমার বউকে অন্যসব বউদের মতো বেনারসীতে নয়, তার পছন্দের রঙের রূপে ও সাজে দেখতে চাই। আর মেহেদী পরার প্রয়োজন নেই। ওটা আমি-ই আপনাকে পরিয়ে দিব।”
ম্যাসেজ দেখে ঝটপট ব্যাগপত্র খুলে একেবারে চমকে গিয়েছিল নওমী। সেদিনের সেই শাড়ি দেখে পিছনের কতকিছু মনে পড়ে গেল তার। দেরী না করে সেই শাড়িই গায়ে জড়াল। একটা স্কার্ফ মাথায় আটকে, খুব সাদামাটা সাজে বউ সেজে বসে রইল। মুখে হালকা মেকাপ করে দিয়েছেন তার ছোটো মামী। তখন থেকেই তিনি তার পাশে বসেছিলেন। এখন কাজী এলে কনের স্বীকারোক্তি শেষে, বরের স্বীকারোক্তি নিয়ে আকদের কাজ কমপ্লিট করে, সাক্ষীদের সাক্ষরও নিয়ে নিলেন। তোফাজ্জল হোসেন পুরোটা সময় মুখ ফুলিয়ে রাখলেও বাকীরা সবাই ভীষণ খুশি ও আমোদে ছিল। বিশেষ করে জাদীদ। সে তো পারলে কবজী ডুবিয়ে খায়। এমন আচানক বিয়ের সাক্ষী হতে পেরে সে ভীষণ খুশিই।
বিয়ের আয়োজন শেষে, রাতের মধ্যেই কনে বিদায়ের সিদ্ধান্ত নিলেন মশিউর রহমান। এজন্য নওমীর বাবাকে আলাদা রুমে বসিয়ে এসব নিয়েই আলোচনা করছিলেন। শোনে খানিকটা রাগ হলো তোফাজ্জল হোসেনের। ক্ষ্যাপেটেপে অস্থির হয়ে বললেন,
‘জোর করে সম্মতি নিয়ে বিয়ে দিয়েছেন, এখন আবার এক কাপড়ে মেয়েকে বিদায় দিতে চাইছেন? এসব আপনি কী শুরু করলেন? আমার মতের কী কোনো দাম নেই? বারেবারে শুধু এক হুমকিধামকি! আমি কি আপনার হুমকিধামকি ভয় পাই?’
মশিউর রহমান শান্তস্বরে প্রশ্ন করলেন,
‘ভয় পাও না?’
তোফাজ্জল হোসেনের মুখে স্কচটেপ বসে গেল। তিনি আর টুঁশব্দটিও করলেন না। মশিউর রহমান বললেন,
‘আমি যা করছি, তোমার মেয়ের ভালোর জন্য করছি। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক মেয়েই সারাজীবন নিজেকে সুখী দাবী করে, আদতে তারা সুখী নয়। সুখী হওয়ার ভান করে থাকে শুধু। আমি জেনে-বুঝে আরেকটা নুজাইফা তৈরী হতে দিতে পারি না। তোমার এক ভুল, আমার বোনের গোটা জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। তা-ও সংসার ভাঙেনি শুধু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। আজ তুমি যেমন গরীব ও ছোটোলোক ভেবে আদিয়ানকে গালি দাও, তেমনই তোমার মেয়েকেও এই সমাজের দশজন খুনির সন্তান বলত। এটা কি নওমীর জন্য ভালো হতো? তুমি নিজেই মেয়েকে ওই অবস্থানে দেখতে পারতে?’
‘এসব কথা রাখুন তো। অসহ্য লাগছে আমার। এমনিতেই আমি বোনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আপনি এটা না করলেও পারতেন। সাইমুমকে কী বলব? ছেলেটা কিছুদিন পরই দেশে আসছে!’
‘ওনাদের যা বলার, আমি বলব। তোমাকে এত ভাবতে হবে না। এখন মেয়েকে বিদায় দেয়ার প্রস্তুতি নাও।’
***
অনাকাঙ্ক্ষিত এই আয়োজনে নওমীসহ অবাক হয়েছে রিংকি-পিংকি দু’জনেই। স্যারের সাথে বোনের বিয়ে, ভাবনাটাই দু’জনকে আপ্লূত করে দিয়েছে। তবে বিদায়ের আগে ছবি না উঠিয়ে ছাড়েনি। পুরোটা সময় অসহ্যরকম এক সুখে বুঁদ হয়েছিল নওমী। বিশ্বাসই হচ্ছিল না কিছু। সবকিছু এত দ্রুত ও চোখের পলকে হয়ে যাওয়াতে টেনশনে বুক ঢিপঢিপ করছে। মনের ভেতর বেদনার ছাপ নিয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবা-মা, মামা-মামী, মামাতো ভাই-বোনদের বিদায় নিয়ে ও যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, তখনই সামনের গেটে ফুলে ফুলে সাজানো একটা রিকশা দেখতে পেল। বিস্ময়ে চোখের পানি চোখেই আটকে গেল।
জাদীদ বলল,
‘আপনার জন্য স্পেশাল গাড়ি সাজিয়ে এনেছি। অবশ্য এটা আদির ইচ্ছে। আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?’
নওমী লাজুক হেসে দু’দিকে মাথা নাড়ল। নুজাইফা আমীন যত্নের সাথে মেয়ের হাতটা এবার আদিয়ানের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়েকে ভালো রেখো, বাবা।’
বড়োলোক বাবার মেয়েকে কতটা ভালো রাখতে পারবে, এই নিয়ে আদিয়ান চিন্তিত ভীষণ। তবে বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে সারাজীবন সমস্ত ঝড়ঝাপটা ও বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখতে পারবে, এ বিষয়ে নিজের কাছেই সে যথেষ্ট স্পষ্ট ও সৎ। তবুও একজন মায়ের মনের দুঃখ মোছাতে ভরসার সাথে বলল,
‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন আপনার মেয়ে আমার কাছে নিরাপদে ও সম্মানে থাকবে, ইনশা’আল্লাহ। আমি তার কোনো অযত্ন করব না।’
আদিয়ানের সৎ ও সাহসী স্বীকারোক্তি শোনে নুজাইফা আমীন দু’জনকে মন ভরে দোয়া করে, মেয়ের কপালে আদর দিয়ে ফুলে ফুলে সাজানো রিকশায় উঠিয়ে দিলেন। রিকশা এগোতে শুরু করলে, আলেয়া বেগম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ভাই, জাদীদ ও মাজেদা খাতুনকে সাথে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। পিছনে থেকে তোফাজ্জল হোসেন রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের গাড়ির ডোর খুলে গাড়িতে উঠে ঠাস করে ডোর লাগিয়ে গলা উঁচিয়ে বললেন,
‘ছোটোলোক সবসময় ছোটোলোকই থাকে। আমার সোনার টুকরো মেয়ের জন্য কি দামী গাড়ির অভাব ছিল? যৌতুক হিসেবে একটা গাড়ি চাইলেই তো দিয়ে দিতাম। অথচ ওই ছোটোলোক নিজের মর্জিমতো চলতে গিয়ে রিকশা সাজিয়ে আনল! ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আমার মান-ইজ্জত আর কিচ্ছু রইল না।’
নুজাইফা আমীন নিজেও ভাই-ভাবী ও মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘সবাইকে নিজের মতো দুই নম্বর ভেবো না। আর কিছু না হোক, মেয়ে এখন থেকে এমন একটা মানুষের ছায়ায় বাঁচবে, যার মধ্যে তোমার মতো হীন মানসিকতা নেই, নেই ধান্ধাবাজি ও নোংরামি। তোমার মতে যে ছেলেটা ছোটোলোক, সেই ছেলের আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, বিশুদ্ধ একটা মন আছে। আছে সৎ চিন্তাভাবনা। যারা ওই সৎ চিন্তাভাবনা দিয়ে ন্যায়ের পথে চলতে ভালোবাসে। অন্যায় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ভালোবাসে।’
তোফাজ্জল হোসেন শক্তকণ্ঠে বললেন,
‘জ্ঞান কম দাও। তোমাদের চালাকি আমি বের করব।’
‘কী করবে তুমি?’
উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলেন তোফাজ্জল হোসেন। এত সহজে তিনি আদিয়ানকে জিতে যেতে দিবেন? কখনওই না।
***
আলেয়া বেগম ও রাশেদুজ্জামানকে আদিয়ানের অ্যাপার্টমেন্টে নিরাপদে নামিয়ে দিয়ে মাকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল জাদীদ। নবদম্পতিকে ছেড়ে দিল তাদের মতো করে। ঠাণ্ডা বেড়েছে বেশ। কুয়াশার কারণে দশহাত দূরত্বও এখন আবছা। নওমী শাড়ির ওপর একটা চাদর জড়িয়েছে শুধু, ভারী সোয়েটার বা ওভারকোট গায়ে জড়াতে ইচ্ছে হয়নি বলে। শাড়ির সাথে এসব ভীষণই বেমানান লাগত। আর যেহেতু শাড়িই পরেনে, এসব পরে এই সাজ ও সৌন্দর্যের অপমান করতে পারল না। চাদরটা কাঁধের একপাশে ফেলে রেখেছে। ফুলহাতা ব্লাউজের কারণে শীত অনেকটাই কম অনুভব হচ্ছিল। কুয়াশাজড়ানো আঁধারের বুকছিঁড়ে ফুলে ফুলে সাজানো রিকশা উদ্দেশ্যহীন যাত্রায় নেমেছে। কোথায় থামবে কে জানে? কতক্ষণের ঠাণ্ডা ও এক জায়গায় বসে থাকাতে হাত-পা কেমন হীম হয়ে এলো নওমীর। সে নিজের একটা হাত দিয়ে অন্য এক হাত ম্যাসাজ করে, দু’হাতে গাল চেপে ধরে নিজেকে একটু উষ্ণ করার চেষ্টা করল।
নওমীর এই হাবভাব খেয়াল করে আদিয়ান বলল,
‘ঠাণ্ডা লাগছে?’
নীরবতার মধ্যে এটাই বোধহয় প্রথম কথা বলল কেউ। শোনে নওমী লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে বলল,
‘একটু একটু।’
পিছন থেকে চাদর টেনে এনে, দু’হাত সম্পূর্ণ ঢেকে রাখল নওমী। আদিয়ান পিছন দিয়ে নিজের একটা হাত ছড়িয়ে, একহাতে নবপরিণীতাকে আগলে নিয়ে বলল,
‘এখন?’
নওমী কিছুই বলল না। দুটো হাতে আদিয়ানকে প্যাঁচিয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। হিমশীতল হাতে বউয়ের গাল ছুঁয়ে কপালে আলতোস্পর্শে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদিয়ান বলল,
‘ফিরে যাবেন? আপনার বোধহয় বেশি ঠাণ্ডা লাগছে!’
নওমী ফিসফিসিয়ে বলল,
‘উঁহু, একটুও না।’
‘একটুও না?’
একইভাবে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল আদিয়ান। নওমী হেসে ফেলল। ওভাবে জড়িয়ে থেকেই বলল,
‘কোথায় যাচ্ছি?’
‘গন্তব্য জানা নেই। তবে পুরো শহর ঘুরব, যদি আপনার সমস্যা না হয় তো। এখনও রাত অর্ধেক হয়নি অথচ আপনার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। মোজা সাথে নিলেই পারতেন।’
‘আমার এসব ভালো লাগে না।’
‘ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে ভালো লাগে?’
‘কাঁপছি কই? আমি তো নিরাপদেই আছি।’
কথার ধরণে হেসে ফেলল আদিয়ান। আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে নিতেই নওমী জানতে চাইল,
‘ওইদিন এই শাড়িটা কার জন্য পছন্দ করেছিলেন?’
‘বউয়ের জন্য।’
‘মিথ্যে কথা। তখন বউ বলতে কেউ ছিল?’
‘না, ছিল না। তবে মনের মানুষ ছিল। তাকে বউ করার ভীষণ স্বাদ ছিল মনে। ওইদিন আপনি যখন শাড়িটা পছন্দ করছিলেন তখনই মনে হলো, একটু ঝগড়া করি। ইচ্ছে করেই বউয়ের কথা তুলে ওই সিচুয়েশন তৈরী করেছি। তবে সত্য এটাই যে, শাড়িটা আপনার উদ্দেশ্যেই কেনা হয়েছিল। যদি এই মুহূর্ত জীবনে না আসত, যদি আপনি আমার জীবনে না আসতেন, হয়তো কোনো এক সময়ে এই শাড়িটা আমি আপনাকে পাঠাতাম।’
নওমী ভীষণ চমকাল এতসব কথা শোনে। আদিয়ান তাকে তখন থেকেই ভালোবাসত? কখনও তো বলেনি এইভাবে। নিজেকে প্রকাশই করেনি ঠিকঠাক। সব অনুভূতি গোপনে এত যত্নে কেউ কীভাবে আগলে রাখতে পারে? মনে প্রশ্ন জাগাতেই বলল,
‘একটা সত্যি কথা বলুন তো!’
বউয়ের চোখের তারায় চোখ হারিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আদিয়ান। নওমী বলল,
‘আপনি আমাকে কবে থেকে ভালোবাসেন?’
চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে কীভাবে, কখন ও কোথায় কোথায় নওমীকে দেখে, ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার জন্ম হয়েছে, সবটাই বলে গেল আদিয়ান। নিজের মনের গোপন সব অনুভূতিকে আজ মুক্ত করে দিল। নওমী অবাক করা কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘ভালোই যদি বাসতেন কোনোদিন সত্য প্রকাশ করেননি কেন? আমি যদি মুখ না খুলতাম, আপনি নিজেকে দাবিয়ে রেখে দিতেন?’
আদিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘হয়তো তাই করতাম।’
‘কেন?’
‘একদিন বলেছিলাম না, আত্মসম্মানের ব্যাপার? তা-ই।’
নওমী পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
‘বাপির জন্য এমন করেছেন, তাই না?’
আদিয়ান ফের আগের মতোই দৃষ্টি ধরে রাখলে নওমী বলল,
‘অফিসে বাপি আপনাকে যা নয় তাই বলে অপনান করেছিল একদিন, এরপরই আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘বাপিই বলেছে।’
‘ওহ…।’
এরপর কেউ-ই আর কোনো কথা বলল না, দু’জনেই চুপ থেকে রাত্রির নিস্তব্ধতা ও সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে লাগল। রিকশা চলল আপন গতিতে। একটা সময় শহর ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে এসে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা ফুচকাওয়ালার সামনে এসে রিকশা থামিয়ে, দু’জনের জন্য দু’প্লেট ঝাল ঝাল ফুচকা অর্ডার দিয়ে নওমীকে একটা নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে রাখল আদিয়ান।
আলো-আঁধারির মায়ায় হারিয়ে গিয়ে ফুচকার প্লেটকে সঙ্গী বানিয়ে, টুকটাক গল্পের ফাঁকেই ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। রাত একটু গভীর হয়ে এলে, ওরা ফিরে এলো গন্তব্যে। রিকশা থেকে নামিয়ে, ভাড়া মিটিয়ে ঝটপট নওমীকে কোলে তুলে নিল আদিয়ান। নওমী চমকে গিয়ে বলল,
‘আশ্চর্য! কোলে তুলেছেন কেন? কেউ দেখলে কী ভাববে?’
‘এখানে আছেটা কে দেখবে? আর দেখলেই কী? আমি পরস্ত্রীকে ছুঁয়েছি? আমি তো আমার বউকে যথাসম্ভব যত্ন ও মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলছি। কার কী বলার আছে শুনি?’
সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে উপরে আসতে গিয়ে মৌমির সামনে পড়ে গেল ওরা। মৌমি ভেংচি কেটে বলল,
‘দাওয়াত না দিয়েই বিয়েশাদীর কাজ শেষ করে ফেললি শাঁকচুন্নি?’
এতক্ষণে সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছে দেখে লজ্জায় পড়ে গেল নওমী। মৌমিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘স্যরি বান্ধবী। এত তাড়াহুড়োর সব হয়ে গেল। কালকেই তোকে ট্রিট দিব, প্রমিস।’
‘হয়েছে রাখ। আর ট্রিট দিতে হবে না। একটা দারুণ কাজ করে এসেছি। রুমে গেলে টের পাবি। ট্রিট হিসেবে পারলে একটা বর খুঁজে দিস। আমারও তো বিয়ে করতে মন চায় না কি?’
নওমী চুপ থাকলেও আদিয়ান ঠাট্টার স্বরে বলল,
‘সমস্যা নেই শ্যালিকা। আপনার বর খোঁজার দায়িত্ব আমার।’
‘যান, ঘরে যান। রাত অনেক হয়েছে।’
সত্যিই অনেক রাত হয়েছে। খেয়াল হতেই আর দেরী করল না আদিয়ান। ফ্লাটের সামনে এসে নওমীকে দাঁড় করিয়ে দরজায় নক দিল। আলেয়া বেগম ও রাশেদুজ্জামান ওদের অপেক্ষায় বসে বসে গল্প করছিলেন। ডোর খুলে ছেলে ও বউমাকে দেখে, সামান্য মিষ্টি ও শরবত দিয়ে বধূবরণ করে পুত্রবধূকে ঘরে তুললেন। নওমী লজ্জায় একদম মিইয়ে যেতে লাগল। তিনি তাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে নিজের ভাইজানকে বললেন,
‘ভাইজান, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। রাত তো কম হলো না।’
রাশেদুজ্জামান হাই তুলতে তুলতে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আলেয়া বেগম নওমীর হাত ধরে তাকে ছেলের রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এখন বিশ্রাম নাও। সকালে কথা হবে।’
নওমী শুধু মাথা নাড়ল। তিনি চলে গেলে সাজানো-গোছানো বাসরঘরের দিকে তাকিয়ে, দু’হাতে মুখ লুকিয়ে বসে থাকল বিছানার এককোণে। আদিয়ান রুমে এলো দু’কাপ কফি নিয়ে। ডোর আটকে, নওমীকে ওভাবে মুখ লুকিয়ে বসে থাকতে দেখে বলল,
‘কী হলো? বসে আছেন কেন এখনও? ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আসুন, কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’
নওমী কোনোমতে বলল,
‘আমি তো জামাকাপড়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কী পরব?’
‘কেন? আমার শার্ট-প্যান্ট। দারুণ মানাবে।’
কৌতুকের সুরে বলল আদিয়ান। নওমী হেসে বলল,
‘ফাজলামি না, সিরিয়াসলি বলছি।’
বিছানার কোণে রাখা একগাদা ব্যাগকে সমাধান হিসেবে দেখিয়ে আদিয়ান বলল,
‘ওগুলোতে আছে। যেটা ভালো লাগে পরে নিন। চাইলে এই শাড়িতেও থাকতে পারেন। আমি তো আপনাকে এই সাজে দেখেই শান্তি পাচ্ছি।’
নওমী এবার সত্যিই ভীষণ লজ্জা পেল। চাদর ফেলে রেখে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে, হাত-মুখ ধুয়ে মেকাপ তুলে এলো। তবে শাড়িটা পাল্টাল না। পরনেই রাখল। ফ্রেশ হয়ে এসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’
আদিয়ান নিজেও মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিল। কফির কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে আরও ঘণ্টাখানেকের গল্প হলো। সেই ফাঁকে ইউটিউব দেখে দেখে বউয়ের হাতে মেহেদী পরিয়ে দিল আদিয়ান। একটু এলোমেলো, অগোছালো হলো, তবুও নওমী সন্তুষ্টচিত্তে স্বামীকে দেখতে দেখতে ছোটো ছোটো সব ইচ্ছে স্বপ্নদের একে-অন্যের নিকট মেলে ধরতে লাগল। গল্পের ফাঁকে বার বার হাই তুলল নওমী। ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মেহেদী তুলে এসে আবারও বিছানায় বসে থাকল। আদিয়ান কফির কাপদুটো সরিয়ে, বাতি নিভিয়ে, অল্প আলোর রঙিন বাতি জ্বালিয়ে বালিশে আধশোয়া হয়ে, রংচঙয়ে আলোয় নববধূকে নিষ্পলক চোখে দেখে গেল। নওমী একবার নখ কামড়াচ্ছে, পরক্ষণেই চুল ঠিক করছে। আবার পা দু’খানা দুলিয়ে কীসব ভেবে যাচ্ছে। তার এই লাজুক লাজুক কাণ্ডগুলো ভীষণ ভালো লাগছিল আদিয়ানের। এতকিছুর পরও নিজে থেকে বিছানায় আসছে না, অথচ হাই তুলেই যাচ্ছে।
আদিয়ান আস্তেধীরে বলল,
‘ঘুম আসেনি? আর কতক্ষণ জেগে থাকবেন? বিছানায় কিন্তু প্রচুর জায়গা।’
নওমী নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়ল না। নতজানু হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। আদিয়ান আরও কিছুক্ষণ মায়াবী মুখের মায়ায় ডুবে-ভেসে, সোজা হয়ে বসে দু’হাতে বউয়ের সদ্য দেয়া মেহেদী রাঙানো হাতদুটো ধরে, থুতনি ছুঁইয়ে মুখটা খানিকটা উপরে তুলে, বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ঠোঁট ছুঁয়ে, নিঃশব্দে আদর এঁকে দিল ঠোঁটে। বলল,
‘এখনও সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে, স্যুইটি।’
নওমীর নিজেরও একই অবস্থা। আসলেই সব সত্যিই? দু’জনে এত কাছে আজ? এত আপন হয়ে? বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও সব সত্যিই। এই বিয়ে, এই মানুষ, এই মুহূর্ত, কিচ্ছু মিথ্যে নয়, কিচ্ছু স্বপ্ন নয়। দুরুদুরু বুকে, ঠোঁটের কোণে পূর্ণতার হাসি নিয়ে নওমী নিজেও আদিয়ানকে আঁকড়ে ধরল, দু’হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। আদিয়ান তাকে বুকে নিয়েই বালিশে মাথা ঠেকাল। নওমী শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল, তা-ই তার হাতের বাঁধন আরও মজবুত হচ্ছিল। যেন বুকের ভেতর একেবারে ঢুকে গেলেই সব শীত, সব কাঁপুনি থেমে যাবে। তাকে পর্যাপ্ত উষ্ণতা দিতে, ব্ল্যাঙ্কেট গায়ে জড়িয়ে নিল আদিয়ান। তবুও কম্পন থামছিল না দেখে জানতে চাইল,
‘আপনি ঠিক আছেন? অসুস্থবোধ করছেন? ডাক্তার ডাকতে হবে?’
নওমী বাধাপ্রদান করে বলল,
‘উঁহু, কিচ্ছু লাগবে না। আমার শুধু আপনাকে লাগবে।’
মুচকি হেসে নওমীর ঠোঁটে গভীরস্পর্শে আদরের চিহ্ন আঁকতে আঁকতে আদিয়ান বলল,
‘ভয় নেই জান। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আদি শুধু আপনার হয়েই থাকবে।’
***
চলবে…