#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩৩
আদিয়ান ভেবেছিল, বিয়ের পরদিনটা ভীষণ অন্যরকম হবে। দু’জনের মধ্যে একটু রোমান্টিক-রোমান্টিক ভাবসাব থাকবে। সূর্যের প্রথম আলো এসে বউয়ের লাজরাঙা মুখ ছোঁবে আর সে তৃপ্তিভরে বউকে দেখবে। আদর করে ছুঁয়ে দিবে একটু। কিন্তু হয়ে গেল উলটো। শীতের সকালেও তার মনে হলো, পায়ের নিচে কিছু একটা এসে তাকে একটুবেশিই উষ্ণতা দিচ্ছে। আবার একটু ভারী ভারী ঠেকছে। চোখ মেলে নওমীকে খুঁজে না পেয়ে, ঘরের দরজা-জানালা খোলা দেখে বুঝে নিল, নওমী অনেক আগেই উঠে গেছে। সে এতটাই ঘুমকাতুরে ছিল যে, টেরও পায়নি। কিন্তু পায়ের ওপরে থাকা উষ্ণতাটা একটু ভিন্ন। সে ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে যে-ই না বিছানা ছেড়ে নামতে যাবে, অমনি পায়ের পাতায় কিটিকে দেখে ভীষণ চমকাল। কিটি তার পায়ের ওপর আরাম করে ঘুমাচ্ছে। আশ্চর্য, এটা ঘরে এলো কখন? বিড়বিড়িয়ে নওমীকে ডাকতে চেয়েও থেমে গেল। আলতোস্পর্শে কিটির তুলতুলে শরীরটা ছুঁতেই সে ঘুম থেকে উঠে এমনভাবে মোচড় দিল, যেন তার ঘুম ভাঙাতে সে ভীষণ বিরক্ত। এরপর আদিয়ান হাত বাড়িয়ে ধরার আগেই বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড় দিল।
ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে এসে দেখল, রিংকি-পিংকি দু’জনেই এসেছে এবং ওরাই কিটিকে নিয়ে এসেছে। নওমী কিটিকে ছাড়া থাকতে পারছিল না, তা-ই রাতেই ফোন করেছিল মামীর কাছে। দুই মামী ভোর হওয়ার সাথে সাথে মেয়েদের দিয়ে কিটিকে পাঠিয়ে দিলেন। এখন কিটি আরামসে নওমীর কোলে বসে আদর নিচ্ছে। আদিয়ান চেয়ারে বসে দুই শালীকে ‘গুড মর্নিং’ জানালে ওরা দু’জনে শুধু ‘গুড মর্নিং’ বলে শান্ত হলো না। আবদার জুড়ে বসল,
‘দুলাভাই আমরা কিন্তু আজকে ঘুরতে যাব। আপনি তো এখনও কাজে জয়েন করেননি। যতদিন ফ্রি আছেন, ঘুরতে নিয়ে যাবেন?’
আদিয়ান দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘একদম না। যতদিন অ্যাক্সাম চলবে ঘোরাঘুরি টোটালি অফ। আর শোনো, আমাকে দুলাভাই নয় ভাইয়া ডাকবে। ঠিক আছে?’
রিংকি গাল ফুলিয়ে বলল,
‘না… দুলাভাইকে দুলাভাই-ই তো ডাকব। দশটা না, পাঁচটা না, একটামাত্র দুলাভাই। তাকে কোন দুঃখে ভাইয়া ডাকতে যাব?’
নওমী গিন্নী গিন্নী একটা ভাব নিয়ে আদিয়ানের নাশতা এগিয়ে দিল। পাশের চেয়ারে সে নিজেও বসল। এতক্ষণে সবার নাশতা শেষ, শুধু তারা দু’জনেই বাকি ছিল। নাশতা খেয়ে দুই ভাইবোন জমিয়ে গল্প করছেন। রিংকি-পিংকির খাওয়াও শেষ। আদিয়ান ও নওমী খেতে বসলে, পিংকি আহ্লাদী কণ্ঠে বোনকে বলল,
‘দুলাভাইকে বলো না, একটু যেন ঘুরতে নিয়ে যায়।’
আদিয়ান অসহায় মুখ নিয়ে বলল,
‘কী দুলাভাই দুলাভাই শুরু করলে তোমরা? আমাকে স্যারই ডাকো দু’জনে।’
‘আপনি তো আমাদের আর পড়াবেন না, তাহলে স্যার কেন ডাকব?’
‘ওকে, ঘুরতে যাবে। শুধু আজকে। অ্যাক্সামের পর আমরা অনেক ঘুরব, কিন্তু এইমুহূর্তে পড়াশোনা ফেলে ঘোরাঘুরিটা একদমই ঠিক না। একটা শর্তে আজ আমরা ঘুরতে যাব।’
দুইবোন আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল,
‘কী শর্ত?’
‘আমাকে ভাইয়া ডাকতে হবে।’
পাংশুমুখে দু’জনেই মাথা নেড়ে খুশিমনে সেই স্থান প্রস্থান করল। নওমী কিটিকে ফ্লোরে একটা সেইফ জায়গায় বসিয়ে, তাকে খাবার দিয়ে, আদিয়ানের জন্য কফি বানিয়ে আনল। সন্তুষ্টির সাথে আদিয়ান বউকে দেখতে দেখতে চুপিসারে বলল,
‘আপনার ঘুম ভাঙল কখন? আমি তো টেরই পাইনি।’
নওমী লাজরাঙা বদনে বলল,
‘খুব ভোরে। আজানের পরই। আপনার ঘুম এতটাই গাঢ় ছিল যে, বার দু’য়েক ডেকেও জাগাতে পারিনি।’
‘কী বলেন? আপনি ডেকেছেন আর আমি শুনতে পাইনি?’
‘হুম, ডেকেছি।’
আদিয়ান ভোরের দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেখানে কিছু চমৎকার মুহূর্ত ছাড়া সে আর কিছু জোর করেও মনে করতে পারল না। একসময় বলল,
‘আপনি আমাকে ডাকেনইনি, একা-একাই উঠে এসেছেন।’
‘মুখে ডাকিনি, অন্যভাবে ডেকেছি।’
‘সেটা কীভাবে?’
নওমী একবার ড্রয়িংরুমে দৃষ্টি দিয়ে আঙুলের ইশারায় একবার নিজের ঠোঁট দেখাল, আরেকবার আদিয়ানের গাল দেখিয়ে বলল,
‘পরপর দুটো চুমু খেয়েও যে বেহুঁশের মতো ঘুমায়, তার ঘুম আর কীভাবে ভাঙাতাম আমি?’
আদিয়ান চমৎকৃত হয়ে বলল,
‘আরেব্বাস, বেশিক্ষণ ঘুমালে বউয়ের চুমু পাওয়া যায়? জানতাম না তো। জানলে এখনও ঘুমিয়েই থাকতাম। কিটি আমার লস করে দিল।’
‘কেন? ও কী করেছে?’
‘আরেহ্, ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে থেকে আমার পায়ের ওপর আরাম করে ঘুমিয়েছে। ওর পশমের স্পর্শ পেয়েই তো ঘুম ভেঙে গেল।’
বলতে বলতে ঠোঁটে হাসি নিয়েই বউয়ের মুখে নাশতা তুলে দিল আদিয়ান। বিবাহিত জীবনের প্রথম সকালটাকে একটু সুখময় করতে, খাবার মুখে তুলে দিয়েই থামল না। কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ সো মাচ্। আমার মতো একজন সাধারণ পুরুষকে ভালোবেসে, তাকে বিশ্বাস করে তার হাত ধরেছেন বলে। আমি হয়তো আপনাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিতে পারব না, তবে যতদিন আমার হয়ে থাকবেন, ততদিন আপনাকে ভালোবাসার পাশাপাশি সম্মানের একটা জীবন দিতে পারব। যে-ই জীবনে কান্নাহাসির অনেক মুহূর্ত আসবে, কিন্তু তবুও আমি আপনাকে একা ছাড়ব না।’
খাবার মুখে নিয়ে, জল টলমল চোখে নওমী বলল,
‘আপনি নিজেকে যতই সাধারণ বলুন না কেন, আমার চোখে আপনি সবসময়ই এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের পুরুষ। আমার সৌভাগ্য যে, আমি আপনার জীবনসঙ্গিনী হতে পেরেছি।’
টুকটাক কথাবার্তা, খুঁনসুটি ও নাশতা খাওয়ার ফাঁকে নওমী খেয়াল করল, রুমে তার ফোন বাজছে। ছুটে গিয়ে রিসিভ করে মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে, তোফাজ্জল হোসেনের সাথেও কথা বলল। মেয়ের সাথে ভালোমন্দ আলাপের পর তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘তোমার শাশুড়ি কি কাছে আছেন? তাকে ফোনটা দিতে পারবে?’
‘হ্যাঁ বাপি, দিচ্ছি।’
নওমী ড্রয়িংরুমে এসে ফোন এগিয়ে দিল আলেয়া বেগমের দিকে। তিনি সেটা কানে ঠেকিয়ে সালাম দিলেন। ভদ্রতাস্বরূপ কতক্ষণ কথা বললেন। একসময় তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘ওদের বিয়েটা যেভাবেই হোক, হয়ে গেছে। তবে মেয়েকে নিয়ে আমার যত স্বপ্ন ছিল, সব ভেঙে গেছে।’
আলেয়া বেগম দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘আমি খুব দুঃখিত বেয়াই সাহেব। এই যুগের ছেলেমেয়ে। বাবা-মা হয়ে তো আমরা আর ওদের মনে দুঃখ দিতে পারি না।’
‘ঠিক তাই। আমি চাইছিলাম, একটা গেট টুগেদার পার্টি দিতে। সামনেই নওমীর পঁচিশতম জন্মদিন। ওইদিনই যদি আমার এখানে পার্টির আয়োজন করি, আপনারা কী আসবেন? ওই আয়োজনটা মূলত নওমী ও আদিয়ানের জন্যই হবে।’
‘আমি আপনার সিদ্ধান্তে খুব খুশি হয়েছি। তবে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, এই আয়োজনে আমি বা আমার ভাই, আমরা কেউ-ই থাকতে পারব না। আমাদেরকে আজই নরসিংদী যেতে হবে। বাড়িতে আমার ভাইঝি একা। ছোটো একটা বাচ্চা নিয়ে ও হিমশিম খাচ্ছে। আপনি এই বিষয় নিয়ে বরং আদির সাথেই কথা বলে দেখুন।’
‘ঠিক আছে। আপনি ফোনটা তার হাতেই দিন। আমি ও’কে বুঝিয়ে বলছি।’
সম্পর্কের যেহেতু উন্নতি হয়েছে, আদিয়ান আর পিছনের কথা মনে রাখতে চায় না। তা-ই আলেয়া বেগম ফোন দেয়া মাত্রই সে ফোন কানে ঠেকিয়ে সালাম দিয়ে, খুব নম্রভদ্র ও শান্ত মেজাজে কথা চালিয়ে গেল। প্রাথমিক আলাপ সেরে তোফাজ্জল হোসেন পার্টির আয়োজনের কথা তুললে, আদিয়ান প্রথমে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবল, এটা কি তাকে অপমান করার একটা ছোট্ট আয়োজন না কি অন্যকিছু। যে মানুষ নিজের আপনজনদের খুন করতে পারে, সে তার সাথেও যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। শুরুতেই মাথায় এই নেগেটিভ চিন্তা কেন এলো, ভেবে পেল না আদিয়ান। তবে নিজের চিন্তাটাও বুঝতে দিল না। শুধু বলল,
‘আমি একটু ভেবে জানাই?’
তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘এখানে আর ভাবার কী আছে? ওইদিন পার্টিতে সবাইকে জানিয়ে দিব যে, তুমি আমার মেয়ের জামাই।’
‘সেটা আপনি যেকোনো সময় জানাতে পারেন, কিন্তু ওইদিনই কেন?’
‘নওমী যে আইইএলটিএস কমপ্লিট করেছে ভুলে যেও না। যদি ও বাইরে চলে যায়, তখন আর মেয়েকে কাছে পাব না। কাগজপত্র সাবমিট করলে ছ’মাসও লাগবে না। আমার একটাই মেয়ে। দূরে যাওয়ার আগে শেষ একবার ওর জন্মদিনটা আমি আনন্দের সাথেই করতে চাই। আর একইদিনে খুশির সংবাদটাও সবাইকে জানাতে চাই।’
নওমীর জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটা মাথায় আসতেই আদিয়ান বলল,
‘ঠিক আছে। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
***
ডিউটিতে এসে আবারও জাহাঙ্গীরের কেইস নিয়ে বসেছে জাদীদ। এই একটা কেইস কেন যে শেষ হচ্ছে না, বুঝে উঠতে পারছে না। সে টর্চারসেলের ভেতরে ঢুকে রাসেলের মুখোমুখি বসে বলল,
‘এত মার খেয়েও মুখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে কেন তোর? তুই কি জানিস, তোর দলের সব ক’জন ধরা পড়ছে?’
রাসেল প্রথমে আঁতকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘ধরে লাভ কী? যার খুঁজে এসব করছেন তাকে তো পাবেন না।’
‘কেন পাব না?’
‘সে অনেক চতুর। যতদিন না নিজে থেকে ধরা দিবে, আপনি তার চুলের নাগালও পাবেন না।’
রাগে ও অপমানে রাসেলের মুখে একটা ঘুষি মেরে বেরিয়ে এলো জাদীদ। আর কোনদিকে যাবে সে? এই কেইসটা এত জটিল কেন? কেন এত প্যাঁচ এখানে? ভাবতে গিয়ে অস্থির হয়ে গেল। এমন সময় তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে সাউন্ড দিয়ে রিংটোন বেজে উঠলে, রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে ভালোমন্দের বদলে ভেসে এলো,
‘কেইসটার কোনো গতি হলো জাদীদ ভাই? শুভর খুনিকে পেয়েছেন?’
দুর্বল কণ্ঠে ভেসে আসা ওইটুকু আওয়াজেই জাদীদ বুঝে গেল ওপাশের মানুষটা রুমঝুম। কোথায় সে নিজে এই কেইস নিয়ে আপডেট দিবে, তা না করে দিনরাত চর্কির মতো ঘুরছেই। এদিকে কেউ যে সমাধানের জন্য ছটফট করছে সে সেটা ভুলেই গেছে। নিজের অপারগতা জানিয়ে জাদীদ বলল,
‘এখনও কোনো সমাধান পাইনি রুমঝুম। শহরের এমন কোনো জায়গা বাকি নেই, যেখানে জাহাঙ্গীরকে খুঁজিনি। এই লোকটা কোথায় যে আছে!’
‘চলে যায়নি তো?’
‘সেটার চান্স খুবই কম। পুলিশের লোকজন চারিদিকে তার ছবি নিয়ে ঘুরছে। এ্যায়ারপোর্টে পা রাখা মাত্রই সে ধরা পড়তে বাধ্য।’
‘তাহলে সে কোথায়? আপনি কেন চেষ্টা করছেন না? এই শহরে অন্যায়ের কি কোনো বিচার নেই?
‘বিচার আছে রুমঝুম, অবশ্যই আছে। বিচারের জন্য খুনিকে তো খুঁজে পেতে হবে, তাই না?’
‘পাচ্ছেন না কেন?’
প্রশ্নে প্রশ্নে মেয়েটা তার ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। জাদীদ ভীষণ অসহায় হয়ে বলল,
‘আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও। ওই লোকটাকে পেলেই আমি তোমাকে জানাব।’
‘কিছুদিন… কতদিন হলো শুভ নেই জাদীদ ভাইয়া? আমি বাচ্চাটার দিকে তাকাতে পারি না! নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। নওমীপুর জন্য ও নিজের জীবনটা দিয়ে দিল। একবার আমার কথা ভাবলও না।’
‘ও তো তখন খুব অসহায় ছিল, রুমঝুম।’
নওমীর কথা উঠে আসাতে হঠাৎ করেই জাদীদের খেয়াল হলো, জাহাঙ্গীরের আসল টার্গেট তো নওমী। সামনেই নওমীর জন্মদিন। লোকটা এখন খুব গোপনে নওমীকে ফলো করছে। তাকে না মেরে সে দেশ ছাড়বে না। মৌমিতাদের বাড়ির দিকে নজর রাখতে হবে। মনে মনে একটা ভাবনা সাজিয়ে রুমঝুমকে সান্ত্বনা দিতে যে-ই না কিছু বলতে যাবে, অমনি ল্যান্ডলাইন বেজে উঠল। জাদীদ বলল,
‘একটা কল এসেছে, রাখছি এখন। খোঁজ পেলে আমি তোমাকে জানাব।’
মোবাইল রেখে টেলিফোন কানে ঠেকাতেই নওমীর বাবা তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘নওমীর জন্মদিন উপলক্ষে একটা পার্টির আয়োজন করেছি। ওইদিন সারা বাড়িতে পাহারা লাগবে। আমার বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় সিকিউরিটি চাই অফিসার।’
জাদীদ তাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলল,
‘আপনি কোনো টেনশন করবেন না। আমি সিকিউরিটি বসিয়ে দিব।’
তোফাজ্জল হোসেন আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলেন। জাদীদ আবারও কেইস ঘাটতে বসে। কোন জায়গায় কতটুকু ফাঁক ছিল, সেসব নিয়েও ভেবে গেল। অথচ সব দিকেই শুধু শূণ্যতা ও ব্যর্থতা। এই কেইসের যদি সমাধান না হয়, শুভর ওপর খুব অবিচার হবে। চিন্তিত জাদীদ ভাবনা থামিয়ে নির্দিষ্ট দিনটার অপেক্ষায় রইল, যেইদিন জাহাঙ্গীর তার টার্গেট পূরণে মাঠে নামবেন বলে ধারণা। যদিও এটা কেবল ধারণা থেকেই আন্দাজ করা, তবুও নিশ্চিত নয় সে। একটা মানুষ ভাইয়ের মেয়েকে মেরে কী শান্তি পাবে? কেন একটা মেয়েকে মারতে গিয়ে সে শুভর জীবন নষ্ট করে দিল? শুভর তো কোনো দোষ ছিল না। একেবারে নিষ্পাপ ও নিরপরাধ ছেলে। তাকে মেরে জাহাঙ্গীরের কী লাভ হলো?
রাত দশটার পর রাসেলকে সেল থেকে বের করে হাতে হ্যান্ডকাফ পরাল জাদীদ। জিপের পিছনে বসিয়ে ডোর লক করে নিজে ড্রাইভিংয়ে বসল। রাসেলের মুখে স্কচটেপ দেয়া। সে শুধু গুঙিয়ে যাচ্ছে তবে কোনো স্পষ্ট শব্দ করতে পারছে না। পা দিয়ে লাথি ও মাথা দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করেও জাদীদকে থামাতে পারল না। ফুল স্পীডে জিপ নিয়ে ব্রিজের ওপর এসে থামল জাদীদ। চারিদিক অন্ধকার। একদম শুনশান। এই রোডে এখন গাড়ি যাতায়াত করছে খুব কম। ডোর খুলে রাসেলকে বের করে, পরপর কয়েকটা ঘুষি মেরে বলল,
‘বল জাহাঙ্গীর কোথায়?’
রাসেল শুধু গুঙিয়ে গেল। ইশারায় বুঝাল স্কচটেপ খুলে দিলেও সে বলবে না। জাদীদ সেটা খুলল না। মুখ চেপে ধরে বলল,
‘বলবি না?’
রাসেল দু’দিকে মাথা নাড়ল শুধু। জাদীদ বলল,
‘স্ত্রী-সন্তানদের জন্য মায়া নেই?’
রাসেল আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝাল, সে না থাকলে আল্লাহ দেখবেন। ভেতরে এত অপরাধ জমা রেখেও কেউ আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে পারে দেখে অবাক হলো জাদীদ। পিস্তল বের করে সেটা রাসেলের মাথায় তাক করে বলল,
‘একটা চাপে তুই শেষ। শেষবার বলছি, বল জাহাঙ্গীর কোথায়?’
রাসেল নিশ্চুপ রইল। জাদীদ আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে না পেরে পরপর দু’বার ট্রিগারে চাপ দিল। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গুঙিয়ে উঠল রাসেল। নিথরদেহ নিয়ে ঢলে পড়ল ফুটপাতে। জাদীদ হাতে গ্লাভস্ পরে, দু’হাতে রাসেলের দেহটা নদীতে ফেলে দিয়ে জিপে উঠে স্টিয়ারিংয়ে মাথা ঠেকাল। তখুনি মোবাইলের ম্যাসেজ টিউন বেজে উঠল। জাদীদ ফোন হাতে নিয়ে দেখল, তাতে অচেনা এক নম্বর থেকে ম্যাসেজ এসেছে। লেখা – “এভাবে আর ক’জনকে মারবে? যতই মেরে পানিতে ভাসিয়ে দিয়ে মিথ্যে নিউজ সাজাও না কেন, খুব একটা লাভ হবে না ইনস্পেকটর। জাহাঙ্গীর দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরবেই, মনে রেখো। এত সহজে আমি আমার লক্ষ্য থেকে সরব না।”
জাদীদ ঝটপট সেই নম্বরে ডায়াল করল, অথচ নম্বর সুইচড অফ দেখাতে শুরু করল। সে ওই নম্বরের লোকেশন জানার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেল, তবুও কোনো কাজ হলো না। নম্বরটা থানায় পাঠিয়ে, জিপ থেকে নেমে ডানে-বামে, সামনে-পিছনে চোখ বুলিয়েও সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না। তবে নিশ্চিত হয়ে গেল, জাহাঙ্গীর তার আশেপাশেই আছে এবং খুব সুক্ষ্ণভাবে তার দিকে দৃষ্টি রাখছে। তার সব কাজকর্ম দেখছে অথচ সে তাকে ধরতেও পারছে না। অক্ষম আক্রোশে ফেটে পড়ে জাদীদ জিপ স্টার্ট করে থানায় এলো। এরপর দীর্ঘক্ষণ লোকেশন ট্র্যাক করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যই সে পেল না। ফোন নম্বরটা কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা এটুকু জানার জন্য সে কাছেপিঠে থাকা পরিচিত কয়েকটা সিমের দোকানে এলো। এবং ওই নম্বর দেখিয়ে জানতে চাইল, এটা এখানকার কোথাও থেকে বিক্রি হয়েছে কি না, হলে কবে হয়েছে এইসব।
কয়েকটা দোকান ঘুরতে ঘুরতে একজন সিমের নম্বর দেখে জানাল, এই সিমটা তারাই সেল করেছে। একটা আশার আলো খুঁজে পেয়ে জাদীদ বলল,
‘এটা কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা একটু দেখবেন?’
লোকটা কম্পিউটারের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ওই সিমের সব ইনফরমেশন জাদীদের সামনে তুলে ধরল। সিম রেজিস্ট্রেশন করেছে জাহাঙ্গীর হোসেন নিজে। ছবিসহ সবটাই স্পষ্ট সেখানে। এইটুকু দেখে জাদীদ এবার পুরোপুরি নিশ্চিত যে, জাহাঙ্গীর ঢাকাতেই আছে। কিন্তু কোথায় আছে? কেন তাকে খুঁজে পাচ্ছে না?
***
চলবে…
“ভাইয়া একটু বাইরে এসো তো। কেউ একজন আপুর সাথে দেখা করতে চান।”
এক ডাকেই কাজ হলো। ঘর থেকে বাইরে এলো উসাইদ। ফারশাদের দুর্ঘটনা ও উজমার অসুস্থতার সুযোগে তিনদিনের ছুটি নিয়েছে সে। তাই আজ বাড়িতেই। সে বাইরে এসে বাড়ির মূল গেটের সামনে দামী ও গর্জিয়াস সাজপোশাকের মুনমুন হক্বকে দেখে সামনে এগিয়ে বলল, “ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। অবশেষে আমার মতো দু’পয়সার ছেলের দ্বারে আসতে হলো আপনাকে। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন…।”
মুনমুন হক্ব মেজাজ দেখাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। সব অপমানের জবাব দিবেন। কিন্তু এইমুহূর্তে একটু নাটক করতে পারলেই ফারশাদের জীবন থেকে চিরদিনের জন্য উজমাকে নাই করে দিতে পারবেন। তিনি ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, “কী করব বলো? আসতেই হতো। শত হলেও আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ি এটা। আমি না এসে পারি?”
উষা সরে দাঁড়ালে মুনমুন হক্ব ভেতরে পা রাখলেন। সাকিবও আসতে চাইল। হাত তুলে উসাইদ তাকে ওখানেই থামিয়ে দিয়ে বলল, “এ্যাই রাস্তার কুকুর, তুই ভেতরে আসছিস কেন? বাইরে থাক।”
সাকিবের মুখের ওপর গেট আটকে দিল উসাইদ। মুনমুন হক্ব হতভম্ব হয়ে গেলেন। চার আনার ছেলের এত দাম্ভিকতা তাকে অবাক করে দিল। তিনি চমকে তাকালে উসাইদ বলল, “আপনি হা করে দেখছেন কী? ভেতরে আসুন।”
উসাইদের এই মেজাজ মুনমুন হক্বের সহ্য হচ্ছে না, তবুও তিনি দাঁতে দাঁত চেপে ভেতরে প্রবেশ করলেন। উসাইদ তাকে ড্রয়িংরুমে এনে বসাল। মিশকাতকে ডেকে চা-নাশতার কথা বলল। মুনমুন হক্ব জানালেন, “আমি কিছু খাব না। আমার বউমাকে ডাকো। তাকে দেখেই চলে যাব।”
উসাইদ বলল, “এত তাড়া কীসের? এসেছেন, বসেন, নাশতা-পানি খান, তারপর উজমার সাথে দেখা করবেন। আপনি এমন কোনো প্রেসিডেন্ট না যে, চাওয়া মাত্রই আমার বোন আপনার সামনে আসতে বাধ্য।”
“দেখো, তুমি এখনও পিছনের কথা ধরে রেখে বসে আছো। আমি ওসব কথা মনে রাখতে চাইছি না। সুসম্পর্কে কোনো ধরনের রাগ-অভিমান থাকা উচিত না।”
“আপনি মানেন এটা সুসম্পর্ক? মনে তো হয় না।”
“আমি এখানে বেশিক্ষণ বসব না, উসাইদ। উজমাকে ডাকো।”
নিচে নামতে এসে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল উজমা। সব কথা শুনছিল। এই মহিলা যে একটা স্বার্থপর ও ভীষণরকম চালাক সেটা উসাইদ এখনও আন্দাজ করতে পারেনি। তবে সে ভীষণ অবাক হলো, ভদ্রমহিলাকে এত তাড়াতাড়ি এমন একটা কুঁড়েঘরে আসতে দেখে। দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে ড্রয়িংরুমে এলো। কয়েক হাত দূরে থেকে বলল, “আমাকে খুঁজে বের করার জন্য এত কষ্ট করলেন আপনি? রাজপ্রাসাদ থেকে সোজা পর্ণকুটিরে চলে এলেন? কী সৌভাগ্য আমার। রীতিমতো বিস্মিত আমি। তা, কী চাই এখানে?”
মুনমুন হক্ব মুখে হাসি ধরে রেখে বললেন, “দূরে দাঁড়িয়ে কেন, মা? কাছে এসে বসো। তোমাকে একটু দেখি।”
উজমা ঝটপট বলল, “দুঃখিত…। আমি কোনো অচ্যুত ও নোংরা কাদামাটিতে মাখামাখি করা ব্যক্তির পাশে বসি না। ওসব ছোঁয়াচে কি না। যদি আপনার শরীরের কাদামাটি আমাকে স্পর্শ করে ফেলে তবে তো আমিও অচ্যুত হয়ে যাব। দূরে আছি, বেশ আছি। কী বলতে চান, ওখান থেকেই বলুন।”
ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মেজাজের ওঠানামাকে সামলে নিলেন মুনমুন হক্ব। এখুনি রি’অ্যাক্ট করলে সব প্লান মাঠে মারা যাবে। আপাতত কিছু বলা যাবে না। তিনি চুপ থেকে নিঃশ্বাস ফেলে উসাইদকে বললেন, “আমি শুধু আমার বউমার সাথে কথা বলতে চাই। তোমরা একটু দূরে যাও।”
উসাইদ বলল, “অসম্ভব। আমরা কেউ এক পা-ও দূরে যাব না। যা বলার আমাদের সামনেই বলুন।”
এরা এত সহজে তাকে একা ছাড়বে না, বেশ বুঝে নিলেন মুনমুন হক্ব। ব্যাগ থেকে মোটা বান্ডেলের অনেকগুলো হাজার টাকার নোট উজমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এগুলো রাখো। কাজে লাগবে। শুনেছি তুমিও অসুস্থ।”
উজমা ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, “কিনতে চান না কি দূরে সরাতে চান? ঠিক কী জন্য এতগুলো টাকা দিচ্ছেন?”
“বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুঝে ফেলেছ। কিনতে চাইছি, তোমার ভালোবাসা। বিক্রি করে দাও, আমার বোনঝির নামে।”
“এত সস্তা? সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে আমার এত দিনের দামী অনুভূতি ও সম্পর্ককে তুচ্ছ করে দেব, তা-ও একটা উচ্ছিষ্টের নামে, ভাবলেন কী করে?”
“তোমাদের মতো মেয়েদের জন্য অসম্ভব কিছু না।”
“ঠিকই বলেছেন অসম্ভব কিছু না। আমরা চাইলে সব করতে পারি।”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে টাকার বান্ডেলগুলো হিসেব করল উজমা। গুটিকয়েক পা ফেলে রান্নাঘরে গেল। দিয়াশলাই হাতের মুঠোয় নিয়ে ফিরে এসে বলল, “হাতে নিই?”
মুনমুন হক্ব বিজয়ীর হাসি ঠোঁটে এনে বললেন, “অবশ্যই। এইসব টাকা তোমার।”
উজমা সামান্য হাসলো। সবগুলো বান্ডেল ফ্লোরে ফেলে হাতের মুঠোয় থাকা দিয়াশলাই দিয়ে একেকটা বান্ডেলে আগুন ধরিয়ে বলল, “এগুলো তো পাপের টাকা। পাপের টাকার অংক যদি লাখ ছাড়িয়ে কোটিতেও পৌঁছায়, আমি আমার ভালোবাসাকে বিক্রি করব না। তাছাড়া ভালোবাসা কোনো বিক্রিত পণ্য নয় যে, তাকে কাগজের কিছু সস্তা নোটের কাছে বিক্রি করে দেব। আপনি হয়তো জানেন না, আপনার ছেলে ও আমি, মনের বিনিময়ে আমরা একে-অন্যের মন কিনেছি, তাই টাকার কাছে মনের লেনদেন ও দামী অনুভূতিটাকে তুচ্ছ করে দিতে পারছি না। পারবও না। একবার এসেছেন, সম্মানের সাথে বলছি। এক্ষুণি বেরিয়ে যান। দ্বিতীয়বার যদি এই বাড়িতে আপনার ওই অচ্যুত শরীর দেখেছি, এই টাকার মতোই আপনার গায়েও আগুন ধরিয়ে দেব। দরজা খোলা আছে। যান… বেরিয়ে যান।”
***
#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব
নিজের জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির গল্প বলতে গিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন আবেগে কেঁদে ফেললেন। তিনি কথা বলছেন, এদিকে তার চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে। সময় কোনদিক দিয়ে কতক্ষণ পেরিয়েছে কারোরই আর সেদিকে দৃষ্টি নেই। এমন বাধভাঙা গলায় কেঁদে কেঁদে জীবনের গল্প বলা মানুষ দুনিয়ায় খুব কম দেখেছে নওমী। আজ সচক্ষে জাহাঙ্গীর হোসেনকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না, এমন একটা মানুষের মনেও দুঃখ আছে, কষ্ট আছে। শুনতে শুনতে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে হাতে থাকা পানির বোতল বাড়িয়ে দিয়ে নওমী বলল,
‘পানি খান একটু।’
জাহাঙ্গীর হোসেন হাত বাড়ালে নওমী পানির বোতল তার হাতে দিয়ে বলল,
‘আপনার একা থাকতে কষ্ট হয় না?’
বোতল থেকে অল্প একটু পানি খেয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন,
‘না হয় না, অভ্যাস হয়ে গেছে।’
‘অভ্যাসের জন্য আপনার চোখে পানি এলো?’
জাহাঙ্গীর হোসেন কথা এড়িয়ে গেলেন। বোতল থেকে আরও কয়েক ঢোক পানি গিলে হঠাৎই থমকে গিয়ে বললেন,
‘এই পানি তো তোমার জন্য। আমাকে দিলে কেন?’
‘আপনি হাঁসফাঁস করছিলেন। মনে হলো, গলা শুকিয়ে গেছে।’
জাহাঙ্গীর হোসেন হাতের বোতল দূরে ছুঁড়ে ফেলে, দু’হাতে দু’চোখ ঢলে বললেন,
‘এই পানিতে ঘুমের ঔষধ ছিল।’
নওমী আঁতকে উঠে বলল,
‘কেন?’
‘এক্ষুণি বাইরে যেতে হবে আমাকে। পাজি মেয়ে।’
মুখে হাত চেপে নিজের জায়গায় বসে রইল নওমী। জাহাঙ্গীর হোসেন দ্রুতপায়ে বাইরে যাবেন, সেই সময় বাইরে থেকে সাইরেনের আওয়াজ কানে এলো। তিনি বুঝতে না পেরে নওমীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তোমার কাছে ফোন আছে?’
‘না, নেই।’
তড়িঘড়ি নিজের দু’হাত ও পার্স দেখাল নওমী। জাহাঙ্গীর হোসেন একপলক ভাতিজির দিকে তাকিয়ে কোমরের পিস্তল হাতে এনে বললেন,
‘তোমার সময় শেষ। এখুনি মরতে হবে তোমাকে।’
তিনি পিস্তল তাক করে গুলি ছোঁড়ার আগেই ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে মাটিতে ঢলে পড়লেন। নওমী সেই সুযোগে জাহাঙ্গীর হোসেনকে টপকে দ্রুত বাইরে বের হওয়ার পথ খুঁজল। বাইরে থাকা সাইরেনের আওয়াজে এখানে যতজন পাহারা দিচ্ছিল, ইতিমধ্যে কিছু আইনের হাতে ধরা পড়েছে আর কিছু পালিয়েছে। আওয়াজ ফলো করে ডানে-বামে তাকিয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজে পেয়ে খুব দ্রুতই নীল আকাশের নিচে এসে দাঁড়াল নওমী। তার ঠিক সামনেই পুলিশের জিপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদিয়ান। মাত্রই গাড়ি থেকে নেমেছে। তাকে দেখে ফোন পকেটে রেখে ছুটে এলো সামনে। বলল,
‘আপনি ঠিক আছেন?’
নওমী উপরনিচ মাথা নেড়ে দু’হাতে আদিয়ানকে জড়িয়ে ধরে এতক্ষণের জমে থাকা ভয়-ডর সবকিছুকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে গেল। আদিয়ান তাকে পরিপূর্ণ ভরসা দিয়ে আগলে নিয়ে বলল,
‘ভয় নেই। জাদীদ গোটা টিম নিয়ে এসেছে। আজ জাহাঙ্গীর ও তার দলের কেউ এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবে না।’
ফোঁপাতে ফোঁপাতে নওমী জানতে চাইল,
‘বাপির কী অবস্থা?’
‘এক্ষুণি হসপিটালে যাব। নিজেই দেখবেন।’
‘বাপি ঠিক আছে না?’
আদিয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে জিপ থেকে একটা পানির বোতল এনে নওমীকে অল্প একটু পানি খাইয়ে, সম্পূর্ণ মুখটা মুছে দিয়ে, তাকে গাড়িতে বসিয়ে বলল,
‘একটু অপেক্ষা করুন, জাদীদ এখুনি চলে আসবে।’
আরও দশ থেকে পনেরো মিনিট পুরো জায়গা সার্চ করে জাহাঙ্গীরকে তার দলবলসহ গ্রেফতার করা হলো। বোতলের পানিতে ঘুমের ঔষধের ডোজ এতটাই বেশি ছিল যে, এখনও লোকটা হুঁশে আসছে না। তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে গাড়িতে তুলে জাদীদ এলো নওমীর সামনে। তাকে একদম দুর্বল ও নিষ্প্রাণ দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘লোকটা আপনার গায়ে হাত তুলেছে?’
নওমী বলল,
‘না, কিছুই করেনি। শুধু হুমকিধামকি দিয়ে রেখেছিল। আর বারবার রিভলভার দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল।’
‘উনি অজ্ঞান হলেন কী করে?’
ঠোঁটে আপনা হতেই হাসি চলে এলো নওমীর। বলল,
‘আমার জন্য নিয়ে আসা পানি উনি নিজেই খেয়ে ফেলেছেন। ওটার মধ্যে ঘুমের ঔষধ মেশানো ছিল।’
কত্তবড়ো বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছে নওমী, ভেবেই বুকে কাঁপন সৃষ্টি হলো আদিয়ানের। সে দু’হাতে বউকে আগলে নিয়ে বসল। জাহাঙ্গীর কতটা ভয়ানক হতে পারত আজ! ভাগ্যিস রব সহায় ছিলেন।
***
আইসিইউ থেকে তোফাজ্জল হোসেনের নিথর দেহখানি বের করে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে তখুনি হসপিটালে পা রাখল নওমী। তার মাম্মির কান্না ও দুই মামার অসহায় মুখ দেখে সামনে ছুটে গিয়ে নুজাইফা আমীনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘মাম্মি, কাঁদছ কেন? বাপি ঠিক আছে না?’
নুজাইফা আমীন কোনোমতে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে আঙুল দেখিয়ে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। নওমী তাঁকে দু’হাতে আগলে নিয়ে হসপিটালের সামনেই বসে পড়ল। এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সবকিছু কেবল দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। জীবনে এই ভয়ানক অধ্যায় কোনোদিন আসবে ভাবতেও পারেনি সে। কোনোদিন মনে হয়নি, বাপির নিষ্প্রাণ দেহ এইভাবে দেখতে হবে! এক জাহাঙ্গীর হোসেন তাদের গোটা সংসারের সব সুখকে কাঁচের থালাবাসনের মতো ভেঙে চুরমার করে দিল। মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে গেল নওমী।
মৃতদেহ অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলে মশিউর রহমান বোনকে অন্য গাড়িতে তুলে নওমীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
‘বাড়ি চলো মামণি।’
নওমী একপলক মামার দিকে তাকিয়ে অসহায় চোখমুখ নিয়ে বলল,
‘আমার বাপি খুব খারাপ একটা মানুষ, এটা কি সত্যি বড়ো মামা?’
‘এখন এসব কথা থাক্ মামণি। কে খারাপ, কে ভালো, তার পরিপূর্ণ হিসেব রবের নিকট আছে। তিনি নিশ্চয়ই উত্তম বিচারক।’
‘তোমরা এতগুলো দিন এসব কথা আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছিলে কেন?’
‘লুকিয়ে না রাখলে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যেত, মামণি। এসব নিয়ে ভেবো না আর। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। বাপির ওপর কোনো অভিমান ও অভিযোগ রেখো না। মানুষ জন্ম থেকে খারাপ কিংবা ভালো হয় না। পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা, সময়ের নিষ্ঠুরতা, এসবই একজন মানুষকে ভালো ও খারাপের হিসেব চিনায়। চলতে পথে কেউ ভালো হয়, কেউ হয় খারাপ। তোমার বাপিও তাদেরই একজন। তাকে মন থেকে ক্ষমা করে দাও।’
জাহাঙ্গীর হোসেনের সব কথা নওমীর প্রথমে বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু লোকটার নীরব আর্তনাদ নিজচোখে দেখে আর অবিশ্বাস্য মনে হয়নি। এতগুলো বছর ধরে যে বাবার আদর-শাসনকে আদর্শ বলে জানত, আজ জানল সেই মানুষটা নিজের কথাবার্তা, আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। মুখেই শুধু বড়ো বড়ো কথা বলে, জেনে-বুঝে অন্যায় করা, লোভী ও একজন খুনির সন্তান হিসেবে নিজের অবস্থান আবিষ্কার করে নওমীর আহাজারি বেড়ে গেল। খারাপ লাগল নিজের মাম্মির কথা ভেবে। মুখবুঁজে সব কষ্ট সহ্য করে একজন মা তাকে শুধু একটা সুন্দর পরিবার দেননি, বাবার প্রতি অসম্মান, ঘৃণা জন্মানোর কোনো সুযোগই রাখেননি। সবসময় বুঝিয়ে এসেছেন, তার বাবা একজন ভালো মানুষ। হয়তো একটু রাগী, অহংকারী, হয়তো একটু টাকার বড়াই আছে, তবে পরিপূর্ণ অসৎ নন। অথচ দিনশেষে, এই সবকিছুর পিছনের গোপন সত্যিটাই সে কোনোদিন জানতে পারেনি, জানার চেষ্টাও করেনি। চোখের সামনে সাজানো-গোছানো একটা সংসার দেখে নিজেকে এতদিন ভীষণ খুশি ভেবে আসা মেয়েটি আজ জানল, বাপির করা একেকটা অন্যায় কীভাবে তার মাম্মিকে শেষ করে দিয়েছে। সেদিন তার মামার কথাগুলোকে নিয়ে খুব একটা ভাবেনি নওমী, অথচ আজই সেইসব কথার গুরুত্ব অনুধাবন করে ভেতরটা একদম শূণ্য হয়ে যেতে লাগল।
মৃতদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স অনেক আগেই তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলেও নওমী বসে রইল নিজের জায়গায়। একদৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। হসপিটালের সব ঝুটঝামেলা শেষ করে নওমীকে নিয়ে গাড়িতে উঠল আদিয়ান। নওমী একেবারে শান্ত মেয়ের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেল। পুরোটা রাস্তা জুড়ে নীরবতার চাদরে ডুবিয়ে রাখল নিজেকে। আদিয়ান তাকে বুঝাল, সান্ত্বনা দিল, কত কথা বলল, তবুও নওমী কোনো কথারই যথোপযুক্ত প্রতুত্তর করল না। হুট করে খাওয়া পরপর দুটো ধাক্কা তাকে পুরোটাই স্তব্ধ করে দিয়েছে।
***
জানাযার নামাজ শেষে, সব মেহমান চলে গেলে, ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল, তবু নওমীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। ব্যস্ততায় আদিয়ানও খেয়াল করেনি, নওমীর এমন চুপ হয়ে থাকা। নুজাইফা আমীন নিজের রুমে বসে তাসবীহ পাঠ করছিলেন। নওমী ছোট্ট শামাকে কোলে নিয়ে ভীড় থেকে সরে এসে সেইযে রুমে ঘাপটি মেরেছিল, এখনও ওখানেই আছে। সারাদিন ধরে কিচ্ছু খায়নি। রুমঝুম খাবার প্লেট আদিয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ভাবীকে শিগগির ডাক্তার দেখাও, ভাইয়া। এখনও ধাক্কাটা হজম হচ্ছে না তার। সারাদিন ধরে খায়নি, ঘুমায়নি, কারও সাথে একফোঁটা কথাও বলেনি। এমন করে দিন কাটলে ও পাগল হয়ে যাবে।’
‘আমি দেখছি।’
রুমঝুমকে নিশ্চয়তা দিয়ে নওমীর রুমে এসে তাকে এত শান্ত হয়ে শামাকে নিয়ে বসে থাকতে দেখে কাছে এসে, খাবার প্লেট সেন্টার টেবিলে রেখে আদিয়ান বলল,
‘আমি শামাকে দেখছি, আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।’
নওমী নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়ল না। আদিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, একহাতে শামাকে আগলে অন্যহাতে নওমীর নিষ্প্রাণ মুখটা ছুঁয়ে, চোখেমুখে আঙুল বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘এমন করলে চলবে? সারাদিন ধরে কিচ্ছু খাননি। কারও সাথে কথাও বলেননি। যা হয়েছে, সেটাতে তো আমাদের কোনো হাত ছিল না, নওমী। আমরা চেষ্টা করেছি। রব যদি সহায় না হোন, যদি কারও মৃত্যু এভাবে লিখে থাকেন, সেটা আমরা আটকাব কী করে?’
এবারও নওমী কোনো উত্তর দিল না। একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আদিয়ান বউয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল,
‘আপনি ভেঙে পড়লে, মাকে কে দেখবে নওমী? মায়ের কথা ভেবে একটু সহজ হোন। কষ্ট হলে একটু কাঁদুন, প্রয়োজনে ভাংচুর করুন, আমার সাথে ঝগড়া করুন, তা-ও নিজেকে একেবারে গুটিয়ে রাখবেন না। এভাবে চললে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এখন আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। আমার জন্য নয়, মায়ের জন্য। মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে আপনাকে। মাকে ভালো রাখার চেষ্টায় নামতে হবে। আপনি ছোটো নন, নওমী। আমি জানি, আপনি এই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত। এবং নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আপনি মাকে আগলে রাখবেন, এ-ও নিশ্চিত। প্লিজ, একটু সহজ হোন। আপনার উচিত না, এখুনি মায়ের কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়া? তাকে ভরসা দেয়া? কী হলো, চুপ করে আছেন কেন? মায়ের কিন্তু আপনি ছাড়া আর কেউ নেই, এটা মাথায় রাখুন।’
আদিয়ানের প্রতিটা কথা ধীরেধীরে যখন শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে ধাক্কা মারল, চট করে হুঁশে এলো নওমী। শক্ত করে আদিয়ানের হাতটা ধরে রেখে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমার বাপি খুনি আর আমি তার সন্তান।’
আদিয়ান তাকে থামিয়ে বলল,
‘ওসব অনেক পিছনের কথা। ওগুলো ভুলে যান। আপনি শুধু বাবার আদর-স্নেহ-মায়া-মমতা এগুলোকে মনে রাখুন। আর রবের নিকট প্রার্থনা করুন। তিনি যেন বাবাকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করে নেন। করুণাময় চাইলে সব সম্ভব, নওমী।’
নওমী খাবারের প্লেটের দিকে চেয়ে জানতে চাইল,
‘মাম্মি খেয়েছেন?’
‘না, এখনও ঘরে বসে আছেন। আপনি নিজে তাকে খাইয়ে দিয়ে আসুন।’
নওমী তা-ই করল। একজীবন মা তাকে আগলে রেখে অনেক ত্যাগ করেছেন। আজ থেকে সে মাকে আগলে রাখতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা বিলিয়ে দিবে। যেভাবেই হোক, মাকে ভালো রাখতে হবে, মনে মনে এই পণ এঁটেই মায়ের রুমের দিকে অগ্রসর হলো নওমী। শামাকে কোলে নিয়ে পিছন পিছন আদিয়ানও এগোলো।
***
অন্ধকার রাতে জাহাঙ্গীরকে অর্ধমৃত বানিয়ে, বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে জিপ থামিয়ে রুমঝুমের ফোনে ডায়াল করল জাদীদ। রিসিভ হওয়ার পর বলল,
‘জাহাঙ্গীর আমার সামনেই আছে। তুমি কি তাকে কিছু বলতে চাও?’
রুমঝুম জানতে চাইল,
‘কোথায় আপনি?’
‘যেখানে শুভর লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে।’
‘আমি আসছি।’
‘এখন?’
‘হ্যাঁ, এখুনি আসব।’
‘তুমি রাস্তাঘাট চিনবে না, রুমঝুম। আদিকে নিয়ে এসো।’
রুমঝুম কোনো শব্দ করল না, ফোন রেখে আধঘণ্টার মধ্যেই বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়াল। তখনও জাদীদ ওই লোকটার হাত-পা ও চোখমুখে রুমাল বেঁধে তাকে ওখানেই ফেলে রেখেছে। রুমঝুম এসে দাঁড়াতেই জাদীদ লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল। চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে রুমঝুমের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
‘ওই মেয়েটাকে দেখেছেন? বয়স কত ওর? বিশ কি একুশ। এই বয়সে ওইটুকুন একটা মেয়ে বিধবা হয়েছে শুধু আপনার জন্য। নিষ্পাপ একটা সন্তান বাবা হারিয়েছে আপনার জন্য। বন্ধু হারিয়েছে আরেক বন্ধুকে। বাবা-মা হারিয়েছে সন্তানকে। এসব করে আপনার লাভ কী হলো? সেইতো আজ, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবেন?’
জাহাঙ্গীর হোসেন গুঙিয়ে উঠে রুমঝুমকে দেখে, জোরপূর্বক উঠে বসতে চাইলেন। জাদীদ তাকে লাথি মেরে দু’টো হাতে পায়ের সাহায্যে আঘাত দিয়ে বলল,
‘টাকা ও লোকের বলে বেঁচে থাকবেন ভেবেছিলেন, তাই না? এজন্য একটা অন্যায় করতে গিয়ে আরও দশটা অন্যায় করেছেন। কানা জব্বার সেজে সবার চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে অন্যায় কাজকর্ম করে গিয়েছেন। নিজের বন্ধুকেও ছাড় দেননি। দিনশেষে কী পেলেন আপনি?’
জাদীদ নিজের রিভলভার বের করে, জাহাঙ্গীরের মাথায় তাক করে ট্রিগারে চাপ দিতে গেলে রুমঝুম বলল,
‘দাঁড়ান জাদীদ ভাই, আপনি নন, ওনাকে আমি মারব। আমাকে বিধবা করার শাস্তি আমি ওনাকে দেব। আমার সন্তানকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করার শাস্তি আমি ওনাকে দেব।’
‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? আইন নিজের হাতে তুলে নিবে?’
‘আমি জানি এটা অন্যায়। তবুও বলছি। এই লোকটাকে আমিই তার অন্যায়ের শাস্তি দিব।’
শত অনুরোধেও কাজ হচ্ছে না দেখে রুমঝুমের কথাই রাখল জাদীদ। পকেট থেকে গ্লাভস্ বের করে দিলে, রুমঝুম সেই গ্লাভস্ পরে, পিস্তল হাতে নিয়ে, জাহাঙ্গীরের মুখোমুখি বসল। সম্পূর্ণ মুখটা পিস্তলের সামনের অংশ দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে শুভর আধপোড়া দেহখানি দু’চোখের পাতায় এঁকে বলল,
‘যতখানি কষ্ট সেদিন শুভ পেয়েছে, তারচে দ্বিগুণ, তিনগুণ কষ্ট আজ আমি আপনাকে দেব। মৃত্যুযন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ হয়, আপনি সেটা নিজ চোখেই দেখবেন।’
জাহাঙ্গীর হোসেন নিজেকে বাঁচানোর কোনো উপায় পেলেন না, চেষ্টাও করলেন না। শুধু বিস্মিত চোখে রুমঝুমকে দেখলেন। ধুমধাম শব্দে আনাড়িহাতে কয়েকটা গুলি ছুঁড়ল রুমঝুম। লোকটা গুঙিয়ে গেল কতক্ষণ। ছটফট করল। একসময় সেই গোঙানি ও ছটফটানি থেমে গেলে নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন পড়ে থাকলেন নদীরপাড়ে। জাদীদ রিভলভার নিজের হাতে নিয়ে, গ্লাভস্ পকেটে ঢুকিয়ে, জাহাঙ্গীরের লাশটা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে বলল,
‘বাসায় যাও। কুইক।’
রুমঝুম হতভম্ব হয়ে বলল,
‘আপনি যাবেন না?’
‘যাব। একটু পর এখানে আরও পুলিশ আসবে, সাংবাদিক আসবে। অনেক ঝামেলার মুখে পড়তে হবে আমাদের। তুমি থাকলে বিপদ হবে। যাও এখান থেকে।’
‘কিন্তু খুনটা তো আমি করলাম, বলে দেব সবাইকে।’
জাদীদ চট করে রুমঝুমকে থামিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
‘বাসায় যেতে বলেছি না? এখুনি বাসায় যাও। আর এই খুন নিয়ে একটাও শব্দ করবে না। কাউকে কিচ্ছু বলবে না।’
‘কেন?’
‘শামাকে সুন্দর একটা জীবন দিতে চাও না?’
রুমঝুম এবার জাদীদের কথার অর্থ ধরতে পেরে বলল,
‘আপনি ফেঁসে যাবেন না তো?’
‘আমার কিছুই হবে না, রুমঝুম। তবে তুমি এখানে থাকলে ফেঁসে যাবে। শামার জীবন নষ্ট হবে। ওর জন্য হলেও তুমি এখান থেকে যাও। আমি এদিক সামলে নিতে পারব।’
রুমঝুম মূল রাস্তায় এসে বাসার দিকে রওনা দিল। জাদীদ নিজেও থানায় এসে নিজের সঙ্গে থাকা আইনের সরঞ্জাম জমা দিয়ে সিনিয়র অফিসারকে বলল,
‘আ’ম স্যরি, স্যার। আজ থেকে এই পেশা ও যাবতীয় দায়-দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। এই পেশা আমার জন্য নয় আর আমি এর যোগ্য নই। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
***
পরিশিষ্ট –
ছোট্ট শামা এখন টুকটুক করে হাঁটে। ছোটো ছোটো পা ফেলে সারাঘর দৌড়ে। বাবা ও দাদীর চোখের মণি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার খিলখিল হাসি ও আধোমুখের ভাষাতে ঘরময়জুড়ে বয়ে বেড়ায় আনন্দ আর হাসি। রুমঝুম প্রাণ ফিরে পায়। মেয়ের হাসিমুখের দিকে তাকালে পিছনের স্মৃতিগুলো এখন আবছাই মনে হয়। ক্ষণে ক্ষণে যখন স্মৃতি ধাক্কা মারে তখন ছুটে যায় শুভকে দেখতে, তার গ্রামের বাড়িতে। শুভর বাবা ও মা কারও সাথেই দেখা করে না। শুধু কবরস্থানে দাঁড়িয়ে দোয়াদরুদ পড়ে চলে আসে। আজ শুভর চতুর্থতম মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে জীবন থেকে অনেকগুলো দিন কেটে গেলেও প্রগাঢ় অনুভূতি হয়ে শুভ আজও বেঁচে আছে তার ঝুমের হৃদয়ে। রাজশাহীতে আজ শুভর জন্য একটা মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই সেখানেই যাবে। মেয়েকে জামাকাপড় পরিয়ে রুমঝুম বলল,
‘দাদীর কাছে থাকো কিচ্ছুক্ষণ। মা তৈরী হয়ে আসি?’
শামা একছুটে মাজেদা খাতুনের রুমে চলে গেলে রুমঝুম আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে, গায়ে জড়িয়ে, চুলের বেণী খুলে চিরুনী দিয়ে চুল আঁচড়াতে বসল। এমন সময় সাউন্ড দিয়ে ফোন এলে রুমঝুম গলা উঁচিয়ে বলল,
‘আপনার ফোন বাজছে তো। এতক্ষণ লাগে ওয়াশুরুমে গেলে? ঘুমিয়ে পড়েছেন না কি? ভাইয়া কল দিচ্ছে।’
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টাওয়েল দিয়ে ভেজা চুল মুছে বিছানার উপরে থাকা ফোন হাতে তুলল জাদীদ। রিসিভ করে প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে, ফোন রেখে রুমঝুমের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘মানুষ কি ওয়াশরুমে ঘুমানোর জন্য যায়?’
রুমঝুম মিটিমিটি হেসে, চুল ঠিকঠাক করে, স্কার্ফ মাথায় চাপিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে বলল,
‘ভাইয়া-ভাবী বের হয়েছে?’
‘হুঁ…।’
জাদীদকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমঝুম ফের বলল,
‘আপনি তৈরী হচ্ছেন না কেন? যাবেন না?’
‘যেতেই হবে?’
রুমঝুম আলগোছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘আপনি যদি এমন করেন, আমার সহজ দিনগুলোও কঠিন হয়ে যাবে। প্লিজ, মনের ভেতর অকারণ কোনো নেগেটিভ ভাবনাকে ঠাঁই দিবেন না। আমি নিজের জায়গায় সৎ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, পিছনের স্মৃতিগুলো মনের একপাশে আগলে রেখে সামনে এগোতে। এখন আপনি যদি ভুলভাল চিন্তা মাথায় গেঁথে রেখে দিন কাটান, কেমন লাগে বলুন তো?’
জাদীদের মন খারাপের কারণটা ভিন্ন। প্রতিবার রুমঝুম যখন রাজশাহীতে যেত, সে একজন ভালো বন্ধু হিসেবে পাশে থাকত। আদিয়ান ও নওমী দু’জনেও থাকত। এই কিছুমাস আগেই হুট করে মাজেদা খাতুনের স্ট্রোক হওয়ার কারণে, তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ঘর-সংসার সামলে নিয়মিত ডিউটি করা জাদীদের জন্য কঠিন হয়ে গেল। ওইদিন সে স্বেচ্ছায় কর্মের ইস্তফা দিয়ে এলেও, রুলস্ অমান্য করার কারণে তাকে ছ’মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল। তবে ছ’মাস পর আবারও তাকে সিনিয়র অফিসারের অনুরোধে কাজে জয়েন করতে হয়েছে। মাজেদা খাতুনকে একা বাসায় রেখে গিয়ে শান্তি পেত না জাদীদ। তার বাবাও অসুস্থ মানুষ। নিজেকে সামলাবেন না কি স্ত্রীকে? রুমঝুমও মাঝেমধ্যে মেয়েকে নিয়ে এখানে আসত। মা হারিয়ে, মায়ের আদর ও শাসনের যতটুকু মাজেদা খাতুনের কাছ থেকে পেয়েছিল, সেইটুকুর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা জানিয়ে, রুমঝুম এই অসুস্থ মায়ের কথা রেখেছে। সেদিন যখন মাজেদা খাতুন রুমঝুমের দু’হাত ধরে অনুরোধ করে বললেন,
‘তুই আমার মেয়ের মতো, ঝুম। আমি জানি, আমার এই আবদার করা সাজে না। তবুও চাইছি, তুই আমার ঘরে চলে আয়। আমার ছেলের বউ হয়ে। কথা দিচ্ছি, তোর পিছনের জীবন নিয়ে কোনোদিন কিচ্ছু বলব না। শুধু আমার ছেলেটার দায়িত্ব নিয়ে ওর পাশে দাঁড়া, মা। তুই-ই পারবি, এই মৃতপ্রায় সংসারকে বাঁচিয়ে তুলতে।’
রুমঝুম সেদিন আর মাজেদা খাতুনকে ফিরিয়ে দেয়নি। ঋণ শোধ করার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছিল। মাজেদা খাতুনের সেবা করা, ঘর-সংসার সামলানো ও নিঃস্বার্থভাবে পাশে থাকা একটা মানুষের সঙ্গিনী হয়ে এই ঘরে পা রাখতে তার দ্বিধা-সংকোচ কিচ্ছু হয়নি। বরং মনের ভেতরে জমে থাকা অপরাধবোধের বোঝা থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। তবে এই কাজে জাদীদ সন্তুষ্ট থাকলেও শুভর কথা মনে হলেই খারাপ লাগা বেড়ে যাচ্ছে। শুভর কবরের সামনে দাঁড়াতেও সংকোচ হচ্ছে। এজন্যই নিশ্চয়তা চাইছিল যে, যেতেই হবে কেন!
রুমঝুমের কথা শোনে জাদীদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে কানে আঙুল ছুঁয়ে বলল,
‘স্যরি, আমি এখুনি তৈরী হচ্ছি।’
গাড়িতে উঠতে শামা তার বাবার কোলে লেপ্টে গেল একদম। আর কারও কোলেও যাচ্ছে না। আদিয়ান ও নওমী দু’জনেই ডাকল। শামা কারও কোলে গেল না। চুপটি করে জাদীদের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকল। লম্বা জার্নি দেখে রুমঝুমও বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। জাদীদ একটা হাতে মেয়েকে আগলে রাখল, অন্যহাতে বউকে। ওইমুহূর্তে রুমঝুমকে ভীষণ সুখী রমণীর একজন, মনে হলো নওমীর। সে একহাতে আদিয়ানকে আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘সময় সব অপূর্ণতা দূর করে দেয়, আদি। এই ঝুমের জন্য কত চিন্তায় ছিলাম আমরা। আজ ওকে সুখী দেখে ভীষণ ভালো লাগছে।’
আদিয়ান বলল,
‘এমনিতেও ওর একটা ভুল ওকে অনেক ভুগিয়েছে।’
‘হ্যাঁ…।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল নওমী। আদিয়ান তার কপালে ছোটো করে আদর দিয়ে বলল,
‘আমাদের জীবনে যত অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তি আসবে, সবটুকু অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তি দূর করে নিব একে-অন্যকে ভালোবেসে। আমি আপনার হয়ে বাঁচব আর আপনি আমার হয়ে। জীবন নিয়ে অভিযোগ করার কোনো সুযোগ থাকবে না আর।’
ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জীবনে প্রত্যেকেই কমবেশি সুখী হয়। নওমীও বলতে গেলে একজন সুখী নারী। তোফাজ্জল হোসেনের মৃত্যুর পর মায়ের দায়িত্ব নিতে গিয়ে নওমী উপলব্ধি করেছে, চলতে পথে কতখানি ধৈর্য্য ও শ্রম দিতে হয়। কখনও কখনও নিজের স্বপ্নকেও বিসর্জন দিতে হয়। যেমনটা দিল সে নিজে। নিজের সবটুকু স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে, লন্ডনে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে, মায়ের সেবাযত্ন করতে, চিরদিন তার পাশে থাকতে, বাবার বিজনেসের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল নওমী। এখন তার দু’চোখে স্বপ্ন ও চাওয়া একটাই, আপন মানুষগুলোর বিশ্বাস, ভরসা ও ভালোবাসায় বেঁচে থাকা। হাঁটি হাঁটি পায়ে পায়ে সময় যেমন সামনে এগোচ্ছে, জীবনের অন্তিমমুহূর্ত ততই ঘনিয়ে আসছে। এভাবে একদিন সবাই-ই চলে যাবে, এই পৃথিবী ছেড়ে, অনেকদূরে।
বন্ধ চোখের পাতায় যত ভাবনার জন্ম হলো, সব ভাবনাদের থামিয়ে দিয়ে, প্রিয়জনের ভালোবাসায় নিজেকে আগলে নিয়ে নওমী বলল,
‘আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা ও অপ্রাপ্তি নেই, আদি। আপনাকে পেয়ে জীবন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রবের নিকট প্রার্থনা, তিনি আমাদের এই পথচলা দীর্ঘ থেকে আরও দীর্ঘতর করুন, যেন জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও আমরা একে-অন্যের হাত ধরে রাখার প্রতিজ্ঞায় অটুট থাকতে পারি, বেঁচে থাকতে পারি একে-অন্যের মাঝে, বাঁচিয়ে রাখতে পারি অন্যসব সম্পর্ককেও।’
***
সমাপ্ত…