#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩
ঘুম ভাঙার পর ব্রাশে টুথপেস্ট নিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে বাড়ির আঙিনায় চক্কর দিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসেছে আদিয়ান। ভোরের স্নিগ্ধ-সুন্দর আলো ও শীতল বাতাস গায়ে মেখে, হাতমুখ পরিষ্কার করছিল। পিছনে যে তার আম্মি এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা সে দেখেনি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে মাকে দেখে একগাল হেসে আদিয়ান বলল,
‘এত সকালে ঘুম ভেঙে গেল?’
আলেয়া বেগম চোখ কটমট করে ছেলের দিকে তাকালেন। অকারণ মায়ের এই রাগের কারণ কী বুঝলো না আদিয়ান। ঠোঁট উলটে জানতে চাইল,
‘কী হলো? এমন করে তাকিয়ে আছো কেন? ভূত দেখলে না-কি?’
আলেয়া বেগম শক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘রাতে তুই তোর রুমে ঘুমিয়েছিস? তোর তো ঝুমের কাছে থাকার কথা। ওর রুম ভেতর থেকে লক করা। তোর রুমের দরজা খোলা। তুই বাইরে। কী এসব?’
‘এইরে কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে’ বিড়বিড়িয়ে এইটুকু জপে মায়ের আঁচলে মুখ মুছে নিল আদিয়ান। কিচ্ছুটি বুঝতে দিবে না এমন একটা ভাব নিয়ে বলল,
‘ঘুমিয়েছি আমার রুমে এতে সমস্যা কী?’
‘তোরা বিয়ে করেছিস তো?’
মা সন্দেহ করছেন এটা বুঝতে পেরে উপরনিচ মাথা ঝাঁকালো আদিয়ান। আলেয়া বেগম বললেন,
‘তাহলে আলাদা কেন?’
‘তুমি তো জানোই, ঝুমের হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস। তাছাড়া ও নিজের পাশে একটা পাশবালিশের বেশি বাড়তি কিছু সহ্য করতে পারে না। একসাথেই ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই আমাকে লাতি দিয়ে নিচে ফেলে দিল। খুব ব্যথা পেয়েছি। পরে রাগ করে আমার রুমে এসে ঘুমিয়েছি।’
আলেয়া বেগম যেন আকাশ থেকে টপকালেন। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থেকে বললেন,
‘ঝুম তোকে লাতি মেরেছে? আমাকে বললি না কেন?’
‘হ্যাঁ, মেরেছে। কোমরে ভীষণ ব্যথা পেয়েছি। একটু গরম পানি দিও তো। সেঁক দিতে হবে। ব্যথাটা গিঁট ধরে বসে আছে। আর শোনো, লাতি মারুক কি চড় মারুক, ওটা ওর আর আমার ব্যাপার। মাঝরাতে এসব কথা তোমাকে বলতে যাব কেন? আমার কি ইজ্জত নেই?’
‘তাই বলে স্বামীর গায়ে হাত তুলবে? মেয়েটা দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে।’
‘আহা, তুমি ভুল ভাবছ আম্মি। হুট করে বিয়ে হয়েছে, মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। আমার নিজেরই কেমন কেমন লাগছে।’
‘এটা কেমন কথা?’
‘তুমি বুঝবে না। যাও, চা বসাও। কড়া করে লিকার দিবে। ঢাকায় গেলে তোমার হাতের চা ভীষণ মিস করি। ওহ, শোনো, ফেরার পথে ঝুমকে সাথে নিয়ে যাব। ওখানেই ভালো একটা কলেজে ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেব। তোমরা কোনো আপত্তি কোরো না।’
আলেয়া বেগমের উত্তরের অপেক্ষায় রইল না আদিয়ান। মামাতো ভাই-বোন ছোটোগুলো সবাই একসাথে পাড়ার মসজিদে যেতে রওনা হয়েছে। ওদের পিছুপিছু সে-ও ছুটলো।
***
খেতে বসে খাবারে গন্ধের জন্য কোনোকিছুই মুখে নিতে পারল না রুমঝুম। সামান্য পানিটুকুতেও বাজে গন্ধ ছড়িয়েছে। মনে হচ্ছে পেটের নাড়িভুঁড়ি একসাথে কুণ্ডলি পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হুটহাট এই পরিস্থিতি তৈরী হওয়াতে মুখে হাত চেপে বেসিনের কাছে চলে গেল সে। আলেয়া বেগম প্রচণ্ড অবাক হয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ?’
হাত-মুখ ভালোমতো ধুয়ে রুমঝুম বলল,
‘তেমন কিছু না, ফুপি। গ্যাস্ট্রিক বেড়ে গেছে হয়তো। পেট ফেপে ঢোল হয়ে আছে।’
এতকিছু ভাববার সময় পেলেন না আলেয়া বেগম। ধরে নিলেন গ্যাস্ট্রিকের জন্যই এমন হয়েছে। কড়া শাসনের স্বরে বললেন,
‘কতবার বলেছি, বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা খাবার খাবি না। তোরা আমার কোনো কথা শুনিস না। হাবিজাবি খাবি আর অসুস্থ হয়ে আমাকে জ্বালাতন করবি। এত পেরেশানি আমার আর ভালো লাগে না।’
‘বকো না তো। তুমি নাশতা কোরো। আমি একটা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেয়ে আসি।’
এ যাত্রায় রক্ষা পেল রুমঝুম। রুমে গিয়ে চুপটি করে বসে রইল। নিজের বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভেবে খুবই খারাপ লাগল তার, সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগল শুভর কথা ভেবে। ক্ষণিকের মেহমান হয়ে জীবনে এসে কোথায় যে হারিয়ে গেল, যেন একটা অতিথি পাখি। একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসে, মায়া বাড়িয়ে আবারও অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। মন খারাপের এই সময়টায় কিছু সুখ সুখ ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখল সে। শুভকে ঘিরে কত সুখকর মুহূর্ত এসেছিল জীবনে। সেইসবই তার মৃতপ্রায় মনকে সজীব করে তুলল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে একাকী বিড়বিড় করতে লাগল। যদি যোগাযোগ করা যায়, এই ভেবে শুভর নম্বরে লাগাতার কল দেয়া অব্যাহত রাখল। ওপাশ থেকে ফোন ‘সুইচড অফ’ বলার পরও থামার নাম নিল না। টানা কয়েক মিনিট পরও যোগাযোগ করতে না পেরে প্রচণ্ড কান্না পেল তার। কেউ এইভাবে কেন হারিয়ে গেল? কোথায় খুঁজবে সে? একজীবনে ভালোবাসা নামক দামী অনুভূতিকে এত কাছে পেয়েও কেন হারিয়ে ফেলল? এমন সব আফসোস তাকে আরও অস্থির, অশান্ত করে দিল। অসহায়ের মতো কেঁদেকেটে মাথা ধরিয়ে ফেলল। রান্নাঘর থেকে আলেয়া বেগমের ডাক শোনা গেলে ঝটপট দু’হাতে চোখ মুছে, খাবার টেবিলের সামনে গেল। আদিয়ান পেটপুরে খাচ্ছে। যেন কতদিন খেতে পায় না। এই দৃশ্য দেখে রুমঝুমের ভীষণ খারাপ লাগল। অভিযোগের সুরে বলল,
‘তুমি কেমন বন্ধু, হ্যাঁ? এতদিন ধরে বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারছ না। দিনরাত কী কোরো? ঘোড়ার ঘাস কাটো?’
মেয়ের মুখে এই কথা শোনে অবাক হলেন রাশেদুজ্জামান। এদিকে আদিয়ান নির্বিকার। সে নিঃশব্দে খাচ্ছে। এইমুহূর্তে খাওয়াটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আর কিছু না। মেয়েকে শান্ত করতে তিনি বললেন,
‘আদির যা করার সেটা ও করেছে। গ্রামের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়েছে। লোকাল থানায় মিসিং ডায়েরি করেছে। নিখোঁজ সংবাদ ছাপিয়েছে। এরবেশি আর কী করবে? তাছাড়া, তুই শুভকে নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন? ওর বাবা-মা আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, তারা দেখবে। আমাদের কী?’
গলার পানি শুকিয়ে এলো রুমঝুমের। বলল,
‘আমাদের এখানে তো রোজ রোজ আসত। তাই জানতে চাইছি। হুট করে কোথায় গায়েব হয়ে গেল, এটা ভেবে তোমার খারাপ লাগছে না, আব্বু? আমার তো ভীষণ খারাপ লাগছে। জলজ্যান্ত একটা মানুষ কীভাবে না-ই হয়ে গেল ভাবো তো।’
রাশেদুজ্জামান মলিনমুখে বললেন,
‘তা তো লাগছেই। বড়ো ভালো একটা ছেলে ছিল। নম্র-ভদ্র। সাত চড়ে রা কাড়ত না।’
আদিয়ান একবার কড়া চোখে তাকিয়ে চোখের ইশারাতেই শাসন করে দিল রুমঝুমকে। কথা এড়িয়ে যেতে বমি বমি ভাব নিয়ে খেতে বসলো রুমঝুম। খুব কষ্টে একটা রুটিই খেতে পারল আর খাওয়া গেল না। জোর করলে হিতে বিপরীত হতে পারে বুঝে একগ্লাস পানি খেয়ে চেয়ার ছাড়ল। রুমঝুম চলে গেলে ওর বলা কথাগুলো ভাবতে লাগল আদিয়ান। জলজ্যান্ত মানুষ কোথায় হাওয়া হতে পারে? এটা কি নিছকই একটা দুর্ঘটনা না-কি পূর্ব পরিকল্পিত? যদিও বন্ধুকে নিয়ে এরকম একটা নেগেটিভ ভাবনাকে মনে ঠাঁই দিতে চাইছে না, তবুও মনে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। কোনো খোঁজখবর নেই, দুর্ঘটনা স্থলে মৃতদেহ নেই, বাড়িতেও নেই, কোত্থাও নেই। আছে তাহলে কোথায়? সে ভাবনারত মন নিয়েই বলল,
‘বড়ো মামা, শুভর কোনো বদভ্যাস তোমার চোখে পড়েছে? এমনটা কি হতে পারে, কোনো কারণে ও গা ঢাকা দিয়েছে? যার কারণে আমাদের সামনে আসতে পারছে না বা আসতে চাইছে না।’
রাশেদুজ্জামান স্পষ্ট স্বরে বললেন,
‘বদভ্যাস তো অনেকগুলো আছে। তবে এটা সত্যি যে ও যথেষ্ট সৎ ও সাহসী একটা ছেলে।’
আদিয়ান এবার একটু চালাকির সাথে জানতে চাইল,
‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ, শুভ আপাদমস্তক ভদ্র ছেলে?’
‘বদভ্যাসগুলো ছেড়ে দিলে, ভদ্রই।’
‘যদি শুভ ও আমার মধ্যে যেকোনো একজনকে ঝুমের জন্য বাছাই করে নেয়ার প্রশ্ন আসে, তাহলে তুমি কাকে বেছে নিতে?’
‘তোকে।’
এক শব্দে উত্তর দিলেন রাশেদুজ্জামান। আদিয়ান অবাক হয়ে জানতে চাইল,
‘আমাকেই কেন, বড়ো মামা? শুভ তো ভালো ছেলে। তাহলে তাকে কেন নয়?’
‘শুভ ভালো তার মানে এই না যে, ও আমার ঝুমের যোগ্য।’
‘এখানে যোগ্যতার প্রশ্ন আসছে কেন? সততা ও মনুষ্যত্ব কি ব্যক্তি চেনার প্রধান মাধ্যম হতে পারে না?’
‘সব ক্ষেত্রে পারে না।’
‘যেমন?’
‘শুভ সৎ হলেও ওর জাত-বংশ কিন্তু ভালো না।’
‘এইটুকুই? জাত-বংশ কি মানুষের ভালোত্বের সার্টিফিকেট দিতে পারে?’
‘সেটার ব্যাখ্যা তো আমি এখুনি তোকে দিতে পারছি না, আদি। তবে তোর একটা কথা যৌক্তিক যে, এটা ইচ্ছাকৃত সরে যাওয়া কি-না। আমার মনে হয়, এটা হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। মানুষ কিন্তু নিজের মধ্যে অনেক রূপকে বাঁচিয়ে রাখতে জানে। যখন-তখন রূপ বদলানো কিছু কিছু মানুষের স্বভাবগত দোষ। শুভ যে রূপ বদলায়নি, এর কি নিশ্চয়তা?’
‘আমিও তো পাল্টাতে পারি। তাই নয় কী? আজ তুমি যে-ই আমিকে দেখছ, কাল হয়তো সেরকম না-ও থাকতে পারি। তখন কী করবে?’
‘ধরে নেব আমার বোঝায় ভুল আছে।’
‘তারমানে শুভকে তুমি ঠিক চিনেছ?’
‘সেটা তো বলতে পারছি না, বাবা। তবে এটা নিশ্চিত যে, শুভ ও তোর মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য আছে। আমি শিওর, সে-ই পার্থক্যগুলো তুই নিজেও জানিস। আর ওই পার্থক্যের কারণেই তোকে আমার পছন্দ।’
***
চিন্তিত মন নিয়ে নিজের রুমে বসে বন্ধুর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে নিজস্ব কিছু ভাবনায় ডুবেছিল আদিয়ান। তারমধ্যেই রুমঝুম ছুটে এলো। ঝড়েরবেগে রুমে প্রবেশ করে এদিক-ওদিক কিছু খুঁজতে আরম্ভ করেছিল সবে। সেটা দেখে আদিয়ান বলল,
‘আমার রুমে কী খুঁজছিস?’
ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টিতে একনজর তাকিয়ে খোঁজাখুঁজিতে মনোযোগ দিল রুমঝুম। আশেপাশে প্রয়োজনীয় কিছু না পেয়ে, বিছানা থেকে বালিশ এনে উরাধুরা কয়েকটা বসিয়ে দিল আদিয়ানের পিঠে। শক্ত মেজাজে বলল,
‘ফুপিকে কী বলেছ তুমি? আমি তোমাকে লাতি মেরেছি? রুম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি? মিথ্যুক। মিথ্যে বলার আর মানুষ পেলে না? ফুপি কত বকেছে আমায়, জানো? মেরেছি না? এখন দেখো, মার কাকে বলে।’
বকা খেয়ে রুমঝুম আর নিজের মধ্যে নেই, অনবরত মেরেই যাচ্ছে। আদিয়ান জানে, ক্ষ্যাপে গেলে একেবারে অবুঝ শিশুর মতো হয়ে যায় এই মেয়ে। এমনিতেও বয়স কম। বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা কম, তারমধ্যে অকারণ বকাবকি শুনলে মাথা আর ঠিক থাকে না। মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবে এজন্য সে আর ফেরাতে গেল না। পিঠে কয়েকটা সয়ে নিয়ে বলল,
‘আমার কি দোষ? তোর রুমে থাকলে সমস্যা, আমার রুমে থাকলে সমস্যা? আমি তাহলে যাব কই? আজ যা হচ্ছে, সেসব তো তোর জন্যই হচ্ছে। আমি কী করব? যে দুর্ঘটনা তুই ঘটিয়েছিস, সেটা বলার মুখ রেখেছিস?’
এত কথা শোনে চুপসে গেল রুমঝুম। বালিশ রেখে বিছানায় বসে আফসোসের সাথে বলল,
‘তুমি শুধু আমার দোষটাই দেখলে। তোমার বন্ধুর দোষ দেখলে না? ও একটা বেঈমান। বাড়িতে ম্যানেজ করবে বলে কোন মেয়ের পিছনে ছুটেছে, দেখো। ওকে সামনে পেলে…।’
‘আহ, ঝুম। বিশ্বস্ত মানুষকে নিয়ে এইসব কথা বলতে নেই। আমাদের হয়তো ভাবনায় ভুল হচ্ছে। ও হয়তো কোনো বিপদে আছে।’
এটা তো ভেবে দেখেনি রুমঝুম। যদি এরকমটা হয়, কী হবে তাহলে? কোথায় গিয়ে খুঁজলে শুভকে পাবে? আতঙ্কিত মন নিয়ে বলল,
‘সত্যিই যদি কোনো বিপদে পড়ে থাকে? আচ্ছা, ও তো আমাদের দু’জনেরই নম্বর জানে। বিপদে পড়লে তো একবার জানাতেই পারত।’
‘হয়তো জানানোর মতো পরিস্থিতি নেই। তুই চিন্তা করিস না। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই কোনো একদিন আমরা ওর দেখা পাব।’
‘ও বেঁচে আছে তো, ভাইয়া?’
ঠিক এই প্রশ্নটাই অনেকক্ষণ ধরে আদিয়ানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ভেবে কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। প্রাণের বন্ধু কোনোভাবে তাকে ধোঁকা দিল না তো। ভাবতে গিয়েও টের পেল, বন্ধুকে নিয়ে আজ সে বার বার নেগেটিভ ভাবনাকেই মনে ঠাঁই দিচ্ছে। নিজেকেই একগাদা বকে দিল। এদিকে রুমঝুম কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল। প্রথমে আস্তে, এরপর শব্দ করে। আদিয়ান চমকে গিয়ে বলল,
‘এখানে আবার কাঁদার কী হলো?’
রুমঝুম কান্নারত মুখে বলে উঠল,
‘ও যদি আর বেঁচে না থাকে? আমার বাচ্চাটার কী হবে, ভাইয়া? কী হবে…!’
এই মেয়েটা দিনদিন ছিঁচকাদুনে হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর। অথচ আগে এমন ছিল না। সদা হাস্যজ্বল রমণী ছিল, দিনে চব্বিশঘণ্টা আমোদে থাকত। দুষ্টুমি, চঞ্চলতা ও হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে বাঁচিয়ে রাখত নিজেকে। এখন দিনের বেশিরভাগ সময়ই কেঁদেকেটে অস্থির থাকে। দুঃশ্চিন্তায় ও প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার দুঃখে, তার অবুঝ মন ভীষণ আতঙ্কিত থাকে। ছোটো হলে এইভাবে কাঁদার জন্য দু’হাতে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে হাতে অনেকগুলো চকলেট ধরিয়ে দিতে পারত আদিয়ান। যেমনটা সে এতগুলো বছর করেছে। কিন্তু কিশোরী বয়স ছাড়িয়ে রুমঝুম যবে থেকে তারুণ্যে পা রেখেছে, সেদিন থেকে এই অভ্যাসটা বদলে ফেলেছে সে। এখন রুমঝুমকে ছুঁতে গেলেও সংকোচ হয় তার। কেবলই ভরসা দিয়ে হাত ধরতে পারে, এরবেশি কিছু না। সে রুমঝুমের কান্না থামানোর কোনো উপায় না পেয়ে বলল,
‘শোন, ঝুম। একটা ঝামেলার মধ্যে আছি। এখানে থাকলে আমাদের আলাদা আলাদা থাকতে হবে। আমি সাতদিনের জন্য এসেছি। সাতদিনই যদি আম্মির চোখে পড়ে যাই, খুব সমস্যা হয়ে যাবে। বলা যায় না, আম্মি সবকিছু বুঝে ফেলতে পারে।’
চোখমুখ মুছে রুমঝুম বলল,
‘তাহলে উপায় কী?’
‘তুই আমাকে বিশ্বাস করিস, ঝুম?’
‘এটা আবার কেমন কথা? তোমাকে অবিশ্বাস কেন করব? বিশ্বাস করি বলেই তো এতবড়ো রিস্ক নিলাম।’
‘গুডগার্ল। এখন যা, ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে নে। একটু পরই আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিব।’
‘আজই?’
‘হ্যাঁ, আজই। তাড়াতাড়ি কর, যা।’
‘বাবাকে কী বলব? তুমি তো ছুটিতে এসেছিলে।’
‘জানি, কিন্তু এখন বলব, ছুটি ক্যান্সেল। আগামীকাল অফিসে জরুরী মিটিং, থাকতেই হবে। তাছাড়া, নওমী। ওর কথাও তো ভাবতে হবে, আমাকে। তাই না?’
ভেবেচিন্তে সম্মতি জানিয়ে রুমঝুম বলল,
‘ঠিক আছে। আমি তৈরী হচ্ছি। তুমি বাবাকে ম্যানেজ কোরো।’
***
চলবে…