পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-০৪

0
24
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৪

হঠাৎ করে ঢাকায় যাওয়ার কথা শোনে রাশেদুজ্জামান অবাক হলেও আদিয়ানের চাকরীর কথা ভেবে নিমরাজি ভাব নিয়ে বললেন,

‘তুই ঝুমকে রেখে যা। ওকে সাথে নিতে হবে কেন? তাছাড়া তুই থাকিস ব্যাচেলর বাসায়, ওকে নিয়ে রাখবি কোথায়?’

এই সমস্যার কথা এতক্ষণ মাথাতেই আসেনি আদিয়ানের। সে শুধু রুমঝুমের শারিরীক অসুস্থতার কথা ভেবেই ঝুঁকের মাথায় এতগুলো কাজ করে ফেলেছে। সে যে বাসায় থাকে, সেখানে তার রুমমেটরা আছে। চারজন মিলে একটা বাসা শেয়ার করে থাকে। এরমধ্যে ওই বাসায় রুম মাত্র দুইটা। দুই রুমে তাদেরই থাকা-খাওয়া ঝামেলার। এটা যে কেন আগে মাথায় এলো না! আজ যদি ঢাকাতে ফিরে যায়, একদিনে নতুন বাসা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যদি পাওয়াও যায়, ভাড়া দিতে হবে দ্বিগুণ। তার যা মাসিক বেতন, একা থাকে বলে হয়তো কয়েক হাজার টাকা বেঁচে যায়, যে টাকাগুলো সে ব্যাংকে জমা রাখতে শুরু করেছে। কিন্তু দু’জনের! এখানে বাড়তি কিছু টাকা খরচ হবেই। না চাইতেও রুমঝুমের দায়িত্ব এখন তার হাতেই, যতদিন না শুভ ফিরে আসছে। অনেক ভেবেচিন্তে একটা ছোট্ট সমাধান পেয়ে বলল,

‘তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি ঠিক সামলে নেব।’

এরপর রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর সব দরকারী কাগজপত্র সঙ্গে নে। অ্যাডমিশনের সময় দরকার হবে। বার বার এখানে আসবে কে? আমি একবার কাজে ডুবে গেলে এত সহজে ছুটি পাব না।’

ঘাড় নাড়িয়ে নিজের প্রয়োজনীয় সবকিছু গোছানোর অজুহাতে রুমে চলে গেল রুমকি। যাবে যেহেতু অনেকদিনের জন্য, কিছুই ফেলে যাওয়া যাবে না। যা কিছু প্রয়োজন, সবটাই একটা লাগেজে গুছিয়ে নিল সে। ঢিলেঢালা একটা গোল টপস পরে, ওড়না বেঁধে বেরিয়ে এলো। বাবা ও ফুপির থেকে বিদায় নিতে গিয়ে সবাইকে ধোঁকা দেয়ার কথা ভেবে কেঁদে ফেলল। সম্মান বাঁচাতে কত মিথ্যের আশ্রয় নিতে হচ্ছে আজ। তার কান্না দেখে আলেয়া বেগম বললেন,

‘বোকা মেয়ে, এখানে এত কাঁদার কী আছে? স্বামীর সংসারেই তো যাচ্ছিস। এমন তো না যে, চিরদিনের জন্য বিদায় নিচ্ছিস। আদি ছুটি পেলে নিয়ে আসবে। আমি বলে দেব ওকে।’

আম্মির কথার উত্তরে আদিয়ান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল,
‘এক বছরের আগে কোনোভাবেই আসব না। ঘনঘন ছুটি নিলে চাকরির বারোটা বেজে যাবে।’

‘তুই না আসিস, অসুবিধা নেই। নতুন বাসা নিলে সেই বাসার ঠিকানা দিবি। আমরা মাঝেমধ্যে দেখতে যাব।’

‘আর দেখে কাজ নেই, আম্মি। অনেক বছর তো দেখলে, এবার আমাকে দেখতে দাও। তোমরা কি আমাকে ঘর-সংসার সাজাতে দিবে না, না-কি? এ্যাই ঝুম, ফ্যাচফ্যাচ করে না কেঁদে গাড়িতে ওঠ। সময় নষ্ট হচ্ছে।’

আদিয়ানের তাড়া দেখে রুমঝুম নিজেই গিয়ে সিএনজিতে বসলো। এখান থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রিজার্ভ যাবে। এরপর বাসে একটানে ঢাকায়। দেরী করলে পৌঁছাতে রাত হবে, এই কারণেই তাড়া দিচ্ছিল আদিয়ান। সে লাগেজ গাড়িতে তুলে মামা ও মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বলল,

‘টেনশন কোরো না, আমরা ভালো থাকব।’

রাশেদুজ্জামান মনভাঙা চেহারা নিয়ে মা মরা মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আদিয়ান হয়তো মামার মনভাব বুঝতে পারল। একপলক তাকিয়ে মামাকে ভরসা দিয়ে বলল,

‘অকারণ ভয় ও দুঃশ্চিন্তাকে মনে প্রশ্রয় দিও না, মামা। আমি ঝুমকে ভালো রাখব। তুমি শুধু আমার ওপর একটু বিশ্বাস রাখো। ওখানে ওর কোনো অযত্ন হবে না। প্রমিস।’

***

এক সপ্তাহ পর ফিরবে বলে, যাওয়ার দুইদিনের মাথায় আদিয়ানকে ঢাকায় উপস্থিত দেখে তার রুমমেটটা যারপরনাই অবাক। আদিয়ানের সাথে যে রুম শেয়ার করে তার নাম ইমরুল। দু’জনকে একসাথে দেখে জানতে চাইল,

‘কী ব্যাপার, আদি? তুমি না বললে, এক সপ্তাহর ছুটি নিয়েছ। এরমধ্যেই ছুটি শেষ?’

রুমঝুমকে নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো আদিয়ান। বিস্ময় নিয়ে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আদিয়ান বলল,
‘চেয়েছিলাম তো এক সপ্তাহ গ্রামেই থাকব, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। এখন এই এক সপ্তাহ নতুন বাসা খোঁজার পিছনে ছুটতে হবে।’

ইমরুল কৌতূহলভরা কণ্ঠে বলল,
‘বাসা পড়ে খোঁজো, আগে এটা বোলো, সঙ্গের এই মেয়েটা কে? কাউকে সাথে নিয়ে আসবে এটা যদি আগে বলতে, ভালো কিছু রান্না করে রাখতাম। এখন এই মাঝরাতে খাবার কই পাব?’

টেনশনে আধপাগল অবস্থা আদিয়ানের। কোনদিক কীভাবে সামলাবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। এক রুমঝুম যে এত বিপদ ডেকে আনবে, সেটা যদি আগে জানত, ভুল করেও শুভর সাথে ওর বিয়ে দিত না। নিজেই সাক্ষী হয়ে বিপদ বাড়িয়ে, সেই বিপদ এখন ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছে। মেজাজেরই বারোটা বেজে গেল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বলল,

‘খাবার ম্যানেজ করা যাবে। নিচের রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। কষ্ট করে কিছু নিয়ে এসো।’

এরপর রুমঝুমের দিকে ইশারা দিয়ে বলল,
‘ও আমার কাজিন। এখন থেকে ঢাকাতেই থাকবে।’

‘ওহ, ঠিক আছে। তোমরা ফ্রেশ হও, আমি দেখি কী পাওয়া যায়।’

রিফাতকে সঙ্গে নিয়ে নিচের রেস্টুরেন্টে চলে গেল ইমরুল। আদিয়ান নিজেদের রুমটা রুমঝুমের জন্য ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘এখন বিশ্রাম নে। আগে ভালো একটা বাসা খুঁজে পাই। তারপর তোকে ডাক্তার দেখাব।’

এতগুলো পুরুষের সাথে সে একা নারী এখানে থাকবে কী করে সেই হিসেব মিলাতে পারলো না রুমঝুম। কেবলই ভয়ে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল। বলল,

‘আমি এখানেই থাকব?’

আদিয়ান তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘এই রুমে আমি আর ইমরুল ভাই থাকি। বাসা না পাওয়া পর্যন্ত তুই এই রুমটাতেই থাক। আমরা অন্যরুমে ম্যানেজ করে নেব।’

‘তোমাদের অসুবিধা হবে না?’

‘তা একটু হবে।’

‘ওরা মাইন্ড করবে না?’

‘ওরা সিচুয়েশন বুঝে।’

রুমঝুমকে বিশ্রামে রেখে আসিফ ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিতে ছোট্ট ড্রয়িংরুমে এসে বসলো আদিয়ান। পাশাপাশি অফিস দু’জনার। আবার একই শহরে বাড়ি ও পড়াশোনা করেছে বিদায় দু’জন দু’জনকে কাছের মানুষ মনে করে একে-অন্যের বিপদ-আপদে এগিয়ে আসে সবসময়। এই কারণেই চাকরির শুরুতেই এই লোকটার সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে তার। এরপর আস্তে-ধীরে ইমরুল ও রিফাতের সাথে আলাপ-পরিচয় হয়েছে। টেলিভিশন ছেড়ে ফুটবল খেলা দেখছিল আসিফ। আদিয়ানকে বসতে দেখে বলল,

‘এই বাসা ছেড়ে দিবে?’

উপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে আদিয়ান বলল,
‘ছাড়তে তো হবেই। অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা নতুন বাসা নিয়ে নেব।’

‘গুড। হঠাৎ করে কাজিনকে টেনে আনতে গেলে কেন?’

জানার মধ্য আসিফ, রুমঝুম ও শুভর ব্যাপারটা জানত। দু’জনের বিয়ের দিন আসিফ নিজেও স্ব-শরীরে উপস্থিত ছিল শুধু আদিয়ানের অনুরোধে। দূরত্বের তোয়াক্কা না করে, একটা ফোনের ডাকে সাড়া দিয়ে কাজী অফিসে উপস্থিত হয়েছিল আসিফ। বড়ো ভাই হয়ে সাক্ষীও দিয়েছিল। আর একজন সাক্ষী আছে, যে রুমঝুমের বান্ধবী মিলি। সে আসিফের প্রশ্ন শোনে ম্লানমুখে বলল,

‘তুমি তো জানোই, শুভর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। বাড়িতে কেউ ওদের বিয়ের কথা জানে না, এখন বলার মতো সিচুয়েশন নেই। সারাদিন কান্নাকাটি করে নিজেরই ক্ষতি করছে। তা-ই এখানে নিয়ে এলাম। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হয়তো শুভকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কম করবে।’

‘হঠাৎ করে শুভ হাওয়া হলো কোথায়?’

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না, ভাই। বার বার মনে সন্দেহ জাগছে। ও কোনোভাবে ঝুমকে ধোঁকা দিল না তো?’

‘তুমি বলেছিলে শুভ ভালো ছেলে। তোমার বোন তাকে ভালোবাসে। তোমার কথার ওপর বিশ্বাস করেই কিন্তু সেদিন বিয়েতে সাক্ষী দিয়েছিলাম আমি। এখন যদি দেখো, যার হাতে বোনকে তুলে দেয়ার মতো রিস্ক নিয়ে দুঃসাহসী একটা কাজ করেছ, সে ধোঁকাবাজ, তখন তো তুমি নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাবে।’

‘আমি আসলে শুভকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। ও কোথায় আছে, কেমন আছে, কোনো খোঁজ না পেলে শান্তি পাচ্ছি না, ভাই। এই কারণেই না চাইতেও সন্দেহ চলে আসে।’

‘সন্দেহ আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে এরকম সন্দেহ যে কারও মনে আসবে। আমার নিজের মনেও সন্দেহ জাগছে। ওর চিন্তা আপাতত ছাড়ো। ঝুমকে কীভাবে ভালো রাখবে সেই চিন্তা কোরো। তবে আমার মনে হয়, বাড়িতে সত্যিটা জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল। তোমরা লুকিয়ে ভুল করছ।’

‘এখন যদি বলি, মারাত্মক ঝামেলা হয়ে যাবে, ভাই। মামা আমাকে যতটুকু বিশ্বাস করতেন, এরপর আর সেটাও করবেন না।’

আসিফ কী বুঝলো কে জানে, এরপর আর বাড়তি কোনো কথা বলল না। রিফাত ও ইমরুল খাবার নিয়ে এলে, নিজের জন্য অল্পকিছু রেখে বাকিটা রুমঝুমের জন্য নিয়ে এলো। গুটিসুটি মেরে বিছানায় বসে আছে রুমঝুম। তাকে দেখে ভীষণ ক্লান্ত ও চিন্তিত মনে হচ্ছে। খাবারগুলো একপাশে রেখে আদিয়ান বলল,

‘খেয়ে নে। অনেক রাত হয়েছে।’

দীর্ঘক্ষণের জার্নিতে পেটের ক্ষিধে এতক্ষণ টের পায়নি রুমঝুম। এখন খাবার সামনে দেখে ঝটপট হাত ধুয়ে খেতে বসলো। খেতে খেতে বলল,

‘তুমি খেয়েছ?’

‘না… তুই খা। আমি পরে খাব।’

‘কাল বাসা দেখতে কোথায় যাবে?’

‘যাব কাছাকাছিই।’

‘আমাকেও সাথে নিও। আমি এখানে একা থাকতে পারব না।’

‘ঠিক আছে।’

রুমঝুম যতক্ষণ খাচ্ছিল, আদিয়ান পাশে বসেছিল। খাওয়া শেষ হলে থালাবাটি নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। যাওয়ার আগে রুমঝুমকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলল,

‘তুই এখন ঘুমো। আমি পাশের রুমেই আছি। যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, কল করিস।’

***

পরপর তিনদিন বাসা খুঁজেও কোথাও যুতমতো একটা ভাড়া বাসা পাওয়া গেল না। যেখানেই বাসা খুঁজে, সেখানেই বলে ফ্যামিলি নিয়ে আসতে। নইলে ভাড়া দেয়া হবে না। ভাই-বোন জানলে নাকমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে বাড়িওয়ালা। খারাপ নজরে তাকায়। এরপর দ্বিগুণ ভাড়া চেয়ে বিদায় করে দেয়। আজ চতুর্থদিন, দু’জনে আজও বেরিয়েছে নতুন বাসার খুঁজে। হাঁটতে হাঁটতে পা দুটোতে ব্যথা ধরে গেছে রুমঝুমের। কখনও এত কষ্টের মুখোমুখি সে হয়নি। সামান্য একটা বাসা খুঁজতে গিয়ে অসুস্থ শরীরটাকে আরও অসুস্থ বানিয়ে ছাড়ছে। ইদানীং ঠিকমতো খেতেও পারে না। রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয় না। সারাক্ষণই চোখের সামনে শুভর চেহারা ভেসে উঠে। কষ্টে ভেতর ফেটে আসে তখন, কিন্তু মুখফুটে কিছু বলতে পারে না। নিজের এই অবস্থার জন্য নিজেই দায়ী। এই পরিস্থিতিতে পড়ে দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারে না। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে ফুটপাতের একটা বেঞ্চে বসে পড়লো রুমঝুম। ওড়না গিয়ে ঘাম মুছে বলল,

‘আর পারব না। এভাবে বাসা খোঁজা যায় না। শরীর মানছে না আমার।’

অসুস্থ বলেই মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে নারাজ ছিল আদিয়ান। কিন্তু রুমঝুম কথা শোনার মেয়ে না। সে ফাঁকা বাসায় থাকবে না। যদিও ওরা তিনজনের কেউ-ই দিনেরবেলা বাসায় থাকে না, সবাই যে যার কাজে চলে যায়। শুধু রুমঝুম একাই থাকত, অথচ মেয়েটা তা-ও থাকবে না। জেদ ধরে চলে এসেছে। সে না-কি বাসা খুঁজতে সাহায্য করবে। এই তার সাহায্য করার নমুনা। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেছে। তার ক্লান্তি ও শারিরীক দুর্বলতার কথা চিন্তা করে আদিয়ান বলল,

‘আমি রিকশা ডেকে দিই? তুই বাসায় চলে যা।’

‘অসম্ভব। বাসা খুঁজে পেলে তারপর যাব।’

‘এভাবে পারবি না, ঝুম। অসুস্থ হয়ে পড়বি। তারচেয়ে আমি একা খুঁজি।’

‘বলছি তো হবে না। আমিও খুঁজব।’

‘বাসা খুঁজতে গিয়ে তুই অসুস্থ হয়ে পড়ছিস, জানতে পারলে আম্মি আমাকে একগাদা বকা দিবে।’

‘দিক বকা। হজম করবে। এমন বুদ্ধি খুঁজে বের করেছ কেন?’

‘তোর জন্যই তো।’

স্পষ্ট কণ্ঠে বলল আদিয়ান। রুমঝুম অবাককরা চোখে একনজর তাকিয়ে জানতে চাইল,
‘আমার জন্যই কেন?’

কাঁধ নাচালো আদিয়ান। হাসলোও সামান্য। এই সমাজে একটা ডিভোর্সি মেয়ের ভবিষ্যৎ কেমন হয়, সেটা সে জানে। এই সমাজে একজন সিঙ্গেল মাদারের দিন কেমন কাটে, এটাও সে উপলব্ধি করতে পারে। এই সমাজে একজন বিধবা নারীর দিন কেমন কাটে, এটাও তার অজানা নয়। বিশ্বস্ত সঙ্গীর ভরসার হাত ছাড়া একজন নারী এই সমাজে একা চলতে গিয়ে নানানরকম অপমান, অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়। একা একজন নারীকে সংগ্রামী জীবনযাপন করতে দেখলে কিছু মানুষের মগজে যেন অপমান করার ভূত চাপে। জেনে-বুঝে মানুষকে কটুক্তি করে। তার মায়ের বেলাতেই তো কতরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল সে। মামা রাশেদুজ্জামান ছিলেন বলেই, মায়ের জন্য সম্মানের একটা জীবন দিয়েছেন। যে মামা তার ও মায়ের দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি ভরসার হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন, আজ তারই মেয়েকে এরকম একটা কঠিন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, বিবেকের কাছে সৎ ও শুদ্ধ থাকতে রুমঝুমের পাশে দাঁড়িয়েছে সে। যদিও রুমঝুমের এই অবস্থারও জন্য সে নিজেও কিছুটা দায়ী, এজন্য মনের ভেতর একটা অপরাধবোধ জমা হয়েছে। সেদিন যদি বিয়ে না দিয়ে সবকিছু মামাকে বলে দিত, এতসব কঠিন মুহূর্তের মধ্যে পড়তে হতো না। প্রেম-ভালোবাসার এই সম্পর্ক তিনি কোনোকালেই মেনে নিতেন না, এতে খুব একটা ক্ষতি না হলেও রুমঝুমের জীবন বেঁচে যেত। নিষ্পাপ বাচ্চাটাও এসবে জড়াত না। নিজের অপরাধের বোঝা কমাতে ও মামার সম্মানের কথা ভেবেই রুমঝুমের জন্য ভাবতে হচ্ছে তাকে। এতকিছু কি এই মেয়েটা বুঝবে? বাস্তবতার কতটা বুঝে সে? সমাজ ও সমাজের মানুষগুলোকে ভালোমতো চিনেই না মেয়েটা। বুঝবেও না এতকিছু। বুঝানোর চেষ্টাও করল না। শুধু বলল,

‘বলেছিলাম তো, শুভকে কথা দিয়েছি। তোর খেয়াল রাখব। এই কারণেই।’

রুমঝুম আর কিছু জানার আগ্রহ দেখাল না। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘চলো, বাসা খুঁজি।’

হাঁটতে হাঁটতে ওরা আবারও বাসা খোঁজা শুরু করলো। যেখানে টু-লেট দেখে সেখানেই ঢুঁ মারে। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে আরও একটা বাসা পেল। বাড়িওয়ালী তাদের দেখেই বলল,

‘এখানে ব্যাচেলর ভাড়া হবে না।’

আজ আর বাসা পাওয়া যাবে না, এটা বুঝতে পেরে আদিয়ান ফেরার রাস্তা ধরলে রুমঝুম ওই ভদ্রমহিলাকে বলল,

‘ব্যাচেলর না তো আন্টি। ফ্যামিলি…।’

ভদ্রমহিলা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। ড্রয়িংরুমে বসিয়ে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন। রুমঝুম খুব সাহসের সাথে আদিয়ানের হাত ধরে বলল,

‘আমরা স্বামী-স্ত্রী। বিশ্বাস না হলে আমাদের পরিবারের লোকজনের সাথে আপনার কথা বলিয়ে দিতে পারি। আমি এই শহরে ক’দিন আগেই এসেছি। ও আগে ব্যাচেলর বাসায় থাকত, এখন একটা ফ্যামিলি বাসার দরকার। ঘর-সংসার গুছিয়ে উঠতে পারছি না। বাসা না পেলে কীভাবে ঘর-সংসার করব, আন্টি?’

আদিয়ান আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল রুমঝুমের দিকে। এই মেয়েটাকে সে এতটাও বুদ্ধিমতী ভাবেনি। কী করল এটা? বাসাভাড়া খুঁজতে এসে এখানেও একেবারে স্বামী-স্ত্রী! রুমঝুম মিটিমিটি হেসে ভদ্রমহিলাকে বিয়ের ছবি দেখিয়ে ম্যানেজ করে ফেলল। এ-ও বলল, তারা মামাতো-ফুপাতো ভাই-বোন। বিশ্বাস হওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন,

‘তোমরা দু’জনই?’

‘জি, আন্টি।’

‘মালপত্র কেমন আছে?’

‘এখনও তেমনকিছু কেনা হয়ে উঠেনি, আন্টি। তবে মাসখানেকের মধ্যে পুরোদমে সংসার সাজিয়ে নেব। আপনি শুধু বলুন, ভাড়া কত দিতে হবে।’

ভদ্রমহিলা একটা নির্দিষ্ট অংক ভাড়া হিসেবে চাইলে আদিয়ান আর দ্বিরুক্তি করলো না। তিনদিন ধরে বাসা খুঁজে হয়রান সে। আর কোনো ঝামেলার দরকার নেই। এ বাসাতেই উঠবে। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আন্টি, আমরা কবে নাগাদ আসব?’

এরমধ্যেই বাড়িওয়ালীর সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে রুমঝুম। তিনি ভীষণ আদুরে সুরে রুমঝুমের সাথে গল্প জমিয়েছেন। সামান্য চা-নাশতা দিয়ে বললেন,

‘কালকেই চলে এসো। কোনো অসুবিধা নেই।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চা খেয়ে বিদায় নিয়ে রাস্তায় এলো দু’জনে। এতক্ষণ বহু কষ্টে হাসি আটকে রেখেছিল রুমঝুম। সড়কে এসে পেটে হাত চেপে খিলখিলিয়ে অনেকক্ষণ হাসলো। বলল,

‘উনি এরমধ্যেই আমাকে মেয়ের আসনে বসিয়ে ফেলেছেন।’

আদিয়ান মুচকি হেসে বলল,
‘ভালোই তো। তুইও একজন মায়ের সাক্ষাৎ পেলি।’

উপরনিচ মাথা নাড়লো রুমঝুম। ভদ্রমহিলাকে প্রথমে একটু কাঠখোট্টা মনে হলেও পরবর্তীতে তাঁর আচার-আচরণে তাঁকে ভীষণ মমতাময়ী মনে হয়েছে। এক জীবনে মায়ের আদরের বড্ড অভাব টের পায় সে। এবার যদি অচেনা এই মায়ের স্পর্শে অভাবটুকু দূর হয়। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে বলল,

‘কাজটা কি ঠিক হলো, ভাইয়া? আমরা সবাইকে ধোঁকা দিচ্ছি। জেনে-বুঝে অন্যায় করছি। একটা অন্যায় ঢাকতে গিয়ে আরেকটা অন্যায় করছি। এই অন্যায়ের শেষ কোথায় বলতে পারো?’

***

চলবে…