#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৭
পায়ে সুড়সুড়ি অনুভব হওয়াতে ঘুম ছুটে গেল নওমীর। চোখ মেলে পায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে দেখল, তার আদুরে বিড়ালটা মাথা দিয়ে পা ঘষে দিচ্ছে। সে ঘুমঘুম চোখে আঙুল ঢলে বিরক্তির স্বরে বলল,
‘উফফ, কিটি। তোকে কতদিন নিষেধ করলাম, পায়ে মাথা ঘষবি না। সুড়সুড়ি লাগে আমার। তুই দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস। বুঝিস না কেন কথা? এমন করলে কিন্তু জঙ্গলে ফেলে আসব।’
বিড়াল কি আর মানুষের মুখের ভাষা বুঝে? কিটিও বুঝলো না। একাধারে মাথা ঘষে গেল। শরীরে লোম ও লম্বা লম্বা গোঁফের স্পর্শ বাড়িয়ে দিল। নওমী বিরক্ত হয়ে বিছানা ছাড়ল। তার প্রতি বিড়ালের আদরের মাত্রা বেড়ে গেলে এমন করে হাতে-পায়ে মাথা ও পিঠ ঘষে নিজের অনুভূতি বুঝিয়ে দেয়। আদুরে হাতে বিড়ালকে কোলে তুলে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘কী? ক্ষিধে পেয়েছে?’
কিটি শুধু ম্যাঁও উচ্চারণ করলো। ধীরপায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল নওমী। উঁকি দিয়ে দেখল ডাইনিয়ে তার রাগী ও মেজাজী বাবা সকালের নাশতা করছেন। সে বিড়ালের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বাপিকে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। বকলে আমি আছি। নিচে যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
একটু আদর দিয়ে দরজার বাইরে বিড়ালকে ছেড়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল নওমী। ড্রয়িংরুম থেকে তার মা নুজাইফা আমীন গলা উঁচিয়ে মেয়েকে ডাকলেন। সাড়া না পেয়ে ডাকতে ডাকতে মেয়ের রুমে এসে দরজার কাছে বিড়ালকে ঘুরঘুর করতে দেখে বুঝলেন, পোষাপ্রাণী ভয় পেয়ে এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থেকে নওমীর অপেক্ষা করছে। যতক্ষণ না সে আসবে, ততক্ষণ নিচে যাবে না। তাকে দেখে পায়ের কাছে কতক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো কিটি। তিনি মেয়ের রুমে প্রবেশ করে মেয়েকে না পেয়ে ফের নিচে চলে গেলেন। যাওয়ার পথে কিটিকেও সঙ্গে নিলেন। ডাইনিংয়ের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নওমীর বাবা তোফাজ্জল হোসেন গম্ভীর মেজাজে বললেন,
‘তোমাদের দু’জনের আর কোনো কাজ নেই? সারাক্ষণ এই বিড়াল নিয়ে কী কোরো? কতদিন বলেছি এটা বাইরে ফেলে আসো। যেকোনো জায়গা নোংরা করে দেবে। ঘরে কত দামী দামী শোপিস। নষ্ট হবে না?’
নুজাইফা আমীন একটা নিরাপদ জায়গায় কিটিকে রেখে কয়েক টুকরো হাড়-গোড়সহ মাংস দিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কিটি খুব ভদ্র। যেখানে-সেখানে নোংরা ছড়ায় না। নিমু ওকে সব শিখিয়েছে।’
‘হ্যাঁ, বিড়াল আবার ভদ্র। যতসব ঢংয়ের কথা। মেয়েকে ডাকো। ঘুম ভাঙেনি এখনও?’
‘আসছে।’
দশ মিনিট পর নওমী এসে উপস্থিত হলো ডাইনিংয়ে। কিটিকে একনজর দেখে তোফাজ্জল হোসেনকে বলল,
‘বাপি আমার কিছু টাকা লাগবে। গতকাল যে আন্টিকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম, ওনার জন্য কিছু শপিং করব।’
মেয়ের এতসব আচরণে ভদ্রলোক ভীষণ বিরক্ত। তিনি বুঝতেই পারেন না, কেন মেয়ে এইসব করে বেড়াচ্ছে? এসবে তো কোনো লাভ হচ্ছে না। পকেটের টাকা যাচ্ছে শুধু। তিনি চেহারায় গম্ভীরতা বজায় রেখে বললেন,
‘কখনও হিসেব করেছ, এভাবে তুমি কত টাকা দান-খয়রাত করছ?’
নওমী মুচকি হেসে খাবার মুখে তুলে বলল,
‘দান-খয়রাতে হিসেব করতে হয় না।’
‘টাকা তো ইনকাম কোরো না। জানো না, কীভাবে ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে।’
‘দেখো, আমার ক্রেডিট কার্ড হাতে পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। হারিয়ে না গেলে আমি তোমার কাছে টাকা চাইতাম না।’
‘ওখানেও তো আমারই টাকা। নিজে তো রোজগার করোনি।’
‘তুমি কি আমাকে টাকার খোটা দিচ্ছ?’
‘না…। শুধু এটা বোঝাতে চাইছি যে, টাকাটা এমনি-এমনি আসে না। এরজন্য শ্রম দিতে হয়। শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত টাকাকে বুঝে-শোনে ব্যয় করতে হয়। যা খুশি তা-ই করছ তুমি? এভাবে আর কত! এবার টাকার মূল্যটা একটু বোঝো। তুমি এতটাও ছোটো নও যে, তোমাকে সবকিছু হাতে-কলমে বোঝাতে হবে।’
কপালে কিছুক্ষণ হাত চুলকে নীরবে বসে রইল নওমী। রাগে দাঁতে দাঁত চাপছে সে। পারছে না শুধু গলা উঁচু করে কথা বলতে। বাবা-মায়ের সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না তার। দান-খয়রাত করে সে আত্মিক তৃপ্তি পায়, গরীব, এতিম ও অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারে। এসব করতে তার ভালো লাগে, এজন্যই করে। এমন না যে, টাকার বাহাদুরি দেখাতে এগুলো করে। আজ হয়তো ইনকাম করছে না, একদিন তো করবে। তাইবলে বাপি তাকে এইভাবে কথা শোনাবেন? তোফাজ্জল হোসেন মেয়ের রাগান্বিত মুখ লক্ষ্য করে বললেন,
‘তোমার ফুপি জানতে চাইছিল, ফাইনাল অ্যাক্সাম দিয়েই তুমি লন্ডনে যাবে কি-না। কী বলব?’
‘আমি জাহান্নামে যাব। পথ দেখিয়ে দাও।’
মেয়ে ভীষণ রেগে গেছে এটা বুঝতে পারছেন তোফাজ্জল হোসেন। তবুও তিনি নরম হলেন না। শক্ত কণ্ঠেই বললেন,
‘তুমি অযথাই রেগে যাচ্ছ, নওমী। আমার কথা বোঝার চেষ্টা কোরো। তুমি কি একবার ভেবে দেখেছ, এতগুলো টাকা আমি কীভাবে রোজগার করছি? কীভাবে বাড়ি-গাড়ি বানিয়েছি? জীবনে আমি যতটা পরিশ্রম করেছি, তার একভাগও যেন তোমাকে করতে না হয়, সেজন্য তোমার সবরকম চাওয়া-পাওয়াকে হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছি। আমি অভাব দেখে বড়ো হয়েছি, তা-ই চাই না আমার সন্তান হয়ে তুমি অভাব দেখে বড়ো হও। এজন্য তোমার হাতে ক্রেডিট কার্ড তুলে দিয়েছি। আর তুমি কী করছ? রাস্তায় যাকে পাচ্ছ তাকেই দান করছ। কেন? এত দয়ালু হতে হবে কেন? এখন যদি টাকার মূল্য বুঝতে না শিখো, কবে শিখবে?’
নওমী এত কথা কানে নিল না। সে শুধু বলল,
‘তুমি কি বলতে চাও, আমাকে এখন কাজ করতে হবে?’
‘চাইলে করতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই। তার আগে টাকার অভাব বুঝতে শিখো। ক্ষিধের অভাব টের পাও।’
‘মানলাম, টাকার অভাব বুঝতে গেলে ইনকাম করতে হয়। এখন ক্ষিধের অভাব বুঝতে গেলে কি না খেয়ে থাকতে হবে?’
তোফাজ্জল হোসেনকে নীরবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খাবার প্লেট দূরে সরিয়ে রাখল নওমী। বলল,
‘ঠিক আছে, খেলাম না। দেখি, ক্ষিধের অভাবটা টের পাই কি-না।’
না খেয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে তোফাজ্জল হোসেন কড়া শাসনের স্বরে বললেন,
‘চাবি রেখে যাও।’
দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করল নওমী,
‘গাড়ি না নিলে যাব কী করে?’
‘পা আছে, হেঁটে যাবে। রাস্তায় গাড়ি আছে, সেগুলোর যেকোনো একটা ভাড়া নিবে।’
‘তুমি ঠিক কী চাইছ?’
‘আমি চাইছি আগামী একসপ্তাহ তুমি সাধারণ জীবনযাপন করে একটা চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা কোরো। এবং এটা বোঝো যে, চাইলেই হাতের মুঠোয় টাকা আসে না। টাকা হাতের মুঠোয় আনতে হলে, মাথার ঘাম পায়ে ঝরাতে হয়।’
বাবা-মেয়ের এই দ্বন্দ্ব দেখে নুজাইফা আমীন বললেন,
‘তুমি খামোখা ওর ওপর টর্চার করছ। কেন এমন করছ? ও যথেষ্ট ম্যাচিওর। ভালোটা বুঝতে জানে। ও যা করছে তা তো খারাপ না। কারও ভালো করা, ভালো চাওয়া কি অন্যায়? কারও মুখে খাবার তুলে দেয়া, তার চিকিৎসা করানো, পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়া, এসব কি ভুল?’
‘অবশ্যই ভুল নয়। ও যা করবে সেটা নিজের টাকায় করুক। আমার টাকা দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। নেক্সট টাইম, তুমিও ওর হাতে মোটা অংকের টাকা দিবে না। সব সুখ পেয়ে ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
বাবার কথা শোনে ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটালো নওমী। বলল,
‘আমি টাকার অভাব, খাদ্যের অভাব, বাসস্থানের অভাব, সবকিছুই বুঝি। আর বুঝি বলেই, ওই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। এতগুলো টাকা দিয়ে কী করবে তুমি? মৃত্যুর পর কবরে নিয়ে যাবে? না-কি মৃতদেহকে তুমি দালানকোঠায় রাখবে? এসব টাকা কী কাজে আসবে তখন? ওই সামান্য টাকায় যদি কিছু মানুষের মুখে হাসি ফুটে তাহলে লাভটা কার হবে? তোমারই তো। তুমি শুধু ইহকালের সুখটাই দেখলে, পরকালেরটা দেখলে না।’
‘এত কথা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি না।’
‘উচিত কথা বলছি বলেই এখন তোমার গায়ে লাগছে। তুমি আমাকে এটা বলে দাও যে, তোমার আয়ের টাকা যেন আমি ওইসব কাজের জন্য ব্যয় না করি। কিন্তু এটা বুঝাতে অভাবের সংজ্ঞা তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। আর কী বললে, আগামী এক সপ্তাহ আমি সাধারণ জীবনযাপন করব? তুমি কি জানো, তুমি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছ? শুধু এক সপ্তাহ কেন, আমি যদি সিদ্ধান্ত নেই যে, জীবনের বাকিগুলো দিন আমি সাধারণ জীবনযাপন করব, তোমার বাপেরও সাধ্য নেই আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাবে।’
নওমী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গ্রেজুয়েশন শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে যাবে। এরপর পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করে, বিয়েশাদী করে ওখানেই সেটেল্ড হয়ে যাবে। সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না আর। বাবা তাকে আজ শুধু টাকার খোটা দেননি, তার আত্মসম্মানে আঘাত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সে অকর্মা। আসলেই কি তাই? জেদ থেকে এই কথা বাবাকে শোনালেও মনে মনে পাকাপোক্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নওমী। নিজের ইনকামেই সে চলবে। আজ থেকে বাবার টাকায় হাতও লাগাবে না। আনমনে এসব সাত-পাঁচ হিসেব করছিল। তখুনি তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘তুমি এত হাইপার হচ্ছ কেন? আমার রোজগার সব তো তোমার জন্যই। আমি শুধু এটা বুঝাতে চাইছি যে, একটু হিসেবী হও। বেহিসেবী চলাফেরাটা ভালো না।’
নওমী একটু ভেবেচিন্তে বলল,
‘ঠিক আছে, তোমার কথাও থাকল। আমার কথাও থাকল। আজ থেকে আমার প্রয়োজনে তোমার একটা টাকাও আমি ব্যয় করব না। এখন আমাকে একটা চাকরি দাও, নয়তো অফিসের দায়িত্ব দাও।’
অফিসের দায়িত্ব দিলে এই সুযোগে ব্যাংক-ব্যালেন্সের বারোটা বাজিয়ে দিবে। দু’হাতে দান-খয়রাত করে দুইদিনেই ফকির বানিয়ে ছাড়বে। মেয়ের চালাকি ধরতে পেরে তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘অফিসের দায়িত্ব এখুনি তোমাকে দিতে পারব না। তবে তুমি চাইলে আমার অফিসের কর্মচারীদের একটা পোস্টে তোমাকে নিতে পারি।’
‘ওকে…। আমি রাজি।’
‘তাহলে যাও, আজই একটা সিভি জমা দিয়ে এসো।’
বাবার কথামতো একটা সিভি তৈরী করে অফিসে এলো নওমী। ম্যানেজারের সাথে দেখা করে সিভি বাড়িয়ে দিল। ম্যানেজার সেটাকে একনজর চোখ বুলিয়ে বলল,
‘দুঃখিত, ম্যাডাম। কোনো পোস্টেই আপনার চাকরি হবে না।’
‘কেন?’
‘আপনার এখনও গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি। এখানে যারা কাজ করে সবাই-ই মাস্টার্স কমপ্লিট করে কোনো না কোনো পোস্টে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এখানে গ্রেজুয়েশন কমপ্লিটের পর সর্বনিম্নে যে চাকরিটা দেয়া হয়, সেটা হলো একজন পার্সোনাল সেক্রেটারি। আপনি কি এরকম কোনো পোস্টে চাকরি করবেন?’
রাগে-অপমানে নওমীর চোখদুটো জ্বলে উঠল। বাবা তাকে সরাসরি না পেরে ঘুরিয়ে-বাঁকিয়ে অপমান করলেন। ম্যানেজারের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো সে। রাস্তায় এসে তোফাজ্জল হোসেনের নম্বরে কল করে বলল,
‘তুমি কী চাইছ বোলো তো?’
ওপাশ থেকে তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘দেখেছ, সামান্য একজন সেক্রেটারি হতে গেলেও কতটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে? এখন তুমি-ই বোলো, কী করবে? ভালোমতো পড়াশোনা করে লন্ডনে যাবে না-কি এই বয়সে চাকরি খুঁজতে নামবে?’
‘আমি তো লন্ডনে যেতে চাইছি। কিন্তু তুমি আমার সাথে উল্টাপাল্টা আচরণ করছ।’
‘আমি উল্টাপাল্টা আচরণ করছি না। লন্ডনে তুমি তখনই যাবে, যখন আমার কথামতো চলবে। যদি মানতে না পারো, তোমার পড়াশোনার পিছনে আমি আর এক টাকাও খরচ করব না।’
‘আমাকে কী করতে হবে?’
‘প্রতিমাসে যে টাকা তোমার হাত খরচের জন্য দিই, আজ থেকে তার অর্ধেক দেব। যত্রতত্র দান-খয়রাত বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনের বেশি এক টাকাও তুমি আর খরচ করবে না।’
‘ঠিক আছে। আর কিছু?’
‘তোমার ক্রেডিট কার্ড ব্লক করে দিচ্ছি।’
‘বাপি…। এটা করতে যাবে কেন?’
‘এটা না করলে সুযোগ পেলেই তুমি টাকা খরচ করবে। যেটা আমি চাইছি না। আমি দাতা মহসীন নই যে, দু’হাতে দান-খয়রাত করব।’
প্রতিমাসে দু’একজনকে দান-খয়রাত করলে টাকা কমে যায় না, বরং গরীব-দুঃখীদের দোয়ায় আরও আয়-উপার্জন ও কর্মে সফলতা নেমে আসে, এটুকু তার মেজাজী বাবাকে বুঝাতে পারল না নওমী। নিজের পড়াশোনা আটকে যাবে, লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে, যেটুকু দান-খয়রাত করত, সেই সুযোগও আর পাবে না। অনেক ভেবেচিন্তে নওমী বলল,
‘তুমি যেভাবে চাইবে, সেভাবেই হবে।’
ভ্যানিটিব্যাগে ফোন রেখে ইচ্ছে করেই রিকশা থামানোর চেষ্টা করল নওমী। বাবার দামী গাড়ির দিকে ফিরেও তাকালো না। দু’একবার হাত নাড়িয়েও কাজ হলো না। কড়ারোদে দাঁড়িয়ে থেকে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। হসপিটালে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসতেই অসুস্থ মহিলার জন্য দুঃশ্চিন্তা বেড়ে গেল। কে জানে, কেমন আছেন উনি! কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর একটা সিএনজি পেল। সেটাতেই চেপে বসলো সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিছুদূর এগোনোর পরই মোড় ঘুরতে গিয়ে একটা রিকশার সাথে ধাক্কা খেল সিএনজি। সে সামান্য ঝাঁকুনি খেয়ে একটু ব্যথা পেল, তবে তার ড্রাইভারের কিছু হলো না। রিকশায় থাকা যাত্রী হঠাৎ ধাক্কা সামলাতে পারেনি এই কারণে সড়কে পড়ে গিয়ে যথেষ্ট আহত হলো। ধাক্কার সময়ই রিকশাওয়ালা দূরে সরে গিয়েছিল বলেই তার কোনো ক্ষতি হয়নি। আহত ব্যক্তিকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে নওমী ছুটে গেল তার সামনে। ততক্ষণে রিকশাওয়ালা, সিএনজির ড্রাইভারের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। এদিকে আহত ব্যক্তির শার্ট ছিঁড়ে হাত ও কপালের একটা অংশ ছিঁলে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। নওমী ড্রাইভারের হয়ে ক্ষমা চেয়ে বলল,
‘স্যরি, স্যরি, ড্রাইভার আসলে খেয়াল করেনি। আপনি ঠিক আছেন? অনেকখানি রক্ত ঝরে গেল। আসুন, আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাই।’
আসিফকে নিয়ে এস আই এর দেয়া ঠিকানায় যাওয়ার তাড়া ছিল আদিয়ানের। ভেবেছিল অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সেখানে যাবে। এজন্য রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিচ্ছিল সে। বুঝেনি, মাঝরাস্তায় এই দুর্ঘটনা ঘটবে। সিএনজির সামনের অংশের ধাক্কাটা তার শরীরের ওপর দিয়েই গেল। রক্তাক্ত হাত নিয়ে মাথা তুলে চোখের সামনে নওমীর অনুশোচনাসূচক স্বর ও হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য দেখে নিজের ব্যথার কথা ভুলে গেল আদিয়ান। বিস্ময় ও মুগ্ধতা একত্রিত করে তাকিয়ে রইল সামনে থাকা রমণীর দিকে। এই তাকিয়ে থাকার অর্থ নওমী বুঝলো না। জানতে চাইল,
‘আপনি কি একা হসপিটালে যেতে পারবেন?’
আদিয়ান কিছুই বলল না। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো। কোমরেও যথেষ্ট লেগেছে। সে দ্বিতীয়বার উঠার চেষ্টা করলে সামনে থাকা রমণী তার হাত বাড়িয়ে দিল। মুগ্ধতার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারল না সে। ঘোরের মধ্যে থেকে বোঝার চেষ্টা করল, দৃশ্যটা স্বপ্ন না-কি সত্যি। নওমী অবশ্য অপেক্ষা করল না। নিজেই এগিয়ে এসে হাত ধরে বলল,
‘আমি হেল্প করছি। ব্যথা বোধহয় বেশি পেয়েছেন। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন কি-না দেখুন।’
বিস্মিত চোখের পলক ফেলা দায় হয়ে পড়ল আদিয়ানের। সে শুধু নওমীর কথা শোনে হাতে-হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত-পা চেক করল। মাথা ঝিমঝিম করছে তার। কপালে হাত চেপে রিকশাওয়ালাকে ডাকল,
‘মামা… আমার অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
রিকশাওয়ালা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলল,
‘রাখেন আপনার অফিস। ক্ষতিপূরণ না নিয়া যামু না।’
দ্বন্দ্ব ও তর্কাতর্কি চলতেই থাকলো। নওমী কোনো উপায় দেখল না। চারপাশে তাকিয়ে আরও একটা সিএনজি থামানোর চেষ্টা করল। একটা সিএনজি সামনে এসে দাঁড়ালে আদিয়ানকে বলল,
‘উঠুন, আপনার ড্রেসিংয়ের দরকার।’
আদিয়ান ঘড়ি দেখল। অফিসের দেরী হচ্ছে। বসের কড়া কিছু গালি আজ নিশ্চিত। সেইসাথে চাকরির বারোটা বেজে যেতে পারে। চিন্তিতমনে বলল,
‘আমি ঠিক আছি।’
নওমী অবাকচোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘এত ব্লিডিংয়ের পর আপনি বলছেন, ঠিক আছেন! কীভাবে?’
‘অফিসে পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাবে। আর একদিন দেরী হলে বসের গালিবকা তো ফ্রিতে শুনতে হবে।’
‘আপনার অফিস কোথায়?’
‘এই কাছেই, পাঁচ মিনিটের পথ।’
পাঁচ মিনিটের পথে কোন অফিস সেটা বুঝতে পেরে নওমী বলল,
‘কিছুই হবে না, আপনি আসুন। আমি বাপিকে বলে দেব।’
দুই ড্রাইভারের দ্বন্দ্ব তখনও অব্যাহত। তাদের তর্কবিতর্ক থামানোর চেষ্টা করলে আরও ঝামেলা। যেহেতু রিকশাওয়ালার রিকশার ক্ষতি হয়েছে, এবং ক্ষতিপূরণ না নিয়ে লোকটা এখান থেকে নড়বেই না, তাই এইসব দ্বন্দ্ব ও ঝামেলায় যেতে চাইল না নওমী। সে আদিয়ানকে জোরপূর্বক অন্য সিএনজিতে তুলে ড্রাইভারকে তাড়া দিল। ড্রাইভার সিএনজি স্টার্ট দিলে হাত বাড়িয়ে কিছু টাকা সিএনজি ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনারা ঝগড়া করুন, আমরা গেলাম।’
দুই ড্রাইভার আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে ছুটে চলা সিএনজির পানে। কী হলো, সবকিছু যেন তাদের মাথার ওপর দিয়ে গেল। এদিকে দু’জনার বোকা বোকা দৃষ্টি দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নওমী। আদিয়ান সেই হাসিতেই ফেঁসে গেল। চোখে চোখ পড়লে মায়াবী কন্যা চোখ নাচালো। আদিয়ান দু’দিকে মাথা নেড়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো শুধু। রক্তাক্ত অবস্থায় কেউ এমন করে হাসতে পারে? দৃশ্যটি দেখে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করল নওমী। আদিয়ানের হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা কপালে চেপে রাখুন, রক্ত বের হচ্ছে।’
***
চলবে…