পায়ে পায়ে হারিয়ে পর্ব-০৮

0
35
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
পায়ে_পায়ে_হারিয়ে লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান

#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৮

কাছাকাছি একটা নার্সিংহোমে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিল আদিয়ান। বেডে শুয়ে ঔষধের কড়া গন্ধ শুঁকে নাকমুখ কুঁচকে রেখেছে সে। চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তি। এই ঔষধ তার দু’চোখের দুশমন। ছোটোবেলা থেকেই সব ধরনের ঔষধে তার মারাত্মকরকম অ্যালার্জি। দেখলে ও নাম শুনলেই মেজাজের দফারফা ঘটে যায়। তীব্র মাথাব্যথা, সর্দি-জ্বরে দিনরাত যদি বিছানায় পড়ে থাকে, তবুও ঔষধ গিলবে না। ছেলের এসব কাণ্ডে আমেনা বেগম রীতিমতো বিরক্ত। রোগ-বালাই হলে মানুষ ঔষধ খেয়ে সুস্থ হতে চায় তাড়াতাড়ি অথচ আদিয়ানের বেলায় উল্টো হয়। কেন যে ঔষধ দেখলে চেহারায় অমাবস্যা নেমে আসে, সেটা তার মা-ও বুঝতে পারেন না। ডাক্তার যখন প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, ব্যথাতুর শরীর নিয়ে আদিয়ান বলল,

‘আপনি আমাকে ছেড়ে দিন, আমি এখন যাই।’

ডাক্তার গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইলেন আদিয়ানের দিকে। সেই দৃষ্টির তোয়াক্কা করল না আদিয়ান। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ব্যথা নিয়েও বেড ছেড়ে দাঁড়িয়ে নিজের হ্যান্ডব্যাগ হাতে তুলে বলল,

‘আমি সুস্থ আছি, আর কোনো ট্রিটমেন্টের দরকার নেই।’

দুর্বল শরীর নিয়ে দু’পা এগোতেই মাথা দুলে উঠল আদিয়ানের। ভাগ্যিস নওমী কাছে ছিল। দু’হাতে ধরে পূণরায় বেডে বসিয়ে বলল,

‘আপনি তো ভালোই দুর্বল হয়েছেন দেখা যাচ্ছে। ট্রিটমেন্ট শেষ হোক, আমি নিজে আপনাকে পৌঁছে দেব।’

আদিয়ান মাথায় হাত রেখে তাড়া দেখিয়ে বলল,
‘তার আর দরকার নেই, ম্যাডাম। আমি একাই যেতে পারব।’

‘আচ্ছা, একটু ওয়েট করুন। উনি কিছু ঔষধ দিচ্ছেন, সেগুলো কিনে দিই, তারপর যান।’

‘আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার কোনো ঔষধ লাগবে না। আমি এমনিতেই ঠিক হয়ে যাব।’

সাহস নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আদিয়ান। এক’পা, দু’পা করে দরজার দিকে এগোলে নওমী সেদিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইল। এই ছেলের কাণ্ডকারখানা ঠিক বুঝল না সে। অসুস্থ শরীর নিয়ে কেউ এমন করে? ডাক্তার নিজেও একনজর আদিয়ানের দিকে খেয়াল করে নওমীকে বললেন,

‘ওনার কি ঔষধে ফোবিয়া আছে?’

নওমী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,
‘আমি তো জানি না।’

‘উনি কে হোন আপনার?’

‘কেউ না। রাস্তায় বিপদে পড়তে দেখে ট্রিটমেন্টের জন্য টেনে এনেছি।’

ডাক্তার কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঔষধ লিখে প্রেসক্রিপশন নওমীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এটা ওনাকে দিয়ে দিন।’

প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে আদিয়ানের পিছন পিছন এগোলো নওমী। খুব ধীর ও সাবধানতার সাথে পা ফেলে নার্সিংহোমের সামনের করিডোরে এসে দাঁড়াল আদিয়ান। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে পাশে থাকা বেঞ্চে বসে চোখ বন্ধ করে রইল সে। নওমী সেই ফাঁকে ফার্মেসি থেকে ঝটপট হাতে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র কিনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,

‘এগুলো সাথে রাখুন, যদি মনে হয়, না খেলে হচ্ছে না, তখনই খাবেন।’

তিতকুটে একটা ভাব নিয়ে চোখ খুলে বিরক্তিকর মেজাজে তাকিয়ে রইল আদিয়ান। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘আমি ঔষধ খাই না।’

‘প্রয়োজনেও না?’

‘না…।’

কৌতূহল জাগলো নওমীর মনে। পাশের ফাঁকা জায়গায় বসে জানতে চাইল,
‘অসুস্থ হলে কী করেন তবে?’

‘শুয়ে থাকি।’

‘সারাদিন শুয়ে থাকেন?’

‘হু…।’

‘কখনওই কি ঔষধ খান না?’

‘না…। ঔষধ দেখলে পেটের ভেতর কেমন করে। বমি বমি ফিল আসে। জোর করে মুখে নিলে, পেটের ভেতরের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হয়।’

আর কী জিজ্ঞেস করবে ভেবে পেল না নওমী। কতক্ষণ চুপ থেকে ভেবে গেল। আদিয়ান একটা রিকশা থামাতে চাইলে নওমী বলল,

‘আপনার বাসা কোথায়?’

‘কাছেই।’

‘একা যেতে পারবেন?’

‘হুম…।’

কথার মাঝখানে নওমীর ফোন বেজে উঠল। প্রিয় বান্ধবী মৌমি কল করেছে। সে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মৌমি বলল,

‘কী রে, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, কই তুই?’

‘আছি, রাস্তায়ই।’

‘আসতে কতক্ষণ লাগবে?’

‘বলতে পারছি না।’

‘আজ এত দেরী করছিস কেন?’

‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন অসুস্থ।’

মৌমি বান্ধবীর অভ্যাস সম্পর্কে অবগত তাই আর এই বিষয়ে কিছু জানতে চাইল না। বলল,
‘ক্লাস শেষে আমাদের কিন্তু একটা প্রোগ্রাম আছে। তুই কি জয়েন হবি না?’

‘হব।’

‘তাহলে তাড়াতাড়ি আয়।’

ফোন রেখে পাশে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল নওমী। ঔষধ রেখেই আদিয়ান হাওয়া হয়ে গেছে। সামনে-পেছনে সবদিকে তাকিয়ে দিল, বেশ কিছুটা দূরে এগিয়ে যাচ্ছে একটা রিকশা। সিটে বসে আছে আদিয়ান। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। দূরে থেকেই বলল,

‘এ্যাই, মামা। ওখানেই দাঁড়ান।’

ঔষধ হাতে নিয়ে রিকশার পিছনে ছুটতে শুরু করল নওমী। আদিয়ান পিছনে তাকাল। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে বলল,

‘মামা, একদম দাঁড়াবেন না, দৌড় দেন। এই মেয়ে সুনামির চেয়েও ভয়ংকর।’

এরকম দৌড়ের অভ্যাস আছে দেখে খুব একটা গায়ে লাগল না নওমীর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘কতক্ষণ করে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছেন না?’

রিকশাওয়ালা অসহায় দৃষ্টিতে আদিয়ানের দিকে তাকালে, নওমী সেই দৃষ্টি খেয়াল করে ঔষধগুলো আদিয়ানের ব্যাগের ভেতর ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে বলল,

‘খবরদার এগুলো ফেলবেন না। অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে। বেকার মানুষের টাকা নষ্ট করতে লজ্জা করে না, আপনার? চাকরি-বাকরি করলে একটা কথা ছিল। বাপির টাকায় চলি, তা-ই হিসেব করে খরচ করতে হয়। যদি এগুলো ফেলে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, বাপিকে বলে আপনার চাকরির বারোটা বাজিয়ে দেব।’

নওমীর হুমকি-ধমকি দেখে হতবাক আদিয়ান কথা হারিয়ে ফেলল। এই মেয়েটা এত বিপজ্জনক আগে জানলে ভুল করেও সামনে পড়ত না। একটা অ্যাক্সিডেন্ট তার কতবড়ো ক্ষতি করে দিল। একে তো ব্যথা দিল, এখন আবার ঔষধের ঠ্যালা। অতিষ্ঠ আদিয়ান গলায় জোর এনে বলল,

‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

নওমী হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, দেখিয়েছি। ভয় পাননি?’

‘আপনার বাবার অফিসে চাকরি করি বলে, যা খুশি তা-ই বলতে পারেন না। আমি একটা শিক্ষিত ছেলে, সিভি জমা দিলে যেকোনো জায়গায় চাকরি হয়ে যাবে।’

নওমী যেন এই কথার থোড়াই কেয়ার করল। সে ফটফট করে বলল,
‘চাকরি তো হাতের মোয়া। সামনে পেলাম আর গিলে ফেললাম। একটা চাকরি পাওয়া কত কঠিন জানেন? গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হয়নি দেখে বাপির অফিসেই চাকরি হয়নি আমার। আর আপনি তো…।’

আদিয়ান এত কথা কানে নিল না। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিল,
‘মামা যান তো, এসব বকরবকর শোনার সময় আমার নেই। এই মেয়ে একটা… একটা।’

কী বলবে ভেবে পেল না আদিয়ান। বিড়বিড় শুরু করল। নওমী স্পষ্ট বুঝল, অচেনা ছেলেটা তাকে বকাঝকা করছে। কৃতজ্ঞতা স্বীকার তো করলোই না, বিপরীতে বকা দিল? রাগে-অপমানে সে ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ঔষধগুলো বের করে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুদূর এগিয়ে একটা রিকশা নিয়ে ভার্সিটির দিকে এগোলে আদিয়ান মাথায় রেখে বিড়বিড়াল,

‘অদ্ভুত! এটা মানুষ না-কি আর কিছু? এই ভালো তো এই খারাপ। একটা মানুষের মেজাজ এতদ্রুত পালটায় কী করে?’

বিড়বিড় থামিয়ে সামনে তাকিয়ে আদিয়ান দেখল, রিকশা থেকে মাথা বের করে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে নওমী। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তার। এ যাবৎ যে চেহারা তাকে মুগ্ধতা ও স্বস্তি দিয়েছে, আজ তা ভীতি দিয়ে গেল। শুকনোমুখে ঢোক গিলে রিকশাওয়ালাকে বলল,

‘আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, মামা? সামনে এগোন।’

***

বাসায় পা রাখতেই রুমঝুম তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে আঁৎকে উঠে বলল,
‘ইয়া আল্লাহ, এ কী অবস্থা তোমার! তুমি বলেছিলে না, আজ শুভকে খুঁজতে যাবে? এই গেলে!’

ধীরেসুস্থে ভেতরে এলো আদিয়ান। রুমঝুমের চেহারায় দুঃশ্চিন্তা। তবে সেই চিন্তা কার জন্য বুঝলো না আদিয়ান। বলল,

‘অফিসেই যেতে পারিনি, ঝুম। ভেবেছিলাম ছুটি নিয়ে শুভকে খুঁজতে যাব, তা আর হলো কই? রাস্তায়ই দুর্ঘটনা ঘটে গেল।’

রুমঝুম হতাশ হলো পুরোটাই। এই মানুষটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। দায়িত্ব অবহেলা করছে। অথচ সে জানে, শুভর খোঁজ বের করা কতটা জরুরী। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানতে চাইল,

‘কী করে হলো?’

দুর্বল শরীর নিয়ে দুর্ঘটনার কথা বলে নিজের রুমে প্রবেশ করে, শার্টের বোতাম খুলে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে রইল আদিয়ান। রুমঝুম বলল,

‘ঔষধ নিয়ে এসেছ?’

দুর্ঘটনার কথা বললেও নওমীর সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত তর্কাতর্কি ও ঝগড়ার কথা কিছুই প্রকাশ করল না আদিয়ান। শুধু বলল,

‘আমি ঔষধ খাই?’

‘এটা তো সাধারণ অসুস্থতা নয়। এখন যদি ঔষধ না খাও, সাতদিনেও কি সুস্থ হবে তুমি?’

‘সাতদিন লাগবে না, কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।’

রুমঝুম আর কিছু বলতে চেয়েও পারল না। এই মানুষটার সাথে অযথা তর্ক করে লাভ নেই। ঔষধ তো খাবেই না, উল্টে আরও একগাদা কথা শোনাবে। দুপুরের রান্না গুছিয়ে রাখতে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুমঝুম। আদিয়ান পোশাক পালটে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়। অমনি চোখে মরার ঘুম নেমে এলো। সেই ঘুম ভাঙল ভরসন্ধ্যায়। খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে যখন মশার ভনভন শব্দ কানে এলো, তখনই চোখ মেলল সে। খেয়াল হলো, আজ শুভকে খুঁজতে যাওয়ার কথা ছিল। অসময়ে ঘুমের কারণে সেটা আর হলো না। সময় ঠিক কত, এটা দেখতে মোবাইল হাতে নিল। স্ক্রিনে আসিফ, বস ও ম্যানেজারের বেশ কয়েকটা মিসডকল দেখে নিজের ওপরই রাগ হলো তার। তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়তে গিয়ে টের পেল, ব্যথা বেড়ে গিয়েছে, পাশাপাশি জ্বরেও শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ওঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। সে দুর্বল শরীর নিয়ে রুমঝুমকে ডাকল,

‘ঝুম, কোথায় তুই? এদিকে একটু আসবি।’

নতুন বাসায় সময় কাটে না দেখে একুশ ইঞ্চির টেলিভিশন কিনে এনেছে আদিয়ান। কাজের ফাঁকে একটু-আধটু সিরিয়াল দেখে রুমঝুম। সারাদিন একটু কাজ, একটু আড্ডা, একটু টিভি দেখা, এভাবেই সময় কাটে তার। টেলিভিশনের দিকে দৃষ্টি হলেও মন তার সেদিকে নেই, শুভতে আছে। সময়ে-অসময়ে প্রিয়জনকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তার জন্য কাঁদতে ভালো লাগে। এখনও সিরিয়ালের একটা চমৎকার মুহূর্ত দেখে, দুঃখে, যন্ত্রণায় চোখের কোণে অশ্রুরা চিকচিক করছে। আদিয়ানের গলার আওয়াজ তার কানে যায়নি, তাই সাড়াও দেয়নি। সে যখন নিজেকে ও শুভকে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত, তখনই টলতে টলতে রুম ছেড়ে বাইরে এলো আদিয়ান। সোফায় বসে বলল,

‘তখন থেকে ডাকছি তোকে, তুই শুনতে পাচ্ছিস না?’

রুমঝুমের মন ভেজায় খারাপ। ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। এত কষ্ট সে আর নিতে পারছে না। ভেতরফাটা কষ্টের কারণে কথার কোনো উত্তর দিল না। আদিয়ান বলল,

‘এক কাপ চা করে দে না, ঝুম। শরীরে একটু জোর আসবে। এত মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, সহ্য হচ্ছে না। জ্বরও এসেছে।’

মন ভালো নেই বলে এই সামান্য কথাতেই চটে গেল রুমঝুম। শুভকে খুঁজতে গিয়েও খুঁজল না, এই কথা মনে হতেই রাগ আরও বেড়ে গেল। সে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘পারব না, নিজে করে খাও।’

আদিয়ান অবাক হয়ে বলল,
‘প্লিজ, এক কাপ চা দে। আমার শরীরে জোর নেই, নয়তো তোকে বলতাম না।’

রুমঝুম একইভাবে বলে উঠল,
‘আমি কেন দেব? নিজের চা নিজেই খাও। নয়তো বিয়ে করে বউ আনো। আমি তোমার দাসীবাঁদী নই, আমাকে দিয়ে যা খুশি তা করাতে পারো না।’

মুহূর্তের মধ্যে টেলিভিশন বন্ধ করে নিজের রুমে চলে গেল রুমঝুম। আদিয়ান ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইল। সামান্য এক কাপ চা চাওয়াতে এত রাগ, এর কোনো কারণই খুঁজে পেল না সে। তবে বুঝল, রুমঝুমের মন ভালো নেই। দুর্বল শরীর নিয়ে নিজেই গেল রান্নাঘরে। আস্তেধীরে গ্যাস অন করে চুলোয় চা বসালো। টালমাটাল অবস্থাতেই চা তৈরী করল। নিজের জন্য, রুমঝুমের জন্য। টি-টেবিলে চা রেখে ডাকল,

‘ঝুম, চা খাবি আয়। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’

ছোটোবেলা থেকে আদিয়ান তার যত্ন নেয়, স্নেহ-মমতা ও আদরে-শাসনে সাথে আগলে নেয়, সব ধরনের বিপদ ও গালিবকা থেকে বাঁচিয়ে নেয়, এসব কথা ভেবে সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে বেরিয়ে এলো রুমঝুম। সামনে এসে কপালে ও গলায় হাত রেখে জ্বর মেপে বলল,

‘ভারী কিছু খেয়ে একটা ঔষধ মুখে নাও।’

‘আমি ঔষধ খাব না, ঝুম। জোর করিস না।’

অভিমানী মন নিয়ে রুমঝুম বলল,
‘তুমি কি শুভকে খুঁজবে না?’

‘খুঁজব তো।’

‘তারজন্য খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে সুস্থ হতে হবে। আর দ্রুত সুস্থ হতে হলে ঔষধটা প্রয়োজন। এমনি-এমনি অসুস্থতা সারবে ভেবেছ?’

‘তুই চিন্তা করিস না, শুভকে একদিন ঠিকই খুঁজে বের করব।’

‘সেই দিনটা কবে আসবে?’

প্রশ্ন করে রান্নাঘরে চলে গেল রুমঝুম। আদিয়ান অসুস্থ দেখে তার জন্য নরম খিচুড়ি রান্না করেছিল। সেটাই একটা প্লেটে তুলে নিয়ে এলো। ততক্ষণে চা শেষ করে ফেলেছে আদিয়ান। প্লেট রেখে রুম থেকে ঔষধ নিয়ে এসে রুমঝুম বলল,

‘এক্ষুণি খাবে।’

একসাথে এতগুলো ঔষধ দেখে আদিয়ান বলল,
‘এগুলো কীসের ঔষধ?’

মাজেদা খাতুন যখন বিকেলে দেখা করতে এসেছিলেন, তখনই আদিয়ানের অসুস্থতার কথা জেনে নিজের ছেলেকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে ঔষধগুলো আনিয়েছেন। রুমঝুম জানে আদিয়ান ঔষধ খায় না, এগুলোও খাবে না। খামোখা টাকা নষ্ট। কিন্তু এসব তো আর মাজেদা খাতুনকে বুঝানো যাবে না। এই কারণেই রেখে দিয়েছে। যদি বুঝিয়ে-শুনিয়ে খাওয়ানো যায়। সে আদিয়ানের প্রশ্ন শোনে বলল,

‘আন্টি এসেছিলেন, দেখে গেলেন তুমি অসুস্থ। এরপর বিকেলে জাদীদ ভাইয়া এগুলো দিয়ে গেলেন।’

মাজেদা খাতুনের একটাই ছেলে এখন। দুই সন্তানের মা হলেও মেয়ের মৃত্যুর পর, এই একজনকে নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। নাম, জাদীদ আহমেদ। বর্তমানে সে পুলিশের চাকরিতে আছে। এই বাড়িতে আসার পর জাদীদের সাথে আদিয়ানের দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে দু’বার। জাদীদের কথা শোনে বলল,

‘ওহ…। আমাকে ডাকিসনি কেন?’

‘মরার মতো ঘুমাচ্ছিলে। কত ডেকেছি। শেষে জাদীদ ভাই বললেন, ‘থাক অসুস্থ মানুষকে আর ডাকবেন না। ঘুম ভাঙলে মনে করে ঔষধ খাইয়ে দিবেন।’ জাদীদ ভাই কিন্তু পুলিশ, ঔষধ না খেলে রিমান্ড দিবে।’

আদিয়ান হেসে খিচুড়ি মুখে নিল। স্বাদ নেই, তেতো। কিন্তু পেটের ক্ষিধে বলে সহ্য করে একটু একটু মুখে নিয়ে বলল,
‘আমি পুলিশ ভয় পাই না।’

‘ডাকব?’

‘ডাক দেখি।’

রুমঝুম যে সত্যি সত্যি জাদীদকে ডাকতে চলে যাবে ভাবেনি আদিয়ান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই জাদীদকে না পেয়ে মাজেদা খাতুনকে টেনে নিয়ে এলো। তিনি এসে বললেন,

‘এ কী, বাবা। ঔষধ খাচ্ছ না কেন?’

রসকষহীন মুখে আদিয়ান বলল,
‘আমি ঔষধ খেতে পারি না, আন্টি।’

‘দুটো মালটা নিয়ে এসো তো, মা।’

রুমঝুম মাল্টা নিয়ে এলে খোসা ছাড়িয়ে দ্রুতহাতে এক গ্লাস জুস তৈরী করলেন মাজেদা খাতুন। ঔষধ বের করে আদিয়ানের মুখের সামনে তুলে ধরলেন। আদিয়ান বাঁধা দিয়ে বলল,

‘আন্টি খাব না, বমিবমি ফিল আসে।’

আর কিছু বলার সুযোগ পেল না আদিয়ান। মাজেদা খাতুন আদুরে স্বরে বকবক করে ঠেলেঠুলে ঔষধ ঢুকিয়ে জুসের গ্লাস মুখের সামনে ধরে বললেন,
‘জুসটা খেয়ে নাও এখন, বমি আসবে না।’

মাজেদা খাতুনের এমনতর আচরণ দেখে আদিয়ানের মনে হলো, বহুদিন পর মায়ের চিরচেনা রূপকে সামনে দেখছে। মায়েরা এত আপন হয়? এত ভালোবাসতে জানে? রক্তের কেউ না, অথচ অনায়াসেই নিজের সন্তানদের মতো যত্ন করছেন। সে বিস্ময় ও ঘোর নিয়ে জুসে চুমুক দিল। সঙ্গে সঙ্গে মুখে থাকা সব ঔষধ তার পেটের ভেতরে চলে গেল। খাওয়া শেষে মাথায় হাত বুলিয়ে মাজেদা খাতুন বললেন,

‘এখন বিশ্রাম নাও। যদি কিছুর প্রয়োজন হয়, ডেকো।’

মাজেদা খাতুন চলে গেলে দরজা আটকে শব্দ করে হেসে উঠল রুমঝুম। আদিয়ান মুখে ও পেটে হাত চেপে বমি আটকানোর চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি সামলাতে দ্রুত আরেক গ্লাস জুস ধরিয়ে দিল রুমঝুম। বলল,

‘আরও বোলো, আমি ঔষধ খাব না, আন্টি। ঔষধ খেতে পারি না। বমিবমি ফিল আসে।’

রুমঝুম মজা নিচ্ছিল, আদিয়ান চোখ পাকিয়ে তাকালে সেদিকে পাত্তাই দিল না মেয়েটা। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। এমন সময় দরজায় আওয়াজ শোনে দ্রুতই সেদিকে ছুটে গেল। তার ঠোঁটেমুখে খুশিরা ঝিকঝিক করছিল। দরজা খুলতেই ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। লোকটা তব্দা খেল কি-না বুঝল না রুমঝুম। চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,

‘কিছু বলবেন, ভাইয়া?’

কী বলতে এসেছিল, ভুলে গেল জাদীদ। বোকার মতো তাকিয়ে রইল। পরস্ত্রী এটা জানার পরও মনের উচাটনকে সামলাতে পারল না। কোনো মেয়ের হাসি এত সুন্দর হয়? চেহারায় এত মিষ্টতা থাকে? নির্লজ্জ, বেহায়া, মানুষ হলি না। এগুলো বলে মনে মনে নিজেকে একগাদা গালি দিয়ে দিক হারিয়ে আমতা-আমতা করে বলল,

‘আপনার হাসব্যান্ডের শরীর এখন কেমন?’

***

চলবে…