#পায়ে_পায়ে_হারিয়ে
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৯
জাদীদকে ভেতরে আসার অনুমতি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল রুমঝুম, তার জন্য সামান্য চা-নাশতা তৈরী করার উদ্দেশ্যে। আদিয়ান সোফার কুশনে পিঠ ঠেকিয়ে দুর্বল শরীরের মধ্যে জোর ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল। জাদীদ সামনে এসে বলল,
‘এখন কী অবস্থা, ভাই? দুর্ঘটনা ঘটল কী করে?’
আদিয়ান মুচকি হাসল। সে নিজেও বুঝতে পারেনি, এরকম একটা মুহূর্তকে মোকাবেলা করতে হবে। এতগুলো বছর রাস্তায় একা বেরিয়েছে, হাঁটাহাঁটি, ঘোরাঘুরি, ছোটাছুটি করেছে, কখনও এরকম দুর্ঘটনা ঘটেনি। আজ হঠাৎ করেই এমন হলো। সবটাই বোধহয় আল্লাহর ইচ্ছা। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যথাতুর শরীর নিয়ে বলল,
‘মোড় ক্রস করতে গিয়েই দুর্ঘটনা ঘটে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, রিকশাওয়ালা নিজেকে বাঁচাতে আমাকে ও রিকশাকে বিপদের মুখে রেখে দৌঁড় দিয়েছেন। ভাগ্যিস আঘাতটা কম, নয়তো কী হতো…।’
রসিকতার ছলে কথা বলছিল আদিয়ান, জাদীদ হেসে ফেলল শোনে। বলল,
‘কী আর করবেন? দুর্ঘটনা তো আর বলেকয়ে আসে না। ক’দিন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
মাথা নেড়ে রান্নাঘরের দিকে চোখ রাখল আদিয়ান। রুমঝুম আসে কি-না দেখল। যেহেতু চা-নাশতা তৈরী করবে, দশ থেকে পনেরো মিনিট এদিকে আসবে না। এই সুযোগে আদিয়ান বলল,
‘আমার একটা সাহায্য লাগবে, ভাই।’
জাদীদ বলল,
‘কী রকম?’
‘আমার বেস্টফ্রেন্ড নিখোঁজ প্রায় দুই মাস হতে যাচ্ছে। থানাপুলিশ কিচ্ছু বাকি রাখিনি। গতকাল এস আই ফোন করে জানালেন ‘কানা জব্বার’এর ঠিকানায় যোগাযোগ করলে শুভর খোঁজ পাব। শুভ না-কি ওনার সাথেই আছে।’
জাদীদকে ভীষণ চিন্তিত দেখাল। আদিয়ান অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, ছেলেটা গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। একটা সময় জাদীদ বলল,
‘নিখোঁজ হওয়ার আগের ঘটনা মনে আছে? কারও সাথে শত্রুতা বা খারাপ কোনো রেকর্ড?’
‘সেরকম কিছু নেই। ওইদিন ফার্মগেট থেকে আমি ওকে রাজশাহীর বাসে তুলে দিয়েছিলাম। এর কয়েকঘণ্টা পর থেকে ওর ফোন বন্ধ। আংকেল-আন্টির সাথেও যোগাযোগ করেনি।’
জাদীদ মনে মনে ধারণা করল, শুভর সাথে ঠিক কী হয়েছে, বা কী হতে পারে। খানিকক্ষণ ভেবে বলল,
‘আমার মনে হয়, আপনার বন্ধু বাসেই কোনোপ্রকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন।’
‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কানা জব্বারের ঠিকানায় গেলে বুঝতে পারতাম।’
‘কানা জব্বারকে এখানে কোথায় পাবেন? দীর্ঘদিন ধরে ওই লোকটাকে তো আমি-ই খুঁজছি।’
‘মানে?’
‘মানে খুব সহজ। লোকটা ভয়ংকর লেভেলের সন্ত্রাস। এমন কোনো অন্যায় নেই যেটা সে করেনি। আমি তো এটাই ভাবছি যে, আপনার বন্ধুর সাথে তার লেনাদেনা কী! কেনই বা দুনিয়ার লোক থাকতে শুভকেই কানা জব্বারের চোখে পড়ল।’
‘হায় আল্লাহ’ বলে অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল আদিয়ান। কোথায় ফেঁসে গেল তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু! কীভাবে খোঁজ পাবে? দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। অনুরোধের সুরে বলল,
‘আপনি আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ। শুভকে না পেলে পাঁচ-পাঁচটা জীবনের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। একদিকে আমি ও ঝুম, অন্যদিকে আংকেল-আন্টি, আবার বাচ্চাটা। প্লিজ, ভাই। একটু সাহায্য করুন আমায়।’
জাদীদ বুঝল না, এই এক শুভকে নিয়ে এতজনের জীবন কীভাবে শঙ্কিত! বন্ধুর জন্য আদিয়ানের টান থাকা স্বাভাবিক। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের টান থাকা সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু স্বামীর বন্ধুর জন্য রুমঝুমের টান জন্মানো কতটা স্বাভাবিক? বিষয়টা খুব ভাবাল। ব্যক্তিগত দেখে এতকিছু জানার আগ্রহ দেখাল না। শুধু বলল,
‘কানা জব্বারের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে আমার কাছে। সামনে পেলে তাকে অ্যারেস্ট করা কঠিন কোনো ব্যাপার না। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই কানা জব্বারকে সবাই নামেই চিনে। সামনা-সামনি কেউ দেখেনি। যার কারণে ওই লোকটাকে অ্যারেস্ট করার অনুমতি থাকা সত্বেও চেহারা অপ্রকাশ্যে থাকার কারণে ও সঠিক লোকেশন না জানার কারণে তাকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
আদিয়ান অবাক হয়ে বলল,
‘একজন অপরাধীর সামান্যতম ইনফরমেশন নেই আপনাদের কাছে?’
‘ইনফরমেশন আছে কিন্তু ছবি নেই, ঠিকানা নেই। এই কারণেই বিষয়টা জটিল। তবুও আমি চেষ্টা করব, দু’জনকে খুঁজে বের করতে। লোকমুখে শুনেছি কানা জব্বার এই শহরেই থাকে, কতটা সত্যি জানি না। যদি ওই লোকটা এই শহরে থেকে থাকে, তাহলে আমার ধারণা শুভও এই শহরেই আছে।’
এইটুকু বলে আবারও গভীর ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল জাদীদ। কতক্ষণ ভেবে চিন্তিতমনে বলল,
‘আপনাকে যে খবর দিল, উনি কোন থানার এস আই?’
‘রাজশাহীর…।’
‘উনি আপনাকে ঠিক কী বলেছেন?’
গতকালকের ফোনালাপ মনে করার চেষ্টা করল আদিয়ান। স্পষ্ট মনে আছে, সেটুকু মনে করে বলল,
‘এস আই বলেছিলেন, শুভর খোঁজ পেয়েছেন। কানা জব্বারের বিশ্বস্ত লোক এসে জেলা কারাগার থেকে শুভকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। এতটুকুই…।’
জাদীদ চরম বিস্ময়ে জানতে চাইল,
‘শুভ কারাগারে কী করছিল?’
‘সেটাই তো জানি না। জিজ্ঞেস করা হয়নি।’
ভাবনাগুলো কেমন যেন জটিল হয়ে গেল। জাদীদ ভেবে পেল না, কানা জব্বার যদি ঢাকায় থাকে, রাজশাহীতে তার লোকজন কী করছে? যদি রাজশাহীতে তার প্রভাব থাকে, তাহলে এস আই কানা জব্বারকে কীভাবে চিনে! আর যদি চিনেও তাহলে কি ওই এস আই ঘুষখোর? কোনোভাবে সে কানা জব্বারের হয়ে কাজ করছে না তো? যদি এরকম হয় শুভকে আটকে রেখে লোকটার লাভ কী? এস আই জেনে-বুঝে আদিয়ানকে দৌঁড়াল না-কি এখানে অন্যকোনো গল্প লুকিয়ে আছে? সে ঝটপট বলল,
‘এস আই’র নম্বরটা দিন। আমি যোগাযোগ করে দেখি, কানা জব্বারের নাম সে কীভাবে পেল!’
ফোনের সেইভ অপশন থেকে এস আই’র নম্বরটা বের করে দিল আদিয়ান। জাদীদ সেটা নিজের ফোনে টুকে নিয়ে অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে একটা ভাবনা সাজিয়ে বলল,
‘আমার মনে হয়, শুভ নিজের শহরে পৌঁছেছিল, কিন্তু বাড়ি অবধি পৌঁছাতে পারেনি, কোনো কারণে মাঝপথে তাকে আটকানো হয়েছে। অথবা এমনও তো হতে পারে, আপনার বন্ধু অপরাধ জগতের সাথে জড়িত!’
মলিনমুখে বসে রইল আদিয়ান। চিন্তা গাঢ় হচ্ছে। শুভর জন্য, রুমঝুমের জন্য, অনাগত বাচ্চাটার জন্য। সে জাদীদের কথা শোনে বলল,
‘আমার বন্ধু এতটাও খারাপ নয়, জাদীদ সাহেব। ওর কিছু বদভ্যাস আছে তাইবলে ও অপরাধী এটা আমি মানতে পারছি না। কোনোদিন যে ছেলে কাউকে গালিগালাজ করেনি, নারীকে অসম্মান দিয়ে কোনো কথা বলেনি, রাস্তাঘাটে লোকজনের সাথে তর্কাতর্কির সিচুয়েশন তৈরী হলেও তর্কে জড়ায়নি, সে অপরাধ জগতের সাথে যুক্ত এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার কোথাও বুঝতে ভুল হচ্ছে। এখানে হয়তো অন্যকোনো গল্প লুকিয়ে আছে, যা আমরা জানি না।’
এটা জাদীদ নিজেও ভাবছিল। কিন্তু সেই অন্যগল্পটা কী? শুভ খারাপ নয়, কিন্তু খারাপ লোকের কেউ তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেছে, সেটাও তো গভীর ভাবনার জন্ম দিচ্ছে মনে। সে আরেকটু সুক্ষ্ণভাবে ভাবার জন্য চুপ হয়ে বসে রইল।
আদিয়ান বলল,
‘কানা জব্বারের লিংক পেলে শুভকেও খুঁজে পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। আপনারা ওর কোনো ঠিকানা জানেন না?’
‘জানলে কি আর বসে থাকতাম? সঙ্গে সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম।’
রুমঝুম কিছু দই-মিষ্টি ও টুকরো টুকরো ফল হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। তাকে দেখে মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে গেল আদিয়ান। এক্ষুণি শুভর ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই। আগে কানা জব্বারকে খুঁজে বের করুক, তারপর শুভকে খুঁজে পেলে সব সত্যি জানাবে। এখন যদি রুমঝুমকে এত কথা বলে, মেয়েটা নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে। তা-ই টপিক চেঞ্জ করতে জাদীদকে বলল,
‘নিন, একটু পুষ্টিকর খাবার খান। তাহলে শরীরে এ্যানার্জি ফিরে পাবেন। শক্তিশালী নাহলে তো আবার আসামীর পিছনে দৌঁড়াতে পারবেন না।’
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে হাস্যরসের এই কথা ঠিক বোধগম্য হলো না জাদীদের। সে বোকা বোকা দৃষ্টিতে আদিয়ানের দিকে তাকালে, চোখের ইশারায় রুমঝুমকে দেখিয়ে খুকখুক করে কাশি দিয়ে একগ্লাস পানি খেল। দিনরাত চোর-ডাকাত ও আসামীদের পিছনে ছুটতে থাকা জাদীদের এই সিগন্যাল বুঝতে খুব একটা দেরী হলো না। বুঝতে পেরে মুচকি হেসে সে-ও রসিকতার ছলে বলল,
‘এইমুহূর্তে এ্যানার্জি আপনার দরকার, ভাই। আমি যথেষ্ট ফিট আছি।’
ফলমূল দিয়ে চা আনার কথা বলে চলে গেল রুমঝুম। জাদীদ এবার ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘হুট করে টপিক চেঞ্জ করলেন কেন?’
আদিয়ান বলল,
‘ঝুমের জন্য। ও জেনে গেলে সমস্যা আছে।’
‘কী সমস্যা?’
বলতে গিয়ে আদিয়ানের খেয়াল হলো, এখন যদি শুভ ও রুমঝুমের বিয়ের কথা বলে, বাসাটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এই শহরে সহজে বাসাভাড়া খুঁজে পাওয়া যায় না। অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে? উপায়ন্তর না পেয়ে বলল,
‘ছোটো মানুষ। বয়স ও অভিজ্ঞতা কম। এরমধ্যে আবার আবেগী। ছোটোখাটো একটা বিপদের কথা শুনলেই হাউমাউ করে কাঁদে। শুভকে ঝুম খুব শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। নেগেটিভ কিছু শুনলে অযথাই ভুল বুঝবে।’
***
অসুস্থ শরীর নিয়ে সকালে অফিসে এলো আদিয়ান। আসার পরই বস তাকে ডাক পাঠালেন। জানে, আজ কপালে একগাদা বকা নিশ্চিত। গতকাল অফিসে আসেনি, ফোন ধরেনি, কলব্যাক করেনি। অভিযোগের তো শেষ নেই। যা বলেন, মুখবুঁজে শুনে ফেলবে এমনভাবে নিজের মনকে বুঝিয়ে দরজায় এসে নক করল। তোফাজ্জল হোসেন একবার চোখ তুলে তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আদিয়ান পা ফেলল, ধীরেধীরে। মুখোমুখি দাঁড়াতেই সামনের চেয়ার দেখিয়ে তিনি বললেন,
‘বসুন…।’
ভীত মন নিয়ে চেয়ারে বসলো আদিয়ান। টের পেল সে ঘামছে। কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। টিস্যু বের করে গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছে নিল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে তোফাজ্জল হোসেন তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন,
‘শরীর কেমন এখন?’
হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল আদিয়ান। তোফাজ্জল হোসেন সরাসরি দৃষ্টি ফেললে তোতলানো কণ্ঠে আদিয়ান বলল,
‘জি… জি স্যার, ভালো।’
‘ক’দিন আগেই এক সপ্তাহের ছুটিতে অফিস আসেননি। এখন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ঘরে বসে আছেন। আপনাকে কতবার কল করা হয়েছিল জানেন?’
‘স্যরি স্যার, হুঁশে ছিলাম না।’
‘এখন কি হুঁশে আছেন?’
‘কপালে যে কী আছে’ এতটুকুই বিড়বিড়াল আদিয়ান। তবে খুববেশি জোরে কিছু বলল না। শুধু নতমুখে বলল,
‘নেক্সট টাইম এমন হবে না, স্যার।’
‘খেয়াল থাকবে তো?’
‘জি, স্যার।’
নিশ্চয়তা পেয়ে একটা ফাইল এগিয়ে দিলেন তোফাজ্জল হোসেন। বললেন,
‘কালকের ফেলে রাখা কাজ। আজকের মধ্যেই এটা দেখে দিবেন। ভুলত্রুটি সব ঠিকঠাক করে দিবেন।’
‘একদিনেই?’
তোফাজ্জল হোসেন কড়া শাসনের চোখে তাকালেন। ওই এক দৃষ্টিতে রাগ, মেজাজ ও অহংকারের বিরাট একটা দম্ভ চোখে পড়ল আদিয়ানের। ভুল সময়ে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে এটা বুঝেই মুখ নামিয়ে বলল,
‘চিন্তা করবেন না, আমি আজকের মধ্যেই ফাইলের সব ত্রুটি ঠিক করে দেব।’
‘ওকে, যান।’
চেয়ার ছেড়ে দরজা পর্যন্ত এগোলো আদিয়ান। পিছন থেকে তোফাজ্জল হোসেন বললেন,
‘গতকাল নওমীর সাথে দেখা হয়েছিল আপনার?’
সামান্য একটা প্রশ্ন, এর গভীরতা কতটুকু হতে পারে সেই বিষয়ে কোনো ধারণা নেই আদিয়ানের। ভাবতেও গেল না। উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি, স্যার… দুর্ঘটনার সময়…।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলেন তোফাজ্জল হোসেন। চেয়ার ছেড়ে আদিয়ানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন। আপাদমস্তক দেখে বললেন,
‘ও আমার মেয়ে। কোনো ছোটোলোকের সাথে আমি ওর চলাফেরা মেনে নিতে পারব না। দ্বিতীয়বার ওর সাথে দেখা হলে একজন অপরিচিত হয়ে থাকবেন। ভুল করেও ওর সাথে কথা বলবেন না, ওর সামনে দাঁড়াবেন না। চেনেন না বলে মুখ ফিরিয়ে নিবেন। আমি চাই না, আপনার সাথে ওর আর দেখাসাক্ষাৎ বা কথাবার্তা হোক। নিজেকে আয়নায় দেখেছেন তো একবার? ওর আর আপনার মধ্যকার পার্থক্য বুঝেন? আপনি আমার মেয়ের নখেরও যোগ্য নন, এটা কি জানেন?’
এত কথার মারপ্যাঁচে আদিয়ান সত্যিই অবাক হলো। চরম সত্যটাও ঠিকই বুঝে নিল। সাধারণ একটা ব্যাপারকে নিয়ে ভদ্রলোক কেন এত ভাবছেন? তাকে সন্দেহ করছেন? খারাপ ভাবছেন? সে মুচকি হেসে বলল,
‘কে ছোটোলোক কে বড়োলোক সেটা এইভাবে না বললেও হবে, স্যার। এটা বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আমার আছে।’
‘আপনি কি আমার সাথে তর্ক করছেন?’
‘না, স্যার…। আমাকে কয়েকটা মিনিট সময় দিন। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।’
আদিয়ান চলে যাওয়ার পর তোফাজ্জল হোসেন দাঁত কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়েটার যে কী হয়েছে! গতকাল বাড়ি ফেরার পর থেকে বার বার বলছে, ‘বাপি যে লোকটার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, সে তোমার অফিসেই চাকরি করে। প্লিজ, তুমি তাকে বকো না। সে অফিসের কাছাকাছি এসেছিল, অফিসে যেতে চেয়েছিল, আমি-ই বাঁধা দিয়েছি, অফিসে না পাঠিয়ে তাকে নিয়ে নার্সিংহোম গিয়েছি।’ আজ আবার অফিসে আসার পথে সে-ই একই ঘ্যানঘ্যানানি। শোনে কানে পোকা ধরে গেল তাঁর। নওমী লোকটা, লোকটা করলেও এই লোকটা কে সেটা বুঝতে দেরী হয়নি ভদ্রলোকের। কারণ গতকাল আদিয়ানই অফিস কামাই করেছে। আবার দারোয়ান রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনতে গিয়ে অফিসের কাছাকাছি আদিয়ান ও নওমীকে একসাথে দেখেছে। নিজের মেয়ের এই অতি ভালোমানুষী আচরণটাই বিরক্ত লাগে তাঁর। তা-ই তিনি চান, মেয়েটা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের এড়িয়ে চলুক। কিন্তু নওমী সেটা শোনে না। সে ফটফট করে বলে,
‘আমার কাছে ধনী-গরীব সবাই সমান। কারও মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না আমি। সবাই-ই তো এক স্রষ্টার সৃষ্টি। রব যদি সবাইকে তাঁর বান্দা মানতে পারেন, তবে আমি কেন সবাইকে মানুষ ভাবতে পারব না?’
আবারও দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করল আদিয়ান। তোফাজ্জল হোসেন জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল ভদ্রলোকের দিকে। তিনি সেটা হাতে নিলেন। চোখ বুলালেন। রিজাইন লেটার দেখে অবাক হয়ে বললেন,
‘এসবের মানে কী?’
আদিয়ান খুব সোজাসাপটা বলল,
‘মানুষের মধ্যে হয়তো ধনী-গরীবের পার্থক্য থাকে, কিন্তু কে ছোটোলোক, কে বড়োলোক সেটা প্রকাশ পায় তার আচরণে। আমার কোনো ব্যবহারে যদি আপনি দুঃখ পেয়ে থাকেন, ক্ষমা করে দিবেন। এই অফিস, এই চাকরি, এসব আমার জন্য নয়। আমি খুব সাধারণ মানুষ। আমার ভাবনাগুলোও অতি সাধারণ। নামী-দামী লোকজনের সাথে ওঠাবসার যোগ্যতা আমার না থাকলেও আত্মসম্মানবোধ প্রখর। এইটুকুতে আঘাত আসলে আশি হাজার টাকার চাকরিটাকেও আমি নিমিষেই তুচ্ছ করে দিতে পারি। কারণ ওইমুহূর্তে, ওই টাকাটা আমার জন্য জাস্ট নর্দমা হয়ে গেছে। আর যা কিছু নর্দমা, সেটা আমি এড়িয়েই চলি। ভুল করেও দ্বিতীয়বার আর ফিরেও তাকাই না। আসছি…। ভালো থাকবেন।’
হাতে থাকা ফাইল টেবিলের ওপর রেখে নিজের ব্যাগ নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো আদিয়ান। দুর্বল শরীর নিয়ে অফিস আসার কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তবুও দায়িত্ব-কর্তব্যের টানে এসেছিল। ভাবেনি, বস তাকে এইভাবে অপমান করবেন। নিচে আসতেই দেখা হলো নওমীর সাথে। মাত্রই একটা উবার থেকে নামল মেয়েটা। দেখেও না দেখার ভান করল আদিয়ান। দূরে সরে দাঁড়িয়ে রিকশা থামাতে চাইলে নওমী বলল,
‘আপনি সুস্থ আছেন? চলে যাচ্ছেন যে? বাপি কি রাগারাগি করেছে?’
আদিয়ান কোনো উত্তর দিল না। ফিরেও তাকাল না। রিকশা দাঁড়াতেই ঝটপট উঠে বসে বিদায় নিল। নওমী ঠোঁট উল্টে বিড়বিড় করল,
‘এত অহংকার, বাপরে…।’
অফিসে পা রেখে ঘটনা কী তা আন্দাজ করতে পারল নওমী। একেকজন যেভাবে আদিয়ানের নাম নিয়ে ফিসফিস করছে, তাতে সে নিশ্চিত হয়ে গেল তার বদরাগী বাপিই কিছু করেছে। নয়তো লোকটা এইভাবে মুখ ফুলিয়ে চলে গেল কেন? সে তার বাপির কাছে না গিয়ে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে জানতে চাইল,
‘অফিসে কোনো ঝামেলা হয়েছে? একজনকে চলে যেতে দেখলাম। উনি তো এই অফিসেই চাকরি করেন, তাই না?’
ম্যানেজার কটাক্ষ করে জানতে চাইলেন,
‘কে? আদিয়ান সাহেব?’
‘ওনার নাম আদিয়ান?’
‘হ্যাঁ, মোহাম্মদ আদিয়ান ফারুকী।’
‘কেন চলে গেলেন?’
‘জানি না। হুট করেই রিজাইন দিলেন। স্যার হয়তো রাগারাগি করেছেন। একটু আগেই স্যারের সাথে কথা বলতে দেখলাম।’
কী গণ্ডগোল কিছুই বুঝলো না নওমী। কাহিনী কী সেটাও জানতে ইচ্ছে হলো না। সে যে দরকারে এসেছিল, সেটা সারতেই তোফাজ্জল হোসেনের সামনে গিয়ে বলল,
‘তুমি ফোন ধরছ না কেন, বাপি? মাম্মি বলছিল, আজ একটু নানুর বাসায় যেতে চায়। রাতে তুমি কি বাড়িতে খাবে না-কি আমাদের সাথে জয়েন হবে?’
***
চলবে…