পারবোনা আমি ছাড়তে তোকে পর্ব-৪২+৪৩

0
13

#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৪২

~” ক্যাম্পাস চত্বরটায় ঝিমধরা রোদ নেমে এসেছে। গাছের পাতার ছায়া মাটিতে অলস নকশা এঁকে রেখেছে। সেখানেই এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মাহি ‘চোখ দূরে, কিন্তু মন যেন আরও বহু দূরের কোনো অচেনা জগতে। তার দৃষ্টি সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে আছে অসীমের পানে। ঠোঁটে নিঃশব্দ এক নিঃশ্বাস, মুখে একরকম বেপারোয়া ভাবনার ছায়া।

রাইসা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল তাকে। শেষমেশ ধীরে এসে মাহির কাঁধে হাত রাখে। সেই মৃদু স্পর্শেই যেন চমকে ওঠে মাহি, চিন্তার ঘোর কাটে তার। চোখ ফিরিয়ে তাকায় রাইসার দিকে, চোখে অদ্ভুত এক ক্লান্তি, সঙ্গে গভীর এক প্রশ্নের ছায়া।

রাইসা নরম স্বরে বলে,
— “কি রে, আবার হারিয়ে গেলি কোথায়?”

মাহি কেবল হালকা একটা হাসি দেয়। কিন্তু সে হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে কিছু না বলা কথা, অপ্রকাশ্য এক গল্প।

হালকা হাসিটা যেন কুয়াশার মতন আছে, আবার নেইও। রাইসা একটু ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাহির মুখের দিকে। পরিচিত এই চেহারাটা আজ যেন একটু অচেনা, একটু বেশি নিঃসঙ্গ।

–““আচ্ছা, বলবি না তো কি ভাবছিলি?” রাইসা আবার জিজ্ঞেস করে এবার কন্ঠে একটু জোর।

~”মাহি হঠাৎই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বাতাসে হাত নেড়ে হেসে বলল,
— “আরে ধুর, কি আর ভাববো! ভাবছিলাম, তুই তো এখন আমার ভাইয়ের বউ হয়ে গেছিস… আমি তোকে এখন কী বলে ডাকবো? বান্ধবী, না কি ভাবি?”

কথাটা শুনে রাইসার গাল দুটো মুহূর্তেই লাল টকটকে হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে একটা লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,

“ধুর, রাখ তো তোর বাজে কথা। এসব ভাবছিস কেন? আসল কথা বল, কী নিয়ে এত ভাবছিলি?”

মাহি একটু হেসে মুখ ঘুরিয়ে দূরে তাকিয়ে বলল,

–“আরে সত্যি বলছি, এসবই তো ভাবছিলাম। জীবন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে রে…”

রাইসা এবার গম্ভীর স্বরে, একটু অধিকার খাটিয়ে বলে উঠল,

” দেখ মাহি, আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি। তাই প্লিজ, ভুলভাল না বুঝিয়ে আসল কথাটাই বল। আমার কাছে লুকাস না কিছু।”

মাহি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত নিঃশব্দ হাসি,

–” হঠাৎ করেই এক নিঃশ্বাসে যেন কথা ফুঁসে উঠলো মাহির বুক থেকে। কণ্ঠটা কাঁপছিল একটু, চোখ যেন হঠাৎই ভারী হয়ে উঠেছে অজানা জলঘন মেঘে। আনমনে, নিচু গলায় বলল সে,

— “তুই তো জানিস রাইসা… আমি মনেপ্রাণে, নিঃশব্দে, সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে ইরফান ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছি। এই ভালোবাসা কোনো শিশিরের মতো হালকা নয়, এটা যেন আমার বুকের গভীরে শেকড় গেথে বসে আছে। এখন তাকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আর ওকে পাওয়া… সেটাও তো আমার এক রঙহীন, অসমাপ্ত, অসম্ভব স্বপ্ন।

~” রাইসা মাহির দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকাল। চোখে ছিল একধরনের শান্ত স্নেহ, বন্ধুত্বের গভীর আশ্বাস। ধীরে, নরম কণ্ঠে বলল সে,

— “কেন পাবি না তুই ইরফান ভাইকে? এখনো তো তাঁর জীবনে কেউ আসেনি। তুই চাইলে, তোর ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে তাঁর মনে জায়গা করে নেওয়া তোর পক্ষে একদম অসম্ভব নয়।”

মাহি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। চোখ নামিয়ে একবার গভীরভাবে শ্বাস নিল, তারপর একটা শুকনো ঢোঁক গিলে ফিসফিস করে বলল,

— “সে তো এত হ্যান্ডসাম, স্টাইলিশ, সফল… চারপাশে কত মেয়ে ঘুরে। যদি হঠাৎ করে তার জীবনে অন্য কেউ চলে আসে, সেই ভয়টা আমাকে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তাড়া করে বেড়ায় রাইসা। আমি… আমি পারব না রে, আমার চোখের সামনে ইরফান ভাইকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখতে। সেই কল্পনাটাই আমাকে ভিতর থেকে ভেঙে দেয়।”

রাইসা এবার একদম সরল সুরে, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

“তাহলে প্রপোজ করে ফেল। নিজের ভালোবাসার কথা তাকে জানিয়ে দে। এত ভয় পাস কেন?”

মাহি চমকে উঠল। যেন হৃদয়ের গভীর এক গোপন কুঠুরি হঠাৎ করে কেউ খুলে দিয়েছে। বিস্ময়ে চোখ বড় করে বলল,

“কি-হ্…! তুই কি বললি?!”

–“হ্যাঁ, , ঠিকই তো বললাম,” রাইসা এবার একটু দৃঢ় স্বরে বলে উঠল, “দেখ, সময় থাকতে তোর মনের কথা ইরফান ভাইকে জানিয়ে দে। পরে যদি আর কিছু করার না থাকে, তখন শুধু আফসোসই করতে পারবি।”

মাহির কণ্ঠে লজ্জা আর আতঙ্ক নিয়ে বলে,

“কিন্তু…”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রাইসা স্নিগ্ধ অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বলে ওঠে,

“দেখ, এভাবে অমীমাংসিত অনুভূতির ভেতর ঝুলে থাকাটা কোনো কাজের না। যদি সত্যিই ভালোবাসিস, তবে সাহস করে সবটুকু বলে দে তাকে । আমার তো মনে হয়… ইরফান ভাইও তোকে কম কিছু ভাবেন না।”

মাহি বিস্ময়ভরা হাস্কি স্বরে ফিসফিস করে বলল

“দুনিয়াজূড়ে এত মেয়ে থাকতে, ইরফান ভাই আমাকে কেন পছন্দ করবে শুনি?”

রাইসা এবার একটু মজা করে, দু’হাত আড়াআড়ি করে রেখে মৃদু হেসে বলল,

“তাই যদি হয়, তাহলে তুইও তো বলতে পারিস না কেন দুনিয়ায় এত ছেলে থাকতে তুই ইরফান ভাইয়ের প্রেমে পড়লি?”

মাহি চুপ করে গেল। একটু পরে চোখে স্বপ্নমাখা ছায়া নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,

“জানি না রে… তবে ইরফান ভাইকে দেখলেই আমার মনে একরকম ঝড় ওঠে। বুকের ভেতর কেমন একটা আলোড়ন চলে ।”

রাইসা এবার একপলক তাকিয়ে থেকে মায়াভরা হাসি দিয়ে বলল,

__” তুই কি কম সুন্দর রে? তোর চোখে যে আলাদা একটা আলো আছে। তোকে প্রপোজ করা ছিল আমাদের কলেজের অর্ধেক ছেলেদের স্বপ্ন… বুঝলি?”

মাহি এবার একটু বাঁকা হাসে, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। মুখ চেপে হেসে বলল,

–“আর বাকি অর্ধেক ছেলেরা তো স্বপ্নে তোকে দেখে!”

একটু থেমে, চোখের পলকে এক গভীর ভাব নিয়ে তাকাল দূরের ফাঁকা দিগন্তে। তারপর রাইসা ভ্রু জোরা কিঞ্চিৎ বাকা করে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে কি আমি চলে যাবো ওদের স্বপ্নের রানী হতে..?

মাহির মুখ থেকে হঠাৎ হাসিটা মিলিয়ে গেল। চোখের পলক বারবার কাঁপতে লাগল,

“তাহলে… আমার ভাইয়ার কী হবে রে?”

রাইসা কিছু বলল না। তার ঠোঁটে শুধু এক লাজুক, স্নিগ্ধ হাসি। সে ধীরে ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। সূর্যের আলো এখন একটু নরম, রোদের ছায়ায় হাওয়ার দোলা। রাইসা নীরবে হাঁটা শুরু করল গোধূলির দিকে।

পেছন থেকে মাহি একটু চুপ থেকে হঠাৎই ডাকল,

“শুনছিস…?”

রাইসা ফিরে তাকাল না, কেবল কানের দুলটা একটু দুলে উঠল বাতাসে।

~” ক্লান্ত দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেলের নরম আলো। ফাহাদ আজ অনেক দেরিতে ফিরেছে অফিস থেকে। প্রতিদিন দুপুরে একটু সময় করে বাসায় ফিরলেও, আজ সে ফিরলো না। রাইসা বুঝতে পারছে না এতো দেরি কেনো হচ্ছে, অথচ ফোনটা হাতে নিয়েও আর ডায়াল করা হয়ে ওঠেনি। কে জানে কোন এক অনামা বাধনে তার আঙুল থেমে গিয়েছিল। হয়তো শুধুই নিঃশব্দ অপেক্ষা।

ফাহাদ ঘরে ঢুকে ধীরে ধীরে চেয়ারে গা ভাসাল। রুমটা শীতল, এসির ঠান্ডা হাওয়ায় চারপাশ জমে আছে, তবু তার কপালের কোণে জমেছে ঘামের এক বিন্দু। ক্লান্তির ভারে মুখটা যেন আরও নিস্তেজ লাগছে। রাইসা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। চোখে একটা মিশ্র অনুভূতি, ।

–“এক মুহূর্ত পরে রাইসা উঠে গেলো, রান্নাঘর থেকে একটা গ্লাসে ঠান্ডা লেবুর সরবত বানিয়ে আনলো। ছোট্ট একটা ট্রেতে গ্লাসটা রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ফাহাদের দিকে,

ফাহাদ চোখ তুলে একবার তাকালো রাইসার দিকে। সে দৃষ্টিতে ক্লান্তি আছে, কিন্তু কোথাও যেন রয়ে গেছে একটা চুপচাপ ভালোবাসার ছায়া। কোনো কথা না বলে সরবতটা হাতে নিয়ে এক টানে শেষ করলো। তারপর নিঃশব্দে উঠে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো, শরীরজুড়ে এক অলক্ষ বিষণ্নতা।

রাইসা দাঁড়িয়ে রইলো হাতের ট্রেটা নিচে নামিয়ে, চোখে অনুচ্চার এক আকুলতা। দিনশেষে দু’জন মানুষ, একটা ঘরে, একসাথে, অথচ কোথাও যেন আলাদা।

–” নিজের সমস্ত সংকোচ, ও লজ্জা সরিয়ে, অবশেষে রাইসা ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“কিছু কি হয়েছে…?”

ফাহাদ চোখ মেলেনি তখনও। ক্লান্ত দেহ, বিষণ্ন মুখ, চোখ বন্ধ রেখেই যেন সব শব্দকে মুছে দিতে চাইছিল। স্থির, মৃদু কণ্ঠে উত্তর দিলো,

~’ “না, তেমন কিছু না। আজ একটু বেশি কাজের চাপ ছিলো… মাথাটা একটু ধরেছে।”

__” রাইসা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। হঠাৎ ফাহাদ অনুভব করলো—নরম, কোমল এক স্পর্শ তার কপালের কাছটায় এসে থেমেছে। অবাক হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেল সেই পরিচিত, অপার স্নিগ্ধতায় মোড়া মুখটা, রাইসা। চুলের গাঁথুনি আলগা হয়ে গেছে, চোখ দুটোয় হালকা ক্লান্তি, কিন্তু তবুও সেই চিরচেনা কোমলতা যেন আলো ছড়িয়ে আছে।

_” রাইসা কপাল কুঁচকে, নরম কণ্ঠে রাইসা বলল,

“কি হলো, আবার তাকালেন কেনো? চোখ বন্ধ করে রাখুন… মাথাটা একটু টিপে দিই, ভালো লাগবে।”

_” ফাহাদ স্থির হয়ে রইলো। চোখের সামনে এমন এক মুখ, এমন এক আশ্রয়, যাকে দেখে চোখ বন্ধ করা যায় না। কিন্তু সে কিছু বললো না, শুধু নিঃশব্দে চোখ বুজলো। রাইসার আঙুলের নরম ছোঁয়ায় মাথার যন্ত্রণাটা যেন একটু একটু করে গলে যেতে লাগলো। শুধু মাথায় নয়, মনে জমে থাকা ক্লান্তি ও যেন একটু একটু করে ভেসে যাচ্ছে সেই মমতার গন্ধে।

__” রুম একা বসে আছে মাহি । চারদিকে নীরবতা, শুধু হৃদয়ের শব্দ, শুধু মনছোঁয়া ভাবনারা। চোখ দুটো জানালার ফাঁকে চলে গেলেও মনটা একটানা ছুটে চলেছে, ইরফান ভাইয়ের কাছে। কীভাবে বলবে? কোথা থেকে শুরু করবে? ভাবতেই গাল দুটো লজ্জায় রঙ ছুঁয়ে যায় হালকা গোধূলির আভায় যেন জ্বলে ওঠে তার মুখ।

রাইসা ঠিকই বলেছে, আর কতদিন নিজেকে এভাবে বন্দি রাখবে! মনের কথাগুলো আর হৃদয়ে ধরে রাখা যায় না। আজই… হ্যাঁ, আজই সে সবকিছু বলে দেবে। অনেকদিনের অনুভূতি, সব জমানো আবেগ, সবটা উজাড় করে দেবে ইরফান ভাইয়ের সামনে। নিজেকে শক্ত করে তুলল মাহি। ধরা গলায় নিজেকে সাহস দিল ‘হবে যেটা হোক, এবার চুপ করে থাকলে আর চলবে না।’

সিদ্ধান্ত নিয়েই দরজার কাছে এগিয়ে এলো সে। দরজার হাতল স্পর্শ করতেই হঠাৎ,

দেখে থমকে গেল মাহি।

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন ইরফান ভাই।

পায়ের তলার মাটি যেন হঠাৎ করেই দুলে উঠল। বুকের ভেতর সমস্ত অনুভূতিগুলো একসাথে ছুটে বেড়াতে লাগল, যেন হৃদয় নামক কোনো পাখির খাঁচা থেকে তারা উড়তে চাইছে, ছুটে যেতে চাইছে ইরফান ভাইয়ের দিকে।

মাহির চোখ বড় হয়ে গেল। শব্দ আটকে গেল গলায়।

ইরফান ভাই… এখানে? এই মুহূর্তে?

মাহির মনে প্রশ্নের ঢেউ।

~”ইরফান মৃদু স্বরে বললো,
” ভেতরে আসতে পারি…?”

শব্দগুলো যেন ধীরে ধীরে ভেদ করে মাহির ভাবনার আবরণ। ঘোর থেকে বাস্তবে ফিরে এলো সে, চোখ তুলে তাকালো ইরফানের দিকে। মুখে কিছু বলল না, শুধু মাথা নেড়ে সম্মতির ইশারা দিল।

ইরফান ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো, আশপাশে একবার চোখ বুলিয়ে পাশে থাকা টেবিলের চেয়ারে বসে পড়ল। তার চোখে এক ধরণের অস্থিরতা, আর মুখে লুকানো এক অপার সংযম, যেন বহু কিছু বলার আছে, অথচ কীভাবে বলবে, জানে না।

মাহির বুকের ভেতর তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, নিঃশব্দে, নিজের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো,

“মাহি, দুর্বল হয়ে পড়িস না। আজ তোকে বলতেই হবে। মনের কথা বুকের ভেতর পুষে রাখলে আর হবে না। অনুভবগুলোকে আজ মুখে আনতেই হবে।”

এই বলে মাহি একরাশ সাহস নিয়ে গলা খোলার চেষ্টা করল। ঠোঁট ফাঁক হতেই…

ইরফান গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,

“একটা কথা বলতে এসেছিলাম, মাহি। বলবো…?”

মাহির বুকটা ধক করে উঠলো। কী বলবেন ইরফান ভাই? কোনো বিশেষ কথা? এমন কিছু, যা বদলে দিতে পারে তার সমস্ত জীবন?

মাহি ভাবনায় ডুবে গেলো। রাইসার কথাগুলো যেন আবার কানে বাজতে লাগল,

–” ইরফান ভাইও হয়তো তোকে পছন্দ করে ?”

তবে কি…? তবে কি আজ তিনিও তার মনের কথা বলতে এসেছেন?

মুহূর্তটাকে স্থির ধরে রাখার আগেই, ইরফান নরম গলায় বললো,

“আমি পাঁচ দিনের জন্য থাইল্যান্ড যাচ্ছি, একটা কন্ট্রাক্ট সাইন করতে। তাই তোকে জানাতে এলাম… তুই যদি অনুমতি দিস, তাহলে যাবো… নয়তো, না।”

কথাগুলো যেন বজ্রাঘাত হয়ে এলো মাহির কানে।

তার সব প্রস্তুতি, সব সাহস, সব ভাবনারা মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ইরফান ভাই তার অনুমতির কথা বলছেন, কিন্তু ভ্রমণের! কোনো আবেগের নয়, ভালোবাসার নয়।

মাহির মনে হলো, সে যেন একা দাঁড়িয়ে আছে এক ধোঁয়াটে প্রান্তরে, আর ঠিক তখনই হালকা হাওয়া বয়ে যায়, নীরবতার বুক চিরে যেন কোনো অদৃশ্য প্রশ্ন ভেসে এলো তার দিকে।

“তবু নিজেকে সামলে নিয়ে মাহি বলল, ‘আপনি যাবেন… এতে কি আমার অনুমতি লাগে?’”

‘অনুমতির চাইতেও অনেক কিছু আছে, মাহি। কিন্তু তা তুই বুঝবি না। শুধু বল, যাবো কি না।’

মাহি চোখ নামিয়ে নিল। একচুল দোলানো কণ্ঠে বলল,
‘প্রয়োজন থাকলে যেতে তো হবেই… সরাসরি উত্তর না দিয়ে কথাটা ঘুরিয়ে দিল সে।

‘আমি এতো কথা শুনতে চাইনি, মাহি। তুই শুধু “হ্যাঁ” বা “না” বল।’

মাহি মহাবিপাকে পড়ল।
ইরফান ভাইয়ের এমন গম্ভীর অথচ চাপা কণ্ঠে বলা কথাগুলো যেন বুকের ভেতর বাজতে লাগল।

আবেগ প্রকাশ করার ইচ্ছেটুকু ছিল, কিন্তু সাহস ছিল না।
তার নিজের না বলা হাজারটা কথা জমে জমে ভার হয়ে গেছে, আর এখন কিনা দিতে হবে ইরফান ভাইয়ের যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত!

কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে, ধীরে ঘাড় কাত করে সম্মতির ইশারা দিল মাহি। ইরফান এক চিলতে হাঁসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো মাহির রুম থেকে,

_” মাহি উদাস মনে তাকিয়ে রইলো ইরফান ভাইয়ের দিকে, চোখ দুটো তখনও অশ্রুসজল, অথচ ঠোঁট জোড়া নিঃশব্দ।

~” পরক্ষণেই ভাবলো থাক এখন নাহয় এসব না ভাবি, ইরফান ভাই কাজ সেরে সাবধানে আগে বাসায় ফিরুক,

_”ঘরে বসে ইরফান লাগেজ গুছাচ্ছিল। কাপড়ের মাঝে গুঁজে রাখছিল প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস, আবার বার করে দেখছিল, ঠিক আছে তো? কিন্তু তার হাতের চেয়ে মন যেন বেশি ব্যস্ত ছিল ” কোথায়? মাহির কাছে।

এতদিন দূরে ছিল, দেশ ছেড়ে ছিল; তখনো কষ্ট ছিল, ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বোঝাতে পেরেছিল এই দূরত্বটাই এখন বাস্তব। তবু, দেশে ফেরার পর মাহিকে প্রতিদিন চোখে দেখা, কথায় পাওয়া , তা যেন এক অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, এক মধুর প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল।

আর এখন? মাত্র পাঁচটা দিন, তবু মনে হচ্ছে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে কিছু।

ইরফানের বুকের ভিতরটায় হালকা এক ব্যথা কুঁচকে উঠলো, চিনচিনে, নিঃশব্দ অথচ তীক্ষ্ণ। এ ব্যথার নাম কী? অভ্যাস ভাঙার যন্ত্রণা? নাকি না-পাওয়া কোনো অজানা আকাঙ্ক্ষা?

_”ইরফান চোখ বন্ধ করল, মাহির হাসি ভেসে উঠল স্মৃতির আয়নায়, যেন তার যাবার পথ থামিয়ে দিতে চাইছে।

এই পাঁচটা দিন, কেবলই মনে হচ্ছে সময়টা এক বিশাল শূন্যতা হয়ে তার বুকের ওপর নেমে আসবে।

নীরব ঘরে, রাতের হালকা বাতাস জানালা দিয়ে এসে পর্দা নাড়ায়। ইরফান জানে, এই বিদায় ক্ষণিকের, তবুও হৃদয় যেন তা মানতে চায় না। তবুও লাইফে কিছু এচিভ করতে হলে এই কিছুদিনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে।

_” রিয়ার সাথে ফোনে শেষ কথাগুলো ফিসফিস করে বলেই রাইসা ফোনটা পাশে নামিয়ে রাখল। ঘরটায় নেমে এসেছে এক প্রশান্ত নিস্তব্ধতা, কেবল দেয়ালঘেঁষা ঘড়ির কাঁটার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। রাইসা ধীরে ধীরে খাটের এক কোণে এসে বসল চুপচাপ, একা।

তার চোখ চলে গেল ঘরের অপর প্রান্তে, সোফায় নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকা ফাহাদের দিকে। শান্ত নিঃশ্বাসে আবৃত এক পরিচিত চির চেনা মানুষ।
আজ প্রায় এক মাস হলো এই মানুষটা কাগজে-কলমে তার স্বামী। অথচ, রাইসার চোখে সে এখনও যেন এক দূরের পথিক, যে এসেছে, পাশে দাঁড়িয়েছে, অথচ ছুঁয়ে দেখেনি তাকে কোনো অধিকার দাবিতে।

_” রাইসা এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারে, বিয়ের দুদিন পরেই ফাহাদ নিজে গিয়ে তার বই-খাতা এনে দিয়েছিলো, আর সকালে কলেজের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বলেছিল,

“তোমার স্বপ্নগুলো যেন থেমে না যায় এই বিয়ের মাঝে, রাই ।”

রাইসার ভেতরটা কেমন জানি ভরে আসে
এক গোপন কৃতজ্ঞতায়, এক গভীর শ্রদ্ধায়। সে ভাবতেই পারেনি বিয়ের পরে পড়ালেখার পথ খোলা থাকবে তার জন্য। অথচ ফাহাদ সেই পথকে কেবল মেনে নেয়নি, বরং নিজ হাতে খুলে দিয়েছে।

__” সকালে খাবার টেবিলে বসে আনমনে চুপচাপ খাবার প্লেট নিয়ে বসে আছে মাহি,পড়নে এস ও ব্লু গাউন, বেনুনি করা চুল, বেনি টা আজ রাইসা করে দিয়েছে তার ননদিনী কে, মাহির সামনে রাখা প্লেটটা ছুঁয়ে আছে মাত্র, খাচ্ছে না, আনমনে খাবার চামচটা একবার নাড়ায়, তারপর থেমে যায়।

_” ইরফান রেডি হয়ে নিচে নেমেছে খাবার খেয়েই চলে যাবে, লাগেজ আগেই নিচে নামানো আছে,

টেবিলের চেনা জায়গায় বসতে বসতে হঠাৎ চোখ পড়ে সামনের দিকে মাহি।
চুপচাপ বসে আছে মেয়েটি, মুখে কোনো কথা নেই, চোখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই।

একটা কুয়াশাচ্ছন্ন মলিনতা ছড়িয়ে আছে তার মুখ জুড়ে, যেন খুব সচেতনভাবে নিজেকে সংবরণ করে রেখেছে, আবার ঠিক ততটাই অসচেতনভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে কোথাও।

-” ইরফান একটু থমকে তাকায় মাহির দিকে। পাঁচটা দিন… মাত্র পাঁচটা দিন, অথচ মনে হচ্ছে এই মেয়েটির মুখ না দেখেই সময়টা পাড়ি দিতে হবে এক দীর্ঘ নির্বাসনের মতো।

তার বুকের ভিতর হঠাৎ এক শূন্যতা নামিয়ে আসে, যেন মস্তিষ্কে কোথাও রক্ত চলাচল থেমে যাচ্ছে। নিঃশব্দ এক ধাক্কায় ইরফান বোঝে, এই মুখটাই তো গত ক’দিন ধরে তার সকাল-সন্ধ্যার অভ্যাস হয়ে উঠেছে।

মাহি খাবার খাচ্ছে না ব্যপার টা লক্ষ করে ইরফান গলা খাঁকারি দিলো, মাহি চোখ তুলে তাকাতেই ইরফান বললো,

~” কিরে খাচ্ছিস না কেনো..?

” হু খাচ্ছি।

_” ইরফান ভ্রু জোরা কিঞ্চিৎ বাকা করে বললো, কোথায় খাচ্ছিস..? প্লেট থেকে একটা কণা ও নড়ে নি।

_” মাহি ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে রইলো মনে মনে বিড়বিড় করে বললো, আজকে চলে যাচ্ছেন তাও আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন উনি..!

~” আজ আমি যাচ্ছি। কাল থেকে ঠিক তিনবেলা, সকালে, দুপুরে, রাতে খাবার টেবিলে বসে প্লেট সামনে রেখে আমার জন্য সেলফি তুলে দিবি। প্রতিবার, খাবারের সাথে একেকটা ছবি চাই আমার।”

মাহি একটু চমকে তাকালো তার দিকে, তারপর ভেতর থেকে শিশুসুলভ এক অভিমানের ছায়া এসে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। ঠোঁটটা উল্টে, চোখ নিচু করে ধরা গলায় প্রশ্ন করল,

“কেনো…? এমনটা করতে হবে কেনো?”

ইরফান এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলো, চোখে যেন একটা কুয়াশার রেখা। কিন্তু নিজের ভেতরের ব্যথাটা প্রকাশ না করে গলা শক্ত করল আবার। মুখটা কঠিন করে বলল,

—”কেনো কি, তা আমি শুনতে চাই না। তোকে বলেছি, তুই করবি। ব্যাস।”

মাহি হয়তো বুঝল না পুরোটা, কিন্তু তার চোখে একটু জল চিকচিক করে উঠলো, অভিমানের, না ভালোবাসার, তা কেউ জানে না।

ইরফান চোখ ফিরিয়ে নিলো, কিন্তু তার ভিতরে সে দৃঢ়ভাবে জানে, এই ছবিগুলোর মধ্যেই থাকবে তার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মুখখানা। পাঁচটা দিনের দূরত্ব, প্রতিবার সেই মুখ দেখে সামলে নেবে সে নিজেকে।

প্রতিবারের ছবি হবে তার না-থাকা সময়ের সঙ্গ, তার প্রতিদিনের অপেক্ষার প্রতিদান।

_” এয়ারপোর্টের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে গাড়ি। ভেতরে বসে ইরফান জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে নীরব, ভাবনায় ডুবে। মনে হচ্ছে প্রতিটা গাছ, বিলবোর্ড, রাস্তাঘাট যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে।

গাড়ি থেমে যায় টার্মিনালের কাছে। সঙ্গে এসেছে সাব্বির আর রোহান, । ফাহাদ আসতে চেয়েও আসতে পারেনি, একটা জরুরি মিটিং পড়ে যাওয়ায়। তবে বিদায়ের মুহূর্তে ফাহাদের না থাকার অভাব ইরফানের মনে পড়ে বটে, কিন্তু আজ তার মন অন্য কিছুতে ভারি।

চেক-ইন শেষ করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে একটু হালকা নিঃশ্বাস নিতে না নিতেই রোহান হঠাৎই এগিয়ে এসে ইরফানকে একটুও সময় না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

চোখেমুখে চেনা দুষ্টুমির হাসি, গলায় প্রশস্ত উচ্ছ্বাস,

“অভিনন্দন দোস্ত!”

ইরফান একটু অবাক, ভ্রু কুঁচকে বলল,

—”এর কারণটা কী জানতে পারি?”

রোহান তখন ইরফানের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,

~”অবশেষে তুইও এই ক’দিনের জন্য ‘বউ-হারা’ হবি। ভাবতেই কেমন যেন খুশি লাগতেছে!ভাব তোর মতো মানুষকেও এখন আমাদের দলে নেওয়া যাচ্ছে!”

সাব্বির হেসে ওঠে পাশ থেকে, আর ইরফানের মুখে এক অনিচ্ছাকৃত হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু সে হাসির ভেতরেও যেন কোথাও জমে থাকে এক টুকরো কষ্ট, কারণ এই ‘বউ-হারা’ অবস্থাটা যে একেবারে রোহানদের মতো হালকা নয়।

তার বিদায় যেন কেবল পাঁচ দিনের নয়, বরং প্রতিটা দিন হবে একটা অপেক্ষার নাম। মাহির মুখ, মাহির চোখের নীরবতা সবকিছু ভেসে উঠছে তার চোখে।

তবু সে আর কিছু বলে না। শুধু রোহানের এই দুষ্টুমির ভেতরেও সে টের পায়, ভালোবাসা ঠিক কোথায় এসে গেঁথে গেছে তার ভেতর,
অভ্যাসের মতো, নিশ্বাসের মতো।

~” ইরফান ভেতরে চলে গেলে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে রওনা হলো রোহান ও সাব্বির , গাড়িতে বসে সাব্বির একটু পর পর রিয়া কে কল করছে আর টুকিটাকি কথা বলছে, রোহান তীক্ষ্ণ নজরে সাব্বির কে পরখ করে দেখলো কয়েকটা মাস আগে যে ছেলে টা অনেক অগোছালো ছিলো আজ সে কি পরিপাটি, মেয়েদের দু চোখে দেখতে পারতো না আজ সে একটি মেয়ের জন্য নিজেকে কতোটা পরিবর্তন করে নিয়েছে, প্রতিদিন এতোগুলা করে সিগারেট খাওয়া ছেলে টা আজ কয় মাস হলো সিগারেট হাতে ছুয়ে দেখে না, রোহানের ঠোঁটের কিনারায় একটু খানি হাসি ফুটলো,

_” পরক্ষণেই নিজের রাগিনীর কথা মনে পড়েছে, ফোন টা পকেট থেকে বের করেই কল করলো অহনা কে! কল রিসিভ হতেই রোহান গলা ঝেড়ে একটি কবিতা শুরু করেছে,

রাগিনী চাঁদ নয়, তবু চাঁদের মত হাঁটে,
বলেছিল একদিন, কচ্ছপে চড়ে যাবে মঙ্গলগ্রহে,আমি বললাম, “বাসা ফিরো আগে, বৃষ্টি হবে বোধহয় রাতে !”

ওর চোখে ধরা পড়ে মেঘের ভিতর মাছ,
আমার প্রেমপত্র সে বানিয়ে ফেলে আচার-ভাস।

রাগিনী রেগে গেলে রঙ বদলায় মুখ,
চিপসের প্যাকেট ছুঁড়ে মারে, বলে, “তুই একটা দুঃখ!”
কিন্তু হেসে ফেলে হঠাৎই, গলায় হাল্কা সুর,
এই মেয়ে নাকি সোজা রাস্তায়ও হাঁটে বাঁক ঘুরে ঘুরে।

সে কখনো প্রেমিকা, কখনো জাদুকরী,?
তবু তার জন্যই এই ভুলভাল কবিতা,
রাগিনী না থাকলে আমার ছন্দে থাকত কেবল নিঃশব্দ নীতা।

~” কবিতা শেষ হতেই রোহান শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজায়, কবিতা তো একটা বলে ফেলেছে কিন্তু এবার রাগিনীর রিয়েকশন টা কি তা ভেবে হয়রান। তবে অপর পাশ থেকে হাসির শব্দ শুনে রোহান ভ্রু জোরা সজল করলো,

~” অহনা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কেমন স্নিগ্ধ কটাক্ষে বলে ওঠে,

—” কবি মশাই, আপনি তো দেখি কবিতা লিখতেই পারেন! তা বেশ,শব্দগুলো শুনতে মন্দ লাগেনি। কিন্তু বলুন তো, তাল-মিল কোথায়? যা আছে, সবই তো ছন্দপতনের ছায়া! তবে আপনার সাহসটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।”

~” বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সামান্য সাহসটুকু তো রাখতেই পারি, মেডাম,
রোহানের কণ্ঠে তখন একধরনের দৃঢ়তা, আবার কোথাও যেন এক গোপন কাঁপুনিও।

অহনা বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বলল,
,ও মা, আপনি তাহলে… বিয়েই করে ফেলেছেন?

রোহান হালকা হাসল।

~” না, করিনি এখনো। তবে করব।

অহনার কণ্ঠ কিছুটা কৌতূহলী, কিছুটা অপ্রস্তুত

” কবে করবেন?

রোহানের চোখে তখন যেন এক অদ্ভুত আলো, এক অনুচ্চারিত প্রত্যাশা,

” যেদিন তুমি রাজি হবে।

এক মুহূর্ত নীরবতা। শব্দ থেমে যায়, নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে ওঠে।
অহনার গাল রক্তিম হয়ে ওঠে। সে লজ্জায় কিছু না বলেই চুপচাপ কলটা কেটে দেয়।

_” কলটা কেটে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ বোকার মতো ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল রোহান। তারপর একটুখানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পাশে সিটে রেখে মাথা চুলকাতে চুলকাতে আপন মনে বলতে লাগল,

“রাগ করলো নাকি আবার…? না না, রাগ করার মতো তো কিছু বলি নি!
রাগ করলে তো কবিতার প্রথম লাইনেই কল কেটে দিত।
তবে কি… লজ্জা পেলো নাকি?”

এইসব চিন্তা মাথায় দানা বাঁধতেই পাশেই বসে থাকা সাব্বিরের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল,

— “কিরে ভাই, রাগী মেয়েরাও কি লজ্জা পায়?”

সাব্বির মুখ তুলে তাকাল। ঠোঁটের কোণে একরকম বিরক্তির রেখা।

“আমারে জিগাস করছিস কেন? তুই জানিস না?”

রোহান হালকা গলায় হেসে বলল,

— “আরে ভাই, আমার তো মেয়েদের ব্যাপারে কোনো আইডিয়াই নাই!”

এইবার সাব্বিরের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। কণ্ঠে একটা চাপা আগুন,

“তাহলে আমার কি মেয়েদের নিয়ে গবেষণাগারের ডিগ্রি আছে নাকি? আইডিয়ার খনি বুঝি আমি?”

রোহান এবার গড়গড়িয়ে বলে উঠল,

~“আরে ধুর, তুইও রেগে যাস কেন! তোর তো বউ আছে, তাই ভাবলাম জিজ্ঞেস করি…”

সাব্বির চোখ কুঁচকে বলল,

“আমি আমার বউয়ের টুকু জানি, অন্য কারোটা জানবো কিভাবে? কাস্টমাইজড রাগ, কাস্টমাইজড লজ্জা!”

রোহান হেসে গড়াগড়ি খায়।

“~”মেয়েদের মন বোঝার চেষ্টার চাইতে… জিলেপির প্যাচ খোলা সহজ।

চলবে…..?

#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৪৩

~” অফিসের দরজায় পা রাখার আগেই ইরফানের ফোনে ‘টুং’ করে একটি মৃদু শব্দ, যেন সকালবেলার ব্যস্ততার মাঝে এক মধুর বিরতি। মেসেঞ্জারে চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক অনাবিল হাসি, যেমনটা শুধু হৃদয়ের আপনজনের স্পর্শেই জেগে ওঠে।

~”মেসেজটি খুলে দেখলো ইরফান, একখানা ছবি। মাহির ছবি।

_” হৃদয় যেন ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো।

~”মুহূর্তটিতে ইরফানের মনে পড়লো গতকালের সেই কথাটি,নিঃশব্দ ভালোবাসার এক নির্দিষ্ট অনুরোধ,

_” প্রতিবেলা খাবারের প্লেট এর সাথে ছবি আমার চাই মাহি,

মাহি ইরফানের কথা রেখেছে, হ্যাঁ মাহি কথা রেখেছে এটাই ইরফানের পাঁচ দিনের দীর্ঘ যাত্রার প্রধান প্রেরণা হয়ে উঠলো।

_”ছবিটিতে মাহি একটুখানি হেসে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে,

কিন্তু ইরফানের চোখে সে ছিল যেন স্বপ্নের দৃশ্য।
কালো রঙের পোশাকে মাহিকে আরও বেশি অপার, আরও বেশি দুর্বার লাগছে আজ।
সে যেন বাস্তব নয়, কোনো শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা এক জীবন্ত কবিতা।

ইরফান নিবিষ্টভাবে ছবিটি দেখতে লাগলো,
চোখ বুলিয়ে গেলো প্রতিটি রেখায়, প্রতিটি অভিব্যক্তিতে।

“ভালোবাসা তার বুকের গভীর প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উপচে পড়লো,
যেন প্রশান্তির এক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।

ঘড়িতে সময় দেখে নিলো সে, এখন থাইল্যান্ডে সকাল দশটা।বাংলাদেশে তখন নয়টা বাজে।
এই সময় মাহি নিশ্চয়ই কলেজের পথে রওনা দেবে,হয়তো ব্যাগ গোছাচ্ছে এখন, নয়তো দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে ছূটে যাচ্ছে বাইরের দিকে।

ইরফানের মুখে আবার এক টুকরো মায়াবী হাসি খেলে গেলো।সে গভীর প্রশান্তি নিয়ে এগিয়ে গেলো নিজের কেবিনে,

_” ড্রয়িং রুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে মুহূর্তেই প্রবেশ করলেন নাজিফা বেগম। তাঁর হাতে একখানা রূপালী ধাতুর ট্রে, তাতে সাজানো নানা রঙের তাজা ফল, কমলা, আপেল, আঙুর, পেয়ারা।

ট্রেটি মাহমুদা বেগমের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে জোর করেই তাঁর হাতে গুঁজে দিলেন ফলের প্লেটটা।

মাহমুদা বেগম একটু চমকে উঠে ফলগুলোর দিকে তাকালেন। তাঁর মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ, কপাল ভাঁজ করে বললেন,

” ভাবি, এসব খেতে আমার মোটেও ভালো লাগে না!”

নাজিফা বেগম রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বিগত স্বরেই বললেন,

_” ভালো লাগুক বা না লাগুক, এখন খেতেই হবে। শরীরের যত্ন না নিলে চলবে? আর শুন, বিকেলে একবার রাবেয়াকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চলে যাস। এই মাসে তো আর যাওয়া হয়নি।”

বলে আর কোনো উত্তর না শুনেই তিনি রান্নাঘরের দিকটায় মিলিয়ে গেলেন, ঘরের কোণায় যেন তাঁর পায়ের শব্দটুকুও হারিয়ে গেল নিস্তব্ধতায়।

” মাহমুদা বেগম নিঃশব্দে ফলের প্লেটটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাঁচের জানালা দিয়ে ভেতরে আসা রোদে কমলার খোসা ঝলমল করে উঠছে।

~” আজ রাইসা বাসায় নেই। কলেজ থেকে একটি জরুরি পত্র চাওয়া হয়েছে, যেগুলো রাইসার জিনিসপত্রের ভেতরেই ছিল, তাদের বাসায়। তাই ফেরার পথে ফাহাদ প্রথমে রাইসাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছে, তারপর মাহিকে নিয়ে ফিরেছে নিজ বাসায়।

মাহিরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের দরকার হবে, কোনো প্রকল্প জমা দিতে হবে বোধ হয়। সেসব মাহি আগেই রাবেয়া বেগমকে বলে রেখেছিল, যেন যত্ন করে গুছিয়ে রাখেন।

রাইসা জানিয়ে গেছে, আজ সে সেখানেই থাকবে মায়ের কাছে, ফিরবে না। কলেজের কাজ শেষ হলে পরদিন বিকেলে মাহির সঙ্গে একসাথে ফিরে আসবে। কণ্ঠে তার ছিল ক্লান্তির আভাস, কিন্তু সেই চিরচেনা কোমল স্থিরতা, আবেগ যা তার উপস্থিতি না থেকেও যেন চারপাশে ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকে।

দুপুরে লাঞ্চ করে আবার অফিসের উদ্দেশ্য রওনা দেওয়ার সময় ফাহাদ হাতের ঘড়ি টা পরতে পরতে চারোদিক পরখ করে দেখলো, ঘর যেন একটু নিঃসঙ্গ আজ। রাইসার না থাকার ভার হালকা হলেও কোথাও একটা শূন্যতা টের পাওয়া যায়, একটা অভ্যস্ত ছায়া আজকের বিকেলটায় অনুপস্থিত।

~” ফাহাদ ফোস করে একটি নিশ্বাস ফেলে চলে গেলো অফিসের উদ্দেশ্য।

_” এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ। অথচ ফাইজার দিনগুলো যেন বিস্বাদ এক অবসর নিয়ে এসেছে। না আছে ক্লাসের ব্যস্ততা, না কোনো পড়াশোনার চাপ, আশেপাশে শুধুই ফাঁকা সময় আর অলস বিকেল।

ছাদে বসে আছে সে। হাতে চকোলেটের ছোট্ট টুকরোগুলো, ধীরে ধীরে কাচছে, যেন সময়টাকেও চিবিয়ে নিচ্ছে ধৈর্যে। পাশে মাহি চুপচাপ তার প্রিয় গোলাপগাছটা ঠিক করছে। বৃষ্টির ধাক্কায় গাছটি একটু হেলে পড়েছে, সেই বাঁকা শিরদাঁড়াকে আবার সোজা করে দিচ্ছে সে, খুব যত্নে, ভালোবাসায়। যেন ওই গাছটুকুই এখন তার সবচেয়ে আপন সঙ্গী।

তিন দিন হলো ইরফান বাসায় নেই। থাইল্যান্ড গেছে । কিন্তু এই তিন দিন যেন মাহির কাছে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, ইরফান নিয়ম করে ছবি চায়। শুধু তাই নয়, কি খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, কি পরেছে
সব কিছুই যেন জানতে চায় সে।

প্রথম প্রথম মাহির কাছে ব্যাপারটা অস্বস্তিকর লেগেছিল। যেন কোনো অব্যক্ত শৃঙ্খলের মধ্যে পড়ে গিয়েছে সে। নিজেকে মনে হতো ইরফানের একান্ত কর্মচারী, যার দায়িত্ব প্রতিমুহূর্তে রিপোর্ট দেয়া। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে সেই নিয়মটাই যেন একধরনের অভ্যাসে রূপ নিয়েছে।

এখন মনে হয়, এটা কেবল নজরদারি নয়, বরং একরকম খেয়াল রাখা, একটানা মনে পড়ে থাকার নাম। মনে হয়, দূরে থেকেও কেউ একজন প্রতিমুহূর্তে তাকে ভাবছে, খোঁজ নিচ্ছে, ভালোবেসে আটকে রেখেছে কোনো অদৃশ্য বন্ধনে।

~” “ইরফান ভাই জানুক বা না-ই জানুক, মাহি তো জানে, তার হৃদয়ের গভীরতম অলিন্দে ইরফান ভাইয়েরই নিঃশব্দ অধিষ্ঠান। যে ভালোবাসা মুখে ফোটে না, চোখে ধরা দেয় না, সে ভালোবাসাই তো নিঃশব্দে সবচেয়ে গভীর হয়ে গেঁথে থাকে প্রাণের গহিনে। মাহির প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি নির্জন মুহূর্তে, যে নামটি কান পাতলেই শোনা যায়, সে নাম ইরফান ভাইয়েরই।”

মাহির চোখে একরাশ নরম আলো, হয়তো অজান্তেই ঠোঁটে খেলছে একটুকরো হাসি। ফাইজার চকোলেট গলছে, আর ছাদের ওপরে নেমে আসছে এক নিস্তব্ধ, গাঢ় বিকেল, ভরা ভালোবাসার হালকা গন্ধে।

~ ” রাতের নির্জনতা যখন ধীরে ধীরে ঢেকে ফেলছিলো চারদিক, ফাহাদের আঙুল ছুঁয়ে গেলো মোবাইলের স্ক্রিন। নামটি ভেসে উঠলো, রাইসা। কল দিতে গিয়েও থেমে গেলো সে। এক সময় এমন ছিলো না, যখন ইচ্ছা হতো, কল করত। সম্পর্কের কোনো সামাজিক নাম ছিল না তখন, তবুও কত সহজ ছিল সেই যোগাযোগ
,বোনের এক বান্ধবী, হয়তো একটু কাছের, একটু বেশি প্রিয়, তবুও সে ছিলো “অপর”।

_” আর এখন? এখন তাদের সম্পর্কের গায়ে বৈধতার সোনালি সিলমোহর, এখন তারা একে অন্যের নামের পাশে স্থায়ীভাবে জুড়ে গেছে। অথচ, অদ্ভুতভাবে সেই সহজতা যেন উবে গেছে কোথায়!

এই স্বীকৃতি যেন উল্টো বুনে দিয়েছে এক অদৃশ্য দ্বিধা, যা ছিলো অকপট, তা হয়ে উঠেছে সংকোচে মোড়া। আগে যেখানে ভালোবাসার ছায়া লুকিয়ে ছিল, এখন সেখানে ভালোবাসারই ঘোমটা পড়ে গেছে।

ফাহাদ বুঝতে পারে না, এ ভালোবাসার ভার, না কি বৈধতার মুখর নীরবতা, কোনটা তাকে পিছিয়ে দেয়। শুধু বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে, কল বাটনটা যেন আজ অচেনা এক পাহাড়।

~” কল না করেই চুপচাপ শুয়ে পড়লো ফাহাদ। তবে প্রতিদিনের মতো আজও নিজের শোফার কোণটাই বেছে নিলো সে, যেন নিজেকে বোঝাতে চায়, রাইসা আছে, ঠিক পাশেই আছে, খাটে। ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো, অথবা ফোনে ব্যস্ত,।

এই ছোট্ট স্বস্তির অভিনয় ফাহাদের মনের কষ্টটাকে ঢাকতে পারে না। চোখ বন্ধ করেও সে টের পায়, শূন্যতা কতটা ভারী হতে পারে। বিছানার পাশে একটা নিঃশব্দ দূরত্ব জমে ওঠে, আর সেই দূরত্বেই যেন আটকে থাকে হাজারো না-বলা কথা।

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, অন্ধকারে তাকিয়ে ফাহাদ মনে মনে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

“ধুর! নিজের পছন্দের মানুষটাকেই বিয়ে করেছি, তা নিয়েই গর্ব করা উচিত ছিল! অথচ এখন কাহিনী এমন যে, বিয়ে করেও বউকে স্পর্শ করতে পারছি না। এতো ‘হালাল’ একটা ভালোবাসা, তাও যেন চুপি চুপি ‘হারাম’-এর মতো লুকিয়ে রাখতে হয়!

” এই দুঃখটা আমি কাকে বোঝাই বলো? পুলিশে গেলে তো বলবে, কোনো অপরাধই তো করোনি ভাই!”

একটুখানি হেসে ফেলে নিজেই, তবে সে হাসিতে কৌতুক যতটা না, তার চেয়েও বেশি একরাশ হালকা হাহাকার।

~’ হঠাৎ করেই দরজায় একটানা কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠলো ফাহাদ। ঘড়িতে তখন গভীর রাত দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে খুললো দরজাটা।

~” দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে মাহি,

ফাহাদের চোখে যেন অজান্তেই হাসির রেখা খেলে গেলো। চোখে মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,

~” কিরে বোন কিছু বলবি..?

~” মাহি একটা হাসি হেসে বললো,

“হ্যাঁ ভাইয়া, আসলে কাল আমাদের কলেজে তেমন কোনো ক্লাস নেই। শুধু পেপার সাবমিশন হবে। তাই ভাবলাম একটু দেরি করে যাবো। তুমি তো সকালে অফিসে যাবে, তাই আগেভাগেই বলে যাচ্ছি,তুমি কাল ঠিক সময়েই বেরিয়ে যেও, আমি গাড়ি করেই চলে যাবো।”

ফাহাদের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে বাঁকা হাসি খেলে গেল। চোখে যেন বোনের প্রতি মায়ার এক মিশ্র ছায়া।

“আরে, সমস্যা কী? নাহয় আমি একটু দেরি করেই অফিসে ঢুকলাম,” বললো সে হালকা সুরে।

মাহি কপালে ভাঁজ ফেলে কপট অভিমান নিয়ে বললো,

“না ভাইয়া, তুমি দেরি করবে কেন? অফিস তো তোমার নিয়মিত দায়িত্ব। আমি আর রাইসা সময় মতোই ফিরে আসবো। ওখান থেকেও তো ছুটি দিয়ে দেবে আগেভাগে। তুমি চিন্তা কোরো না, ।

ফাহাদ একটু থেমে মাথা নাড়লো, বোনের প্রতি ভালোবাসার সেই নীরব সম্মতি নিয়ে বললো,

“ঠিক আছে।”

_’ সকালের আলো জানালার পর্দা গলে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছিলো। ঘুম ভাঙতেই মাহি এক ঝটকায় ঘড়ির দিকে তাকালো। আজ দেরিতে যাবার কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু এতটাই দেরি হয়ে যাবে, তা সে কল্পনাও করেনি।

হতভম্ব হয়ে পাশের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নেয়। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে রাইসার নাম
,টানা তিনটা মিসড কল। ঘুমের ঘোরে একটাও টের পায়নি সে। বুকের ভেতর কেমন একটা খচখচ করে ওঠে, হয়তো রাইসা অপেক্ষা করে করে বেরিয়ে পড়েছে কলেজের উদ্দেশ্যে।

মাহি আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে নামতেই গলা ছেড়ে ডেকে ওঠে,

“মা… ও মা! কোথায় তুমি?”

~” সিঁড়ির ধাপে ধাপে তার পায়ের শব্দে যেন সকালটা আরও ব্যস্ত হয়ে ওঠে, রাবেয়া বেগম বেরিয়ে এলেন, হাতে ময়দা আর মসলা লেগে আছে,

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়েই বললেন,

“কিরে মা, কী হয়েছে?

মাহি একটু হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল,

“তোমাকে যে কাগজগুলো রেডি করে রাখতে বলেছিলাম, সেগুলো কোথায় রেখেছো?”

রাবেয়া বেগম শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন,

“সব রেডি আছে মা, পাঁচ মিনিট দাঁড়া, আমি হাতটা ধুয়ে এনে দিচ্ছি।”

_”কিন্তু মাহির গলায় ততক্ষণে উৎকণ্ঠার ছায়া

“না না, পাঁচ মিনিটও আর ওয়েট করলে অনেক দেরি হয়ে যাবে! তুমি শুধু বলো কোথায় রেখেছো, আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি। এমনিতেই অনেকটা লেট হয়ে গেছে!”

রাবেয়া বেগম হেসে ফেললেন মায়াভরা দৃষ্টিতে,

“আচ্ছা আচ্ছা, চুপ কর! আলমারির সামনে একটা নীল ফাইলে সব রাখা আছে, নিয়ে নে তুই।”

“ঠিক আছে!”

বলেই মাহি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে তড়িঘড়ি করে রাবেয়া বেগমের ঘরের দিকে ছুটে গেল।

পেছনে থেকে মায়ের মুখে একটা প্রশ্রয়ভরা হাসি। এই মেয়েটার ব্যস্ততা, উত্তেজনা, সবই যেন তার মা হয়ে দেখতেই ভালো লাগে।আবার চলে গেলেন তিনি রান্না ঘরে।

~” রুমে ঢুকেই মাহি এক নিঃশ্বাসে এগিয়ে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে ছোট্ট চাবিটা তুলে নেয়। চেনা হাতে চাবি ঘোরাতেই খুলে যায় আলমারির দরজা।

ভেতরে সারি সারি ফাইল, সব একরকম দেখতে। কোনটা যে তার প্রয়োজনীয়, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। একের পর এক তাকিয়ে দেখার সময়ও নেই। হঠাৎ চোখে পড়ে সামনে রাখা একটি নীল ফাইল। বুক ধুকপুক করতে করতে ফাইলটা টেনে নিয়ে খুলে দেখে, হ্যাঁ, এটিই সেই কাগজপত্র!

একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেই মাহি আলমারির দরজা বন্ধ করতে যায়, ঠিক সেই মুহূর্তেই আলমারির এক কোনার ভাজ থেকে হঠাৎ করে একটা লাল রঙের ফাইল হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায় নিচে। ফাইল খুলে ছড়িয়ে পড়ে কাগজপত্র
, আঁকাবাঁকা, এলোমেলো, অগোছালো সব লেখা আর কিছু পুরোনো ছাপা ছবি।

মাহি থমকে দাঁড়ায়। বিরক্তিতে নিজের কপালে গাট্টা মেরে বলে ওঠে,

“আহ! দেরির সময় সবকিছু যেন আরও দেরি করিয়ে দিতে আসে! এই ফাইলটা এখনই পড়তে হলো?”

~” মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে নিচু হয়ে কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে থাকে সে। মাথার মধ্যে টিক টিক করে চলা ঘড়ির কাঁটা যেন ব্যঙ্গ করে বলে, ‘তাড়াহুড়োর মানুষকে সময় কখনো ক্ষমা করে না!’

~” ফাইলের পাতাগুলো তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে নিচ্ছিল মাহি। কিন্তু হঠাৎ…
একটা কাগজ থমকে দিলো তার হাত।
অযত্নে ছড়িয়ে থাকা কাগজের ভিড়ে একটি পাতলা সাদা কাগজ, যার ঠিক মাঝখানে স্পষ্ট টাইপকরা একটি বাক্য যেন শূন্যতা ভেদ করে তার হৃদয়ে ছুরির মতো বিঁধলো,

“We adopted this child.”

ঠিক নিচেই, ছোট্ট করে লেখা,

“Mehreen Noor Mahi”

এক মুহূর্তে মাহির চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। শব্দ, আলো, দেয়াল, সব মিলিয়ে একটা ভারী নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ফেললো। শরীরটা যেন জমে গেলো, একটা অনাহুত কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়লো প্রতিটি স্নায়ুতে।

“আমি… এই বাড়ির মেয়ে নই?”

‘মনের ভেতর থেকে ভেসে এলো একটি চাপা আর্তনাদ।

চোখের কোণ দিয়ে প্রথমে নিঃশব্দে, তারপর অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু। সে জানেই না কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, কিংবা কেমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। কেবল মনে হলো, মাটি যেন হঠাৎ করে নিজের রুক্ষতা ফিরিয়ে দিয়েছে, ফ্লোরটা ইট পাথরের মতো শক্ত হয়ে মাহির পায়ের নিচে আঠার মতো আটকে গেলো।

মাহি উঠে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু যেন পা দুটো আর তার নিজের নয়। তার পরিচয়, তার অস্তিত্ব, তার সমস্ত শিকড়, এই বাড়িকে ঘিরে যে বিশ্বাসে গড়ে উঠেছিল, আজ তা একটা বাক্যের কাছে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে।

সে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠায়। নীরবতায়।
আকাশ যেন ধ্বসে পড়েনি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটাই শব্দ ঘুরপাক খায়,

“আমি তাহলে কে…?”

~” পেপার টা হাতে তুলে নিয়ে মাহি এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

“তারের মতো ঠান্ডা হয়ে আসা আঙুলগুলো ধীরে ধীরে বাকিগুলোও গুছিয়ে নিল, যান্ত্রিক, অভ্যাসবশত।

_” তারপর কোনো কিছু না বলে, না দেখে, ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে।

দরজাটা ভেতর থেকে টেনে বন্ধ করেই যেন আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।
দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে স্লো মোশনে বসে পড়ল মেঝেতে।

ঘরটা নিশ্চুপ।
তার নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই।

এই নীরবতা কেবল নিঃশব্দ নয়, এ এক বিষাক্ত স্তব্ধতা।

“–এ যেন অস্তিত্বের চরম সত্যের মুখোমুখি হবার এক ভয়াবহ মুহূর্ত।

“এটা কি সত্যি…?

নাকি কোনো বিভ্রম…?

একটা দুঃস্বপ্ন…?

কটু পরেই যদি ঘুম ভেঙে যায়…?”

চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো মাহি।
প্রার্থনার মতো, খুব ছোট্ট করে ফিসফিস করে বললো মনে মনে,

“ভালো লাগছে না… কেউ আমায় জাগিয়ে দাও… কেউ বলো এটা মিথ্যে… দয়া করে কেউ…”

কিন্তু ঘরের নিস্তব্ধতা কোনো সাড়া দেয় না।
স্বপ্ন নয়, এই বাস্তব নীরব অথচ আঘাত হানা সত্য,মাহিকে গিলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে।

তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রু।
চুপচাপ। কোনো শব্দ নেই।
শুধু চোখের জল যেন শব্দহীন ভাষায় বলছে,

“আমি তো সবাই কে আমার নিজের বলেই জানতাম … তাহলে আমার পরিচয় কি ?”

~” মাহি বসে থাকে, ঠিক যেমন কেউ সমুদ্রের তীরে বসে থাকে ঝড় থেমে যাওয়ার অপেক্ষায়।

~” নিস্তব্ধতায় কাঁপতে কাঁপতে বেজে চলেছে ফোন।
বারবার।
একটানা।
রাইসা কল করছে।

স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠছে পরিচিত নামটা,

“Raisa Calling…”
আবার… আবার…

__”কিন্তু মাহির দিক থেকে কোনো সাড়া নেই।
সে নড়ে না, চায় না, চায়লেও পারছে না।
বলা যায়, এই পৃথিবীতে মাহির আর উপস্থিতি
নেই।

এই মুহূর্তে তার অস্তিত্বটা যেন একটা দেহহীন ছায়া, নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ, নিঃসাড়।

জীবন তাকে আজ এমন এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে,

_”যেখানে শব্দ অর্থ হারায়, ভাষা স্তব্ধ হয়ে যায়,
আর হৃদয়… হৃদয় শুধু একটা শব্দ, ধোঁকা, এই অনুভূতিতে ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে থাকে।

“যে জীবনকে নিজের বলেছিলাম এতকাল,
সে জীবনই আজ বলে উঠছে, তুই তো ছিলি আমাদের কেউ না…”

রাইসার কলের রিংটোনটা একসময় বন্ধ হয়ে যায়।
তবু, ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত বেজে যাওয়া রিনরিন শব্দ যেন থেকে যায়,

” মাহির নিঃশব্দ চিৎকারের মতো…

সে তাকায় না স্ক্রিনের দিকে, না উঠে দরজা খোলে, না চোখ মুছে। শুধু বসে রইলো মাহি।

” চোখের দৃষ্টিটা কোথাও স্থির নয়, কিন্তু তবুও কোথাও আটকে আছে।

কোনো দিকেই তাকাচ্ছে না, তবু যেন এক শূন্য দিগন্তের দিকে নির্নিমেষে চেয়ে আছে।

_”হাত দুটো তার কোলে নিস্তেজ পড়ে আছে,
পায়ের পাতাগুলো মেঝেতে ছুঁয়ে আছে বটে,
কিন্তু তাতে কোনো সাড়া নেই।

-“একটি হাওয়া যেন এসে তার শরীর থেকে প্রাণশক্তির সবটুকু কেড়ে নিয়ে গেছে।

হাত-পা নয় শুধু, যেন গোটা সত্তাটাই অসাড় হয়ে গেছে।
হৃদয়ের ভিতরকার কিছু একটা চিড় ধরে ভেঙে গেছে,

-“আর সেই ভাঙনের শব্দ, শুধু সে-ই শুনতে পাচ্ছে।

__”শরীর আছে, সময় চলছে, বাতাস বইছে,
তবু মাহি নেই।

~” সে কেবল বসে আছে,
একটা ভাঙা আয়নার মতো,

_”যার প্রতিফলনে আর কোনো পরিচিত মুখ খুঁজে পাওয়া যায় না।

~” নির্বাক এক ঘোরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে মাহি। চারপাশে যেন সব শব্দ থেমে গেছে, নিঃশব্দে কেবল নিজের বুকের ভেতর এক পাহাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। গভীর ভাবে ভাবছে সে,

“আচ্ছা… ফাহাদ ভাইয়াও কি জানেন এই জঘন্য সত্যিটা? আর ইরফান ভাই? সেও কি জানে সব কিছু, তবুও কিছুই বলেনি আমাকে?”

চোখের কোণে বিষাক্ত প্রশ্ন জেগে ওঠে,

“তবে কি এতদিন আমার প্রতি যে স্নেহ, যে যত্ন, যে সম্মান… সবই কি কেবল করুণা ছিলো? আমার মতামত, আমার অস্তিত্ব… ছিলো কি শুধু দায়সারা প্রহসন? ঠকানো হয়নি কি আমাকে?”

এই কথাগুলো হৃদয়ের প্রতিটি কোষে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হ্যাঁ, ঠকেছে মাহি। নিজের অজান্তেই উচ্চারণ করে ফেলে সে,

“হ্যাঁ… ঠকেছি আমি।”

আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না মাহি। ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। কান্নাটা যেন বুকের গভীর থেকে উঠে আসে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে শূন্যতা, প্রতিটি অশ্রুতে ব্যথার দলা। এতটা কান্নার পর শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার, বুকটা ধুকধুক করে উঠছে, গলা শুকিয়ে গেছে।

কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ায় সে। তার পুরো শরীর কাঁপছে, যেন নিজের ভার আর নিতে পারছে না। টেবিলের উপর পড়ে থাকা পেপারটা হাতের মুঠোয় নিয়ে, দৃষ্টিতে আগুন আর অভিমান, বেরিয়ে পড়ে মাহি।

দরজার চৌকাঠ পেরুনোর আগে শেষবারের মতো পেছনে তাকায় সে, এই বাড়ি, এই দেয়াল, এই স্মৃতি… আর কেউ বোঝেনি, সে একা কতোখানি ভেঙে গেছে ভেতরে ভেতরে।

‘গেটের দরজাটা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল সে। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা
আশেপাশের বাড়িগুলো, গাছের পাতা, আকাশের রঙ… সবই যেন মুছে যাচ্ছে চোখের জল আর অভিমানে।

~” বেলা একটার দিকে রাইসা ক্লান্ত শরীরে কলেজ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসায় ফিরে। দরজার চাবি ঘুরাতে না ঘুরাতেই চোখে পড়ে, ড্রয়িংরুমে বসে আছেন নাজিফা বেগম

” জুতা খুলে ভেতরে ঢুকেই রাইসা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“বড় আম্মু, মাহি কোথায়? অনেকবার ফোন দিয়েছি, একটাও রেসপন্স করেনি। কলেজেও তো আজ দেখা হয়নি… গেলো না কেন ও?”

নাজিফা বেগম চমকে তাকান তার দিকে। গলায় কাঁপা কাঁপা স্বর,

“কি বলছিস মা ? মানে… তোদের কলেজে তো দেখা হওয়ার কথা ছিলো! মাহি তো সকালেই বের হয়ে গেছে …!”

এক মুহূর্তে চারপাশ থমকে যায়। রাইসার মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, চোখেমুখে গভীর উদ্বেগ।

“মানে মাহি কলেজে গিয়েছে? কিন্তু আমি তো তাকে দেখিনি…!”

দ্রুত পা চালিয়ে মাহির রুমের দিকে ছুটে যায় সে। দরজা খোলা, ভেতরে নিঃস্তব্ধতা জমে আছে।

“রুমে কেউ নেই। শুধু বিছানার এক কোণে পড়ে আছে মাহির ফোন, নিঃশব্দ, নিস্পন্দ।

__”রাইসার গলা শুকিয়ে আসে। কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নেয়, তড়িঘড়ি ফাহাদকে ডায়াল করে সব জানায়।

অল্প সময়ের মধ্যেই ফাহাদ এসে হাজির হয় বাসায়। মুখে উদ্বিগ্নতা, চোখে আতঙ্ক, বোনের নিখোঁজ হওয়া যেন হঠাৎই তার পুরো পৃথিবীটা ওলট-পালট করে দেয়।

“মাহি…? মাহি কোথায়?”

বারবার চিৎকার করে ডাকে সে। ঘরের প্রতিটি কোনে খোঁজে,

এর পর আশে পাশে এক অসহায় ভাইয়ের মতো ঘুরে বেড়ায় এদিক-ওদিক। বুকের মধ্যে অনাগত এক ঝড় উঠেছে, যার ভাষা নেই, শুধু এক চাপা দহন।

নাজিফা বেগম, রাবেয়া বেগম, মাহমুদা বেগম ও ফাইজা ঘরে বসে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছেন, আর রাইসা নিঃশব্দে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে, মাথা নিচু, চোখে অশ্রু আর অপরাধবোধ।

~”“কাল যদি… কাল যদি আমি বাসায় থাকতাম…!”

এই একটা বাক্যই যেন তাকে ছিঁড়ে ছিঁড়েখাচ্ছে।

__”আজ যদি সবকিছু স্বাভাবিক থাকতো, তাহলে সকালে মাহি আর সে একসাথেই কলেজে যেতো, হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে। আমি থাকলে মাহি আজ একা হতো না!”

_” রাইসার বুকের মধ্যে বিষাক্ত একটা খোঁচা দেয়—
“কেন ফিরে এলাম না ওর সঙ্গে কাল রাতে? কী এমন ব্যস্ততা ছিলো আমার?

“এই অনুশোচনা যেন কেবল একটা চিন্তা নয়, একেকটা শিকল হয়ে পেঁচিয়ে ধরছে তার বুক। চোখের সামনে মাহির নিষ্পাপ মুখটা ভেসে ওঠে বারবার, অভিমানী, নির্জন, একা।

_” ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আসে। সময় যেন থেমে গেছে।
রাইসা চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে,

“ক্ষমা করে দিস মাহি… এবার তুই ফিরে আয়, প্লিজ…”

_” বিকেলের ক্লান্ত আলোটা যেন আজ আকাশেও বিষাদের রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। চারদিক নিস্তব্ধ, কিন্তু এক অদৃশ্য অশান্তি যেন বাতাসে ছড়িয়ে আছে। এই নিঃশ্বাসহীন বিকেলে, শহরের প্রতিটি অলিগলিতে উদভ্রান্তের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে দু’জন মানুষ
ফরহাদ চৌধুরী ও কাশেম চৌধুরী।

প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, প্রতিটি পরিচিত মুখে প্রশ্ন

দুই ভাইয়ের চোখে একটাই অনুভব

অভিভাবকত্বের ব্যর্থতা, আর একটি নিষ্পাপ মুখের জন্য অজানা শঙ্কা।

কাশেম চৌধুরী বারবার চোখ মুছছেন, যেন চোখের জল না, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন।ফরহাদ চৌধুরী বার্ধক্যের ভার নিয়ে হাঁটছেন দ্রুত পায়ে, মুখে নীরব প্রার্থনার শব্দ,
“ও যেন ভালো থাকে… আল্লাহ, ওকে তুমি হেফাজতে রেখো…”

এই সময়েই খবর আসে, মনির চৌধুরী সিলেট থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।

“খবরটা শুনে ঘরে যেন আরও নিস্তব্ধতা নেমে আসে।

~” গাড়িতে বসেই ফোনে একের পর এক কল করছেন তিনি, পুরনো বন্ধু, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, একসময়কার ব্যবসায়িক পরিচিতদের কাছে সাহায্য চাইছেন।

“আমাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে ভাই… মাহি…! কিছু একটা করো, প্লিজ…”

আর এদিকে, আকাশপথে ছুটে আসছে আরেকজন, ইরফান।

__” থাইল্যান্ডে অফিসিয়াল মিটিংয়ের মাঝপথে ফোন পেয়েই সে যেন সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে উঠে পড়েছে প্রথম ফ্লাইটে।
প্লেনের জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে, চোখে শুধু মাহির মুখ।

_” সেই মিষ্টি হাসি… সেই অভিমানী দৃষ্টি…
এখন সবকিছু কেবল একটিই প্রশ্নে আটকে,
“সে কোথায়… আমার মাহি কোথায়?”
ইরফানের ভিতরটা জ্বলছে। নিজেকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে তার জন্য।
“আমি তো কথা দিয়েছিলাম… আমি সব বিপদের দেয়াল হবো। তাহলে কীভাবে হারিয়ে গেলো সে আমার চোখের আড়ালে?”

প্লেন যখন ঢাকার আকাশে, তখন ইরফান উন্মাদের মতো হয়ে ওঠে। একমাত্র লক্ষ্য
,মাটিতে পা দিয়েই মাহিকে খুঁজে বের করতে হবে … সুস্থ… নিরাপদ।

চলবে……?