#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৪৪
~” ঢাকাতে পা রাখতেই যেন ঝড় বইয়ে দিল ইরফান। শহরের প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি গলিতে, সে পাগলের মতো খোঁজে ফিরলো “মাহি”!মাহি কোথায়?
~” ফাহাদ বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজে চোখ রাখতেই বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাহি একা, নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে।
_”তাঁর মুখটায় এমন এক গ্লানির ছায়া, এমন এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, যেন ভিতরে ভেঙে পড়া এক জগৎ ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু কেন?
~’ মাহি তো কখনও এভাবে কোথাও একা পা বাড়ায় না।
ইরফানের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে, যেন কান্না আর রাগ মিশে গলে যাচ্ছে ভিতরের রক্তে।
ঘাড়ের রগ ফুলে ওঠা পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে, দেহজুড়ে থরথর কাঁপুনি।
মাথায় এক প্রবল ঘূর্ণি -যন্ত্রণার, শঙ্কার, এবং এক অসম্ভব ভালোবাসার।
শিরা-উপশিরা হয়ে উঠেছে একটাই নামের প্রতিধ্বনি,
“মাহি…”
~” হঠাৎ ভেঙে পড়া সংবাদটা যেন বজ্রাঘাতের মতো এসে আঘাত করল ফরিনা বেগমের বুকের ওপর। মাহি, তার চোখের মণি, ভাইঝির মতো নয়, যেন নিজের কন্যাসম! নিখোঁজ! শব্দটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না প্রথমে। কিন্তু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সব দেয়াল ভেঙে চুরমার করে যখন নিশ্চিত হলো মাহির হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি।
দিনাজপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছুটে আসার পথটা ছিল শুধু কান্না আর কান্নায় ভরা। বাসের জানালার কাঁচে টপটপ করে পড়ছিল চোখের জল। বাইরের পৃথিবী ধীরে ধীরে পেছনে ফেলে যাচ্ছিল, কিন্তু ফরিনা বেগমের বুকের মধ্যে জমে থাকা ভারটা কোথাও যাচ্ছিলো না। অহনার ভেতরটাও যেন ছিঁড়ে গেছে। বুকের ভেতর চাপা কষ্টটা আর ধরে রাখতে পারছিল না সে। তার কান্না আর ফরিনা বেগমের কান্না একসূত্রে মিশে এক শোকসঙ্গীতে পরিণত হচ্ছিল।
~” দিনের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল। সন্ধ্যার নরম আবছা আলোয় ঢাকার আকাশ যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছিল, এক অজানা উদ্বেগে, এক চাপা ঘূর্ণিতে। মাহির সন্ধান না পেয়ে চারদিক যখন নিস্তব্ধতার গহ্বরে ডুবে যাচ্ছিল, তখনই ইরফানের চোখ দুটো জ্বলে উঠল এক অগ্নিশিখার মতো।
সে বুঝে গিয়েছিল, সময়ের প্রতিটি ক্ষণই এখন গুরুত্বপূর্ণ। আর স্থির থাকা মানেই হেরে যাওয়া।
সিদ্ধান্তটা এক মুহূর্তেই নিয়ে ফেলল সে।
দুইটি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রাখা হলো দ্রুত। শহরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার জন্য। একটি হেলিকপ্টারে উঠে নিজেই নিয়ন্ত্রণ নিল ইরফান, আর অপরটিতে পাঠালো ফাহাদকে যার চোখেও এখন শুধুই এক দৃশ্য, মাহি।
~” বিস্তৃত নগরজুড়ে যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি ধূসর দেয়ালের আড়ালে, রোহান, নিরব আর সাব্বির, খুজে বেরাচ্ছে।
তিনজনের পায়ে বিশ্রাম নেই। যে যার মতো ছুটে চলেছে, কেউ উত্তর দিকে, কেউ পূর্বে, কেউ অজানা কোনো বস্তির গলি ধরে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেছে। কারও হাতে মোবাইল, কারও মুখে ধুপধাপ প্রশ্ন,
—”এই মেয়ে… এক্ষুণি এখানে দেখেছো?”
—”এই ছবিটা চিনতে পারো? কিছু মনে পড়ে?”
নিরবের চোখ লাল হয়ে উঠেছে ক্লান্তিতে, তবু দমেনি। রোহান হুঙ্কার ছাড়ছে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে, “খুঁজে না পেলে মিডিয়ায় তুলে দেবো!” সাব্বির চুপচাপ ছুটে চলেছে যেন নিজের দম শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামবে না।
ওরা জানে “মাহি যতক্ষণ না ফিরে আসে, ইরফানকে সামলানো অসম্ভব।
ঢাকার আকাশ তখন দুই ছায়ার চিহ্নে কেঁপে উঠল, দুটি হেলিকপ্টার ছুটে চলেছে বিশাল এই শহরের প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি ছাদ, প্রতিটি সম্ভাবনার খোঁজে।
ইরফান উপরে থেকেই নিচের প্রতিটি কোণায় নজর রাখছিল, যেন চোখ দিয়েই আঁচ করতে চাইছিল কোথাও থেকে কোনো সংকেত, কোনো নিদর্শন ভেসে আসবে কি না। কানে লাগানো হেডসেটের ভেতর ফাহাদের উত্তেজিত গলা মাঝে মাঝেই ভেসে আসছিল,
—”এখানে দেখেছি কিছু লোক জড়ো হয়ে আছে… আমি নিচে নামছি !”
আকাশে ভেসে থাকা সেই মুহূর্তগুলোয় ইরফান যেন একেবারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছিল। আর প্রতি মুহূর্তে তার ভেতরে বাজছিল একই প্রার্থনা,
“মাহি… প্লিজ, একবার… কোথাও থেকে সাড়া দে …!”
~” নিরব আকাশের নিচে হেলিকপ্টারের কাচঘেরা কেবিনে বসে ইরফান যেন এক অনন্ত শুন্যতায় দৃষ্টিপাত করছিল। আলো-আঁধারির এই বিশাল শহরটাকে আজ তার কাছে মরুভূমির মতো শুষ্ক আর অর্থহীন মনে হচ্ছিল। ভেতরে জমে ওঠা যন্ত্রণা আর অনির্বচনীয় হতাশা এক ক্রমাগত ঝড় তুলছিল হৃদয়ে।
সে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু শুধু মনে পড়ছিল মাহির মুখ, সেই চঞ্চল হাসি, সেই অভিমানী চোখ দুটো, যেখানে ইরফান একসময় নিজের পৃথিবী খুঁজে পেয়েছিল।
হঠাৎই ইরফানের কণ্ঠের স্বর নিঃশব্দে কেঁপে উঠল। ঠোঁটের কোণে নরম, ব্যথাতুর বিড়বিড় করে উঠে এলো কথাগুলো,
—”এমনটা কেন করলি মাহি…? আমি তো তোর অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলাম… তাহলে কেনো আবারও আমায় একই শাস্তি দিলি? আমি কি এতটাই অবহেলাযোগ্য…? আমি কি এমন অপরাধ করেছি…?”
কথাগুলো যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল না, বরং প্রতিটি শব্দ আঘাত করছিল নিজের বুকেই, নিজের অস্তিত্বেই। গলার স্বর ভাঙা, চোখের কোণ ভেজা।
—”আমি আর পারছি না, মাহি… আমার জান-পাখি… আমার শেষ ভালোবাসা, My weakness… প্লিজ ফিরে আয়।”
“ফিরে আয় মাহি… আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে…”
~” রাতের আকাশ তখন নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ, শুধু হেলিকপ্টারের পাখার ঘূর্ণির শব্দ যেন ছিঁড়ে ফেলছিল নীরবতা। ইরফানের চোখ ছুটে চলেছিল নিচের অসীম শহরজুড়ে, কান খোলা, হৃদয় অস্থির। সহসা, এক চেনা দৃশ্য, এক পুরনো ছায়া চোখে ধরা পড়ল… দূরদূরান্ত পেরিয়ে মাহির কলেজ এলাকা থেকে অনেক দূরে, জনশূন্য এক প্রান্তে।
ইরফানের হৃদয় কেঁপে উঠল।
“স্টপ… থামাও এখানেই!”
আগ্নেয় কণ্ঠে হেলিকপ্টার থামানোর নির্দেশ দিল সে।
চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে যেন শিকারি বাঘের মতো, কিন্তু ভেতরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে আবেগের। হেলিকপ্টার যখন ধীরে ধীরে নিচে নামছে, তখনই ইরফান দেখতে পেল…
সেই গাছটা।
~” সেই কৃষ্ণচূড়া গাছ, যেখানে ইরফান মাহি কে প্রথম বারের মতো নিয়ে এসেছিল সেদিন কলেজ শেষে।
সেই গাছের নিচে, এক গভীর ছায়ায় বসে আছে মাহি।
কোনো এক অদৃশ্য যন্ত্রণায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সে, দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে নিঃশব্দে। কাঁধে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো যেন জোৎস্নার আলোয় ঢেকে দিয়েছে তার চেহারার সমস্ত ব্যথা। গাছের পাতায় আলো-ছায়ার খেলা, তার ভেতরেই অস্পষ্টভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে মাহির অবয়ব
,শান্ত, নিঃসঙ্গ, ক্লান্ত…!
~” নীরবতার এক দীর্ঘ অধ্যায়ের পর হঠাৎ করেই চারপাশে নেমে এলো আলো আর কোলাহলের বন্যা। হেলিকপ্টারের গর্জন, লোকজনের ছুটোছুটি, বাতাসে হঠাৎ সৃষ্ট উত্তাপ সব মিলিয়ে মুহূর্তেই চমকে উঠল মাহি। এতক্ষণ যিনি নিঃশব্দে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে ছিলেন, যেন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন পৃথিবীর সকল সাড়াশব্দ থেকে, তিনিই হঠাৎ ভীতু হয়ে গেলেন।
মাথা ধীরে ধীরে তুলে উপরে তাকায় মাহি । চোখে বিস্ময়, বুকের ভেতর এক অজানা কাঁপুনি।
আর তখনই…
তাকিয়ে দেখলেন সেই চিরচেনা মুখটা, ইরফান ভাই।
এক মুহূর্ত, এক দৃষ্টিতে জমে থাকা সমস্ত কষ্ট যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। চোখের পাতা ভিজে গেল নিমেষেই, আর কোনো শব্দ না করে, শুধু এক আকুলতায় কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়াল মাহি।
“ইরফান ভাই…”
শুধু এই ডাকে, যেন ভেঙে গেল পৃথিবীর সমস্ত বাঁধ।
ইরফান আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। ঝড়ের মতো ছুটে এসে মাহিকে জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে, ঠিক এমনভাবে চেপে ধরল যেন দুনিয়ার কোনো শক্তি, কোনো ভাগ্য তাকে আর আলাদা করতে না পারে।
মাহির কান্না তখন বেড়েই চলেছে। যেন বুক ফেটে কষ্ট বেরিয়ে আসছে। সে কাঁদতে কাঁদতে ইরফানের শার্ট দু’হাতে খামচে ধরেছে, ঠিক সেইরকমভাবে যেভাবে ছোট্ট একটি পাখি ঝড়ের সময় ডানায় মাথা গুঁজে ধরে।
ইরফান যেনো কয়েক মূহুর্তের জন্য প্রশ্ন করতে ভুলে গেলো । কোনো কৈফিয়ত চাইলো না।
শুধু নিজের কাঁপতে থাকা বুকের গভীরে অনুভব করলো তার দেহের মাঝে আজ লুকিয়ে আছে ছোট্ট একটা দেহ তার স্বপ্নচারনী।
~” কয়েক মুহুর্ত পরে ধীরে ধীরে মাহি নিজেকে গুটিয়ে নিলো ইরফানের বুক থেকে। চোখের কোণে এখনও কান্নার ছাপ, কিন্তু এখন তাতে ভয় কম,।
ইরফান কিছু বলল না। শুধু এক চিরচেনা, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাহির দিকে। তার চোখে তখন এক গভীর প্রশ্রয়, এক নিশ্চিন্ততা, যা কথায় প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না।
হঠাৎ, ইরফান মাথা ঘুরিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে তাকালো।
হাত তুলে ইশারায় জানিয়ে দিলো, এবার তোমরা চলে যাও। আর অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।
হেলিকপ্টারের ভেতরে বসে থাকা দুজন লোক দ্রুত নির্দেশ বুঝে নিলো। মুহূর্তের মধ্যেই প্রপেলার ঘুরতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকট শব্দ তুলে আকাশ ছুঁয়ে মিলিয়ে গেলো সেই হেলিকপ্টার ফাঁকা হয়ে গেলো আকাশ, নেমে এলো এক নিস্তব্ধতা।
~” ইরফান পকেট থেকে ফোন বের করে ফাহাদ কে জানালো সব, বাসায় সবাই কে বলে দিতে বললো, সাথে রোহান, নিরব ও সাব্বির কেও। ওরা ও অনেক খুজে খুজে বোধহয় পাগল হচ্ছে। এরপর ফাহাদ কে লোকেশন জানিয়ে দিলো,
~” তুই এখানে গাড়ি নিয়ে আয়,
~” তারপর আর কোনো বাড়তি কথা না বলে, সজোরে নিঃশ্বাস ফেলে ইরফান ফোনটা কেটে দিলো। বাতাসটা যেন হালকা হয়ে গেলো মুহূর্তেই।
~” কিছুক্ষণ আগের নিঃশব্দ প্রশান্তি যেন আচমকাই ছিঁড়ে গেল ইরফানের চোখে জমে থাকা অশান্তির ঝড়টায়। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিজের মাথা দু’হাতে চেপে ধরল সে, যেন সমস্ত যন্ত্রণাটাকে ঠেলে বের করে আনতে চাইছে কপালের ভাঁজ থেকে।
তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলল মাহির দিকে।
চোখে তখন জলের মতো স্বচ্ছ প্রশ্ন, ঠোঁটে এক ঝাঁজালো কষ্টের ধ্বনি। গলা ধরে আসছে, তবুও কণ্ঠে চাপা রাগ, অভিমান, ভালোবাসা সবকিছু মিশে একসাথে আছড়ে পড়ল,
“বাসা থেকে একা বেরিয়েছিলি কেনো মাহি? বল!
সারাদিন বাড়ি ফিরলি না কেনো? ফোন বাসায় ফেলে আসলি , খোঁজ নেই না, এতটা নিষ্ঠুর হবার কারণ কী?
আর এই জায়গায়… এখানে কেনো এলি তুই?
এই কৃষ্ণচূড়ার নিচে এতো রাতে কি করছিস , বল…?
এতগুলো মানুষ… এত ভালোবাসা, এত উৎকণ্ঠা, সব কিছুকে এমন করে পুড়িয়ে দিয়ে… কি সুখ পেলি তুই মাহি?”
ইরফানের কণ্ঠ যেন গর্জে উঠছে না, বরং ভিতর থেকে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। তার চোখে তখন ক্রোধ নয়, ছিল এক ব্যাকুল প্রেমিকের ছিন্নভিন্ন আত্মা।
সে এগিয়ে এসে একটু ঝুঁকে দাঁড়াল মাহির সামনে। কণ্ঠটা নরম হয়ে এল, কিন্তু তাতে একধরনের ভেতরে-ভেতরে পুড়ে যাওয়া আর্তি
“তুই কি বুঝতে পারিস না, আমি ঠিক কেমন হয়ে গিয়েছিলাম তোকে হারিয়ে?
একটা মুহূর্তের জন্য ভাব তো তোকে খুজে না পাওয়ার যন্ত্রণা এই কয়েক ঘন্টায় কাকিয়ার উপরে কেমন প্রভাব ফেলেছে! আর কাকা তার অবস্থা একবার ভাব, ফাহাদের কথা ও কি মনে পড়ে নি তোর..?…”
হাত বাড়িয়ে ধীরে মাহির কাঁধে রাখল ইরফান, চোখে তখন কেবল একটিই প্রশ্ন,
“তুই কেনো এমন করলি মাহি? কেনো আমাকে এইভাবে আবার ভাঙলি?” তবে কথা টা আর মুখে বললো না।
~” ঠিক সেই সময়েই… হঠাৎ যেন এক বিস্ফোরণ ঘটল নীরবতায়।
মাহি, যে এতক্ষণ চোখে জল আর কণ্ঠে নীরবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে আচমকা বদলে গেল।
মাথা ঝাঁকিয়ে, পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল,
“না! না! সব মিথ্যে! সব! সবাই অভিনয় করেছে আমার সাথে… আপনিও, ইরফান ভাই!”
তার গলা কাঁপছে, বুক ধড়ফড় করছে, চোখে আগুন আর জল একসাথে খেলা করছে।
সেই বাধ ভাঙা কান্নার ভিতরেও শব্দগুলো বেরিয়ে এলো তীক্ষ্ণ ছুরির মতো,
“করুণা করেছে সবাই আমাকে! করুণা!
আমি তো ওই বাড়ির কেউ নই…আমি তো ওই পরিবারের মেয়েই নই, !”
এই কথা শোনা মাত্রই ইরফানের পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল। বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন শূন্য, হাওয়াহীন এক গহ্বরে তলিয়ে গেল সে।
তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল মাহির মুখে, যেন কোনো বিস্ময়ে নয়, বরং এক দুঃস্বপ্নে আটকে গিয়েছেন তিনি। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
“… মাহি… এই কথাটা জানলো কীভাবে?”
এই প্রশ্নটা বুকের ভেতরে বজ্রাঘাতের মতো বাজলো ইরফানের ।
আর সেই মুহূর্তেই সবকিছু এক ভয়াবহ বাস্তবতায় রূপ নিল ইরফানের মনে।
তবে কি …? এই সত্যটাই মাহির অভিমান?
এই কারণেই কি মাহি চলে এসেছে , ফিরে যেতে চায়নি, কারো মুখোমুখি হতে চায় নি …?
ইরফান থমকে গেল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
তার চোখে তখন কোনো অভিমান নেই, কোনো রাগ নেই…
ছিল শুধু গভীর যন্ত্রণার ছায়া, একটা এমন কষ্ট, যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় শিরা-উপশিরা বেয়ে।
_” নিঃশব্দ বাতাসে ঠাণ্ডা হিমের মতো ছড়িয়ে ছিল এক বিষণ্ণতা। মাহির চোখ দুটো স্থির হয়ে ছিল ইরফানের চোখে, ভেতর থেকে যেন ঝরে পড়ছিল এক নিবৃত্ত যন্ত্রণার নদী।
কণ্ঠে ভার জমে থাকা কাতরতা নিয়ে সে বলল,
“আমি সত্যিটা জানতে চাই, ইরফান ভাই। আপনি তো সব জানেন, তাই না? আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই… সেই কঠিন সত্যটা।”
ইরফান থমকে গেল। বুকের ভেতর কেমন এক হাহাকার বেজে উঠলো। হঠাৎ করেই গলা শুকিয়ে গেল তার। একটুখানি সময় নিয়ে, এক নিঃশ্বাসে একটি শুকনো ঢোঁক গিলে, ধীর হাতে মাহির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো সে।
নরম গলায় বলল,
“চল… বাসায় চল। ওখানে বসে সব বলবো। সব বুঝিয়ে বলবো তোকে ।”
কিন্তু মাহি যেন অনড় এক পাহাড় হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। চোখে জেদ আর কষ্টের মিশেল। হাতটা টেনে নিলো নিজের দিকে, কাঁপা কণ্ঠে সে ফেটে পড়লো,
“না, আমি যাবো না। ওই বাসায় আর ফিরবো না আমি! কেন যাবো? ওই বাসায় আমার কেউ নেই, ইরফান ভাই। আমি তো শুধু একজন আশ্রিতা, একটা অবাঞ্চিত ছায়া মাত্র!”
~”মাহির কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত শেষ কথাটাই যেন আগুন ছড়িয়ে দিল ইরফানের শিরায়-শিরায়। মুহূর্তেই বদলে গেল তার চোখের ভাষা, মুখের রেখায় জমে উঠলো এক বিস্ফোরক ঝড়।
ধমকে উঠলো সে,
—”আর একবার… আর একবারও যদি এমন বাজে কথা বলিস, , গাল থাপড়ে লাল করে দেবো! ভাবিস কী তুই নিজেকে? বেশি জানিস তুই?”
রাগে ফোসফস করতে করতে এক পা সামনে এগিয়ে এলো ইরফান। চোখে যেন দাবানল, কণ্ঠে বজ্রের ঝাঁজ।
—”তুই কি করবি, কি করবি না, তা আমি ডিসিশন নেবো। কোথায় যাবি, কোথায় যাবি না, সেটাও আমি ঠিক করবো।”
এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সে, যেন বহুদিনের জমে থাকা আগুন আজই প্রথম ফুঁড়ে বেরোলো। তারপর একটুখানি থেমে, চোখে এক নিঃশব্দ ব্যথার রেখা টেনে, গলা নরম করলো ইরফান
—”ছোট্ট তোকে … এই দু’হাতে জাপটে ধরেছিলাম একদিন। সেদিন থেকেই তুই আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব আমি কাউকে দেইনি, দেবও না।”
~”মাহি নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো ইরফানের দিকে। কথার ঝড় থেমে গেলেও, তার ভিতরে যেন এক অদৃশ্য ঝড় বইছিল এখনো। ফরসা গাল দুটো সারাদিনের কান্নায় বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, আর চোখ দুটো, সেগুলো তো যেন যন্ত্রণার ফোয়ারা। লাল হয়ে ফুলে উঠেছে, যেন প্রতিটি অশ্রুবিন্দু রক্ত হয়ে ঝরে পড়েছে একেকবার।
ইরফানের বলা কথাগুলো যেন আগের মতো লাগছে না এখন। সেই তীব্রতা, সেই দম্ভ
,সবকিছুই যেন একটা অদ্ভুত ছায়া ফেলে যাচ্ছে মাহির মনে।
~” নিঃশব্দে কিছুক্ষণ মাহির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ইরফান। চারপাশের নিস্তব্ধতা যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠলো তার সেই দৃষ্টিতে। তারপর খুব আস্তে, ভাঙা কণ্ঠে বলল,
“জানিস মাহি, ছোটবেলায় একদিন ফুপি যখন প্রথম আমাকে আমার অতীতের কথা বলেছিল… তখন যেন সমস্ত পৃথিবীটাই আমার কাছে নতুন এক রূপে ধরা দিল। যে মানুষটা আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে, আদরে, স্নেহে, ভালোবাসায় আগলে রেখেছে
,তিনি আদতে আমার জন্মদাত্রী নন… তিনি আমাকে পেটে ধরেননি।
~” আমি তখন মাত্র দুই বছরের… আর সেই বয়সেই, আমার নিজের মা আমাকে রেখে অন্য কারো হাত ধরে চলে গিয়েছিলেন।এটা জানার পরে তখন…..
সেই মুহূর্তটাতে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট, সবচেয়ে তুচ্ছ এক প্রানী মনে হয়েছিল। কেন যেন মনে হতো, আমার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো দোষ ছিল… আমি হয়তো এমন কিছু ছিলাম যা মায়ের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
ধীরে ধীরে নিজেকেই দোষ দিতে শুরু করলাম,ভাবতাম, হয়তো আমার গায়ের রঙটাই আমার অভিশাপ। হয়তো আমি একটু কালো বলেই মা আমাকে ভালোবাসতে পারেনি। মা হয়তো আমার মুখের দিকে তাকাতেই পারতো না বলেই আমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল…”
ইরফানের কণ্ঠ ধীরে ধীরে ফেঁসে আসছিল।
~” এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার শুরু করল ইরফান, কণ্ঠে যেন অতীতের ধুলো মিশে আছে,ভরাট অথচ কেমন ভেঙে পড়া।
“ঠিক তার দুই বছর পরের কথা, তখন আমার বয়স এগারো। হঠাৎ একদিন কাকিয়ার খুব অসুস্থতা দেখা দিল। ভর্তি করাতে হলো হসপিটালে। ফাহাদ তখনও খুব ছোট, বড়জোর নয় বছর বয়স হবে। ডাক্তার বলেছিল, কাকিয়া আর কখনো মা হতে পারবে না। সে খবর শুনে পুরো বাসার পরিবেশটা যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, একধরনের বিষণ্নতা যেন ঘিরে ধরেছিল সবাইকে।
কাকিয়া হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে কান্না করতো নিঃশব্দে, চোখে ছিল অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা, ভাঙা স্বপ্নের বেদনা। সেই কান্নার শব্দ যেন হাওয়ার সাথে মিশে গিয়ে আমাদের হৃদয় কেঁপে দিতো প্রতিনিয়ত।
একদিন সন্ধ্যার দিকে দেখি ফাহাদ হসপিটালের ঘর থেকে একা কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে। চিন্তায় পড়লাম। খুঁজতে বের হলাম, এদিক ওদিক তাকালাম, কোথাও নেই ও। শেষে হসপিটালের পেছনের দিকে গেলাম, নির্জন এক কোনায়… আর সেখানেই আমার চোখ আটকে গেল।
একটি ময়লার ঝুড়ির পাশে পড়ে ছিল ছোট্ট এক শিশু, কাপড়ে মুড়ে রাখা, তবুও তার সেই সাদা ধপধপে শরীর, নিষ্পাপ মুখ, আর চোখ দুটো… কী যে অপার্থিব সৌন্দর্য!
সে শিশুটা তখনও কাঁদছিলো, ক্ষুধায়, ভয়-ভীতি আর অবহেলায় ভেজা কান্না। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলতেই… যেন পুরো আকাশে রং ছড়িয়ে দিল কোনো অলৌকিক হাসি। হ্যাঁ মাহি, সেই অবহেলিত শিশুটিই হেসে ফেলেছিল আমার কোলে উঠে… আর আমি, আমি যেন সেই মুহূর্তেই জীবনের এক নতুন মানে খুঁজে পেয়েছিলাম…”।
~” ইরফান থামল একটুখানি, যেন কথাগুলো নিজের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসছে। তারপর গভীর চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে, যেন নিজেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
“আগে ভেবেছিলাম, হয়তো আমি দেখতে ভালো নই, তাই আমার মা আমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। হয়তো আমার গায়ের রঙ, আমার মুখের গড়ন, কিংবা আমার অস্তিত্বই ছিল তার অপছন্দের কারণ।
কিন্তু ওই দিন… সেই শিশুটিকে যখন দেখলাম,সৃষ্টিকর্তার যেন নিজ হাতে গড়া এক অপূর্ব সৃষ্টি! সাদা, ধবধবে ছোট্ট শরীরটা যেন আলো ছড়াচ্ছিল, আর তার চোখ দুটো… এতটাই সুন্দর, এতটাই নরম যে একবার তাকালেই মন ভরে যায়।
তবুও… তবুও তাকে কেউ ফেলে রেখে গেছে এক নিঃসংগ ঝুড়ির পাশে! কেন? কী ছিল তার অপরাধ?
সেদিন আমার মনে এক প্রশ্ন দানা বাঁধল
,তাহলে কি আসলেই রূপ, রঙ, সৌন্দর্য… এগুলো মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে না? তাহলে তো এই শিশুটির জীবনে কোনো দুঃখ থাকার কথা ছিল না।
~”সেদিন প্রথম বুঝলাম আমরা কেবল কিছু মানুষের স্বার্থপরতা আর নিষ্ঠুরতার শিকার। যাদের হৃদয়ে মমতা নেই, তাদের চোখে কোনো রূপই মূল্যহীন।”
~” সেই মুহূর্তে আমি নিজের সঙ্গে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম… নিঃশব্দ, নিঃশর্ত এক প্রতিজ্ঞা।
তাকে আমি প্রাণপণ আগলে রাখবো। যেনো কোনো কষ্ট কখনো তার গায়ে ছায়া ফেলতে না পারে।
_” মাহির চোখে জলের রেশ, আর ইরফানের কথাগুলো যেন নিঃশব্দে চারপাশের বাতাসকেও ভারি করে তুলল। মাহির বুঝতে বাকি রইলো না সেই শিশুটিই.. মাহি..!
-” নিশুন্ধ সন্ধ্যায় হসপিটালের শেষ প্রান্তের আঙিনায় ফাহাদ খেলতে খেলতে হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়।
তার বিস্মিত চোখের দৃষ্টি আটকে যায় আমার কোলে চুপটি করে বসে থাকা এক ফুটফুটে শিশুর দিকে।
চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল ফাহাদের, যেন সে তার ছোট্ট পৃথিবীর এক নতুন অতিথিকে দেখে ফেলেছে।
আমি সন্তর্পণে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই, এক এক করে সবাই থমকে দাঁড়ালো,
চোখে ছিল বিস্ময়, মনে ছিল শত প্রশ্ন।
আমার শান্ত কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়ল একটু আগের কাহিনির আদ্যোপান্ত,
সব কথা শোনামাত্রই কাকিয়া ছুটে এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন,
এক আচ্ছন্ন মমতায় বুকের কাছে চেপে ধরলেন তাকে।
চোখে তাঁর জলের রেখা, ঠোঁটে এক অভিভূত হাসি,
কারণ তিনি জানেন, মাতৃত্বের স্বাদ তাঁর জন্য দ্বিতীয়বার ফিরে আসবে না।
তাই এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে
কাকা ও কাকিয়া মিলেই একটি সিদ্ধান্ত নিলেন,
এই ফুটফুটে শিশুকন্যা হবে তাঁদেরই সন্তান ।
আর নামকরণ?
সে তো আমারই দেওয়া ।” Mehreen Noor Mahi ”
~” মাহি গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলল।
বুকের ভেতর যেন কিছু একটা ভারী হয়ে জমে আছে,যেন অনাহুত কোনো সত্য তার শিরায় শিরায় ঢুকে পড়েছে
চোখের সামনে ছায়া হয়ে ভেসে উঠল সব স্মৃতি, সব প্রশ্ন।আর কয়েকদিন পরেই তো সে আঠারোতে পা দেবে,কিন্তু মনে হচ্ছে,
আজই যেন তার জীবনের বয়স একধাপে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে সময়।
~” ইরফান এগিয়ে এসে মাহির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলটুকু নিঃশব্দে মুছে দেয়।
তার স্পর্শে ছিল গভীর মমতা, আর কণ্ঠে এক ধরণের নীরব ধিক্কার, যা কাঁপিয়ে দেয় মাহির ভেতরটা।
“কাকিয়া তোকে কতটা ভালোবাসে, সেটা তো তুই জানিসই, মাহি.. আর ফাহাদ?”
ইরফানের গলা একটু কেঁপে ওঠে,
“ওর কথা কি আলাদা করে বলার প্রয়োজন আছে?” কাকা তো তোকে এক নজর না দেখলে ছটফট করে।
মাহি নিচু করে চোখ,
লজ্জা, অপরাধবোধ আর অদম্য কষ্ট একসাথে ছায়া ফেলে তার মুখে।
~” ইরফান ধীরে বলে ওঠে,
“তুই যখন একা এই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এলি…
একটিবারও কি ওদের কথা মনে পড়েনি?”
সেই মুহূর্তেই জঙ্গলের ছায়াঘেরা পথে,বড় বড় গাছের ফাঁক গলে,ঝোপ-ঝাড় পেরিয়েএকটা নিঃশব্দ উপস্থিতি এসে দাঁড়ায় তাদের পাশে “ফাহাদ”।
দূরে গাড়ি থামিয়ে,
কারণ এই নির্জনতায় গাড়ি আর এগোতে পারে না,সে একাই হেঁটে এসেছে, ক্লান্ত পায়ে, গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে।
~” মাহি হঠাৎই ছুটে আসে ফাহাদের দিকে
কোনো কিছু না ভেবেই, সমস্ত আবেগে ভেসে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার ভাই কে ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে সে, ভেতরে জমে থাকা সব অনুশোচনা যেন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে তার চোখ দিয়ে। সত্যিই তো সবাইকে না বলে এভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে সে সবাই কে কষ্ট দিয়েছে এটা ঠিক হয়নি।
ফাহাদের বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে এক অজানা ব্যথা।বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে।
তার মন কেঁপে ওঠে একটাই প্রশ্ন বুকের মধ্যে তীব্র হয়ে বাজে “কি হয়েছে ওর? কোথায় ছিল এতক্ষণ? এই জঙ্গলের ভেতরেই বা কী করছিল একা?”
ভয় আর উৎকণ্ঠার অন্ধকার ছায়া ফাহাদের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে,চোখে জ্বলে ওঠে আতঙ্কের ছায়া। যেন কিছু ভয়াবহ ঘটে গেছে,
যা সে এখনও জানে না।
তবে ঠিক সেই মুহূর্তে
ইরফান চোখের নরম ইশারায় ফাহাদকে আশ্বস্ত করে,তার কণ্ঠে নীরব ভরসার ভাষা,
“চল, বাড়ি গিয়ে সব বলছি।”
ফাহাদ ধীরে মাহির কাঁধে হাত রাখে,
আর কোনো প্রশ্ন করে না,
~’ তিনজনের পায়ের শব্দ মিশে যায় শুকনো পাতার মৃদু খসখসে শব্দে,নির্জন বনের ছায়া পেরিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তারা।
চলবে….?
#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে.
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৪৫
~” ~” সকালের আলো যেন নিঃশব্দে ছুঁয়ে গেলো দুজন তরুণীকে রাইসা আর মাহি। দুজনেই আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়েছে, কলেজের পথে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অনুচ্চারিত ব্যাকুলতা।
গতকাল ছিলো পেপার জমা দেওয়ার শেষ দিন। অথচ দুজনের একজনও জমা দিতে পারেনি। মাহি অভিমান নিয়ে চলে গিয়েছিলো কারও সাথে কোনো কথা না বলে। আর রাইসা… সে তো মাহির প্রতীক্ষায় কাঁটিয়ে দিয়েছিলো পুরো সময়টা। শেষমেশ জমা না দিয়েই ফিরে এসেছিলো, মনটা ভার নিয়ে।
আজ তাই, ভোরের আলো ফোঁটার আগেই দুজনই প্রস্তুত। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে, কলেজে পৌঁছে, অন্যদের আগেই, দুজনে সোজা চলে যায় বিভাগীয় কক্ষে, হাতে ধরা সেই গুরুত্বপূর্ণ পেপারগুলো। আগাম সময় পেরিয়ে জমা দিতে আসায় প্রথমে মাহির কাছ থেকে সি.আই. রীতিমতো রুঢ় সুরে পেপার নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে ঠিক তখনই ইরফানের একটি ফোন,শব্দের ওপারে নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলা কিছু কথা যেন বদলে দেয় পরিস্থিতি। সি.আই. একরকম নিঃশব্দ সম্মতিতে মাথা নাড়িয়ে পেপারগুলো নিয়ে নেয়।
মাহির চোখে একটুকরো প্রশান্তি, আর রাইসার ঠোঁটে ফুটে ওঠে হালকা এক হাসি।
পেপার জমা দেওয়ার কাজ শেষ হতেই দুজনে হালকা হয়ে যায় যেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে ধীরে ধীরে ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ায়।
~” গতকালের ঘটনার ভার এখনো যেন মাহির মনে নীরব এক অনুতাপে দগ্ধ হয়ে জ্বলছে। বাসায় ফিরতেই মা’র সেই অশ্রুসিক্ত চোখের দৃষ্টিটুকু তাকে যেন মুহূর্তেই ভেঙে চুরে দেয়। মায়ের চোখে জমে থাকা সে যন্ত্রণার জল, কোনো অভিযোগ ছিল না তাতে, ছিল কেবল একরাশ অব্যক্ত ভালোবাসা, কষ্ট, আর হতাশার চিহ্ন।
সেই দৃষ্টির এক ঝলকেই যেন মাহির হৃদয়ে বাজ পড়ে। সে বুঝে যায়, কতটা বড় ভুল করে বসেছে সে। এই মানুষগুলো, যাদের ভালোবাসা তাকে শৈশব থেকে আগলে রেখেছে, যারা কখনও তাকে অভাব কিংবা বেদনার ছায়া পর্যন্ত ছুঁতে দেয়নি, তাদের হৃদয়ে সে নিজ হাতে কষ্ট ঢেলে দিয়েছে।
মায়ের মুখটা মনে পড়তেই বুকের ভিতরটা কেমন ভার হয়ে আসে মাহির। ছোটবেলায় যখন কাঁদত, মা আঁচলে মুখ মুছে দিতো, খাবার নিয়ে কতো বেলা পেছনে ঘুর ঘুর করতো, এখনো করে অথচ সেই মা, আজ তার কারণেই চোখের জল ফেলেছে।মাহির নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়েছিল তখন ।
~” ইরফান সেই রাতে ঘরে ফিরে যখন পরিস্থিতির গভীরতা বুঝে ওঠে, তখন আর কোনো দ্বিধা রাখে না। দৃঢ় কণ্ঠে, সংযত অথচ অপরিসীম গুরুত্ব নিয়ে সবার উদ্দেশে বলে দেয়
“এই বিষয়ে আর ঘরে কোনো কথা হবে না। মাহিকে কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। কারো যদি কিছু বলার বা জানার থাকে, তাহলে সে সরাসরি আমাকে বলবে। কিন্তু বাসার ভেতর এই নিয়ে আর একটাও উচ্চারণ চলবে না।”
তার কণ্ঠে এমন এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা ছিল, যার পরে আর কোনো প্রতিবাদ ওঠেনি। চারপাশ যেন নিঃশব্দ । ইরফান যেমন এক দৃষ্টিতে পরিবারের শান্তি রক্ষা করে, তেমনি মাহির জন্য এক অদৃশ্য বর্ম হয়ে দাঁড়ায়।
~” বিকেলের নরম আলোয় যখন বাড়ির প্রতিটি কোণে নেমে আসে এক আশ্চর্য শান্তি, তখন মাহি আর রাইসা ফ্রেশ হয়ে শোফায় এসে বসে পড়ে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অহনা আর ফাইজা। চারজন মিলে হালকা আড্ডায় মেতে ওঠে,কখনো পুরোনো স্মৃতি, কখনো আজকের কলেজের গল্প, কখনো বা কোনো অকারণ হাসি। মুহূর্তগুলো যেন নতুন করে বুনে দিচ্ছিলো তাদের বন্ধন।
আজকের রান্নার ভার পুরোপুরি তুলে নিয়েছেন ফরিনা বেগম। তার হাতের স্বাদ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই, তার রান্নায় ঘরের প্রতিটি কোণেই ভেসে বেড়ায় এক অভ্যর্থনার গন্ধ। নাজিফা বেগম আর রাবেয়া বেগম পাশে থেকে সাহায্য করেন, কখন কী লাগবে, সব কিছু খেয়াল রাখছেন ।
ঘরের ভেতরে যেন আজ এক উৎসবের আবহ। ইরফান তার সকল বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে ফেলেছে তারে ডিনারের জন্য । তবে সবচেয়ে বিশেষ করে আমন্ত্রণ গেছে রিয়া আর সাব্বিরের কাছে। রিয়া আসবে শুনেই রাইসার চোখে ঝিলিক ফোটে
অপেক্ষার প্রহর যেন দীর্ঘ হচ্ছিল এতদিন ধরে। “আপুকে এতদিন পরে দেখব!” এই এক বাক্যেই রাইসার মুখে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাসের রঙ।
মাহি, অহনা আর ফাইজাও কম খুশি নয়। রাইসার সঙ্গে তাদের ও খুশির বাহার মিলেছে।
~”সন্ধ্যার আকাশ তখন রঙ ছড়াচ্ছে হালকা বেগুনি ছায়ায়, ঠিক এমন মুহূর্তেই রোহান আর নিরব এসে পৌঁছে যায়। নিরব চেয়েছিল একটু পরে, একটু সময় নিয়ে আসতে, কিন্তু রোহানের ব্যাকুলতায় তার সে ইচ্ছা আর রক্ষা পেল না। রোহানের চোখেমুখে খুশির একরকম উচ্ছ্বাস
,এক ধরনের বালকসুলভ উত্তেজনা, যেন কোনো অজুহাতে আজ একবার রাগিনীকে দেখা যাবে। দীর্ঘদিনের একটুকরো অপেক্ষা যেন আজ রঙ পেতে যাচ্ছে।
~” তার কিছু সময় পরেই সাব্বির আর রিয়া এসে পৌঁছায় তাদের মাঝে, এসে থেকেই রোহান এদিক-ওদিক চোখ বোলাতে থাকে। যেন কাউকে খুঁজছে, কোনো চেনা মুখের আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছে চারপাশে। কারো উপস্থিতি তাকে না বলা এক আকর্ষণে টেনে নিচ্ছে।
~” ঠিক তখন রিয়ার আগমনের খবর শুনে, সে খবর পৌঁছাতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে চার রমণী, রাইসা, মাহি, অহনা আর ফাইজা চারজনের মুখেই উচ্ছ্বাস।
তারা যেন এক ঝলক আলোর মতো সিঁড়ি বেয়ে নামছে, হাসিমুখ, খোলা চুল, নরম কুন্তল দুলছে হাওয়ার ছোঁয়ায়। প্রতিটি পা ফেলে তারা যেন নিচে নেমে আসছে সময়ের কোনো উৎসবমুখর প্রবাহ থেকে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই রোহানের চোখ আটকে যায়,তাদের ভিড়ের মাঝেও শুধু একজনের দিকেই। অহনা।
সে যেন ধীরে ধীরে নামছে, অথচ রোহানের কাছে সেই মুহূর্তটা থেমে গেছে। চারজনের মাঝে অহনা, নীরব, আলোছায়ায় মোড়া মুখখানা, এক কোমলতার আবরণে ঘেরা। তার চোখের রেখা, ঠোঁটের হালকা বাঁক, চলার ছন্দ সবকিছু রোহানের মনে এক অপার মুগ্ধতা তৈরি করে।
~” চারজন নেমেই রিয়ার সাথে আলাপ শুরু করে নানা কথা,এরপর রিয়া কে নিয়ে উপরে চলে যায় ওরা। রাইসা আপু কে নিজের রুমে নিয়ে যায়, সাথে অহনা মাহি ও ফাইজা।
–” রাত তখন ধীরে ধীরে গভীরতার চাদর মেলে দিয়েছে শহরের আকাশজুড়ে, খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিশ্রামের ছলেই বসে পড়েছে বাড়ির তিন কর্তা,ফরহাদ চৌধুরী, কাশেম চৌধুরী আর মনির চৌধুরী। সঙ্গে রয়েছে ইরফান, নিরব, রোহান আর সাব্বির ও ফহাদ পাঁচজন তরুণ একটু গম্ভীর, একটু হাসিখুশি।
শোফার এক কোণে বসে থাকা তিন গিন্নী নাজিফা বেগম, রাবেয়া বেগম, আর মাহমুদা বেগম তাদের পাশে রয়েছেন ফরিনা বেগম তারা তাদের আলোচনায় ব্যাস্ত ।
আর এইসব দৃশ্যের ফাঁকে বাসার এক কাজের মেয়ে নিঃশব্দে ঘুরে ঘুরে সবার মাঝে, হাতে হাতে ঠাণ্ডা কোল্ড ড্রিংকস পৌঁছে দিচ্ছে।
~” আর ঠিক তখনই হঠাৎ করে এক কন্ঠ শুনে সবাই ঘুরে তাকায়,
“রোহান,”
ফরহাদ চৌধুরীর ভারী অথচ স্থির গলায় বলে,
“তুমি চাইলে এর মধ্যে একদিন তোমার বাবা-মাকে নিয়ে একবার এ বাসায় আসতে পারো। তোমার আর অহনার বিয়ের ব্যাপারে একটু আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে…”
কথাটা যেন আকাশ থেকে আচমকা নেমে এলো রোহানের কানে। ঠিক তখনই সে গ্লাসে এক চুমুক দিয়েছিল, কিন্তু বাক্যটা শোনামাত্রই হঠাৎ গলা আটকে এলো। গ্লাসটা কেঁপে উঠল হাতে, হুট করে একটানা কাশিতে ভেঙে পড়ল রোহান।
সবাই চমকে তাকায় তার দিকে।
সে কি ঠিক শুনল?
অহনার বিয়ে… আর তার সঙ্গে?
কথাগুলো যেন মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। পাশে বসা ফাহাদ হালকা চাপা হাসিতে মুখ ঢাকে, নিরব চোখ চাওয়াচাওয়ি করে সাব্বিরের সাথে।ইরফান গম্ভীর ভাবে ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো, ফরহাদ চৌধুরী তখনো স্থির, অভিভাবকের মতো শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী।
রোহান কাশি থামানোর চেষ্টা করে, অথচ বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দে বেজে চলেছে এক অচেনা সুর। চারপাশের আলো যেন ঝাপসা হয়ে আসে কিছুক্ষণের জন্য। সে চাইলেও কোনো কথা বলতে পারে না, কেবল মনে হয়, এই মুহূর্তটাই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় চমক।
~” প্রথমটায় রোহান যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। ফরহাদ চৌধুরীর কথাটা শুনে কেবল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে, গলা শুকিয়ে আসছিল, শব্দ আটকে গিয়েছিল ঠোঁটের কোণে। আতঙ্কে কিংবা বিস্ময়ে, সে তখনো বোঝার চেষ্টা করছিল,এই কথাটা কি সত্যিই তার উদ্দেশেই বলা হলো?
কিন্তু ফরহাদ চৌধুরী থেমে থাকলেন না। এবার আরেকটু গম্ভীর, ভারী গলায় স্পষ্ট করে বললেন,
“বাবা, তুমি কি আমাদের অহনাকে বিয়ে করতে চাও… নাকি…?”
পুরো প্রশ্নটা শেষ হওয়ার আগেই, যেন নিজের মনের সব দ্বিধা ভেঙে দিয়ে, হঠাৎই রোহান কথা টেনে নেয়। তার চোখে তখন স্পষ্ট এক আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি, কণ্ঠে চুপ থাকা শব্দগুলো জেগে উঠে শক্ত হয়ে উচ্চারিত হয়,
“হ্যাঁ আঙ্কেল! আমি অহনাকেই বিয়ে করতে চাই। যদি আপনারা রাজি থাকেন তো।”
এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর, যেন পুরো হলরুম জুড়ে এক আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। সকলে তাকিয়ে থাকে রোহানের দিকে, কেউ চোখে মৃদু বিস্ময়, কেউবা হাসির প্রশান্ত ছায়া।
কিন্তু রোহান তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না,এই সবকিছু এত সহজে, এত সুন্দরভাবে সম্ভব হলো কীভাবে!
.
.
.
.
.
.
~” ইরফানের ঘরটা তখন আলো-আঁধারিতে ডুবে, জানালার পর্দা হালকা দুলছে বাতাসে। ঘরের মাঝখানে বসে আছে চারজন,ফাহাদ, সাব্বির, নিরব আর রোহান। নিঃশব্দে সময় কাটছে, চোখে-মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, আবার কোথাও যেন জমে আছে কিছু না-বলা বিস্ময়।
হঠাৎ সেই নীরবতা ভেঙে ফাহাদ মুখ তোলে, চোখে জিজ্ঞাসা আর কণ্ঠে একরাশ অভিমান মিশিয়ে বলে ওঠে,
“ভাইয়া, তুমি এত কিছু ম্যানেজ করে ফেললে অথচ আমি কিচ্ছু জানি না! অবাক লাগে
তুমি এসব কিভাবে এত নিখুঁতভাবে সামাল দিলে…?”
~” ইরফান হঠাৎ হালকা এক হাসি হেসে ফেললো,একটা শান্ত, নিশ্চিন্ত হাসি, যেন অনেক কথা জমে ছিল সেই চুপচাপ চোখের আড়ালে। তারপর ধীরে সুস্থে চারদিকে তাকিয়ে, গলায় এক ধরনের আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
“ফুপি ইদানীং শরীরের দিক থেকে খুব একটা ভালো নেই। তাই তিনি চান অহনার বিয়ে দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হতে। তখনই তিনি আমার কাছে একজন ভালো পাত্রের খোঁজ চাইলেন। আমি তখনই রোহানের নাম বলি।”
একটু থেমে ইরফান এবার রোহানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
“তবে এক্ষেত্রে বিষয়টা এমন ছিল না যে রোহান আমার বন্ধু বলেই আমি ওর কথা বলেছি। আমি ফুপিকে আগে থেকেই জানিয়েছিলাম, রোহান অহনাকে পছন্দ করে। তাই এ বিয়েটা দায়িত্ব না, বরং একরকম ইচ্ছে ও অনুভব থেকেই হবে।”
এরপর একটু গলা নিচু করে, গম্ভীর স্বরে যোগ করলো,
“বাবা কাকা দের বোঝাতে একটুও সময় লাগেনি। সবাই জানে,রোহান ভালো ছেলে, ভালো চাকরি করে, পরিবারভিত্তিক মানুষ। সবদিক মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম, অহনার জীবনে রোহান একটা শান্তি আর নিরাপত্তা এনে দিতে পারবে।
~” ফাহাদের কণ্ঠে এক ধরনের দুর্বলতা, যেন ভিতরে ভিতরে দ্বিধা আর শঙ্কার এক অজানা ঢেউ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আর… সিয়াম ভাইয়াকে কী বলবে ?”
ইরফান একটু চুপ করল। তারপর এক ঝলক বক্র হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে নিয়ে ধীর কণ্ঠে উত্তর দিল
“সিয়াম ভাইয়া তো সব জানেন আগেই। রোহান আর অহনার বিষয়টা আমি অনেক আগেই ওনাকে জানিয়েছি।”
চারপাশ হঠাৎ থমকে যায়। মুহূর্তটুকু যেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায় নিঃশব্দে।
সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ইরফানের দিকে, এই ছেলেটা এত নিখুঁতভাবে সব গুছিয়ে ফেলল?কতটা সহজে, কতটা নিঃশব্দে সব জট খুলে দিল সে!বুঝতে না দিয়েই যেন একের পর এক গাঁথা কৌশলে আগাম ছকে নিয়েছে প্রতিটি পদক্ষেপ।
~” বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতিতে একে একে সবাই নিচে নামছে। গাড়ির দরজাগুলো খুলছে, আলো-ছায়ায় মুখগুলো বিদায়ের আবহে নরম হয়ে আসছে। ঠিক তখনই, সবার অলক্ষ্যে রোহান ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ইরফানের দিকে। কিছুক্ষণের নীরবতা… তারপর হঠাৎই সে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে।
চোখে কৃতজ্ঞতার এক অনবদ্য দীপ্তি, কণ্ঠে স্নিগ্ধ আবেগে ভেজা স্বর,
“Thanks রে…!”
ইরফান প্রথমে খানিকটা থমকে যায়, তারপর এক প্রশান্ত হাসি মুখে খেলে যায়। দু’হাত তুলে বন্ধুর পিঠে দৃঢ়ভাবে একটা চাপড় দিয়ে বলে,
“You are not my friend, Rohan… you are my brother.”
…….
~” রাতটা যেন একটু বেশিই নির্জন। চারপাশে একরাশ শুনশান নীরবতা। ইরফান ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে। মাথার উপর ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তারার আলো যেন জমে আছে চোখে, মনেও। হালকা বাতাসে ওড়ছে তার শার্টের কোণ, আর সাথে এক গভীর ভাবনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে তার নিঃশব্দ উপস্থিতিতে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে ফাহাদের গলা ভেসে আসে,
শান্ত, নরম এক সুরে, যেন প্রশ্ন নয়… স্মৃতির মতো কিছু।
“ভাইয়া, তুমি তো বলেছিলে… আগে তোমার বিয়ে হবে, তারপর রোহান ভাইয়ারটা দেবে…”
ইরফান খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। মুখে এক আশ্চর্য নীরব হাসি ফুটে ওঠে, আকাশের দিকেই চোখ রেখে ধীরে বলে,
“কিছু জিনিস ভাবনার বাইরেও ঘটে…”
ফাহাদ অবাক হয়ে বলে,
“মানে?”
ইরফান এবার আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে ফাহাদের দিকে তাকায়। তার চোখে তখন এক পরিণত, শান্ত বোধের রেখা,
“কখনো কখনো কিছু ভাবনা দূরে সরিয়ে, সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়…
এই ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে।”
হাওয়া তখন একটু ঠান্ডা হয়ে উঠছে, কিন্তু ইরফানের কণ্ঠে যে উষ্ণতা,তা যেন সময়কেও প্রশ্রয় দেয় নিজের পথ তৈরি করতে।
~” ফাহাদ একটু অবাক হয়ে ইরফানের দিকে তাকালো। তার চোখে কৌতূহলের ঝিলিক, ঠোঁটে অর্ধেক হাসি। মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে ভাইয়া তুমি … কবে বিয়ে করবে?”
ইরফান চোখ সরিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকায়, হালকা হেসে বলে,
“তোর বোন চাইলে… যে কোনো দিনই সম্ভব।”
ফাহাদ এবার কপাল কুঁচকে চোখ টিপে প্রশ্ন করে,
“আর যদি… বোন না চায়?”
ইরফান এবার ধীরে তার দিকে ফিরলো। ঠোঁটে দৃঢ় এক হাসি, চোখে নির্ভার অথচ দৃঢ় আত্মবিশ্বাস,
“তোর বোনকে চাইতেই হবে।”
চলবে……….?