পারবোনা আমি ছাড়তে তোকে পর্ব-৪৮+৪৯

0
15

#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৪৮

~” চারদিকে ঝিলমিল করে জ্বলে উঠেছে রঙিন আলোর । ইরফান আর ফাহাদ একমনে কাজ করছে,কখনো ফুলের তোড়াজোড়া, কখনো বাতি ঝোলানো, কখনো আবার অতিথিদের তালিকা মিলিয়ে দেখা,সব কিছু যেন নিখুঁত হতে হবে, একটুও কম নয়।

ফাহাদ রাইসা কে সাথে করে নিয়ে গিয়ে রিয়া ও সাব্বির কে নিয়ে এসেছে, পুরো বাড়ি জমজমাট।

রোহানের বাড়ি থেকে হলুদের জন্য পাঠানো হয়েছে হলুদ রঙা শাড়ি, গয়না, আর মুগ্ধতার মতো সাজসজ্জার জিনিস,সবই অহনার জন্য।

~” কাঁচা ফুলের সৌরভে মোড়ানো সেই সাদামাটা স্টেজটার এক কোণে রাইসার হাত ছুঁয়ে গেল একটি গোলাপ। নিঃশব্দেই ফুটে উঠল তার লালচে কাঁটা। মুহূর্তেই রাইসার নরম হাতে ফুটে উঠল এক চিকচিকে ক্ষত, ছোট্ট এক ফোঁটা রক্ত রঙ ছড়াল তার আঙুলের কিনারায়।

দূর থেকে ফাহাদ সব দেখছিল। তার দৃষ্টি যেন এক পলকে স্থির হয়ে গেল সেই রক্তফোঁটার উপর। উত্তেজনায় সে যেন সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলল। তড়িঘড়ি ছুটে এলো রাইসার দিকে, মুখে উদ্বেগের ছায়া, চোখে অস্থিরতা। এক ছেলেকে বলে পাঠালো ফার্স্টএইড বক্স আনতে। তারপর সেই ছটফটে ব্যাকুলতা নিয়ে নিজ হাতে তুলে নিল ওষুধ, মলম লাগালো ক্ষতস্থানে। যত্ন করে, অসম্ভব কোমল হাতে ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে দিল রাইসার আঙুল।

রাইসা চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার দিকে। বিস্ময়ভরা চোখে। এমন একটুখানি কাটা, এমন সামান্য ব্যথা,তাতেই ফাহাদের এমন ছটফটানি, এমন পাগলামি… বড় অদ্ভুত লাগল।

ফাহাদের ব্যস্ত হাতে তখনও মলমের শেষ ছোঁয়া, আর ঠিক তখনই,রাইসার কণ্ঠ ফেটে এল খুব নিচু, খুব নরম অথচ অসম্ভব ভারী এক প্রশ্ন, যেন নিজের ভেতরের দীর্ঘ চেপে রাখা বেদনাই শব্দ খুঁজে পেল অবশেষে।

— “আপনি কি এই দায় থেকে মুক্তি চান?”

~” ফাহাদের চোখে এক মুহূর্তের বিস্ময় খেলে গেল, তারপর তা ঘনীভূত হলো গভীর অনুভবের এক স্তরে। রাইসা তাকিয়ে আছে তার দিকে, ফাহাদ অসহায় দৃষ্টি তে তাকালো রাইসার দিকে এক মুহুর্ত চুপ রইলো।

~” ফাহাদ রাইসার হাত দু’টো ধরে রেখেছিল ঠিক যেন কোনো দুলতে থাকা দৃশ্য আঁকড়ে ধরে আছে,নিস্তব্ধ, কিন্তু গভীর। রাইসার প্রশ্নের ভার তখনও বাতাসে ঝুলে আছে। হঠাৎ, ধীরে, নরম অথচ নিঃসংশয় কণ্ঠে কথা ফোটে ফাহাদের মুখে,

— “তুমি যদি চাও, রাই… আমি তোমায় মুক্তি দিতে পারি।”

এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে, তার চোখে ঝিলিক দেয় এক শুষ্ক অথচ ধ্রুব আলো।

— “কিন্তু যদি আমার কথা জানতে চাও, তাহলে শুনো,আমি মুক্তি চাই না। বরং আমি চাই তোমায় আরো গভীরভাবে, আরো কঠিন বন্ধনে ধরে রাখতে। কারণ তোমায় আমি কোনো দায়বোধ থেকে বিয়ে করিনি। আমি তোমায় ভালবেসে বিয়ে করেছি।”

রাইসার চোখ যেন হঠাৎ বিস্ফোরিত হবার মতো বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে যায়। আর ফাহাদ, এবার গলায় হালকা তীব্রতা এনে, কথাগুলো ঝরে পড়তে থাকে ঠিক বুকে জমে থাকা বজ্রের মতো,

— “তুমি কি ভেবেছিলে, সেদিন ভাইয়া সবার সামনে বলেছিল বলে আমি সম্মতি দিয়েছিলাম? তাদের মুখের কথা রাখতে হয়েছিল তাই? না রাই!”

তার কণ্ঠে তখন কাতরতা,

— “সেদিন যদি তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকত, তাহলে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো ভাইয়ার অবাধ্য হতাম। সেই মুহূর্তে, সেই বিয়েতে, আমি শুধু তোমাকেই দেখেছিলাম। শুধু তোমাকে চাইছিলাম।”

~” রাইসা স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন এক ঝটকায় চারপাশের সমস্ত শব্দ থেমে গেছে,ফুলের সুবাস, রঙিন আলোর ঝিকিমিকি, মানুষজনের হাঁটাচলা,সবকিছু হঠাৎই ঝাপসা হয়ে এলো তার দৃষ্টিতে।

ফাহাদের মুখ থেকে ভেসে আসা প্রতিটি শব্দ এখনো বাতাসে দোল খাচ্ছে”আমি দায় থেকে নয়, ভালবাসা থেকে বিয়ে করেছি”, “তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, আমি কখনো রাজি হতাম না…”

এটাই কি তবে ফাহাদের সত্য? এটাই কি তার মনের গভীর গোপন কথা, যা রাইসা এতদিনেও বুঝতে পারেনি?

তাহলে রাইসা যেটুকু ভাবছিল এতদিন,যে তাদের সম্পর্ক কেবল একটি সামাজিক দায়, ইরফান ভাইয়ের মুখ রক্ষার এক নিঃশব্দ সিদ্ধান্ত,সবটা কি তবে ভুল ছিল?

তার ভেতরে কোথাও যেন এক পাথর ভার হালকা হয়ে এল, আবার সাথে সাথে জমে উঠল এক নতুন দ্বিধার ধোঁয়াশা। অনুভব আর অবিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল সে,শুধু নীরবতায়।

চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, ফাহাদ আর নেই। সে স্থান ত্যাগ করেছে।

রাইসা তাকিয়ে রইল শূন্য পায়ে চলে যাওয়া সেই ছায়ার দিকে, চোখে অপার দ্বিধা, ঠোঁটে নীরব প্রশ্নচিহ্ন।

~” প্রোগ্রামের রঙ মেখে সন্ধ্যা যখন একটু একটু করে রাতের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, তখন উঠোনের এক কোণে সাজানো ছোট্ট মেহেদী স্টেজে বসেছে অহনা। কাঁথা বিছানো মঞ্চে সে সোনালি হলুদের শাড়িতে মোড়া।

এবার আর কোনো মেহেদী ডিজাইনার আসেনি,অহনার ইচ্ছেতেই। তার সোজাসাপটা কথা ছিলো,

“আমার মেহেদী আমার আপন মানুষজনই দেবে। বাইরের কেউ কেন?”

রাইসা আর মাহি,দুজনেই তো ভালো মেহেদী দিতে পারে । রাইসার হাতে মেহেদীর নকশা যেন কথা বলে, ঘূর্ণি থেকে পাতার ছায়া পর্যন্ত নিখুঁত ছন্দে ফুটিয়ে তোলে সে। আর মাহি,তার প্রতিটা রেখায় থাকে শিল্পের কোমলতা, অভিজ্ঞতার ছাপ।

আজ তাই অহনার হাত ধরে বসেছে রাইসা, পাশে মাহি। মেহেদীর কাচা পাতার ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে তাদের হাসি আর কথার মাঝে। রাইসা মনোযোগ দিয়ে আঁকছে বিয়ের প্রথম ডিজাইন, আর মাহি দিচ্ছে পরেরটা,তবে এতো সব কিছুর মধ্যে রাইসার মনের মধ্যে চলছে তান্ডব যা সে কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।

~” রিয়া ফাইজার দুই হাতে নিপুণভাবে মেহেদি এঁকে দিয়েছে, রঙ এখনো কাঁচা। সে একটু এগিয়ে এসেছে, হাসিমুখে চারদিকের আনন্দগল্পে মিশে যেতে। ঠিক তখনই… হলুদ শাড়ির আচলটা যেন দুষ্টু হাওয়ার ছোঁয়ায় ফসকে মাটিতে পড়ে গেল।

ফাইজা নিচে তাকিয়ে এক নিশ্বাস ফেলে বলে উঠল,

“কি আর করার! তুলতে গেলেই তো মেহেদির ডিজাইনটা একেবারে যাবে ।”

বুঝেই উঠতে পারছিল না কী করবে,ডান হাত তুলবে, নাকি বাম? তার আগে আরেকটু এগোতেই পাশ থেকে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠস্বর, একটু মজা মেশানো ভরাট রুক্ষতা নিয়ে,

— “বাড়িঘর পুরো ঝাড়ু দেওয়া পিচ্চি মেয়ে, তোমার আর নিজের আচল দিয়ে ঝাড়ু না দিলেও চলবে।”

পেছনে তাকাতেই মুখটা স্পষ্ট হলো,নিরব। চেনা মুখ, চেনা ভঙ্গি, তবু আজ যেন একটু অন্যরকম লাগলো ফাইজার কাছে। তার ঠোঁটে একপাশে চাপা হাসি, চোখে সেই চিরচেনা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব।

নিরব ভাই, সাধারণত খুব একটা কথা বলেন না। কিন্তু ফাইজার সাথে মাঝে মাঝে হালকা ঠাট্টা করেন। একটু রাগ লাগে, আবার মজাও লাগে, এক অদ্ভুত টান যেন জন্ম নিচ্ছে ধীরে ধীরে।

ফাইজা আচমকা বুঝে উঠতে পারে না, কেন মনে হলো,নিরবের এই ঠাট্টার মাঝে যেন একটু বেশি মনোযোগ, একটু ভিন্নরকম দেখার দৃষ্টিও লুকিয়ে আছে। বুকের গভীরে কিছু একটা হালকা কাঁপে, নরম হাওয়ার মতো।

~” তবুও ফাইজা থেমে থাকল না। চোখে ঝিলিক দেওয়া একরাশ দুষ্টুমির ছায়া আর ঠোঁটে চেপে রাখা আধা হাসি নিয়ে বেশ খোলামেলা ভঙ্গিতে বলেই ফেলল,

— “আজ প্রথমবারের মতো শাড়ি পরেছি, সামলাতেই কষ্ট হচ্ছে। তার উপর দু’হাতে মেহেদি… কী আর করবো বলুন! আপনি তুলে দিন না।”

নিরব একটু চমকে তাকায় ফাইজার দিকে। মেয়ে যে এমন করে সরল ভঙ্গিতে বলে দেবে, তা সে ভাবেওনি।

~” চুপচাপ আচল টা ওঠালো নিরব, আচমকা ফাইজা হেঁটে চললো সামনের দিকে। নিরব তখনো আচলটা হাতে ধরে আছে, তার চোখে-মুখে বিস্ময়।

এক মুহূর্ত দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে আচলটা হাতেই রেখে সে এগিয়ে চললো ফাইজার পিছু পিছু,শব্দহীন পদচারণা, ধীরে ধীরে।

ভ্রু কুঁচকে, মুখে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলো সে,

“হায় রে সময়! পিচ্চি মেয়ের আচল হাতে নিয়ে হাঁটছি আমি! এমন দিনও দেখতে হলো?”

~’ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একটি চেয়ারে বসে পড়লো ফাইজা। চুপচাপ, যেন কিছুই হয়নি। তার চুলের একপাশ বাতাসে একটু উড়ে গিয়ে আবার নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়লো কাঁধে।

নিরব ধীরে এগিয়ে গিয়ে তার হাতে ধরা আচলটি চুপচাপ চেয়ারের পাশে রাখলো। মুহূর্তেই যেন আগুন ধরে গেলো তার স্নায়ুতে
,কারো চোখে যদি এই দৃশ্য ধরা পড়ে, তবে মান-ইজ্জতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে যাবে!

লজ্জার মিশ্র এক তাগিদে, সে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করলো,পা ফেলার শব্দ যেন অসস্থি তে ভারী হয়ে উঠেছিল। এক হাতে পাঞ্জাবির গলা ঠিক করতে করতে নিরব দ্রুত মিলিয়ে গেলো ভিড়ের মধ্যে।

ফাইজা চুপচাপ সে দিকেই তাকিয়ে রইলো। চোখে একরাশ শ্লেষ-মেশানো প্রশ্রয়, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।

~” প্রায় শেষ রাতের দিকে যে যার রুমে গেলো, নিরবতা যখন শহরটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, ঠিক তখনই রোহান বারবার ফোন করলো অহনাকে। মোবাইল স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো বারবার, কিন্তু অহনা কল রিসিভ করলো না। পরিবর্তে, অহনা একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিলো,

“কিছু বলবেন?”

প্রান্তরের ওদিক থেকে রোহানের রিপ্লাই আসলো একটুখানি দুলে ওঠা মনভরানো আবেগে,

“কলটা রিসিভ করো অহনা… আজকের রাতে তোমার মধুময় কণ্ঠ শুনে তবেই তো ঘুম আসবে…”

মেসেজটা পড়ে অহনা এক মুহূর্ত থমকে থাকলো, চোখে যেন এক চিলতে হাসি, কিন্তু ঠোঁটে জমে থাকা লজ্জা ছিল আজকের রাতের মত গাঢ়।

সে ধীরে টাইপ করলো,
“গতকাল বিয়ে… আজ কোনো কথা নেই। ছ্যাচড়ামো না করে, চুপচাপ শুয়ে পড়ুন।”

সাথে জুড়ে দিলো এক নির্দিষ্ট ইমোজি, তারপর নিশব্দে অফলাইনে চলে গেলো অহনা।

~” রোহান কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লো, মনে মনে আওড়ালো, কাল যেই বউ কে বিয়ে করবো সেই বউয়ের সাথে এখন কথা বললে সেটা ছ্যাচড়ামো হয়..?

~” মাহি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছিলো, শরীরটা ক্লান্ত হলেও চোখে ঘুম আসছিল না। মাথার ভেতরটা যেন ধকধক করে জ্বলছিল, কপালের দুপাশ টানটান ব্যথায় ভারী হয়ে উঠেছে। তীব্র মাথা যন্ত্রণা একেবারে ধরা যায় এমন, কষ্টটা নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত স্নায়ুর ভেতর।

দরকার ছিল একটা মাথা ব্যথার ওষুধ। কিন্তু নিজের ড্রয়ার ঘেঁটে দেখল, একটাও নেই।

একটু ইতস্তত করেই নিচে নামলো মাহি। ভাবলো, হয়তো মা’র কাছে বা বড় আম্মুর ওষুধের বাক্সে কিছু একটা পাওয়া যাবে। ঘরের বাতাসটা তখন নির্জন, নিস্তব্ধ। আলো আধাঁরের করিডোরে হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো যেন গোটা বাড়িটাই ঘুমের নিচে ঢেকে গেছে।

এক এক করে দরজাগুলোর সামনে দাঁড়ালো,
মায়ের রুম, বড় আম্মুর রুম… সবক’টাই বন্ধ। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ নেই, কোনো আলো নেই। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে হয়তো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

মাহি দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। চাইলেই নক করতে পারতো,

‘থাক, এতো রাতে আর কাউকে বিরক্ত করে লাভ নেই,’ মনে মনে বললো সে।

চুপচাপ পায়ের ধ্বনি ফেলে আবার নিজের ঘরের দিকে ফিরে গেলো, তার কপালের শিরাগুলো টনটন করছিল।

মাহি ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে ফিরছিলো, নিঃশব্দ করিডোর ধরে এগোতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। দরজার সামনে এসে দেখতে পেলো,ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। অপ্রস্তুত হয়ে গেলো মুহূর্তেই।

ইরফানের চোখে ঘুম নেই, বরং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— “কোনো সমস্যা?”

মাহি হালকা করে এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে বললো,

“উঁহু, কিছু না…”

তার কণ্ঠে ছিল অপ্রস্তুত গড়গড়ানি, চোখের পলকে ছিল একটু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
কিন্তু ইরফান যেন বুঝে ফেললো,এই ‘কিছু না’-র ভেতরেই লুকিয়ে আছে আসল কিছু।

–“এক পা এগিয়ে এসে সে ধীরে হাত রাখলো মাহির কপালে।হাতের স্পর্শে মাহির গা এক ঝটকায় কেঁপে উঠলো। যেন সেই ছোঁয়ায় শুধু কপাল নয়, ভেতরের সমস্ত দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

ইরফান উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলো,

~ “তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। সত্যি করে বল, মাহি… কী হয়েছে তোর?

মাহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
তারপর গলা খানিকটা খাদে নামিয়ে, চোখ নামিয়ে শান্ত স্বরে বললো,

“একটু মাথা ব্যথা করছে…

~” ইরফানের কপালে মুহূর্তেই চিন্তার ছায়া ঘন হয়ে এলো। চোখ দুটো গভীর হয়ে উঠলো উদ্বেগে। কণ্ঠটা নরম হলেও স্পষ্ট

“ওষুধ খেয়েছিস?”

মাহি মাথা নাড়িয়ে ধীরে বললো,

— “উঁহু।

— “কেনো?”

— “ওষুধ নেই…”

ইরফান কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। তারপর একেবারে সোজাসাপ্টা বললো,

— “তুই রুমে যা। আমি আসছি।”

মাহি কিছু বলার আগেই সে দ্রুত পায়ে ঘুরে গেলো নিজের রুমের দিকে।

আলমারির এক কোণ থেকে বের করলো ছোট একটা মেডিসিন বক্স। তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করলো মাথা ব্যথার ওষুধ।
তারপর নিচে নেমে গেলো রান্নাঘরের দিকে। নিঃশব্দে গ্যাস চালু করে কেটলিতে পানি বসালো।
আদা কুচি করে চায়ের কাপে ফেলে দিলো, সঙ্গে একটু মধু, আর এক চিমটে দারচিনি।

চা আর ওষুধ হাতে নিয়ে সে আবার উঠে এলো, ধীরে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো মাহির রুমের সামনে।
দরজায় কড়া না নাড়েই প্রবেশ করলো,

~” রুমের আবছা আলোয় হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইরফানকে দেখে মাহির চোখে একরাশ বিস্ময় ভেসে উঠলো,

” ইরফানের কণ্ঠে ধরা পড়লো এক সহজ স্বর,
— “চা খেয়ে, তারপর ওষুধটা খা। তারপর আরাম করে একটা লম্বা ঘুম দে, দেখবি মাথা ব্যথা সেরে যাবে ।

~” মাহি কিছু না বলে চুপচাপ তার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলো, ছোট ছোট চুমুকে শেষ করলো ধোঁয়া ওঠা আদা চা।
তারপর ওষুধটা খেয়ে পানি খেলো এক ঢোক।

ইরফান সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ,

রুমের আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে ইরফান গলা খানিকটা নিচু করে,
হাস্কি অথচ মোলায়েম স্বরে বললো,

“তুই এখন ঘুমা। আমি যাই… কিন্তু যদি বেশি খারাপ লাগে… একটা কল করিস আমায়, প্লিজ।

শেষ কথাটা যেন একটু বেশিই দরদের সঙ্গে বললো ।
মাহি মুখ তুললো না, চোখ শুধু একবার নরম করে বন্ধ করলো।

ইরফান আর কিছু বললো না,
শুধু একবার গভীর দৃষ্টিতে মাহির দিকে তাকিয়ে,ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

~” মাহি বিছানায় বসে থেকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সেই ফাঁকা দরজার দিকে
,যেদিক দিয়ে ইরফান চলে গেল।
তার চোখে তখন কোনো ঘুম নেই, বরং একরাশ অদ্ভুত ব্যথামিশ্রিত প্রশান্তি।

নিচু গলায়, নিঃশব্দে নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলো মাহি, একটা চাপা হাসি ঠোঁটের কোণে খেলে গেল…

— “আমার অসুখে যদি আপনার এমন যত্ন পাই…তবে এমন অসুখে আমি প্রতিদিন পুড়তে রাজি, ইরফান ভাই…”

শব্দগুলো বাতাসে মিশে গেল,
কিন্তু তার ভেতরের ভালোবাসার কুয়াশা যেন আরেকটু ঘন হয়ে উঠলো।বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো মাহি,কিন্তু মনের গভীরে কোথাও
লেগে রইলো ইরফানের হালকা স্পর্শ।

~” রাইসা এপাশ-ওপাশ করছে বিছানায়। ঘরের বাতাসে যেন একধরনের অস্থিরতা জমে আছে, ঠিক যেমনটা জমে আছে তার বুকের ভেতর। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে রাতের গভীরে, কিন্তু তার চোখে একফোঁটা ঘুম নেই।

চোখ বন্ধ করলেই কানে ভেসে আসে সন্ধ্যার সেই মুহূর্তগুলো,ফাহাদের বলা কথা, তার শান্ত অথচ স্পষ্ট স্বর,আর সেই চোখের দৃষ্টি,যেখানে না ছিল অভিযোগ, না কোনো প্রত্যাশা,
ছিল শুধু একরাশ নিরব ভালোবাসা আর স্যাক্রিফাইস।

রাইসা কাঁথা সরিয়ে ধীরে চোখ মেলে তাকায় শোফার দিকে।ফাহাদ ঠিক আগের মতোই, নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে একজন পুরুষ যার স্বামী হবার অধিকার আছে,তবু সে কোনো অধিকার দাবি করেনি কখনো, একই ঘরে থেকেও ছুঁয়ে দেখেনি তাকে।রাইসার চোখ ভরে আসে কৃতজ্ঞতায়।

তার বুকের ভেতর হালকা এক চাপা কষ্ট জমে ওঠে,
এই মানুষটার জন্য সে কী দিয়েছে এখনো পর্যন্ত?এক মুহূর্তে নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হয় রাইসার।তার ভালোবাসাহীন নিরবতা, তার দূরত্ব এসবের পাশে ফাহাদের নিঃশব্দ ভালোবাসা যেন আরও বিশাল, আরও দয়াময় হয়ে উঠে।

চোখ ফিরিয়ে নেয় রাইসা
বুকের মধ্যে যেন অপরাধবোধের ঢেউ আছড়ে পড়ে।
ভেতরে ভেতরে কেবল একটা প্রশ্ন বেজে ওঠে।
“আমি কি সত্যিই তার যোগ্য ?”

চলবে………..?

#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৪৯ (প্রপোজ স্পেশাল পর্ব )

~” বিয়েবাড়ি তখন জমজমাট। আলো, হাসি আর হইহুল্লোড়ে পুরো বাড়ি যেন উৎসবের রঙে ডুবে আছে। গেস্টরা একে একে আসতে শুরু করেছে, কেউ গেটের সামনে ছবি তুলছে, কেউ ভেতরে ঢুকেই মিষ্টিমুখে ব্যস্ত। চারপাশে যেন উচ্ছ্বাসের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।

এই আনন্দময় কোলাহলের মাঝেই এক কামরায় বসে আছে অহনা,আজকের দিনের সবচেয়ে আলোচিত মুখ, বধু সে আজ।
তিন জন পার্সোনাল মেকআপ আর্টিস্ট তাকে ঘিরে সাজিয়ে তুলছে পরীর মতো।
আলতো করে পরানো হচ্ছে গয়না, মাথার টিকলি ঠিক করা হচ্ছে একে একে।
অহনার চোখে-মুখে জড়ানো একধরনের লজ্জা, অথচ মিষ্টি আত্মবিশ্বাস।

সাজ প্রায় সম্পন্ন হতেই মাহি নিজের মতো ফ্রেশ হয়েএকটু হালকা গর্জিয়াস লুকে রেডি হয়ে সোজা চলে গেলো রাইসার রুমে।

রাইসা তখন আয়নার সামনে বসে হালকা করে নিজেই সাজছিলো,কিন্তু ততক্ষণে মাহি এসে পড়েছে রুমে।হাতের ব্রাশ রেখে রাইসার পাশে বসে হাসিমুখে বললো,

— “আয় দেখি, তোকে আমি সাজিয়ে দিই। ভাবিরা একটু স্পেশাল না হলে চলে?”

রাইসা হেসে ফেললো লাজুকভাবে।
মাহি খুব যত্ন করে তার মুখে হালকা গ্লো তুলে দিলো,চোখে দিলো নরম সিমার, ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙ।অন্য কেউ হলে রাইসা হয়তো অস্বস্তি পেত, কিন্তু মাহির ছোঁয়া এতটাই আপন,
সে চুপচাপ বসে রইলো।

সব শেষে মাহি আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো,

~ “এই তো আমার মিষ্টি ভাবি…”

রাইসা আবার হেসে ফেললো নরম গলায়।

কিছুটা নীরবতা ভেঙে, মাহি হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে গেলো।

চোখ নামিয়ে ধীরে বললো,

— “একটা কথা বলবো তোকে?”

রাইসা চোখ বড় করে তাকালো,
— “হ্যাঁ বল।”

মাহি এক দম গভীর নিশ্বাস ফেললো,
চোখ দুটো একটু বন্ধ করে নিয়ে যেন ভেতর থেকে সাহস টেনে আনলো।
তারপর কণ্ঠটা একটু কাঁপা, কিন্তু স্থির,

— “আমি আজ… ইরফান ভাইকে প্রপোজ করবো।”

~” মাহির কথাটা শুনে রাইসা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। চোখে যেন খানিকটা বিস্ময়, আবার ভেতরে কোথাও গভীর প্রশংসা মেশানো উষ্ণতা।

তারপর হালকা একটা হাসি ফুটে উঠলো রাইসার ঠোঁটে।
সে ধীরে হাত বাড়িয়ে মাহির হাত চেপে ধরলো,
চোখে চোখ রেখে একরাশ বিশ্বাস নিয়ে বললো,

— “একদম পারফেক্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিস মাহি।
আর দেরি করিস না… আজই বলে দে,
ইরফান ভাইকে তোর মনের কথা।”

~” মাহির কণ্ঠে ধরা পড়ে এক চাপা কাঁপুনি—

“আমার খুব ভয় করছে, রাইসা।”

রাইসা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মাহিকে বুকের কাছে টেনে নেয়।
তার চোখে ছিলো এক দৃঢ়তাভরা কোমলতা,

—“ভালোবাসলে সাহসী হতে হয়, মাহি। বেহায়া হতে হয়, শুনলি? ভয়, লজ্জা, ঘৃণা,সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয় তখন। নয়তো ভালোবাসা অপমানিত হয়, অপূর্ণ থেকে যায়।”

মাহি সেই কথাগুলো শুনে স্থির হয়ে যায়। তার চোখে ধরা পড়ে দ্বিধা, অথচ তাতে মিশে থাকে একরকম বোঝাপড়ার আলো। সে মাথা নিচু করে আস্তে করে মাথা নাড়ায়।

~” ঘরের দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার মতো করে ফাইজা এসে দাঁড়ায়, মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলে,

“ভাবি…! রিয়া আপু তোমাকে একটু ডেকেছে।”

রাইসা একবার মাহির দিকে তাকায়। চোখে ছিল এক রকম অনুধ্যানের শীতল স্পর্শ।

তারপর ধীরে বলে,

“একটু থাক মাহি, আমি আসছি।

রাইসা চলে যেতেই ফাইজা এসে মাহির পাশে বসল। কোনো শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস নয়, আজ তার চোখে ছিলো বড়দের মতো নিরীক্ষণ,
এক ধরনের চাহনি,

সে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
—“আপু, তোমার কি হয়েছে? এমন অস্থির লাগছে কেন তোমাকে…?”

মাহি কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
ফাইজার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন নিজের শৈশবের প্রতিফলন খুঁজে পায়,

আজ প্রথমবারের মতো ফাইজাকে বড় মনে হলো তার, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ধীরে বলে ফেলে,

“তোকে একটা কথা বলা হয়নি, ফাইজা…”

ফাইজা কপাল কুঁচকে তাকায়,
—“কি কথা?”

মাহি চোখ নামিয়ে নেয়। তার কণ্ঠে চাপা কাঁপুনি,তবুও শব্দগুলো বেরিয়ে আসে,

—“আমি… ইরফান ভাইকে ভালোবাসি।

~” মাহির স্বীকারোক্তির পর ঘরটা যেন নিঃশব্দে থমকে যায়।
কিন্তু ফাইজার মুখে বিস্ময়ের ছায়া নেই,
সে একেবারেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মৃদু হেসে বলে,

—“হ্যাঁ, আমি জানি তো, আপু…!”

মাহির চোখে বিস্ময়ের ঝলক।
সে ধাক্কা খাওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে—

~ “তুই কিভাবে জানলি, ফাইজা?”

ফাইজা চোখ নামায় না, ঠোঁটে রেখে দেয় এক শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত হাসি দিয়ে বললো,

—“তোমার চোখের ভাষা আমি বুঝি, আপু।
তুমি না বললেও আমি অনেক কিছু বুঝে যাই।
ভালোবাসা লুকানো যায়, কিন্তু চোখ… সেটা বলে ফেলে। আর মনের টান থাকলে চোখের ভাষা ও পড়া যায়।

~” মাহি অবাক চোখে ফাইজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একসময় যে ছোট্ট মেয়েটা কাঁধে ঝুলে থাকতো,
আদুরে গলায় রাগ করতো,আজ তার চোখ যেন অন্য কথা বলছে ,

আজ যেন প্রথমবারের মতো মাহি অনুভব করলো,তার ছোট্ট বোনটা বড় হয়ে গেছে।
নির্বাক থেকে শুধু তাকিয়ে রইলো ফাইজার দিকে,চোখে মিশে রইলো বিস্ময়, ভালোবাসা আর এক অজানা প্রশান্তি।

~” ঘরজুড়ে কোলাহল।লোকজন সবাই এসে গেছে।দাওয়াতি ভিড়ে ঘর উপচে পড়ছে, খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে।
চারপাশে যেন উৎসবের রঙ ছড়িয়ে আছে, হাসি, কথা, আতিথেয়তার ব্যস্ততা।

মাহি এক কোণায় দাঁড়িয়ে, চোখে একটানা খোঁজ।চোখ বোলায় এদিক-ওদিক, যেন কাউকে খুঁজে ফিরছে অবচেতনে” ইরফান ভাই,
কিন্তু ইরফান তখন ব্যস্ত এক অভ্যাগত স্বাগতিক।সাদাকালো পাঞ্জাবিতে তাকে ঘিরে রয়েছে একালার লোকজন, অফিসের বন্ধুরা,
ফাহাদের সঙ্গে মিলে সে দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে অতিথিদের আপ্যায়ন।

মাহি আর একটু তাকিয়ে দেখতে চেয়েছিল,
ঠিক তখনই ফাইজা দৌড়ে এসে দাঁড়ায় তার সামনে, হাপাতে হাপাতে রোমাঞ্চিত কণ্ঠে বলে,
—“আপু! বর এসে গেছে! চলো, গেইট ধরতে হবে!”

মুহূর্তেই মাহির চোখে আলো ঝলকে ওঠে।
ফাইজার হাত ধরে সে ছুটে যায় রাইসার দিকে,
রাইসাও প্রস্তুত, চেহারায় দুষ্টু হাসি আর চোখে উচ্ছ্বাস।

তিনজন মিলে, আরো কিছু কাজিনদের সঙ্গে একত্র হয়ে দাঁড়িয়ে যায় গেটের মুখে।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়া সব দেখছে চুপচাপ।তার পাশে সাব্বির, দু’জনের মাঝখানে অদ্ভুত এক বোঝাপড়ার ভাব।

বিয়েবাড়ির হুল্লোড়ে চারপাশে যেন উড়ছে রঙ, হাসি আর গানের তালে মিশে থাকা আনন্দের ঢেউ।বাড়ির গেটের সামনে লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা দড়ি , যার ওপারে প্রবেশ নিষিদ্ধ যতক্ষণ না বরপক্ষ দাবি মেটায়।

রোহানের সঙ্গে এসেছে তার দুই-একজন কাজিন।স্মার্ট শার্ট-প্যান্টে দাঁড়িয়ে তারা গেটের সামনে একটু বিরক্ত, একটু রোমাঞ্চিত।
আর ঠিক দড়ির এপাশে দাঁড়িয়ে মাহি, দুষ্টু চোখে হাসি লুকিয়ে রেখে বলে ওঠে,

“আমাদের দাবি মানতেই হবে! নাহলে ভেতরে ঢোকার পথ বন্ধ!”

রোমাঞ্চে ভরা সেই মুহূর্তে ফাইজাও যোগ দেয়,
হাত উঁচিয়ে বলে,
—“হ্যাঁ হ্যাঁ! পেয়সা ছাড়ো, তামাশা দেখো! আমরা এমনিই ছাড়বো না আজ!”

চারপাশে হাসির ঝলক, হাততালি, উল্লাস।
বরপক্ষের ছেলেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, কে কতটা দিতে রাজি, আর কে কতটা বাঁচিয়ে দিতে পারবে।

রোহান নিজের চিরচেনা মৃদু হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে, সব দেখতে দেখতে মাথা নাড়লো।
তবে আজ তার চোখে একটু বেশি সতর্কতা সে বার বার রবিনের দিকে তাকাচ্ছে,

রবিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, তবে আজ সে মাহির দিকে একবারও তাকায়নি।
ইরফানের সঙ্গে ঘটনার ছায়া এখনো ওর মনে গেঁথে আছে।তবুও ফাইজার দিকে চোখ গেলেই একটু থেমে যায় সে।চোখে ধরা পড়ে প্রশংসার এক ঝলক,কি সুন্দর টানা টানা চোখ!
তাজা বসন্তের মতো মুখ, দুষ্টু অথচ কোমল হাসি।

রবিনের মনে হয়,
“এই বোনেরা , হায় রে! কেউ কারো থেকে কম যায় না! একেকটা যেন ফুলের মতো ফুটে আছে এই বাড়িতে।”

এক ঝলক তাকিয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ফাইজার দিকে হেসে ফেললো রবিন।তার হাসির ভেতর ছিল মুগ্ধতা।

এদিকে গেটের সামনে দরকষাকষির আসর জমে উঠেছে।রোহান মজা করে বলে,

_”ভাই, আমি দেখি আজ নোট গুনতে গুনতে ঘাম ছুটে যাবে !”

মাহি চোখ কুঁচকে বলে,
—“ যতক্ষণ না আমরা খুশি, ততক্ষণ গেট খুলবে না!”

ফাইজা বলে ওঠে,

” না দিলে ভেতরে ঢোকার বদলে চলে যেতে হবে ! আমাদের রেট কিন্তু একদম ফিক্সড!

~” তার কথায় মুহূর্তেই গেটের সামনে হেসে ওঠে সবাই।ছেলেরা পকেট হাতড়াতে শুরু করে, আর মেয়েরা খিলখিলিয়ে হাসে। রাইসা ও এক হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

.
.
.
.
.
.
.
.
.

সব নিয়ম কানুন সেড়ে এখন খাওয়া দাওয়া চলছে বর পক্ষের। নিশ্চিন্ত আনন্দে ডুব দেওয়া মুহূর্তগুলোর মাঝে হঠাৎ যেন এক টুকরো নীরবতার আভাস।

–” সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, ফাহাদ রাইসাকে পাশে ডেকে নিলো। কোলাহল থেকে খানিকটা দূরে এসে, গভীর যত্নে তার হাতে একটি খাবারের প্লেট তুলে দিলো সে। প্লেটের পাশে রাখা চামচটি হাতে দিয়ে শান্ত অথচ কঠিন কণ্ঠে বলল,

— “খেয়ে নাও, রাত থেকে কিছু খাওনি…”

রাইসা থমকে গেল। বিস্ময়ে ভরা চোখে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

— “আপনি জানলেন কীভাবে…?”

ফাহাদ হালকা হাসলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক প্রশ্রয়মাখা হাসি। উত্তর দিলো,
— “বউদের খোঁজখবর রাখতে হয়। আর কথা না বাড়িয়ে এখন খেয়ে নাও।”

রাইসা একটু চুপ করে রইলো। চোখের কোণে যেন জমে উঠেছে এক চিলতে আবেগের ছায়া। ধীরে স্বরে বলল,

“খাইয়ে দেবেন…?”

ফাহাদ অবাক হয়ে তাকালো। যেন ঠিক শুনলো কি না, নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।

রাইসার কণ্ঠ তখন আরও নরম, আরও কোমল।

“আপনি আমাকে ‘বউ’ এর মর্যাদা দিয়েছেন। অথচ আমার ভুল ধারণা আমাদের দুজনের মাঝখানে দেয়াল তুলেছিল। আজ বুঝতে পারছি… আমি আপনাকে চাই, একজন স্বামী হিসেবে… সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে।”

ফাহাদের কণ্ঠ কেঁপে উঠলো আবেগে,

“মানে… তুমি এই বিয়ে মেনে নিয়েছো…?”

রাইসার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি,

— “হ্যাঁ… এখন থেকে আমার খাটের পাশে যে জায়গাটা খালি থাকে, আপনি সেখানে ঘুমাতে পারেন… নির্দ্বিধায়।”

~” রাইসার কথায় এক মুহূর্তের নীরবতা নামলো ফাহাদের চোখে-মুখে। তারপর কোনও পূর্বঘোষণা ছাড়াই, এক নিঃশ্বাসে সে প্লেটটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে রাইসাকে জড়িয়ে ধরল।

_” আচমকা ফাহাদের এমন আবেগময় আচরণে রাইসা খানিকটা চমকে উঠল বটে,
চোখে-মুখে বিস্ময় থাকলেও, মুখে কোনো কথা বলল না রাইসা। শুধু নীরবে এই হঠাৎ আবেগের কাছে নিজেকে সমর্পণ করল।

রাইসা আর ফাহাদ বুঝতে পারলো আজকের এই মুহূর্ত তার জীবনের সেই মোড়, যেখানে ভালোবাসা আর স্বীকৃতির বন্ধনে তারা একে অপরকে গ্রহণ করছে সম্পূর্ণভাবে।

কয়েক মুহূর্ত পর, নরম করে ফাহাদ রাইসার কাঁধে হাত রাখল।তারপর ধীরে রাইসাকে এক পাশে রাখা একটি চেয়ারে বসিয়ে দিল।
নিজে বসল আরেকটিতে, তার চোখে তখন যত্নের এক অভূতপূর্ব ।

সে ধীরে ধীরে খাবার তুলে রাইসার মুখের কাছে এগিয়ে দিল।

প্রথমে রাইসা একটু অন্য রকম অনুভব করলেও , চোখে যখন ফাহাদের সেই মায়াভরা দৃঢ়তা দেখতে পেল, তখন মাথা নিচু করে সে খেতে শুরু করল।

.
.
.
.
.
.
.

~” অসংখ্য চেষ্টার পরও ইরফানের সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি মাহির। প্রতিবারই কোনো না কোনোভাবে বাধা এসে দাঁড়িয়েছে মাঝপথে,কখনো কেউ এসে গেছে, কখনো কোনো দায়িত্ব টেনে নিয়েছে তাকে। অথচ সে জানে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। তখন সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে নিজের কাজে, হৈচৈ, আনাগোনা, হুলস্থুলের ভিড়ে আর এমন নিঃসঙ্গ ক্ষণ ফিরে আসবে না। হয়তো এটাই শেষ সুযোগ।

হৃদয়ের ভেতর জমে থাকা কথা আজ আর আটকে রাখা যাবে না,আজ না বললে আর বলা হবে না কোনোদিন। নিজের হাতের আঙুল দুটো মুঠো করে চেপে ধরে মাহি ধীরে ধীরে বলল, একরকম নিজেকেই সাহস জুগিয়ে,
“যাই হোক, আজ ইরফান ভাইকে আমার মনের কথা বলেই ছাড়ব। এমন সুযোগ হয়তো আর কোনোদিন আসবেই না।”

~” হঠাৎই মাহি নীরবে এগিয়ে এসে ফাইজার কানে কানে কিছু একটা বলল। কণ্ঠটা এতটা নিচু আর গভীর ছিল যে বাইরের কেউ কিছু টের পায়নি। ফাইজার চোখে হালকা বিস্ময়, কপালে কুচকে ওঠা একরকম জিজ্ঞাসা নিয়ে মাথা হেঁট করে সম্মতিসূচক ভঙ্গি দিল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ইরফানের সামনে দাঁড়াল।

“ভাইয়া… মাহি আপু তোমাকে ডাকছে,” সংক্ষিপ্ত অথচ জোরালোভাবে বলল ফাইজা।

ইরফান কপাল কুঁচকে ভ্রু তুলে তাকাল তার দিকে, কণ্ঠে বিস্ময় মিশ্রিত সংশয়,

“কেনো?”

ফাইজা নরম গলায় উত্তর দিল, “আমি জানি না।”

“কোথায় ও?” ইরফানের প্রশ্নে ফাইজা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, “ছাদে।”

ইরফানের মনে এক ঝড় ওঠে। হাজারটা প্রশ্ন ঘুরতে থাকে মাথার মধ্যে, কিন্তু সেসবকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল ছাদের দিকে।

~” ছাদের এক প্রান্তে নিরব দাঁড়িয়ে আছে মাহি। আকাশটা গাঢ় নীলতায় মেঘেরা ঢেকে যাচ্ছে, আর সেই নরম আলোয় মাহিকে মনে হচ্ছিল যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক স্বপ্নময় রমণী।

তার পরনে পার্পেল রঙের ঝলমলে লেহেঙ্গা,
যার জমিনে মিশে আছে সূক্ষ্ম গোল্ডেন কারুকাজ। হালকা অথচ অভিজাত সাজে সাজানো মাহি, খোলা চুলগুলো হাওয়ায় হালকা দুলে উঠছে, যেন অন্যমনস্ক কবিতার মতো অবিন্যস্ত সৌন্দর্য। চোখে ঘন কাজল, ঠোঁটে কোমল লিপস্টিকের ছোঁয়া,

ইরফান থমকে গেল। চোখের সামনে যেন মুহূর্তেই সব কোলাহল থেমে গেল, চারপাশের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে শুধু থেকে গেল মাহির সৌন্দর্যের নীরব উপস্থিতি। এতক্ষণ যে মেয়েটিকে সে ভিড়ের মাঝেও কয়েক বার তাকিয়ে ছিলো মাহির দিকে তখনও অসম্ভব সুন্দর লেগেছিল, কিন্তু এখন যেন কোনো পুরনো গল্পের রাজকন্যা, যার সৌন্দর্যে লুকিয়ে আছে চেনা অথচ নতুন এক বিস্ময়।

ইরফানের বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই কেমন যেন কেঁপে উঠল। যেন হৃদস্পন্দনটা এক লাফে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। নিজের অজান্তেই মনে হলো, এত সুন্দর, এত মোহময়ী মাহিকে সে কখনো এভাবে দেখেনি ইরফান নিজের অজান্তেই শব্দ করে বলে উঠলো,

আজকে তোকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মাহি ,

~” তবে ইরফানের উপস্থিতি আর চাহনির গভীরতা যেন তখনও মাহির কাছে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারেনি। সে ডুবে ছিল অন্য এক জগতে,ভেতরের ভয়, অজানা এক উত্তেজনা আর না বলা অনুভবের ভারে।

ইরফান খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর হাত তুলে নরম একটা ইশারা করল,যা মুহূর্তেই ভেঙে দিল মাহির ধ্যান। চমকে উঠল সে, চোখ তুলে তাকাতেই দেখল ইরফানের তাকানো মুখ।

“কিরে, কী হয়েছে তোর? কী ভাবছিস?”
ইরফানের কণ্ঠে মিশে ছিল একধরনের স্নিগ্ধ উদ্বেগ।

কোনো উত্তর না দিয়ে মাহি ধীরে ধীরে পেছনে রাখা একটি ছোট্ট ফুলের তোড়া হাতে তুলে আনল। সে তোড়ায় কয়েকটি তাজা জারবেরা, অর্কিড, আর সাদা গোলাপ ফুলের নিখুঁত মিশেল, আর তার মাঝখানে লুকানো একটি খাম,একটি চিরকুট।

মাহি শব্দহীন হাতে এগিয়ে দিল ইরফানের দিকে। কিন্তু সেই হাতের কম্পন স্পষ্ট,শুধু হাত নয়, যেন তার গোটা শরীরই কাঁপছিল। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দে গর্জে উঠছে হৃদপিণ্ড, ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম কাঁপুনি। সাহস করে সামান্য এগিয়ে গেলেও, চোখে ছিল অজানা আতঙ্ক।

~” ইরফান ধীরে হাতে নিল ফুলের তোড়াটি। জারবেরা আর অর্কিডের মৃদু সৌরভে ভেসে আসছিল এক নিঃশব্দ আবেগ। ফিতেয় বাঁধা খামটি খুলে, ভেতরে রাখা ছোট্ট চিরকুটটি বের করল সে।

চোখ নামিয়ে তাকাতেই থমকে গেল,সাদা কাগজে অনবদ্য হস্তাক্ষরে লেখা এক সংক্ষিপ্ত অথচ হৃদয়ভরা বার্তা।

“রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
‘ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দীর্ঘ পত্র না লিখতে’।
তাই সংক্ষেপে বলতে চাই…”

পরের লাইনটায় একটিমাত্র শব্দ,
ঘন নীরবতা ভেদ করে যেন হৃদয় স্পর্শ করল সরাসরি,

“ভালোবাসি।”

ইরফান মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। চোখের পলকে ঝাপসা হয়ে গেল চারপাশ, যেন কাগজের ওই একটি শব্দ তার সমস্ত জগৎ উল্টে দিল। কী সহজ, কী নিখাদ, আর কতটা গভীর ছিল সেই স্বীকারোক্তি, এক জীবনের সমস্ত জমে থাকা অনুভব এক মুহূর্তে হৃদয়ের দরজায় এসে কড়া নাড়ল।

চিরকুটটা ইরফান হৃদয়ের কাছটায় তুলে আনল
এটা শুধু কাগজ নয়, মাহির আত্মার স্পর্শ ছিল তাতে। কিছু অনুভব বোঝাতে শত বাক্য নয়,একটি মাত্র শব্দই যথেষ্ট।

“ভালোবাসি।”

~” ইরফান ধীরে চোখ তুলে তাকাল মাহির দিকে। মাহি তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে
যেন ভেতরের ঝড় সামলাতে নিজেকে ঘিরে রেখেছে এক নিঃশব্দ দেয়ালে। ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাঁপা-কাঁপা শরীরটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো অজানা ভয় আর প্রতীক্ষার প্রহরে জমে গেছে। অথচ সেই ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দেহের প্রতিটি ছায়া ঘামেভেজা,নাকের ডগায় টলটলে ঘামের ফোঁটা আলোর মতো ঝিকমিক করছে।

ইরফান থমকে দাঁড়াল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল,তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে, আবেগ-আবৃত কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলে উঠল,

“ভালোবাসিস আমায়…?”

শব্দগুলো ছুঁয়ে গেল বাতাস, স্পর্শ করল মাহির বুকের গহীনে লুকিয়ে রাখা সব চুপ থাকা আকুলতাকে।

মাহি ধীরে চোখ মেলে তাকাল। সেই চোখে ভয়, লজ্জা, ভালোবাসা,সব মিলেমিশে এক অভিব্যক্তি, যা ভাষার অতীত। ঠোঁটের কোণে সামান্য কাঁপুনি, আর চোখে সেই চিরচেনা কোমলতা।

ইরফান আবার জিজ্ঞেস করল, এবার কন্ঠে আরো বেশি ব্যকুলতা,

কি হলো, বল… ভালোবাসিস আমায়?”

মাহি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল,একবার উপরে, একবার নিচে। কাঁপা কাঁপা সেই সম্মতির ইশারায় চোখে ছিল নিঃশব্দ জবাব, কিন্তু ইরফানের তাতে মন ভরল না।

সে এক ধাপ এগিয়ে এসে স্থির দৃষ্টিতে মাহির চোখে চোখ রেখে বলল, কণ্ঠে আবেগের সাথে একরকম দাবিও মিশে আছে,

“না… মাথা নাড়ালে হবে না। তোকে মুখে বলতে হবে, স্পষ্ট করে… আমি শুনতে চাই, তোর মুখ থেকে।”

মাহি যেন আরও একটু সেঁধিয়ে গেল নিজে ভেতরে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে, বুকের ভেতর ঢেউ খেলছে না বলা অনেক আবেগের। সাহস করে গলা খুললেও, কণ্ঠ যেন নিজেই নিজেকে প্রতিহত করতে চাইছে।

তারপর অনেকটা ভেতরের শক্তি একত্র করে, গলা একটু নামিয়ে, আমতা আমতা করে, ভাঙা স্বরে সে উচ্চারণ করল,

“ভা… ভালোবাসি।”

~” ইরফান ধীরে ধীরে আরও এক ধাপ এগিয়ে এল, এসে দাঁড়াল একদম মাহির কাছাকাছি,তাদের মাঝখানে তখন আর কোনো দূরত্ব নেই, শুধু দুটো হৃদয়ের অস্থির স্পন্দন, আর নিঃশ্বাসের গোপন ভাষা।

মাহি নিচু চোখে তাকিয়ে, নিঃশব্দে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল, আর ইরফান তখন গভীর কণ্ঠে, এক আশঙ্কা আর প্রত্যাশার মাঝামাঝি এক আবেগে বলল,

“কখনো… কোনো ভয় বা বাধায়, আমায় ছেড়ে যাবি না তো?”

একটু থেমে, ইরফান নিজের ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরল মাহির দিকে,

“সকলের সামনে দাঁড়িয়ে… আমার এই হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারবি তো, মাহি?”

~” মাহি নিঃশ্বাস আটকে রাখা এক মুহূর্তের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিল,চোখে লজ্জা, আবেগ আর অপরিসীম ভালোবাসার ছায়া। ইরফানের প্রসারিত হাতটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, যেন সাহস সঞ্চয় করছিল নিজের সমস্ত ভয়, সংশয় আর দ্বিধাকে পেছনে ফেলে একটি প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য।তারপর ধীরে ধীরে, কাপা-কাপা হাতে সে এগিয়ে নিয়ে ইরফানের হাতের উপর হাত রাখলো,

মাহি কণ্ঠ নিচু করে, গলার সেই কম্পমান গভীরতায়, কিন্তু অসীম আন্তরিকতায় বলল,

“হ্যাঁ, পারবো।”

~” ইরফান হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে মাহির চোখে চোখ রাখে। গভীর, স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে

“বিয়ে করতে চাস আমায়…?”

প্রশ্নটা যেন বজ্রপাতের মতো নেমে আসে মাহির কোমল হৃদয়ে। কিছু সময় তার চোখ-মুখ স্তব্ধ হয়ে থাকে, যাকে সে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে , সে কি না এমন প্রশ্ন করছে! ভালোবাসলে কি তবে বিয়ে করার প্রশ্ন উঠে? হয় নাকি তেমন!

তবুও… ভালোবাসার কাছে মাথা নত হয় সকল যুক্তি। ধীরে মাথা নাড়ে মাহি। সম্মতির সেই ক্ষীণ ইশারায় মাহি বুঝিয়ে দিলো।

ইরফান আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে মাহির হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো,

“চল,”

মাহি থমকে গিয়ে চোখ বড় করে তাকায়, বিস্ময়ে,

“কোথায় যাবো?”

ইরফান তখনও একইরকম স্বাভাবিক, অথচ ভয়ংকর নিশ্চয়তায় জবাব দেয়,

“বিয়ে করবো তোকে ।”

~” বিস্মিত নয়নে থমকে দাঁড়ায় মাহি। চোখে লেগে থাকে অবিশ্বাসের ছায়া, কণ্ঠটা কেঁপে ওঠে

“আজ…?”

ইরফান কোনো উত্তেজনা ছাড়াই, ভীষণ শান্ত গলায় বলে,

“আজ নয়… এখন।”

শব্দগুলো যেন তীব্র ছুরির মতো কাটে মাহির বুকের গভীর অনুভব। মুহূর্তে তার বুক ধকধক করে ওঠে।অপলক তাকিয়ে থেকে, অনুরোধের সুরে ফিসফিস করে বলে,

“আজ না প্লিজ…”

ইরফান কপাল কুঁচকে তাকায়, চোখে কিছুটা অবাক রাগ,

~”কেনো..?’

মাহি হঠাৎ যেন একটু পিছিয়ে আসে, কণ্ঠে ভয় মেশানো অসহায়তা,

“আজ অহনা আপু আর রোহান ভাইয়ার বিয়ে… এমন দিনে আপনি যদি এমন পাগলামি করেন, বাসায় বিরাট অশান্তি হবে। প্লিজ… দোহাই লাগে…”

~” ইরফান গভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,
দেখ আমরা যদি গোপনে প্রেম করি তাহলে হয়তো মুহূর্তগুলো হবে রোমাঞ্চকর, কিন্তু সম্পর্কটা হারামের গণ্ডিতে পড়ে যাবে। , তুই আমার জীবনে ফুটে ওঠা এক পবিত্র ফুল আমি তোকে হারাম ভাবে আমার জীবনে জড়াতে চাই না “তুই শুধু আমার দিকে ফোকাস দে মাহি।আমার পাশে থাক।বাকি জগতের হিসেব আমি একাই সামলে নেবো।”

ইরফানের চোখে তখন অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, যেন সমস্ত দুনিয়া একপাশে সরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস লুকিয়ে আছে সেই দৃষ্টিতে।

একটু থেমে, নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলে,

“তবে মনে রাখিস… আজ যদি আমার হাত ছেড়ে দিস, তাহলে আর কখনো এই হাত ধরতে পারবি না। এখন তুই সিদ্ধান্ত নে, থাকবি, না ছেড়ে যাবি।”

শব্দগুলো যেন মুহূর্তেই জমাট বাঁধে চারপাশের বাতাসে। মাহির বুকের ভিতর দুলে ওঠে এক ভয়ানক কম্পন। তার সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে, কিন্তু হাত… ইরফানের হাত সে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। না, সে হাত ছাড়বে না।

ইরফান কিছু বলে না আর, শুধু এক দৃষ্টিতে দেখে মাহির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করে,

~” সিঁড়ির মাথায় পা রাখতেই ইরফান আর মাহিকে দেখে নিরব এগিয়ে আসে, কপালে চিন্তার ভাঁজ। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,
“ভাই, তোকে খুঁজছে সবাই! বিয়ের কাজ শুরু করতে পারছে না। সবাই তোকে ছাড়া কিছুতেই এগোচ্ছে না। ভাই, তাড়াতাড়ি নিচে চল, সবাই ওয়েট করছে।”

মাহি থমকে যায়, ইরফানের হাত শক্ত করে ধরে থাকা অবস্থায় নিরবের দিকে এক চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকায়।

~” নিরব চলে গেলে ইরফান আর মাহি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে। নিচতলার হলরুমে সাজানো বিয়ের মঞ্চে এখনো কাজী সাহেব বসে আছেন, সামনের টেবিলে রাখা নিকাহনামা, কলম, আর আতর-গোলাপজল। চারপাশে আত্মীয়-স্বজন, আতিথ্যে ব্যস্ত মুখগুলো।

হঠাৎ ইরফান সবার সামনে দাঁড়ায়, হাতে মাহির হাত শক্ত করে ধরে। উপস্থিত শত চোখ সেই দৃশ্য দেখে থমকে যায়।

ফরহাদ চৌধুরী , কপাল কুঁচকে উঠে দাঁড়ান।
তীব্র ভ্রুক্ষেপে বলেন,

“কি হয়েছে ইরফান? সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে! এত দেরি করছো কেন? যাই হোক… এসো, বিয়ে শুরু হবে এখন।”

কিন্তু ইরফান শান্ত, সুস্পষ্ট কণ্ঠে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এখানে আবারার ইরফান চৌধুরী আর মেহরিন নূর মাহির বিয়ে আগে হবে । তারপর রোহান আর অহনার।”

এক মুহূর্তেই যেন পুরো ঘরে বিস্ফোরণ ঘটে।
সব আলোচনা স্তব্ধ হয়ে যায়। উপস্থিত সকলের চোখ বিস্ফারিত, যেন কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না তারা যা শুনছে।

কেউ মুখ টিপে চায়, কেউ ফিসফিস শুরু করে, কেউ আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বাকরুদ্ধ।

মাহি কেঁপে ওঠে। ভয় আর লজ্জার মিশ্র অনুভবে কাচুমাচু হয়ে ইরফানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন মাটির নিচে ঢুকে যেতে চায়। তবুও হাতটা সে ছাড়ে না

চলবে………..?