পারবোনা আমি ছাড়তে তোকে পর্ব-৫০+৫১

0
11

#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৫০ ( স্পেশাল পর্ব ২)

~” বাড়ি ভর্তি মানুষ তাকিয়ে আছে ইরফান ও মাহির দিকে, সবচেয়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ইরফান। পাশে মাহি কান্নাভেজা চোখ, কাঁপা কাঁধে একরাশ অস্পষ্টতা। আর চারদিক থেকে ছুটে আসা স্তম্ভিত দৃষ্টিগুলো যেন তাদের ঘিরে ফেলেছে অদৃশ্য এক ঘূর্ণাবর্তে।

ফরহাদ চৌধুরী, কপালে গভীর ভাঁজ ফেলে এগিয়ে এলেন। কণ্ঠে রাগের দহন,

“কি বলছো তুমি, ইরফান? এসব কথার মানে কি? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?”

কেউ একজন গোপনে ফরহাদ চৌধুরীর কাঁধে চাপড় দিলো, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। কাশেম চৌধুরী, নরম স্বভাবের মানুষটি, পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ধীরে বললেন,

“বাবা, এই আনন্দের দিনে, এই আয়োজনের মাঝে তুমি এমন কথা বলছো কেন? একটু ভেবে দেখো তো!”

তবু ইরফান স্থির, চোখে গভীর দৃঢ়তা।

এদিকে মনির চৌধুরী এগিয়ে এসে ইরফানের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন

“পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই? এসব কথা এখন বলার সময়?”

~” সবকিছু স্তব্ধ। কোলাহল থেমে গেছে। সাজঘরের স্নিগ্ধ আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা শত মুখ যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে,

হঠাৎ ইরফানের কণ্ঠ ছেঁড়ে এলো বজ্রগর্জনের মতো,
“হ্যাঁ চাচ্চু, এটাই সময়! কারণ… এই বিয়েটা এখনই হবে!”

~’ মাহির দুচোখ ছলছল করছে, ঠোঁট কাঁপছে অস্ফুটভাবে, আর পুরো শরীরটা যেন নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছে কারও চোখে না পড়ার মতো। ও দাঁড়িয়ে আছে, অথচ ভেতরটা বলির পাঠার মতো কাঁপছে,এত মানুষের সামনে, এত অপ্রত্যাশিত আবেগের ঝড়ের ঠিক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে।

মনটা চিৎকার করে উঠলো ওর নিজের ভেতরে,
“হায় আল্লাহ! আমি কোথায় মুখ লুকাবো! মাটি যদি এখনই দুই ভাগ হয়ে যেতো, আমি যেন ভিতরে ঢুকে যেতাম চিরতরে!”

চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলো থমকে গেলো একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, কেউ ফিসফিস করে কিছু বলছে, কিন্তু কারো কণ্ঠই স্পষ্ট নয়। এই ভিড়ের মাঝেও ইরফানের কণ্ঠ যেন ঠিকই পথ খুঁজে নিচ্ছে।

সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো ফরহাদ চৌধুরীর দিকে। তার চোখে দৃঢ়তা, মুখে শান্ত অথচ অনড় সংকল্প। সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়তেই তার বুক ভেঙে এক দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো।

“বাবা,”

স্বরে এক ঝাঁঝালো বিষণ্ণতা, “আপনি তো বলেছিলেন, যেদিন মাহি নিজ মুখে বলবে যে ও আমায় ভালোবাসে, সেদিন আপনি নিজে দাঁড়িয়ে ওকে আমার হাতে তুলে দেবেন।”

এক মুহূর্তের নীরবতা। থেমে আবার বলে ইরফান,

“আমি সেই কথা মনে রেখেছি,”ইরফানের চোখ ঝলকে উঠলো,
“এতদিন নিজের ভালোবাসা বুকের গভীরে লুকিয়ে রেখেছি। একা পুড়েছি, নিঃশব্দে কেঁদেছি, কিন্তু কখনো ওর সামনে কিছু বলিনি। আমি জানতাম, ভালোবাসা চেয়ে পাওয়া যায় না। তাই নিজের অনুভবের পুঁজি নিয়ে আমি চুপ করে থেকেছি।

তার কণ্ঠ এবার থমথমে উঠোনে ঘুরে ফিরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে,

“আমি আমার চ্যালেঞ্জ জিতেছি, আপনার দেওয়া শর্ত পূরণ করেছি বাবা। আজ মাহি নিজে বলেছে, ও আমায় ভালোবাসে। আমি ওর ভালোবাসা অর্জন করেছি, পাওয়ার যোগ্য হয়েছি। তাই… আজই, এখানেই, এই মুহূর্তেই আমাদের বিয়েটা হবে।

~” ফাহাদ এসে ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে কাধে হাত রেখে একটু খানি সাহস যোগায়, যদিও আগে থেকেই ইরফান প্রস্তুত ছিল,মনস্থির, অবিচল।তবুও ফাহাদের এই বিশ্বাসভরা ছোঁয়ায় মনে হলো, বুকের ভিতর জমে থাকা দ্বিধাগুলো যেন একটু কমে এলো।

মুহূর্তের মধ্যে রাইসা, ফাইজা, রিয়া আর অহনার শরীর কেঁপে উঠলো এক অজানা আশঙ্কায়। কি হবে এখন? কী বিস্ফোরণ অপেক্ষা করছে সামনে? চোখে-মুখে স্নিগ্ধতার বদলে জমেছে আতঙ্কের ছায়া।

ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে তখন ফরহাদ চৌধুরী, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনে। তাঁকে থামাতে এগিয়ে এলেন নাজিফা বেগম , তাঁর কাঁপা গলায় শান্ত করার চেষ্টা।

একপাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লেন রাবেয়া বেগম। তিনি কিছু বলেন না, শুধু নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কাশেম চৌধুরীর দিকে।

মাহমুদা বেগম নেই আজকের এই আসরে। শরীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর চিরচেনা স্নেহময় উপস্থিতি আজ অনুপস্থিত।

বাড়ি ভর্তি সকলে তাকিয়ে আছে ইরফান আর মাহির দিকে। যেন পুরো পৃথিবীর নিঃশ্বাস আটকে আছে এই দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তে। শত কোলাহলের মাঝেও এক চিলতে নীরবতা ছুঁয়ে যায় মাহিকে। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ইরফানের দিকে, চোখে নিঃশব্দ প্রশ্নের ঘূর্ণাবর্ত।

—“কি বললো ইরফান ভাই…?” তার ঠোঁট কাঁপে নিঃশব্দে।

“সে আমাকে আগে থেকেই ভালোবাসে?”
মাহির চোখ জুড়ে বিস্ময়। হৃদয়ে দোলা দেয় এক অভূতপূর্ব অনুভূতি।
“তবে কেন সে বললো না এতদিন?”

মাহির সঙ্গে সেই একই প্রশ্ন ঘুরছে রাইসা, অহনা আর ফাইজা,তিনজনের মনে।

~” মাহি নিজের মনে নিজেকে প্রাশ্ন করলো,

কী সেই শর্ত.?

আর বড় আব্বু,তিনি কেন ইরফান ভাই কে এই শর্ত দিলেন?

আলো, গানে মোড়ানো এক আনন্দঘন মুহূর্ত ধীরে ধীরে ঢেকে যায় এক রহস্যে।
আর তারই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে, একটুখানি অভিমান, একটুখানি বিস্ময়, আর এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে মাহি।

তার চোখে যেন শুধুই প্রশ্ন,

“কেন?”

“এই প্রেম যদি সত্যি ছিল, তবে এতদিন তা আড়াল ছিল কেন?”

~” ফরহাদ চৌধুরী ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন ইরফানের দিকে। চোখে মুখে আগুন জ্বলছে, গম্ভীরতা যেন ভারী করে তুলছে চারপাশের বাতাস।তাঁর একেকটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, বাতাস থমকে যাচ্ছে, সময় যেন থেমে দাঁড়িয়েছে।

ফরিনা বেগম উৎকণ্ঠিত হয়ে এগিয়ে আসেন তাঁর সামনে।এই চৌধুরী পরিবারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও, আজ তাঁর মনে অজানা
ভয়, যদি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে যায়…
যদি দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এক মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে যায়…

রোহান দ্রুত এসে দাঁড়ায় ইরফানের পাশে, একদম নিঃশব্দে।নিরব আর সাব্বিরও এগিয়ে আসে,তাদের উপস্থিতি যেন নীরব অথচ বলিষ্ঠ এক প্রতিরক্ষা।একবারের জন্যও ইরফান পিছিয়ে যায় না, তার চোখে কোন দ্বিধা নেই, কেবল আত্মবিশ্বাস।

ফাহাদ কিছুটা আমতা আমতা করে গলা খোলার চেষ্টা করলো,

“আসলে বড় আব্বু…”

কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই
ফরহাদ চৌধুরী হাত তুলে ইশারা করলেন,

~” থেমে যাও।

চারপাশের নীরবতা আরও ঘন হয়ে আসে।

তারপরে তিনি ধীর কণ্ঠে,
তবে সেই কণ্ঠে ছিল প্রশ্নের থেকেও বেশি অভিভাবকত্বের গভীর ভার,তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন মাহির দিকে,

—”তুমি কি সত্যি সত্যি ইরফানকে ভালোবাসো…?”

~” বড় আব্বুর মুখে এমন সরাসরি প্রশ্ন শুনে মুহূর্তেই থমকে গেল মাহি।
তার মুখে ঘাম জমেছে, কপাল বেয়ে নেমে পড়ছে টলটলে ফোঁটা।
বুকে যেন কে একখানা পাথর চাপিয়ে বসে আছে,মন, শরীর, আত্মা—সব কেঁপে উঠছে ভয় আর দ্বিধায়।

“গলা শুকিয়ে কাঠ। শব্দ বেরুতে চায় না ঠোঁটের কোণে।চোখ দুটো স্থির হয়ে গেছে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে এই প্রশ্ন তার জন্যই এসেছে, তাও বড় আব্বুর মুখ থেকে,
যাঁর সামনে সে মাথা নিচু করেই কথা বলে আজীবন।

কিছুটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে।
নীরবতা ভারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে, যেন প্রতিটি মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে সেই একটিমাত্র উত্তরের জন্য।

ফরহাদ চৌধুরীর কণ্ঠ আবার কেঁপে উঠলো, এবার আগের চেয়েও গম্ভীর,

“একটা প্রশ্ন করেছি তোমায়!
বলো, ইরফান যা বলেছে…তা কি সত্যি?
তুমি কি সত্যিই তাকে ভালোবাসো?”

শব্দগুলো যেন বজ্রাঘাতের মতো আঘাত করলো মাহির হৃদয়ে।
তার চোখে পানি এসে ভিজে উঠলো দৃষ্টির কোণ, কিন্তু সে সেগুলো লুকাতে চাইল না।
কণ্ঠ তখনও শুকনো, কিন্তু ঠোঁট একটু নড়ে…
তার ভিতরের লড়াই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে চোখে মুখে,সমাজ, দায়িত্ব, ভয়, আর… ভালোবাসা
সব কিছুর সংঘর্ষে দাঁড়িয়ে আছে সে।ঠোঁট জোরা তিরতির করে কাঁপছিলো সেই, ছলছল নয়নে তাকিয়ে সে হালকা করে মাথা নাড়ায় উপর নিচ।

~” মাহির সেই অকপট সম্মতি সূচক মাথা নাড়ানো দেখে মুহূর্তের মধ্যে যেন বজ্রপাত নয়,পুষ্পবৃষ্টি নেমে এলো চৌধুরী বাড়ি জুড়ে!

ফরহাদ চৌধুরী, যিনি কিছুক্ষণ আগেও আগ্নেয়গিরির মতো গমগম করছিলেন,
হঠাৎ এমন উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন,

—”আহারে! আমার ঘরের লক্ষ্মী! আমার বউমা রাজি! হায় রে খোদা! আমার ইরফানের কপালে সোনার নৌকা!”

চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন চমকে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
যেন কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না,
এই লোকটাই সেই গম্ভীর মুখের চৌধুরী সাহেব, যাঁর কণ্ঠে এতক্ষণ বজ্রধ্বনি হচ্ছিল!

আর এখন?

হাসির ফোয়ারা যেন মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে,
চোখে-মুখে আনন্দের এমন ধারা বইছে যে মনে হয়এ আর মানুষ নন, কোনো নববধূর,অভিভাবক হিসেবে পুরস্কার জেতা অভিনেতা!

~” চারপাশ যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।
সবার চোখে-মুখে বিস্ময়, কানে হালকা গুঞ্জন
কী হচ্ছে এখানে? এতক্ষণ যে উত্তাপ, যে রাগ, যে দমবন্ধ পরিস্থিতি, তা হঠাৎ করে এমন আনন্দে রূপ নিল কীভাবে?

এই দ্বিধা ও জল্পনার মাঝেই
ফরহাদ চৌধুরী মুখে প্রশান্তির হাসি নিয়ে, ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন কাশেম চৌধুরীর দিকে।
তাঁর কণ্ঠে ছিল মজা মিশ্রিত এক দৃঢ়তা,

“ভাই, তোর কোনো আপত্তি আছে?”

সব চোখ এবার ঘুরে গেল কাশেম চৌধুরীর দিকে।তিনি এক মুহূর্তও না ভেবে এগিয়ে এসে বললেন,

“না ভাইয়া, আপত্তি কেন থাকবে?
ইরফান বাবার মতো ছেলে।আমার সোনার টুকরো মেয়ের যোগ্য পাত্র সে।”

এই কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন আশীর্বাদের মতো ছড়িয়ে পড়ল এক স্নিগ্ধতা।
ফরহাদ চৌধুরী দুহাত উঁচিয়ে বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ!”

আর তারপরেই যেন ফের বেজে উঠলো তাঁর হাসির সুর।একেবারে প্রাণখোলা, উদ্দাম, নির্ভেজাল এক আনন্দযেটা তাঁর মতো ব্যক্তিত্বের মুখে দেখা যায় খুব কমই। এবার সাথে যোগ দিলেন কাশেম চৌধুরী,

সকলেই চমকে তাকিয়ে রইলো।
ফাহাদ, রাইসা, ফাইজা, অহনা, রোহান, নিরব, সাব্বির, সবাই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ যেন কোনো নাটকের ক্লাইম্যাক্সে এসে হঠাৎ প্লট টুইস্ট দিয়ে দিলো।

“কি হচ্ছে আসলে?”

“এইটা কি সত্যি?”

ফরিনা বেগম আর মনির চৌধুরী দুই ভাই বোন বিস্ময়ে চোখ গোল করে তাকিয়ে রইলেন একে অপরের দিকে, নাজিফা বেগম এক সস্থির নিশ্বাস নিলেন তাদের দুই ভাইয়ের হাসি দেখে, রাবেয়া বেগম এসে নাজিফা বেগম এর পাশে দাঁড়ায় অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

“হায় আল্লাহ! এই মানুষটা যে হাসতেও জানে, তা তো জানতাম না!”

ইরফান তখন স্তম্ভিত।এমন হঠাৎ আনন্দে সে কিছু বলতে পারছে না,শুধু মাহির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিলো, চোখে প্রশান্তির এক আশ্চর্য আলো।

~” পুরো ব্যাপারটাই যেন মাহির মাথার উপর দিয়ে গেল।এক মুহূর্ত আগে যেখানে সবকিছু ছিল চাপা উত্তেজনা, ভয়, আর নিঃশ্বাস আটকে রাখা অপেক্ষা, হঠাৎ করে সেটাই রূপ নিল উৎসব, উল্লাস আর প্রশংসার জোয়ারে।

মাহি দাঁড়িয়ে আছে প্রায় থমকে যাওয়া অবস্থায়।তার মুখে লাজুক বিভ্রান্তি, চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা।সে যেন বুঝতেই পারছে না
এই নাটকের কাহিনি কখন, কিভাবে এমন মোড় নিল!

তার অবুঝ দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে ঘুরে এলো ইরফানের দিকে।সে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো,
ঠিক যেন কেউ বইয়ের শেষে এসে পৌঁছেছে কিন্তু পাতাগুলো এখনো পড়া হয়নি।

ইরফান মাহির দিকে একবার তাকিয়ে চোখ টিপে হাসলো।তারপর হালকা হাস্যরস মিশ্রিত গলায় ফিসফিসিয়ে বললো,

“কিছু জিনিস না বোঝাই ভালো… My dear weakness।”

মাহি হঠাৎ থমকে গেল।
তার মুখে যেন বিস্ময়ের ছায়া লেগে রইলো কিছুক্ষণ।ইরফানের মুখে এই প্রথম এমন কথা শুনছে সে,

এই প্রথম কোনো সরাসরি, অকপট উচ্চারণ…
সে তার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় করে তাকিয়ে রইলো ইরফানের দিকে।

“My dear weakness…”
এই কয়েকটা শব্দ যেন মাহির বুকের গভীরে গিয়ে টোকা দিল।কান্না, হাসি, লজ্জা, সব মিলিয়ে একরকম কাঁপুনি বয়ে গেল,শরীরজুড়ে।

~” কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশের উত্তেজনা, গুঞ্জন আর বিস্ময় সব যেন গলে গিয়ে মিশে গেল এক নির্মল প্রশান্তিতে।চৌধুরী বাড়ির আঙিনায় এখন ভেসে আসছে গুনগুনে কোরআন তিলাওয়াত আর খুশির মিষ্টি ফিসফাস।কাজি সাহেব বসে জায়গা নিয়েছেন, বিয়ের পবিত্র কাজ শুরু হয়েছে।

মাহিকে সাজানো হয়েছে ঠিক যেন রাজকুমারীর মতো,হালকা লাল আর সোনালি জামদানি, মাথায় টিকলি, আর চোখে কাজল
সে যেন নিজেকেই চিনে উঠতে পারছে না আয়নার সামনে।

অপর পাশে বসেছে অহনা, সবার চোখে মুখে কৌতুহল, আর একটু রোমাঞ্চ নিয়ে তাকিয়ে আছে সবাই,

দুই বোন,একজন ফুপাতো, আরেকজন মামাতো,আজ একসাথে বউ হয়ে বসেছে বিয়ের আসরে!এই দৃশ্য যেন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই পরিবারে।

অন্যদিকে, ইরফান ও রোহান বসে আছে জামাই বেশে।দুজনেই আজকের তারকার মতো, অথচ চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ স্পষ্ট।

হঠাৎ রোহান কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে ইরফানের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

“ভাই, এইটা কি ধরনের বিচার হলো ? আমার জন্য কাজি আসলো, আর তুই কিনা আগেই বিয়ে করে ফেলছিস ?”

ইরফান ঘাড় কাত করে, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি রেখে ফিসফিসিয়ে জবাব দিল

“সমন্ধী কে? আমি না তুই?”

রোহান চোখ কুঁচকে বললো,

” তুই!

ইরফান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,

” তো আমার বিয়ে না হয়ে তোরটা আগে হবে কেন ?”লাইনে থাক, এক ঘণ্টা পরে তোদেরও ডাক পড়বে। আগে সিনিয়র জামাইরে সাইন করতে দে।”

রোহান মুখ চিপড়ে ফিসফিস করে বললো,
—“বিয়ে হইতেছে , আর তুই এখানে স্যালারির মতো সিনিয়র-জুনিয়রের হিসাব করতাছিস?”

দুজনেই মুখ চেপে হাসি চাপার চেষ্টা করলো, কিন্তু চোখ-মুখে সেই কিশোরসুলভ আনন্দ আর দুষ্টুমির ঝিলিক থামানো গেল না।

~” সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে, কাজি সাহেব পরম শান্তভাবে মুখ তুলে তাকালেন ইরফানের দিকে।

মাহির মুখ নুয়ে আছে, চোখে অপার লজ্জা আর লুকানো হাসির ছায়া।আর ইরফান,সে চোখে অনাবিল আত্মবিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে আছে।

কাজি সাহেব কণ্ঠে ধর্মীয় গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন,

” বাবা ” রাজি থাকলে বলো,কবুল।”

এক মুহূর্ত নীরবতা।

তারপর ইরফান হঠাৎই যেন সমস্ত আবেগ, সমস্ত প্রতীক্ষা আর ভালোবাসা দিয়ে
এক চিৎকারে যেন আকাশকেও সাক্ষী করে বলে উঠলো

“আলহামদুলিল্লাহ! কবুল! কবুল! কবুল!”

যেন এই কবুল বলার মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে জীবনের সবথেকে বড় অর্জন।

এরপর হালকা হেসে, চোখের কোণে আবেগ লুকিয়ে রেখেসে গম্ভীর কণ্ঠে, কিন্তু স্নেহভরা দৃষ্টিতে বললো,

“তিন কবুল,
আমার মহারানীর ভালোবাসাকে কবুল,
তার অভিমান কে কবুল,আর তার পাগলামি বাচ্চামি গুলো ও কবুল।”

চারপাশে উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।এই ইরফানকে যেন কেউ আগে কখনো দেখেনি, চোখে আনন্দের আলো, মুখে এক সন্তুষ্ট বিজয়ীর হাসি।

রাইসা, ফাহাদ, রোহান, ফাইজা,সবাই চমকে চেয়ে রইলো। আবার মনে মনে অনেক খুশি ও হলো।
কাশেম চৌধুরী চশমা নামিয়ে চোখ মুছলেন নিঃশব্দে,আর ফরহাদ চৌধুরীর মুখে ফুটে উঠলো এক গভীর প্রশান্তি।

~’ ইরফান ও মাহির বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই, আবার যেন নতুন করে শুরু হলো ভালোবাসার আরেকটি অধ্যায়।
মিষ্টি আলোয় ঝলমল করা বিয়ের আসরটা এবার আরও একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলো,
কারণ এবার আসরে বসেছে রোহান ও অহনা।

কাজি সাহেব নিজের দায়িত্বের প্রতি সমান নিষ্ঠায়,
আবারও শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“বাবা, রাজি থাকলে বলো, কবুল।”

রোহান এক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলো।
চোখে-মুখে তার সেই চিরচেনা দুষ্টু ভঙ্গি,
আর মনে মনে ঠিক তখনই বিড়বিড় করে উঠলো,

_”রাজি না থাকলে কি ঢ্যাং ঢ্যাং করে এখানে বর সেজে বসে আছি নাকি?

একটা নাক সিঁটকানো অভিব্যক্তি দিয়ে যেন নিজেকেই উত্তর দিলো।

তবে তা মুখে না এনে, নাটকীয় এক গলা খাঁকারি দিয়ে, নিজেকে গুছিয়ে নিলো সে।

তারপর হালকা ভঙ্গিমায় গলা মোলায়েম করে,
কণ্ঠে গাম্ভীর্য এনে বললো

“কবুল… কবুল… কবুল!”

তার এই উত্তর শুনে পাশের অহনা মুখ নিচু করেও লাজে-হাসিতে কাঁপতে লাগলো।

~” সব আনুষ্ঠানিকতা, নিয়মকানুন আর শপথের পরে,চৌধুরী বাড়িতে শুরু হলো বিয়ের এক আবেগঘন, রঙিন পর্ব,

“~আয়না দেখা~”

বিয়ের রীতি অনুযায়ী নবদম্পতির সামনে ধরা হলো রুপার কাজ করা এক ঝকঝকে আয়না,
যেখানে প্রতিফলিত হবে ভালোবাসা, ভবিষ্যৎ আর একে অপরের প্রতিজ্ঞা।

প্রথমে রোহান ও অহনার সামনে আয়না ধরে দাঁড়ালো রিয়া।
চোখে একরাশ কৌতূহল আর মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বললো,
—”আয়নায় কাকে দেখা যায়?”

রোহান আয়নার দিকে চেয়ে হেসে বললো,

“আমার ভালোবাসা… আমার মিষ্টি রাগিনীকে দেখছি আমি।”

তার কণ্ঠে ছিলো আদর, চোখে ছিলো প্রশান্তি।
আর এই কথা শুনে অহনা চুপচাপ মাথা নিচু করে ফেললো,ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক লজ্জামাখা হাসি,যা কোনো ফুলের পাঁপড়িকেও হার মানায়।

এরপর রাইসা ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালো ইরফান ও মাহির সামনে।সেও একই প্রশ্ন করলো,
—“আয়নায় কাকে দেখা যায়?”

ইরফান এক দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ,মাহির প্রতিফলিত মুখের দিকে গভীরভাবে চেয়ে থেকে বললো,

“আমার হৃদয়ের একমাত্র রানীকে দেখছি”
আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা,
আমার লাজুক বউকে।”

মাহি এক চিলতে হাসি দিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো,লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছে,
আর চারপাশে যেন এক কোমল প্রেমের বাতাস বয়ে গেল।

~” সব রীতি, সব নিয়মের পর্দা যখন নামল, তখন যেন সন্ধ্যা নেমে এলো নতুন আলোয়। বড়রা একে একে সোফায় বসে গেলেন, তাদের চোখে প্রশান্তির ঝিলিক। একে অন্যর সাথে কথায় মেয়ে উঠলো।

এদিকে ইরফানের বন্ধুরা মিলে উৎসবের মেজাজে চারপাশে ছোট্ট একটা আলোর জগৎ তৈরি করল,স্টেজের সামনে গিয়ে ওরা ইরফান, মাহি, রোহান আর অহনাকে বসিয়ে দিল আনন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে।

চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে এক টুকরো কাঁচের মতো রঙিন হৈহুল্লোড়। বন্ধু-বান্ধব আর কাজিনদের চঞ্চলতা, হাসি, দুষ্টুমি,সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নের মঞ্চ। এখানে আজ কোনো বড় ছোট নেই, নেই কোনো নিয়মের বেড়াজাল,শুধু মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়ানো এক টুকরো আনন্দ।

হঠাৎ, মিউজিক বক্সে জোরে বেজে উঠল এক মায়াবী হিন্দি গান, ফাইজা আর রিয়া মুচকি হেসে রাইসার হাত ধরে তাকে টেনে তুলল স্টেজের দিকে। ওদিকে নিরব আর সাব্বির মিলে হাসিমুখে ফাহাদকে ঠেলে দিল নাচের মঞ্চে। আজ তাদের মধ্যে আর কোনো সংকোচ নেই, কোনো দুরত্ব নেই,শুধু এক গভীর অনুরাগ, অদৃশ্য টান, যেন ইরফান-মাহির বিয়ের খুশি দুজনের হৃদয়ের সব পর্দা ভেঙে দিয়েছে। গানটি বেজে চলেছে,

“! Kasam hai tumhe tum!”

“! Agar mujhase ruthe!”

“! Rahe saans jab tak !”

“! Ye bandhan na toote! ”

“! Tumhen dil diya hai! ”

“!Ye vaada kiya hai sanam main !”

“! Tumhaari rahungi sada! ”

গানের সুরে হৃদয়ের ধ্বনি মিশে গেল।

মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা দর্শকদের সামনে, সেই নরম আলোর নিচে, রাইসা আর ফাহাদ একে অপরের চোখে চোখ রেখে নাচতে লাগল। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন আবেগ ঝরে পড়ছে, প্রতিটি ভঙ্গিমায় ফুটে উঠছে এক অমোঘ সম্মোহন। গান শেষ হতে না হতেই চারদিক হাততালির ঝংকারে, শিস আর উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে উঠল।

~” হালকা নিঃশ্বাস ফেলে দুজন স্টেজ থেকে নামছিল, কিন্তু যাওয়ার আগে ফাহাদ চোখের ইশারায় সাব্বির আর রিয়াকে ডাক দিল। রাইসা হেসে রিয়ার হাত ধরে তাকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে দিল।

সাব্বির একটু দ্বিধায় ছিল, কিন্তু রিয়ার চোখে একরাশ চঞ্চল উচ্ছ্বাস দেখে সে আর নিজেকে থামাতে পারলো না। একসাথে তারা উঠল সেই একই স্টেজে,যেখানে কিছুক্ষণ আগেই প্রেম আর আবেগের আলপনা এঁকে দিয়েছিল ফাহাদ-রাইসা।

ঠিক তখনই ডিজে একটা বিখ্যাত হিন্দি হাই বিট গান ছেড়ে দিল, সেই গানে যেন স্টেজটা কেঁপে উঠল, চারপাশে আলো-ছায়ার নাচ, সবাই একসাথে তালি দিয়ে উঠলো, হাত উঁচিয়ে উৎসাহ দিতে লাগলো।

গানের তালে সাব্বির আর রিয়া নাচছে,

“! Teri chunari lipat lipat ke pagal mujhe banaaye !”

“! Pehle se hi tadap raha tha aur mujhe tadpaaye ! ”

“! Jane tamanna kar na aise Sitam!”

“! Kuch na mein bolu tujhe meri kasam ! ”

“! Aayi jawani sar pe mere! ”

“! Tere pe kya karoon jawani pe rehem !”

“!! haye!! ”

“! Aaja na chhoole meri chunari sanam! ”

“! Kuchh na mein boloon tujhe meri kasam! ”

~” সাব্বির আর রিয়ার প্রাণখোলা নাচ শেষ হতেই হলরুমে যেন আনন্দের বিস্ফোরণ ঘটল। সবাই আবারো চিৎকার করে উঠলো, হাততালিতে ভরে উঠল চারপাশ। কিন্তু ঠিক তখনই, যেন উৎসবের রথ হঠাৎ থেমে গেল। মঞ্চটা খালি, সবার মনে একটাই প্রশ্ন,এবার কার পালা?

হঠাৎ রাইসা একটা দুষ্টু হাসি নিয়ে ফাইজার পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছু না বলেই ঠেলে দেয় তাকে মঞ্চের দিকে। ফাইজা একটু লাজুক, একটু অবাক, কিন্তু চোখে-মুখে এক অপূর্ব উচ্ছ্বাস।

মিউজিক বক্সে এবার বেজে ওঠে এক চটুল ছন্দের বাংলা গান,

“বলছি তোমার দিব্বি খেলে আমি বড় শান্ত ছেলে…”

কিন্তু স্টেজে তখনও ফাইজা একা। সে চারপাশে তাকায়, চাতক পাখির মতো কারো খোঁজে। কার সঙ্গে নাচবে? কে আসবে তার পাশে?

ঠিক তখনই, সাব্বির নিরবকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দেয়। নিরব একটু দ্বিধায়, কিন্তু পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে আসে মঞ্চের দিকে।

তবে চমক তখনও বাকি।

রবিন, অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ ফাইজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার আর নিজেকে থামাতে পারেন না। ধীরে ধীরে, কিন্তু দৃপ্ত পায়ে মঞ্চে উঠে দাঁড়ান। এক পাশে নিরব, অন্য পাশে রবিন, আর মাঝখানে ফাইজা,যেন দুই মাধ্যাকর্ষণের মাঝে এক চঞ্চলা তারা।

গানের পরবর্তী কলিতে তিনজনের নাচে প্রাণ ফুটে ওঠে, আবার ও একই কলি এবার নিরব শান্ত চোখে তাকিয়ে তাল মেলায়,

~” বলছি তোমার দিব্যি খেলে আমি বড় শান্ত ছেলে ,

.
.
.
.
~” তারপর রবিন সামনে এসে দাঁড়ায়,

“দেখছি তোমায়
সুযোগ পেলে
শুনে বুঝি বিষম খেলে…”

রবিন একটু এগিয়ে আসে, চোখে একটু mischievous ভাব, ঠোঁটে হালকা হাসি। তার ভঙ্গিমা যেন বলে,তোমায় দেখে বিষম খেলেও, মন তো আমায় তোমার দিকেই টানে।

নিরব হালকা মাথা নেড়ে ফাইজার দিকে তাকিয়ে ছন্দে ছন্দে পা মেলে নাচে।

তাদেরতাদের তিনজনের নাচ এবার এক ছন্দে মিশে যায়। ফাইজা মাঝখানে, দুই পাশে দুই ছায়া,কিন্তু কারটা আপন, তা বুঝে উঠা দায়।

গানের শেষ কলি শুরু হয়, সবার চোখ তখন সেই মঞ্চেই আটকে,

“পড়ে গেছি ইশকে তে
আছি বড় রিস্কে তে
খালি পিলি মিস করে যাই
একটু যদি মিশতো সে…”

নাচের তালে ফাইজা একবার নিরবের দিকে ঘোরে, আবার রবিনের দিকে। তিনজনের পা যেন ঘূর্ণির মতো মঞ্চে ঘুরছে, হাওয়ার মতো হালকা, আগুনের মতো প্রাণবন্ত। হাসি-মজা আর চোখে চোখে খেলা।

“রাগারাগী কম করে
মনটা নরম করে
SMS এ হলেও যদি
বলতো আমায় সে..
আসো না কেনো বাসো না
ভালো লাগে না যে আমার…

শেষ লাইনে তিনজন একসঙ্গে হাত তুলে ঘুরে দাঁড়ায়,

চারপাশে আবারো হাততালির ঝড়, শিস, হইহল্লা, আর সেই মঞ্চে জ্বলজ্বল করে ওঠে ফাইজা, নিরব, আর রবিন।

~” হঠাৎই পরপর আরেকটি ডিজে গান চালিয়ে দিল। লাইটের ঝলক, স্পটলাইটের ছটায় মুহূর্তে বদলে গেল মঞ্চের রঙ।
ফাইজা একটু চমকে তাকালো সামনের দিকে, চোখে মিশে ছিল এক মুঠো বিস্ময়।
নিরব যেন হঠাৎ করেই একটু অপ্রস্তুত, চোখ নামিয়ে নিলো, যেন কিছু বলতে গিয়ে নিজেই থেমে গেল।
তবে রবিন? তার মেজাজ এখনো ফুরফুরে। সে তো কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই নিজের মতো ছন্দে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।

গান যেহেতু চলছে, এখন থেমে যাওয়াও চলে না।
তিনজনেই একসাথে আবার নাচে মেতে উঠলো—
আলো-আঁধারির মাঝে, গানের তালে, প্রাণভরে…,

Round de cak one, Round de cak Ae Round de cak..!

No Matter Let, Tem Say…………. Let’s Have some…..!

Runak shaunak……….Let’s Have some………..Rimix….!

~” নাচ শেষ হতেই হালকা আলোয় ভেসে এলো ঘামভেজা তিনটি মুখ।
তিনজনেই ধীরে ধীরে নেমে এলো স্টেজ থেকে,
প্রান ভোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে, যেন দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে এবার।

ফাইজার কপালের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গাল ছুঁয়ে নামছে,
নিরব নিজের শার্টের কলার একটু আলগা করে নিলো, আর রবিন তো হাঁপাতে হাঁপাতে হেসে উঠলো, “আরে ভাই, আজ তো পুরোটাই জিম সেশন হয়ে গেলো!”

চারপাশের আলো এখনো ঝলমল করছে,
তবু তাদের মধ্যে এক ধরনের নিঃশেষ উচ্ছ্বাস,

চলবে………………..?

#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৫১

রাত তখন ঠিক নয়টা। চারোদিকে রঙিন আলো জ্বলছে, আকাশের নিচে ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে ইরফান ফোনে কথা বলছে সিয়ামের সঙ্গে,আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অহনা।

কয়েক ঘণ্টা আগেই রোহান আর তার কাজিনরা মিলে অহনাকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছে তার নতুন জীবনের প্রথম ঠিকানায়,শ্বশুরবাড়ি।
ফাহাদও গিয়েছিল,সহজ করে, সান্ত্বনা দিয়ে, শান্তভাবে অহনাকে বুঝিয়ে ফিরে এসেছে।

বাসায় ফিরেই ছাদে উঠে এসেছে ফাহাদ, ইরফানের খোঁজে।

কলটা কেটে যেতেই, হঠাৎ চোখে পড়ল ইরফানের, ফাহাদ তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফেলেছে।

ফাহাদ একটু অবাক ভঙ্গিতে, কিন্তু মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলল,

“ভাইয়া… তোমার আর বোনের আজকেই বিয়ে হয়ে গেল! আমি এখনো ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না! এত দ্রুত… এসব সম্ভব হলো কীভাবে?”

ইরফান হালকা ভ্রু নাচিয়ে, দুষ্টু হাসি চেপে মজা করে জবাব দিল,
“সমন্ধী হয়ে ছোট বোনের প্রেমের কাহিনি শুনতে চাস? লজ্জা করে না তোর?
তোর লজ্জা থাকুক আর না থাকুক, আমার তো অন্তত কিছুটা লজ্জা আছে!”

ফাহাদ একটু চোখ কুঁচকে, ঠোঁটের কোণে কটাক্ষ মিশিয়ে বলে উঠল,

“ওও আচ্ছা! আর ছোট বোন জামাই হয়ে যখন এতোকাল ছোট বোন সমন্ধীর কাছে প্রেমে হেল্প নিছো,তখন কি তোমার সেই লজ্জা একটু হলেও জাগেনি… ভাইয়া?”

~”ইরফানের ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি খেলে গেল।
মৃদু স্বরে, যেন নিজের ভাবনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

“নিরব কোথায়…?”

ফাহাদ এক পা এগিয়ে এসে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
জবাবে হালকা ক্লান্ত গলায় বলল,

“আসার পথে নিরব ভাইয়া নেমে গেছে। আমি জোর করছিলাম আমার সাথে আসতে,
কিন্তু সে হেসে বলল”এখন না, সকালে আসব।’

একটু থেমে, চারপাশের নীরবতা অনুভব করে ফাহাদ আবার বলল,

বাসায় এসে শুনলাম সাব্বির ভাইয়া রা নাকি চলে গিয়েছে ?”

ইরফান এক মুহূর্ত চুপ করে
নরম গলায় বলল,

“হ্যাঁ…
সাব্বির রিয়াকে নিয়ে চলে গেছে।” আজ না গেলেও পারতো তবে বললো বাসায় কিছু একটা প্রয়োজন আছে তাই আর বারণ করিনি।

~” রাত প্রায় দশটা ছুঁইছুঁই। দুই ভাই ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে,চারপাশে রাতের নরম হাওয়া, আকাশে ছড়ানো তারার ঝিকিমিকি। নিচে ফাহাদের ছোট ভাইয়েরা এখনো আনন্দে মাতোয়ারা,গানের তালে নেচে চলেছে, হাসি আর কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে এলাকা। সেই দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখছে ইরফান আর ফাহাদ।

তাদের আলাপের ফাঁকে সময় যেন নিঃশব্দে গড়িয়ে গেছে। আজকের দিনটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, এক অসমাপ্ত অপেক্ষার অবসান। ছাদের নীরব আলোর নিচে দাঁড়িয়ে ইরফানের মনে হঠাৎই ঝলসে উঠলো সেই ভাবনা মাহি, তার স্বপ্নের মেয়ে, এখন তারই হয়ে গেছে। আজ কাগজে-কলমে, সামাজিক স্বীকৃতিতে, একেবারে চিরকালের জন্য।

এই ভাবনার সাথে সাথেই ইরফানের চোখের কোণে একটুকরো শান্তির দীপ্তি, হৃদয়ে এক অপার তৃপ্তির ঢেউ। বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত, বহু বছরের আকাঙ্ক্ষা আজ পরিপূর্ণতা পেয়েছে। নিজের মনের গভীরে সে অনুভব করলো এক অদ্ভুত শান্তি,যেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইটা সে আজ জিতে গেছে।

হঠাৎ করেই নিচের দিক থেকে ভেসে এলো এক চনমনে ডিজে গানের তালে ঝঙ্কার রাতের আকাশ যেন মুহূর্তে নেচে উঠলো সে সুরে। এক মুহূর্ত আগে যে ইরফান ছিলো ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে, চোখে গভীর স্বপ্নস্নাত তৃপ্তি,সে হঠাৎই যেন নিজের ভেতরের বাঁধন ভেঙে দিলো।

গানের তালে তালে সে নিজের অজান্তেই নাচে মেতে উঠলো। আনন্দে, উত্তেজনায়, গভীর ভালোবাসার পরিপূর্ণতায় তার ভেতরে জমে থাকা আবেগ আর স্থির থাকতে পারলো না। বহু বছরের কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির সুখে সে আজ নাচে,উন্মুক্ত আকাশের নিচে।

ফাহাদ হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ের দিকে। ভাইয়া, যে সবসময় সংযত, গম্ভীর, আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিমূর্তি, সেই ভাইয়া, আজ এই রাতের জ্যোৎস্নায় ছাদে দাঁড়িয়ে সুরের তালে নাচছে!

ফাহাদের ঠোঁটে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো। বিস্ময়ের সেই ছায়া এখন প্রশংসায় রূপ নিলো। সে জানে, এই নাচ কোনো সাধারণ উচ্ছ্বাস নয়,এটা এক বিজয়ের উচ্ছ্বাস, এক ভালোবাসার উত্থান, এক তৃপ্ত হৃদয়ের উচ্ছল প্রকাশ।

“পরক্ষণেই ফাহাদের ভেতরেও যেন একরাশ উচ্ছ্বাস খেলে গেলো। ইরফানকে এভাবে আনন্দে ভেসে যেতে দেখে, নিজের হৃদয়টাও হঠাৎই ফুরফুরে হয়ে উঠলো। আজকের দিনটাই যেন অলৌকিকভাবে সাজানো
,রাইসার সঙ্গে তার মনের এক অপূর্ব মিলন, আর তারই মাঝে ইরফান-মাহির বিয়ের সেই চমকে দেওয়া মুহূর্ত,সব মিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দে দিনটা পূর্ণ হয়েছে।

আর তাই দেরি না করে ফাহাদও নেমে পড়লো সেই আনন্দের স্রোতে। ছাদে, তারাদের নিচে, ডিজে গানের তালে এবার দুই ভাই একসাথে নাচতে শুরু করলো,হাসিমুখে, অবাধে, নির্ভার প্রাণে।

গানের পর গান বাজতে লাগলো। একটার পর একটা তিনটি গান শেষ হলো, আর দুই ভাই যেন সময় ভুলে গেলো। কখন যে পনেরো মিনিট কেটে গেছে টেরই পায়নি তারা। নাচ শেষে দু’জনেই হাঁপাতে হাঁপাতে থামলো,কিন্তু মুখে তখনও চওড়া হাসি, চোখে একরাশ উজ্জ্বল আনন্দ নিয়ে নিচে নামলো দুই ভাই।

.
.
.
.
.

~” একটু গলা খাঁকারি দিয়ে ধীরে ধীরে কক্ষে প্রবেশ করলো রোহান। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তার চোখ স্থির হলো বেডের দিকে। সেখানে নরম আলোয় বসে আছে অহনা,নতুন বউয়ের সাজে, শাড়ির আঁচলে মুখ আড়াল করা, মাথা নিচু করে যেন নিজের ভেতরেই লুকিয়ে আছে।

রুমে নেমে এসেছে এক অভূতপূর্ব নীরবতা। সময় যেন থমকে গেছে। রোহান নিঃশব্দে এগিয়ে এসে পাশে বসলো, কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া নেই। অহনা একটিও শব্দ করেনি, শুধু মাথা নিচু করে বসে আছে, যেমন ছিল, তেমনই। তার স্পন্দনহীন নীরবতা যেন রোহানের বুকের ভিতরটায় নিঃশব্দ ঝড় বইয়ে দিচ্ছে।

রোহান ভেতরে ভেতরে দ্বিধায় ভুগতে লাগলো,কি বলবে? কিভাবে শুরু করবে? কীভাবে এই নতুন জীবনের প্রথম কথাগুলো গেঁথে তুলবে নতুন স্ত্রীর সঙ্গে?

শেষমেশ, দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে, গলা ভেজা এক কোমল সুরে রোহান গেয়ে উঠলো:

“অহনা… একটু কথা কহ না…”
“অহনা… মুখ মুখ তুলে চাহো না..!

~” অহনা মুখ তুলে তাকায়নি, তবুও তার ঠোঁটের কোণে ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো এক ঝলমলে, লাজুক হাসি,যা লুকানো থেকেও বলে দেয় হৃদয়ের গোপন আনন্দ।রোহান একধাপ এগিয়ে এলো, চোখে ছিল এক ধরনের মুগ্ধতা, এক ধরনের গভীর আকুলতা।সে নিঃশব্দে অহনার ঘোমটা সরিয়ে দিলো, যেন আলোর নিচে তুলে আনলো তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুখ।

অহনা একঝলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। চোখে লাজ, মুখে মৌনতা, অথচ হৃদয়ে তীব্র ধ্বনি বাজছে ভালোবাসার।
রোহান ধীরে হাতে হাত রেখে, তার আঙুলের আলতো স্পর্শে অহনার থুতনির নিচে হাত রাখলো। সে চোখে চোখ রেখে বললো,

— “আমার মিষ্টি বউ… আমার ভালোবাসা।
যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,তোমাকেই একদিন আমার বউ করে নিয়ে আসবো।
আর আজ… তুমি সত্যি সত্যিই আমার ঘরের বউ হয়ে এলে।”

তার কণ্ঠে ছিল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আবেগের স্পন্দন,
যা অহনার সমস্ত শরীর জুড়ে এক নীরব শিহরণ বইয়ে দিল।
সে কিছু বললো না, তবু তার লাজে রাঙা মুখ আর কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছিল,সে আজ নিজেকে হারিয়ে দিয়েছে ভালোবাসার এই নিঃশর্ত মোহে।

রোহান একটুকরো চুপির মুহূর্তে পকেট থেকে একটি ছোট্ট মখমলি রিংবক্স বের করলো।তারপর ধীরে ধীরে অহনার বাম হাতের অনামিকায় সেই আংটিটি পরিয়ে দিলো।আঁকড়ে ধরলো তার হাত, যেন অদৃশ্য এক প্রতিজ্ঞার বন্ধনে।

রোহান খুব নিচু গলায়, গভীর চোখে তাকিয়ে বললো,
— “আজ থেকে আমাদের নতুন জীবন শুরু, অহনা।
তুমি আর আমি,দুজন, এক হৃদয়।
এ জীবনের প্রতিটা ভোরে আমি চাই, তুমি আমার পাশে থাকো… শুধু তুমি।”

বাতাসটা যেন হঠাৎ একটু গাঢ় হয়ে এলো, ফুলের গন্ধ মিশে গেল চিরন্তন কোনো ভালোবাসার গল্পে।আর সেই মুহূর্তে, অহনার চোখে একফোঁটা জল জমে উঠলো আনন্দের, পূর্ণতার, ভালোবাসার…

~” ইরফান ও ফাহাদকে একসাথে দেখে রাইসা স্নিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করল,

— “কোথায় ছিলেন আপনারা এতক্ষণ?”

ফাহাদ একটু হেসে উত্তর দিল,
— “ছাদে ছিলাম… কিছু কথা হচ্ছিল ভাইয়ের সাথে।”

ইরফান ঠোঁটের কোণে একটু রসিকতা মেখে বলল,

“আহা, বিয়ের পর দেখি আমার ভাইয়ের বেশ উন্নতি হয়েছে! ছাদে উঠতেও এখন পারমিশন লাগে… তবে হ্যাঁ, বউয়ের অনুমতি নিয়েই যাওয়া ভালো, শান্তি থাকে সংসারে।”

রাইসা হেসে হঠাৎ চোখ টিপে বলল,

“ভাসুর মশাই, আমার প্রিয় বান্ধবীকে কিন্তু রুমে রেখে এসেছি অনেকক্ষণ হলো। একবার গিয়ে দেখে আসুন, রাগে না আবার বোম হয়ে গেছে!”

ইরফান নাটুকে ভঙ্গিতে কপালে হাত রেখে বলল,
— “ভাই, তুই থাক… আমি গিয়ে দেখি, তোর বোনের পরিস্থিতি এখন কেমন!”

ফাহাদ হালকা হেসে মাথা ঝাঁকাল, যেন মেনে নিলো ভাইয়ের কাণ্ড।
আর ইরফান? সদ্যবিবাহিতা নববধূর রাগ ভাঙাতে ব্যাকুল হয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

~” রাইসা হেসে হেসে রুমের দিকে পা বাড়াল। ফাহাদও ছুটে চললো তার পেছন পেছন, যেন হাসিমুখে ছুটে চলেছে তার বহু কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার ঠিকানার দিকে। আজ যেন এতোদিনের চেনা রাইসাকে নতুন করে লাগছে,একেবারে ঘরোয়া, একেবারে তার নিজের। যেন আজই প্রথম রাইসাকে “বউ” বলে ভাবতে পারছে সে।

রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে, ফাহাদ নিঃশব্দে গিয়ে রাইসার পাশে বসে পড়ল। রাইসা তখন আয়নার সামনে বসে চুলে মোটা বেনি বাঁধছিল। তার চুলের ঘন কালো স্রোত যেন নীরবে বয়ে চলছিল রূপকথার কোনো নদীর মতো।

সে মুখ না ঘুরিয়েই বলল,
—”কি জনাব, কিছু বলবেন ?”

ফাহাদ হঠাৎ করেই আবেগে গলা ভার করে বলল,
—”কি বলবো, ম্যাডাম? আজ খুব প্রেম পাচ্ছে মনে । জীবনে প্রথমবার মনে হচ্ছে, কথার কোনো লাগাম নেই আমার মুখে…”

রাইসা লজ্জায় চোখ নামিয়ে আনল। গাল ছুঁয়ে গেল হালকা রক্তিম আভা। ফাহাদ একটু আরেকটু কাছে সরে এলো, তার নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেল রাইসার কাঁধ।

রাইসা তখন বেনি করা চুলটা পেছনে ফেলে দিল । ফাহাদ ধীরে ধীরে মাথা রাখল রাইসার কাঁধে। ভালোবাসার প্রথম স্পর্শে রাইসার সারা দেহে শিহরণ খেলে গেল,একটা অনভিজ্ঞ স্পন্দন, প্রথম ভালোবাসার প্রথম কাঁপুনি।

ফাহাদ নরম স্বরে বলল,
—”জানো রাই , এমন একটা রাতের জন্য আমি কতোদিন ধরে অপেক্ষা করে এসেছি… এমন একটা রাত, যখন আর কোনো দূরত্ব থাকবে না, থাকবে শুধু তুমি আর আমি, আমাদের ছোট্ট পৃথিবীটা।”

রাইসা কোনো কথা বললো না। শুধু চোখ নামিয়ে কাঁধে রাখা ফাহাদের মাথার ওম অনুভব করলো। এই ছিলো তাদের প্রথম অনুভব, প্রথম স্পর্শ, প্রথম ভালোবাসার সাক্ষ্য।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

~” ঘরভর্তি ছিলো মৃদু পারফিউম আর নতুন বিয়ের গন্ধ। ঠিক এমন সময় দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো ইরফান, চোখ তার ছানাবড়া হয়ে গেলো যেনো কেউ চোখের সামনে থেকে চাঁদটা হঠাৎ সরিয়ে দিয়েছে।

— “আমার বউ কোথায়…?”
চিৎকার করে উঠলো সে, কণ্ঠে ভয় আর অস্থিরতার মিশেল।

আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছিলো মাহি। এমন চিৎকারে খোলা আঁতকে উঠে খোলা চুলেই দৌড়ে এলো সে, চোখে-মুখে বিস্ময় আর কণ্ঠে একধরনের কোমলতা।

— “কি হয়েছে ইরফান ভাই…?”
চিন্তিত স্বরে জানতে চাইলো সে।

ইরফান কপাল কুঁচকে তাকালো মাহির দিকে।
— “রেখে গেলাম একদম নতুন বউ, আর রুমে এসে দেখি বউ নেই? এটা আবার কেমন কথা…?”

মাহি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো। বুঝে উঠতে পারছিলো না ইরফান কী বলতে চাইছে। ভ্রু উঁচিয়ে ধীরে ধীরে বললো,
— “মানে…?”

ইরফান এবার সরাসরি তার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
— “তুমি এটা কি পরেছো…?”

মাহি নিচের দিকে তাকালো নিজের পোশাকের দিকে। তারপর মাথা তুলে অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে মৃদু স্বরে বললো,

“কেনো? থ্রিপিস পরেছি তো!”

রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো বাসর রাতের লাজুক সাজসজ্জা—নরম আলো, গোলাপের পাপড়ি, সুগন্ধি মোমবাতি আর আবেশ মাখা নীরবতা। ঠিক সেই মুহূর্তে, ইরফান চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো, যেন বুকের গভীর থেকে জমে থাকা অভিমান আর ভালোবাসা একসাথে বেরিয়ে এলো।

— “আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে… আজকের রাতটা আমাদের প্রথম রাত। আজ তুমি লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে বউ সেজে লজ্জায় কুঁকড়ে থাকবে, আর আমি তোমার সেই লজ্জা ভাঙাবো, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। আর তুমি কিনা! আরাম করে থ্রিপিস পরে আয়নার সামনে বসে আছো? এটা কোনো বউ হওয়ার সাজ হল?”

তার কণ্ঠে মিলেছিলো অভিমানের ছোঁয়া, কিন্তু চোখে ছিলো নিখাদ ভালোবাসা আর একরাশ অপূর্ণ প্রত্যাশা।

মাহি নরম হেসে নিচু স্বরে বললো,
— “বাহ্… শখ কতো,

লাজুক ভঙ্গিতে এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলো সে, কিন্তু কণ্ঠে ছিলো টুকরো খুনসুটি।

ইরফান এবার ভ্রু কিঞ্চিৎ বাকা করে এগিয়ে এলো, চারপাশে চোখ বোলালো,রঙিন পর্দা, ফুলে মোড়ানো খাট, সুবাসিত বালিশ, মৃদু রোমান্টিক সুর…

— “বাসরঘর সাজানো, খাট সাজানো… অথচ বউই নেই!
না, আমি এই বাসর মানি না । বউ ছাড়া এই বাসর অসম্পূর্ণ…!”

~” ইরফানের কথা শেষ হতেই ধীরে ধীরে নিচু স্বরে মাহি বললো,

— “এতো ভারী ভারী গয়না আর লেহেঙ্গা পরে থাকতে ভালো লাগছিলো না। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম… তাই খুলে ফেলেছি সব।”

ইরফান এক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মায়াভরা দুটো চোখ… খোলা চুলগুলো অবাধ্যভাবে কাঁধ ছুঁয়ে, পিঠ ছুঁয়ে চারপাশে ছড়িয়ে আছে। সাজের অনুপস্থিতি মাহির সৌন্দর্যকে আরও সহজ করে তুলেছে,আর সেই সহজতাতেই যেন হারিয়ে গেলো ইরফানের সমস্ত রাগ।

সে এক চিমটি মিষ্টি হাসলো, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক নিয়ে আদুরে গলায় বললো,

“এখন ভালো লাগছে, হুম?”

মাহি চুপচাপ একটু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বললো,

“আচ্ছা ইরফান ভাই, আমি একটা হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছি না। আপনি একটু বুঝিয়ে দিবেন…?”

ইরফান ভুরু তুলে তাকালো। মুহূর্তেই রসিকতার ভঙ্গিতে হালকা হাসিতে বললো,

“তোর কলেজের টিচাররা তাহলে সারাদিন কী শেখায় ক্লাসে? আর তোর প্রাইভেট টিচাররা-ই বা কী করে? যদি বাসর রাতে হাসবেন্ডকে বউকে অংক বোঝাতে হয়—তাহলে তো বিষয়টা চিন্তার!”

মাহি চোখ কুচকে কিছুটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

“আহ! প্লিজ হেয়ালি বাদ দিন তো! কিছু প্রশ্ন মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে গেছে।”

ইরফান এবার আর দুষ্টুমি করলো না। বরং ধীরে ধীরে দু’হাত বাড়িয়ে আলতো করে মাহির হাত ধরলো। তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে খাটে বসিয়ে দিলো। এরপর নিজেও ওর মুখোমুখি হয়ে বসল, যেন ভালোবাসার পাঠশালায় শিক্ষক হয়ে প্রস্তুত।

— “বলুন, মহারাণী। আপনার জটিল প্রশ্নের সমাধান আমি-ই করে দিচ্ছি আজ…”

~” তখন আপনি যে বড় আব্বু কে বললেন কি যেনো শর্তের কথা সেটা কি..?

~” এরই মধ্যে ইরফান চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে একটা ভাবনার ছায়া। তার চোখ যেন দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে,স্মৃতির পাতায়,

~” একটু চুপ থেকে, নিচু স্বরে বললো,
— “আজ না… অন্য কোনো দিন বলবো।”

মাহি চুপ করে ছিলো কিছুক্ষণ। কিন্তু তার হৃদয়ের গভীর থেকে যেন একটা আবেগ উঠতে লাগলো। চোখে ভেসে উঠলো একটুখানি অভিমান, ঠোঁট কাঁপলো হালকা।

~” সে ধীরে ধীরে মুখ তুললো, গলায় একটুখানি অভিমানের মিশেল,

— “না… আজকেই শুনবো। আপনি বলুন।”

~” ইরফান হালকা একটা নিশ্বাস ফেলে গম্ভীর স্বরে বললো,

“তাহলে শোনো…
দেশে ফেরার আগেই আমি বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তোমার আর আমার বিয়ের ব্যাপারে।
ইচ্ছে ছিলো, দেশে ফিরেই তোমায় বিয়ে করে ফেলবো।”

মাহির চোখ ধীরে ধীরে বিস্ময়ে বড় হতে লাগলো। ঠোঁটের কোণ কেঁপে উঠলো, যেন কোনো অজানা স্বপ্ন আচমকা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটুখানি গলা কাঁপিয়ে সে বললো,

— “আপনি… আপনি আমাকে আগে থেকেই ভালোবাসতেন, ইরফান ভাই…?”

ইরফান তাকালো তার চোখের গভীরে, একটুখানি মৃদু হাসি খেলে গেলো মুখে,

“হ্যাঁ।”
একটি শব্দ, কিন্তু তাতে যেন শত সহস্র আবেগ গাঁথা।

মাহি এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, চোখের পাতা জোড়া কাঁপিয়ে বললো,

“কবে থেকে…?”

ইরফান কিছুক্ষণ নীরব, তারপর অতীতের কোনো এক ঘরের কোণ থেকে শব্দ তুলে আনলো,

“অনেক আগেই…”
একটু থেমে কপাল ভাঁজ করলো, চোখে খানিকটা কৌতুক আর আদরের ধমক,

— “কিন্তু তুই এখন এসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে, যা বলছি চুপচাপ শুনবি। নাহলে আমি আর বলবো না…!”

মাহি যেন আঁতকে উঠলো, তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়লো,

— “না না… আমি আর মাঝে বলবো না, আপনি বলুন। আমি শুনছি…”

~” ইরফান একটু থেমে, অতীতের কথা মনে করে মৃদু হাসলো। গলায় আবেগ জমে উঠছে, কণ্ঠটা একটু ভারী হয়ে গেলো।

সে ধীরে ধীরে বললো,

— “বাবাকে বলার পর… বাবা বেশ খুশি হয়েছিলেন। বাবা-মা দুজনেই তোমাকে খুব ভালোবাসেন, জানো?
তবে খুশি হলেও, বাবার মুখে একটুখানি চিন্তার ছাপ ছিলো।
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে, আমায় বলেছিলেন…”

ইরফান একটু থামলো, যেন বাবার সেই কণ্ঠ এখনো কানে বাজছে,
— ‘দেখো ইরফান,
তুমি মাহিকে পছন্দ করো, বিয়ে করতে চাও, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু মাহি মা যেদিন মন থেকে এই বিয়েতে রাজি হবে, সেদিন আমি নিজে তোমাদের বিয়ে দেবো।’

মাহি স্তব্ধ হয়ে শুনছে, চোখে বিস্ময় আর মুগ্ধতা।

ইরফান নরম গলায় বললো,
— “প্রথমে কথাটার মানে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমি।
তখন বাবা ধীরে ধীরে আমায় বুঝিয়ে বললেন…”

তার কণ্ঠে বাবার কথা যেন আরেকবার ফিরে আসে,

— ‘তুমি আগে দেশে এসো।
তারপর তোমার ব্যবহার, তোমার আন্তরিকতায় বোঝাও,তুমি মাহিকে ভালোবাসো।কিন্তু মুখে কিছু বলবে না।যদি মাহি মা নিজে থেকেই একদিন বলে,সে-ও তোমায় ভালোবাসে,
তখন আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়ে দেবো।

~” ইরফান ফোস করে নিশ্বাস ফেলে বলে, তখনো আমি কারণ টা বুঝতে পারি নি। তবে একটু পরে বাবা আরেকটু সুন্দর ভাবে আমায় বুঝিয়ে বলে,

~” জানো বাবা আমিও তোমার মাকে খুব ভালোবেসেই বিয়ে টা করেছিলাম। যদিও বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয় সবার সম্মতি নিয়ে কিন্তু আমি তাকে ছোট থেকেই পছন্দ করতাম। তোমার মা আমার চাচাতো বোন ছিলো, যদিও আপন চাচা না ওর দাদ আমার দাদা ভাই ভাই। বাবা কাকা রা মিলে বিয়ে ঠিক করেছিলেন কিন্তু তোমার মায়ের পছন্দ ছিলো অন্য কেউ।

–” সেটা সে তার বাবার কাছে শিকার করতে পারে নি,আবার তার প্রেমিক ও ছিলো তখন বিদেশে তাই এক প্রকার চাপে পরে বাধ্য হয়ে সে আমাকে বিয়ে করে। বিয়ের পরে সে আমার সাথে ঠিক মতো কথা বলতো না অথচ আমি বুঝতে পারতাম না কেনো?আমি ভাবতাম ছোট মানুষ তাই লজ্জা পায়। মনির এর সাথে ভালো খাতির ছিলো কিন্তু মনির ও তার পছন্দ সম্পর্কে জানতো না।

ইরফানের গলা এবার কেঁপে উঠলো,

“তুমি তখন মাত্র দুই বছর বয়সী।
ঠিক তখনই… তার সেই পুরোনো প্রেমিক ফিরে আসে বিদেশ থেকে।
এবং একদিন…
তোমার মা তোমাকে রেখে, সব কিছু ছেড়ে সেই প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায়।”

— “তখন না, আমি ভেঙে পড়েছিলাম একেবারে।
মনে হয়েছিলো, জীবনের সব আলো নিভে গেছে।
তোমার মা হঠাৎ করে চলে যাওয়ার পর, সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেলো।
তবুও তোমার দেখাশোনার দায়িত্বে রাবেয়া ছিলো,
সে তখন অনেকটা সামলে রেখেছিলো তোমায়।
আর আমি… আমি আর কোনোদিন দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা চিন্তাও করিনি।”

— “ঠিক তখনই, সময়ের পরিক্রমায় এলো আরেক নতুন অধ্যায়।
ফাহাদের জন্মের সময় ঘনিয়ে এসেছে,
রাবেয়া তখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতো।
তখন কাশেম আর মনির মিলে একপ্রকার জোর করেই
আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললো নাজিফার সঙ্গে।”

মাহি নিঃশব্দে শুনছে, যেন প্রতিটি শব্দ তার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে। ইরফানের কণ্ঠ এবার একটু নরম, একটু স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো,

— “নাজিফা…
সে শুধু ঘরে আসেনি,
সে এসে তোমার মায়ের অভাব পূরণ করেছে।
তোমার প্রতি ছিল তার অপার মমতা,
শুধু দায়িত্ব নয়,ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা।”

— “তার মা একদিন তাকে বলেছিলেন,
‘আরেকটা সন্তান নাও।’
তখন সে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেছিলো…
‘আমার একটা ছেলে আছে মা,
আর দ্বিতীয় কোনো সন্তান লাগবে না।
আমি চাই না, আমার ছেলের ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাক।’”

~” ইরফান একটু নিচু স্বরে বললো,

বাবা সেদিন বলেছিলো,

দোষ তোমার মায়ের ছিলো না বাবা দোষ টা আমারই ছিল বিয়ের আগে তার মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল আমি চাই না তুমি ও আমার মতো একি ভুল করো।

~” ঘরের বাতাসে যেন এক মুহূর্তের জন্য ভার জমে উঠলো। এতক্ষণ যে কণ্ঠ ছিলো স্মৃতির ভারে নরম, তা এবার খানিক কঠিন হয়ে উঠলো। ইরফানের চোখে ঝলক দিয়ে উঠলো এক তীব্র অভিমান, এক অদম্য ক্ষোভ,যেটা সে এতদিন ধরে নিজে পুষে রেখেছে।

সে একটুখানি সামনে ঝুঁকে গলা নামিয়ে বললো, কিন্তু তাতে রাগের ঝাঁজ স্পষ্ট,
— “ওই মানুষটা…
সে শুধু আমার বাবার জীবনটা নষ্ট করে যায় নি.? সে আমার জীবনকেও এলোমেলো করে দিয়েছে। আমার বিয়ের সময়টাও বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে।”

তার চোখের পলক কাঁপে, কণ্ঠে ঘন হয়ে জমে থাকা না বলা কষ্ট ফেটে পড়ে,

“নাহলে…
অনেক আগেই আমি তোমাকে আমার করে নিতাম, মাহি।
কোনো বাধা থাকতো না, কোনো অপেক্ষা থাকতো না, আমি তোমায় চিরদিনের জন্য নিজের করে নিতাম।”

~” এরপর ইরফান গভীর মায়াভরা কণ্ঠে বললো,
— “সেদিন থেকে আমার প্রতীক্ষা শুরু…
কবে তুমি এসে বলবে— ‘ভালোবাসি’।
আজ… আমি সফল।
আমি চিরদিনের জন্য তোমাকে নিজের করে পেয়েছি।
আমি ভীষণ খুশি, মাহি…
আমার স্বপ্নচারণীকে আমি বাস্তবে পেয়েছি।
আমার উইকনেস… আমার ভালোবাসা…!”

শেষের কথাগুলো বলতে গিয়েই গলা একটু কেঁপে উঠলো ইরফানের। আবেগ তার কণ্ঠ ছুঁয়ে গিয়েছে, চোখের কোণে জমেছে একটুখানি অদৃশ্য জলরেখা।

মাহি ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে রইলো ইরফানের দিকে, যেন মুহূর্তটাকে হৃদয়ের ফ্রেমে বন্দি করে নিতে চাইছে। তারপর মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো

— “আচ্ছা… উইকনেস মানে তো দুর্বলতা…
তার মানে, আমি আপনার দুর্বলতা?”

ইরফান হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। চোখে ছিলো গর্ব, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মিশেল।

মাহি আবার চোখ নামিয়ে ভাবুক স্বরে বললো,
— “কিন্তু… ‘স্বপ্নচারিণী’ মানে কী?”

ইরফান একটু এগিয়ে এলো, তারপর ধীরে ধীরে মাহির কানের কাছে মুখ নিয়ে,
একটুখানি হিসহিসিয়ে বললো,

“স্বপ্নচারিণী মানে…
স্বপ্নে বিরাজ করা তুমি,
তুমি আমার স্বপ্নের সমস্তটা জুড়ে বিচরণ করো,
তবে এখন থেকে শুধু স্বপ্নেই নয়…
বাস্তবেও।”

মাহির চোখ ভরে উঠলো এক অভূতপূর্ব আলোয়।
এই মুহূর্তে সে শুধুই মেহরিন নূর মাহি নয়,সে হয়ে উঠেছে কারো স্বপ্নের রানি, জীবনের অঙ্গীকার, ভালোবাসার পূর্ণতা।

~” হঠাৎ, ইরফান নিঃশব্দে পকেটে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট একটি চকচকে বক্স বের করলো।
মাহি অবাক হয়ে তাকালো ইরফানের দিকে,তারপর ধীরে ধীরে চোখ গেলো ইরফানের হাতে ধরা বাক্সটির দিকে।

ইরফান তার শান্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে বাক্সটি খুলতেই এক ঝলক আলো ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। একটি নেকলেস,একদম সেই ডিজাইনের!
মাহির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। মুহূর্তেই তার মনে পড়ে গেলো,এটা তো সেই হারিয়ে যাওয়া নেকলেস, যেটা কিছুদিন আগেই কোথাও পড়ে গিয়ে হারিয়ে যায়। যেটার জন্য কত কান্না করেছিলো সে। মায়ের কাছে বায়না করেছিলো, বলেছিলো,”আমার ওই নেকলেসটাই চাই, আর কিছু না।” কিন্তু রাবেয়া বেগম অনেক চেষ্টা করেও সেই মডেলের নেকলেস আর কোনো মার্কেটে খুঁজে পাননি।

মাহি তখন ধীরে ধীরে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলো।

ইরফান তখনই মাহির কাছ থেকে একটি ছবি চেয়ে নিয়েছিলো—যেখানে মাহি পরেছিলো তার প্রিয় সেই নেকলেসটি।মাহির মনে হলো ইরফান ভাই হয়তো অনেক খুজে সেই নেকলেস টি পেয়েছে ।

রাতের নিস্তব্ধতায় সময় যেন থমকে আছে। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো নেমে এসেছে ঘরের ভেতর, যেনো এই মুহূর্তটাকে আলাদা করে ছুঁয়ে রাখার জন্যই।

ইরফান ধীরে ধীরে চকচকে বক্সটা মাহির হাতে তুলে দিলো।
নরম গলায় বলল,

“তোমার সব স্বপ্ন, শখ, আহ্লাদ,সবকিছুর দায়িত্ব আমার।
তোমার শূন্যতার থেকেও বেশি পূর্ণতা দেবো আমি।”

তার কণ্ঠে ছিলো এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, এক চিরন্তন অঙ্গীকারের ছোঁয়া।

মাহি অবাক হয়ে বক্সটা হাতে নিয়ে তাকালো। প্রথমে ভেবেছিলো এটা সেই হারিয়ে যাওয়া নেকলেসটাই। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখে ফুটে উঠলো বিস্ময়ের ছায়া।

না… এটা ঠিক সেই মডেল, ঠিক সেই আকৃতি… কিন্তু!

এই নেকলেসের পাথরগুলো যেন অন্যরকম ঝলমলে, অন্যরকম দীপ্তিময়। সাধারণ পাথরে এমন কাঁপন ধরানো ঝিলিক থাকে না। আলো পড়তেই যেন লক্ষ লক্ষ তারা একসাথে জ্বলে উঠেছে।

এটা কোনো সাধারণ নেকলেস নয়।
এটা ছিলো এক নিখুঁতভাবে কারুকার্য করা হোয়াইট গোল্ড প্ল্যাটিনামের ওপরে বসানো হাই-কোয়ালিটি ডায়মন্ডের নেকলেস। প্রতিটি পাথর ছিলো নিখুঁত কাটের, শীতল ঝকঝকে দীপ্তিতে জ্বলজ্বল করছিলো। মাঝখানে ছিলো একটি ড্রপ শেইপড সলিটেয়ার, যেন একটুকরো চাঁদ এসে ঠাঁই নিয়েছে গলার ঠিক মাঝখানে।

মাহির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। ওর ঠোঁট কেঁপে উঠলো কিছু বলার জন্য, কিন্তু ভাষা যেন আটকে গেলো গলায়।

সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো ইরফানের দিকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,

“ইরফান… এটা তো… এটা তো অনেক দামি…!”

ইরফান একটু এগিয়ে এসে হাতটা রাখলো মাহির হাতের উপর। চোখে এক চিরন্তন প্রশান্তির ছোঁয়া,

—”তুমি দামি… নেকলেস নয়… আমার জীবনের সবচেয়ে দামী অনুভুতি তুমি।

এই নেকলেস তো কেবল এক উপহার মাত্র।

মাহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। চোখে জল, ঠোঁটে কাঁপন, আর হৃদয়ে এক অপূর্ব প্রশান্তি।সে জানে, এই মানুষটা শুধু স্বপ্ন দেখায় না… স্বপ্ন পূরণ করতেও জানে।

~” দুজনের মধ্যে নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা।
কিছু মুহূর্ত শব্দহীন কেটে গেলো, শুধু হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাওয়া যাচ্ছিলো যেন।

মাহি মাথা নিচু করে বসে রইলো, দু’হাতের মাঝে জড়িয়ে রাখা ছোট্ট বাক্সটা।
ইরফান তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে,লাজুক, নরম, আবেগে ভেজা মুখটা যেন আরও কোমল হয়ে উঠেছে আলো-আঁধারের খেলায়।

কিন্তু হঠাৎ,একদম আচমকা, যেন আবেগের বাঁধ ভেঙে গেলো।
মাহির ঠোঁট কেঁপে উঠলো, মুখটা কুঁচকে গেলো শিশুর মতো, আর পরক্ষণেই সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।।

ইরফান এক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
তার হৃদয়ে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো। কী এমন হলো যে এই আনন্দের মুহূর্তে মাহির চোখে অশ্রু…?

সে তাড়াতাড়ি একটু ঝুঁকে এসে কাঁপা গলায় বললো,
—”মাহি…? কি হয়েছে…? কোনো সমস্যা হচ্ছে…?
কোথাও খারাপ লাগছে তোমার…?
তুমি অসুস্থ বোধ করছো…?
বলো না মাহি, প্লিজ, কাঁদছো কেনো তুমি?”

মাহি তখনো কাঁদছে। কান্নার মাঝে দম নিতে নিতে কথা বলার চেষ্টাও করছে, কিন্তু কোনো শব্দ যেন ঠিকভাবে বেরোচ্ছে না।

ইরফান আরও বিচলিত হয়ে মাহির পাশে বসে পড়লো, তার দুই কাঁধে হাত রেখে গভীর কণ্ঠে বললো,
—”আমি আছি তো মাহি… আমি আছি।
তুমি কাঁদো না প্লিজ… আমি তোমার পাশে আছি, সব সময়, সব কষ্টে…
তুমি শুধু বলো কী হয়েছে।”

মাহির কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে চোখ মুছে সে তাকালো ইরফানের দিকে।
চোখ দুটো জলের সমুদ্রে ভিজে একাকার,

~” একটুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ মাহি নিচু গলায় বলে উঠলো,

“কিছুদিন পরেই আমার প্রিটেস্ট পরীক্ষা… অথচ আমি এখনো ঠিকমতো পড়াই শুরু করতে পারিনি।”

—”বিয়েবাড়ির এত হইহুল্লোড়, আত্মীয়স্বজন আসা-যাওয়া, শপিং, অনুষ্ঠান… সব মিলিয়ে ঠিকমতো বই খুলে দেখারও সময় হয়নি। ভেবেছিলাম অহনা আপুর বিয়ের পর পড়ায় মন বসাবো… কিন্তু…”
একটু থেমে চোখ নামিয়ে নিলো সে।

“কিন্তু এখন তো… আমারই বিয়ে হয়ে গেলো…!”

কথাগুলো বলেই নাক টানলো মাহি, চোখে জল জমে উঠেছে।

—”আমি জানি এবার রেজাল্ট ভালো হবে না। পড়া কিছুই ঠিকঠাক হয়নি। নিজেকেই খুব অপরাধী লাগছে …”

ইরফান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হালকা গম্ভীর ভঙ্গিতে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—”মাহি… আজ আমাদের বাসর রাত…!
এটা কি এসব কথা বলার সময়?”

তারপর আর এক মুহূর্ত না ভেবে ইরফান কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিজের সাথেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
—”হায় আল্লাহ! বাসর রাতে বাসর নিয়ে না ভেবে… এক্সাম নিয়ে টেনশন করা বোধহয় শুধু আমার বউয়ের পক্ষেই সম্ভব!”

তার কণ্ঠে ছিলো একরাশ মায়া মেশানো মজা।
একটা ছোট্ট হাসি ফুটে উঠলো ইরফানের ঠোঁটে, আর মাহি তখনও ভেজা চোখে চুপচাপ বসে আছে,

মাহির নীরবতা লক্ষ করে ইরফান ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মাহির মাথায় আলতো করে হাত রাখলো।
তার গলায় নামলো এক আশ্বস্ত কণ্ঠের সুর,

—”মাহি, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়েটা হঠাৎ হয়ে গেছে ঠিক আছে, কিন্তু তোমার স্বপ্নগুলো থেমে যাবে না। আমি তোমার পাশে আছি। তুমি সময় নিয়ে আবার শুরু করো, আমি তোমাকে হেল্প করবো। তুমি চাও তো আমি নোট তৈরি করে দেবো, তোমার জন্য সময় ভাগ করে দেবো, শুধু তুমি হাল ছাড়বে না।”

মাহি তাকালো ইরফানের দিকে,চোখে অশ্রু, কিন্তু ভেতরে যেন একটু আলো ফুটে উঠলো।

ইরফান মৃদু হেসে বললো,
—”তুমি আমার জীবনসঙ্গী, কিন্তু তার আগে তুমি একজন স্বপ্নবাজ মেয়ে।
তোমার স্বপ্ন পূরণে আমি তোমার ছায়া হবো, সঙ্গী হবো, শিক্ষকও হবো দরকার হলে…কিন্তু তুমি হার মানবে না, কেমন?”

~” মাহি আজ প্রথমবার ইরফানের মুখ থেকে অনেকবারই শুনলো,

“তুমি …”

এই শব্দ টা অচেনা নয়, তবুও ইরফান ভাইয়ের কণ্ঠে এটা যেনো অন্যরকম, গভীর, একটু বেশিই আপন।

মাহি খেয়াল করলো ইরফান ভাই আজ নিজেও গুলিয়ে ফেলেছে ‘তুই’ আর ‘তুমি’, মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে তার ভাষার ধরণ।
একবার আদর করে বলছে “তুমি”, পরক্ষণেই চেনা ভঙ্গিতে গলে পড়ছে “তুই” শব্দটায়।
এই ছোট্ট গুলিয়ে যাওয়া শব্দগুলো মাহির হৃদয়ে এক আশ্চর্য উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এই অস্থির, আবেগে মোড়ানো মুহূর্তে হঠাৎই মাহির মধ্যে একরাশ প্রশান্তি খেলে গেলো।এই অস্থিরতার মাঝেই সে খুঁজে পেলো এক আস্থার হাত, এক পরিপূর্ণ নির্ভরতা।ভেতরে ভেতরে যেন কিছু একটার ভার হালকা হয়ে গেলো।মাহির ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক নিঃশব্দ হাসি,নরম, নির্ভেজাল, নিষ্পাপ।

ইরফান সেটা লক্ষ করে শিশুসুলভ বায়নায় বললো,
—”এখন সব কিছু বাদ দিয়ে আমাকে আদর করো…!”

মাহি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নিলো, গাল টকটকে লাল। চোখ নামিয়ে ফেললো সঙ্গে সঙ্গেই।
তবু হৃদয়ের ভিতর ধকধক করে উঠলো এক অজানা অনুভবে।

তার ঠিক পরেই, ইরফান যেন কোন প্রস্তুতিহীন মুহূর্তে আচমকা মাহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।

মাহির পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। শিরায় শিরায় বয়ে গেলো এক অব্যক্ত শিহরণ।কোলের উপর মাথা রাখা ইরফান, চোখ বন্ধ করে প্রশান্ত এক হাসি হেসে আছে।

মাহি থম মেরে রইলো। তার কাঁধের কাছে যেন বাতাস থেমে গেছে। বুকের মধ্যে ঢেউ উঠছে, চুপিচুপি।

ইরফান হঠাৎ করেই গলায় সুর তুলে গেয়ে উঠলো,
সেই চিরচেনা কণ্ঠ, কিন্তু আজকের সুরে ছিলো কিছুটা বেশি কাঁপন, কিছুটা বেশি আকুলতা।চারপাশে নেমে এলো নিস্তব্ধ এক আবেশ, যেনো সময়ও থমকে দাঁড়ালো ইরফানের গানের তালে।

“এলোমেলো মনটাকে,
কি করে কে আর রাখে,
কেন আমি এত করে তোকে চাই…?

পারবো না আমি ছাড়তে তোকে,
পারবো না আমি ভুলতে তোকে,
পারবো না ছেড়ে বাঁচতে তোকে..!
হয়ে যা রাজি একবার…”

প্রতিটি শব্দে যেন বুনে দিচ্ছিলো ইরফান তার হৃদয়ের ব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো,নড়ল না, blink করলো না চোখের পাতাও।ইরফানের কণ্ঠে এমন গান সে আগেও শুনেছে,
তবে আজকের সুরে ছিলো এক অন্যরকম অনুভবের ছায়া,
এক অদ্ভুত প্রশান্তি।

মাহির মনে হচ্ছিলো,
এই গানটা তার জন্যই গাওয়া, এই মুহূর্তটা কেবল তাদের দু’জনের জন্যই লেখা, আর ইরফানের কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন এসে নামছিলো মাহির বুকের ঠিক মাঝখানে।

চলবে………….,