#পারবোনা_আমি_ছাড়তে_তোকে
#লেখনিতে_ইশিতা_ইসলাম
#পর্বঃ ৫২ ( অন্তিম পর্ব)
নরম সকালের আলো জানালার ফাঁক গলে ধীরে ধীরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। হালকা মিষ্টি রোদের সেই কোমল ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙলো মাহির। চোখ মেলে প্রথমেই সে আবিষ্কার করলো নিজেকে ইরফানের উষ্ণ বুকে জড়ানো অবস্থায়। সমস্ত রাত জুড়ে ইরফান তাকে এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছিলো, যেন বুকের বন্ধন একটুও আলগা হলেই মাহি হারিয়ে যাবে কোথাও, মিলিয়ে যাবে দূরের কোনো কুয়াশা ভেজা অরণ্যে।
মাহি নিঃশব্দে শ্বাস ফেললো, বুকের গহীনে কিছু একটার স্পন্দন যেন দপদপ করে উঠলো। ইরফানের হৃদস্পন্দনের তালে নিজের বুকের শব্দ মিশে যাচ্ছে। এক চিলতে ঠান্ডা বাতাস জানালার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তেই গা কেঁপে উঠলো তার। এই মুহূর্তে চারপাশে শুধু নিস্তব্ধতা আর উষ্ণতা,তবে সেই উষ্ণতা যেন তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এক আশ্রয়ের নাম।
মাহি একটু নড়ার চেষ্টা করতেই ইরফানের হাত আরও শক্ত হয়ে এলো তার গলার কাছে, যেন তাকে আগলে রাখার অবচেতনে জন্ম নেওয়া ভয় তাকে ছাড়তে দিচ্ছে না। মাহি থমকে গেলো।
তারপর ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্ক হাতে, যেন কোনো ভঙ্গুর স্বপ্ন ছুঁয়ে যাচ্ছে এমন কোমলতায়, ইরফানের হাত দুটো আলতো করে সরিয়ে নিলো মাহি। বুকের ভেতর হালকা কাঁপন, এক মায়াবী মোহের রেশ টেনে রাখে তাকে,তবুও সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।
~” মাহি ধীরে ধীরে ইরফানের বুক থেকে নিজেকে আলগা করে যখন উঠে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ইরফান চোখ মেলে বললো,
“কোথায় যাচ্ছো… জান?”
শব্দটা শুনেই মাহির পা থমকে গেলো। যেন পরিচিত কারো কণ্ঠে একেবারে অচেনা এক ডাক শুনলো। ইরফান ভাইয়ের মুখে এমন শব্দ? মাহির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠলো।
ইরফানও যেন একটু অবাক, মাহিকে নিশ্চুপ দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
—”কি হলো পাখি… চুপ করে আছো কেন?”
মাহি এবার ঠোঁট একটু বাঁকিয়ে, কপাল কুঁচকে বললো,
“আপনি এসব কবে থেকে বলা শিখলেন, ইরফান ভাই?”
ইরফান হালকা হাসির ছাপ রেখে বললো,
“কি শিখলাম আমি আবার?”
মাহি একটু নড়েচড়ে বললো,
—”এই যে… জান, পাখি! এইসব!”
ইরফান এবার আধো অভিমান, আধো ভালোবাসায় চোখ রাঙিয়ে বললো,
“আমার বউকে আমি জান, পাখি, ময়না, টিয়া,সব বলবো! তাতে সমস্যা কী?”
মাহি এবার খুনসুটির ছলে মুখ টিপে হেসে বললো,
—”কিন্তু আমি তো আপনার চাচাতো বোন… চাচাতো বোনকে কি কেউ এসব বলে?”
ইরফানের চোখ মুখ মুহূর্তেই বদলে গেলো। একটুখানি বিরক্তি নিয়ে বললো,
—”কি বললে তুমি…?”
এই বলতেই না বলতেই মাহি এক দৌড়ে হেসে হেসে পালিয়ে গেলো রুম থেকে। তার হাসির রিনিঝিনি শব্দ যেন ছড়িয়ে পড়লো পুরো ঘরজুড়ে, আর ইরফান উঠে বসে সেই হাসি শুনে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
~” “এই হাসিটা দেখার জন্য ঘুম ভাঙার প্রতিটা সকালকে আমি কতোভাবে কল্পনা করেছি, কতো রাত জেগে শুধু এটাই ভেবেছি…
কতো বছর, কতো ঋতু কেটে গেছে…
তুমি জানো না, মাহি…
তোমার ঘুমভাঙা চোখে ছায়া লাগা এই মিষ্টি হাসিটা দেখার জন্য,
আমি ঠিক কতটা অপেক্ষা করেছি।”
~” রিচুয়াল অনুযায়ী, কাল হয়ে গেছে অহনা আর রোহানের শুভ পরিণয়। আজ সকালে সবাই যাবে ওদের আনতে। যদিও আজই ইরফান আর মাহির বৌভাত, কিন্তু বাড়ির সকলের আগে কাজ অহনাকে নিয়ে আসা। এরপর রাতের আয়োজনে চৌধুরী বাড়ি হয়ে উঠবে আনন্দ আর উজ্জ্বলতায় ভরপুর, ইরফান আর মাহির নতুন জীবনের শুভকামনায়।
বাড়ির তিন কর্তা আর অহনার বাবা ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েছেন বাজারের দিকে। আজ তো আর সাধারণ কোনো দিন নয়,অহনার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছাতে হবে বড় মাছ, দুধ আর মিষ্টি আরো বিভিন্ন আয়োজন নিয়ে।
সকাল থেকে ইরফান কয়েকবার ফোন দিয়েছে সাব্বির আর নিরবকে, অবশেষে ওরা এসে হাজির। তবে, কথা ছিল রিয়াও আসবে, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সে আর আসতে পারেনি। এতে মাহি আর রাইসার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলেও, পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার ছাড়া উপায় ছিল না।
তাই ওরা তিনজন,মাহি, রাইসা আর, ফাইজা,রেডি হয়ে নিয়েছে একসাথে। আজ ফাইজাকে সাজিয়েছে মাহি, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে নরম গোলাপি ছোঁয়া,সব মিলিয়ে যেন এক অপূর্ণ সুন্দরতা পূর্ণতায় রূপ নিলো। আর মাহিকে আজ সাজিয়েছে রাইসা নিজ হাতে
,সাবধানে চুল গুছিয়ে, জড়ানো শাড়ির ভাঁজে মুগ্ধতা আর ভালোবাসা বুনে দিয়েছে সে।
আজকের দিনে তার বান্ধবীকে চাই একেবারে নিখুঁত বউয়ের রূপে,যাতে তার ভাসুর মশাই , একটুও চোখ ফেরাতে না পারেন।
~” বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি চোখ ধাঁধানো সাজানো বাইক,একেকটা যেন নিজস্ব সৌন্দর্যে, গর্বে ও উত্তেজনায় প্রস্তুত এক নতুন যাত্রার সাক্ষী হতে। তবে তাদের মধ্যেও একটি বাইক যেন সমস্ত নজর কাড়ে,কালো রঙের সেই ঝকঝকে মেশিনটা, যার প্রতিটি কোণা মুড়ে রাখা হয়েছে সতেজ কাঁচা ফুলে, সুগন্ধ আর স্পর্শে যার শরীর জেগে উঠেছে নতুন জীবনের মতো।
এই বাইকটি বিশেষ ভাবে সাজানো, একটা আলাদা ভালোবাসা আর যত্নে গড়া। কারণ এটা ইরফানের। আর আজকের দিনের জন্য এটাই তার মাহির জন্য সাজানো রাজসিংহাসন।
সকলে মিলে ঠিক করেছে,আজ বাইক রাইডেই হবে অহনার শ্বশুরবাড়ি যাত্রা। একদিকে রোমাঞ্চ, অন্যদিকে আনন্দে ভরা এই যাত্রা যেন এক ছোট্ট মিছিল।
সাব্বির ও নিরব যাবে একসাথে,
রাইসা থাকবে ফাহাদের পাশে, আর পেছনে বসবে ফাইজা,তিনজন মিলে একটা গুঞ্জনময় দল।
আর ঠিক সামনের সাড়ি তে থাকবে ইরফানের কালো বাইকটা,তার হ্যান্ডেলে জড়ানো জুঁই আর গাঁদা ফুলের মালা যেন প্রতিটি বাতাসে ঘোষণা দিচ্ছে, আজকের দিনটি শুধু তাদের দু’জনের জন্য।
~” চৌধুরী বাড়ির প্রাঙ্গণে তখন হাসি-আনন্দ আর প্রস্তুতির গুঞ্জন। রাইসা আর ফাইজা এসে দাঁড়িয়েছে সবার সামনে,দুজনেই যেন আজ রূপে আলো করে রেখেছে চারপাশ। কিন্তু তখনও মাহি আসেনি সকলে মাহির জন্য অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ করেই ঘরের দোরগোড়া পেরিয়ে বেরিয়ে এলো মাহি। শাড়ির কুচি হাতে তুলে সামলে নিচ্ছে, একেকটি পা যেন পদ্মপাতায় রাখা জলের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। তার পরনে গোলাপি রঙের ঝলমলে শাড়ি, কাঁধে ঝরে পড়া নরম চুল, কপালে সুনিপুণ টিপ আর মুখজুড়ে এক অদ্ভুত কোমলতা। দুধে-আলতা গায়ের রঙে আজ মাহি যেন বাস্তবের কোনো কবিতার পাতায় লেখা এক সজীব উপমা।
ঠিক সেই মুহূর্তে, ভিড়ের ফাঁক গলে ইরফানের চোখ গিয়ে পড়ে মাহির ওপর। থমকে যায় সময়, নীরব হয়ে যায় চারপাশের শব্দ। যেন পৃথিবীর সমস্ত আলো ঠিক তখনই এসে পড়েছে সেই একটি মুখের ওপর। ইরফান বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, চোখের পলক ফেলতেও ভুলে যায়। তার হৃদয়ের ভিতরটায় যেন কিছু একটা আলতো করে নড়ে ওঠে।
ফাহাদ দূর থেকে সব লক্ষ করে এগিয়ে এসে ইরফানের কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে দাঁড়ায়। মুখে এক চঞ্চল হাসি, কণ্ঠে রসিকতার সুর,
“ভাইয়া, আপনি কি ঠিক আছেন? বাইক চালাতে পারবেন তো? না কি গাড়ির ব্যবস্থা করি?”
ইরফান যেন হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসে। কাশি দিয়ে সামান্য গলা পরিষ্কার করে বললো,
“বাইক চালাতে পারবো না কেনো?”
ফাহাদ এবার আরেকটু দুষ্টু ভঙ্গিতে হেসে বললো,
“না মানে… তুমি তো আমার বোনকে দেখে একেবারে ফিদা হয়ে আছো ! এই ঘোরে তো মনে হয় স্টিয়ারিং ছাড়াও পথ চলবেন। আর বাইক চালাতে এনার্জি থাকবে বলেও তো মনে হয় না।”
ইরফান এবার এক হাত পকেটে গুঁজে নিয়ে ঠোঁটের কোণে এক আত্মবিশ্বাসী হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“তোর বোনকে কোলে তুলে নিয়ে গেলেও আমার ফুল স্পিডে এনার্জি থাকবে। এটা… অন্য রকম পাওয়ার, ভাই। তুই ছোট মানুষ বুঝবি না।”
~” ফাহাদ একটু দুষ্টুমির ভঙ্গিতে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল,
“কী হে! আমি ছোট বলেই ভাবলে যা খুশি বলবা? শোনো ভাইয়া… তুমি ভুলে যেও না, আমি কিন্তু তোমার সমন্ধী।”সম্পর্কে তোমার থেকে বড় আমি। তার চোখেমুখে অভিমান মেশানো একরকম আদুরে আত্মবিশ্বাস।
ইরফান ঠোঁট কামড়ে মৃদু হাসি হেসে জবাব দিল,
“সমন্ধী… সমন্ধীর মতোই থাকো। ছোট বোন আর তার জামাইয়ের রোমান্টিক সিনে নজর দেওয়া বারণ।
ইরফানের তির্যক ইঙ্গিত, আবার তাতে ঝরে পড়ল হৃদয়ের নির্ভেজাল খুনসুটি।
ফাহাদ এবার একটু গম্ভীর গলায়, যেন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
“আজ তোমার কপাল ভালো ভাইয়া, আমার একখানা সমন্ধী নেই… না হলে দেখিয়ে দিতাম, কীভাবে সমন্ধীকে সন্মান দিতে হয়, আর কেমন করে সেবা করতে হয়!”
ফাহাদের কথা শুনে ইরফান হেসে ফেলল। সেই নিখুঁত হাসি,যেটা একাধারে তীক্ষ্ণ আবার কোমল, যার তলায় লুকানো থাকে অনুরাগের গভীর স্রোত। তার হাসিতে ফাহাদের মুখেও প্রশান্তির রেখা ছড়িয়ে গেল। দুই ভাইয়ের চোখাচোখি আর হাসির ভেতর দিয়ে যেন বহু পুরোনো বন্ধনের এক টুকরো দৃশ্য জীবন্ত হয়ে উঠল।
ঠিক এমন মুহুর্তে, স্নিগ্ধ অথচ ধীর পদক্ষেপে, শাড়ির আচল সামলে ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল মাহি।
~” মাহির সেই ঝিলমিল শাড়িতে, দুধে আলতা রঙে মোড়া মুখখানি যেন ইরফানের নিঃশ্বাস আটকে দেয়।
চোখদুটো কেমন নেশায় ঝিমিয়ে আসে…
হৃদয়ে কোথা থেকে যেন আবেগের এক নিরব ঝর্ণা বয়ে যায়, যা বাইরের কোনো কোলাহল ছুঁতে পারে না।
চারপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে, হাসি, গল্প আর উৎসবের রঙে মেতে আছে সবাই,কিন্তু ইরফানের দৃষ্টি আটকে আছে একমাত্র মাহির দিকেই।
নিজের মনেই ফিসফিস করে উঠল ইরফান,
“উফ্… কপাল খারাপ আমার…!
এতো মানুষের ভিড়ে আটকে আছি বলে বউটাকে এখনো গপাগপ দুই-চারটা চুমু খেতে পারছিনা …!”
~” মাহি আরেকটু এগিয়ে আসলে, ইরফান হেলমেটটা হাতে তুলে নিয়ে মাহির দিকে তাকায়,চোখে প্রখর ভালোবাসা , ঠোঁটে এক চঞ্চল হাসি। মাহি একটু হেসে মাথা নিচু করে। রাইসা একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “আজ তোকে একেবারে সিনেমার নায়িকা লাগছে।”
মাহি লাজুক হেসে, চুপচাপ ইরফানের বাইকে উঠে বসে। ইরফানের কাঁধে হাত রাখতেই যেন মুহূর্তটা থমকে যায়,পেছনে ফেলে আসা হাজার অভিমান, কষ্ট, প্রেম, চাওয়া-পাওয়ার সব হিসেব যেন এই যাত্রার প্রথম স্টার্টিং সাউন্ডে মিলিয়ে যায়।
বাইক স্টার্ট দিতেই বাতাস কাঁপে, ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে
~” বাইক থামলো রোহান দের বাসার গেইট এর সামনে, বাড়ির বড় রা সকলে গাড়ি তে এসেছে আর বাকি সবাই বাইকে।
–“ফটক খুলতেই যেন উঁকি দিল এক উৎসবমুখর পরিবেশ। চারপাশে আলোকসজ্জা, সাজসাজ রব, আর সেই সঙ্গে গেট থেকে শুরু করে বাড়ির উঠোন অবধি ছড়িয়ে রয়েছে নানা রঙের ফুল আর টিনসেলের লালচে ঝিলিক। ভিতরে পা রাখতেই দেখা গেল, রোহানদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত। হাসি-আনন্দ আর পরিচিত কণ্ঠস্বরের ভিড়ে মুহূর্তেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো পরিবেশ।
এদিকে রোহানদের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত বড়রা, অন্যদিকে মাহি, রাইসা আর ফাইজা এক দৃষ্টিতে খুঁজতে লাগলো অহনাকে। কখনো এই ঘরে, কখনো সেই ঘরে উঁকি দিচ্ছে তারা।
~” এক তলা বিশিষ্ট ছাদ দেওয়া উঁচু ছাউনির নিচে বড় বড় ঘর যেন একে একে খুলে দিচ্ছে তাদের জৌলুশ। চকচকে সাদা দামি টাইলস, সাজানো আসবাব, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ,সব মিলিয়ে বাড়িটি যেন রুচির ছাপ রেখে গড়ে তোলা এক পরিপাটি স্থাপত্য।
~” প্রান্তের এক রুমে দেখা মিললো অহনার সুন্দর শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে বসে আছে অহনা,
মাহি, রাইসা ও ফাইজা যখন দরজার কাছে এসে পৌঁছালো, অহনার মুখখানা মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। চোখের কোণে চিকচিক করলো আনন্দের ঝিলিক।মাহি যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, ছুটে গিয়ে একটানে জড়িয়ে ধরলো অহনা আপুকে।
“অহনা আপু…!”
~” রাইসা আর ফাইজা হাসিমুখে এসে পাশে দাঁড়াতেই শুরু হয়ে গেলো চারজনের কথার মিছিল। নানা কথা মিলিয়ে চললো মিষ্টি গল্প, গায়ে গায়ে ঠেলে উঠলো নরম হাসি আর উচ্ছ্বাসের ঢেউ।
ঠিক তখনই হঠাৎ ফাইজার মুখে এক টুকরো বিষ্ময়, যেন হালকা কোনো অস্থিরতা ভেসে উঠলো চোখে।
সে এক মুহূর্তে হাত দিয়ে কানের দিকটা ছুঁয়ে দেখলো,ডান কানে দুল নেই।আচমকা দাঁড়িয়ে উঠে আরেকবার নিশ্চিত হলো,না, সত্যিই নেই।
“আমার এক কান থেকে দুল পড়ে গেছে!”
কণ্ঠে কিছুটা অস্থিরতা, বাকিরাও চমকে উঠলো।
মাহি একটু নরম স্বরে বললো, রাস্তায় কোথাও পড়ে যায় নি তো.?
ফাইজা মনে করতে চেষ্টা করলো,বাইকে নামার সময়ও তো দুটো দুলই ছিল! স্পষ্ট মনে আছে, রোহানের বাড়ির গেট পার হওয়ার পরেও অনুভব করেছিল দুটো দুলের ভার। তাহলে এখন হঠাৎ করে একটার হদিস নেই কেন?
~” ফাইজা হালকা হলেও স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললো,
“না না, রাস্তায় নয়… সম্ভবত এখানেই কোথাও পড়েছে। তোমরা বসো, আমি একটু বাইরে গিয়ে দেখি, যেদিক দিয়ে এসেছি, সেই পথেই খুঁজে দেখি,মিলেও যেতে পারে।”
মাহির কণ্ঠে চিন্তার আভা, তবুও সাবধানে বললো,
—“আমি কি তোর সাথে আসবো ফাইজা?”
ফাইজা মাথা নেড়ে মৃদু হাসিতে বললো,
—“না আপু, তোমরা থাকো। আমি এই গেলাম, এই এসেও পড়বো।”
মাহি একটুখানি দ্বিধা নিয়ে চোখে সম্মতির ইঙ্গিত দিতেই,
ফাইজা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
~” অনেকটা পথ ধরে এদিক ওদিক খুঁজেও যখন হারিয়ে যাওয়া দুলটির কোনো হদিস পেলো না, তখন হালকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফাইজা আবার ফিরে চললো অহনার রুমের দিকে।
হঠাৎ করেই, এক মোড় ঘুরতেই, ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো রবিন,একদম অপ্রস্তুত অবস্থায় ফাইজার পথ আটকে।ফাইজার পা থেমে গেল।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে সে মৃদু হেসে বললো,
“আরে! রবিন ভাই, আপনি!”
মুখে ‘ভাই’ শব্দটি শুনে রবিনের চোখেমুখে যেন একটু অস্পষ্ট অস্বস্তির ছায়া নেমে এলো। ভেতরে জমে থাকা হালকা প্রেমানুভূতির ফুলটা যেন হঠাৎ করেই শুকিয়ে যেতে লাগলো।
কিছুটা কৌশলেই নাক কুঁচকে, আধো হেসে রবিন বললো,
“বেয়াইকে কিন্তু ভাই বলে ডাকতে নেই, জানো তো?”
ফাইজা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“তাহলে কী ডাকতে হয়? মামা…?”
~” রবিন একটু হেসে ফাইজার দিকে তাকালো, কিন্তু ফাইজা তখনও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চুলটা কানের পেছনে সরিয়ে ঠোঁটের কোণে এক আলগা হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
~” রবিন ফাইজার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিল, তারপর মনে মনে আপনমনে বিড়বিড় করে বললো,
“সুন্দরীরা বোকা হয়,এই ধারণা কে যে ছড়িয়েছিল, বড্ড ভুল করেছিল। ওদের চালাকি তো এমন নিঃশব্দে কাজ করে, কেউ টেরই পায় না কবে কে কাকে হারিয়ে দিল!”
~” ফাইজা আচমকা এক হাত নেড়ে রবিনের দৃষ্টি ফেরালো বাস্তবে। ভাবনার ঘোর কাটতেই রবিন খানিকটা হকচকিয়ে উঠলো, তারপর নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে হালকা হেসে বললো,
“দেখো, নাম ধরে ডাকবা বুঝছো! আমি একটু ভিন্ন ধরনের মানুষ… কেউ অন্য নামে ডাকলে বুঝতেই পারি না, আসলে আমাকেই ডাকা হচ্ছে কিনা। তাই ‘রবিন’ বললেই ভালো, হ্যাঁ?”
ফাইজা একপলক তাকিয়ে থেকে ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করলো, ঠোঁটে এক তীর্যক হাসি নিয়ে বললো,
“না, আমি আবার এতটাও বেয়াদব না যে বড়দের নাম ধরে ডাকবো। ডাকতেই হলে,রবিন ভাই’ বলেই ডাকবো।”
ফাইজার কথার মধ্যে একরাশ সংযম, আবার যেন সূক্ষ্ম কটাক্ষের ছোঁয়া।
রবিন চোখের পলকে একরকম হেরে গিয়ে দীর্ঘ ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো, আবার মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলো,
“বাহ, বউ তো এমনই হওয়া উচিত …আসলেই ছোট মরিচে ঝাল বেশি।”
~” রবিন কিছু না বলে এক দম্পত হেসে সামনে এগিয়ে গেল, কিন্তু চোখের কোণে ছিলো একরাশ দুষ্টু মায়া,যেন কথার খেলায় হেরে গিয়ে মনের খেলাটা নতুন করে শুরু করতে চাইছে।
ফাইজা হালকা মাথা নাড়িয়ে আবার দু’পা এগিয়ে গেলো সামনে। চোখ গেলো করিডোরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নিরব ভাইয়ের দিকে,এক হাতে ফোন কানে, অন্য হাতে খেলাচ্ছলে ঘোরাচ্ছেন একটা ঝুমকো দুল।
এক পলক দেখে ফাইজার চোখের পাতা কেঁপে উঠলো,ওটাই তো তার হারিয়ে যাওয়া ঝুমকো!দ্রুত পা বাড়িয়ে নিরবের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, ফাইজা নিরবের হাত থেকে দুলটি নিতে চাইল।
ঠিক তখনই নিরব ফোনটা কেটে রাখলো, দৃষ্টিটা ফাইজার দিকে স্থির হয়ে গেলো,চোখে বিস্ময়ের রেখা, কণ্ঠে রুক্ষতা।
—“এই পিচ্চি মেয়ে! এটা তোমার খেলার জিনিস না,কারো প্রয়োজনীয়, মূল্যবান জিনিস!”
ফাইজা বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
—“তা শুনি, এটা কার মূল্যবান জিনিস?”
নিরব ঠোঁট উল্টে, কণ্ঠে একরাশ অনাগ্রহ মিশিয়ে জবাব দিলো,
—“জানি না কার… তবে তাকেই খুঁজছি।”
ফাইজা এবার একটু চুপ থেকে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
—“এটা আমার।”
নিরব ভ্রু নাচিয়ে ঠোঁটের কোণে এক ধরণের দুষ্টু হাসি টেনে মজার ছলে বললো,
—“মিথ্যে বলছো না তো? নাকি ঝুমকোটা পেয়ে খেলার ছলে নিয়ে যাচ্ছো?”
ফাইজা একটু বিরক্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়াতে যাচ্ছিলো, প্রতিবাদ করার ঠিক আগমুহূর্তেই হঠাৎ রবিন এসে পাশে দাঁড়ালো।
সে নিরবের দিকে একরাশ বিনয়ের ভঙ্গিতে এগিয়ে বললো,
—“কেমন আছেন ভাই?”
নিরব শান্ত, ঠান্ডা গলায় ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
—“ভালো। তুমি কেমন?”
রবিন হালকা মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
দুজনের কথোপকথনের মাঝখানে ফাইজা দাঁড়িয়ে রইলো, চোখে একরাশ বিরক্তির ছায়া।
~” একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফাইজা যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, হঠাৎ করেই বলে উঠলো,
“আমার ঝুমকোটা দিন।”
তার স্বরটা ছিল নরম অথচ তীক্ষ্ণ, চোখে একধরনের অভিমান মেশানো হতাশা।
রবিন ধীরে ঘুরে তাকালো তার দিকে। চুপচাপ। কিছু না বলে, এক চিলতে চোখে তাকিয়ে রইলো ফাইজার দিকে। যেন সেই চাহনির আড়ালে বহু না-বলা প্রশ্ন জমে আছে।
নিরব একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে হালকা হাসিতে বলে উঠলো,
— “এটা যে তোমার, আমি কিভাবে বুঝবো?”
ফাইজা এবার আর দেরি করলো না। হাত দিয়ে কানের পাশের চুলগুলো সরিয়ে দিলো, যেন প্রমাণ হাজির করতে চায়,
“এই যে দেখুন, এটার জোড়া ওইটা।”
তার সাদা ধপধপে ঘাড়টা যেন হঠাৎ করেই উন্মুক্ত হয়ে উঠলো, সূর্যের আলোয় মথিত, কাচের মতো স্বচ্ছ। রবিন একঝলক তাকালো সেই দিকটায়, চোখে এক অদ্ভুত স্থিরতা। যেন মুহূর্তের মধ্যেই সময় থেমে গেলো।
কিন্তু নিরব চোখ সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,
“আরে আরে! মজা করলাম। রাখো তোমার ঝুমকো। তবে সাবধান রেখো পরের বার, পিচ্চি মানুষ! এভাবে জিনিস হারিয়ে ফেললে চলবে?”
তার কণ্ঠে হাসি ছিল, কিন্তু চোখে একরকম নিষ্ঠুর দূরত্ব।
ফাইজা কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থাকলেও, পিচ্চি মানুষ এই ডাকটা কানে যেতেই মুখটা কুচকে গেল তার।রবিনের ঠোঁটের কোণে তখন এক দমকা হাসি খেলে গেল,ছোট্ট, চাপা, কিন্তু অর্থপূর্ণ।
দু’জনের দিকে একবার তাকিয়ে ফাইজা মুখটা একটু বাঁকিয়ে একরকম অভিমানে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো। তার পায়ের শব্দ যেন ঘরের নিস্তব্ধতাকে চিড়ে এগিয়ে চললো দূর থেকে আরও দূরে।
নিরব কিন্তু সেদিকে একবারও তাকালো না। সে তখনও ফোনের স্ক্রিনে ব্যস্ত,
আর রবিন?সে তাকিয়ে রইলো… গভীর এক দৃষ্টিতে, আবেগ আর বিস্ময়ে মেশানো দৃষ্টিতে ফাইজার পেছন চলে যাওয়ার দিকে। তার চোখ যেন বলছে, একবার পেছন ফিরে তাকাও প্লিজ,কিন্তু ফাইজা একবারের জন্য ও ঘুরে তাকালো না।
.
.
.
.
.
.
.
.
বিকেলের শেষ আলোয় সকলে রোহান আর অহনা কে নিয়ে ফিরলো বাসায়,হাসি-খুশিতে ভরা একধরনের ক্লান্তি যেন গায়ে মেখে।
সন্ধ্যার আগেই চৌধুরী বাড়ি রঙিন হয়ে উঠলো,ঝিকিমিকি আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠলো, কানায় কানায় ভরে উঠলো হাসি, কোলাহল, আর অভ্যর্থনার গুঞ্জন।
চৌধুরী বাড়ি যেন এই সন্ধ্যায় হয়ে উঠলো আলোয় মোড়ানো কোনো এক উৎসবের দীপ্ত সৌধ।
তবে আনন্দের মধ্যেও মাহবুবা বেগম একটু গ্লানিভরা শারীরিক অবস্থা নিয়ে চুপচাপ বসেছিলেন। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা শরীরটায় এমন অবসাদ আসাই স্বাভাবিক, তবুও মনির চৌধুরীর কপালে ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল।
বাড়ির আনন্দ যত বড়ই হোক, স্ত্রীকে নিয়ে তার চিন্তার কমতি ছিল না।
সন্ধ্যার আগেই গাড়ি নিয়ে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন মাহবুবা বেগমকে চিকিৎসকের কাছে,মাহবুবা বেগমের এই সময়ে মনির চৌধুরীর যত্ন, আর দায়িত্ব যেন আরো বেড়ে গিয়েছে।
অন্যদিকে, ঘরভর্তি আনন্দ।
দুই জোড়া নবদম্পতি বসে আছে সাজানো স্টেজে।
এক পাশে রোহান আর অহনা, মনে হাজারো খুশি নিয়ে বসে আছে,
অন্যদিকে ইরফান ও মাহি, ইরফানের চোখে এক গভীর আলো, যা বলে দেয়, এ শুধু নতুন বিয়ের উল্লাস নয়, দীর্ঘ প্রতীক্ষারও পরিণতি।
আত্মীয়-স্বজনেরা এসে নতুন বউদের দেখতে দেখতে হেসে উঠছে, প্রশ্ন করছে, কথা বলছে, বউদের হাতে গুঁজে দিচ্ছে সালামি, হাতে তুলে দেওয়া খামগুলোতে যেন আশীর্বাদের মিহি ছোঁয়া।
~” রাইসা তখন স্টেজের দিকে এগোচ্ছে, এক হাতে শাড়ির কুচি সামলাতে সামলাতে পা ফেলছে করিডোরে। হঠাৎই শাড়ির ভাঁজে পা আটকে গেলো তার,এক পা হড়কালো, পড়ে যাওয়ার ঠিক মুহূর্তে কেউ যেন তাকে আঁকড়ে ধরলো।
ফাহাদ।
আচমকা টেনে ধরে তাকে নিজের বাহুর মাঝে সামলে নিলো সে।
রাইসা থমকে গেল, এক পলক তাকিয়ে রইলো ফাহাদের দিকে,
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো সে।
ফাহাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
— “সাবধানে চলবে তো রাই? এক্ষুনি পড়ে যাচ্ছিলে !”
কথা শেষ করেই সে নিচু হয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল, শাড়ির কুচির ভাঁজ গুছিয়ে দিলো নিখুঁত যত্নে, তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো।
রাইসা কিছু বললো না, শুধু একটুখানি হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে,নীরব, লাজুক।
ফাহাদও যেন কিছু একটা বলতে চাইলো, আর এক কদম এগিয়ে এল। হাতটা এগিয়ে এল রাইসার কোমরের দিকে, ঠিক তখনই,
সেখানে উপস্থিত হলো ফাইজা।
হঠাৎ এই দৃশ্য দেখে সে এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিয়ে হেসে হেসে বললো,
— “আমি কি তাহলে ভিতরে চলে যাবো ভাইয়া?”
ফাহাদ মুহূর্তেই অপ্রস্তুত। চোখ নামিয়ে নিলো, হাত সরিয়ে নিলো রাইসার কাছ থেকে, রাইসার গালজোড়া লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়, সে চোখ নামিয়ে নিলো নিচে।
ফাইজা হালকা হেসে বুঝিয়ে দিলো, সে এই দৃশ্য দেখে বিরক্ত হয়নি, বরং মিষ্টি কিছু দেখে ফেলেছে অকস্মাৎ।
তারপর তিনজনেই ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো স্টেজের সামনে,
~” হঠাৎ করেই আনন্দ-উল্লাস, কথার কোলাহল, আলো-ঝলমলে মুহূর্তগুলোর মাঝেও ইরফানের ভেতরটা ছটফটিয়ে উঠলো। ভীড়ের মধ্যেও তার চোখে ধরা পড়লো,মাহির চোখে এক অদ্ভুত ক্লান্তির ছাপ, মুখে যেন এক চাপা অস্বস্তি।
সে আর থেমে থাকতে পারলো না। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— কি ব্যাপার উইকনেস, কোনো সমস্যা ? এমন কেনো লাগছে তোমার? কোথাও কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”
মাহি প্রথমে মুখ ফিরিয়ে নিলো, যেন প্রশ্নটা উপেক্ষা করতেই চাইলো। তবে ইরফান তো সহজে হাল ছাড়ার মানুষ নয়। তার গলার সুরে একরকম জেদ মিশে ছিল, আদরের মতো চাপা উদ্বেগ।
চোখে চোখ রেখে আবার বলল,
— “মাহি, আমাকে বলো । কিছুতো সমস্যা অবশ্যই হচ্ছে ।”
মাহি এবার আর না বলে থাকতে পারলো না। ক্লান্ত চোখে তাকালো ইরফানের দিকে, এক মুহূর্ত চুপ থেকে মুখ ফুটেই বললো,
— “ভালো লাগছে না শরীরটা… খুব দুর্বল লাগছে। মাথাটা ভারী হয়ে আছে।
“কথা টা কানে যেতেই ইরফানের ভেতরটা মুহূর্তেই যেন কেঁপে উঠলো। উৎসবের সব শব্দ তখন তার কানে ধ্বনির মতো হয়ে গেলো—বেসুরো, অপ্রয়োজনীয়। সে শুধু তাকিয়ে রইলো মাহির দিকে,
চারপাশ তখনও মুখরিত আলো আর শব্দের উৎসবে। হঠাৎ করেই সবার অগোচরে, একরকম আচমকাই ইরফান এগিয়ে এলো, মাহির সামনে দাঁড়িয়ে, তাকে একঝটকায় কোলে তুলে নিলো।
চারদিকে মুহূর্তেই সবার চোখ ঘুরে এলো তাদের দিকে। বিস্ময়ে, কৌতূহলে,বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো সবাই। মুহূর্তেই যেন নিস্তব্ধতা নেমে এলো চারপাশে।
মাহি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। তার মুখে হালকা আতঙ্ক, চোখে একরাশ লজ্জা। সে মিনতির সুরে ফিসফিস করে বললো,
“এই… কী করছেন আপনি? নামান আমাকে… সবাই দেখছে…”
ইরফানের কণ্ঠে তখন অদ্ভুত নির্লিপ্ত অথচ গম্ভীর এক সুর,
“দেখুক না, তাতে আমার কী? আমি আমার বউকে কোলে তুলেছি, অন্য কাউকে না।”
মাহি এবার আরও একটু আঁকড়ে ধরলো ইরফানের কাঁধ, গলার স্বর কাঁপছিল,
“পড়ে যাবো… প্লিজ, নামান…”
ইরফানের চোখে তখন একধরনের অপরাধবোধহীন ভালোবাসা মিশ্রিত উন্মাদ জেদ। ভ্রু দু’টো কুঁচকে এলো, সে ঝুঁকে মুখটা মাহির কানের কাছে নিলো। তার গরম নিশ্বাস ছুঁয়ে গেল মাহির ঘাড়। মাহির শরীর কেঁপে উঠলো অনাহুত শিহরণে।
ফিসফিস করে ইরফান বলল,
— “প্রথম যেদিন তোমায় কোলে তুলেছিলাম, সেদিনই বলেছিলাম… উপর আল্লাহ ছাড়া এই হাত থেকে তোমায় কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তুমি ভুলে গিয়েছো মাহি… দুর্বলতা শুধু শরীরে না, মনের ভিতরও হয়। কিন্তু আমার মন এখনো শক্ত… আর তুমিই আমার শক্তি।”
~” ফাহাদ খানিকটা ছুটোছুটি করে, নিঃশ্বাসে অস্থিরতা নিয়ে এগিয়ে এলো। চোখে স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ, কণ্ঠে হালকা কাঁপুনি
“কি হয়েছে ভাইয়া? বোনের কি হয়েছে?”
মাহি তখন যেন একপ্রকার লজ্জা ও ক্লান্তির ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মাথাটা গুঁজে রেখেছে ইরফানের বুকের মাঝে।
ইরফান এক হাতে মাহির পিঠে স্নেহের ছোঁয়া দিয়ে ফাহাদকে শান্ত কণ্ঠে বললো,
“ক্লান্ত হয়েছে খুব… শরীরটাও একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা রোহান এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলো,
“ডাক্তার ডাকি…?”
মাহি তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে নিষেধ জানায়, । এরপর ইরফানের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে খুব আস্তে, কেবলমাত্র তার শোনা যায় এমন ফিসফিসে স্বরে বললো,
“একটু শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে… ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন নেই। ”
ইরফান চোখে দুষ্টুমি ঝলক নিয়ে রোহানের দিকে ফিরলো। মুখে একরাশ নিঃসংকোচ হাসি,
“বউ বলছে ওর ‘স্পেশাল ট্রিটমেন্ট’ দরকার… ওইসব ডাক্তার-বদ্যি দিয়ে হবে না ভাই। আমরা তাহলে একটু যাই…”
এই বলে সে মাহিকে আরো শক্ত করে ধরে আগলে নিয়ে ঘরের ভেতরে পা বাড়ালো।
ইরফানের নির্লজ্জ মন্তব্যে মাহির গালদুটো লাল হয়ে উঠলো, কানের পাশে যেন লজ্জার ধোঁয়া উঠছে ধীরে ধীরে। বুকের ভেতরটা কাঁপছে, আর ঠোঁটের কোণে জমে থাকা একটুখানি লাজুক হাসি।
~” অথচ মহির মনের ভেতরে তখন এক ধরনের ছোটোখাটো ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
এই মানুষটা,
যার চোখে সবসময় একরকম গাম্ভীর্য থাকে, যার মুখে কম কথা, যার চাহনিতে থাকে শীতল দৃঢ়তা, সেই মানুষই আজ সবার সামনে এমন নির্লজ্জ ভাবে কথাগুলো বলে কীভাবে এতটা সহজ হতে পারে?
মাহির মনের ভেতর প্রশ্নের ঝড়,
“এটা কি সেই ইরফান ভাই.?
যার চোখে কখনো সরাসরি তাকাতেই ভয় লাগতো…
সে আজ নিজেই এইভাবে সবার সামনে বেহায়ার মতো আমাকে নিয়ে ভালো বাসার কথা প্রকাশ করছে ?”
–” মাহির মাথার ভেতর যখন এমন ঘোরপাক চিন্তা চলছে, তখন তার গাল বেয়ে নেমে আসছে একপ্রকার উষ্ণতা,লজ্জার, আশ্চর্যের, আর হয়তো একটু আনন্দেরও।
লজ্জায় সে যেন নিজেরই শরীরটাকে ছোট করে ফেলতে চাইছে। মুখটা ইরফানের বুকে আরও গভীরভাবে চেপে ধরেছে, যেন লুকিয়ে ফেলতে পারলেই রেহাই মেলে।
কিন্তু ইরফান? নির্বিকার,মুখে এখনো সেই অভদ্র রকমের শান্ত হাসি,।
মাহি মনে মনে কেবল ফিসফিসিয়ে বলে,
“এই লোকটা দিনকে দিন একদম পাগল হয়ে যাচ্ছে… আর আমি? আমি বোধহয় সেই পাগলামিতেই বাঁধা পড়ে যাচ্ছি…”
~” বাড়ির খোলা করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইরফান, কোলে মাহিকে নিয়ে।
চারপাশে ঝলমলে আলো, বাতাসে পর্দা দুলছে, আর মাহির মনে হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেন এখন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।
লজ্জায় তার গালজোড়া লাল টকটকে, কণ্ঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছে,
“প্লিজ নামিয়ে দিন… আমি হাঁটতে পারবো…”
বারবার মিনতি করেও কোনও লাভ হচ্ছে না।
ইরফান নিরুত্তর। ঠোঁটের কোণে একটুখানি রহস্যময় হাসি,
যেন নিজের আদরের জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরেছে সে পৃথিবীর সামনে।
তবু মাহি ক্ষান্ত দিচ্ছে না, তার কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা আবদার,
“বাড়ির ভেতর, এইভাবে! যদি মা – আম্মু রা দেখে ফেলেন… লজ্জায় মরে যাব!”
কিন্তু ইরফান নির্বিকার।
মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে সে আর তার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দেখছে না।
আর তখনই…
সিঁড়ির ঠিক মুখেই দেখা গেল ফরহাদ চৌধুরী আর কাশেম চৌধুরী বসে আছেন ড্রইংরুমের সোফায়, হাতে চায়ের কাপ।
দুই ভাই চায়ের ধোঁয়ার মধ্যে রাজনীতির পুরনো খবর নিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন, হঠাৎ চোখের কোণে দৃশ্যপট বদলে গেল। ইরফানের কোলে মাহি কে দেখে দুজনেই ভরকে গেলেন।
ফরহাদ চৌধুরীর চোখে পড়তেই অবস্থা বিশ্লেষণ না করে সোজা হাতে টেবিলের ওপর রাখা দৈনিক পত্রিকা তুলে এনে কাশেম চৌধুরীর চোখের সামনে ধরে দিলেন,
নিজেও একটি প্রত্রিকা চোখের সামনে নিয়ে বললেন,
“বলিস কী, আজ তো খবরের পাতা বেশ জমজমাট!”
আর কাশেম চৌধুরী বিস্ময়ে বললেন,
“হ্যাঁ ভাই, একদম হঠাৎ করে কেন যেন আলো লাল হয়ে গেল মনে হচ্ছে!”
এই দৃশ্য দেখে মাহির প্রাণটা বুঝি হঠাৎ করেই কেঁপে উঠলো।
সে চোখ বন্ধ করে ইরফানের বুকের মাঝে মুখ গুঁজে বললো,
“আমি চাই এখনই মাটি ফেটে যাক… আর আমি সেখানেই ঢুকে যাই…”
কিন্তু ইরফানের বুকটা ছিল বিশাল ঢাল,সেই ঢালের নিচে লুকিয়ে থেকেও মাহি টের পেলো, তার হৃদয়ের ধুকপুকানি শুধু ওরই জন্যই।
ইরফান তখন হালকা গলায় ফিসফিস করে বললো,
“তোমার লজ্জা আমার গর্ব… আর তোমাকে ভালোবাসা আমার সাহস। তাই যা করছি, একদম ঠিক করছি।”
ইরফান যখন ধীরে ধীরে মাহিকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল, তখনও মাহির মুখটা লজ্জায় লাল টকটকে। চোখ বন্ধ করে ইরফানের বুকের মাঝে মুখ গুঁজে রেখেছে সে, যেন চাইলেই ওই বুকের ভেতর ঢুকে নিজের অস্তিত্ব আড়াল করে ফেলতে পারে।
সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ইরফান। নিচে থেকে ফরহাদ চৌধুরীর গলা শোনা গেল,
“যাও যাও… তাড়াতাড়ি যাও… আমরাও তো একসময় তরুণ ছিলাম।”
তার কণ্ঠে ছিল একরাশ দুষ্টু মজা, আর রসিকতা ।
দরজা খুলে ঘরের ভেতরে পা রাখলো ইরফান, তারপর ধীরে ধীরে মাহিকে নামিয়ে বিছানায় বসাল। মাহির মুখে তখনো লজ্জার ছায়া, চোখের পাতা ভারী, ঠোঁট দুটো কাঁপছে, কিছু বলতে চেয়েও যেন পারছে না।
ইরফান ধীরে ধীরে মাহির পাশে এসে বসলো। নরম হাতটা বাড়িয়ে ওর কপালে একটুখানি ছোঁয়া দিলো,মায়ার ছোঁয়া, যত্নের ছোঁয়া।
তার চোখে ছিল গভীর চিন্তা, কণ্ঠে কোমলতা,
“বেশি খারাপ লাগছে…?”
মাহি চোখ তুলে তাকাতে চাইল না।
ইরফানের চোখে চোখ রাখলেই যে নিজের সমস্ত দুর্বলতা ভেঙে ভালোবাসার ঢেউয়ে ভেসে যাবে সে, তা ভালো করেই জানে।
মাথা নিচু রেখেই ধীরে বললো,
“না… ঠিক আছি।”
একটু চুপ থাকলো দুজন। ঘরের ভেতর বাতাসটা তখন নিঃশব্দ, একটানা। যেন দুই হৃদয়ের নিঃশ্বাসে বুনছে এক নতুন অধ্যায়।
হঠাৎ করেই মাহি মুখ তুলে, একটু আবদার মেশানো কণ্ঠে বললো—
“ইরফান ভাই… আপনি আমাকে ‘তুমি’ না করে ‘তুই’ বলে ডাকবেন?
আপনার মুখ থেকে তুই ডাকটা শুনতে বেশি ভালো লাগে … আমার খুব ইচ্ছে আপনি আমাকে সব সময় তুই করেই ডাকেন …”
ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকালো, চোখে একরাশ বিস্ময় আর মৃদু হাসির ছায়া,
“উহু… বউকে ‘তুই’ ডাকা শোভা পায় না।”
মাহি এবার একদম অসহায় চোখে তাকিয়ে মিনতির সুরে বললো,
“প্লিজ ইরফান ভাই… প্লিজ…”
ইরফান এবার ভ্রু উঁচিয়ে, একটুখানি খুনসুটির ঢংয়ে বললো,
“ঠিক আছে, ডাকতে পারি। তবে একটা শর্তে।”
মাহির চোখ চকচক করে উঠলো, কৌতূহলে টিপে রাখা একপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কি শর্ত আবার?”
ইরফান হালকা হেসে, গলায় একটুখানি খুনসুটি মেশানো গাম্ভীর্য এনে বললো,
“তাহলে তুমি আমাকে তুমি করে বলবে।”
মাহি যেন হঠাৎ জড়িয়ে গেল নিজের সংকোচে। চোখ গোল করে বললো,
“কীহ্! আমি পারব না!”
ইরফানের চোখে তখন একরাশ দুষ্টু প্রেম। তার গাল ছুঁয়ে, ঠোঁটে নরম একটা হাসি এনে বললো,
“তাহলে আমিও ‘তুই’ করে ডাকবো না।
তোমার যেমন আমার মুখে ‘তুই’ ডাক শোনার ইচ্ছে, আমারও তেমনি ইচ্ছে তোমার মুখে আমার জন্য ‘তুমি’ শব্দটা শুনি।
ভালোবাসা যদি সমান হয়, ভাষাটাও সমান হোক না উইকনেস। ”
~ ” বেশ কিছুক্ষণ চুপিসারে চেষ্টা চালিয়েও ইরফান মাহির মুখে “তুমি” শব্দটা শোনার সাধ পূর্ণ করতে পারলো না। শত আদরে, শত ভালোবাসায়, একটুও রাগ না দেখিয়েও,মাহির জেদের কাছে শেষমেশ হার মানলো সে।
ইরফান ভাবলো, ভাগ্যে যদি থাকে, তাহলে হয়তো একদিন,কোনো এক বিকেলে, কিংবা গভীর রাতে চোখে চোখ রেখে মাহি নিজে থেকেই বলবে “তুমি”। এখনো এই সম্পর্কে সে পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ নয়, আর সময়টাই তো বড় প্রয়োজন।
তার উপর মাহির শরীরটাও ক্লান্ত, আর চাপ দেওয়া মানে যেন সেই আহত মনটাকেই আবার আহত করা।এই ভেবেই ইরফান নিজেকে থামিয়ে দিলো।
এক চিলতে হাসি মুখে এনে শুধু মৃদু কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে… আজ নয়। কিন্তু একদিন তুমি নিজেই বলবে,তুমি। আর আমি সে দিনটার জন্য অপেক্ষা করবো… অগাধ ভালোবাসায়।”
~ইরফানের কথা শেষ হতেই, মাহি হঠাৎই গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্য দিকে। অভিমান মাখা সেই মুখ দেখে ইরফানের চোখে ফুটে উঠলো একটুখানি দুষ্টু হাসি। সে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হলো আমার মহারানীর? আবার মুড সুইং?”
মাহি ঠোঁট উল্টে তাকাল না, তবুও গলায় রেশ রেখে জবাব দিলো,
— “আপনার মুখে ‘তুমি’ শব্দটা একদম বেমানান । খুবই বাজে শোনায়।”
ইরফান থমকে গেলো। বুঝলো, তার বউ সত্যিই জেদি… আর সেই জেদ নিয়ে তার একটা নিজস্ব মাধুর্য আছে, যার কাছে হার মানতে কোনো লজ্জা নেই, বরং তাতেই লুকিয়ে ভালোবাসার আসল গভীরতা।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তারপর মাথা একটু নিচু করে ঠোঁটটা আনলো মাহির ঠোঁটের কাছাকাছি, একটুও না ছুঁয়ে, নিঃশ্বাসে নিঃশব্দে বললো,
— “ঠিক আছে জানপাখি , আর বলবো না ‘তুমি’। এবার থেকে আবার ‘তুই’ বলেই ডাকবো, যেমনটা আগে ডাকতাম… যেমনটা তুই চাইছিস।”
~’ মাহি এক চিলতে কোমল হাসি ছুঁইয়ে দিয়ে ধীরে বলে উঠলো,
— “আপনি… আপনি এভাবেই আমার হয়ে সারাটা জীবন থাকবেন তো? ইরফান ভাই, আমায় কখনো ছেড়ে যাবেন না তো?”
ইরফান ভ্রু কুঁচকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো, তারপর মৃদু হেসে বললো,
— “কাউকে দেখেছিস কখনো, নিজের প্রাণভোমরা নিজের হাতে দূরে ঠেলে দিতে?”
মাহি নিঃশব্দে মাথা নাড়লো, চোখ নামিয়ে শুধু একটুখানি ‘না’।
তখন ইরফান এগিয়ে এল, চোখ দুটো যেন নেশায় ভেজা, অথচ সে নেশা কোনো মাদকতার নয়,ভালোবাসার। গভীর, কাঁপন জাগানো সেই চাহনিতে সে বললো,
— “তুই আমার প্রাণভোমরা… তোকে ছেড়ে থাকা কি এত সহজ? কিভাবে যাবো তোর থেকে দূরে, বল? এই জীবনে হাসিমুখে মৃত্যু মেনে নিতে পারি, কিন্তু তোকে ছেড়ে বাঁচতে পারবো না রে। মরেই যাবো আমি। পারবো না আমি ছাড়তে তোকে , পারবো না তোকে ছেড়ে একটুকুও বাঁচতে…”
~” মাহি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তারপর শিশুর মতো সারল্যে ইরফানের বুকে মুখ গুঁজে ধরলো। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তার শার্ট, যেন সেই বুকটাই তার একমাত্র আশ্রয়। নাকটা ইরফানের বুকের ওপর আলতো করে ঘষে নিয়ে নিঃশব্দে বলে উঠলো,
— “আপনি… আমায় এতটা ভালোবাসেন?”
শব্দগুলো কাঁপছিল হালকা, কিন্তু তাতে ছিল এক অফুরন্ত কৌতূহল, বিস্ময় আর বিশ্বাসের আহ্বান।
ইরফানের শরীরটা মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল, যেন পুরো পৃথিবীটা থেমে গেছে এই প্রশ্নের মাঝে।সে ধীরে মুখটা নামিয়ে মাহির গলায় মুখ গুঁজে দিলো। নিঃশ্বাস গড়িয়ে পড়লো মাহির গলার পাশে, কণ্ঠে জেগে উঠলো এক হাস্কি, কাঁপা সুর,
— “ভালোবাসি… খুব ভালোবাসি! এতটা যে, তা মাপার মতো কোনো ভাষা নেই আমার।
তুই আমার নিঃশ্বাস, আমার ধুকপুকানি…
তুই ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, অন্ধকার।”
~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~