#পারমিতা
#পর্ব_১
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
বাসরঘরে বসে আছে পারমিতা। গা ভর্তি ডায়মন্ডের জুয়েলারি, পরনে লাল লেহেঙ্গা। হাত ভর্তি চুড়ি কিন্তু হাতে কোনো মেহেদী নেই। খাটের মাঝখানে বসে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে । যেভাবে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো সেভাবেই বসে রয়েছে পারমিতা।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের হাতের দিকে। বিয়েতে মেয়েদের হাতে হয় মেহেদী দেওয়া থাকে আর না হয় আলপনা করা থাকে কিন্তু পারমিতার হাতে কিছুই করা নেই। নিজের পরনের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে রইল পারমিতা। যে রং টা পারমিতার একদম অপছন্দ সেটা পরেই বিয়ে হয়েছে ওর। চোখ মুখ ফুলে আছে, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে পড়তে মেকাপের উপর দিয়ে গালে তার ছাঁপ বসে গেছে।
বুঝ হওয়ার পর থেকে স্বপ্ন দেখেছিলো বিশাল বড় এক ডাক্তার হবে। সমাজে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসবে। তাই পড়ালেখায় কখনো কমতি রাখেনি।
এরপর যখন বয়স ১৫ হলো তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো অরিয়নের মতো একজন ছেলের। যে কীনা পারমিতাকে সেভাবেই ভালোবাসবে যেভাবে অরিয়ন আফরিনকে ভালোবাসে।
পারমিতার বয়স তখন ১২, অরিয়ন একদিন ডাক দিয়ে পারমিতার হাতে একটা চিঠি আর এক বক্স বিদেশি চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বললো-
–এটা গিয়ে আফরিন আপিকে দিবি, ঠিক আছে পরী?? বলবি আমি দিয়েছি। আর চকলেটটা তোর জন্য।
–ওকে অনিয়ন ভাইয়া।
জবাব দেয় পারমিতা।
–একটা চড় খাবি। অনিয়ন ডাকিস কেনো।
একটু রাগ হওয়ার অভিনয় করে বলে অরিয়ন।
–তোমাকে অনিয়ন ডাকতে ভালো লাগে।
খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলে পারমিতা।
এরপর থেকে বুঝতে পারলো তাদের দুজনের মধ্যে ভাব হয়েছে। তাদের মধ্যকার যতো গিফট ও চিঠি আদান প্রদান করা হতো সবটার বার্তাবাহক ছিলো পারমিতা। বর্তমান যুগ যদিও চিঠির না তবুও অরিয়ন আর আফরিন নিজেদের ভালোবাসা এভাবে প্রকাশ করতেই বেশি পছন্দ করতো।
পারমিতা বুঝতে পারলো অরিয়ন যেভাবে আফরিনকে ভালোবাসে সেভাবে হয়তো কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারবে না। সব সময় আফরিনের দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, আফরিনের যে কোনো প্রয়োজনে সবার আগে এগিয়ে আসা, অন্য মেয়েদের থেকে নিজের দুরত্ব বজায় রাখা সব কিছু যেন অরিয়নকে সব ছেলেদের থেকে একদম আলাদা করে তুলেছিলো।
মনের কোণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটা আকাঙ্খা জাগতে শুরু করলো। যেখানে পারমিতার জীবনে আশা প্রেমিক অথবা স্বামী যদি অরিয়নের মতো ভালো না বাসে তাহলে বিয়েই করবে না পারমিতা। চোখের সামনে এমন একটা লেভেল সেট করে দিলে তা কি আর সহজে ইগনোর করা যায়!
পারমিতার বাবারা ছিলেন ৩ ভাই। পারমিতার বাবাই সবার ছোট। ভালোবেসে বিয়ে করলেও তাদের কোনো সন্তান হয়নি দীর্ঘ ৮ বছর। তাও যেন তাদের মধ্যকার ভালোবাসা কমেনি কিন্তু যেদিন পারমিতা এই পৃথিবীতে আসবে জানতে পারলো সেদিন তারা বুঝতে পারলো তাদের জীবনটা পরিপূর্ণ করে দিলো পারমিতা। তাই পরিপূর্ণ বোঝাতেই মেয়ের নাম রেখে দিলো পারমিতা চৌধুরী।
পারমিতার বয়স যখন ৫ তখন রোড এক্সিডেন্টে পারমিতার মা সুমাইয়া চৌধুরী ও বাবা ওয়াসিম চৌধুরী দুজনেই মারা যান। সরকারি ছুটির দিন থাকাতে ভালো ডাক্তার দেখার সুযোগটা পাওয়ার আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায় তারা। সবার থেকে সেই ঘটনা শুনে শুনে বড় হওয়া পারমিতা মনে মনে শপথ নেয় ডাক্তার হওয়ার ।
চোখের সামনে নিজের ছোট ভাইয়ের মেয়েকে এতিম হতে দেখে তা সহ্য করতে পারেনি ওয়াহিদ চৌধুরী তাই পারমিতাকে নিজের বুকে টেনে নেন তিনি ও তার স্ত্রী মায়া চৌধুরী। পারমিতা ও নিজের মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতে চাইনি বলেই পারমিতার নাম রাখে পারমিতা মেহরোজ চৌধুরী। নিজের মেয়ে মেহেরিন আফরিন চৌধুরীর সাথে মিলিয়ে।
পারমিতা, বয়স ১৮ হয়েছে এক সপ্তাহ আগে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সব কাজিনরা মিলেই এক সপ্তাহ আগে বিশাল করে সেলিব্রেট করেছে পারমিতার বয়স ১৮ হওয়াকে। যেখানে আরফিন, পারমিতা, আরিয়ান, অরিয়ন, নিপা ( আফরিনের খালাতো বোন), নয়ন ( আফরিনের খালাতো ভাই), পারমিতার বন্ধু বান্ধব সবাই ছিলো।
কাজিনদের মধ্যে সবার বড় অরিয়ন, বয়স ২৯। এরপর আফরিন যার বয়স ২৬। এরপর আরিয়ান যার বয়স ২৪ ও সবার শেষে পারমিতা।
পারমিতার বড় চাচ্চু হাবিব চৌধুরী ও তার স্ত্রী আনিকা চৌধুরীর বড় ছেলে অরিয়ন। ছোট ছেলে আরিয়ান।
কিন্তু ভাগ্যের লিখন কেউ খন্ডাতে পারেনা। যেখানে ডাক্তার হওয়ার কথা ছিলো সেখানে ১৮ বছর বয়সে কারো বউ হয়ে বসে আছে পারমিতা।মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বিয়ের পিরিতে বসতে হলো পারমিতাকে।
বাঙ্গালী আর বাকি ১০ টা মেয়ের মতোই পারমিতার উচ্চতা ৫.২”। গায়ের রঙ ফর্সা, কালো ঘন চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে। গোলগাল চেহারা,বড় বড় চোখ আর গোলাপি ঠোঁটে যেন একটা পুতুলের মতো লাগে। তাই আদর করে সবাই পরী বলেই ডাকে পারমিতাকে।
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় পারমিতা। পা মাটিতে পড়তেই লেহেঙ্গা মেঝে স্পর্শ করে। অনেকটা বড় হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। উঁচু জুতা খুলে ফেলাতে নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে লেহেঙ্গা। হাতাটাও যেন এখনি পুরো হাত ঢেকে ফেলবে পারমিতার। নিজের হাত দিয়ে লেহেঙ্গার গলা ধরে পেছনে টান দিয়ে ঠিক করে। গলাটা বেশি বড় হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে জানালায় পাশে দাঁড়ায় পারমিতা। বাইরের আকাশে আজ কোনো চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। ঘন কালো মেঘে সবটা ঢেকে গেছে। আশে পাশের সব কিছু সাজানো। ফুল, লাইটিং সব কিছু দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো বাড়ি। বাংলাদেশের সেরা ওয়েডিং প্লানার দিয়ে সব আয়োজন করা হয়েছে। সব কিছু এতো সাজানো থাকলেও মেঘলা এই আকাশটার সাথে যেন সব কিছু বড্ড বেমানান লাগছে।
নতুন বউ নিজের রুমের মধ্যে থাকলেও একের পর এক গাড়ি এসে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করছে।
“আমার কী ডাক্তার কী আর হওয়া হবে?? নতুন জীবনে কী মানিয়ে নিতে পারবো আমি?? সবার মন কী জয় করতে পারবো ??”
নিজের মনে হঠাৎ করে প্রশ্ন জাগে পারমিতার।
জানালার পাশ থেকে হেটে গিয়ে রুমের দক্ষিন পাশের দেয়ালে টানানো বিশাল বড় ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে পারমিতা।
কারো রুমে প্রবেশ করার শব্দে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে থাকে পারমিতা। বাইরে থেকে কয়েক জনের আবছা আবছা কথা শোনা যাচ্ছে।
–ভিতরে প্রবেশ করতে হলে টাকা দিয়ে ঢুকতে হবে।
একজন মেয়েলি কন্ঠ বলে উঠে।
–১ লক্ষ টাকা না দিলে বউয়ের কাছে যাওয়া যাবে না।
আরেকজন মেয়ে বলে উঠে।
–উহু, না না, টাকা দিতেই হবে।
–আচ্ছা আচ্ছা।
এরপর কী কথা হলো পারমিতা জানেনা। অট্টহাসিতে মেতে উঠলো সবাই। মেয়েগুলোর কণ্ঠ যেন কিছুক্ষণের জন্য চেনাচেনা লাগলো পারমিতার। “কোনো পরিচিত আত্নীয় হতে পারে” ভাবে পরী।
কিছুক্ষণ কথা আর হাসাহাসির পর সবাই থেমে গেলো। বুঝতে পারলো হয়তো নিজেদের ইচ্ছাপূরণ হওয়ায় সবাই চলে গেছে। নিজের দৃষ্টি আবারও ছবির দিকে নিয়ে যায় পরী। বিশাল বড় দেওয়ালের একটা বড় অংশ নিয়ে ছবিটা টানানো। পাশেই ছোট ছোট পারিবারিক ছবি রয়েছে।
দরজা খোলার শব্দে যেন ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো পরী। নিজের লেহেঙ্গা দু হাত দিয়ে শক্ত করে মুঠ করে ধরে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিরবতা বিরাজ করছে রুমের মধ্যে। রুমে প্রবেশ করা মানুষটাও কোনো কথা বলছে না। নিজের জায়গায় সেও দাঁড়িয়ে আছে তা না হলে হাটার শব্দ পারমিতার শোনার কথা ছিলো কিন্তু পারমিতা কিছুই শুনতে পায়নি।
–ছবিতে আফরিনকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না?
কথাটা শুনতেই ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায় পারমিতা। দরজার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেরওয়ানি পড়া অরিয়ন।
অরিয়ন আফনান চৌধুরী।
চলবে……