পারমিতা পর্ব-০২

0
81

#পারমিতা
#পর্ব_২
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

প্রতিটা মানুষের জীবনে একজন আইডল থাকে। যে জীবনে বড় হওয়ার সাথে সাথে তার মতো হতে চায়,নিজের সব তার অনুসারে করার চেষ্টা করে। পারমিতার আইডল ছিলো আফরিন ।

ওয়াহিদ চৌধুরী যেদিন পারমিতাকে বাড়িতে নিয়ে আসলেন সেদিন আফরিন সবার আগে পারমিতাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে নিজের সব খেলনা ও জিনিস দেখাতে লাগলেন। পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে নিজের সব খেলনা দিয়ে বললেন “আজ থেকে সব তোর” এরপর থেকে কোনোদিন ছোট্ট পারমিতার মনে হয় নি এটা তার নিজের বাড়ি নয়।

——————-

–ছবিতে আফরিনকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না?

অরিয়নের কথাটা শুনেই পেছনে ফিরে তাকায় পারমিতা। বর সাজা অরিয়ন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফরিনের ছবিটার দিকে।

আফরিনের গায়ের রঙ শ্যামলা, উচ্চতায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি, চুলগুলো কাধ পর্যন্ত। গোলগাল চেহারায় মায়া যেন চুয়ে চুয়ে পড়ছে আফরিনের মুখ থেকে।পছন্দের রঙ নীল। ছবিতে আফরিন সাদা রঙের এক গাউন পড়া। বিশাল এক চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা রাখা, দু হাত চেয়ারের দু পাশে রাখা। দেখে মনে হচ্ছে যেন এক আফসারা বসে আছে চেয়ারে।

অরিয়নের রুমে এই ছবিটা পারমিতা দেখে আসছে আরও ৫ বছর আগে থেকে। নীল রঙের দেয়াল থেকে শুরু করে পুরো ঘরটাই যেন একটা নীলের রাজ্য। আফরিন থাকবে বলেই সব কিছু নিজের হাতে সাজিয়েছিলো অরিয়ন ও আফরিন।

৬ বছরের ভালোবাসা পরিপূর্ণ হওয়ার কথা ছিলো আজ। হ্যাঁ, আজ আফরিন আর অরিয়নের বিয়ের কথা ছিলো। বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পর থেকে আফরিন আর অরিয়নকে এতো বেশি খুশি হতে আর কখনো দেখেনি পারমিতা। বিশেষ করে অরিয়নকে, অরিয়নকে দেখলেই মনে হতো যেন পৃথিবীর সব কিছু পেতে যাচ্ছে অরিয়ন। কীভাবে একজন মানুষ অন্য একজনকে এতো ভালোবাসতে পারে তা বুঝতেই পারতো না পারমিতা। মনে প্রাণে সব সময় চাইতো এদের দুজনের উপর যেন কারো নজর না পড়ে।

কথায় আছে যখন ভালোবাসার মানুষেরা একে অপরকে অপরিসীম ভালোবাসে তখন ভাগ্য তার নির্মম খেলা দেখানো শুরু করে কিন্তু তা যে কখনো নিজের চোখে দেখতে পারবে পারমিতা তা কল্পনাও করেনি কখনো।

অরিয়নের পরিবার নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে আফরিনকে যদিও কেনো আনিকা চৌধুরী পারমিতাকে পছন্দ করে না তা জানা নেই পারমিতার। যখন অরিয়ন আফরিনকে নিয়ে নিজের অনুভূতির কথা পরিবারে জানালো তখন যেন বাড়িতে উৎসব লেগে গেলো। ছোট থেকেই পারমিতা দেখে আসছে সবাই আফরিনকে খুব বেশি ভালোবাসে। ভালো না বেসে যাবে কোথায়? সবাইকে সম্মান করা, সবার সাথে সুন্দর করে কথা বলা,হাটা চলা সব কিছুতে যেন অন্যরকম এক মাধুর্য প্রকাশ পেতো আফরিনের। ছোটবেলায় পারমিতা আয়নার সামনে আফরিনের মতো কথা বলা, হাটা চলা করার প্যাক্টিস কতবার করেছে তা নিজেও জানেনা।

পারমিতার পরনের কাপড় থেকে শুরু করে সব কিছু আজ পড়ে থাকার কথা ছিলো আফরিনের। সব কিছু নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছিলো অরিয়ন কিন্তু আজ সব পরে অরিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পারমিতা। লেহেঙ্গা বড় হওয়া, এক প্রকার গা থেকে খুলে যাওয়ার মানে এটাই ছিলো যে সব কিছু কেনা আফরিনের মাপের।

অরিয়ন আস্তে আস্তে হেটে ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এক মিনিটের জন্যও ছবি থেকে চোখ কোথাও সরছে না অরিয়নের। নিজের হাত দিয়ে ছবিটা স্পর্শ করে অরিয়ন। অন্য দিকে এক দৃষ্টিতে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে পারমিতা।
পারমিতার ১৮ বছরের জীবনে অরিয়নকে এতোটা ভেঙ্গে পড়তে আর কখনো দেখেনি পারমিতা।

–আমার আফরিন।
করুন সুরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

–কাম ব্যাক টু মি বেব।
ছবির সাথে নিজের মাথা লাগিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে অরিয়ন।

–অরিয়ন ভা..
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে ডাক দেয় পারমিতা

–তুই কি সব জানতি??
পারমিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর সুরে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় পারমিতা। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে অরিয়নের দিকে।

–তুই কী সব জানতি আগে থেকে??
হঠাৎ করে চেচিয়ে বলে উঠে অরিয়ন।

হঠাৎ করে অরিয়নের কণ্ঠ শুনে ভয়ে নিজের জায়গায় লাফিয়ে উঠে পারমিতা। অরিয়নকে সব সময় হাসিখুশি দেখে এসেছে পারমিতা, এরকম রাগন্ত অবস্থায় তো কখনো দেখেনি।

অরিয়ন আফনান চৌধুরী। উচ্চতা ৬ ফুট ১ ইঞ্চি,গায়ের রঙ ফর্সা। শান্ত, নম্র স্বভাবের ছেলে অরিয়ান। চমৎকার দৈহিক গঠন যাকে এক কথায় বলে সুদর্শন পুরুষ। বাবার সাথে রিয়েল স্টেট ব্যবসা দেখাশোনা করছে ৩ বছর ধরে।

–ন….ন…না।
আমতা আমতা করে বলে পারমিতা।

–তুই তো সব সময় ওর সাথে থাকতি। তুই কীভাবে জানতে পারলি না পরী?
অবিশ্বাসের চোখে পারমিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–আপু….আপু.. এমন কিছু… এমন কিছু করতেই পারেনা। তুমি…তুমি ভুল বুঝছো আপুকে।
ভয়ে আমতা আমতা করে আবারও বলে উঠে পারমিতা।

–আমি ভুল বুঝছি??
পারমিতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।

অরিয়নের চাহনি দেখে ভয় পেয়ে দু পা পিছিয়ে পড়ে পারমিতা। অরিয়নকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি সামনে যাকে পাবে তাকে খুন করে ফেলবে।

–আমি যদি ভুল বুঝে থাকি দেন হোয়ার ইজ মাই আফরিন?
চিৎকার করে কথাটা বলেই পাশে থাকা একটা ছবির ফ্রেম হাতে তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে অরিয়ন।
ক্ষণিকেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় ফ্রেমটি।

–আমি জানিনা…আমি জানিনা।
ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে পারমিতা।

–ছেলেটা কে?
শান্ত গলায় প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–কো…কোন ছে…ছেলে??
জবাব দেয় পারমিতা।

এই পৃথিবীতে যদি একজন মানুষকে ক্ষনিকের জন্যও ভয় করেনি পারমিতা তাহলে সে হলো অরিয়ন কিন্তু আজ যেন সব থেকে বেশি ভয় হচ্ছে অরিয়নকে দেখেই। হাত পা অনবরত কাঁপছে পারমিতার।

–যেই ছেলের সাথে….যেই ছেলের সাথে ও পালিয়েছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে চুপ করে থাকে পারমিতা। কী জবাব দেবে? আফরিনকে কোনোদিন কোনো ছেলের সাথে দেখেনি পারমিতা।

যদি কারো সাথে আফরিনের সম্পর্কই না থাকে তাহলে আজ কেনো বিয়েটা হলো না ওদের?? কেনই বা দু দিন আগে পারমিতার রুমে এসে এক অদ্ভুত আইডিয়া শেয়ার করে আফরিন।

২ দিন আগে
——————

–মিতা ঘরে আছিস??
দরজায় নক করে বলে আফরিন।

–হ্যাঁ আপু আছি, ভিতরে আসো।
জবাব দেয় পারমিতা।

–শুন না মিতা আমি সেই একটা প্ল্যান করেছি বিয়ের দিনের জন্য। যা বাস্তবায়ন করতে পারলে তোর অনিয়ন ভাইয়ার মুখটা দেখার মতো হবে।
পারমিতার পাশে বসতে বসতে বলে আফরিন।

–কি প্ল্যান আপু??
কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে পারমিতা।

–শুন, বিয়ের দিন আমি পার্লারে যাবো সাজতে..তোর..

–পার্লারে কেনো যাবে?? ওরা তো এখানে আসবে আমাদের সাজাতে।
আফরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই পারমিতা বলে উঠে।

–আরে তুই আমার কথা শুন, আমি যাবো পার্লারে সাজতে। তুই অরিয়নের হাতে এই চিঠিটা দিবি।
কথাটা বলেই পারমিতার হাতে এক চিঠি তুলে দেয় আফরিন।

চিঠি খুলে দেখেই যেন চোখ কপালে উঠে যায় পারমিতার।

–তোমার কী মাথা খারাপ?? এইসব কী লিখেছো তুমি?? অনিয়ন ভাইয়া এটা কখনো বিশ্বাস করবে না।
আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলে পারমিতা।

–আরে…এটা জাস্ট আফনানের সাথে দুষ্টামি করছি আর কিছুই না। তুই এটা অকে দিবি। এরপর ও যখন দেখবে আমি টাইম মতো আসছি না তখন সবাই টেনশনে পড়ে যাবে। তখন আমি এসে হাজির হবো। ভাব তখন সবার কী অবস্থা হবে।
কথাগুলো বলেই খুশি হয়ে যায় আফরিন।

–মজা তো হবে কিন্তু, কিন্তু অনিয়ন ভাইয়া যদি রাগ করে?
আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলে পারমিতা।

–আফনান আমার সাথে কোনোদিনও রাগ করে থাকতে পারবে না।
মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বলে আফরিন।

আফরিনের হাসিটা দেখে যেন মন গলে গেলো পারমিতার। আর তাছাড়া আফরিন আর পারমিতা দু দিন পর পর ই একটা না একটা প্র‍্যাংক করতে থাকে অরিয়ন ও আরিয়ানের সাথে।

–হ্যাঁ আপু অনেক মজা হবে।
পারমিতাও খুশি হয়ে বলে।

————–

চিঠিটা।

প্রিয় আফনান,

জানি আমি আজ যা করতে যাচ্ছি তার জন্য কোনোদিন তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। আমি কোনোদিন এমনটা তোমার সাথে করবো তা কল্পনাও করিনি কিন্তু মানুষ যে তার হৃদয়ের গোলাম। আমাদের বন্ধুত্ব যখন ভালোবাসায় রূপ নিলো তখন ভেবেছিলাম আমি হয়তো তোমাকে সত্যিকারে ভালোবাসি কিন্তু আমার চিন্তা পরিবর্তন হয়ে গেলো অন্য একজনের আগমনে। তার সাথে সময় কাটানোতে আমি বুঝতে পারলাম যা তোমার জন্য আমি অনুভব করেছিলাম তা ভালোবাসা নয়।

বলতে পারো ৬ বছর পরেই কেনো আমি একথা বলছি, আমি জানিনা কেনো আজ এই কথা আমার বলতে হচ্ছে। চেয়েছিলাম সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েটা করে নিবো কিন্তু কাল নিজেকে হলুদের শাড়ীতে দেখে আর সহ্য করতে পারলাম না। এই বিয়েটা আমার দ্বারা করা সম্ভব নয় আফনান। আমাকে ক্ষমা করে দিও। দোয়া করি এমন কাউকে পাও যে তোমাকে তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসবে।

পারলে ক্ষমা করে দিও।

ইতি,
আফরিন।

——————

বর্তমান

আফরিন যে অন্য কাউকে কখনো ভালোবাসতেই পারেনা তা ভালোই জানতো পারমিতা তাই তো আফরিনের সাথে এই দুষ্টামিটা করতে রাজি হয়ে যায়। প্ল্যান মাফিক বিয়ের দিন পারমিতা স্টেজে এসে কান্নার অভিনয় করতে করতে চিঠিটা অরিয়নের হাতে তুলে দেয়। ঐ দিকে সময় পেরিয়ে গেলেও আফরিনের কোনো খোজ পাওয়া যায়নি। ফোন বন্ধ, পার্লারে গেলে জানা যায় আফরিন সেখানে যায় নি। ক্ষনিকের মধ্যেই যেন নাই হয়ে গেলো আফরিন। ভিতরে ভিতরে মুচকি হাসি হাসতে থাকা পারমিতার চেহারায় কখন যে চিন্তার ছাঁপ পড়তে শুরু করেছিলো তা পারমিতা নিজেও খেয়াল করেনি।

তবে কী আফরিন সত্যি অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে?? অরিয়নের মতো একজন লয়াল মানুষ থাকাও কী কখনো জীবনে এনাফ হয় না?? সত্যি কী ভাগ্য মাঝে মধ্যে আমাদের সাথে তার নির্মম খেলা খেলে??

চলবে….