#পারমিতা
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
প্লেনের বেডে শুয়ে আছে মিতা। এবার অরিয়ন আর ফার্স্টক্লাস সীটের ব্যবস্থা না করে বেডের ব্যবস্থা করেছে। গতবার প্লেনে মিতার যেই বাজে অবস্থা হয়েছিলো, তা এড়াতেই এই ব্যবস্থা করা।
গতকাল রাতে মিতা যখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলো তখন অরিয়ন রাত জেগে বাংলাদেশে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলে।
–আমাদের উপর এটাক করেছিলো কারা?
বিছানায় শুয়ে থাকা মিতা শক্ত করে বিছানার চাদর ধরে রেখে অরিয়নের উদ্দেশ্যে বলে উঠে।
বেডের এক পাশে বসে ম্যাগাজিন দেখছিলো অরিয়ন। মিতার কথা শুনে মিতার দিকে তাকাতেই নজর যায় মিতার হাতের দিকে। চাদরটা এমন ভাবে ধরে রেখেছে,যেন ছেড়ে দিলেই পড়ে যাবে।
–আমার বিজনেস রাইভাল।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
–ওদের উদ্দেশ্য তোমাকে মে*রে ফেলা ছিলো।
অবাক হয়ে বলে মিতা।
–হুম।
ম্যাগাজিন রেখে বেডে উঠতে উঠতে বলে অরিয়ন।
–অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম আমরা, তা না হলে কি যে হতো।
আবারও বলে মিতা।
–কিছুই হতো না। আমি কিছু হতেই দিতাম না।
মিতার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থেকে বলে অরিয়ন।
–সামান্য বিজনেসের জ..
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই অরিয়ন মিতার হাত থেকে বিছানার চাদর ছাড়িয়ে নেয়। অরিয়ন কি করছে তা দেখছে মিতা। আলতো হাতে অরিয়ন মিতার হাত নিজের হাতে নিয়ে নেয়। মিতার আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের আঙ্গুল দিয়ে মিতার হাত মুঠ করে ধরে অরিয়ন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিতা আর নিজের হাতের দিকে।
মিতার হাত স্পর্শ করার মূহুর্ত থেকেই যেন হার্টবিট দ্রুত চলছে মিতার। ইদানিং অরিয়নের স্পর্শ এক অন্যরকম শিহরণ জাগায় মিতার শরীরে। নিজেকে অরিয়নের কাছে নিরাপদ মনে হয়।
মিতার হাত ধরে রাখা অরিয়ন মিতার দিকে তাকাতেই দেখতে পায়,মিতা আগে থেকেই অরিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। ধরে রাখা মিতার হাত মিতার পেটের উপর এনে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মিতাকে। মোশন সিকনেসের কারণে মিতা যে কতটা অস্বস্তি অনুভব করছিলো তা অরিয়ন ভালোই বুঝতে পেরেছিলো। গতবার জড়িয়ে ধরাতে একটু শান্ত হয়েছিলো ভেবে এবার ও জড়িয়ে ধরে মিতাকে। অরিয়ন জড়িয়ে ধরতেই মিতার শরীর রিলাক্স হয়ে পড়ে।
একে অপরের এতো কাছাকাছি আসাতে,একে অপরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অরিয়ন মিতাকে দেখতে দেখতেই চোখ গিয়ে আটকায় মিতার ঠোঁটের দিকে। এক দৃষ্টিতে মিতার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকতেই যেন গলা শুকিয়ে আসলো অরিয়নের। মনে হতে লাগলো ঠোঁটগুলো স্পর্শ না করলে হয়তো এই তৃষ্ণা আর মিটাতে পারবে না অরিয়ন। অন্যদিকে, অরিয়নের চাহনি দেখে মিতা ভালোই বুঝতে পারছে কি হতে যাচ্ছে। অরিয়নের চোখ, চেহারা বার বার এটাই বোঝাচ্ছে যে,অরিয়ন কিস করতে চায় মিতাকে।
অরিয়ন নিজের মুখ মিতার ঠোঁটের কাছাকাছি নিতেই নিজের বুকে মিতার স্পর্শ অনুভব করে। মিতার ঠোঁট থেকে চোখ সরিয়ে বুকের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে মিতা নিজের হাত রেখেছে অরিয়নের বুকে। মিতা ভালোই জানে অরিয়নের এই কিস করা, প্রতিনিয়ত মিতাকে স্পর্শ করা সবটাই শারীরিক আকর্ষণ বা মোহ। যা ক্ষণিকের জন্য আসে আবার ক্ষণিকের মধ্যেই চলে যায়। তাই বাধা দিতেই অরিয়নের বুকে হাত রেখে হালকা করে ধাক্কা দেয় মিতা।
অরিয়ন মিতার ধাক্কা অনুভব করতেই নিজের হাত দিয়ে মিতার হাত ধরে বিছানায় চেপে ধরে। মিতার দূরে সরানোটা কেনো যেন একটু ও ভালো লাগলো না অরিয়নের, উলটো মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। অরিয়ন আর এক মিনিটও অপেক্ষা না করে ঝাপিয়ে পড়ে মিতার ঠোঁটের উপর। মিতার ঠোঁট স্পর্শ করতেই যেন রুহ ফিরে আসলো অরিয়নের আত্নায়। সামান্য কিসের জন্য অরিয়ন একজন ১৭/১৮ বছরের ছেলেদের মতো বিহেভ করবে তা যেন ভাবতেও পারছে না অরিয়ন। তাও মিতার ঠোঁট দেখলেই কেনো যেন মনে হয় এটাই প্রথম কিস অরিয়নের।
–উম্মম্মম…
কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মিতা। অরিয়ন এতো ডেস্পারেটলি কিস করতে ব্যস্ত যে মিতার জন্য শ্বাস নেওয়াও এখন কষ্টকর হয়ে গেছে।
–ওয়েট, অরিয়ন ভাই…
–আহ..
মিতার নিজের ঠোঁট ছাড়িয়ে কথাটা বলতেই মিতার গলায় স্বজোরে কামড় বসিয়ে দেয় অরিয়ন। এতো জোরেই কামড় বসিয়েছে যে চোখের কোণে পানি চলে এসেছে মিতার।
–অরিয়ন, শুধুই অরিয়ন।
মিতার কপালের সাথে নিজের কপাল স্পর্শ করে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয় মিতা। অরিয়ন? কিছুদিন আগেও অরিয়ন ডাকায় রাগ করেছিলো অরিয়ন আর আজ? আজ নিজেই বলছে শুধু অরিয়ন ডাকতে।
–হোয়াট আর ইউ ডুয়িং টু মি, লাভ?
নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মিতার ঠোঁট ঘোষতে ঘোষতে বলে অরিয়ন।
পরক্ষণেই আবারও মিতাকে কিস করতে থাকে অরিয়ন। নিজের হাত দিয়ে মিতার শার্টের বাটন খুলতে মরিয়া হয়ে পরে। মিতার শার্টের বাটন খুলতে ব্যস্ত অরিয়নের মনোযোগ নষ্ট হয় মোবাইলে রিং বাজতেই।
–ওয়েট।
একপ্রকার বিরক্ত হয়ে কথাটা বলেই মোবাইল নিতে পাশ ঘুরে অরিয়ন।
মোবাইল হাতে নিতেই যেন নিজের জায়গায় পাথর হয়ে রইল অরিয়ন। হুট করে অরিয়ন কেনো নিজের জায়গায় এমন স্থীর হয়ে রইল তা বুঝার জন্য মিতা বিছানা থেকে উঠে অরিয়নের দিকে তাকায়। যেই অরিয়নের মুখে এতোক্ষণ মিতার জন্য এক অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছিলো সেই অরিয়নের মুখে এখন শুধুই অনুশোচনা আর অপরাধবোধ। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো অবৈধ কাজ করতে গিয়ে ধরা পরে গিয়েছে। অরিয়ন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোবাইলের দিকে। মোবাইলে এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে তা দেখার জন্য মোবাইলের দিকে তাকাতেই যেন মিতাও পাথর হয়ে রইল। মোবাইলের স্ক্রিনে ভাসছে আফরিনের ছবি। যেই ছবিতে আফরিন খোলা চুলে শুয়ে আছে বিছানায়। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি এক হাসি দিয়েছে আফরিন। কতই না সুন্দর লাগছে ছবিতে আফরিনকে।
অরিয়ন তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে উঠেই ওয়াশরুমে চলে যায়। হঠাৎ করেই মিতার মাথা যেন প্রচন্ড ঘুরতে শুরু করেছে, বমি আসবে মনে হতেই শুয়ে পরে মিতা। এই খারাপ লাগা মোশন সিকনেসের কারণে নয়, এই খারাপ লাগা এটা বুঝতে পেরে যে আফরিন আর অরিয়নের ভালোবাসা কতটা গভীর ছিলো। এটা ভেবে যে আফরিন ধোকা দিয়ে গেলেও কেনো অরিয়ন আফরিনকে ভুলতে পারছে না, কেনো ৬ মাস হয়ে গেলেও অরিয়ন মুভ অন করতে চাইছে না। মিতার কি খুশি হওয়া দরকার? এটা ভেবে যে, অরিয়নের মতো লয়াল মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নাকি দুঃখ পাওয়া উচিৎ? যে এরকম একজন মানুষ মিতার স্বামী হয়েও মিতার না। “কেনো চলে গেলে তুমি আপু? না তুমি চলে যেতে, না আমি তোমার আফনানকে ভালোবাসতাম আর না আমার এতো কষ্ট হতো। তার সবকিছুতেই যখন তুমি তাহলে কেনো তাকে ফেলে চলে গেলে?” মনে মনে ভাবতে ভাবতেই কাঁদতে থাকে মিতা।
অরিয়ন যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো মিতা তখন একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। অরিয়ন এক পাশে রাখা সোফায় বসে টিভি অন করে টিভি দেখার চেষ্টা করে।
” লাভ? অরিয়ন, শুধুই অরিয়ন” কথাগুলো বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে অরিয়নের মাথায়। “কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? মিতার প্রতি এরকম আকর্ষণ?” মনে মনে ভাবে অরিয়ন।
মিতার জন্য অরিয়ন যা অনুভব করছে তা আর কখনো কারো জন্যই করেনি অরিয়ন। না করলেও এটা ভালোই বুঝতে পারছে এই অনুভূতিটা ভালো না, মিতা বা অরিয়ন কারো জন্যই ভালো না।
আড় চোখে মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন। মিতার চোখ বন্ধ। চোখ বন্ধ হলেও মিতা যে ঘুমায়নি তা অরিয়ন জানে।
হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আফরিনের ছবিটা দেখে অরিয়ন। “কি সব হচ্ছে আমার সাথে আফরিন? কেনো পরীর জন্য আমার এমন লাগছে? আমি কি পরীর মধ্যে তোমাকে খুজছি?” মনে মনে ভাবে অরিয়ন।
হ্যাঁ, তাই হবে। আফরিন আর মিতার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তাই হয়তো মিতার মধ্যে আফরিনকে খুজে নিচ্ছে অরিয়ন। কিন্তু তা যে ঠিক নয় সেটাও বুঝতে পারছে অরিয়ন। একজনের শূন্যস্থান অন্যজনকে দিয়ে বিশেষ করে পরীকে দিয়ে পূরণ করিয়ে নেওয়া ঠিক নয়।
“পরী ডিসার্ভ করে এমন একজনকে, যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব জায়গায় পরী থাকবে, যার মন আমার মতো ভাঙ্গা হবে না,যে পরীকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসবে,যে পরীকে মাথায় তুলে রাখবে” নিজের মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হাতে থাকা মোবাইল অরিয়ন কখন শক্ত করে চেপে ধরেছে বলতেও পারেনা। শুধু জানে কিছু ভাঙ্গার শব্দে চোখ হাতের দিকে যেতেই লক্ষ্য করে মোবাইলের স্ক্রিন ফেটে গেছে।
স্ক্রিনে থাকা আফরিনের ছবিটা এখন আর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে শুয়ে থাকা মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন।
চাদর দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে মিতা, হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। মিতার দিক থেকে নজর সরিয়ে সোফার সাথে হেলান দেয় অরিয়ন।
“আমার পরী” বিরবির করে বলে অরিয়ন।
**************
এয়ারপোর্টে যখন অরিয়ন আর মিতা ল্যান্ড করলো মিতার অবস্থা তখন দুই কারণেই খারাপ। একে তো মোশন সিকনেস তার উপর যা প্লেনের মধ্যে হয়েছে তা। মিতার অবস্থা খারাপ জেনেও এবার আর অরিয়ন মিতাকে ধরলো না। প্লেনে যা হয়েছে তার জন্য নিজের উপর ই রেগে আছে অরিয়ন। মিতার সামনে কেনো যেন ইদানীং নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না অরিয়ন। তাই মিতাকে না ধরেই আগে আগে হাটতে থাকে অরিয়ন। মিতা কোনোমতে নিজেকে স্থির রেখে অরিয়নের পিছন পিছন হাটছে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবরারকে।
ড্রাইভার সহ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আবরার। দূর থেকে মিতাকে দেখে দৌড়ে চলে যায় মিতার কাছে। নিজের ভাই অরিয়নকে যেন দেখলোই না আবরার।
–আরিয়ান ভাইয়া।
আবরারকে দেখে খুশি হয়ে বলে মিতা।
–মিতা।
বলেই মিতাকে জড়িয়ে ধরে আবরার।
–এই অবস্থা কেনো তোর? মোশন সিকনেস এখনো ঠিক হয়নি তোর? চেনাও যাচ্ছে না।
একের পর এক বলেই যাচ্ছে আবরার।
মাথা নাড়িয়ে না বলে মিতা।
–আয় আর টেনশন নেই, তোর আরিয়ান আছে। কথাটা বলেই মিতাকে আবারও জড়িয়ে ধরে আবরার। মিতাও আবরারকে জড়িয়ে ধরে। নিজের শক্তি ছেড়ে দেয় আবরারের উপর।
অরিয়ন একটু দূর থেকে সবই দেখে যাচ্ছে। কিন্তু অরিয়ন যেন মিনিটের জন্যও ওদের থেকে নজর সরাতে পারছে না। অরিয়নের নজর গিয়ে আটকায় যেখানে আবরারের হাত মিতাকে স্পর্শ করেছে সেখানে। নিজের অজান্তেই ব্রিফকেস শক্ত করে ধরে অরিয়ন।
–স্যার ব্যাগ।
হঠাৎ করে ড্রাইভার বলে উঠে।
ড্রাইভারকে ব্যাগ দিয়ে আবারও তাকায় আবরার আর মিতার দিকে। এখনো দু জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। দু জনের মুখেই প্রকৃত হাসি ফুটে আছে।
–এখানে তোর বড় ভাই অপেক্ষা করছে আর তুই কাজিন নিয়ে পরে আছিস।
কেমন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে কথাটা বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় মিতা আর আবরার। অরিয়ন এভাবে কথাটা বলবে তা যেন বিশ্বাস করছে পারছে না দু জনের একজনও।
–এমন ভাব করছিস যেন এই পৃথিবীতে আর কেউ কোনোদিন প্লেনে উঠেনি আর অন্যকারো মোশন সিকনেস হয় না।
কথাটা বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে গাড়ির দিকে হাটা শুরু করে অরিয়ন।
–তুই ঠিক ই বলিস, ও একটা পেঁয়াজ। মানুষকে শুধু কান্না করাতেই পারে আর কিছুই পারেনা।
মন খারাপ করে থাকা মিতার দিকে তাকিয়ে বলে আবরার।
–আয় মন খারাপ করিস না। বাসায় গিয়ে পেঁয়াজ আলীকে বাবা থেকে বকা খাওয়াবো দেখিস।
আবরার কথাটা বলতেই ফিক করে হেসে দেয় মিতা।
–চলো।
বলে মিতা।
****************
গাড়ির পেছনের সিটে মিতা আর অরিয়ন বসেছে। মিতার সামনা সামনি ড্রাইভিং সিটের পাশে বসেছে আবরার। অরিয়ন চুপ করে থাকলেও মিতা আর আবরার এক মিনিটের জন্যও চুপ হচ্ছে না। প্যারিসে কি কি দেখেছে, কি কি খেয়েছে, কোনটা দেখতে কেমন সব কিছু খুলে বলছে আবরারকে।
–জানো, লুভর মিউজিয়াম অনেক সুন্দর। আরিয়ান ভাইয়া, তুমি কি জানতে? আইফেল টাওয়ারের উপরে উঠা যায়?
প্রশ্ন করে মিতা।
–তাই নাকি? আমি তো জানতাম ই না।
বলে আবরার।
আবরারের কথা শুনে যেন আরও রাগ হচ্ছে অরিয়নের। কি দরকার মিথ্যা বলার তা বুঝে না অরিয়ন। আবরার আরও অনেক আগেই বন্ধুদের সাথে প্যারিস ঘুরে গেছে, তাও জানেনা বলছে।
–তুমি সাথে থাকলে অনেক ভালো হতো। আর সব কিছু দেখাও হলো না, চলে আসতে হলো।
মন খারাপ করে বলে মিতা।
–নেক্সট বার তোকে নিয়ে আমি যাবো, সব ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।
বলে আবরার।
–তাই নাকি? খুব মজ…
–চুপ, একদম চুপ। আরিয়ান কি তোর ছোট? নাকি তোর সমান? বড়দের সামনে কথা কম বলতে হয় জানিস না? সেই কখন থেকে দেখছি বকবক করে যাচ্ছিস।
রাগান্বিত অরিয়ন চেচিয়ে উঠে মিতাকে উদ্দেশ্য করে। মিতা ভয়ে নিজের জায়গায় লাফিয়ে উঠে।
–কিন্তু…
–আর একটা কথা বলবি তো দুই গালে দুইটা চর মারবো।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।
–অরিয়ম ভাইয়া, কি হয়েছে তোর? ওর সাথে এমন করছিস কেন?
অরিয়নের রিয়েকশন বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে আবরার।
–চুপচাপ গাড়িতে বস, না হয় এখন গাড়ি থেকে বের করে দিবো।
কড়া কন্ঠে বলে অরিয়ন।
–আজব।
বলেই রাস্তায় দিকে তাকায় আবরার।
মিতার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। অরিয়ন কোনোদিন মিতাকে বকাও দেয়নি আর আজ বললো চর মারবে। চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে মিতা। মিতা যে কাঁদছে তা ঠিকি বুঝতে পেরেছে অরিয়ন। মিতার চোখের পানি দেখে অরিয়নেরও মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু অতোটাও মন খারাপ হয়নি যতোটা মিতাকে আবরারের সাথে হাসি-খুশি ভাবে কথা বলতে দেখে হয়েছিলো।
কি এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে মিতার জন্য তা বুঝতে পারছে না অরিয়ন কিন্তু তার ফলাফল যে মিতার জন্য ভালো হবে না তা ঠিকি বুঝতে পারছে অরিয়ন। নাকি অরিয়নের পরীর জন্য?
চলবে……
#পারমিতা
#পর্ব_২০
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
অরিয়ন আর মিতার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে বাড়িতে অপেক্ষা করছে সবাই। আজ সকালেই ওয়াহিদ চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী ও চলে এসেছে এই বাড়িতে। গতকাল রাতে অরিয়ন থেকে গাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা শোনার পর থেকে কেউ এক মিনিটের জন্যও নিশ্চিন্তে থাকতে পারেনি।
বাড়ির গেটের সামনে কালো গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় মায়া চৌধুরী ও আনিকা চৌধুরী।
আবরার গাড়ি থেকে নামতেই তাড়াহুড়ো করে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় আনিকা চৌধুরী। অরিয়ন আর মিতাও নেমে আসে এরপর।
–কি অবস্থা তোর বাবা? কোথাও আঘাত লাগেনি তো?
অরিয়নকে জড়িয়ে ধরে বলে আনিকা চৌধুরী।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মায়া চৌধুরী মিতাকে দেখতেই স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ছাড়ে।
মিতাও মায়া চৌধুরীকে দেখতেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
–মা।
–কেমন আছে আমার মেয়েটা? কোথাও ব্যাথা পায়নি তো?
মিতাকে জড়িয়ে ধরতেই কেঁদে ফেলেন মায়া চৌধুরী।
–না মা, কিছুই হয়নি আমার। কান্না করছো কেনো?
মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে মিতা।
–কই না তো, কান্না করছি না আমি। তোমার কি অবস্থা অরিয়ন? ওদের সম্পর্কে কোনো খোজ পেলে?
মিতাকে জড়িয়ে ধরে অরিয়নের উদ্দেশ্যে বলে মায়া চৌধুরী।
–না চাচি।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–এই ঠান্ডায় কি সব কথা বাইরেই করবে নাকি ভিতরেও যাবে?
সবার উদ্দেশ্যে বলে আবরার।
–হ্যাঁ বাবা, ভিতরে চল।
আনিকা চৌধুরী বলে।
সবাই মিলে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।
ড্রয়িং রুমেই বসে আছে হাবিব চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরী। দু জনে মিলে গভীর আলোচনায় মগ্ন। সবাইকে আসতে দেখেই চুপ হয়ে গেলো দুজনে।
–বাবা।
দৌড়ে গিয়ে ওয়াহিদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে মিতা।
–কেমন আছে আমার মিতা মামুনি?
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–আমি ভালো আছি বাবা। বাবা প্যারিস অনেক সুন্দর, আমরা অনেক কিছু দেখেছি। আর তোমাদের জন্যও অনেক কিছু এনেছি আমি।
–উহু উহু উহু।
মিতার কথা শুনেই একটু কাশি দিয়ে উঠে অরিয়ন। কাশি শুনতে পেয়ে অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা।
–না মানে আমরা এনেছি বাবা।
বলে মিতা।
মিতার কথা শুনে সবার মুখেই হাসি ফুটে উঠে, শুধুমাত্র আনিকা চৌধুরী ছাড়া। আনিকা চৌধুরী যেন কথাটা শুনে আরও বিরক্ত হলো। ভ্রু কুচকে রইল।
–এখানে কিন্তু আমিও আছি।
হাবিব চৌধুরী বলে উঠে।
–কেমন আছো বড় চাচ্চু?
হাবিব চৌধুরীর কাছে গিয়ে হেসে বলে মিতা।
–ভালো, তুই কেমন আছিস? প্যারিস সুন্দর তাই না?
বলে হাবিব চৌধুরী।
–হ্যাঁ অনেক সুন্দর।
জবাব দেয় মিতা।
–তোমাদের হাসি তামাশা শেষ হলে আসল কথায় আসবে?
বলে উঠে আনিকা চৌধুরী।
–আমার ছেলেটা মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে, কীভাবে সবাইকে ধরবে তা নিয়ে কথা না বলে তোমরা আছো আনন্দে।
সোফায় বসতে বসতে বলে আনিকা চৌধুরী।
–শায়লা, পরীকে ওর রুমে নিয়ে যাও। ও অনেক ক্লান্ত।
বলে অরিয়ন।
–আমিও এখানে থাকবো।
বলে মিতা।
–যা বলেছি তা করো শায়লা।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে অরিয়ন।
শায়লা আর কোনো কথা না বলে মিতাকে ধরে উপরে নিজের রুমের নিয়ে যায়। মিতা মন খারাপ করে শায়লার সাথে চলে যায়।
***************
–তুই শিউর গাড়িটা ওদের ই ছিলো?
প্রশ্ন করে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–হ্যাঁ চাচ্চু।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–আমি সবার জন্য বডিগার্ড এর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বিশেষ করে আরিয়ান আর পরীর জন্য।
আবারও বলে অরিয়ন।
–আমার কেনো লাগছে বডিগার্ড?
বলে আবরার।
–কারণ তুই বাইরে যাস।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–ওরা যেহেতু প্যারিস যেতে পেরেছে তার মানে ওরা প্রতিনিয়ত আমাদের ফলো করছে। আমি আইজিপি এর সাথে কথা বলবো।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আমিও বাড়ি,অফিস আর কলেজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–মিতাকে কিছুদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে নি..
–না।
মায়া চৌধুরী তার কথা শেষ করার আগেই অরিয়ন বলে উঠে।
অরিয়নের হঠাৎ এমন জবাবে সবাই অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।
–মানে বলছিলাম যে, এই বাড়িটা কখনো খালি থাকে না। কেউ না কেউ থাকেই। ঐ বাড়িতে তো ও একা থাকবে, সেইফটি নিশ্চিত করা না পর্যন্ত ও এখানে থাকলে ভালো হতো।
বলে অরিয়ন।
–কিন্তু..
–আমার মনে হয় অরিয়ন ঠিক বলছে মায়া। এখন আমাদের ভেবে চিন্তে কাজ করতে হবে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–আমি ও একমত ওয়াহিদের সাথে।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–মিতাকে তাহলে এখন থেকে আমি কলেজ নিয়ে যাবো আর আসবো।
হুট করে বলে উঠে আবরার।
–ঠিক আছে। তাই হবে।
অরিয়ন কিছু বলার আগেই হাবিব চৌধুরী সম্মতি দেয়।
–এসব কথা পরেও বলা যাবে, তুই বাবা রেস্ট করে নে একটু।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–আনিকা আপা ঠিক বলেছে। অনেকটা পথ জার্নি করেছো, তুমি রেস্ট নেও অরিয়ন।
বলে মায়া চৌধুরী।
–ওকে।
বলে অরিয়ন।
******************
বিছানায় শুয়ে আছে অরিয়ন। মাঝরাতে সব কিছু অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। এই অন্ধকারটা যেন শুধু ঘরকেই ঘিরে রাখেনি, অরিয়নের জীবনটাও ঘিরে রেখেছে। শরীর এতোই ক্লান্ত যে হাত পা প্রচুর ব্যাথা করছে অরিয়নের তাও দু চোখের পাতায় ঘুম নেই। চোখ বার বার শুধু বেডের অপর পাশে যাচ্ছে। একদিন আগেও অরিয়নের সাথেই একই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলো মিতা। কিন্তু আজ? অরিয়নের কেনো অস্থিরতা কাটছে না বুঝতে পারছে না অরিয়ন।
নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় ঠোঁটে। মনে হচ্ছে এই ঠোঁটে এখনো মিতার স্পর্শ অনুভব করছে অরিয়ন। “এসব কি ভাবছি আমি?” কথাটা ভাবতেই লাফিয়ে উঠে অরিয়ন। লাইট অন করেই তাকিয়ে থাকে আফরিনের বিশাল ছবিটার দিকে। আগে যতোবার বিজনেস বা অন্যকোনো সমস্যায় অরিয়নের অস্থিরতা অনুভব হতো তখন আফরিনকে বা আফরিনের ছবিটার দিকে তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যেত অরিয়নের, কিন্তুএখন যখন আফরিনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল তখন যেন অস্থিরতা আরও বেড়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে অরিয়নের।
কিছু বুঝে উঠে আগেই যেন নিজে নিজে রুম থেকে বের হয়ে মিতার রুমের দিকে হাটা শুরু করলো অরিয়ন। মিতার রুমের কাছাকাছি যেতেই থেমে যায় অরিয়ন। দরজা খোলার শব্দ পেতেই ঘাবড়ে যায় অরিয়ন। মিতার উপর অজানা কোনো বিপদ নয় তো? কথাটা ভাবতেই যেন হাত পা কাঁপতে শুরু করলো অরিয়নের। তাড়াহুড়ো করে দরজার সামনে যেতেই দেখে আবরার রুম থেকে বের হচ্ছে। এতো রাতে আবরারকে মিতার রুমে দেখে চমকে যায় অরিয়ন।
–তুই এতো রাতে এখানে?
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।
–ফা*..তুই?
হঠাৎ করে অরিয়নের শব্দ পেয়ে ভয়ে লাফিয়ে উঠে আবরার।
–ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
বড় করে শ্বাস ছেড়ে বলে আবরার।
–এখানে কি করছিস তুই?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–এসেছিলাম মিতাকে দেখতে। সব ঠিক আছে নাকি তাই। তুই এখানে কেনো?
প্রশ্ন করে আবরার।
–অস্থির লাগছিলো তাই বের হয়েছিলাম।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–ওহ, আচ্ছা গুড নাইট।
কথাটা বলেই নিজের রুমের দিকে হাটা শুরু করে আবরার।
–আরিয়ান!
ডাক দেয় অরিয়ন।
–জ্বি?
–পরী এখন আর ছোট না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের রুমে যখন তখন প্রবেশ করা ঠিক না। আশা করি নেক্সট টাইম কথাটা মাথায় থাকবে।
অরিয়ন কথাটা যে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো না তা আবরারের বুঝতে বিশেষ কোনো জ্ঞানী মানুষ হতে হয়নি। মুখে গম্ভীরতা প্রকাশ পাচ্ছে, কণ্ঠে নেই কোনো কোমলতা। আবছা আলোয় সবটা ভালো করে বুঝতে না পারলেও অরিয়নের কথাটা একদম ভুলও মনে করলো না আবরার।
–মনে থাকবে।
কথাটা বলেই নিজের রুমে চলে যায় আবরার।
অরিয়ন নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। দু হাত মুঠ করে ধরেছে। হাতের রগগুলো স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে। দাঁতে দাঁত চাপতেই স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে। আবরার নিজের রুমের দরজা লক করতেই অরিয়ন মিতার রুমের দিকে হাটা শুরু করে।
দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে অরিয়ন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আজ রুমের ডীম লাইটটাও অফ করা। দরজায় দাঁড়িয়েই পাশে থাকা সুইচ অন করতেই পুরো ঘর আলোকিত হয়ে যায়। বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মিতা। কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পরণে টপস আর স্কার্ট। কিন্তু যা অরিয়নের মাথা খারাপ করে দিলো তা হলো স্কার্টটা অনেকটা উপরে উঠে আছে। ঘুমন্ত মিতা নড়াচড়া করায় কখন স্কার্ট উপরে উঠেছে বুঝতে পারেনি। স্কার্ট দিয়ে হাটু পর্যন্ত ঢাকা কিন্তু তার নিচের পা বের হয়ে আছে।
“স্কার্ট উপরে,আবরার, রুমে” কথাটা ভাবতেই কি হলো জানা নেই অরিয়নের। নিজের গায়ের স্বমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে লাগায় অরিয়ন।
–কে? কে? কে? কে?
বিকট শব্দে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে মিতা।
হার্টবিট যেন বিদ্যুতের গতিতে চলছে মিতার।
ঘুম ঘুম চোখে অরিয়নকে নিজের রুমে দেখে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না মিতার। স্বপ্ন ভেবে চোখ ডলে আবারও তাকায় অরিয়নের দিকে।
–অরিয়ন ভাইয়া তু…
–ঠাসসসসসসসস।
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই দু কদমে মিতার সামনা-সামনি এসে মিতার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় অরিয়ন।
কি হলো মিতা যেন কিছুই বুঝে উঠার সময় পেলো না। অরিয়ন এতো জোরে থাপ্পড় মেরেছে মনে হচ্ছে কেউ গাল থেকে খাবলে মাংস তুলে নিয়েছে। ২ মিনিটের জন্য যেন চোখেমুখে অন্ধকার দেখলো মিতা।
–অরিয়ন ভা..
–আহহ।
মিতা আবারও কথা বলার আগেই অরিয়ন নিজের বাম হাত দিয়ে মিতার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে, ব্যাথায় শব্দ করে উঠে মিতা।
কি হচ্ছে মিতা কিছুই বুঝতে পারছে না। গালের ব্যাথা অনুভব করার আগেই যেন মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে। এতো জোরে চুল টেনে ধরেছে মনে হচ্ছে চামড়াসহ ছিড়ে আসবে চুল। অরিয়ন চুল ধরেই মিতার মুখ নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
–হো*র হতে মন চাচ্ছে তোর,তাই না?
দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।
–অরিয়ন ভাইয়া।
অরিয়নের কথা শুনেই রাগ উঠে যায় মিতার। একে তো কোনো কথা ছাড়াই গায়ে হাত তুলেছে তার উপর কি সব আজেবাজে কথা বলছে।
–কি? গায়ে লাগছে? হো*রদের মতো দরজা খুলেই ঘুমাস, যেন যে কেউ এসে একবার তোকে দেখে যেতে পারে?
মিতার চুল আরও জোরে টেনে ধরে বলে অরিয়ন।
–কথা সাবধানে বলবে।
অরিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বলে মিতা। দু চোখে যেন আগুন ঝরছে মিতার।
–শরীর দেখানোর অনেক শখ হয়েছে তোর তাই না?
–কি সব আজেবাজে বলছো তুমি।
মিতার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। নিজের হাত দিয়ে অরিয়নের হাত ধরে চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করে।
–ছাড়ো, লাগছে আমার।
বলে উঠে মিতা।
–আমার এটেনশন না পেয়ে এখন আরিয়ানের পিছনে লেগেছিস?
কথাটা ভাবতেই যেন অরিয়নের মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। বার বার শুধু মিতাকে শাস্তি দিতে মন চাচ্ছে।
–কিহ? আহ, ব্যাথা পাচ্ছি আমি অরিয়ন ভাইয়া। তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না। ছাড়ো আমাকে।
চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে মিতার।
–তুই কবে থেকে এমন হয়ে গেলি পরী?
মিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–আমি আবার কেমন হয়ে গেলাম? আরিয়ান ভা..
–চুপ। তোর মুখ দিয়ে আরিয়ানের নাম নিবি না।
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।
–কি করেছি আমি? এরকম করছো কেনো?
কাঁদতে কাঁদতে বলে মিতা।
–কি করেছিস তুই? ইউ আর বিহেভিং লাইক এ ফা*কং হো*র।
চেচিয়ে বলে উঠে অরিয়ন।
–শরীর দেখাবি তাই তো? দেখি, দেখা আমাকে..
কথাটা বলেই মিতার চুল ছেড়ে দেয় অরিয়ন।
অরিয়ন চুল থেকে হাত সরাতেই মিতা নিজের হাত নিয়ে মাথায় ঘসতে থাকে, ব্যাথা কিছুটা কমানোর জন্য। কি সব হচ্ছে মিতার সাথে কিছুই বুঝতে পারছে না মিতা। একটু আগেই তো আবরারের সাথে কথা বলছিলো মিতা। আবরার রুম থেকে বের হতেই শুয়ে পরে মিতা। বার বার ঝিমাচ্ছিলো বলেই আবরার চলে যায়। বিছানায় শুতেই চোখ লেগে যায় মিতার। এতো জার্নি করায় প্রচুর ক্লান্ত ছিলো।
মিতার রুহ কেঁপে উঠলো যখন অরিয়নের হাত মিতার স্কার্ট গিয়ে স্পর্শ করলো। নিমিষেই মিতা নিজের হাত দিয়ে অরিয়নের হাত ধরে ফেলে।
–কি করছো তুমি এসব।
চোখ বড় বড় করে বলে মিতা।
–শরীর দেখছি।
মিতার দিকে তাকিয়ে রেগে বলে অরিয়ন।
কথাটা বলেই স্কার্ট উপরে তুলতে নিতেই মিতা তা টেনে ধরে।
–তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? ছাড়ো বলছি।
স্কার্ট ধরে টানতে টানতে বলে মিতা।
–তোর ইচ্ছেটা পূরণ করছি, আমার এটেনশন পাচ্ছিস।
মিতার স্কার্ট টানতে টানতে বলে অরিয়ন।
–কি সব আজেবাজে বলছো তুমি। ছাড়ো বলছি অরিয়ন ভাইয়া।
অনুরোধের সুরে বলে মিতা।
–কি দরকার এতো অভিনয় করার পরী? তোর এটেনশন পাওয়ার জন্য আরিয়ানের প্রয়োজন নেই, আমি আছি তো। আমি তোর সব ইচ্ছা পূরণ করে দিবো।
তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বলে স্কার্ট ধরে টান দিতেই হাটুর একটু উপরে উঠে যায় স্কার্ট।
মিতা অবাক হয়ে নিজের হাটু আর স্কার্টের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন যখন মিতার হাটু বের হয়ে আছে তখন যেন অরিয়নও নিজের জায়গায় পাথর হয়ে রইল। কি করছিলো তা যেন মাথায় এতোক্ষণে ঢুকলো।
–প..
–ঠাসসসসসস।
অরিয়ন কথা বলার আগেই থাপ্পড় মারে মিতা।
যদিও মিতার ছোট্ট হাতে থাপ্পড়টা অরিয়নের কাছে কিছুর মতোই লাগলো না তাও রাগে ফুসতে লাগলো অরিয়ন। মিতার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকাতেই মিতা ভয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে। বিছানার এক কোণায় চলে যায়। গুটি মেরে বসে থাকে। অরিয়নের গায়ে হাত তুলেছে তা যেন নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না মিতা।
–সরি, সরি, আমি..মারতে চাই নি…তুমি….তুমি কাপড়…হাটু….উপরে…সরি, সরি।
মিতা ভয়ে ভয়ে আবল তাবল বলতে লাগলো।
অরিয়নকে দেখে মনে হচ্ছে এখুনি আবারও এসে চর মারবে মিতাকে। তখনের চরে এতোই ব্যাথা পেয়েছে যে ভয়ে কাঁপছে মিতা। এখন তো অরিয়নের গায়েই হাত তুলেছে এখন কি হবে তা ভাবতেই আরও বেশি কাঁপছে মিতা।
–সরি, সরি, সরি।
বার বার বলে যাচ্ছে মিতা।
অরিয়ন নিজের জায়গায় তাকিয়ে কাঁপতে থাকা মিতাকে দেখছে। অরিয়নের পরী, অরিয়নকে দেখে এভাবে কাঁপতে থাকবে তা যেন কল্পনাও করেনি অরিয়ন। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মিতার গায়ে কোনোদিন একটা টোকাও দিতে দেয়নি অরিয়ন আর সেই অরিয়ন নিজেই মিতার গায়ে হাত তুলেছে। কারণ? কারণ এক অজানা ভয়। ভয় পরী অন্যকারো হয়ে গেলে?
সব সময় আফরিনকে ছাড় দেওয়া, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে দেওয়া অরিয়ন কবে থেকে এমন হয়ে গেলো? ওয়েস্টার্ন ড্রেস আফরিন সব সময় পরে এসেছে, অরিয়নের তো তখন এমন লাগেনি। তাহলে সামান্য একটু পা অন্য কেউ দেখেছে ভাবতেই কেনো সবকিছু চুরমার হয়ে গেলো অরিয়নের?
অরিয়ন আর কিছু না বলেই মিতার রুম থেকে বেরিয়ে পরে। বিছানায় বসে থাকা মিতা, অরিয়নকে রুম থেকে বের হতে দেখেই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। কাঁপা কাঁপা শরীরে দৌড়ে গিয়ে দরজা লক করে। দরজা লক করতেই মাটিতে বসে পড়ে মিতা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কি হয়েছে,কি জন্য অরিয়ন এমন করলো তা কিছুই জানেনা মিতা। কিন্তু যা মিতা জানে তা হলো অরিয়নের এই ভয়ানক রূপ।
যেই ভয়ানক রূপ মিতা কখনো আগে দেখেনি। যে রূপ দেখলে মিতা কখনোই অরিয়নকে ভালোবাসতো না।
চলবে….
#পারমিতা
#পর্ব_২১
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
আজ শুক্রবার। পুরো বাড়ি জুরে সবাই ঘুমাতে ব্যস্ত। ৯ টা বেজে গেলেও বাড়ির কাজেরলোক ছাড়া কেউ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।
বিছানার উপর বসে আছে আনিকা চৌধুরী। হাতে একটা ফটো এলবাম। এলবামে অরিয়ন,আর আবরারের ছোটবেলার ছবি থেকে এখনের ছবি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আনিকা চৌধুরীর পাশেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হাবিব চৌধুরী। আনিকা চৌধুরী এলবামটা ড্রয়ারে রেখে নিজের কাঁপা কাঁপা হাতে হাবিব চৌধুরীর বালিশের নিচে হাত দেয়। একটু পরেই হাতে করে নিয়ে আসে একগোছা চাবি। ধীরে ধীরে আলমারির কাছে গিয়ে হাবিব চৌধুরীর লক করা ড্রয়ার খুলতে চাবি প্রবেশ করায়।
–আনিকা।
পেছন থেকে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
হঠাৎ করে হাবিব চৌধুরীর কণ্ঠ শুনে লাফিয়ে উঠে আনিকা চৌধুরী। পরক্ষণেই চোখে পানি চলে আসে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে বলতে থাকে “কেনো আর কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলো না হাবিব”।
চাবি হাতে নিয়ে হাবিব চৌধুরীর দিকে ফিরে আনিকা চৌধুরী, চোখের কোণে পানি জমেছে। চোখ তুলে হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে অনুরোধের দৃষ্টিতে কিছু বোঝাতে চাইলো। হাবিব চৌধুরী বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে আনিকা চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের হাত দিয়ে আনিকা চৌধুরীর হাত থেকে চাবিটা নিতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো আনিকা চৌধুরীর।
–অতীত ভুলে যাও আনিকা।
আনিকা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে হাবিব চৌধুরী।
হাবিব চৌধুরী জড়িয়ে ধরতেই হাওমাও করে কাঁদতে লাগলেন আনিকা চৌধুরী।
———————-
মিতা নিজের রুমে মাটিতে বসা অবস্থায় দরজার সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। গতকাল রাতে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ডান পাশের গালে ৫ আঙ্গুলের ছাপ এখনো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সাদা ধবধবে শরীরে আঙ্গুলের ছাপ কালচে দাগের মতো ফুটে আছে।
সকাল ১০ টা।
ডাইনিং টেবিলে সবার জন্য নাস্তা রেডি করে রেখেছে শায়লা। হাবিব চৌধুরী সোফায় বসে নিউজপেপার পড়ছেন। ওয়াহিদ চৌধুরী পাশেই বসে চা খাচ্ছেন আর বড় ভাইয়ের সাথে মাঝে মধ্যে দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলছেন।
মায়া চৌধুরী আর আনিকা চৌধুরী ডাইনিং টেবিলে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছেন।
–শায়লা আমাকে নাস্তা দেও।
আবরার টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে বলে।
–একটু অপেক্ষা কর, অরিয়ন আসছে এরপর একসাথেই নাস্তা করিস।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–ওহ হো মা,তোমার রাজপুত্রের জন্য এখন নাস্তাও খাওয়া যাবে না। তো মহারাজ আসবে কখন?
–বড় ভাইয়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তা কি ভুলে গেছিস আরিয়ান?
সোফার থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
–ওহ হাবিব, তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করো।
বলে আনিকা চৌধুরী।
–ঠিক ভাইয়া। আপনি কিন্তু ঠিক এভাবেই ওয়াহিদের সাথে লেগে থাকতেন।
কথাটা বলেই হেসে ফেলে মায়া চৌধুরী।
মায়া চৌধুরীর কথায় সকলেই হেসে ফেলে।
–শায়লা, মিতাকে ডেকে আনো।
বলে মায়া চৌধুরী।
–আর ডাকতে হবে না, আমি চলে এসেছি।
ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে মিতা।
মিতার পড়নে আজ সাদা রঙের কামিজ। চুল ডানপাশে এনে নিজের গাল লুকিয়ে রেখেছে। হাসতে হাসতে মায়া চৌধুরীর পাশে গিয়ে বসে মিতা।
–গুড মর্নিং এভরিওয়ান।
বলে মিতা।
–গুড মর্নিং।
সকলেই জবাব দেয়।
–খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা, কি আছে তাড়াতাড়ি দেও।
একটু বেশি আগ্রহ নিয়ে বললো মিতা।
সকাল সকাল বিনা কারণে মিতাকে এতোটা প্রফুল্ল দেখে মায়া চৌধুরীর মনটা যেন কেমন করে উঠলো। সব কিছু ঠিক মনে হচ্ছে না মায়া চৌধুরীর। মিতার দিকে ভালো করে তাকিয়ে রইল। সব সময় বড় চুল নিয়ে বিরক্ত হওয়া মিতা আজ সকাল সকাল কেনো চুল খুলে রেখেছে তাও বুঝতে পারছে না মায়া চৌধুরী।
–এইতো অরিয়ন ও চলে এসেছে। চলো, চলো নাস্তা শুরু করা যাক।
ওয়াহিদ চৌধুরী বলে।
সকলে ডাইনিং টেবিলের কাছে চলে আসতেই মিতা নিজের চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ওয়াহিদ চৌধুরীকে জায়গা দেয়। নিজে গিয়ে বসে তার পরের চেয়ারে। মিতার মুখোমুখি বসেছে আবরার আর আবরারের ডানপাশের সিট খালি রাখা অরিয়নের জন্য।
অরিয়ন যতো টেবিলের দিকে আগাচ্ছে মিতার ভয় যেন ক্রমাগত ততোই বেড়ে চলেছে। না চাইতেও হাত পাঁ কাঁপছে মিতার। নার্ভাসনেসের কারণে অনবরত পা নাচিয়ে যাচ্ছে মিতা। আড় চোখে অরিয়নের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় কফি কালারের একটা টি শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পড়া। বাম হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকানো আর ডান হাত, ডান হাত দেখতেই যেন অবাক হলো মিতা। ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা। “গতকাল রাতেও তো ঠিক ছিলো” মনে মনে ভাবে মিতা।
অরিয়ন আবরারের পাশের চেয়ারে বসতেই নজর যায় মিতার দিকে। মিতা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে উপরের দিকে তাকালেই হয়তো কেউ শাস্তি দিবে। কারণটা ভালোই জানে অরিয়ন। নিজের অজান্তেই ডান হাত মুঠ করে ধরে অরিয়ন।
সবাই নাস্তা খাওয়া শুরু করতেই লক্ষ্য করে অরিয়নের হাতের ব্যান্ডেজ।
–হাত কাটলো কিভাবে?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।
–উনাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো শায়লা?
শায়লার সাথে একজন লোক দেখে প্রশ্ন করে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–অরিয়ন স্যারের রুমে। বেসিনের আয়নাটা ভেঙ্গে গেছে তা ঠিক করাতে।
জবাব দেয় শায়লা।
–আয়না ভাঙ্গলো কীভাবে? আর হাত? হাত কাটলো কিভাবে?
প্রশ্ন করতে থাকে আনিকা চৌধুরী।
–পা পিছলে পড়ে যেতে নিয়েছিলাম। আয়না ধরতেই ভেঙ্গে হাত কেটে গেছে।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–এটা আবার কখন হলো? গতকাল রাতেও তো ভালো দেখলাম যখন মিতা..
কথাটা বলতে নিতেই বড় বড় চোখ করে আবরারের দিকে তাকায় অরিয়ন। চুপ হয়ে যায় আবরার।
সকলেই কেমন যেন সন্দেহের চোখে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। খাবার খেতে খেতেই অরিয়ন মিতার দিকে তাকালেও মিতা যেন একবারও চোখ তুলে উপরে তাকালো না। প্রতিনিয়ত ডান হাতে শক্তি প্রয়োগ করায় আবারও রক্ত বের হতে শুরু করেছে অরিয়নের হাত থেকে,তাও যেন অরিয়নের চোখ মিতার থেকে সরছে না।
–অরিয়ন, তোর হাত থেকে আবারও রক্ত বের হচ্ছে বাবা।
ঘাবরে গিয়ে বলে আনিকা চৌধুরী।
–আমার খাওয়া শেষ।
বলেই টেবিলে থেকে উঠে চলে যায় অরিয়ন।
–আমি যাচ্ছি হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে।
বলেই টেবিল থেকে উঠে যেতে নেয় আনিকা চৌধুরী।
–ওয়েট, আনিকা।
আনিকা চৌধুরীর হাত ধরে বলে হাবিব চৌধুরী।
–এসব কাজ অরিয়নের স্ত্রীর।
আবারও বলে হাবিব চৌধুরী।
হাবিব চৌধুরীর কথা শুনে কাশতে থাকে মিতা।
–আমি কেনো!
আমতা আমতা করে বলে উঠে মিতা।
–কারণ তুই ওর ওয়াইফ।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–হাবিব, তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। অরিয়ন আমার ছেলে। ওর উপর আমার অধিকার বেশি।
রেগে বলে আনিকা চৌধুরী।
–হাবিব ভাই, আপাকে যেতে দিন।
বলে মায়া চৌধুরী।
–সব জায়গায় এখন আর আনিকা থাকতে পারবে না তা বুঝতে হবে ওকে, মায়া। মিতা নিজের দায়িত্ব পালন কর। যা।
বলে হাবিব চৌধুরী।
আনিকা চৌধুরী আর কোনো কথা না বলে মিতার দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে রইল।
*****************
অরিয়নের রুমের দরজার সামনে ফাস্ট এইড কিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। মিতার চোখের সামনে শুধু গতকাল রাতের ঘটনা ঘুরছে। অরিয়নকে এমন ভাবে কোনোদিন ভয় পাবে মিতা তা নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই হাত গিয়ে মিতার ডান গাল স্পর্শ করে।
ব্যাথা অনুভব করতেই হাত সরিয়ে নেয় মিতা। রুমের মধ্যে শায়লা আর মিস্ত্রি আছে ভাবতেই কিছুটা হাফ ছাড়ে মিতা।
“শায়লা আপু আর বাকিদের সামনে কিছু করতে পারবে না, তারা থাকতে থাকতেই ব্যান্ডেজ করে চলে আসবো” মনে মনে ভাবে মিতা। আস্তে করে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে মিতা। অরিয়ন বিছানায় বসে আছে। শায়লা ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রি ঠিক মতো কাজ করছে নাকি তা দেখছে।
মিতা রুমে প্রবেশ করতেই অরিয়ন মিতার দিকে তাকায়। মিতার দিকে তাকাতেই মিতা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে মিতার।
ধীরে ধীরে মিতা অরিয়নের একটু কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। অরিয়নের নজর মিতা থেকে সরছে না। চুলগুলো দিয়ে এখনো ডান গালটা ঢাকা। তার কারণ ভালোই জানে অরিয়ন। হঠাৎ করেই নিজের উপর যেন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অরিয়নের।
–বড় চাচ্চু পাঠিয়েছে।
ধীর কন্ঠে আমতা আমতা করে বলে মিতা।
–অপেক্ষা কর।
জবাব দেয় অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে যেন দম বন্ধ হয়ে আসলো মিতার। বড় বড় চোখে একবার অরিয়ন ও একবার শায়লার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–আমার পড়া আছে, বেশিক্ষণ লাগবে না তো। এখন করে দেই।
একটু এগিয়ে গিয়ে বলে মিতা।
মিতার কন্ঠে যেন ডেস্পারেশন ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না।
–আই সেইড ওয়েট।
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।
মিতার ভয়ে কান্না পাচ্ছে খুব। কেনো ওর সাথেই এমন হয় ভেবে পাচ্ছে না। একদিকে আনিকা চৌধুরী, যার ঘৃণা ভরা দৃষ্টি প্রতিনিয়ত মিতাকে কষ্ট দেয় তার উপর এখন অরিয়নের এই পরিবর্তন।
–আমাদের শেষ।
বলে শায়লা।
–যাবার সময় দরজা লাগিয়ে দিয়ে যেও।
বলে অরিয়ন।
–দরজা কেনো, খোলা থা…।
অরিয়নের কথা শোনা মাত্রই মিতার মুখ থেকে কথাটা বের হয়ে যায়। কিন্তু অরিয়নের দিকে চোখ যেতেই আবারও চুপ হয়ে যায় মিতা।
শায়লা রুম থেকে বের হওয়ার সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে যায়। মিতা নিজের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে মিতা।
–ব্যান্ডেজ কি করবি নাকি দাঁড়িয়েই থাকবি?
মিতাকে নিজের জায়গা থেকে নড়তে না দেখে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনেই তাড়াতাড়ি করে বিছানায় বসে পড়ে মিতা। বক্স খুলে তুলা, সেভলন যাবতীয় জিনিস বের করে নেয়। কেঁচি দিয়ে ব্যান্ডেজ কেটে ধীরে ধীরে খুলতে থাকে মিতা। মিতার নজর যেন অরিয়নের হাত থেকে অন্য কোথাও যাচ্ছে না।
অরিয়ন মিতার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। মিতা খুব সাবধানে কাজ করছে, যেন একটু ভুল হলেই অনেক বড় মাশুল দিতে হবে মিতাকে। কাজ করতে থাকা মিতার হাত যে অনবরত কাঁপছে তা খেয়াল করতেই বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগলো অরিয়নের। নিজের বাম হাত এগিয়ে দিতেই মিতা ভয়ে পিছিয়ে পড়ে। অরিয়নের হাত বাড়াতে দেখে আবারও চর মারবে ভেবে ভয়ে পিছিয়ে পড়ে মিতা। অরিয়ন অজানা এক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিতার গাল থেকে চুল সরিয়ে কানের পিছনে গুজে দেয়। হাতের উলটো পাশ দিয়ে মিতার গালে স্পর্শ করে অরিয়ন। থাপ্পড়ের দাগটা বার বার স্পর্শ করতে থাকে অরিয়ন।
মিতার শরীরে দেওয়া অরিয়নের দাগ দেখে কখনো এমন লাগেনি অরিয়নের। সেই দাগগুলো যেন মিতার প্রতি এক অধিকারবোধ প্রকাশ করতো কিন্তু গালের এই দাগ? এই দাগ বড্ড বেমানান লাগছে মিতার শরীরে। তার থেকেও বেশি নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে অরিয়নের। গতকাল রাতে নিজের রুমে এসে রাগে আয়নায় একের পর এক ঘুষি মারতেই হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় অরিয়নের। সেই ব্যাথাটা যেন কিছুই মনে হচ্ছে না অরিয়নের। ইচ্ছে করছে এই হাতটাই কে*টে ফেলতে,যে হাত মিতার গায়ে উঠেছে।
–তুই বলেছিলি..
হুট করে বলে উঠে অরিয়ন।
অরিয়নের অর্ধেক কথা শুনে অরিয়নের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় মিতা।
–তুই বলেছিলি তুই আমাকে ভালোবাসিস। সত্যি ভালোবাসিস?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।
এতোদিন পর অরিয়ন কেনো এই কথা উঠালো তা মাথায় ঢুকছে না মিতার। হ্যাঁ, মিতা অরিয়নের এই রূপকে অপছন্দ করে, ঘৃণাও করে হয়তো। তবে ভালোবাসা, ভালো তো মিতা সেই মিষ্টি অরিয়নকে বাসে যার জন্য মিতার অনুভূতি একটু ও পরিবর্তন হয়নি। মিতা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়।
–কথাটা ভুলে যাবি না তো?
আবারও প্রশ্ন করে অরিয়ন।
এবার মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।
অরিয়ন আর কোনো কথা বললো না। চুপ করে রইল। মিতাও নিজের কাজে মন দিলো। হাতে ব্যান্ডেজ করা হলে আস্তে করে উঠে যায়।
–পরী?
মিতা দরজার কাছাকাছি যেতেই ডাক দেয় অরিয়ন।
অরিয়নের ডাক শুনে ফিরে তাকায় মিতা। অরিয়ন নিচে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।
–আই এম সো সরি,লাভ। গতকাল রাতে যা হয়েছে তার জন্য।
কেমন যেন এক করুন সুরে বলে উঠলো অরিয়ন।
অরিয়নের এই জিনিসটা সব থেকে বেশি কষ্ট দেয় মিতাকে। এই অসহায়ত্বতা। নিজের আইডল, নিজের সব থেকে পছন্দের মানুষকে এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলে হয়তো মনের মধ্যে সব তছনছ হয়ে যায়?অরিয়নের কণ্ঠ ঠিক এমনটাই শোনা গিয়েছিলো আফরিন চলে যাওয়াতে। মিতার চোখের কোণে যেন পানি নিজে নিজেই চলে আসলো। আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় মিতা।
“ভালোবাসলে কেনো এতো কষ্ট পেতে হবে? কষ্টই যদি পেতে হবে তাহলে ভালোবাসা না থাকলেই কি হতো?” প্রশ্ন জাগে মিতার মনে।
***********************
৩ মাস পর।
সেদিনের পর থেকে অরিয়ন নিজেকে কাজে এতোটাই ব্যস্ত করে দিলো যে একে অপরের সাথে দিনে দু একবার দেখা হয়। মিতাও নিজের পড়ার দিকে মন দিয়েছে, কিছুদিন পরেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু হবে মিতার। সেদিনের পর থেকে মিতা আর একদিনও দরজা খোলা রেখে ঘুমায় নি। আবরার আর দু জন বডিগার্ড মিতাকে সাথে করে কলেজে নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে।
–বাংলা ব্যাকরণ কিছু শেষ করতে পেরেছিস? আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এখন মনে হচ্ছে ইংলিশ গ্রামার থেকে বাংলা গ্রামার বেশি কঠিন।
পড়ার টেবিলে বসে ফোনে কথা বলছিলো মিতা।
–তুই হাসিস না তো, আমার মনে হচ্ছে আমি বাংলায় ফেল করবো।
বলে মিতা।
–হা হা হা, আমি কি স্যার বাংলার জন্য রেখেছি? আমি তো রে…
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিকট শব্দ শুনতেই দূরে ছিটকে পড়ে মিতা। জ্ঞান হারানোর আগে চোখের সামনে দেখতে পায় শুধু আগুন আর আগুন।
——————-
মিটমিট করে চোখ খুলে মিতা। মাথা আর শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে। ভালো করে নড়তেও পারছে না।
–মিতা, মা আমার। কেমন লাগছে তোর এখন? খারাপ লাগছে কোনো? কি হয়েছে বল আমাকে।
মিতাকে চোখ খুলতে দেখেই বলতে থাকে মায়া চৌধুরী।
–প্রচন্ড ব্যাথা।
কোনোমতে জবাব দেয় মিতা।
–ব্যাথা কমে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। বেশি কিছু হতে পারেনি। ভাগ্যিস আরিয়ান তখন নিজের রুমে ছিলো আর শব্দ পেয়েই দৌড়ে তোর রুমে গিয়েছিলো।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–কি হয়েছিলো?
প্রশ্ন করে মিতা।
–এসি ব্লাস্ট করেছিলো। বিছানায় ছিলি না বলেই বেঁচে গিয়েছিস তা না হলে কি যে হতো।
মিতার সামনে আসতে আসতে বলে হাবিব চৌধুরী।
–তুই রেস্ট কর মিতা, কিছু ভাবতে হবে না তোর।
বলে মায়া চৌধুরী।
–হুম।
জবাব দেয় মিতা।
বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম আসছে না মিতার। রুমের দিকে তাকাতেই চিনতে পারলো সাথে সাথে। আবরারের রুমে শুয়ে আছে মিতা। আবরার যদি না থাকতো তাহলে আজ হয়তো মিতাও বেঁচে থাকতে পারতো না। অথচ রুমের কোথাও আবরারকে দেখতে পাচ্ছে না মিতা।
–পরী? পরী?
দরজা খুলেই রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অরিয়ন। টাই আর শার্টের বাটন খোলা। যেভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছে এখানে। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় বসেই মিতার শরীর পরীক্ষা করতে থাকে কোথায় কোথায় ব্যাথা পেয়েছে তা দেখার জন্য।
–কোথায় আঘাত পেয়েছিস? বেশি খারাপ লাগছে? এসিতে কি সমস্যা ছিলো? ফা*, সমস্যা থাকলে আগে কেনো বলিসনি? তোর যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে? কি হয়েছে কথা বল?
একের পর এক অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে অরিয়ন।
মিতা যেন উত্তর দেওয়ার ও সময় পাচ্ছে না। অরিয়ন কেমন যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছে মিতাকে এমন দেখে।
–ভা…ভালো আছি। কিছুই হয়নি।
ধীরে ধীরে বলে মিতা।
–শান্ত হও অরিয়ন, মিতা এখন ভালো আছে। ভয়ের কিছু নেই।
বলে মায়া চৌধুরী।
–হুম।
সায় দিয়েও মিতার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো অরিয়ন।
–তুই..তুই এখন থেকে আমার রুমে থাকবি। আমার সাথে।
হঠাৎ করে বলে উঠে অরিয়ন।
চলবে….