পারমিতা পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
105

#পারমিতা
#পর্ব_২৮
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

হঠাৎ করে অরিয়ন এরকম কিছু করবে তা এক মুহুর্তের জন্যও ভাবেনি মিতা। অরিয়নের ঠোঁট মিতার ঠোঁট স্পর্শ করতেই পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে অরিয়ন। যেন মিতা সরে গেলেই দম বন্ধ হয়ে আসবে অরিয়নের। মিতাও অরিয়নের চুমুতে সারা দেয়। অরিয়নের এই ডেস্পারেশন দেখলে মিতার মনে হয় অরিয়নও মিতাকে চায়। অল্প করে হলেও মিতাকে চায়। আমরা তো তার জন্যই এরকম ডেস্পারেট হই যার জন্য কিছু হলেও অনুভব করি তাই না?

কতক্ষণ একে অপরকে চুমু খেয়েছে কারও জানা নেই। অরিয়নের যখন মনে হলো মিতার জন্য শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে তখন আলতো করে ঠোঁটে চুমু খেয়ে মুখ সরিয়ে আনে। নিজের মাথা গুজে দেয় মিতার গলায়। বড় বড় করে শ্বাস নেয় কতক্ষণ। মিতা নিজের দু হাত দিয়ে অরিয়নকে জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে। নিজের ভালোবাসার মানুষকে এতোদিন পর সামনা-সামনি দেখাটা সহজ বিষয় না, তা ভালোই জানে মিতা।

–শি ইজ ব্যাক।
আস্তে আস্তে বলে অরিয়ন।

–ওরা…ওরা আফরিনকে..
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলেই মিতা থেকে সরে আসে অরিয়ন।

অরিয়নের চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে ফুটে উঠেছে অন্য এক অনুভূতি আফরিনের জন্য। মিতা অন্যকিছু বুঝে উঠার আগেই অরিয়ন রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে যায় অরিয়ন।

–অরিয়ন? কোথায় যাচ্ছো?
অরিয়নের পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে বলে মিতা।

অরিয়ন যেন মিতার কথা শুনলোই না। দ্রুত সিড়ি বেয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে হাটতে থাকে।

–অরিয়ন?
আবারও ডাক দেয় মিতা।

অরিয়ন দ্রুত হেটে চলে যায় ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে স্যুট পরিহিত ব্যক্তিটি। দুধের মতো সাদা ধবধবে তার গায়ের রঙ, চোখগুলো বড় বড়, চুলগুলো জেল দিয়ে পেছনে সেট করা। গলায় আর হাতের কব্জির দিকে ট্যাটু দেখা যাচ্ছে। তার সামনা-সামনি বসে আছে আনিকা চৌধুরী। ওয়াহিদ চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী বসে আছে অন্যপাশে। মায়া চৌধুরীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অরিয়ন যেতেই সকলে নিজেদের কথা বন্ধ করে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।

–আপনি?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–আমার নাম মাইকেল।
ইংরেজিতে বলে লোকটি।

কন্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে লোকটি এশিয়ান, ব্রিটিশ বা আমেরিকান একসেন্টে কথা বলছেন না। “রাশিয়ান” মনে মনে ভাবে অরিয়ন।

–আফরিনকে কোথায় পেলেন? আর কীভাবেই পেলেন?
ইংরেজিতে অরিয়ন প্রশ্ন করে।

অরিয়নের পিছনে এসে দাঁড়ায় মিতা। সকলেই অধীর আগ্রহ নিয়ে অরিয়ন আর মাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিয়নের চোখমুখে এখন গাম্ভীর্যতা ফুটে উঠেছে। আনিকা চৌধুরীর সাথে মিতার চোখাচোখি হতেই যেন ব্যঙ্গাত্মক এক হাসি ফুটে উঠলো আনিকা চৌধুরীর মুখে।

–আফরিনকে আমাদের মেনশনে আনা হয়েছিলো একজন র*ক্ষিতা হিসেবে, আমার বসের জন্য।
জবাব দেয় মাইকেল।

–কিন্তু বসের কোনো র*ক্ষিতার প্রয়োজন ছিলো না। তাই আফরিনকে আবারও পতি*তালয়ে পাঠিয়ে দিতে বলে।
আবারও বলে মাইকেল।

মাইকেলের কথাগুলো যতো শুনছে, অরিয়নের মাথায় যেন ততোই আগুন জ্বলতে শুরু করছে। মিতা অরিয়নের কাছাকাছি এসে অরিয়নের হাত নিজের হাতে নিয়ে নেয়। মিতার স্পর্শ অনুভব করতেই নিজের হাত দিয়ে মিতার হাত শক্ত করে ধরে অরিয়ন।

–বসের আফরিনের প্রতি কোনো আকর্ষন ছিলো না তা আফরিন বুঝতে পারতেই বসকে জানায় সে পতি*তালয়ে ফিরে যেতে চায় না। মেনশনে কাজের লোক হয়ে থাকতেও রাজি আছে। কারণ কি জানতে চাইলে সব খুলে বলে আফরিন।

মাইকেলের কথা যতো শুনছে মিতার হাতের উপর ততোই শক্তি প্রয়োগ করছে অরিয়ন। এতোক্ষণ শক্ত করে হাত ধরে রাখলেও এখন একটু একটু হাতে ব্যাথা অনুভব কর‍তে শুরু করেছে মিতা। নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য যতোই মোচড় দিচ্ছে অরিয়ন যেন ততোই শক্ত করে মিতার হাত ধরে রাখছে।

–আফরিন কি সত্যি বলছে নাকি মিথ্যে তা যাচাই করতে স্যার আমাকে পাঠায় ভা*রত। তদন্ত করে জানতে পারি আফরিন সত্যি বলছে। ওর বন্ধু আর ড্রাইভারকে এপারে আনতেই মে*রে ফেলা হয়েছিলো।

–একজন পতি*তার জন্য একজন মা*ফিয়া বসের এতো মায়া? কারণ কি?
কথাটা বললেও কতটা বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করেছে তা আর কেউ না বুঝলেও মিতা ঠিকি বুঝতে পারছে। হাতের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে,মনে হচ্ছে এক্ষুনি হাড্ডি ভেঙ্গে যাবে। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে মিতার।

–আমরা মাফিয়া হলেও আমাদের একটা নীতি আছে। আমরা নারী ও শিশুদের উপর এটার্ক করি না। হিউম্যান ট্রা*ফিকিংয়ের বিরুদ্ধে আমরা।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে বলে মাইকেল।

–কোথায় আর কে আফরিনকে নিয়ে গিয়েছিলো আমরা তা জানতে চাই। এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে।
ওয়াহিদ চৌধুরী বলে উঠে।

–হাহাহাহাহহা।
শব্দ করে হাসে মাইকেল।

–হাসছেন কেনো?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।

–সাধারণ মানুষের জন্য এসব এতো সহজ? ওদের কেউ ধরতে পারবে না। আর ভিন্ন দেশ হলে তো কথাই নেই। আর আইন কিছুই কর‍তে পারবে না। কারণ আইন চোখে দেখেও অন্ধ।
অনায়াসে কথাগুলো বলে মাইকেল।

–সব কিছু জানার পরও আমরা চুপ করে থাকবো? আফরিন কোনোদিন বাড়িতে নাও ফিরতে পারতো। এরকম হাজারো মেয়ে নিখোঁজ হয়ে আছে। যারা তার নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেনি।
রেগে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–উনার থাকার ব্যবস্থা করো। আর কুমিল্লা বর্ডারের ব্যাপারটা আমি দেখছি। কীভাবে ওদের সামনে দিয়ে মানুষ পা*চার করা হয় সেটাই এখন ওদের বোঝাবো।
আনিকা চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে অরিয়ন।

–সরি, কিন্তু আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আমাকে এক্ষুনি ফিরতে হবে।
বলে উঠে মাইকেল।

–অহ, আচ্ছা।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–তবে..
একটু বলে থামে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–তবে আপনার বসের নামটা জানতে পারি? যার জন্য আমার মেয়ে ফিরে এসেছে তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
আবারও বলে উঠে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–ওয়াহিদ ঠিক বলেছে।
সায় দেয় হাবিব চৌধুরী।

–সাদমান। বসের নাম সাদমান। এর বেশি আর কিছু বলতে পারবো না।
জবাব দেয় মাইকেল।

–ধন্যবাদ। আপনার বসকে বলবেন, তার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–জ্বি, এখন তাহলে যাই।
বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাইকেল।

–জ্বি।
কথাটা বলেই মিতার হাত ছেড়ে দিয়ে মাইকেলের সাথে হাটা শুরু করে অরিয়ন।

***********************

আলমারি থেকে মিতার একসেট জামা বের করে এনেছে মায়া চৌধুরী। বিছানায় শুয়ে আছে আফরিন। তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। জামা নিয়ে আফরিনের কাছে আসতেই লক্ষ্য করেন আফরিনের চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে। সেই মাধুর্যতা কিছুই দেখা যাচ্ছে না চেহারায়। মনে হচ্ছে মেয়ে তার অনেক বড় হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। বিছানার কাছে জামা নিয়ে আসতেই মায়া চৌধুরীর দিকে তাকায় আফরিন। নিজের মাকে এতোদিন পর সামনা সামনি দেখে যেন নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না। আলতো করে এক মিষ্টি হাসি দেয় আফরিন।

–জামাটা পড়ে নে।
জামা এগিয়ে দিয়ে বলে মায়া চৌধুরী।

আফরিন কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে মায়া চৌধুরীর হাত থেকে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। বিছানায় বসে অপেক্ষা করতে থাকে মায়া চৌধুরী।

–মা,ভিতরে আসবো?
বাইরে থেকে দরজায় নক করে অনুমতি চায় মিতা।

–আয়।
আনমনে জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

ধীরপায়ে মায়া চৌধুরীর কাছে গিয়ে বসে মিতা। নিজের দু হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। মিতা জড়িয়ে ধরতেই যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মায়া চৌধুরী।

–কি এমন পাপের শাস্তি আমার মেয়েটা পেলো মিতা? কি এমন পাপের শাস্তি।
কান্না করতে করতে বলে মায়া চৌধুরী।

–কোনো পাপের শাস্তি না মা। এভাবে কেঁদো না। আপু ফিরে এসেছে, তুমি এভাবে কাঁদলে আপু আরও ভেঙ্গে পড়বে।
মায়া চৌধুরীর মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে মিতা। মায়া চৌধুরীকে ভরসা দিলে কি হবে, নিজের চোখ দিয়েও অনবরত পানি পড়ছে মিতার।

ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হতেই মিতাকে ছেড়ে আগের মতো করে বসে মায়া চৌধুরী। তাড়াতাড়ি করে দু জনেই চোখের পানি মুছে নেয়।

–মা, চেইনটা লাগিয়ে দেও।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলে আফরিন।

আফরিনকে দেখে আলতো এক মলিন হাসি দেয় মিতা। আফরিনও বিনিময়ে এক মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দেয়।

–আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
বলেই এগিয়ে যায় মিতা।

মিতাকে এগিয়ে আসতে দেখেই ঘুরে দাঁড়ায় আফরিন। মিতা চেইন ধরতে এগিয়ে যেতেই দু পা পিছিয়ে পড়ে। হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে এলো মিতার। দু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আফরিনের পিঠের দিকে। দু কদমে আফরিনের কাছাকাছি গিয়ে নিজের দু হাত দিয়ে জামা টেনে পিঠ বের করতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতা।

আফরিনের পুরো পিঠ জুরে কাঁটা কাঁটা দাগ। কয়েক জায়গায় দাঁতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ক্ষত গুলো বেশি নতুন না আবার বেশি পুরাতন ও না। মিতার কান্না দেখে দৌড়ে আসে মায়া চৌধুরী। আফরিনের পিঠ দেখে নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দু জনের কান্নার শব্দ আফরিনের কানে যেতেই ঘুরে তাকায় আফরিন। নিজের চোখেও পানি জমেছে।

–কান্না করছো কেনো তোমরা? আমি ফিরে এসেছি তো।
দু জনকে জড়িয়ে ধরে বলে আফরিন।

–তোমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে তা ভাবতেও পারছি না আপু।
কান্না করতে করতে বলে মিতা।

–যা হবার তা হয়ে গেছে। সবার কাছে আমি ফিরে এসেছি তাই অনেক, তুই, মা-বাবা, আফনান সবাইকে ফিরে পেয়েছি আর কি চাই আমার?
কাঁদতে কাঁদতে বলে আফরিন।

“আফনান”। আফরিনের মুখে অরিয়নের নাম শুনে মিতার কষ্ট লাগার কথা ছিলো কিন্তু কষ্ট না লেগে মিতার মধ্যে হঠাৎ করে অপরাধবোধ কাজ করছে। নিজেকে হুট করেই খুব সেলফিশ মনে হচ্ছে মিতার। ছোট বোন হিসেবে কি করেছে মিতা? তাকেই ভালোবেসে ফেলেছে যাকে আফরিন ভালোবাসে, তার সাথে সংসার দেখার স্বপ্ন দেখছিলো যাকে উদ্দেশ্য করে বেঁচে ছিলো আফরিন। ছোটবেলা থেকে নিজের মা-বাবার ভালোবাসা ভাগ করেছে আফরিন, নিজের সব খেলনা, জামাকাপড় শেয়ার করেছে আফরিন। শেষমেশ আফরিনের ভালোবাসার মানুষকেও চেয়ে বসলো মিতা? তাহলে কি আনিকা চৌধুরী ঠিক ই ভাবেন মিতা সম্পর্কে ?

আফরিনের জামায় চেইন লাগানো শেষ হতেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে আফরিন। মায়া চৌধুরী আর মিতা আফরিনের পাশেই বসে আছে। আফরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মায়া চৌধুরী।

–ঘুমানোর একটু চেষ্টা কর, আফরিন।
মায়া চৌধুরী বলে।

–ঘুম তো আমার সেদিনই শেষ যেদিন আর বাড়িতে ঢুকতে পারিনি, মা।
এক দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে আফরিন। দু চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে আফরিনের।

মিতা আর মায়া চৌধুরীর চোখ দিয়েও পানি পড়তে শুরু করেছে।

–আফনান কোথায় মা?
মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আফরিন।

আফরিনের কথা শুনেই মায়া চৌধুরী তাকিয়ে থাকে মিতার দিকে। মিতাও তাকিয়ে আছে মায়া চৌধুরীর দিকে।

–আছে এখানেই।
মাথা নিচু করে জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

–মায়া, চলো খাবার খাবে।
রুমে প্রবেশ করে বলে আনিকা চৌধুরী।

আনিকা চৌধুরীর পিছন পিছন অরিয়নও রুমে প্রবেশ করে। দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অরিয়ন। আনিকা চৌধুরীর কথা শুনে সেদিকে তাকাতেই আফরিনের চোখ যায় অরিয়নের দিকে। মুহুর্তেই আফরিনের চোখে আনন্দ ফুঁটে উঠে। মিতা আফরিনের দিকে তাকিয়ে সবটাই লক্ষ্য করছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরিয়ন আফরিনের দিকে তাকিয়ে আছে মন খারাপ করে। কয়েক ঘন্টা আগেও হাসিখুশি থাকা মিতার সেই রিয়ন কোথায় চলে গেলো মিতা জানেনা। শুধু জানে এতো মানুষের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে মিতার রিয়ন নয়। সে মিতার অরিয়ন নয়। সে মিতার অনিয়ন ভাইয়াও নয়। সে শুধুই আফরিনের আফনান।

–আমি খাবো না আপা, আপনারা খেয়ে নেন।

মায়া চৌধুরীর কথা শুনে সকলের ঘোর কাটে। আফরিন নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। অরিয়ন নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিতা তাকিয়ে থাকে নিজের কাঁপতে থাকা হাতের দিকে।

–খেয়ে নেও মা। আমি ঠিক আছি। সত্যি।
মায়া চৌধুরীর হাত ধরে বলে আফরিন।

–কিন্তু..

–কোনো কিন্তু না মা, খেয়ে নেও তুমি।
বলে মিতা।

–হ্যাঁ মায়া, খেয়ে এখানেই আফরিনের সাথে শুয়ে থেকো তুমি।
বলে আনিকা চৌধুরী।

–আমি এখানে শুলে মি…

–অরিয়ন আবরারের রুমে শুবে, আর ও গেস্ট রুমে।
মায়া চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে আনিকা চৌধুরী।

–হ্যাঁ মা, আন্টি ঠিক বলছে। তুমি এখানে ঘুমাও।
বলে মিতা।

–এখন তো সব ঠিক, এখন চলো খেতে।
মায়া চৌধুরীকে বলে আনিকা চৌধুরী।

আনিকা চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী রুম থেকে বের হয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকা আফরিন একটু পর পর আড় চোখে অরিয়নকে দেখছে। রুমের মধ্যে যেন হঠাৎ করেই পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেছে।

–আমি গিয়ে রুম গুছিয়ে নিচ্ছি।
কথাটা বলেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় মিতা।

মিতার কথা শুনতেই চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে অরিয়ন। মিতা অরিয়নের দিকে তাকালো না। হেটে দরজার পাশে অরিয়নের সামনা-সামনি দাঁড়ায় মিতা।

–মিতা?
ডাক দেয় আফরিন।

–জ্বি আপু?
আফরিনের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় মিতা।

–দরজা আটকিয়ে যাস।
বলে আফরিন।

মিতা কিছু না বলে অরিয়নের দিকে তাকায়। অরিয়নও তাকিয়ে আছে মিতার দিকে। বুকের মধ্যকার সেই যন্ত্রণা আবার অনুভব করছে মিতা। কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় মিতা। দরজা লাগতেই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে শুরু হয়েছে মিতার। হেটে চলে যায় গেস্ট রুমের দিকে।

***************

মিতা চলে গেলেও অরিয়ন নিজের জায়গায় ই দাঁড়িয়ে আছে। আফরিন ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে।
একটু আগেও সবাইকে সামাল দিতে থাকা আফরিন ছোট বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে থাকা আফরিনকে জড়িয়ে ধরে অরিয়ন।

–আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, হচ্ছে না যে আমি ফিরে এসেছি আফনান। ওদের সব অত্যাচার সহ্য করেছি, শুধুমাত্র এই আশায় যে একদিন আমি তোমাদের মাঝে ফিরে আসবো।
অরিয়নের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে আফরিন।

–আমি, আমি ভেবেছিলাম তোমাকে আর দেখা হবে না। আমি ভেবেছিলাম আমার আফনানকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
অরিয়নের বুক থেকে মাথা তুলে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে আফরিন।

–তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? আমি নিজেও যে তোমাকে ছাড়া ভালো ছিলাম না।
আলতো এক হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলে আফরিন।

অরিয়ন এক নজরে তাকিয়ে আছে আফরিনের দিকে। মন চাচ্ছে সব কিছু তছনছ করে দিতে। আফরিনকে এভাবে কোনোদিন দেখবে তা ভাবতেও পারছে না অরিয়ন।

–হয়তো তোমার সাথে প্র‍্যাংক করতে চেয়েছিলাম বলেই তার শাস্তি পেয়েছি। আর করবো না। প্রমিস।

অরিয়নের গাল নিজের দু হাত দিয়ে ধরে কথাটা বলেই নিজের মুখ এগিয়ে নেয় অরিয়নের দিকে। আফরিনের ঠোঁট অরিয়নের ঠোঁটের কাছাকাছি আসতেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় অরিয়ন। আফরিন স্থির হয়েই দাঁড়িয়ে রইল। অরিয়নের গাল ছেড়ে দিয়ে দু পা পিছিয়ে যায়।

–সরি, ভুলে গিয়েছিলাম আমি আর আগের মতো নেই। আমি অপবিত্র হয়ে গেছি ওদের স্পর্শে।
বিষন্ন এক হাসি দিয়ে কথাটা বলেই বিছানার দিকে চলে যেতে নেয় আফরিন।

এক পা এগিয়ে দিতেই আফরিনের হাত ধরে অরিয়ন। ঘুরে অরিয়নের দিকে তাকায় আফরিন।

–তুমি ভালোই জানো এসবে আমার কিছুই যায় আসে না,আফরিন।
নিচের দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

–তাহলে?
প্রশ্ন করে আফরিন।

–আমি বিয়ে করে নিয়েছি।
কথাটা বলে একটু থামে অরিয়ন।

–পরীকে।
মাথা তুলে আফরিনের দিকে তাকায় অরিয়ন।

চলবে….

#পারমিতা
#পর্ব_২৯
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–আমি বিয়ে করে নিয়েছি।
কথাটা বলে একটু থামে অরিয়ন।

–পরীকে।
মাথা তুলে আফরিনের দিকে তাকায় অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে মুখটা ক্ষণিকের জন্য শুকিয়ে গেলো আফরিনের,পরক্ষণেই হাসতে শুরু করে। অরিয়ন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আফরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে এই হাসিটা যে আনন্দের হাসি না তা ভালোই জানে অরিয়ন।

–তুমি আমার সাথে দুষ্টামি করছো তাই না?
অরিয়নের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে আফরিন।
হাসিটা মুখ থেকে সরে সিরিয়াসনেস প্রকাশ পাচ্ছে আফরিনের চেহারায়।

–তোমার মনে হয় আমি এমন একটা বিষয় নিয়ে দুষ্টামি করবো?
জবাব দেয় অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে দু পা পিছিয়ে পড়ে আফরিন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আলতো করে এক হাসি দেয়। হাসি দিলেও আফরিনের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে গড়িয়ে। আফরিনের এই চোখের পানি দেখলে এক সময় পাগল হয়ে যেত অরিয়ন, আর এখন? এখন বুকের মধ্যকার সেই যন্ত্রণা চাপা দিয়েই দাঁড়িয়ে রইল অরিয়ন।

–তুমি জানো, কেন তোমাকে আমি এতো ভালোবাসি?
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আফরিন। মুখে চিলতে এক হাসি আফরিনের।

অরিয়ন কিছু বললো না। চুপ করে তাকিয়ে রইল আফরিনের দিকে। অপেক্ষা করছে আফরিনের জবাবের।

–কারণ তুমি সবার থেকে একদম আলাদা আফনান, আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর আমি তোমাকে এক মিনিটের জন্যও কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে দেখিনি। কারণ তুমি আমার কাছে লয়ালের আরেক নাম।
আফরিনের মুখ থেকে হাসিটা যেন একটুও সরছে না।

কথাগুলো শুনে যেন অরিয়নের অস্থির লাগছে।
“আলাদা? কিসের আলাদা? আফরিন কি শুনেনি আমি পরীকে বিয়ে করেছি?” মনে মনে ভাবে অরিয়ন। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইল অরিয়ন।

–ধন্যবাদ তোমাকে।
আবারও বলে আফরিন।

কি জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে তা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে আফরিনের দিকে তাকায় অরিয়ন। অরিয়নের চাহনি দেখে আফরিনও বুঝে গেছে তার মানে।

–কারণ তুমি আমাকে নিজে থেকে সব বলে দিয়েছো, কারণ তুমি মুখ সরিয়ে নিয়েছো, কারণ তুমি আমার বোনের প্রতি নিষ্ঠাবান,কারণ তুমি বিয়ের এই সম্পর্ককে সম্মান দিয়েছো।
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে আফরিন।

–আমি..সরি…কি..

–সরি বলো না আফনান। তুমি বরং আমাকে আমার নিজের চোখে খারাপ হওয়া থেকে বাঁচিয়েছো। তোমাকে কিস করার পর যদি আমি জানতে পারতাম তুমি মিতার স্বামী, তাহলে এখন যতোটুকু বেঁচে আছি তাও মরে যেতাম।
অরিয়নের হাত ধরেই কথাগুলো বলে আফরিন।

–মিতাকে…মিতাকে ভালোবাসো তুমি?
হঠাৎ করে প্রশ্ন করে আফরিন।

আফরিনের প্রশ্ন শুনে যেন তব্দা খেয়ে গেলো অরিয়ন। অরিয়নের পক্ষ্যে অন্য কাউকে ভালোবাসা কি সম্ভব? পরীকে ভালোবাসলে কি আফরিনের জন্য খারাপ লাগতো অরিয়নের? কিন্তু পরীর জন্য যা অনুভব করে তা? পরীর মধ্যে আফরিনকে খোজা কি এখন বন্ধ হবে, এখন যখন আফরিন ফিরে এসেছে? অরিয়নের মাথায় সব কিছু যেন একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২৯ বছরের জীবনে এতো কনফিউজড অরিয়ন কখনো ছিলো না, তাহলে এখন? এখন কেনো এতো কনফিউশান?

আফরিন অরিয়নের দিকে তাকিয়ে অরিয়নের জবাবের অপেক্ষা করছে। অরিয়ন নিজের মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। আফরিন অরিয়নের হাত ছেড়ে একটু সরে আসে।

–মিতার প্রতি অন্যায় করো না আফনান।
গম্ভীর কন্ঠে বলে আফরিন।

–আমি কি করবো? কি করবো আমি? তুমি কেনো আমাকে ধোঁকা দিয়েই চলে গেলে না আফরিন?
চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।

ধৈর্যের সীমা যেন শেষ হয়ে গেলো অরিয়নের। এতোদিনের লুকানো সব অনুভূতি একসাথে আসতে শুরু করেছে অরিয়নের সামনে। রাগ, অভিমান সব যেন এক সাথেই গ্রাস করে নিচ্ছে অরিয়নকে।

–আমি এটা ভেবে মুভ অন করতে চেয়েছিলাম যে হয়তো তুমিও ভালো আছো অন্যকারো সাথে। কিন্তু এখন?
দরজায় এক লাথি মেরে বলে অরিয়ন।

–এখন তোমার দিকে তাকালে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয় আমার। মনে হয় তুমি সেখানে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছিলে আর আমি..আমি এখানে ভালো ছিলাম। এতো সহজে মুভ অন করে ফেলেছি, তাহলে কি ভালোবাসলাম তোমাকে আমি?
কথাগুলো অরিয়ন যেন আফরিনকে না, নিজেকে বলছে।

–আমি কারো থেকে আলাদা না আফরিন, আলাদা না। আমিও ওদের মতো যারা একজন চলে গেলে অন্যজন নিয়ে ভালো থাকে।
আবারও দরজায় শক্তি দিয়ে লাথি মেরে বলে অরিয়ন।

–তুমি হয়তো কোনোদিন ফিরে আসবে তা ভেবে তোমার ফিরে আসার রাস্তাটাও খোলা রাখিনি আমি, হোয়াট হেভ আই ডান। এসব কিছুর মাঝে পরীকেও জড়িয়ে ফেলেছি আমি। এখন না পারছি তোমার দিকে তাকাতে, না পারছি পরীর দিকে তাকাতে।
রাগান্বিত অরিয়ন ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে বলতে থাকে।

–আমার কথা ছাড়ো আফনান, ভাবো আমি আর ফিরে আসিনি।
রোবটের মতো বলে আফরিন।

–কিভাবে ভাববো আফরিন? কীভাবে? আমার সব জুড়ে শুধুই তুমি ছিলে।
হতাশ হয়ে বলে অরিয়ন।

–অতীত ছিলাম। বর্তমান নিয়ে ভাবো।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে আফরিন।

–শুধু জেনে রাখো,পরিস্থিতি অন্যরকম হলে আমি পরীকে কখনোই বিয়ে করতাম না। কাউকেই করতাম না।
কথাটা বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায় অরিয়ন।

দরজা লাগানোর বিকট শব্দ লাফিয়ে উঠে আফরিন। অরিয়ন চলে গেছে বুঝতে পেরেই অশ্রুসিক্ত নয়নে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতের কুয়াশায় সবটা আবছা আবছা দেখাচ্ছে। ডীম লাইটের আলোতে সব কিছু কেমন যেন মাধুর্যতা হারিয়ে ফেলেছে। আকাশের দিকে তাকায় আফরিন। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অনবরত।

–আফনান, আমার আফনান।
ডান হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে বেলকনিতে বসে পড়ে আফরিন। কান্নার এই বাধ যেন কোনোমতেই থামাতে পারছে না আফরিন। “ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা এতো বেশি হবে, তা যদি জানতাম তাহলে সেই প্র‍্যাংক করার কথা আমি কখনো কল্পনাও করতাম না ” মনে মনে ভাবে আফরিন।

******************

অন্ধকার বিছানায় শুয়ে আছে অরিয়ন। কপালের উপর এক হাত দেওয়া। চোখ বন্ধ করে রেখেছে। শুয়ে থাকা অরিয়নের চোখের সামনে আফরিনের কান্না করা চেহারা ভাসছে, কানে বাজতে থাকে সেই ভয়ানক কথাগুলো যা কখনো শুনবে বলেও কল্পনা করেনি অরিয়ন। আফরিনের সেই চোখ, যা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে পানি আপন মনে পরেই যাচ্ছে, তা ভাবতেই যেন নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো অরিয়নের মন।

চোখ বন্ধ করা অরিয়নের সামনে ভেসে থাকা আফরিনের ছবি যেন আবছা আবছা হতে হতে অন্য কারো ছবিতে পরিনত হতে লাগলো। চোখ মিটমিট করে সব কিছু পরিষ্কার করে দেখার চেষ্টা করতেই লক্ষ্য করে সামনেই তাকিয়ে আছে পরী। পরীর চেহারায় ভেসে উঠেছে অসহায়ত্বতা। অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকা চাহনি। যে চাহনি চিৎকার করে বলছে ” কেনো আমাকে আশা দেখালে?”। পরক্ষণেই বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে অরিয়ন। বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগলো। বুকের মধ্যে কেমন যেন এক ব্যাথা অনুভব করছে অরিয়ন। অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। পরীর চাহনি কেনো হঠাৎ করে এরকম উথালপাথাল করে দিলো অরিয়নের মন তা বুঝায় আগে তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে যায় অরিয়ন।

কোনো কিছুর বুঝার আগেই অরিয়নের পা যেন অরিয়নকে গেস্ট রুমের সামনে নিয়ে এসেছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অরিয়ন। ভিতরে যাবে কি না তার জন্য দ্বিধাবোধ করছে কিন্তু বুকের এই যন্ত্রণা তা?এই অস্থিরতা তার কি হবে?

কিছু না ভেবেই দরজার লক ধরে মোচড় দেয় অরিয়ন। দরজা লক করা ভেতর থেকে। দরজা লক করা দেখে বড় করে শ্বাস ফেলে অরিয়ন।

*************

বিছানায় শুয়ে আছে মিতা। গভীর চিন্তায় মগ্ন। নিজের চোখের সামনে ভাসছে আফরিনের কথাগুলো, গায়ের দাগগুলো, অরিয়নকে জড়িয়ে ধরা, অরিয়নের দিকে তাকাতেই মুখে হাসি ফুটে উঠা,অরিয়নের আফরিনের দিকে তাকিয়ে থাকা। রুমে আসার পর থেকে এক মিনিটের জন্যও শান্তি পাচ্ছে না মিতা। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও মিতার মন জানতো আফরিন পালিয়ে যায় নি, তারপরও কীভাবে অরিয়নকে ভালোবেসে ফেললো মিতা? নাকি ভালোবাসাটা আগে থেকেই ছিলো যা বুঝতে পারেনি মিতা। কেনো সব সময় আফরিনের সব কিছুতেই ভাগ বসাতে হয় মিতার?
মিতার ইচ্ছে করছে ম*রে যেতে আর না হয় নিজের চুল টেনে নিজের ছিড়তে।

নিজের চিন্তায় মগ্ন মিতার ঘোর কাটে দরজার লক মোচড়ানোর আওয়াজ শুনে।

–কে?
প্রশ্ন করে মিতা।

দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অরিয়ন মিতার কন্ঠ শুনতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বস্তির এক নিশ্বাস ছাড়ে বড় করে। কারো কন্ঠ শুনেও যে স্বস্তি পাওয়া যায় তা যেন কোনোদিন ভাবেও নি অরিয়ন।

–কে?
আবারও জিজ্ঞেস করে মিতা।

অরিয়ন চুপ করে রইল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। এ কোন দ্বিধায় জড়ালো অরিয়ন তা মাথায় ঢুকছে না।

লক মোচড়ানোর স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেয়েছে মিতা। বার বার কে জিজ্ঞাসা করার পরও কোনো জবাব না পেয়ে দরজা খুলতে যায় মিতা। দরজা খুলতেই অবাক হয় মিতা। এই গভীর রাতে দরজার সামনে কেউ নেই। রুম থেকে বের হয়ে আশেপাশে একটু দেখার চেষ্টা করে কেউ আছে নাকি। কিন্তু কাউকেই চোখে পরে না মিতার,অতঃপর দরজা লাগিয়ে দেয় মিতা।

মিতার হাটার শব্দ পেতেই তাড়াতাড়ি করে নিজের রুমের দিকে হাটা শুরু করে অরিয়ন। এতো রাতে কেনই বা মিতার কাছে ছুটে এসেছে তা জানেনা। শুধু জানে যা হচ্ছে তা ঠিক না। মিতার জন্য ঠিক না।

*****************

নাস্তার টেবিলে সবাই বসে অপেক্ষা করছে, অরিয়ন ও আফরিনের জন্য। মিতা, মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরীর সাথে বসেছে। সব সময় অরিয়নের পাশে আফরিন ই বসে এসেছে তাই এবার মিতা নিজেই আর অরিয়নের পাশের চেয়ারে বসেনি।

–আমার মনে হয় অরিয়ন আর মিতার বিয়ের খবরটা আফরিনকে জানানো উচিৎ।
সবার উদ্দেশ্যে বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমার ও ত…

–কি বলছো তুমি? আফরিন জানতে পারলে কি হবে জানো?
ওয়াহিদ চৌধুরীর কথা মাঝখান থেকে কেটেই উত্তর দেয় আনিকা চৌধুরী।

–কি হবে মানে?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।

–আফরিন যেভাবে উত্তেজিত হলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে,অরিয়নের বিষয়টা জানলে কি হবে একবার ভেবেছো? মেয়েটার উপর দিয়ে কি সব গেছে, শেষমেশ যদি জানতে পারে অরিয়নও ওর নেই তাহলে?
সবার দিকে তাকিয়ে বলে আনিকা চৌধুরী।

আনিকা চৌধুরীর কথা একদম ফেলে দেওয়ার মতোও মনে হলো না কারো।

–কিন্তু..

–না মা। আন্টি যা বলছে ঠিক বলেছে।
মায়া চৌধুরী কিছু বলার আগেই জবাব দেয় মিতা।

–আমার ও মনে হয় আফরিন আপু এসব শোনার জন্য এখনো প্রস্তুত না। আর আমার কথা ভেবো না, আমি ঠিক আছি।
সকলের উদ্দেশ্যে বলে মিতা।

মিতায় কথায় কেউ কোনো জড়তা বা মন খারাপের মতো কিছু অনুভব করলো না, তাই সবাই একমত হয় আপাতত আফরিনকে কিছু জানানো হবে না। কিছুদিন গেলেই সবটা খুলে বলা হবে।

–ওরা আসছে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

মিতা সিড়ির দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে আফরিন আর অরিয়ন এক সাথে কথা বলতে বলতে সিড়ি দিয়ে নামছে। আফরিন আর অরিয়ন দু জনের মুখেই জেনুইন হাসি। অরিয়নের মুখে এরকম হাসি মিতা শেষবার দেখেছিলো বিয়েরদিন সকালে। এরপর সব কিছু যেন ঝড়ের বেগে এসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো। মিতা নিজের জায়গায় খিচ মেরে বসে রয়েছে। সকলের দিকে তাকিয়ে একটু আলতো হাসি ফুটায় নিজের চোখেমুখে। সকলেই তাকিয়ে আছে আফরিন আর অরিয়নের দিকে। সবার মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে।

আজ যখন আফরিন আর অরিয়নকে একসাথে আবারও অনেকদিন পর দেখছে মিতা, তখন বুঝতে পারছে দুজনকে একসাথে কতই না সুন্দর আর মানানসই লাগছে। নিজেকে অরিয়নের সাথে বড্ড বেমানান লাগছে মিতার।

–গুড মর্নিং এভরিওয়ান।
একটা হাসি দিয়ে বলে আফরিন।

–গুড মর্নিং।
সকলেই জবাব দেয়।

অরিয়ন টেবিলের সামনে এসে কিছুটা অবাক হয়। মিতা আজ অরিয়নের পাশের চেয়ারে বা তার আশেপাশেও বসেনি। অপজিটে বসেছে। কেনই বা বসবে? আফরিন তো চলে এসেছে। মিতা নিজের থেকে সব বুঝতে পারছে তা তো ভালো, তাই না? তাও অরিয়নের মন কেমন যেন করছে। ইচ্ছে করছে মিতাকে টেনেহিঁচড়ে হলেও আগের জায়গায় বসাতে। “কি আজেবাজে ভাবছি আমি?” নিজেই নিজেকে বলে অরিয়ন।

–কিরে মিতা, ওখানে বসেছিস কেনো?
অরিয়ন চেয়ারে বসে গেলেও, আফরিন দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করে মিতাকে।

আফরিনের প্রশ্ন শুনে সবাই কিছুটা অবাক হয়। একে অপরের দিকে চোখাচোখি করে।

–এখানে মানে? আমি তো এখানেই বসি।
আমতা আমতা করে জবাব দেয় মিতা।

–আগে বসতি, কিন্তু এখন কেনো বসবি? এখন ওটা আমার জায়গা। তুই তোর স্বামীর সাথে বস।
কোনোরুপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই খুব অনায়াসে কথাগুলো বলে ফেলে আফরিন।

আফরিনের কথা শুনে সকলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল আফরিনের দিকে। অরিয়ন কোনো কথা না বলে নিজের প্লেটে খাবার তুলছে, মাঝে মধ্যে আড় চোখে মিতার দিকে তাকাচ্ছে। মিতার দৃষ্টি সেদিকে নেই, মিতার পুরো মনোযোগ আফরিনের দিকে।

–তুই, তুই কীভাবে জানলি?
প্রশ্ন করে মায়া চৌধুরী।

–সেটা বড় কথা না মা, বড় কথা হলো মিতাকে ওর জায়গায় আসতে বলো।
জবাব দেয় আফরিন।

আনিকা চৌধুরী আফরিনের কথা শুনে রাগে ফোসফোস করতে থাকল।

–আমি একদম শিউর এই মেয়েটাই বলেছে। এই মেয়ে এই, নিজের বোনের সুখ সহ্য হয় না তাই? আসতে না আসতেই অরিয়নকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছিস।
রাগে মিতার দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে থাকে আনিকা চৌধুরী।

–মা।
গম্ভীর সুরে ডাক দেয় অরিয়ন।

–মা কি? এই মেয়েটা তোকে আফরিন থেকে কেরে নিতে চায় বুঝিস না কেনো। আমার তো মনে হয় আফরিনকে ঐ প্র‍্যাংক করার বুদ্ধিট…

–বেস মা, অনেক হয়েছে। আফরিনকে সব আমি বলেছি। শুধু শুধু পরীকে দোষারোপ করবে না।
প্লেট ছেড়ে দাঁড়িয়ে রাগ হয়ে বলে অরিয়ন।

মিতা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ভিজে আসছে মিতার।

–এই মেয়েটা ম*রে গেলেই ভালো হতো, সেদিনের এটাকে ও ম*রে গেলে খুশি হতাম আমি। ওর জন্য তোর জীবন নিয়েও টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে আনিকা চৌধুরী।

–মা..।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।

–আন্টি প্লিজ চুপ থাকুন।
বলে আফরিন।

–আপা।
মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরী একই সাথে বলে উঠে।

–আনিকা।
অবাক হয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।

আনিকা চৌধুরীর কথা শুনে অবাক হয় মিতা। একজন মানুষের মৃ*ত্যু কামনা করতে পারে কতটা ঘৃণা করলে তা ভালোই জানে মিতা। কিন্তু মিতার সব কিছু যেন দুটো শব্দেই আটকে গেলো “ওর জন্য “।
” আমার জন্য অরিয়নের জীবনে ঝুঁকি? ” মনে মনে ভাবে মিতা।

আনিকা চৌধুরী কথাটা বলেই টেবিল ছেড়ে চলে যায়।

–মা, আমি আর এখানে থাকবো না।
বলে আফরিন।

–ঠিক আছে। নাস্তা শেষ করেই রওয়ানা হবো আমরা।
বলে মায়া চৌধুরী।

–আমি ও যাবো তোমাদের সাথে।
হুট করে বলে উঠে মিতা।

মিতার কথা শুনে অবাক হয়ে মিতার দিকে তাকিয়ে রইল অরিয়ন। কিন্তু মিতা এক মিনিটের জন্যও অরিয়নের দিকে তাকাচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে তাও মিতার দিকেই তাকিয়ে থাকে অরিয়ন। ক্ষনিকের মধ্যে যেন মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে অরিয়নের। হাতের চামচ শক্ত করে ধরেছে, দাঁতে দাঁত চেপে ধরা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিতার সাথে চোখাচোখি হলেও মিতা যেন অরিয়নকে দেখলোই না।

–আর ইউ ফা*কং সিরিয়াস?
হুট করে অরিয়নের কি হলো জানেনা, কথাটা বলেই প্লেট ধরে মেঝেতে ছুড়ে মারে। পরক্ষণেই গিয়ে দাঁড়ায় মিতার সামনে।

চলবে….

#পারমিতা
#পর্ব_৩০
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

হুট করে অরিয়ন প্লেট মেঝেতে ফেলে দেওয়াতে সবাই যেন অবাক হয়ে গেল। শান্তশিষ্ট স্বভাবের অরিয়নকে এতো রাগতে কোনোদিন দেখেনি কেউ। হাবিব চৌধুরী, মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরী যেন পাথর হয়ে রইল নিজের জায়গায়।
আফরিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিয়নের দিকে। হঠাৎ মিতার কথায় কেন এতো রেগে গেল তা বুঝতে পারছে না আফরিন। ছোটবেলা থেকে অরিয়নকে দেখে আসছে আফরিন, ৬ বছর একদম কাছ থেকে দেখেছে তাও অরিয়নের এরূপ কোনোদিন দেখেনি আফরিন।

–অরিয়ন?
নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।

অরিয়নের কানে হাবিব চৌধুরীর কথা যেন ঢুকলোই না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়েই আছে। মিতা কিছুক্ষণ আফরিনের দিকে তাকাচ্ছে তো কিছুক্ষণ অরিয়নের দিকে।

–রুমে রাইট নাউ।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।

হঠাৎ করে সামনে এসে অরিয়ন চেচাতেই মিতা লাফিয়ে উঠলো, ক্ষণিকেই দৌড়ে চলে যায় সবার সামনে থেকে। অরিয়ন মিতার প্লেট হাতে নিয়ে তাতে খাবার নিতে থাকে।

–অরিয়ন।
একটু রাগ হয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমার কানে সমস্যা না বাবা, শুনছি। কি বলবে বলো।
প্লেট হাতে হাবিব চৌধুরীর সামনে এসে বলে অরিয়ন।

–কি ছিলো এটা?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে হাবিব চৌধুরী।

–তোমার জানতে হবে না।
বলেই হাটা শুরু করে অরিয়ন।

–কি দেখলাম ভাইয়া।
অবাক হয়ে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–বুঝতে পারছি না।
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয় হাবিব চৌধুরী।

****************

গেস্ট রুমে দৌড়ে এসেছে মিতা। হঠাৎ করে অরিয়ন চেচিয়ে উঠাতে ভয় পেয়ে গেছে মিতা। ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না আসছে প্রচুর। মিতার সাথেই কেন এরকম রাগ হয়ে কথা বলে তা বুঝতে পারছে না মিতা। অথচ আফরিনের সাথেও কত সুন্দর করে হাসছিলো অরিয়ন। ” কারণ ও আফরিনকে ভালোবাসে ” মনে মনে ভাবে মিতা।

“ওর জন্য এখন তোর জীবন নিয়েও টানাটানি শুরু হয়েছে” হঠাৎ করেই আনিকা চৌধুরীর কথাটা মনে পরে যায় মিতা। “আমার জন্য মানে? কি বলছিলো আন্টি? আমার জন্য অরিয়নের জীবনে ঝুঁকি? ” মনে মনে ভাবতে থাকে মিতা।
মোবাইলে এলার্ম বাজতেই ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিতা। একটু পরেই কলেজ যেতে হবে।

*************

খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকতেই রুমে মিতাকে দেখতে পায় না অরিয়ন। “গেস্ট রুম” বিরবির করে কথাটা বলেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে যায় অরিয়ন।

অরিয়ন গেস্ট রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় মিতা কলেজ ড্রেস পরে আয়নার সামনে বসে নিজের চুল আচরাতে ব্যস্ত। কোনো কথা না বলেই রুমে ঢুকে বিছানায় খাবারের প্লেট রাখে অরিয়ন। মিতা অরিয়নকে দেখেই মাথা নিচু করে রাখে। অরিয়ন কোনো কথা না বলে মিতার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিরুনি নিয়ে নেয় মিতার হাত থেকে। পরক্ষণেই মিতার চুল আচরাতে থাকে। মিতা আয়নায় অরিয়নের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। অরিয়ন কি করতে চাইছে তা বুঝার চেষ্টা করছে। অরিয়নের চেহারা থেকে রাগের চিহ্ন চলে গেছে। কেউ দেখলেও বুঝবে না একটু আগেও চেচামেচি করে এসেছে এই লোক।

চুলে বেনি করা শেষ হলে আলতো করে মিতার মাথায় চুমু খায় অরিয়ন। মিতার হাত ধরে বিছানায় বসায়। প্লেট হাতে তুলে নিয়ে খাবার মিতার মুখের কাছে ধরে। মিতা চুপ করে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ করে এরকম শান্ত বা চুপ হওয়ার কারণ কি হতে পারে তা বুঝার চেষ্টা করছে। মিতা নিজের মুখ না খুলে হাত দিয়ে খাবার নিতে গেলেই অরিয়ন হাত পিছিয়ে আনে। বড় বড় চোখ করে মিতার দিকে তাকায়। মিতা ভয়ে নিজের হাত নামিয়ে ফেলে। আবারও খাবার মিতার মুখের সামনে ধরে অরিয়ন।

এবার মিতা এক প্রকার হার মেনেই চুপচাপ মুখ খুলে খাবার খেতে থাকে। অরিয়ন চুপচাপ মিতার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে মুখের খাবার শেষ হওয়ার। মুখের টা শেষ হতেই আবারও খাবার সামনে নিয়ে নেয় যায় অরিয়ন।
খাবারের প্লেট বেডসাইড টেবিলে রেখে পানির গ্লাস ধরে মিতার মুখের কাছে। এবারও মিতা চুপচাপ পানি পান করে নেয়।

গ্লাস টেবিলে রেখে একটু দাঁড়ায় অরিয়ন। অরিয়নের দেখাদেখি মিতা দাঁড়াতে নিলেই কাধে হাত রেখে বসিয়ে রাখে অরিয়ন। নিজের প্যান্টের পকেট থেকে ডেবিট কার্ড বের করে মিতার পাশে আবারও বসে অরিয়ন। মিতার হাত নিয়ে হাতের তালুতে কার্ডটা রাখে। হঠাৎ করে কার্ড কেনো দিলো বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা।

–নিজের পছন্দ মতো যা কিনতে মন চায় কিনে নিস।
কথাটা বলেই মিতার দু গাল ধরে নিজের কাছাকাছি এনে ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খায়।

–ঐ বাড়িতে যাবি না তুই।
মিতা থেকে সরে এসে বলে অরিয়ন।

এতোক্ষণে অরিয়নের মোটিভ বুঝতে পারে মিতা। এতো আদর যত্ন সব নিজের কথা মানিয়ে নেওয়ার কৌশল তা বুঝতে পারছে মিতা। রাগ করে হাতের ডেবিট কার্ড বিছানায় ছুড়ে মারে মিতা। কার্ড গিয়ে কোথায় পরলো তা অরিয়ন দেখেও যেন দেখলো না। নিজের চেহারা আগের মতোই শান্ত।

–আমি যাবো। এখানে আর থাকবো না আমি। আমার ভালো ল…

–চুপ, একদম চুপ।
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই অরিয়ন নিজের হাতের তালু দিয়ে মিতার মুখ চেপে ধরে কথাটা সম্পূর্ণ করতে বাধা দেয়।

–যাবি না, মানে যাবি না।
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।

নিজের মাথা নাড়িয়ে না করতে থাকে মিতা।

–আমাকে দিয়ে এমন কিছু করাস না, লাভ। যেন আমাকে পরে পস্তাতে হয়।
মিতার মাথা ধরে নিজের বুকে চেপে ধরে বলতে থাকে অরিয়ন।

–তুই বলেছিস তুই আমাকে ভালোবাসিস। ভালোবাসলে সব সময় থেকে যেতে হয়। তুইও থেকে যাবি।
শান্ত কণ্ঠে খুব অনায়াসে কথাগুলো বলে অরিয়ন।
যেন মিতাকে জোর করে আটকে রাখছে না।

অরিয়নকে এক ধাক্কা দিয়ে সরে আসে মিতা। এক দৃষ্টিতে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অরিয়নের দিকে।

–পাগল তুমি? সাইকোদের মতো বিহেভ করছো কেনো? এই ভালো তো এই খারাপ। আমি এখানে থাকবো না। আপু চলে এসেছে, আমি আমার বাড়ি চলে যাবো।
এক শ্বাসে কথাগুলো বলে মিতা।

অরিয়নের এসব ব্যবহার দেখে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মিতা। তার থেকেও বড় কথা, আফরিনের দিকে তাকালে লজ্জা লাগে মিতার। দু জন ভালোবাসার মানুষের মাঝে বাধা হয়ে থাকতে চায় না মিতা। আফরিন মিতার জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষকে পর্যন্ত ত্যাগ করতে রাজি হয়ে গেছে। আর মিতা? সব সময় শুধু নিয়েই যাবে? আজ না হয় আফরিনের আফনানকে ফিরিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও ঋণ পরিশোধ করবে মিতা।

–এটাই তোর বাড়ি, এটাই।
রাগান্বিত অরিয়ন চেচিয়ে উঠে।

মিতা অরিয়নের রাগ দেখে ভয় পেলেও নিজেকে শক্ত করে রাখে।

রাগান্বিত অরিয়ন নিজের দু হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকে, হাত নিয়ে চুল ধরে টান দিয়ে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করে। ডাইনিং টেবিলের ওখানে মিতা ভয়ে লাফিয়ে উঠেছিলো তা লক্ষ্য করেছিলো অরিয়ন। তাই তো একটু কোমলতার সাথে মিতার সাথে কথা বলছিলো কিন্তু মিতা, মিতা মাথাটা খারাপ করেই দেয় বার বার।
বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে ও ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অরিয়ন। মিতার সামনে গিয়ে আলতো করে এক হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে।

–ঠিক আছে। কাল আমি নিয়ে যাবো, ২/১ দিন থেকে আবার একসাথে চলে আসবো, ওকে?
মিতার হাত ধরে বলে অরিয়ন।

মিতা অরিয়নের কথা শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। বিরক্তবোধ করলো এরকম অবুঝের মতো কথা বলার কারণে।

–আমি একেবারে যে…

–আহ..
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে অরিয়ন।

–লাভ,লাভ,লাভ।
মিতার কাছাকাছি নিজের মুখ নিয়ে হেসে হেসে বলে অরিয়ন।

মিতার চোখে সেদিনের থাপ্পড়ের সিনটা ভাসতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মিতার। আবারও চড় মে*রে বসে নাকি তা ভাবতেই কাঁপতে থাকে। অরিয়ন হাসি বন্ধ করে গম্ভীর চেহারায় মিতার নাকের সাথে নিজের নাক স্পর্শ করায়।

–আমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে তোকে আমি খু*ন করে ফেলবো, পরী।
মিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে অরিয়ন।

মিতা অরিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টামি বা মিথ্যে খোজার চেষ্টা করলো কিন্তু সিরিয়াসনেস ছাড়া আর কিছুই পেলো না। মিতার গালে আলতো করে চুমু দেয় অরিয়ন। এক পা পিছিয়ে এসে দাঁড়াতেই মিতা দু পা পিছিয়ে পড়ে।

–আফরিন সমস্যা তাই তো? আফরিন চলে যাবে বাসা থেকে। কিন্তু তোর মুখ থেকে যেন দ্বিতীয় বার যাওয়ার কথা না শুনি।

মিতা চুপ করে অরিয়নের কথা শুনছে। কি জবাব দিবে বুঝতে পারছে না।

–ব্যাগ নিয়ে নিচে আয়। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।
কথাটা বলেই প্লেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় অরিয়ন।

মিতা কোনো কিছু না ভেবেই রুমের দরজা লাগায়। সুটকেস বের করে তাতে পাগলের মতো কাপড় ঢুকাতে থাকে। অনেক হয়ে গেছে অরিয়নকে ভয় পাওয়া। ম*রতে হলে মরবে তাও আর এখানে থাকবে না মিতা। নিজের বোনের জন্য হলেও থাকবে না। অরিয়নের সব কথা শোনার জন্য এখানে আসেনি মিতা। সুটকেসে কাপড় ঢুকিয়ে ব্যাগ হাতে নেয় মিতা।

প্লেট নিয়ে মিতার রুম থেকে বের হতেই সামনা সামনি দেখা হয় আফরিনের সাথে। আফরিন কিছুটা অবাক হয়ে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকলো। অরিয়ন কোনো রিয়েকশন না দিয়েই হাটা শুরু করে।

–কি হয়েছে তোমার? তুমি তো এরকম ছিলে না।
পেছন থেকে আফরিন বলে উঠে। আফরিনের কথা শুনতেই দাঁড়িয়ে যায় অরিয়ন। আফরিনের দিকে ঘুরে তাকায়।

–সেই আফনান কোথায় যাকে আমি চিনতাম?
প্রশ্ন করে আফরিন।

–সেই আফনান তার আফরিনের সাথেই ম*রে গেছে। এখন আমি শুধুই অরিয়ন।
রোবটের মতো বলে অরিয়ন।

–মিতাকে ভালোবাসো তুমি?
আবারও প্রশ্ন করে আফরিন।

–কতবার বলেছি না, বাসি না।
বিরক্ত হয়ে জবাব দেয় অরিয়ন।

–না বাসলে ওর থাকা না থাকায় কি আসে যায়? ওকে যেতে বাধা দিচ্ছো কেন?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে আফরিন।

–অনেক কিছু যায় আসে, ও আমার ওয়াইফ। ও আমার সাথেই থাকবে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।

–কিন্তু ওর…

–কোনো কিন্তু মিন্তু না। ও এখানে থাকবে মানে এখানেই থাকবে। আর কথা বাড়াতে চাই না আফরিন।
কথাটা বলেই চলে যায় অরিয়ন। আফরিনের কোনো কথার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো না।

আফরিন দাঁড়িয়ে থেকে অরিয়নের চলে যাওয়া দেখছে। মিতাকে নিয়ে প্রশ্ন করতেই যেন অরিয়নের চেহারার রঙ বদলে গেলো। “আমি যা ভাবছি তাই কি?” মনে মনে ভাবে আফরিন। “মিতাকে সাবধান করতে হবে সময় থাকতে” মনে মনে কথাটা ভেবেই মিতার রুমের দিকে হাটা শুরু করে আফরিন।

মিতা ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিতেই দরজার কাছে আফরিনের সাথে দেখা হয়।

–আপু।
বলে মিতা।

–কলেজ যাচ্ছিস?
মিতাকে দেখে বলে আফরিন।

–হ্যাঁ আপু। আগামী মাস থেকে বোর্ড এক্সাম।
জবাব দেয় মিতা।

–তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।

–হ্যাঁ আপু, বলো না।

–আমার ম….আচ্ছা তুই আগে কলেজ থেকে আয় এরপর বলবো কথা।
বলে আফরিন।

–বেশি ইম্পোর্টান্ট হলে এখন বলতে পারো আপু।

–নাহ তেমন কিছু না। তুই আয়, এরপর বিকালে বলবো।

–ওকে আপু। আমি তাহলে আসি।

–ওকে।

***************

গাড়িতে উঠে বসেছে মিতা। অরিয়ন পাশেই বসে আছে। মিতা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরিয়ন মাঝে মধ্যে আড় চোখে মিতার দিকে তাকালেও মিতা সেদিকে নজর দিচ্ছে না। নিজের হাতে মিতার হাত নিয়ে নেয় অরিয়ন। আঙ্গুলের ভাজে হাত গুজে দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখে অরিয়ন।
মিতা অরিয়নের হাত ধরলো না। যেমন ছিলো তেমন ই রেখে দিলো।

–সমস্যা কি তোর,হ্যাঁ?
চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।

হঠাৎ করে অরিয়নের চেচানো শুনে ড্রাইভার চাচাও লাফিয়ে উঠে এক প্রকার। অরিয়নের কথা শুনে অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা।

–মানে?
বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে মিতা।

–হাত ধরছিস না কেন? সমস্যা কি? এমন ভাবে আছিস যেন আমি তোকে কোনদিন স্পর্শ করিনি।
রেগে রেগে বলে অরিয়ন।

–আমাকে বিয়ে করার কারণ কি ছিলো?
হুট করে প্রশ্ন করে বসে মিতা।

মিতার কথা শুনে হাত ছেড়ে দেয় অরিয়ন।

–কি হলো? এখন তুমি জবাব দেও। আমাকে বিয়ে করার কারণ কি ছিলো?

–কারণ কি জানিস না? আফরিন আসেনি তাই করেছি।
অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দেয় অরিয়ন।

–আমাকে মা*রতে চায় কারা?
প্রশ্ন করে মিতা।

অরিয়ন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল মিতার দিকে।

–কি হলো জবাব দেও?

–আমি কোনো জবাব দিতে বাধ্য নই।
উত্তর দেয় অরিয়ন।

–অবশ্যই তোমরা বাধ্য। আমার জীবনের….কি হলো আমার দিকে তাকাও।
মিতার কথা শুনতেই ফোনের দিকে তাকিয়ে টাইপ করতে ব্যস্ত হয়ে যায় অরিয়ন।

–জবাব দেও। তাকাও বলছি।
রাগ হয়ে বলে মিতা।

অরিয়ন মিতার দিকে ফিরেও তাকালো না।

–ওকে।
বলেই অন্যদিক করে ফিরে বসে মিতা।

“সময় হয়ে গেছে সব সত্য উন্মোচন করার” মনে মনে বলে মিতা।

চলবে…