পারমিতা পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
123

#পারমিতা
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–অরিয়ন মিতার সাথে ঐভাবে কথা বললো কেন? এসবের মানে কি?
প্রশ্ন করে মায়া চৌধুরী।

–আমি ও কিছু বুঝতে পারছি না মায়া।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–তুমি দেখলে? মিতার যাবার কথা শুনতেই কীভাবে প্লেট ছুড়ে মারলো ও? আর মিতা অরিয়নকে আবার কবে থেকে ভয় পাচ্ছে?
একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে মায়া চৌধুরী।
মুখে তার বিষন্নতার ছোঁয়া। ভ্রু কুঁচকে কথাগুলো বলে যাচ্ছে একের পর এক।

মিতা আর অরিয়ন বাসা থেকে বের হওয়ার পর হাবিব চৌধুরীর স্ট্যাডি রুমে একসাথে কথা বলতে বসেছে সবাই। হাবিব চৌধুরী, মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরী বসে আছে রুমে। আজ সকলে সবাই নিজের চোখে যা দেখলো তা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কারো। যেখানে ওয়াহিদ চৌধুরী ও মায়া চৌধুরী একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে সেখানে হাবিব চৌধুরী চুপ করে সব কথা শুনছে। দেখে মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি।

–আমার মনে হচ্ছে আফরিনের ফিরে আসা, যা যা ঘটে গেলো আফরিনের সাথে তা শুনে ও কিছুটা মেন্টালি ডিস্টার্ব ফিল করছে। তাই রিয়েকশন ঐরকম চলে এসেছে।
একটু ভেবে বলে হাবিব চৌধুরী।

–নিজের আর এই সিচুয়েশন এর উপর ফ্রাস্ট্রেটেড মনে হচ্ছিলো অনেক।
আবারও বলে হাবিব চৌধুরী।

মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরীর কাছে হাবিব চৌধুরীর কথাগুলো গ্রহণযোগ্য মনে হলো। অরিয়ন যে আফরিনকে কতটা ভালোবাসতো তা সম্পর্কে সবাই অবগত। যেহেতু আফরিন ফিরে এসেছে আবার অরিয়ন চিট করার মতোও মানুষ না। সেহেতু নিজের প্রতি ডিস্টার্ব ফিল করাটা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হতেও সময় লাগলো না।

–তা তো বুঝলাম। কিন্তু ভাইয়া, একটা কথা না বললেই না।
হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–আমার মনে হয় এখন ভাবির একটু নরম হওয়া উচিৎ। মিতার সাথে আর কতদিন এসব করে আসবেন উনি? আজ ঐ বিষয়টাও তুলে ফেলেছেন। ভাগ্য ভালো যে মিতা ব্যাপারটা খেয়াল করেনি।
একটু কঠোর সুরে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–আমি আনিকার সাথে কথা বলবো এই ব্যাপারে।
উত্তর দেয় হাবিব চৌধুরী।

–হুম।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

*******************

–তোমাকে যা যা বলেছিলাম তা করা শেষ?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–জ্বি স্যার। আমি সব খবর নিয়ে নিয়েছি। ওরা চেষ্টা করছে আমাদের থেকে টেন্ডারগুলো নিয়ে নেওয়ার।
জবাব দেয় অরিয়নের বয়সি এক যুবক।

–ওরা চেষ্টা করতে থাকুক। তোমাকে যে প্রমাণ যোগার করতে বলেছিলাম তার কিছু হলো?
আবারও বলে অরিয়ন।

–না স্যার। প্যারিসের রাস্তার যেখানে এই ঘটনা ঘটেছিলো সেখানে কোনো সিসিটিভি পাওয়া যায়নি। গাড়ি শনাক্ত করতে না পারার কারণে কিছু কনফার্ম করা যাচ্ছে।
জবাব দেয় ছেলেটি।

–ওকে, এখন যেতে পারো।
ল্যাপটপে নিজের মনোযোগ দিয়ে বলে অরিয়ন।

–ওকে স্যার।

–সজিব?
ছেলেটি চলে যেতে নিতেই ডাক দেয় অরিয়ন।

–জ্বি স্যার?
অরিয়নের দিকে এগিয়ে এসে বলে সজিব।

–আমার জন্য এক কাপ কফি পাঠাও, আর বাড়িতে বড় দেখে ৩ তোড়া রজনীগন্ধা ফুল পাঠানোর ব্যবস্থা করো। নিশ্চিত করবা, সেই ফুল যেন গেস্ট রুমেই রাখা হয়।
বলে অরিয়ন।

–ওকে স্যার।
কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সজিব।

সজিব রুম থেকে বের হতেই একটু নড়েচড়ে বসে অরিয়ন। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। মিতার সাথে কেন এমন জানো*য়ারের মতো বিহেভ করলো তা নিজেও বুঝতে পারছে না। শুধু এতোটুকুই জানে, যখন মিতা অরিয়নকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বললো তখন মাথা খারাপ হয়ে গেলো অরিয়নের। মন চাচ্ছিলো সব কিছু শেষ করে দিতে, সাথে মিতাকেও। যখন দূরে রাখতে চেয়েছিলো তখন জোর করেই পাশে ছিলো মিতা আর এখন? এখন যখন নিজের কাছে রাখতে চাচ্ছে তখন ছেড়ে যেতে চায়।

“ভালোবাসা ছাড়া কী সম্পর্ক টিকে না? সব সম্পর্কে কী সব সময় ভালোবাসা থাকে?”মনে মনে ভাবে অরিয়ন।

“আমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে তোকে আমি খু*ন করে ফেলবো, পরী”

কথাটা বার বার অরিয়নের মাথায় ঘুরছে, এসব টক্সিক কথাবার্তা অরিয়ন বলেছে তা যেন নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু তখন যা বলেছে তা যে মিথ্যে ছিলো না, অভিনয় ছিলো না তা ভালোই বুঝতে পারছে অরিয়ন। মিতার চলে যাওয়ার কথাটা শুনতেই কেন এমন পাগলের মতো বিহেভ করলো তা বুঝতে পারছে না অরিয়ন। আফরিন থাকাকালীনও এরকম ছিলো না অরিয়ন। অরিয়নের মনের মধ্যে এক অজানা ভয় বাসা বেধেছে।

“কি হচ্ছে আমার সাথে? কেন তোর চলে যাওয়ার কথা আমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা দিচ্ছে, পরী? কেন আমি একই ভুল বার বার করছি? কি বলে ক্ষমা চাইবো আমি? তুই কি ক্ষমা করবি আমাকে? তোর রিয়নকে?” টেবিলের সাথে নিজের মাথা লাগিয়ে ভাবতে থাকে অরিয়ন। সেই চেনাজানা অস্থিরতা আবারও অনুভব করছে।

*****************

বাসায় ফিরতে ফিরতে মিতার প্রায় ৪ টা বেজেছে। মন খারাপ লাগছিলো বলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছে আজ। রুমের দরজার সামনে আসতেই রজনীগন্ধা ফুলের ঘ্রাণ প্রবেশ করে মিতার নাকে। কিছু না ভেবে দরজা খুলতেই দেখতে পায় সোফার পাশের টেবিলে বড় বড় সাইজের ৩ টা ফুলের তোড়া। ফুলগুলো হাত দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে মিতা। ব্যাগ রেখে কিছুক্ষণ ফুলের কাছে বসে থাকে। কি করা উচিৎ মিতার? জানেনা। শুধু জানে আফরিন এসেছে। সব কিছুর যে হকদার সে চলে এসেছে। স্যুটকেস থেকে একসেট জামা বের করে গোসল করতে চলে যায় মিতা।

মায়া চৌধুরীকে কোথাও দেখতে না পেয়ে খুজতে থাকে মিতা। পুরো বাড়িতে কোথাও আফরিন আর মায়া চৌধুরীকে দেখা যাচ্ছে না।

–শায়লা আপু, মা আর আপুকে দেখেছো?
প্রশ্ন করে মিতা।

–মায়া ম্যাম আর আফরিন বাগানে গেছে একটু আগে।
জবাব দেয় শায়লা।

–ওকে, ধন্যবাদ।

কথাটা বলেই হুরহুর করে হাটা শুরু করে মিতা। বাড়ির বাম দিকটা হাবিব চৌধুরী সখ করে ফুলের বাগান করেছে। সেখানেই এক পাশে বিকালে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য সোফা সেট করা হয়েছে। দূর থেকে মিতা দেখছে, মায়া চৌধুরী ও আফরিন পাশাপাশি বসে আছে। মিতার দিকে দুজনের পিঠ। কোনো একটা কিছু নিয়ে দু জনেই কথা বলতে ব্যস্ত। মিতার আসাটা কেউ লক্ষ্য করেনি।

–তারপর আফনান বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো?
প্রশ্ন করে আফরিন।

আফরিনের কথাটা শুনেই মিতা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেলো। কোনো সারাশব্দ করলো না। অপেক্ষা করলো মায়া চৌধুরীর জবাব আসার।

–কোনো উপায় ছিলো না। আমরা সবাই যে মিতাকে কতটা ভালোবাসি তা তো তুই জানিস ই। আর বিশেষ করে অরিয়ন, ও যে মিতাকে কতটা আদর করে তা তোর থেকে কে ভালো জানে।
জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

–হুম।
বলে আফরিন। কথাটা আফরিন বলতেই বড় করে একটা শ্বাস ফেলে। যেন বুকের কষ্টটা কমানোর চেষ্টা করছে।

–মিতাকে বাঁচাতে হলে এটা করতেই হতো। তোকে হারিয়ে অরিয়ন তো এমনিতেই ভেঙ্গে পরেছিলো মিতার ব্যাপারটা জানার পর মিতাকেও হারাতে চায় নি।
আবারও বলে মায়া চৌধুরী।

–আরিয়ানের সাথে তো বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, তাহলে আরিয়ানের সাথে হলো না কেনো?
মাথা নিচু করে প্রশ্ন করে আফরিন।

আফরিনের কথা শুনে মনে হচ্ছে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করছে অরিয়নের বিয়েটা হয়নি। কন্ঠে প্রকাশ পাচ্ছে দুঃখ কষ্ট।

–কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়াতেও যখন তুই আসলি না, স্টেজে একাই অপেক্ষা করছিলো অরিয়ন। মানুষ এটা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলো। কেন ৬ বছর ভালোবাসার পরও বিয়ের দিন তুই আসলি না। তাহলে কি অরিয়নের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে? কোনো চারিত্রিক সমস্যা? কোনো শারীরিক অক্ষমতা? তাও…
কথাটা বলে থামেন মায়া চৌধুরী। আফরিনের হাত নিজের হাতে নেয়।

–তাও?
জিজ্ঞাসা করে আফরিন।

–তাও অরিয়ন বিয়ে কর‍তে রাজি হয়নি। শেষমেশ মিতার ব্যাপারটা খুলে বলতে হয়েছে ওকে, সাথে কিছু মিথ্যে ও। তবেই রাজি হয়।
কথা শেষ করে মায়া চৌধুরী।

আফরিন নিজের হাত দিয়ে চোখ মুছে নেয়।

–আমি কী ছোটবেলায় খুব বড় কোনো পাপ করেছিলাম মা?
হঠাৎ করে প্রশ্ন করে আফরিন।

কথাটা শুনতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে মায়া চৌধুরীর। মায়া চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।

–তাহলে আমার সাথে এমন কেনো হলো মা? কেনো দিনের পর দিন ঐসব সহ্য করতে হয়েছে আমার। কেনো যখন আশা নিয়ে ফিরলাম তখন আমার শেষ আশাটাও শেষ হয়ে গেলো।
কথাটা বলতেই মায়া চৌধুরী আফরিনকে জড়িয়ে ধরে।

–কেন আমার আফনানকে উনি আমার করে দিলেন না, মা? কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন উনি আমাকে? কেন ওরা আমাকে সেখানেই মেরে ফেললো না।
কাঁদতে কাঁদতে বলে আফরিন।

আফরিন আর মায়া চৌধুরীর সব কথাই দাঁড়িয়ে শুনলো মিতা। মিতার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।
” আমার জীবন বাঁচাতে মানে? আরিয়ান ভাইয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো? তাহলে সেই মানুষগুলো কি সত্যিই আমাকে মা*রতে এসেছিলো? অরিয়নকে নয়? আমাকে কে বা কেনই মা*রতে চাইবে?” মনে মনে ভাবতে থাকে মিতা। এসব কিছুর থেকেও যা মিতাকে সব থেকে কষ্ট দিচ্ছে তা হলো পরিবারের সম্মান বাঁচাতে মিতা আর অরিয়নের বিয়ে হয়নি। হয়েছে মিতার জীবন বাঁচাতে, এবারও অরিয়ন আফরিনের না হতে পারার একমাত্র কারণ মিতা। কোনো কথা না ভেবেই দৌড়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে মিতা।
সোজা চলে যায় নিজের রুমে।

********************

সবাই সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। গাড়ি অপেক্ষা করছে সবার জন্য। একটু পরেই নিজেদের বাড়তে চলে যাবে আফরিন। মিতার স্যুটকেস দরজার সামনে রাখা। নিজের প্রয়োজনীয় বই ব্যাগে ঢুকাতে ব্যস্ত। আফরিন রুমে প্রবেশ করতেই মিতার মুখে হাসি ফুটে। আফরিনও হাসি ফিরিয়ে দেয় বিনিময়ে।

–এইতো আপু, আর ৫ মিনিট।
কথাটা বলে ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস ঢুকাতে থাকে মিতা।

আফরিন হেটে গিয়ে মিতার পাশাপাশি দাঁড়ায়। নিজের হাত রাখে ব্যাগের উপর। বাধা দেয় কিছু ঢুকানোর জন্য।

–তুই আমাদের সাথে যাচ্ছিস না, মিতা।
বলে আফরিন।

–কেনো আপু? এরকম কেনো বলছো?
মন খারাপ করে প্রশ্ন করে মিতা।

–কারণ তোর যাওয়াটা ঠিক হবে না। এদিকে আয়।
কথাটা বলে মিতার হাত ধরে বিছানায় বসায় আফরিন। মিতার পাশে আফরিনও বসে।

–আমি আফনানকে এমন এক পর্যায়ে ছেড়ে গিয়েছিলাম যেখানে ওর জন্য সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ৬ বছরের ভালোবাসা, ৬ বছরের স্বপ্ন। সব।
মলিন এক হাসি দিয়ে বলে আফরিন।

এই হাসির পিছনের কষ্ট যেন মিতার নজর থেকে গেলো না।

–আপু…

–আমার কথা শেষ করতে দে মিতা।
বলে আফরিন।

–সেই সময়ে তুই আফনানের পাশে ছিলি। যেমন করেই হোক ওকে সময় দিয়েছিস। তোদের বিবাহিত সম্পর্ক আগের থেকে ভালো হয়েছে। ও তোকে নিজের জীবনে কিছুটা হলেও মেনে নিয়েছে। এর মানে কি জানিস?
প্রশ্ন করে আফরিন।

–কী?
জিজ্ঞেস করে মিতা।

–এর মানে ও না চাইতেও তোর উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। ওর সবটা না হলেও অনেকটা জুরে এখন তুই জায়গা করে নিয়েছিস। ও তোর উপর এতোটাই নির্ভরশীল হয়েছে যে, নিজের ভালো থাকা খারাপ থাকা এখন আর নিজের উপর নেই। তোর উপর ছেড়ে দিয়েছে। এক কথায় ও তোর উপর অবসেসেড।
আজ অরিয়নের চোখে মিতার জন্য যে পাগলামি লক্ষ্য করেছে আফরিন তাতে সব কিছু আফরিনের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

–তুই যদি এখন ওকে ছেড়ে যেতে চাস,তাহলে ও অন্য রকম পাগলামি করবে। এমনকি ভায়োলেন্টও হয়ে যেতে পারে।

–তাহলে?
প্রশ্ন করে মিতা।

–ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে। ওর মতো করে কিছুটা চলতে হবে তবে একদম সব কিছু ওর মন মতো করা যাবে না। এতে আরও বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। তাই বলছি সব কিছু কিছুটা স্বাভাবিক হতে দে। এখন তুই চলে গেলে হিতে বিপরীত হবে।
মিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে আফরিন।

মিতার মধ্যে যেন অপরাধবোধ আরও বেড়ে গেলো। আফরিন সব হারিয়েও নিজের বোনের জন্য কতটা ভাবছে আর সেই বোনই নাকি তার ভালোবাসার মানুষ কেড়ে নিয়েছে।

–আমাকে ক্ষমা করে দেও আপু, আমাকে ক্ষমা করে দেও।
আফরিনকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে মিতা।

–এভাবে বলিস না পাগলি। মাঝে মধ্যে আমাদের হাতে কিছুই থাকে না। সব উপরওয়ালার ইচ্ছা।
মিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে আফরিন।

–আমাকে ক্ষমা করে দেও, ক্ষমা করে দেও।
বিরবির করে বলতে থাকে মিতা।

*******************

অরিয়ন যখন বাসায় ফিরলো তখন সবার ঘুমানোর টাইম হয়ে গেছে। আফরিনরা নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে সন্ধ্যার পর। মিতা নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। অরিয়ন নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কাপড় চেঞ্জ করে আর এক মিনিটও অপেক্ষা করলো না। সরাসরি চলে যায় গেস্ট রুমে। সকাল থেকে একবারও মিতাকে দেখেনি অরিয়ন। অস্থির লাগতে শুরু করেছে অরিয়নের। এক ঝলকের জন্য হলেও মিতাকে দেখতে হবে।

মিতার রুমের কাছে এসে কড়া নাড়ে অরিয়ন।
ঘুমঘুম চোখে কড়া নাড়ার শব্দ শুনতেই চোখ খুলে তাকায় মিতা।

–কে?
শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে মিতা।

–আমি, দরজা খুল।
সাথে সাথে উত্তর দেয় অরিয়ন।

অরিয়নের কণ্ঠ শুনতেই ঘড়ির দিকে তাকায় মিতা। রাত প্রায় ১২ টা। এতো রাতে কেনো এসেছে তা বুঝতে পারছে না মিতা।

–দরজা খুল পরী।
আবারও বলে অরিয়ন।

মিতা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। অপেক্ষা করে অরিয়নের চলে যাওয়ার।

–পরী? কি হয়েছে দরজা খুল।
অরিয়নের কন্ঠে যেন ধৈর্য্য নেই, এমন ভাবে বলতে লাগলো অরিয়ন।

–পরী?

–পরী?

–লাভ? দরজা খুল প্লিজ।
অরিয়ন নিজের শক্তি দিয়ে দরজায় কড়া নাড়ছে যেন ঘুম থেকে উঠে হলেও মিতা দরজা খুলে।

–আমি দরজা খুলবো না। তুমি নিজের রুমে ফিরে যাও।
এতো শব্দ সহ্য করতে না পেরে বলে উঠে মিতা।

–দরজা খুল পরী। তোকে একবার দেখবো।
অনুরোধের সুরে বলে অরিয়ন।

–কাল সকালে দেখো। এখন নিজের রুমে যাও। আমি দরজা খুলবো না।
নিজের ডিসিশন জানিয়ে দেয় মিতা।

–প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ। লেট মি ইন,লাভ।
দরজার লক ধরে মোচড়াতে মোচড়াতে বলে অরিয়ন।

–আই উইল কি*ল ইউ, কি*ল ইউ।
রেগে বলে অরিয়ন।

–সরি, সরি। প্লিজ লাভ, একবার খুল।
পরক্ষণেই কোমলভাবে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের ক্ষনিকের মধ্যে এমন পরিবর্তন দেখে আফরিনের বলা কথাগুলো ভাবে। নিজেকে কঠোর হতে হবে ভেবে চুপ করে খিচ মেরে বসে রইল মিতা। কিছুক্ষণ পরেই বাইরে থেকে শব্দ আসা বন্ধ হয়ে যায়।

” তোমার ভালোবাসাকে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রমিস করেছি আমি, তার জন্য যা করার তাই করবো” বিরবির করে কথাটা বলেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মিতা।

চলবে…

#পারমিতা
#পর্ব_৩২
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

ভোরের আলো মিতার চোখে পড়তেই চোখ খুলে মিতা। চোখে ব্যাথা অনুভব করছে। মোবাইলের ক্যামেরা অন করে নিজের চেহারার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় চোখ ফুলে আছে। গতকাল রাতে কান্না করার কারণে চোখ ফুলে গেছে।

বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় মিতা। বই খাতা সব রেডি করে নেয়। নাস্তা করার উদ্দেশ্যে রুমের দরজা খুলতে নিচে নামে মিতা।

নাস্তার টেবিলে আজ আবরারকে ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে আবরারকে দেখতেই যেন হাসি ফুটলো মিতার ঠোঁটে। দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে সোজা গিয়ে আবরারের পাশে বসে।

–আরিয়ান ভাইয়া।
পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বলে মিতা।

–মিতা, কেমন আছিস?
মিতার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে আবরার।

–ভালো আছি। তুমি কখন আসলে ঢাকা থেকে?
আবরারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–গতকাল রাতে।
জবাব দেয় আবরার।

–কেমন কাটলো তোমার ট্যুর?
উৎসুক মিতা জিজ্ঞাসা করে।

–খুব ভালো।
জবাব দেয় অরিয়ন।

মিতা প্লেটে নিজের খাবার নিয়ে খেতে থাকে। আবরারও নিজের খাবার খাচ্ছে।

–শুনলাম…
কথাটা বলে একটু চুপ থাকে আবরার।

আবরারের কথা শুনে আবরারের দিকে তাকায় মিতা।

–শুনলাম আফরিন ভা…আফরিন আপু ফিরে এসেছে?
মিতার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করে আবরার।

–হ্যাঁ।
জবাব দেয় মিতা।

–যা শুনেছি সব কি সত্যি?
মিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবরার।

–মিথ্যে কেন হবে?
ভ্রু কুচকে বলে মিতা।

–রাশিয়ান মাফি*য়া সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে তোর? তারা কেন একজন মেয়েকে, যে কিনা র*ক্ষিতা হতে গিয়েছিলো তাকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে? ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
অনায়াসে বলে আবরার।

–কি বলতে চাচ্ছো তুমি? ওরা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে কারণ ওরা ভালো মানুষ। সবাই খারাপ হবে এমন কি কোনো কথা আছে?
সরল মনে বলে মিতা।

–না। কথা নেই। তবে মা*ফিয়ারা এতো দয়ালু না মিতা।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে আবরার।

–ওসব কিছু জানিনা আমি। আপু ফিরে এসেছে তাতেই খুশি।
খাবার মুখে দিতে দিতে বলে মিতা।

–আফরিন আপু ফিরে এসেছে তাতে আমিও খুশি। কি একটা এবার হবে।
অন্যমনস্ক হয়ে বলে আবরার।

–কি হবে?
জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–তেমন কিছু না।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে আবরার।

আবারও যেন খাবার টেবিলে নিরবতা বিরাজ করতে শুরু করলো। মিতা একটু পর পর আড় চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ভাবছে গভীর ভাবে।

–তুমি কি জানতে?
হুট করে প্রশ্ন করে মিতা।

মিতার নজর নিজের প্লেটের দিকে। চামচ শক্ত করে ধরে রেখেছে। আবরার মিতার কথা শুনতেই মিতার দিকে তাকায়।

–কি জানতাম?
জিজ্ঞেস করে আবরার।

–তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা ছিলো তা?
নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে মিতা।

মিতা ভালোই জানে আবরার এমন একজন মানুষ যে, কিছু যেনে থাকতে মিতার কাছে কখনোই গোপন করবে না। আনিকা চৌধুরী বা হাবিব চৌধুরী মিতাকে কিছুই বলবে না। অরিয়নও কিছু বলতে অস্বীকার করে দিয়েছে। মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরীর বলার হলে অনেক আগেই বলে দিতে পারতো মিতাকে। তার অর্থ তারা বিষয়টা মিতাকে জানাতে চায় না। একমাত্র ভরসা শুধুই আবরার।
7
–জানতাম।
স্বীকার করে আবরার।

আবরারের কথা শুনে একটা হাসি দিলো মিতা। এই হাসি আনন্দের নয়। নিজের অনুমান ঠিক হয়েছে তার হাসি।

–তুমি কি জানো কেউ আমাকে মা*রতে চায়?
প্রশ্ন করে মিতা।

–জানি।
এবারও স্বীকার করে আবরার।

এবার মিতার হাসির সাথে দু ফোঁটা চোখের পানি প্লেটে পড়লো।

–তুমি কি জানো আন্টি আমাকে অনেক ঘৃণা করে?
কথাটা বলতে যেন মিতার শ্বাস আটকে আসছে। তাও বললো।

–আমরা কেউ অন্ধ না মিতা। সবার চোখ আছে।
জবাব দেয় আবরার।

এবার মিতা চোখ তুলে আবরারের দিকে তাকায়। আবরার আগে থেকেই মিতার দিকে তাকিয়ে আছে। মিতার চোখে পানি ছলছল করছে অন্যদিকে আবরারের চোখেও বিষন্নতা।

–কারণ কি?
আবরারের চোখে চোখ রেখে বলে মিতা। আবরার এবার চোখ সরিয়ে নেয়। কি বলবে নিজেও জানেনা।

–আমার বলার অনুমতি নেই। থাকলে আমি তোর কাছে কিছুই লুকাতাম না।
মাথা নিচু করে বলে আবরার।

–কি ভুলের শাস্তি পাচ্ছি আমি? আমাকে কেনো তোমরা কেউ কিছু বলছো না? কি এমন অপরাধ করেছি যার জন্য তোমরা সবাই মুখ বুজে সব সহ্য করো?
কাঁদতে কাঁদতে বলে মিতা।

–কি হলো বলো? তোমার সাথে কেনো আমার বিয়ে ঠিক হবে? কেনো কেউ আমাকে মারতে চাইবে? কেনো আমি এই বাড়িতে আন্টির চোখের কাঁটা? জবাব দেও আরিয়ান ভাইয়া।
আবরারের শার্টের কলার ধরে চেঁচাতে থাকে মিতা।

মিতার এতো অপমান, এতো রহস্য আর সহ্য হচ্ছে না। যদি কেউ পছন্দই না করে তবে কেনো মিতাকে এখন থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছে না। সামনে থেকেও কেনো অদেখার মতো বাঁচবে মিতা? এতোদিন সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেছিলো, ভেবেছিলো সময়ের পরিক্রমায় সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে ঠিক তার উল্টোটা।

আবরার কাঁদতে থাকা মিতাকে জড়িয়ে ধরে। কি করবে নিজেও বুঝতে পারছে না। তবে মিতার চোখের পানি আবরার সহ্য করতে পারে না।

–কাঁদিস না। কিছু কথা না জানাই ভালো।
মিতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে আবরার।

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন। অনেক্ষন ধরেই সব কিছু দেখছে। হাত দিয়ে রেলিং শক্ত করে ধরা। তাকিয়ে আছে মিতার দিকে। মিতা নিজের দু হাত দিয়ে আবরারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। মিতার মাথা আবরারের কাঁধে। আবরারের হাত মিতার মাথায়। প্রতিনিয়ত মিতার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে আবরার। রাগান্বিত অরিয়ন নিচে আর নাস্তা করতে না নেমেই হাটা শুরু করে।

****************

গাড়িতে বসে আছে মিতা। গন্তব্য নিজেদের বাড়ি। একবার সামনা-সামনি সব কিছু মায়া চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করতে চায় মিতা। নাস্তা শেষ করে কলেজে চলে আসে। নাস্তা করা বা কলেজে আসার সময়ও অরিয়নের সাথে দেখা হয়নি মিতার। মনে মনে ঠিক করেছে এবার যা প্রশ্ন করার তা নিজের মা বাবা থেকেই আগে শুরু করতে হবে। তাই কলেজ থেকে বাড়ি না গিয়ে সরাসরি নিজের বাসায় যাচ্ছে মিতা।

মিতা যখন বাড়িতে ঢুকলো ওয়াহিদ চৌধুরী তখন অফিসে। ওয়াহিদ চৌধুরী নিজের বড় ভাই হাবিব চৌধুরীর ব্যবসার দেখাশোনা করে। ড্রয়িং রুমে মায়া চৌধুরী কারো সাথে মোবাইলে কথা বলতে ব্যস্ত।

–মা?
মুখে বিশাল বড় হাসি ফুঁটিয়ে দৌড়ে যায় মিতা।

–আচ্ছা আমি পরে ফোন দিবো।
কথাটা বলেই মোবাইল রেখে দাঁড়িয়ে পরে মায়া চৌধুরী। মিতাকে জড়িয়ে ধরে।

–কেমন আছে আমার মেয়েটা?
বলে মায়া চৌধুরী।

–ভালো। তুমি কেমন আছো মা?
জবাব দেয় মিতা।

–আমিও ভালো আছি। তুই আসবি কল করে বলিস নি কেনো?
মিতাকে নিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলে মায়া চৌধুরী।

–তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
জবাব দেয় মিতা।

–আচ্ছা তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে। কথা ছিলো তোর সাথে।
বলে মায়া চৌধুরী।

–কি কথা? আর আপু কোথায়?
আশেপাশে খুজে দেখার চেষ্টা করে মিতা।

–আফরিন নিজের রুমে।
জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

–ওহ, কি কথা বলবে?
প্রশ্ন করে মিতা।

–আফরিন আশার খুশিতে একটা পার্টি দিবো ভাবছি। ওর মনটাও ভালো হবে। সারাদিন মন খারাপ করে থাকে।
বলে মায়া চৌধুরী।

–হ্যাঁ দেওয়া যায়। কবে করবে ঠিক করেছো?
প্রশ্ন করে মিতা।

–এখনো করিনি। তুই বল, ২ দিন পর করলে কেমন হবে?
প্রশ্ন করে মায়া চৌধুরী।

–করা যায়।
বলে মিতা।

মিতার সম্মতিতে চোখেমুখে আনন্দ ফুঁটে উঠেছে মায়া চৌধুরীর। একটু পরেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। মাথা নিচু করে কান্না করা শুরু করে দেয় মায়া চৌধুরী।

–আমার হাসিখুশি থাকা মেয়েটাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না, মিতা। কি পাপের শাস্তি দিচ্ছেন আমাদের জানিনা।
কাঁদতে কাঁদতে বলে মায়া চৌধুরী।

–কেঁদো না মা। সময় দেও, আপু ঠিক হয়ে উঠবে দেখো।
মায়া চৌধুরীকে ধরে বলে মিতা।

৯ মাস। ৯ মাস পতি*তালয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে থাকা কোনো মুখের কথা না। একজন নারীর কাছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্পর্শ করার চাইতে বড় শাস্তি আর কিছু নেই। আফরিন কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা কল্পনাও করতে পারছে না মিতা। তাও এটা সকলের জানা বড় থেকে বড় ক্ষতও একদিন ঠিক হয়ে যায়। দরকার শুধু সময়ের। দরকার আপনজন মানুষের সাপোর্ট।
“কিন্তু সেই আপনকে তো তুই নিয়ে নিয়েছিস” কথাটা যেন মিতার মাথায় হুট করেই চলে আসলো। নিজে একটু নড়েচড়ে বসলো।

–এসেছিস যখন তখন আজ থেকে যা। আমি হাবিব ভাইকে ফোন করে বলে দিচ্ছি।
বলে মায়া চৌধুরী।

–আচ্ছা মা। আমি আপুর কাছে যাচ্ছি।
কথাটা বলেই ব্যাগ কাধে নিয়ে আফরিনের রুমের দিকে হাটতে থাকে মিতা।

******************

ছাদে বসে আছে আফরিন আর মিতা। মিতা দোলনায় দোল খাচ্ছে, আফরিন পাশেই চেয়ারে বসে আছে। ছাদের একপাশে করা বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে আফরিন। আর আফরিনের দিকে তাকিয়ে আছে মিতা।

–আমার মাঝে মধ্যে মনে হতো ঐ জাহান্নাম থেকে হয়তো আমি কখনো রক্ষা পাবো না।
হুট করে বলতে শুরু করে আফরিন।

–একবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ধরে ফেলেছিলো আমাকে..সেদিন আমি বুঝতে পারলাম না খেয়ে থাকার কষ্ট কতটা। শুধু পানি খেয়ে ৪ দিন ছিলাম। ওরা আমাকে খাবার দেয়নি।
বাগানের দিকে একমনে তাকিয়ে থেকে বলে আফরিন।

মিতা দোলনা থেকে উঠে আফরিনের পাশের চেয়ারে বসে। আফরিনের হাতে নিজের হাত রাখে।

–কত কত দোয়া করেছি আমি জানিনা..তবে আমার চোখের পানিতে হয়তো তার একটু দয়া হয়েছে তাই রাশিয়ায় আমি ও চলে গেলাম।
দু জনের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে আফরিন।

–মা*ফিয়ার মতো মারাত্মক জায়গা থেকে কীভাবে ফিরে আসলে তুমি? বাড়িতেই বা কেনো দিয়ে গেলো তোমাকে?
আফরিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–জানিনা। হয়তো পুরোটাই মিরাকেল। তবে..
একটু বলে থামে আফরিন।

–তবে?
প্রশ্ন করে মিতা।

–তবে ওদের বসকে দেখে আমার চেনাচেনা লাগছিলো। মনে হয়েছিলো কোথাও তো দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে করতে পারছি না।
বলে আফরিন।

–কি বলছো? রাশিয়ান মা*ফিয়া বসকে দেখেছো এর আগে?
একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–বস কিন্তু রাশিয়ান ছিলো না।
বলে আফরিন।

–কিহ?

–হ্যাঁ। দেখতে এশিয়ান মনে হয়েছিলো আর ছেলেটা আমার কথা সব বুঝতে পারছিলো। এত্ত ইয়াং বয়সে মা*ফিয়া কিভাবে হয়ে গেলো তাও মাথায় যাচ্ছিলো না।

–ইয়াং মানে? মাইকেল এর মতো না?
প্রশ্ন করে মিতা।

–না। ২০/২১ হবে যতোদূর আমার মনে হয়েছে।
বলে আফরিন।

–কি বলো, এতো কম বয়সে মা*ফিয়া বস!
অবিশ্বাসের সুরে বলে মিতা।

–হুম। আচ্ছা বাদ দে। আমাকে ছাড়া কি কি করলি তা বল।
একটু হাসি দিয়ে বলে আফরিন।

–তেমন কিছুই না। তবে আমরা প্যারিস গিয়েছিলাম।
বলে মিতা।

–তাই নাকি? কি কি দেখলি?
প্রশ্ন করে আফরিন।

–হ্যাঁ, আচ্ছা শুনো কি কি দেখেছিলাম।
বলতে শুরু করে মিতা।

**************

বিছানায় শুয়ে আছে মিতা। এসেছিলো মায়া চৌধুরী আর ওয়াহিদ চৌধুরীর কাছে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুজতে। কিন্তু মায়া চৌধুরীর অবস্থা দেখে আর পার্টির কথা শুনে মহল নষ্ট করতে মন চায় নি মিতার। পার্টি শেষ হলেই জিজ্ঞেস করবে ঠিক করেছে মিতা।

****************

সকালের নাস্তা শেষ করেই বাড়িতে চলে এসেছে মিতা। আজ কলেজ বন্ধ তাই টিউশন টিচার ১০ টা করে আসবে মিতাকে পড়াতে। তাই নাস্তা করেই আর অপেক্ষা না করে চলে আসে মিতা। শায়লার সাথে ড্রয়িং রুমে দেখা হতেই একটু কথা বলে নেয় মিতা।

শায়লার সাথে কথা শেষ হতেই রুমের দিকে যায় মিতা। রুমের সামনে আসতেই একটু দাঁড়িয়ে যায় মিতা। রুমের দরজা খোলা। সাধারণত মিতার এই গেস্ট রুমে কারও আসার কথা না। মিতার স্পষ্ট মনে আছে যাওয়ার সময় মিতা দরজা লাগিয়ে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে রুমের দিকে বিছানায় পা ঝুলে থাকতে দেখে মিতা। রুমের মধ্যে ঢুকতেই দেখতে পায় অরিয়ন বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। পা খাট থেকে নিচে ঝুলছে। পড়নে কোর্ট প্যান্ট। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। পাশেই টেবিলে অরিয়নের ব্রিফকেস রাখা।

অরিয়নকে দেখে মিতার বুঝতে একটু ও সময় লাগেনি যে, অরিয়ন এভাবে কাল রাত থেকে শুয়ে আছে। পরণের টাই খোলা, শার্টের বাটন খোলা। ইন করা শার্ট বেরিয়ে আছে। মিতা ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই অরিয়নের চেহারা মিতার সামনে আসে।
চোখমুখে ক্লান্তি ফুঁটে উঠেছে অরিয়নের। মনে হচ্ছে কতরাত ঘুমায় নি। চোখগুলো কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। হুট করেই সামনা-সামনি তাকাতেই মিতার সাথে চোখাচোখি হয় অরিয়নের। মিতাকে দেখতেই ধীরে সুস্থে উঠে বসে অরিয়ন। নিজের হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে।

রাগান্বিত অরিয়নকে দেখে মিতার ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু সামনে বসে থাকা অরিয়নের চেহারায় রাগের কোনো চিহ্ন নেই। এমন শান্ত শিষ্ট অরিয়নকে দেখে মিতার রুহ যেন কেঁপে উঠছে।

চুল ঠিক করে মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন। আলতো করে এক হাসি দেয়। অরিয়নের হাসি দেখে দু পা পিছিয়ে পড়ে মিতা। মিতার পিছিয়ে পড়া লক্ষ্য করতেই বাঁকা এক হাসি দেয় অরিয়ন।

–আমার মানতেই হবে। তুই খুব সাহসী।
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় অরিয়ন।

অরিয়নকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই আর অপেক্ষা না করে দৌড় দেয় মিতা। লক্ষ্য যত দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

–ওহ, নো..
ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে কথাটা বলেই দৌড় দেয় অরিয়ন।

চলবে…

#পারমিতা
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

মিতা কেন দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো তা মিতা জানেনা। শুধু জানে অরিয়নের চোখ দেখে একটা কথাই মাথায় ঘুরছে” আবারও থাপ্পড় মারলে?”।

নিজের স্বমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড় দিতেই দরজার কাছাকাছি চলে আসে মিতা। আর এক পা এগোলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু মিতার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো যখন পেছন থেকে একজোড়া হাত এসে মিতার কোমর ধরে মিতাকে শূন্যে তুলে নেয়।

–না, না, না, না। ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো।
চেঁচামেচি করতে থাকে মিতা।

মিতার চেঁচামেচি যেন অরিয়নের কানে গেলোই না। ক্ষণিকের মধ্যে কাঁধে তুলে নেয় মিতাকে। হঠাৎ করে মিতাকে এভাবে কাঁধে তুলে নিতেই অবাক হয়ে যায় মিতা। কিছু বুঝে উঠার আগেই অরিয়ন হেটে সোজা চলে যায় বেডের সামনে। ধুপ করে বিছানায় ফেলে অরিয়ন। নরম তোশকে মিতা ব্যাথা পায়নি, তবে এভাবে হঠাৎ করে ফেলে দিবে বলেও প্রস্তুত ছিলো না মিতা। শোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসার আগেই মিতার উপর ঝাপিয়ে পড়ে অরিয়ন।

–কি করছো?
মিতার কথা শুনতেই নিজের এক হাত দিয়ে মিতার দু হাত নিয়ে মাথার উপর বিছানায় চেপে ধরে অরিয়ন।

–পরী.পরী.পরী.আমার বোকা পরী।
মিতার কাছাকাছি নিজের মুখ নিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতার গাল স্পর্শ করার জন্য নিজের ডান হাত এগিয়ে নেয় অরিয়ন। অরিয়নের হাত এগিয়ে আসতে দেখেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ সরিয়ে নেয়। যতোটা পারে নিজের মুখ বিছানায় গুজে দেওয়ার চেষ্টা করে। অপেক্ষা করে অরিয়নের থাপ্পড়ের। চোখ বন্ধ করে থাকা অপেক্ষা করলেও অরিয়নের হাত মিতার গাল স্পর্শ করলো না। চোখ তুলে অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা।

ভয়ে মিতা মুখ সরিয়ে নিতেই অরিয়নের হাত শূন্যে স্থির হয়ে রইল। কি জন্য মিতা এমন করলো তা বুঝতেও সময় লাগলো না নিজের। মুখের কোণ থেকে হাসিটা সরে যায় অরিয়নের। দাঁতে দাঁত চেপে রইল। নিজের প্রতি হঠাৎ করেই রাগ হচ্ছে অরিয়নের।

মিতা চোখ তুলে অরিয়নের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের হাত বাড়িয়ে হাতে উলটো পাশ দিয়ে মিতার গাল স্পর্শ করে। মিতা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিয়নের দিকে।

–সেই ভুল আর হবে না, লাভ।
মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে অরিয়ন।

“লাভ? কিসের লাভ?” মনে মনে ভাবে মিতা। মিতা ভালোই জানে এখন মিতার প্রতি অরিয়নের এই মোহ ততোদিন থাকবে যতোদিন না অরিয়ন পুরোপুরি সব মেনে নিয়ে মুভ অন করছে। যখন মিতার প্রতি এই নির্ভরশীলতা কেটে যাবে তখন অরিয়ন ঠিক আগের মতোই আফরিনের পথ চেয়ে থাকবে।

–ভেবেছিস একটা কাঠের দরজা আর অন্য একটা বাড়ি তোকে আমার থেকে দূরে রাখতে পারবে? এতো সহজ? কি ভেবেছিলি? আমি সেদিন চলে গিয়েছিলাম?
কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দেয় অরিয়ন।

মিতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল অরিয়নের দিকে।

–চাবি হাতে সারারাত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।
নিজের হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মিতার নিচের ঠোঁট স্পর্শ করে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় মিতা। “কি বলছে এসব? এতোটা মরিয়া কেন বিহেভ করছে অরিয়ন?” কিছুই যেন মিতার মাথায় ঢুকছে না।

–নেক্সট টাইম আমি ভদ্রতা দেখিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো না, পরী। চাবি থাকুক বা না থাকুক। দরজা ভেঙ্গে হলেও তোর কাছে যাবো।
মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

–নিজের থেকে আমাকে দূরে সরাতে দিবো না আমি।

–কেন?
অরিয়ন কথাটা বলতেই জিজ্ঞেস করে বসে মিতা।

মিতার মনে একটু হলেও আশার আলো জাগছে। এই ভেবে হয়তো এই কয়েক মাসে মিতার প্রতি একটু হলেও ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে অরিয়নের। অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল অরিয়নের দিকে।

–কারণ তুই আমার। কারণ তুই আমার ওয়াইফ। কারণ তুই আমার পরী।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের জবাব শুনে মিতার আশা হতাশায় রুপ নিতেও সময় নিলো না। “কি ভাবছিলি তুই? এতো বছরের ভালোবাসা ভুলে তোকে ভালোবাসবে? আফরিনকে ভুলে যাওয়া এতোই সহজ? তুই শুধুই অবসেশন আর কিছুই না” নিজের মন বলতে থাকে মিতাকে।

ক্ষণিকের মধ্যে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে মিতার ঠোঁটে। চোখের কোণে হালকা করে পানি জমে। নিজেকে শক্ত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অরিয়নের দিকে।

–হাত ছাড়ো।
কঠোরভাবে বলে মিতা।

–পারলে ছাড়িয়ে নে।
মিতার হাতে আরও প্রেশার দিয়ে বলে অরিয়ন।

–আমাদের দুই বোনকে ইউস করতে খুব ভালো লাগছে তোমার তাই না?
ঘৃণার চোখে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

মিতার কথা শুনে হাত আরও শক্ত করে ধরে অরিয়ন। চোখে রাগ ফুটে উঠে সাথে সাথে।

–কি বললি?
দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।

–যা শুনেছো তাই বলেছি।
সাথে সাথে জবাব দেয় মিতা।

–মুখ সামলে কথা বলবি পরী।
উচ্চস্বরে বলে অরিয়ন।

–ওহ, তাই নাকি? তো মি. অরিয়ন আপনার কেমন লাগছে আমাদের দু বো..

–চুপ, একদম চুপ।
ক্ষণিকেই মধ্যে অন্য হাত দিয়ে মিতার মুখ চেপে ধরে অরিয়ন। মিতা নিজের কথাও শেষ করতে পারেনি।

–আমি সহ্য করছি বলে এই না তুই যা খুশি তাই বলবি।
নিজের মুখ মিতার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলে অরিয়ন।

–অহ, তুমি ইউস করছো না? আমি আবার ভাবলাম করছো। দেখো না, এই মূহুর্তে আমার জন্য কতোই ডেস্পারেট তুমি। আবার আপুর দিকে তাকালে তোমার চোখে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
তাচ্ছিল্যের হাসি যেন মিতার মুখ থেকে সরছেই না।

–পরী……
চেঁচিয়ে উঠে অরিয়ন।

–কি? সত্যি কথা গায়ে লাগছে? ওহ ওয়েট।
কথাটা বলে একটু থামে মিতা।

–আমার জন্য এতো ডেস্পারেশন কী আমার সাথে রাত কাটানোর জন্য? আমাকে তোমার এতোই ভালো লেগেছে যে ৬ বছরের ভালোবাসাও ভুলতে সম…

–ঠাসসসসসসসসসস…
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই থা*প্পড় মা*রে অরিয়ন।

অরিয়নের হাত মিতার গাল স্পর্শ করতেই মুখ অন্যপাশে ঘুরে যায় মিতার। পরক্ষণেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে মিতার।

–তোমার আফরিন ফিরে এসেছে। কেন তোমরা একে অপরের কাছে ফিরে যাচ্ছো না? কেন আমাকে মুক্তি দিচ্ছ না এসব থেকে? আমি তোমার শারীরিক চাহিদা মেটাতে পারবো ন…

–পারমিতা….
ভয়ানকভাবে চেঁচিয়ে উঠে অরিয়ন।

মিতার চোখ দিয়ে পানি পড়া ক্ষণিকের জন্যও কমছে না। যেখানে দু জনের একসাথে থাকা সম্ভব হবে না সেখানে কেন মিতা মিথ্যে স্বপ্ন নিয়ে বাঁচবে?

–তুই, তুই আমার সম্পর্কে এরকম ভাবতে পারলি?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–তোর মনে হয় আমি তোর শরীর চাই?
কথাটায় যেন ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পেলো না।

অরিয়নের প্রশ্ন শুনতেই মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয় মিতা। সময় এসেছে অরিয়নের সত্যটা মেনে নেওয়ার। মেনে নিতে হবে যে, ওর একমাত্র ভালোবাসা শুধুই আফরিন। মেনে নিতে হবে যে, মিতা ভালোবাসা নেই এমন কোনো সম্পর্কে কখনো থাকবে না।

মিতার মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াটা যেন থা*প্পড়ের মতো অরিয়নের মুখে পড়লো। এই ঘুরিয়ে নেওয়ার মানে “এমন টাই ভাবে মিতা”।
ঝড়ের গতিতে মিতার থেকে সরে আসে অরিয়ন।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া
নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠে অরিয়ন।

–তোর শরীর চাই আমি?
ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সব কিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে অরিয়ন।

–আমার সম্পর্কে এমন জঘন্য ভাবিস তুই?
সোফায় লাথি মেরে বলে অরিয়ন।

মিতা নিজের জায়গা থেকে নড়লো না। নিজের হাত দিয়ে চাদর শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো।

–এসব ভেবে আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাস তুই?
দেয়ালে স্বজোরে ঘুসি মেরে বলে অরিয়ন।

–আমার থেকে দূরে সরে যেতে চাস, দূরে সরে যেতে চাস, দূরে সরে যেতে চাস।
মন্ত্রের মতো কথাটা বলতে বলতে একের পর এক ঘুসি মারতে থাকে অরিয়ন।

হাত থেকে র*ক্ত বের হওয়া শুরু করেছে। তাও থামছে না অরিয়ন। বিছানায় শুয়ে থাকা মিতা চোখ দিয়ে না দেখলেও, ভালোই জানে অরিয়ন এখন কি করছে। নিজের মনকে শক্ত করে শুয়ে রইল মিতা। এখন অরিয়নের এই পাগলামোতে কেয়ার দেখাতে গেলে মিতার জন্য সবটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। মিতার চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে শুরু করেছে বিছানার চাদরে।

–হাহাহাহাহাহাহহাহাহাহাহাহা।
হুট করে হাসতে থাকে অরিয়ন।

হঠাৎ করে এরকম শব্দ করে হাসিতে মুখ ঘুরিয়ে অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা। এমন কেনো করছে বুঝতে পারছে না। একটু আগেও তো রাগান্বিত ছিলো তবে এখন কেন এভাবে হাসছে তা বুঝতে পারছে মিতা।

–হাহাহাহাহাহহহাহাহাহাহাহ।
নিজের র*ক্তাক্ত হাত কোমরে রেখে হাসতে থাকে অরিয়ন। হাসতে হাসতেই মিতার দিকে এগিয়ে যায়।

বিছানায় শুয়ে থাকা মিতা অরিয়নের এগিয়ে আসা দেখছে। অরিয়নের মুখ হাসি। তবে এই হাসির মানে মিতা জানেনা। চেহারা দেখে কিছুই বুঝতে পারছে না মিতা। অরিয়ন বেডের সামনে আসতেই মিতার পা ধরে টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসে। কি হচ্ছে মিতা তা ভাবারও সময় পেলো না। বিছানার শেষ দিকে আসতেই হাত ধরে টান দিয়ে বসায় অরিয়ন। হাটু ভেঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে নিজেও। মিতার কাছাকাছি যতোটা সম্ভব এসে দু হাত শক্ত করে ধরে রাখে অরিয়ন।

মিতা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

–ঠিক আছে।
বলে অরিয়ন।

এতোক্ষণে মাথায় ঢুকলো মিতার। অরিয়ন অবশেষে সত্যটা মানতে চাচ্ছে ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মিতা। এখন হয়তো সব ভুলে আফরিনের কাছে আবারও ফিরে যাওয়াটা মেনে নিয়েছে বলে মনে করে মিতা। নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই তা আরও শক্ত করে ধরে অরিয়ন। মিতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে অরিয়নের দিকে।

–তোর যদি মনে হয় আমি তোর শরীরের জন্য তোকে চাই তাহলে..

–তাহলে এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসা উচিৎ। তাই না?
মুখে একটু হাসি ফুঁটিয়ে বলার চেষ্টা করে মিতা।

মিতার হাসির বিনিময়ে মিষ্টি এক হাসি ফিরিয়ে দেয় অরিয়ন।

–তাহলে তাই।
কথা শেষ করে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনতেই মুখ থেকে হাসি খায়েব হয়ে যায় মিতার। তাই মানে কি? কি বলতে চাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না মিতা।

–মানে?
প্রশ্ন করে মিতা।

–তোর শরীরের জন্য চাই তাই তো? তাহলে তাই। এই জন্য হলেও তোর থেকে যেতে হবে। আমার থেকে দূরে যেতে পারবি না তুই।
মিতার হাতে আলতো করে চুমু খেতে খেতে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় মিতার। নিজের হাত সরানোর চেষ্টা করলেও সফল হয় না।

–তোর ঘৃণা আমি সহ্য করতে পারবো কিন্তু তোর থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়। এতে যদি তোর হাত পা বে*ধেও তোকে আটকে রাখতে হয় তাহলে তাই করবো।
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় অরিয়ন।

–আফরিনের প্রতি আমার অনুভূতির কী হয়েছে আমি জানিনা। তোর জন্য আমার হঠাৎ করে কী হয়েছে তাও আমি জানিনা। তবে মনে রাখ, যদি তোর আমার থেকে দূরে যেতেই হয়,তবে দুজনের একজনের লা*শের উপর দিয়ে যেতে হবে।
কথাটা বলতে বলতে নিজের র*ক্তাক্ত হাত নিজের গায়ে থাকা শার্টে মুছতে থাকে।

–তুই আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় সুখের সংসার করবি, সেই স্বপ্ন তোর স্বপ্নই থেকে যাবে। তোকে অন্য কারো হওয়া দেখার চাইতে তোর লা*শ দেখা পছন্দ করবো আমি।
কথাটা বলেই মিতার ঠোঁট হুট করেই চুমু খায় অরিয়ন।

চলবে…