পারমিতা পর্ব-৩৯+৪০+৪১

0
106

#পারমিতা
#পর্ব_৩৯
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

অরিয়ন বাসায় আসার আগেই ডাক্তার আর নার্সরা বাসায় এসে অপেক্ষা করছে। কাজের লোকরা অরিয়নের রুম থেকে শুরু করে সব কিছু রেডি করে রেখেছে। ওয়াহিদ চৌধুরী গাড়িতে উঠতেই কল করে বলে দিয়েছে অরিয়ন ট্রিটমেন্ট বাসায় করাবে। যেহেতু অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে সেহেতু এখন ভয়ের কিছু নেই।

আফরিনের সাথে কথা শেষ করে নিজের রুমের চলে আসে মিতা। অরিয়নকে হাসপাতালে আবার দেখতে যাবে। যতো যাই হয়ে যাক, অরিয়ন মিতাকে ভালো না বাসলেও মিতা তো বাসে। দূর থেকে হলেও চোখের দেখাটা হলেও দেখে আসবে মিতা। হাসপাতালে গিয়ে সুযোগ বুঝে হাবিব চৌধুরীর সাথেও একটু কথা বলে নিবে। ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে যায় মিতা।

অরিয়ন যে বাড়িতে নিজের ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করেছে সে সম্পর্কে বেখেয়াল মিতা। অন্য কেউ ও মিতাকে এই খবর দেয় নি, আসলে দেওয়ার সুযোগ হয়নি। ক্লান্ত মিতা নিজের রুমে চলে এসেছে সরাসরি, আফরিন বা আবরার এই কথা বলার সুযোগ পায়নি আর।

অরিয়ন বাসাতে আসতেই তাড়াতাড়ি করে ধরে রুমে নিয়ে যায় সবাই। অরিয়নের শরীর আর মাথা থেকে ঘাম ঝরছে অনবরত। বুকের ব্যাথাটা সহ্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে অরিয়ন। তাড়াতাড়ি করে অরিয়নকে রুমে নিতেই নার্সরা ড্রেসিং করতে চলে আসে। র*ক্তক্তা হাত আর বুকের ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ব্যান্ডেজ করে স্যালাইন লাগায়।

স্যালাইন হাতে লাগিয়ে শুয়ে আছে অরিয়ন। শরীর থেকে র*ক্ত যাওয়া ও পেইন কি*লার খাওয়াতে এখন ঘুমাচ্ছে। অরিয়নের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আনিকা চৌধুরী। চোখেমুখে রাগ যেন ভেসে উঠেছে স্পষ্ট। এই রাগ নিজের প্রতি, নিজের ছেলের প্রতি। যে সব কিছু জানার পরও মিতার জন্য পাগলামি করেই যাচ্ছে।

হাবিব চৌধুরী আর ওয়াহিদ চৌধুরী ড্রয়িং রুমে বসা। নিজেদের মধ্যে কথা চলছে। যে মিতাকে মা*রার চেষ্টা করেছে তাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে পুলিশ। কোন দিক থেকে গুলি চলেছে তা কেউ বলতেও পারেনি। বাড়িতে সিসিটিভির ব্যবস্থা থাকতেও ক্যামেরায় কিছুই ধরা পড়েনি। যেন কোথায় কী আছে সব কিছুই খু*নির জানা।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তাড়াতাড়ি করে নিজের ব্যাগ কাঁধে নেয় মিতা। মনটা হুট করে আনচান করছে। একবার গিয়ে অরিয়নকে দেখে আসবে ঠিক করেছে। রুম থেকে বের হতেই লক্ষ্য করে ড্রয়িং রুমে বসে আছে ওয়াহিদ চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী। নিজেরা কথায় ব্যস্ত ভেবে আর সেদিকে আগায় না মিতা। বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করে।

–কোথায় যাচ্ছিস?
ডাক দেয় হাবিব চৌধুরী।

–হাসপাতালে চাচ্চু।
জবাব দেয় মিতা।

–হাসপাতালে? হাসপাতালে কেন? অরিয়ন তো বাসায়।
ভ্রু কুঁচকে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–বাসায়? হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিলো এতো তাড়াতাড়ি?
প্রশ্ন করে মিতা।

–হাসপাতাল তো দিতে চায়নি। তবে নবাব আর থাকতে চাচ্ছিলো না। নবাব তো হাসপাতাল থেকে একা একাই বের হয়ে গিয়েছিলো তোকে খুজতে।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমাকে খুজতে?
বলে মিতা।

–হ্যাঁ। বাড়িতে ফোন করে তুই নেই সেটা শুনার পড়ই পাগলের মতো দৌড়ে বাড়িতে গিয়েছিলো। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কী যে অবস্থা হয়েছিলো। হাসপাতালে নিতে চাইলে বললো বাসায় থাকবে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

মিতা এবার হাবিব চৌধুরী ও ওয়াহিদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে যায়। অরিয়ন মিতার জন্য ম*রতে বসেছিলো সেটা কী কম ছিলো? যে এখন এই অসুস্থ শরীর নিয়েও খোজাখুজি করতে হবে?

–তোরা থাক আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নি।
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় হাবিব চৌধুরী।
চলে যায় মিতা আর ওয়াহিদ চৌধুরীকে একা রেখে।

–খাওয়া দাওয়া করেছিস কিছু?
প্রশ্ন করে ওয়াহিদ চৌধুরী।

মাথা নাড়িয়ে না বলে মিতা।

–কেন? না খেলে যে শ…

–আমাকে কে আর কেনই বা মা*রতে চাইবে বাবা? আমি কী করেছি?
ওয়াহিদ চৌধুরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠে মিতা। মিতার প্রশ্নে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–কে মা*রতে চায় জানিনা। তবে মনে হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়ের শত্রু। অরিয়নকে ভয় দেখানোর জন্যই তোর উপর বার বার এটাক করছে।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–বাবা, একটা প্রশ্ন করি?
বলে মিতা।

–আমার কাছে প্রশ্ন করার জন্য কবে থেকে আবার তোর অনুমতির প্রয়োজন পড়লো?
মিতার মাথায় হাত রেখে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–মায়ের কী কেউ ছিলো না? বাবা-মা কেউ? তারা কেন আমার সাথে যোগাযোগ করেনি?
প্রশ্ন করে মিতা। মা বলতে মিতা যে সুমাইয়া চৌধুরীর কথা বুঝিয়েছেন তা বুঝতে পেরেছে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–কোনোদিন তো এসব কথা জিজ্ঞেস করিস নি? তবে আজ কেন?
উলটো প্রশ্ন করে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–আজ মার কথা খুব মনে পড়ছে তাই। তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে।
মাথা নিচু করে মন খারাপ করে বলে মিতা।

–তোর মা বাবার বিয়েটা ছিলো ভালোবাসার। তোর নানা বিয়েতে রাজি ছিলো না তাই তোর মা পালিয়ে আসে ওয়াসিমের সাথে। মেয়ের পালিয়ে যাওয়াতে তোর নানা অনেক কষ্ট পান। সে ছিলো বড়ই জেদি মানুষ। সুমাইয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তোর মা বাবার মৃত্যুর খবর পাঠালেও সে আর যোগাযোগ করেনি।
সব ঘটনা মিতাকে খুলে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী। লুকানোর মতো কিছুই নেই। যেই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখার ছিলো তা তো আনিকা চৌধুরী বলেই দিয়েছে৷ বাকি সব কিছু তো অরিয়ন মিতাকে খুলে বলেছে।

–না….নানা ভাইয়ের নাম কী?
আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে মিতা। মনে মনে দোয়া করছে কবির রহমান যেন একটা ঠকবাজ হয়। হাবিব চৌধুরীকে নিয়ে যেভাবে কথা বলেছে তা একটু ও ভালো লাগেনি মিতার।

–নামটা….
একটু ভাবে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–আসলে অনেকদিন হয়েছে তো তাই…ক…করিম..কবির…হ্যাঁ, মনে পড়েছে…কবির রহমান।
ভেবে চিন্তে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

ওয়াহিদ চৌধুরীর জবাবে কিছুটা হতাশ হলো মিতা। কি করবে বুঝতে পারছে না।

–তুমি কি তাকে কখনো দেখেছিলে?
প্রশ্ন করে মিতা।

–না। তবে একবার ছবি দেখেছিলাম। সুমাইয়ার সাথে ছিলো। তবে হাবিব ভাইয়া দেখেছিলো কয়েকবার।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–বড় চাচ্চু কেনো?
প্রশ্ন করে মিতা।

–কারণ সুমাইয়া পালিয়ে আসার পর উনি খুব হেনস্তা করতে চেয়েছিলেন আমাদের। তখিন সব কিছু হাবিব ভাইয়াই হ্যান্ডেল করেন।
বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–ওহ আচ্ছা।
বলে মিতা।

–তুই মন খারাপ করিস না। তোর মা বাবা আর অহনার সাথে যা হয়েছে তাতে তোর কোনো দোষ নেই।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–এই বাড়িতে কেন অহনা আপুর ছবি নেই? কেন কোনোদিন অহনা আপুর নাম শুনিনি আমি?
অশ্রুসিক্ত নয়নে ওয়াহিদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–অরিয়নের জন্য।
জবাব দেয় ওয়াহিদ চৌধুরী।

–মানে?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে মিতা। অরিয়নের জন্য এমনটা কেন হবে তা বুঝতে পারছে না।

–মানে অরি…

–ওয়াহিদ….এইদিকে তাড়াতাড়ি আয়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাক দেয় হাবিব চৌধুরী।

–আসছি ভাইয়া। পরে কথা বলবো। তুই খেয়ে নিস।
কথাটা বলেই হাবিব চৌধুরীর দিকে চলে যায় ওয়াহিদ চৌধুরী।

মিতাও সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে৷ উদ্দেশ্য অরিয়নকে একবার দেখা।

****************

অরিয়নের রুমে একজন নার্স ছাড়া আর কেউ নেই। অরিয়ন বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। নার্স কাউচে বসে ঝিমাচ্ছে। মিতা ধীর পায় অরিয়নের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অরিয়নের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে লাগছে।

” আমাকে বিয়ের করার সাথে আমার মৃত্যুর কী সম্পর্ক? আমাকে বিয়ে করে কী কম উপকার করেছো যে জীবন দিয়েও আরও করতে হবে?” ঘুমন্ত অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে মিতা।

অরিয়নের পাশে বেডে বসে মিতা। নিজের হাত দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করে অরিয়নের হাত।

“সবকিছু কী ভালোবাসা থেকে করতে পারলে না?” অরিয়নের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলে মিতা।

“পরের জন্মে আমি না হয় তোমার আফরিন হবো, তুমি আমার আফনান হয়ে এসো” কথাটা বলতেই মিতার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। আলতো করে অরিয়নের হাত উঁচু করে তাতে চুমু খায় মিতা।

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অরিয়ন রুমে ঘটে যাওয়া কিছুই জানতে পারেনি। তবে কিছু একটা স্বপ্নে দেখতেই ঘুমের চোখে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে অরিয়নের।

***************

সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিয়েছে। ওয়াহিদ চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে মায়া চৌধুরীকেও নিয়ে এসেছে। গেস্ট রুমে মিতার সাথে আজ আফরিন ও ঘুমাবে।

বিছানায় শুয়ে আছে মিতা। আফরিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু মিতার চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না।

–টুং
মোবাইলের আওয়াজ শুনতেই মোবাল হাতে তুলে নেয় মিতা। স্ক্রিনে আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ দেখা যাচ্ছে। ইনবক্সে প্রবেশ করে মিতা।

আননোন নাম্বার :
ঘরের শত্রু বিভীষণ। তোমাকে যে মারতে চায় সে চৌধুরী পরিবারেরই একজন।
ইতি K.R.
মেসেজ আসে আননোন নাম্বার থেকে।

মেসেজ দেখেই লাফিয়ে উঠে বসে মিতা। কে পাঠিয়েছে এই মেসেজ আর কথাই বলছে বুঝতে পারছে না। চৌধুরী পরিবারের লোক কখনোই মিতার সাথে এমন করতে পারে না। ছোট থেকে সবাইকে দেখে আসছে মিতা।

মিতা:
কে আপনি? ফাইজলামি করা মোটেও পছন্দ করিনা আমি। আর কখনো মেসেজ দিবেন না।

সাথে সাথে মেসেজের রিপ্লাই দেয় মিতা।

অপর পাশ থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি। কতক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে আছে তা মিতা জানেনা। শুধু জানে ভালো লাগছে না। মাথা থেকে মেসেজের ব্যাপারটা শত চেষ্টা করেও সরাতে পারছে না। মাথা ঘুরিয়ে আফরিনের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে আফরিন ঘুমাচ্ছে। কিছু একটা ভেবে বিছানা থেকে নামে মিতা। ধীরপায়ে রুমের দরজা লাগিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

ধীরে ধীরে হেটে গিয়ে দাঁড়ায় অরিয়নের রুমের সামনে। দরজা খুলতেই দেখতে পায় ঘুমিয়ে থাকা অরিয়নকে। পাশেই বসে মোবাইল টিপছে একজন নার্স। মিতাকে দেখতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠে সে। হাতের ইশারায় বসে থাকতে বলে মিতা। নার্স ও নিজের জায়গায় আবারও বসে পড়ে। অরিয়নের পাশে যেতেই নার্স উঠে দাঁড়ায়,গিয়ে বসে সোফায়। মিতা অরিয়নের পাশে বসে খাটের সাথে হেলান দেয়।

***************

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে মিতার। লাফিয়ে উঠে দেখে অরিয়ন এখনো ঘুমাচ্ছে। গতকাল রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি মিতা। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই বেরিয়ে আসে নার্স। মিতা কোনো কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

স্টাডি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। হাবিব চৌধুরীর সাথে কিছু কথা বলার ছিলো। কবির রহমান যা বললো ও আননোন নাম্বার থেকে যা আসলো সব হাবিব চৌধুরীকে বলে দিবে বলে ঠিক করেছে মিতা। আর যাই হোক হঠাৎ করে কেউ একজন এসে এই পরিবার নিয়ে বললে তা অন্ধবিশ্বাস করা মিতার জন্য বোকামি হবে।

–চাচ্চু ভিতরে আসবো?
দরজা খুলে উঁকি দিয়ে বলে মিতা।

চেয়ারে বসে আছে হাবিব চৌধুরী। হাতে চায়ের কাপ। মিতার কন্ঠ শুনতেই মুখ তুলে মিতার দিকে তাকায়। মিতাকে দেখতেই মুখে ফুটে উঠে মিষ্টি হাসি।

–আয়।
টেবিলে কাপ রাখতে রাখতে বলে হাবিব চৌধুরী।

মিতাও হাসি দিয়ে যায় হাবিব চৌধুরীর সামনে। পাশে থাকা চেয়ার টেনে বসে মিতা।

–এতো সকাল সকাল এখানে? কিছু বলবি?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।

–মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।
বলে মিতা।

মিতার কথা শুনতেই হাবিব চৌধুরীর চেহারায় বিষন্নতা ফুঁটে উঠে।

–আমার নানাভাই কবির রহমানকে চিনো তুমি?
কিছু একটা ভেবে হাবিব চৌধুরীর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে মিতা।

মিতার কথা শুনতেই মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় হাবিব চৌধুরী। দেখে মনে হচ্ছে চুরি ধরা পড়েছে। কেমন যেন বার বার মিতার থেকে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ করে হাবিব চৌধুরী এহেন পরিবর্তন দেখে মিতা গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। অপেক্ষা করতে থাকে হাবিব চৌধুরীর উত্তরের।

–না।
অন্যদিকে তাকিয়ে কিছু একটা করার অভিনয় করতে করতে বলে হাবিব চৌধুরী।

“বাবা তো বলেছিলো..” মনে মনে কথাটা ভাবে মিতা।

–কখনো দেখা হয়েছিলো নানা ভাইয়ের সাথে?
ভ্রু কুঁচকে হাবিব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–কী হয়েছে তোর? সকাল সকাল এতো প্রশ্ন করছিস কেন?
চেঁচিয়ে উঠে হাবিব চৌধুরী। চোখেমুখে রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।

হঠাৎ করে চেঁচানোর কারণে লাফিয়ে উঠে মিতা। তা লক্ষ্য করে হাবিব চৌধুরী। বড় বড় করে একটু শ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে হাবিব চৌধুরী।

–সরি। আসলে একটা নিউজ শুনে এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না। তার উপর এতো প্রশ্ন শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–না, কোনোদিন দেখা হয়নি। আজ কেন জিজ্ঞেস করছিস?
প্রশ্ন করে হাবিব চৌধুরী।

“মিথ্যে” মনে মনে বলে মিতা।

–না এমনিতেই। গতকাল মায়া মার সাথে কথা বলার সময় কথায় কথায় নানা ভাইয়ের নাম উঠেছিলো। ভাবলাম তুমি তো পরিবারের সবার বড় হয়তো তুমি চিনে থাকবে।
মন খারাপ করে বলে মিতা।

–উনার সাথে আমাদের কোনোদিন দেখা হয়নি।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–আচ্ছা। আমি তাহলে যাই।
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় মিতা।

–শুন..
বলে হাবিব চৌধুরী।

–জ্বি বলো।
বলে মিতা।

–আজ থেকে তুই অরিয়নের রুমে ঘুমাবি..

–কিন্তু নার্স তো….

–নার্স রাতে পাশের আবরারের রুমে থাকবে। রাত বিরাতে অরিয়নের কিছু প্রয়োজন হতে পারে। স্ত্রী হিসেবে এই সময় এসব করা তোর দায়িত্ব।

–আচ্ছা।
কথাটা বলেই হেটে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় মিতা। মাথা ঘুরিয়ে একবার ফিরে তাকায় হাবিব চৌধুরী দিকে। হাবিব চৌধুরী চিন্তিত অবস্থায় নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে।

“কেন মিথ্যে বললে তুমি? তবে কী তুমি যেমন দেখাচ্ছো তেমন নও? তবে কী সত্যিই ঘরের শত্রু বিভীষণ? ”
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় মিতা।

চলবে……

#পারমিতা
#পর্ব_৪০
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–পরী?

–পরীইইইইইই?

–পরীইইইইইইইইইই??

–প্লিজ স্যার আপনি এভাবে চেঁচামেচি করবেন না। আপনার বিপি বেড়ে যাবে।
অরিয়নের কাছে গিয়ে বলে নার্স।

–পরীইইইইইইইইইইইইইইইইইইই?

–পরীইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই?

–স্যার প্লিজ থামুন।
বলে নার্স।

ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই পরীর জন্য অপেক্ষা করছে অরিয়ন। গতকাল বাসায় আসার পর থেকে একবারও চোখের দেখাটাও দেখেনি অরিয়ন। ভেবেছিলো পরী হয়তো একবার হলেও আসবে কিন্তু আসে নি। নার্স খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। সকালের ঔষধ এখনো খাওয়াতে পারেনি অরিয়নকে। কখন থেকে পরীর নাম ধরে চিৎকার করেই যাচ্ছে।

–প…

–কি হয়েছে? এভাবে চেঁচামেচি করছিস কেন?
দ্রুত রুমে আনিকা চৌধুরী প্রবেশ করতে করতে বলে। আনিকা চৌধুরীর পেছন পেছন রুমে আফরিনও প্রবেশ করে।

–পরী কোথায়? এখানে নেই কেন ও?
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।

–পরী তো নিজের রুমে ক…

–নিজের রুম মানে? পরীর রুম এটা। গেস্ট রুম কবে থেকে পরীর রুম হয়ে গেল?
আফরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠে অরিয়ন।

আফরিন অবাক হয়ে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল। আফরিন এই রুমে আছে কী না, অরিয়নের এহেন বিহেভিয়ারে আফরিনের খারাপ লাগছে কী না তা যেন দেখার প্রয়োজনও অনুভব করলো না অরিয়ন। আফরিনের মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে যতই সময় যাচ্ছে অরিয়ন যেন ততোই ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে।

–ওকে কেন ডাকছিস?
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে আনিকা চৌধুরী।

–প্রয়োজন আছে তাই।
জবাব দেয় অরিয়ন।

–কিসের প্রয়োজন? কী এমন প্রয়োজন যে এভাবে চেঁচামেচি করছিস ছোট বাচ্চাদের মতো।
বিরক্ত হয়ে বলে আনিকা চৌধুরী।

বার বার পরী পরী করা যে আনিকা চৌধুরীর কাছে বিষের মতো লাগে তা যেন এই পরিবারের কেউ বুঝতেই পারে না। নাকি বুঝেও ইচ্ছে করে এরকম করে কে জানে!

–তোমাকে বলা যাবে না।
আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় অরিয়ন।

–আমি ভেবেছিলাম আফরিন ফিরে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই তোর ভালোবাসা ফিরে পাবি, ঐ মেয়ে এই বাড়ি থেকে বিদায় হবে। কিন্তু তুই, তুই আফরিনকে দুই দিনে ভুলে গেলি। মেয়েটার প্রতি তোর একটু করুণাও হলো না।
হতাশার দৃষ্টিতে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে বলে আনিকা চৌধুরী।

কিছু সময়ের জন্য অরিয়নের চোখ আফরিনের দিকে যায়। আফরিন নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্য সময় আফরিনকে এভাবে দেখলে অরিয়নের যে খারাপ লাগা কাজ করতো আজ তা করছে না। আজ খারাপ লাগছে আফরিন যেসবের মধ্যে দিয়ে ৯ টা মাস পার করেছে তার কথা ভেবে।

কী করবে অরিয়ন? কী করা উচিৎ অরিয়নের? অরিয়নতো ভেবেছিলো আফরিন অন্য কারো সাথে সুখে আছে। মিতার সাথে ৯ টা মাস পার করা ৬ বছরের চাইতে বেশি কখন আর কীভাবেই হয়ে গেল? কেন ৬ বছরের ভালোবাসা আফরিনকে ছাড়া থাকতে পারলেও ৯ মাসের নিজের স্ত্রী পরীকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে অরিয়নের কষ্ট হয়?

“এটা কী ভালোবাসা?” মনে মনে ভাবে অরিয়ন।

” ভালোবাসা হলে তো আমার বুঝে যাওয়ার কথা ছিলো, যেমনটা বুঝেছিলাম আফরিনের সময়? নাকি পরী সত্যিই বলে যে, ওর শরীরকে ভালোবাসি আমি?” কথাটা ভাবতেই নিজের অজান্তেই হাত শক্ত করে মুঠ করে ফেলে অরিয়ন।

“যদি শরীরকেই ভালোবাসবো তাহলে আফরিনকে দেখলে কেন আগের মতো কিছু অনুভব হচ্ছে না আমার? কেন মন শুধু বার বার পরী পরী করছে? ভাবতে থাকে অরিয়ন।

–আমাকে ডে…
দরজা খুলে কথাটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল মিতা।

দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আনিকা চৌধুরী ও আফরিন। বিছানার সামনে হাতে নাস্তার ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নার্স। অরিয়ন বিছানায় শুয়ে আছে। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কোনো কথা হচ্ছিলো রুমে। মিতা আসতেই যেন নিরবতা ছেয়ে গেলো।

–আমি না হয় পরে আসছি।
কথাটা বলে ঘুরে রুম থেকে বের হয়ে যেতে নেয় মিতা।

–দাঁড়া।
পেছন থেকে ডাক দেয় অরিয়ন।

অরিয়নের কন্ঠস্বর শুনে দাঁড়ায় মিতা। আফরিনও চোখ তুলে অরিয়নের দিকে তাকায়। মিতাকে দেখতেই অরিয়নের চোখ যেন জ্বলজ্বল করছে। আফরিনের বুকটা হুট করেই চিনচিন করছে। আফরিন ভেবেছিলো নিজের সম্মান হারানোর চেয়ে হয়তো একটা মেয়ের কাছে কষ্টের আর কিছুই হয় না। ভুল ভেবেছিলো আফরিন। নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখে অন্য কারো জন্য অনুভূতি দেখার চেয়ে কষ্টের আর কিছুই নাই। মুখে ফুঁটে উঠলো এক মৃদু বিষন্নতার হাসি।

–আমার নাস্তা রেডি কর। নাস্তা খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতা অবাক হয়ে অরিয়ন আর নার্সের দিকে তাকিয়ে রইল। নার্সের হাতে নাস্তা। অথচ নাস্তা রেডি করার কী আছে এখানে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না মিতা। এক পা এগিয়ে দিতেই চোখ যায় আফরিনের দিকে। আফরিনের মুখে মৃদু এক হাসি। কিন্তু সেই হাসিতে নেই কোনো প্রাণ। মনে হচ্ছে জীবন্ত কোনো লাশের মুখে জোর করে কেউ হাসি ফুটানোর চেষ্টা করেছে। পরীর মুখটা কালো হয়ে এলো। আফরিনের এরকম চেহারা সহ্য হচ্ছে না মিতার। সামান্য অবসেশন এর জন্য নিজের বোনের জীবনটা নষ্ট করতে পারেনা মিতা।

–নাস্তা তো সামনেই আছে। খেয়ে নেও।
একটু গম্ভীর ভাবে বলে মিতা।

নিজেকে একটু শক্ত করার চেষ্টা করছে।

–সামনে আছে তা আমিও দেখতে পাচ্ছি।
গম্ভীরভাবে অরিয়ন ও বলে।

–তাহলে আবার রেডি ক…

–তোকে.বলেছি.নাস্তা.রেডি.করতে।
প্রতিটা শব্দে জোর দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।

মিতার চোখ আবারও আফরিনের দিকে যায়। আফরিনের চোখে পানি ছলছল করছে। যে কোনো মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বাধ ভেঙ্গে যাবে। আফরিনের চোখের পানি দেখে মিতারও মেজাজ যেন খারাপ হয়ে এলো।

–পারবো না। আমি তোমার বাড়ির কাজের মেয়ে নই যে,যখন যা বলবে তাই করবো।
কথাটা বলেই আর এক মিনিটও অপেক্ষা করে না মিতা। রুম থেকে সোজা বের হয়ে যায়।

অরিয়ন দাঁতে দাঁত চেপে রইল। নিমিষেই শোয়া থেকে উঠে বসেই নার্সের হাতে থাকা ট্রে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। কাচের প্লেটগুলো সাথে সাথে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আফরিন আর আনিকা চৌধুরী হা করে তাকিয়ে রইল অরিয়নের দিকে। এসব কী করছে অরিয়ন? দুজনের একজনও কিছু বুঝতে পারছে না।

–আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।
বড় বড় শ্বাস ফেলে বলে অরিয়ন।

–অরিয়ন তুই এস…

–আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাইইইই।
চেঁচিয়ে বলে অরিয়ন।

আনিকা চৌধুরী আর কিছু বললো না। নিজেকে সবার সামনে অপমানিত মনে হতে লাগলো। একবার নার্সের দিকে ও একবার আফরিনের দিকে তাকিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আফরিন আনিকা চৌধুরীর চলে যাওয়া দেখছে। অরিয়নের দিকে তাকাতেই অরিয়নের সাথে চোখাচোখি হয় আফরিনের। কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে অরিয়ন।

–তোমাকে কী আলাদা করে বলতে হবে?
আবারও চেঁচিয়ে উঠে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় আফরিন। নার্স গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। অরিয়ন দাঁতে দাঁত চেপে খাটের উপর স্থির হয়ে বসে রইল।

–আপনার মেডিসিন খে..
কথাটা বলতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নার্সের দিকে তাকায় অরিয়ন। সাথে সাথেই চুপ হয়ে যায় নার্স। হঠাৎ করে এরকম রেগে কেন গেল বুঝতে পারছে না।

******************

রুমে এসেই মিতা কেমন যেন বন্দি খাঁচায় আটকে থাকা পাখির মতো ছটফট করতে লাগলো। ক্ষণে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছে তো ক্ষণে ব্যাগ গুছাতে থাকলো। অরিয়নের চাহনি, আফরিনের চোখের পানি, মিতাকে পাগল করে দিচ্ছে। এ কোন দ্বিধায় পড়ে গেল মিতা? তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে কাঁধে তুলে নিয়েই সরাসরি গিয়ে গাড়িতে বসে মিতা। আজ ক্লাস করার ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়েই যেতে হচ্ছে মিতার। সব কিছু থেকে পালাতে হবে যেভাবেই হোক।

*****************

সারাদিন ক্লাস শেষ করে কলেজ গেইট থেকে বের হতেই গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কবির রহমানকে।
কবির রহমানের পড়নে আজ কালো রঙের স্যুট।

“কত হবে তার বয়স?৬০?৬৫? ” মনে মনে ভাবে মিতা। দেখে ৬০ বা ৬৫ মনে হয় না। মনে হয় ৫০/৫৫ বয়সের এক মধ্যবয়স্ক লোক।

দূর থেকে মিতাকে দেখতেই হাসি ফুঁটে কবির রহমানের চেহারায়। এগিয়ে যায় মিতার দিকে। মিতার কাছাকাছি আসতেই হাত রাখে মিতার মাথায়।

–কেমন আছো পারমিতা?
মিষ্টি এক হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে কবির রহমান। কবির রহমানের কন্ঠে মায়া আর স্নেহ প্রকাশ পাচ্ছে।

পারমিতা মুখ ফুটে কিছু বললো না। মৃদু এক হাসি দিয়ে ভালো আছে বোঝায়।

–চলো কোথাও গিয়ে বসি।
মিতার কাঁধে নিজের হাত রেখে বলে কবির রহমান। মিতা কিছু একটা ভেবে রাজি হয়।

******************
কলেজের সামনে থাকা ওয়েলফুডের দোকানে বসেছে মিতা। ড্রাইভার মিতাকে না দেখলে খোজাখুজি শুরু করে দিতে পারে ভেবে দূরে কোথাও যায় নি মিতা।

মিতার সামনে বার্গার আর কোল্ড ড্রিংকস রাখা। কিন্তু মিতা কিছুই স্পর্শ করেনি। কবির রহমান মিতার দিকে তাকিয়ে আছে।

–ওয়াহিদ চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন করেছিলে তুমি?
জিজ্ঞেস করে কবির রহমান।

মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে মিতা।

–আর হাবিব চৌধুরী?
মিতার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বলে কবির রহমান।

–বললো আপনাকে চিনেনা।
জবাব দেয় মিতা।

মিতার জবাব শুনতেই হেসে দেয় কবির রহমান। যেন এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিলো। মিতা কবির রহমানের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসির কারণ বোঝার চেষ্টা করছিলো।

–হাসছেন কেন?
প্রশ্ন করে মিতা।

–আচ্ছা একটা কথা বলো তো…
কথাটা বলেই গম্ভীর দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকায় কবির রহমান।

–তোমার উপর এই হামলা গুলো কী বিয়ের আগে কখনো হয়েছিলো?
প্রশ্ন করে কবির রহমান।

–আপনি কীভাবে জানলেন আমার উপর হামলা হয়েছে?
ভ্রু কুঁচকে সন্দেহের দৃষ্টিতে কবির রহমানের দিকে তাকায় মিতা।

–যেভাবে জানতে পেরেছিলাম তুমি আমার নাতনি হও।
অনায়াসে বলে ফেলে কবির রহমান।

–না।
আগের প্রশ্নের জবাব দেয় মিতা।

–আচ্ছা তুমি কী কখনো ভেবে দেখেছো? কেন বিয়ের দিন আফরিন চলে গেল? কেনই বা এতো মানুষ থাকতে, অরিয়নের চাইতে ১১ বছরের ছোট মেয়ের সাথে অরিয়নের বিয়ে হলো? কেনই বা বিয়ের পর পর তোমার উপর এতো এটাক হওয়া শুরু করলো?
একের পর এক কথাগুলো বলে যাচ্ছে কবির রহমান।

কবির রহমানের প্রশ্নগুলো শুনতেই চিন্তায় পড়ে গেলো মিতা। তাই তো, এতো কিছু তো ভাবেনি মিতা।

–কী বলতে চাইছেন আপনি?
অধৈর্য্য হয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–তুমি কী কখনো ভেবে দেখেছো,আসলেই আফরিনের চলে যাওয়াটা কি*ডন্যাপ ছিলো কী না?
আবারও বলে কবির রহমান।

–কী সব বলছেন আপনি?
রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে মিতা।

–যা সত্যি তাই বলছি।
চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বলে কবির রহমান।

–কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? এসব বলে কী প্রমাণ করতে চাইছেন?
আবারও প্রশ্ন করে মিতা। মিতার চোখের কোণে পানি ছলছল করছে।

–তোমার কী কখনো মনে হয়নি, সব কিছু প্ল্যান করে করা হয়ে থাকতে পারে?
গম্ভীরমুখে মিতার দিকে তাকিয়ে বলে কবির রহমান।

–মানে?
কথাটা যেন মিতার মুখে আটকে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে দু ফোঁটা পানি পড়লো।

–মানে কী তা তুমি ভালোই জানো, পারমিতা।
বলে কবির রহমান।

–কে আর কেন?
আবারও প্রশ্ন করে মিতা।

–কে হতে পারো তাও তুমি জানো৷ তুমি শুধু মানতে চাইছো না।
মিতার দিকে এগিয়ে এসে বলে কবির রহমান।

–কারণ কী?
পরাজিত কন্ঠে প্রশ্ন করে মিতা। বুকটা ধুকধুক করছে মিতার। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে হার্ট অ্যা*টাক করবে। এতো কিছু কেন এক সাথেই হচ্ছে মিতার সাথে?

–তোমার মায়ের নামে হাজারো কোটি টাকার সম্পত্তি আছে। যার বর্তমান মালিক তুমি।
জবাব দেয় কবির রহমান।

–তোমার মায়ের সাথে রাগ করে অনেক বছর যোগাযোগ রাখিনি আমি। কিন্তু আমার এতো এতো সম্পত্তির মালিক যে শুধুই সুমাইয়া ছিলো। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম আমার সুমাইয়া এই পৃথিবীতে নেই। আরও জানতে পারলাম সুমাইয়ার এক মেয়েও আছে।
কবির রহমানের কণ্ঠ আটকে আসছে। চোখেমুখে দুঃখ ভেসে উঠেছে। ক্ষণিকের জন্য মিতার মনে হলো কবির রহমানের চোখের কোণে পানিও দেখতে পেয়েছিলো।

–কিছুদিন আগে মানে? আপনাকে তো মৃত্যুর সাথে সাথে খবর পাঠানো হয়েছিলো।
অবাক হয়ে বলে মিতা।

–মিথ্যে কথা। আমাকে কোনো খবর পাঠানো হয়নি।
বলে কবির রহমান।

–ভেবেছিলাম হয়তো বেশিদিন বাঁচবো না। তাই রাগ থাকলেও সব সম্পত্তি সুমাইয়ার নামে করে দেই। সুমাইয়া এখন আর নেই। সব কিছুর মালিক তুমি।
বলে কবির রহমান।

–কী বলতে চাচ্ছেন?
মিতা যেন বুঝেও অন্য কোনো উত্তরের আশা করছে।

–তুমি মারা গেলে সব সম্পত্তি চৌধুরী পরিবারের..

–মিতা মামুনি?
কবির রহমানের কথা শেষ হওয়ার আগেই দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভার মিতাকে ডাক দেয়।

–জ্বি কাকা?
তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে মাথা ঘুরিয়ে বলে মিতা।

–বাসা থেকে তোমাকে বার বার কল করা হচ্ছে। কল ধরোনি তাই আমাকে দিয়েছে। ইমার্জেন্সি।
বলে ড্রাইভার।

–আচ্ছা তুমি যাও, আমি আসছি।
বলে মিতা।

মিতার কথা শুনে ড্রাইভার কাকা দোকান থেকে বের হয়ে যায়। মিতা আর কিছু না বলে ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়।

–আমার বাড়ির দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা। সুমাইয়াকে আমি হারিয়েছি কিন্তু সুমাইয়ার শেষ চিহ্নকে হারাতে চাই না।
মন খারাপ করে বলে কবির রহমান।

মিতা আর কিছু বললো না। ব্যাগ কাঁধে নিয়েই দোকান থেকে বের হয় মিতা। দোকান থেকে বের হতেই বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে মিতা। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে মিতার। আর কী দেখার বাকি আছে? শেষমেষ নিজের আপন মানুষ? যাদেরকে এতো বিশ্বাস করেছে মিতা? এতো ভালোবেসেছে তারা?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখের পানি মুছে ব্যাগ খুলে মোবাইল হাতে নেয় মিতা। স্ক্রিনে আলো জ্বলতেই দেখতে পায় ৫০ টা মিসড কল।পরিবারের সবাই একের পর এক কল দিয়েছে মিতাকে। মোবাইল নিয়ে কল দেয় মায়া চৌধুরীকে।

–হ্যালো মা।
রোবটের মতো বলে মিতা।

–মোবাইল কই তোর? কখন থেকে কল দিচ্ছি।
অপর পাশ থেকে মায়া চৌধুরীর উত্তর আসে।

–সাইলেন্ট ছিলো।
জবাব দেয় মিতা।

–অরিয়ন..
কথাটা বলে একটু থামে মায়া চৌধুরী।

–অরিয়ন কী?
গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলে মিতা।

–অরিয়ন সকাল থেকে খাবার আর ঔষধ খাচ্ছে না। তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।
জবাব আসে মায়া চৌধুরীর।

মিতা কিছু বলার আগেই কল কেটে যায়।

–চলুন কাকা।
বলে মিতা।

চলবে……..

#পারমিতা
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

চৌধুরী মেনশন এর সামনে এসে দাঁড়ায় কালো রঙের গাড়িটা। মেইন দরজা আজ অন্যদিনের মতো বন্ধ নয়, মনে হচ্ছে কারো অপেক্ষায় খোলা রেখেছে। বিবর্ণ চেহারার মিতা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। কাঁধের ব্যাগটা গাড়ির সিটেই পড়ে আছে। বাড়িতে ঢুকতেই দু চারটা কাজের লোক ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না মিতা। ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসে মোবাইল দেখছে শায়লা।

–শায়লা আপু?
ধীরে ডাক দেয় মিতা।

হঠাৎ করে মিতার ডাক শুনে চমকে উঠে শায়লা। নিজের বুকের উপর থুথু দেয় ভয় কমানোর উদ্দেশ্যে।

–হ্যাঁ, মিতা। বল।
তাড়াতাড়ি করে মিতার সামনে এসে বলে শায়লা।

–সবাই কোথায়?
কাউকে দেখতে না পেয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

–উপরে, অরিয়ন স্যারের রুমে।
জবাব দেয় শায়লা।

মিতা আর কোনো কথা বাড়ালো না। সিড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলো। অরিয়নের রুমের দরজা আগে থেকেই খোলা। উঁকি দিতেই দেখতে পায় সকলেই রুমে বসে আছে। অরিয়ন বিছানায় অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে।

–মা।
মায়া চৌধুরীকে ডাক দিয়ে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে মিতা।

সকলের দৃষ্টি যায় মিতার দিকে। বিছনায় শুয়ে থাকা অরিয়ন যেন মিতার কন্ঠ শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, তাও মুখ ঘুরিয়ে মিতার দিকে তাকালো না।

–এসেছিস তুই?
মিতার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে মায়া চৌধুরী।

অরিয়নের পাশে বসে থাকা আনিকা চৌধুরীর মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। মিতার দিকে আড় চোখে তাকায় একটু পর পর।

–কী হয়েছে?
প্রশ্ন করে মিতা।

–অরিয়ন সকাল থেকে খাবার খাচ্ছে না। ঔষধ ও খায় নি।
জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

–কেন?
প্রশ্ন করে মিতা।

মায়া চৌধুরী এর কোনো জবাব দিলো না। কিছু বলতে যাবে তখনি পেছন থেকে মায়া চৌধুরীর কাঁধে হাত রাখে আফরিন। চোখের ইশারায় কিছু বোঝায় মায়া চৌধুরীকে।

মায়া চৌধুরী নিজের জায়গা থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ায় আনিকা চৌধুরীর সামনে। নিজের সামনে মায়া চৌধুরীকে দাঁড়াতে দেখে ভ্রু কুঁচকে কিছু বোঝায় চেষ্টা করে আনিকা চৌধুরী ।

-ও মাই গড।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় আনিকা চৌধুরী। রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আনিকা চৌধুরীর পেছন পেছন মায়া চৌধুরী ও বেরিয়ে যায়।

আফরিন মিতার দিকে তাকিয়ে আলতো করে এক হাসি দিলো। মিতাও বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দেয়। মাথা ঘুরিয়ে নার্সের দিকে তাকায় আফরিন।

–ট্রে টা এখানে রেখে দিন।
নার্সকে বলে আফরিন।

আফরিনের কথা শুনে নার্স টি টেবিলের উপর ট্রে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নার্সের পেছন পেছন আফরিনও বেরিয়ে আসে।

পুরো রুমে এখন শুধু মাত্র অরিয়ন আর মিতা। দরজা লাগানোর শব্দ শুনতেই মাথা ঘুরিয়ে মিতার দিকে তাকায় অরিয়ন। এক দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে রইল অরিয়ন। মিতাকে দেখে রাগ হচ্ছে, আবার ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। এমন কেন হয়ে গেল অরিয়ন বুঝতে পারছে না।

বিছানায় শুয়ে থাকা অরিয়নের চেহারা শুকিয়ে গেছে একদম। চোখমুখ থেকে উজ্জ্বলতা সরে গেছে। এই মানুষটা কী করেনি মিতার জন্য? আর বিনিময়ে মিতা তাকে শুধু দূরে সরিয়েই দিচ্ছে। আচ্ছা দূরে সরিয়ে দিয়ে কী সব পরিবর্তন করা যায়?

ধীর পায়ে হেটে গিয়ে বিছানার পাশে বসে মিতা। অনেক কিছু বলতে আর জিজ্ঞেস করতে মন চাচ্ছে মিতার। একই সাথে চুপ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কবির রহমান যা বললো তা কি সত্যি? সত্যি কী আফরিনের হারিয়ে যাওয়াটা সাজানো ছিলো? সত্যি কী অরিয়নের সাথে মিতার বিয়েটা প্লান করা ছিলো? সব কিছু কী অরিয়ন জানতো? কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরঘুর করছে মিতার।

মিতা বিছানায় বসতেই চোখে চোখ পরে অরিয়নের সাথে। অরিয়ন ও চোখ সরাচ্ছে না এক মিনিটের জন্যও। শোয়া থেকে উঠে বসে অরিয়ন। নিমিষেই নিজের মাথা রাখে মিতার কাঁধে। ডান হাত দিয়ে মিতার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে মিতা। হঠাৎ করে এভাবে মিতার কাছাকাছি চলে আসাতে অবাক হয় মিতা, হয়তো কিছুটা অপ্রস্তুতও। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে মিতার। ইচ্ছা করছে দু হাত দিয়ে অরিয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু মিতা হাত বাড়ালো না। শক্ত করে হাত মুঠ করে রাখলো।

–তুই বলেছিলি, তুই আমাকে ভালোবাসিস।
মিতার কাঁধে মাথা রাখা অবস্থায় বলে উঠে অরিয়ন।

–তুই বলেছিলি, তুই আমাকে কখনো ছেড়ে যাবি না।
আবারও বলে অরিয়ন।

–খাবার খেয়ে ঔষধগুলো খেয়ে নেও।
নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় বলার চেষ্টা করে মিতা।

–কিন্তু তুই আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস, আমাকে প্রতিনিয়ত ইগনোর করে যাচ্ছিস।
বলে অরিয়ন। অরিয়নের কথায় যেন পাহাড় সমান অভিমান প্রকাশ পাচ্ছে।

–ঔষধ না খেলে শরীর খা…

–আহ..
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতার কাঁধে কামড় দেয় অরিয়ন। ব্যাথায় শব্দ করে উঠে মিতা। অরিয়ন নিজের মনে কথা বলার চেষ্টা করছে আর মিতা? মিতা কোনো ভাবে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করছে তা বুঝতে পারতেই রাগ উঠে যায় অরিয়নের। ফলে কামড় বসিয়ে দেয় মিতার কাঁধে।

অরিয়নের কামড়ের হিংস্রতা যেন বেড়েই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব রাগগুলো মিতার উপর ছাড়ছে অরিয়ন। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে নিজের দু হাত দিয়ে অরিয়নের দু বাহু ধরে পেছনের দিকে ঠেলতে থাকে মিতা।

–অরিয়ন ভাইয়া, ব্যাথা পাচ্ছি আমি।
কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে মিতা।

মিতার ভাইয়া ডাক শুনে যেন আরও রাগ উঠে গেলো অরিয়নের। একে তো অরিয়ন জড়িয়ে ধরলেও মিতা অরিয়নকে জড়িয়ে ধরেনি, কথাগুলো ইগনোর করছিলো তার উপর ভাইয়া বলা শুরু করেছে আবার।

–তোকে কতবার বলেছি ভাইয়া না ডাকতে।
মিতার কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে মিতার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতার দৃষ্টি অরিয়নের দিকে থাকলেও মিতা নিজের হাত দিয়ে কাঁধে কামড়ের জায়গা ঘোসতে ব্যস্ত, তাতে যদি ব্যাথাটা একটু কমে।

–তুমি খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নেও।
অরিয়নের প্রশ্ন ইগনোর করে আবারও বলে মিতা।

–তুই কথা বলবি না আমার সাথে?
দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলে অরিয়ন।

–আগে খাবার খাও,এরপর।
বলে মিতা।

–আন।
রাগান্বিত অরিয়ন বলে।

মিতা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টি টেবিল থেকে খাবারের ট্রে হাতে করে নিয়ে আসে। বেডের উপর ট্রে রাখতেই স্যুপের বাটি হাতে তুলে নেয় অরিয়ন। চামচ দিয়ে স্যুপ নিয়েই মিতার মুখের কাছে ধরে আগে। মিতা অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।

–আমি খেয়ে এসেছি বন্ধুদের সাথে। তুমি খাও।
জবাব দেয় মিতা।

–খাবি নাকি ছুড়ে সব ফেলে দিবো?
গম্ভীর কণ্ঠে বলে অরিয়ন।

মিতা আর কিছু না বলে স্যুপ মুখে নেয়। পরের বার স্যুপ মুখে দেয় অরিয়ন। যত দ্রুত সম্ভব স্যুপ শেষ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অরিয়ন। মাঝে মাঝেই স্যুপ মিতার মুখে তুলে দিচ্ছে আর মিতাও কোনো ঝামেলা না করার জন্য খেয়ে নিচ্ছে। স্যুপের বাটি ট্রে তে রাখতেই মিতা ঔষধ হাতে তুলে দেয় অরিয়নের। অরিয়নও চুপচাপ ঔষধ খেয়ে নেয়।

অরিয়নের ঔষধ খাওয়া শেষ হলে মিতা ট্রে নিয়ে আবারও টি টেবিলের উপর রেখে আসে। ফিরে এসে আবারও বসে অরিয়নের সামনে। অরিয়নের নজর গিয়ে আটকায় মিতার গলার কাছে কাঁধের অংশে। অরিয়নের দাঁতের ছাপ এখনো বসে আছে। নিজের অজান্তেই অরিয়নের হাত গিয়ে স্পর্শ করে কামড় দেওয়া জায়গা। আলতো করে এগিয়ে যায় মিতার দিকে। অরিয়নের এগিয়ে আসা বুঝতে পেরেই সরে যেতে নেয় মিতা কিন্তু তার আগেই নিজের হাত দিয়ে শক্ত করে মিতাকে ধরে বসিয়ে রাখে অরিয়ন। আলতো করে চুমু দেয় কামড় দেওয়া জায়গায়। অরিয়নের ঠোঁট কাঁধে স্পর্শ করতেই চোখ বন্ধ করে নেয় মিতা। মিতার হার্টবিট যেন বেড়ে যাচ্ছে৷ অন্যদিকে, অরিয়ন একের পর এক চুমু দিয়েই যাচ্ছে কাঁদে। একটু পরেই ঠোঁট গিয়ে স্পর্শ করে মিতার গলাকে।

অরিয়ন নিজের হাত দিয়ে মিতার কোমর আমারও জড়িয়ে ধরে৷ যতোটা সম্ভব টেনে নিজের আরও কাছাকাছি আনার চেষ্টা করছে। মিতার শরীরের সাথে অরিয়নের শরীর স্পর্শ হতে শুরু করেছে। অরিয়নে ঠোঁট থেকে কোমলতা যেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে আরও ডেস্পারেট হয়ে পড়ছে অরিয়ন।

–তুমি অসুস্থ।
অরিয়নের বাহু ধরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে মিতা। অরিয়নের উদ্দেশ্য কী তা ভালোই বুঝতে পারছে মিতা।

–আই নো, আই নো, আই নো।
মিতার গলায় বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করতে করতে বলে অরিয়ন।

–কী করেছিস তুই আমার সাথে? কেন তোকে বার বার কাছে পেতে ইচ্ছে করে? কেন তোর দূরে যাওয়া আমাকে এতো যন্ত্রণা দেয়? কেন সবার অবহেলা সহ্য করতে পারলেও তোর অবহেলা সহ্য করতে পারছি না আমি? কেন তুই দূরে চলে যেতে চাইলেই তোকে কষ্ট দিতে মন চায় আমার? কেন?
মিতার নাকের সাথে নিজের নাক ঘষতে ঘষতে বলে অরিয়ন।

–কেন আমার সামনে আমার ৬ বছরের ভালোবাসা আফরিন থাকতেও ওর দিকে তাকাতে পারিনা আমি? কেন আমার নজর সব জায়গায় শুধু তোকেই খুজে?
মিতার গালে আলতো করে চুমু দিতে দিতে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে বুক ফেটে কান্না আসছে মিতার। এতো কথার কোনোই মূল্য নেই। কারণ অরিয়নের মন এখনো আফরিনের। মিতা তো এই সম্পর্ককে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলো এটা ভেবে যে, একদিন হয়তো অরিয়নের মনটাও মিতার হয়ে যাবে। কিন্তু এখন? এখন সেই আশাটুকুও মিতার মধ্যে নেই। অরিয়নের এই অবসেশন কেটে গেলে এতো পাগলামোও কেটে যাবে তখন? তখন কী নিয়ে বাঁচবে মিতা? অরিয়নের চোখে অন্য কারো জন্য ভালোবাসা দেখেও ওর সাথে সংসার যে মিতা কখনো করতে পারবে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে মিতার।

*****************

–আফরিন?
আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলে মায়া চৌধুরী।

–জ্বি মা?
বলে আফরিন।

–আমি….আমি আর তোর…তোর বাবা ভাবছিলাম।
কথাগুলো একটু বলে থামে মায়া চৌধুরী। মনে হচ্ছে এখনো দ্বিধায় আছে পরবর্তী কথাটা বলবে কী না তা নিয়ে।

–বলে ফেলো মা।
মায়া চৌধুরীর দ্বিধাবোধ বুঝতে পেরে বলে আফরিন।

–আমরা ভাবছিলাম তুই ও যদি মুভ অন করিস এই আর কি।
বলে ফেলে মায়া চৌধুরী।

–কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সময় নিয়ে আস্তেধীরে। একটা ভালো ছেলের খোজ পেয়েছিলো তোর বাবা।
আবারও বলে মায়া চৌধুরী। চোখে মুখে একটু ভয় কাজ করছে, আফরিন যদি ভুল বুঝে তাই।

নিজেদের রুমে কথা বলছে আফরিন আর মায়া চৌধুরী। অরিয়নের রুম থেকে বেরিয়েই আফরিনের সাথে কথা আছে বলে আফরিনকে নিয়ে গেস্ট রুমে আসে মায়া চৌধুরী।

মায়া চৌধুরীর কথা শুনে প্রথমে অবাক হয় আফরিন। মুভ অন? কী থেকে মুভ অন করবে আফরিন? আফনান থেকে? নাকি নিজের জঘন্য অতীত থেকে? কোনোদিন আফনানকে ভুলে গেলেও নিজের অতীত যে কখনো ভুলতে পারবে না আফরিন। এই অতীত যেনেও কী কোনো ছেলে কাউকে বিয়ে করতে রাজী হবে? হবে না। আর যে হবে সে শুধু মাত্রই আফরিনের বাবার টাকার জন্য হবে। বিয়ে করতে আমরা যে সব সময় পবিত্র মানুষটাই খুজি। আর আফরিন যে পবিত্র নেই তা আফরিন ভালোই জানে।

–আমি এখনো এসবের জন্য রেডি না,মা।
জবাব দেয় আফরিন।

–মানুষ রেডি হয় না,আফরিন। চেষ্টা করতে হয়। অতীত আঁকড়ে ধরলে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবি না। অরিয়ন এখন অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। যেখান থেকে ওর ফিরে আসা অসম্ভব।
মাথা নিচু করে বলে মায়া চৌধুরী।

–আমি আফনানের আশা করছি না, মা। আফনান আমার কাছে ফিরে আসতে চাইলেও আমি আফনানকে মেনে নিতাম না। ও আমার ছোট বোনের স্বামী, মা। কীভাবে ওকে মেনে নিবো? মিতার সাথে আমি কোনোদিন চোখাচোখি করতে পারবো না। মিতার চোখে অরিয়নের জন্য যেই সম্মান দেখতে পারতাম তার সাথে তো এখন অরিয়নের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসাও দেখতে পাই।
কথাগুলো বলতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে আফরিনের।

–বড় বোন হিসেবে ওর থেকে সেই সুখ কীভাবে কেড়ে নিবো আমি, মা? কীভাবে?
কথাগুলো বলতেই আফরিনকে জড়িয়ে ধরে মায়া চৌধুরী। নিজেও কান্না করতে থাকে।

–আই এম সো প্রাউড অফ ইউ, আফরিন। সো সো মাচ।
আফরিনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে মায়া চৌধুরী।

******************

মিতার চোখের পানি অরিয়নের ঠোঁট স্পর্শ করতেই অরিয়ন চোখ খুলে তাকায় মিতার দিকে। মিতার চোখ এখনও বন্ধ। মিতাকে এই অবস্থায় দেখে অরিয়নের অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। মিতাকে তো এভাবে দেখতে চায় না অরিয়ন। নিজের ঠোঁট দিয়ে চুমু দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুখে নেয় অরিয়ন। নিজের ডান হাত দিয়ে মিতার মাথায় পিছনে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে।

–আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিস না। তুই জানিস না আমি কী করে বসবো তাহলে,পরী। আমি নিজেও জানিনা আমি কী করবো, শুধু জানি তোকে আমার চা….

–আই ওয়ান্ট ডিভোর্স।
চোখ বন্ধ অবস্থায় বলে মিতা।

চলবে……