পারমিতা পর্ব-৪৮+৪৯+৫০

0
98

#পারমিতা
#পর্ব_৪৮
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–রিয়ন!!!!!!
নিজের অজান্তেই মিতার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে।

বাতাসের গতি বেড়ে চলেছে, মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,বৃষ্টির গতিও বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই অরিয়নের মনের মধ্যে থাকা, এতোদিনের জমানো সব কষ্ট ঝড়ের মাধ্যমে বেড়িয়ে আসছে।

পার্কের দুপাশে দুজন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। চারিপাশে শুধু বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে,কিন্তু মিতা এই বৃষ্টির শব্দের সাথে অরিয়নের অস্বাভাবিক হৃদ স্পন্দনও শুনতে পারছে। অরিয়ন সম্পূর্ণ ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। অবাক দৃষ্টিতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিতার দিকে তাকিয়ে আছে অরিয়ন। যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না মিতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, অরিয়নকে দেখামাত্রই মিতার হাত থেকে ছাতাটা পড়ে যায়। সেদিকে যেন চোখ গেল না মিতার। এক নজরে শুধু অরিয়নের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল।

অসময়ের এই বৃষ্টি যেন কারও উপর করুণাও করছে না। মিতাকেও ধীরে ধীরে নিজের রঙে রাঙানোর জন্য ভিজিয়ে নিতে লাগলো।

অরিয়নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিতার ওজন অনেকটাই কমে গেছে। গালগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। মুখের মধ্যে থাকা সেই কোমলতা ভাবটা যেন সরে গেছে। লাল ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মিতা, এই বৃষ্টিতে সাদা রঙের একটা থ্রি পিস পড়ে এসেছে। সাদা জামায় হলুদ রঙের ছোট ছোট সূর্য্যমূখি ফুল আঁকা। মিতার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নেয় অরিয়ন, সাদা রঙের জামা খেয়াল করতেই নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠে অরিয়নের। “বোকা মেয়ে” মনে মনে বলে উঠে অরিয়ন।

বৃষ্টির ঠান্ডা পানিতে ভিজতে শুরু করেছে মিতা। সারা শরীরে যেন শীতলতা বয়ে বেড়াতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে জমে বরফ হয়ে যাবে। বৃষ্টির পানি মিতার শরীরে পরতেই যেন ঘোর কাটলো অরিয়নের। ধীরগতিতে পা বাড়ায় অরিয়ন। আলতো পায়ে এগিয়ে যায় মিতার দিকে। মিতার থেকে ক্ষণিকের জন্যও চোখ সরায় না, মিতার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় হাটু ভেঙ্গে বসে পড়ে। মিতা অরিয়নের চোখে চোখ রেখে অরিয়নকে দেখছে। অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বাম হাত দিয়ে ছাতাটা ধরে। ছাতা হাতে আলতো করে উঠে দাঁড়ায় অরিয়ন।

মিতার মাথার উপর ছাতা ধরে অরিয়ন। নিজেও এগিয়ে যায় মিতার দিকে। দুজন এখন অনেকটাই কাছাকাছি।

অরিয়ন মনে মনে ভেবেছিলো, মিতাকে যখন সামনা সামনি পাবে তখন কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিবে, কিন্তু এখন?
অরিয়ন আলতো করে মিতাকে নিজের বুকে সাথে মিশিয়ে নিলো। নিজের ডান হাত দিয়ে মিতার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে অরিয়ন। অন্যহাতে ছাতা ধরে রেখেছে মিতার মাথার উপর । নিজের বুকের সাথে মিতার মাথা স্পর্শ করতেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো অরিয়ন। মিতার মাথায় আলতো করে চুমু খায়। চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে অরিয়নের।

জড়িয়ে ধরা মেয়েটার জন্য অরিয়ন কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তা হয়তো মিতা কোনোদিন জানতেও পারবে না। বৃষ্টির পানি সেই প্রমাণ সাথে সাথেই মুছে দিচ্ছে। জড়িয়ে ধরা মিতার জন্য আজ অরিয়ন যা অনুভব করছে তা হয়তো এই পৃথিবীর সব চাইতে পবিত্রতম এক অনুভূতি। এই অনুভূতিতে নেই শারীরিক চাহিদা, কোনো আকর্ষণ, রূপের প্রতি মোহ বা ছলনা। যা আছে তা শুধুমাত্র স্নেহ,আদর,মায়া, ভালোবাসা আর শান্তি।

অরিয়নের চোখের পানি বৃষ্টির পানির সাথে এক হয়ে মিশে যাচ্ছে মিতার মাথার চুলে।

–আই মিসড ইউ সো মাচ, লাভ।
মিতার মাথার সাথে নিজের গাল স্পর্শ করিয়ে আলতো করে বলে অরিয়ন।

–সো মাচ।
আবারও বলে অরিয়ন।

স্তব্ধ হয়ে থাকা মিতার দু হাত যেন নিজে নিজেই উপরের দিকে উঠতে থাকলো। আলতো করে জড়িয়ে ধরে অরিয়নকে। দু হাত দিয়ে অরিয়নকে জড়িয়ে ধরতেই যেন বাধ ভেঙ্গে গেল মিতার। দু চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরতে লাগলো,কিন্তু মিতা তা অরিয়নকে বুঝতে দিলো না। অরিয়নের ভিজে যাওয়া পোশাকে মিতার ভালোবাসার চিহ্নটাও মুছে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দু জন কতক্ষণ একে অপরকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো তা কারোই জানা নেই।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ শুনে ঘোর কাটে দুজনের। মিতা অরিয়ন থেকে সরে এক পা পিছিয়ে আসে। মিতা পিছিয়ে পড়লেও অরিয়ন মিতার হাত শক্ত করে ধরে রাখে। অরিয়ন হাত ধরতেই অরিয়নের দিকে তাকায় মিতা। অরিয়ন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে নিজের সাথে নিজে কিছু নিয়ে লড়াই করছে।

–কেন পালিয়ে গেলি তা জানতে চাইবো না।
নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে অরিয়ন।

মিতা চুপ করে অরিয়নের কথা শুনছে। মাঝে মধ্যে একবার পুরো পার্কটা দেখে নিচ্ছে। এই বৃষ্টিতে কেউ নেই পার্কে। মানুষের কোনো আনাগোনাও শুনছে না মিতা।

–কী ভুল বা দোষ ছিলো আমার তাও জানতে চাইবো না।
আবারও বলে অরিয়ন। প্রতিটা কথায় অভিমান ভেসে উঠেছে।

–কেন ভালোবাসি বলেও এই পদক্ষেপ নিলি, তাও জানতে চাইবো না আমি।
এবার চোখ তুলে মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

অরিয়ন মিতার দিকে তাকাতেই মিতা নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। পাশে থাকা ফুল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মিতার চোখে অশ্রু ছলছল করছে।

–শুধু বলবো, বাড়ি চল।
বলে অরিয়ন।

******************

চৌধুরী মেনশন,চট্টগ্রাম।

বিছানায় হাত পা মেলে শুয়ে আছে আবরার। পাশেই ফোনে অনবরত কল বেজেই চলেছে।
নামের জায়গায় ৩ টি লাভ দেখা যাচ্ছে। গতকাল থেকে কল দিয়েই চলেছে ফাহমিদা। কল ধরেনি আবরার। এখনো কল বেজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই আবরারের। চোখ বন্ধ করে রেখেছে শুধু। চোখের সামনে সব কিছু যেন বিদ্যুতের গতিতে স্পষ্ট দেখতে পারছে আবরার।

ফ্ল্যাশব্যাক:

মুরাদপুরের একটি কফি শপের সামনে গাড়ি করে এসে দাঁড়িয়েছে আবরার। গতকাল মোবাইলে কথা বলে এখানে দেখা করার কথা জানায় ফাহমিদা। গাড়ি থেকে নেমেই চোখের সানগ্লাসটা ঠিক করে নেয় আবরার, হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে ১০ মিনিট লেট করেছে সে।
অরিয়নের কারণে সব কাজের চাপ এখন আবরারের ঘাড়ে এসে পড়েছে, নিজের জন্য সময় খুজে পাওয়াও মুসকিল হয়ে পড়েছে। সেখানে কফিশপে আসতে পেরেছে তাই অনেক।

কফিশপের নাম চোখের সামনে আসতেই নাক ছিটকায় আবরার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আহামরি কিছুই না। নর্মাল মিডেল ক্লাস মানুষদের জন্য এই কফিশপ। “কি আর করার” ভেবেই শপে ঢুকে আবরার।

যেমনটা ভেবেছিলো ঠিক ততোটাও খারাপ না শপটা, ভিতরে ঢুকতেই এমনটা ভাবে আবরার।
সুন্দর এলিগেন্ট ভাইব দিচ্ছে শপের ইন্টোরিয়রগুলো। আবরার মাথায় হুট করেই হাত রাখে, ফাহমিদাকে কীভাবে চিনবে বুঝতে পারছে না। মিতার প্রতি অনুভূতি থাকলেও মিতার বন্ধুদের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না আবরারের। একবার প্রতি সীটে চোখ বুলায় আবরার। প্রায় হাতেগুনা সব গুলো সীটেই কাপল বসে আছে। এক পাসের দুটি সীটে শুধুমাত্র একজন করে দুটো মেয়ে বসা। আবরারকে খেয়াল করতেই মেয়ে একটা নিজের সীটের থেকে উঠে এগিয়ে আসে। মুখে বিশাল এক হাসি, পরণে একটা স্কার্ট ও টপস। চুলগুলো খোলা। বাঙালি মেয়ে হলেও কেমন যেন ওয়েস্টার্ন ওয়েস্টার্ন একটা ভাইব দিচ্ছে মেয়েটা।

–ইউ আ…
মেয়েটা সামনে আসতেই মুখ খুলে আবরার। কিন্তু আবরারের কথা শেষ হওয়ার আগেই আবরারকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় মেয়েটি।

আবরার পিছনের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে একটি ছেলের হাত ধরেছে মেয়েটি। বুঝতে পারে মেয়েটি ফাহমিদা নয়।

এবার অন্য সীটে একা বসে থাকা মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায় আবরার। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না, নিচের দিকে তাকিয়ে মোবাইলে কিছু দেখতে ব্যস্ত। মেয়েটির পরণে কালো রঙের জামা। সেটা কী থ্রি পিস নাকি অন্য কিছু তা বুঝতে পারছে না আবরার। ওড়না মাথায় পেঁচানো।

–অবুক।
আবরার টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকায় ফাহমিদা। হঠাৎ করে কাউকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। বুকের উপর হাত রেখে পিছিয়ে যায় কিছুটা।

আবরার এক নজরে তাকিয়ে রইল ফাহমিদার দিকে। বিড়াল চোখের মেয়েটি আবরারকে দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণেই মুখে বিশাল এক হাসি ফুঁটে উঠে। মুক্তোর মতো দাঁতগুলোর আলতো এক ঝলক দেখতে পায় আবরার।

–আবরার ভাইয়া?
প্রশ্ন করে ফাহমিদা।

————–

বর্তমান।

হঠাৎ করেই চোখ খুলে তাকায় আবরার। চোখেমুখে চিন্তার ছাঁপ পড়েছে। সেদিনের সেই সামান্য এক দেখা আবরারের জীবনটা যে ক্ষণিকেই পরিবর্তন করে দিবে তা কে জানতো!
ফাহিদার মধ্যে তো আহামরি কিছুই ছিলো না, আর বাকি ৫ টা মেয়ের মতো নর্মাল মেয়ে ফাহমিদা,তাও আবরারের জীবনটা যেন রঙে রাঙিয়ে দিলো ফাহমিদা। মিতার শূন্যতাটা ফাহমিদা কবে থেকে পূরণ করতে শুরু করলো তা বুঝতেও পারেনি আবরার।

পাশেই কল বাজতে থাকা মোবাইলের দিকে চোখ যায় আবরারের। ফাহমিদা একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে।

–হ্যালো?
কল রিসিভ করে বলে আবরার।

–কতগুলা কল দিলাম দেখোনি?
অপর পাশ থেকে বলে ফাহমিদা।

–দেখলে তো কল ধরতাম ই, তাই না? ধরিনি তার মানে দেখিনি। আর কেউ কল না ধরলে বুঝতে হয় যে, সে ব্যস্ত। এই কমনসেন্সটাও নেই তোমার?
রাগান্বিত আবরার বলে।

ফাহমিদা চুপ করে রইল। একটা মানুষ এতোগুলো কল দিলে তা যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই দিয়েছে,তাও তো আবরারের বুঝতে হবে তা না? উলটো ফাহমিদার সাথে রাগারাগি করা শুরু করে দিয়েছে।

–ঠিক আছে।
ফাহমিদা অভিমানের সুরে কথা বলেই কল কেটে দেয়।

–শি*ট।
বিছানায় মোবাইল ছুড়ে ফেলে দেয় আবরার। একটা ভুল, ভুল বললে ভুল হবে। সবটা তো আবরার জেনেই করেছিলো। এখন তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছে নিজের অনুভূতিকে আগলে নিতে আর না পারছে এর থেকে বের হয়ে আসতে।

একপ্রকার হার মেনেই আবারও মোবাইল হাতে তুলে নেয় আবরার। কল দিতে থাকে ফাহমিদাকে কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না।

–এই মেয়ে আমাকে পাগল না করে শান্তি পাবে না।
কপালের উপর হাত রেখে বলে আবরার।

–যা খুশি করো গিয়ে।
বলেই আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আবরার।

**********************

–শুধু বলবো, বাড়ি চল।
বলে অরিয়ন।

মিতা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় অরিয়নের হাত থেকে। মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। অরিয়ন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মিতার দিকে।

–কেন?
প্রশ্ন করে অরিয়ন। তবে কথাটা প্রশ্ন কমই মনে হলো।

–তুমি এখানে কেন? তুমি কীভাবে জানলে আমি এখানে?
বলে মিতা।

অরিয়নের সাথে আজ দেখা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কী শুধুই কো-ইন্সিডেন্স নাকি অন্যকিছু? কিছুই মিতার মাথায় ঢুকছে না।

–আমাকে দেখে খুশি হস নি তুই।
ব্যাঙ্গাত্মক এক হাসি দিয়ে বলে অরিয়ন।

–বলো কীভাবে জানলে? আর আরিয়ান ভাইয়া কো….. ওয়েট।
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মিতা। মাথার মধ্যে সব কিছু এখন পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।

–তুমি সব জানো!
বলে মিতা।

–কেন আরিয়ান? কেন আমি নই?
অভিমানের সুরে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

অরিয়ন কী প্রশ্ন করেছে তা ঠিক বুঝতে পারছে মিতা,তাও কিছু বললো না।

–তোর ভালোবাসা সব কিছুই কী ছলনা ছিলো? মিথ্যে ছিলো? অভিনয় করেছিলি আমার সাথে?

এবার ও মিতা কিছু বললো না। অসহায়ের মতো অরিয়নের দিকে তাকিয়ে রইল।

–সেদিন রাতে আমাদের মধ্যে যা হয়েছে সব কী মিথ্যে ছিলো?

–রিয়ন, কী সব বলছো তুমি?
বলে মিতা।

–ঠিকটাই বলছি। আমি ঠিকটাই বলছি। মিথ্যে না হলে কেন তুই আমাকে রেখে চলে আসলি?
কেন আরিয়ানের সাথে যোগাযোগ রাখলি? কেন আমার কথা একবার ভাবলি না তুই?
মিতার দিকে দু পা এগিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে অরিয়ন।

–কেন ভালোবাসি বলেও চোরের মতো পালিয়ে গেলি তুই? বল।
মিতাকে বার বার প্রশ্ন করতে থাকা অরিয়ন এতোটাই মগ্ন হয়ে পড়েছে যে, মিতার হাতে যে প্রতিনিয়ত চাপ পড়ছে সেদিকে লক্ষ্যই নেই অরিয়নের।

–জবাব দে!
চেঁচিয়ে বলে অরিয়ন।

–কারণ আমি সব জানি।
একটানে অরিয়নের থেকে হাত ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে জবাব দেয় মিতা।

–কী জানিস তুই?
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।

–সবটাই। যা আমার জানার প্রয়োজন ছিলো, অনেক আগে থেকেই। যা তোমরা লুকাতে চেয়েছিলে।
অরিয়নের চোখে চোখ রেখে বলে মিতা।

–তুই সব জানিস! কিন্তু কীভাবে?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–হাহ, অবাক হলে মনে হয়।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে মিতা।

–অবাক হবো? অবাক কেন হবো?
কী বুঝতে না পারার করার মতো বলে অরিয়ন। যেন মিতার কথা কিছুই বুঝতে পারছে না।

–ওহ প্লিজ।

–কী প্লিজ? কী বলতে চাচ্ছিস তুই?
এগিয়ে গিয়ে আবারও মিতার হাত ধরে অরিয়ন।

–কী বলতে চাচ্ছি তা জানোনা?
অরিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

–ন…

অরিয়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ চমকায়। ভয়ে লাফিয়ে উঠে মিতা। বৃষ্টি আর বাতাসের গতি যে আগের থেকে বেড়েছে সেদিকে লক্ষ্য করেনি কেউ। দুজন চারপাশে তাকাতেই লক্ষ্য করে আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝড়-তুফান এর সংকেত মনে হচ্ছে অরিয়নের।

মিতা নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো। অনুভূতিগুলো যেভাবে আক্রমণ করতে শুরু করেছে তাতে এই ঝড়-তুফান কিছুই মনে হচ্ছে না মিতার। অরিয়নের হাতে থাকা ছাতাটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। অরিয়ন থেকে অন্য হাত ছাড়িয়ে আবারও দু পা পিছিয়ে আসে। অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়ে দেখছে মিতা কী করে।

–বাড়ি ফিরে যাও।
নিচের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

–I love you.
বলে অরিয়ন।

–আকাশের অবস্থা ভালো না।
মিতার অন্য দিকে ঘুড়ে জবাব দেয়।

–Please.
অনুরোধের সুরে বলে অরিয়ন।

–পরী!
উচ্চস্বরে বলে উঠে অরিয়ন। এগিয়ে যায় মিতার দিকে।

কাকভেজা অবস্থায় অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়ে রইল। টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে অরিয়ন। চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।

–বাড়ি চল, পরী।
মিতার হাত আলতো করে স্পর্শ করে বলে অরিয়ন। অধীর আগ্রহ নিয়ে মিতার সম্মতির আশায় আছে অরিয়ন। মনে হচ্ছে একটা না শব্দ অরিয়নকে এখানেই শেষ করে দিবে।

মিতার চোখে পানি ছলছল করছে। চাইছে কোনোমতে যেন নিজেকে শক্ত করতে পারে। বার বার নিজেকে এই মানুষটার সামনে দুর্বল হতে দিবে না। মিতা নিজের হাত অরিয়নের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। নিয়ের হাতে থাকা ছাতাটা অরিয়নের দিকে এগিয়ে দেয়।

–আমাকে ভুলে যাও, রিয়ন। আমি এখন অন্য কারোর।
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে মিতা।

“আমি এখন অন্য কারোর”

“আমি এখন অন্য কারোর”

কথাটা যেন বার বার প্রতিধ্বনির মতো অরিয়নের কানে বাজতে থাকলো। এতোক্ষণ নিজের মধ্যে ধরে রাখা সব অনুভূতিগুলো যেন লুকিয়ে পালালো। ক্ষণিকেই অনুরোধের থেকে সব কিছু যেন ভয়ানক কিছুতে রূপ নিতে শুরু করলো।

–হাহাহহাহাহাহায়াহহাহাহায়াহ।
শব্দ করে হাসতে থাকে অরিয়ন।

চলবে……..

#পারমিতা
#পর্ব_৪৯
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–হাহাহহাহাহাহায়াহহাহাহায়াহ।
শব্দ করে হাসতে থাকে অরিয়ন।

এই হাসি কতই না বিশ্রী লাগছে অরিয়নের মুখে,অদ্ভুত লাগছে এই হাসির শব্দ। অরিয়নের হাসি দেখে অচেনা কেউ ভাববে মিতা হয়তো কোনো কৌতুক বলেছে।

অরিয়ন হাসতে হাসতে দুহাত নিজের পেটে হাত রাখে। মিতার কাছে এই অরিয়নকে এক সময় অদ্ভুত রকমের বিশ্রী লাগছে, তো আরেক সময় ভয়ানক সুন্দর লাগছে। ভয়ানক আর সুন্দর শব্দগুলো একসাথে যায় না কিন্তু মিতার কাছে এসবের কোনো মানেই নেই।

–অনেক সুন্দর কৌতুক বলতে পারিস। নতুন শিখলি বুঝি?
পেটে হাত রাখা অবস্থায় মাথা তুলে মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতা কিছু বললো না। এক নজরে অরিয়নকে দেখছে।

মিতার চেহারার অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়াতে অরিয়ন নিজের হাসি বন্ধ করে। দু হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো পেঁছনের দিকে নিতে নিতে সোঁজা হয়ে দাঁড়ায়। বড় করে নিশ্বাস ছাড়ে কয়েকবার। এগিয়ে যায় মিতার দিকে।

–তোর কী মনে হয়, আমি আবা*ল? বল*দ নাকি বোকা**দা?
অগ্নি দৃষ্টিতে মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

–ভাষা সুন্দর করে কথা বলবে।
অরিয়নের কথা শুনে যেন আগুন জ্বলে উঠে মিতার।

–তোর ভাষার গুষ্টিকিলাই আমি।
মিতার হাতে থাকা ছাতা টান দিয়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে অরিয়ন।

–অরিয়ন!!
অরিয়নের এহেন বিহেভিয়ার দেখে চেঁচিয়ে উঠে মিতা।

–চুপ। একদম চুপ। আর একটা কথা বলবি না।
নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল এনে দেখিয়ে বলে অরিয়ন।

–সুন্দর করে কথা বলছিলাম তা ভালো লাগেনি, তাই না? অন্য কারোর? অন্য কারোর? তোর অন্য কারোর মা*রে…

–ঠাসসসসসসসস।
অরিয়ন নিজের কথা শেষ হওয়ার আগেই থাপ্পড় মা*রে মিতা।

মিতা কী ভেবেছিলো? মিতা অন্য কারোর সেটা জানার পর খুশি খুশি এখান থেকে চলে যাবে অরিয়ন? এরকম কিছু হতে পারে তা তো মিতার জানা কথাই। তাও অরিয়নের এসব কিছু সহ্য হচ্ছে না মিতার। মিতার দুচোখে যেন কোনো ভয় বলতে কোনো কিছুই নেই। অন্য কারোর হলে কোন অধিকারে চড় বসালো তাও জানেনা। শুধু জানে অরিয়ন মিতাকে কিছুই করবে না।

মিতার দুর্বল হাতের থাপ্পড় অরিয়নের কাছে কিছুর মতোই লাগলো না। ব্যাথা তো দূরের কথা কিন্তু যা অরিয়নকে কষ্ট দিলো, তা হলো মিতার অরিয়নকে আ*ঘাত করার ইচ্ছাটা।

–আমার সাথে বাসায় যাবি।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে অরিয়ন।

–বললাম না আমি যাব না? বললাম না আমি অন্য কারোর? মাথায় কী কথা ঢুকে না নাকি?
চেঁচিয়ে বলতে থাকে মিতা।

মিতার উপরে যেন কিছু ভর করেছে। কিসের রাগ কোথায় ছাড়ছে তা বুঝতে পারছে না।

–অন্য কারোর অর্থ আমি এখন অন্যজনের বিবাহিতা। অন্য কারোর ব…

–ঠাসসসসসসসসসসসস।
মিতাকে ঠাটিয়ে এক চড় বসায় অরিয়ন।

থাপ্পড় খাওয়ায় মিতার মুখ অন্যদিকে সরে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মিতা। রাগান্বিত অবস্থায় অরিয়নের দিকে ফিরে তাকায়।

–আমার গা*য়ে হাত তুললে তুমি!
বলে মিতা।

–বেশ করেছি তুলেছি। এখন যদি এই বা*লের কথা বন্ধ না করিস তাহলে হাত, পা ভে*ঙ্গে এরপর কোলে করে বাড়ি নিয়ে যাবো।
বলে অরিয়ন।

–তুমি..

–আমি কি? কি আমি? আইন অনুযায়ী আমি তোর স্বামী। আমাকে ডিভোর্স না দিয়ে তুই কীভাবে অন্য জায়গায় বিয়ে করলি? আমাকে কী ১৭/১৮ বছরের কঁচি খোকা পেয়েছিস? যা ইচ্ছা তা বুঝ দিবি?
মিতার হাত শক্ত করে ধরে বলে অরিয়ন।

–আর যদি বিয়ে করেও নিস তাহলে আইন ও ধর্ম অনুযায়ী তা অবৈধ। এক অবৈধ সম্পর্কের জন্য আমি আমার ওয়াইফে ছেড়ে যাবো তা কীভাবে ভাবলি তুই? এতোদিনে আমাকে এই চিনেছিস?
মিতার মুখের উপর চলে আসা চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বলে অরিয়ন।

ছাতা ফেলে দেওয়ার কারণে মিতা প্রায় ভিজে গেছে। কী অপরূপ সুন্দর লাগছে মিতাকে তা একমাত্র অরিয়নের চোখ দিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে। ৬ মাস আগে মিতা পালিয়ে না গেলে আজ এই বৃষ্টিতে ছাদে দুজনে বৃষ্টিতে ভিজতো, নাচতো, এরপর গরম গরম চা পান করতে করতে গল্প করতো। মিতার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতো অরিয়ন কিন্তু সবটাই এখন উলটো। এই বৃষ্টিতে দুজনে ঝগড়া করছে, দু জন দুজনকে চড় মে*রেছে।

–আমি বাড়ি যাব না।
এক ঝাপটা দিয়ে অরিয়নের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে মিতা।

–বাড়ি তো তুই যাবি ই। আমিও একটু দেখি কার ম*রার এতো সখ হয়েছে যে তোকে বিয়ে করেছে। তোকে নিয়ে গেলে তো তোর স্বামীর ছুটে আসার কথা তাই না? নাকি কাপুরুষের বাচ্চা তাও আসবে না?
মিতার চোখে চোখ রেখে বলে অরিয়ন।

মিতা কিছু বললো না। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলো অরিয়নের দিকে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে চোখ দিয়ে আগুন বেড়িয়ে আসবে আর তা অরিয়নকে পুড়ে ছারখার করে দিবে।

–নাকি সবটাই মিথ্যে? সবটাই অভিনয় আমাকে ভুলার জন্য?
নিজের হাত দিয়ে আলতো করে মিতার গলায় স্পর্শ করতে করতে বলে অরিয়ন।

অরিয়নের স্পর্শ অনুভব করতেই নড়েচড়ে উঠে মিতা। অরিয়নের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে অরিয়নের দৃষ্টি এখন আর মিতার চেহারার দিকে নেই। তাকিয়ে আছে মিতার গলার দিকে যেখানে হাত স্পর্শ করেছে সেখানে। অরিয়নের চেহারার ফুটে উঠেছে অন্য অনুভূতি। এই স্পর্শ বা অনুভূতির অর্থ মিতা ঠিকি বুঝতে পারছে।

–গলাটা খালি খালি লাগছে।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।

এই কথাটা দিয়ে কী বুঝিয়েছে তাও বুঝতে পারছে মিতা। কারণ মিতার গলাতে গোল্ডের একটা চেইন পড়া আছে তাও খালি থাকার মানে যে এটা না তা বুঝাই যাচ্ছে। মিতা আবারও অরিয়নের হাত সরিয়ে দেয়।

–Don’t touch me.
বলে মিতা।

–আহা,স্বামী বেচারা বুঝি খুব রাগ করবে?
ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বলে অরিয়ন।

–আমি যে সব কিছুতে প্রথম তা কী জানে?
বাঁকা হাসি দিয়ে বলে অরিয়ন।

–অরিয়ন!!!

–আহ!!!
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিতার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে অরিয়ন।

–অনেক হয়েছে মিষ্টি মিষ্টি কথা। My wife likes spicy things. Don’t you, love?
মিতার মুখের কাছাকাছি গিয়ে বলে অরিয়ন।

মিতা নিজের হাত দিয়ে চুল থেকে হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে থাকে।

–পালিয়ে গেলি কেন? কোথায় ছিলি এতোদিন?
কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

একটু আগে মিতাকে কাছে পাওয়ার যে অনুভূতিটা দেখা গিয়েছিলো এখন আর তা দেখা যাচ্ছে না। গম্ভীরতা প্রকাশ পাচ্ছে হঠাৎ করে। একটা মানুষ কীভাবে ক্ষণিকের মধ্যে এতো পরিবর্তন হতে পারে তাই বুঝতে পারছে না মিতা।

–জবাব দে।

–ব্যাথা পাচ্ছি আমি।
চুলে টান খাচ্ছে মিতা। এখন চামড়ায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছে।

–ব্যাথা পাওয়ার জন্যই ধরেছি। বল কেন পালিয়েছিলি?
আবারও চুলে টান দিয়ে বলে অরিয়ন।

–কারণ তোমাদের মতো মিথ্যাবাদীর সাথে আমি থাকতে চাই নি।
বলে ফেলে মিতা। কথাটা বলতেই মিতার চোখে ঘৃণা প্রকাশ পেতে থাকে।

–মানে?
ভ্রু কুঁচকে বলে অরিয়ন। মিতার কথার কিছুই বুঝতে পারছে না অরিয়ন।

–মানে খুব ভালোই জানো। এতো অভিনয় করার কী আছে?

–কী বলতে চাচ্ছিস পরিষ্কার করে বল।
বলে অরিয়ন।

–আমি ব্যাথা পাচ্ছি।
অধৈর্য্য হয়ে বলে মিতা।

–I know.
বলে অরিয়ন।

–আমাকে খু*ন করার চেষ্টা, রাতে তোমার আর বড় চাচ্চুর কথা বলা আর এর পর পরই আমাকে ভালোবাসি বলা। সবগুলো খুব স্বাভাবিক ঘটনা তাই না?
অরিয়নের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলে মিতা।

–কি বলতে চাচ্ছিস তুই?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–কেন অভিনয় করলে? আমি তো কিছুই চায়নি তোমার কাছে? ভালো নাই বাসতে আমাকে। তাও কেন ভালোবাসার অভিনয় করলে? কেন ব্যবহার করলে আমাকে? টাকাই কী সবকিছু?
কথাগুলো বলতেই মিতার চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে।

–কি সব বলছিস তুই। টা…

–আহ…

–আয়ায়ায়ায়ায়া।
চিৎকার করে উঠে মিতা।

–অরিয়ন!!!!!!!!
ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে মিতা।

মিতা আর অরিয়নের কথা চলাকালীন হুট করেই পেছন থেকে কেউ অরিয়নের মাথায় বারি মারে। নিমিষেই মিতার থেকে কিছুটা দূরে সরে আসে অরিয়ন। মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। হাতে র*ক্ত দেখা যাচ্ছে। মিতা দৌড়ে অরিয়নের কাছে গিয়ে বসে।

অরিয়ন র*ক্তমাখা হাত দেখে পিছনের দিকে তাকায়। সামনের দাঁড়িয়ে আছে ৮/১০ জন লোক। বয়সে প্রায় অরিয়নের সমান বা বড় হবে। একজনের হাতে কাঠের টুকরো একটা। একপাশে র*ক্ত লেগে আছে। বুঝতে পারে এটা দিয়ে আ*ঘাত করা হয় অরিয়নকে।

–দাঁড়ায় আছস কেন। মাইয়াটাকে ধর।
লোকগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠে।

লোকটার কথা শুনতেই মিতা ভয়ে অরিয়নকে শক্ত করে ধরে। মাথায় আ*ঘাত পাওয়ার কারণে চোখে সব যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখছে অরিয়ন। একজন মিতার দিকে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে দেয় মিতার দিকে কিন্তু মিতাকে স্পর্শ করার আগেই তার হাত ধরে ফেলে অরিয়ন।

–কে তোরা?
হাত মোচড় দিয়ে ধরে উঠে দাঁড়ায় অরিয়ন। মিতাকে নিজের শরীর দিয়ে পুরোটাই লুকিয়ে রাখে।

–আয়ায়ায়া।
ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে লোকটি।

–ঐ দাঁড়ায় আছস কেন। ধর ওরে।
সামনে থেকে একজন বলতেই ৪/৫ জন এগিয়ে আসে অরিয়নের দিকে।

–যেভাবেই হোক এখান থেকে পালাবি তুই৷ ওদের কাছে ধরা দিবি না। আমি খুজে নিবো পরে।
বলে অরিয়ন।

অরিয়ন হাত ধরে রাখা লোকটাকে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। অন্যরা লোকটিকে ধরতে ধরতেই এগিয়ে যায় অরিয়ন। একের পর এক ঘুষি আর লা*থি মারতে থাকে অরিয়ন। ৫ জনের সাথে মা*রামা*রি করতে করতে বাকি ২ জন এগিয়ে যেতে থাকে মিতার দিকে। মিতা দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

–কে তোরা? আমাদের সাথে কী সমস্যা?
একজনের লোকের বুকের উপর পা রেখে চাপ দিয়ে বলে অরিয়ন।

লোকটি কিছু বললো না। একটু পর পর মাথা ঝাকি দিচ্ছে অরিয়ন। একটু পর পর চোখে ঝাপসা দেখছে। পেছন থেকে অরিয়নকে একজন লা*থি মা*রতেই মাটিতে পড়ে যায় অরিয়ন।

মিতা দৌড়াচ্ছে পালানোর জন্য। কেনই বা এরা মিতাকে ধরতে এসেছে অথবা কেনই অরিয়নকে মা*রছে তা জানেনা মিতা। নাকি জানে?

–বাঁচাওওওওওওওও।
চিৎকার করে উঠে মিতা।

এই বৃষ্টিতে কেউ কিছুই শুনতে পারবে নাকি তা সন্দেহ আছে।

–বাঁচাওওওও, কেউ আছোওওওও?
আবারও দৌড়েতে দৌড়েতে চিৎকার করে উঠে একজন।

–আহহহহহ…
পেছন থেকে মিতার চুল টান দিয়ে ধরতেই চিৎকার করে উঠে মিতা।

অরিয়নকে ৩/৪ জন মিলে পিটাচ্ছে। মাটিতে পড়ে আছে অরিয়ন। একের পর এক লা*থি দিয়েই যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। মাথায় আঘাত খাওয়া অরিয়নের শরীর থেকে র/ক্ত বেরিয়ে গেছে অনেকটা। শরীর অনেকটাই দুর্বল হয়ে এসেছে অরিয়নের।

–আয়ায়ায়া..
মিতার চুলের মুঠি ধরে টান দিতেই চিৎকার করে উঠে মিতা। মিতা ভেবেছিলো অরিয়ন চুল ধরাতেই ব্যাথা পেয়েছিলো কিন্তু এখন বুঝতে পারছে এই ব্যাথার কাছে কিছুর ছিলো না ঐটা।

–ছাড় আমাকে..ছাড়। বাঁচাওওওওওও।
চিৎকার করে মিতা।

–চুপ ছেড়ি। চিল্লাবি না। একদম জানে শেষ কইরা দিমু।
চুল ধরে রাখা লোকটি বলে।

–ছাড়া আমাকে, ছাড়।
চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে মিতা।

–বেশি ফালাবি তো তুই ও মরবি। তোর মজনুরে জীবিত দেখতে চাইলে চুপ কইরা থাক।
বলে লোকটি।

–আসছি শুধু তোরে নিতে। স্যার কইছে তোরে নিতে। তার পোলারে ছাইড়া দিতে। তোর জন্য তারে মা*রতে হইছে,মা*গী।
মিতার চুল ধরে হাটতে হাটতে বলে লোকটি।

লোকটির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মিতা। চুলের থেকে হাত সরিয়ে নেয়। “কী ভেবেছিলো? হাবিব চৌধুরী এতো সহজেই ছেড়ে দিবে? ” পরাজয়ের সহিত চুপ করে রইল মিতা।

–ঐ,ছাইড়া দে মজনুরে। লায়লারে পাইছি।
মিতার চুল ধরে রাখা লোকটি চেঁচিয়ে বলে।

–রিয়ননননন।
মাটিতে লুটিয়ে থাকা অরিয়নকে দেখে বলে উঠে মিতা।

মিতার কন্ঠ শুনতেই ঘোর কাটে অরিয়নের। চোখ খুলে মিতার দিকে তাকাতেই চোখ যায় মিতার চুল ধরে রাখা হাতের দিকে। সাদা রঙের জামাটা কাদায় নোংরা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য সবটা মরীচিকা লাগলো সবকিছু অরিয়নের কাছে। মাথা ঝাকি দিয়ে আবারও চোখ তুলে মিতার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সবটাই বাস্তব। ক্ষণিকেই যেন ভূত ভর করলো অরিয়নের উপর। দু হাতে দুজনের পা ধরে টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় অরিয়ন। এক লাফে নিজে উঠে দাঁড়ায়।

একের পর এক আঘাত করতে থাকে লোকগুলোকে। কিছুক্ষণ আগেও অরিয়নকে মা*রতে থাকা লোকগুলো যেন এখন অরিয়নের সাথে শক্তিতে পারছে না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তারা।

–মাদার**দ।
মিতার চুল ধরে রাখা লোকটির দিকে তাকিয়ে গালি দিয়েই দৌড়ে এগিয়ে যায় অরিয়ন।

কিছুদূর দৌড়ে গিয়েই থেমে যায় অরিয়ন। লোকদুটো অরিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। একে অপরকে ফিসফিস করে কিছু বলে। একজন নিজে থেকে একটু এগিয়ে আসে। অরিয়ন হঠাৎ কেন থেমে গেল তা বুঝতে পারছে না মিতা। মিতার কাছে সব পরিষ্কার হয় যখন মাটিতে পড়ে থাকা ছাতাটা তুলে নেয় অরিয়ন। এক দৃষ্টিতে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেই হাত দিয়ে টেনে ছাতার কাপড় খুলে আনে। মিতার চোখ সাথে সাথেই বড় বড় হয়ে যায়। অরিয়নের দৃষ্টি মিতার দিকে না থাকলেও অরিয়ন কী করতে চাইছে সব বুঝতে পারছে মিতা।

হাটা শুরু করে অরিয়ন। একটু এগিয়ে আসা লোকটি আশা পাশে তাকিয়ে গাছ থেকে ঠাল ভেঙে নেয়। খালি হাতে যে মা*রামা*রিতে টিকা যায় না তা ভালোই জানে এরা। লোকটি গাছের ঠাল দিয়ে আঘাত করার আগেই ছাতার হ্যান্ডেল দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে অরিয়ন। লোকটিকে যেন আঘাত করার কোনো সুযোগই দিচ্ছে না অরিয়ন। র*ক্তে আশেপাশের পানি লাল হয়ে এসেছে।

মিতার চুল ধরে রাখা লোকটি সব কিছু দেখে ভয়ে মিতার চুল ছেড়ে দেয়। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। অরিয়ন তা লক্ষ্য করতেই পেছনে দৌড়াতে থাকে। ধরতে না পেরে হাতের ছাতাটা ছুড়ে মা*রে। পায়ে আঘাত করতেই পড়ে যায় লোকটি। সাথে সাথে গিয়ে ধরে ফেলে অরিয়ন।

–মাফ করেন ভাই, মাফ করেন। আপনার পাও ধরি।
অরিয়নের পা ধরে কাঁদতে থাকতে লোকটি।

অরিয়ন কিছু বললো না। মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নিচু হয়ে বসে অরিয়ন।

–মাফ চাই ভাই। আর হবে না। আমাগো যা কইছে আমরা তাই করছি।
বলে লোকটি।

অরিয়ন আলতো করে লোকটির ডান হাত ধরে। তাকিয়ে থাকে হাতের দিকে। যতো তাকিয়ে থাকছে ততোই হাতের উপর চাপ প্রয়োগ করছে অরিয়ন।

–প্লিজ ভাই প্লিজ, মাফ কইরা দেন ভাই।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
লোকটির বুকে পা দিয়ে লাথি মারে অরিয়ন। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লোকটি। ডান হাত মোচড় দিয়ে ধরে অরিয়ন।

–আমার পরীর চুল ধরেছিস এই হাত দিয়ে।
গম্ভীর কন্ঠে বলে অরিয়ন।

–আয়ায়া..
ব্যাথায় কোকাতে থাকে লোকটি।

–আমার পরীকে আমি ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারে না, শু*য়োরের বাচ্চা। পারে না।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
অরিয়ন কথাটা বলতে বলতেই ডান হাতটা মোচড় দেয়। সাথে সাথেই ভেঙ্গে যায় ফলে বিভৎসভাবে চিৎকার করে উঠে লোকটি।

–আমার পরীকে কেউ কষ্ট দিতে পারে না।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।

–কেউ না।
বলতে বলতে ভাঙ্গা হাতে আবারও মোচড় দিতে থাকে অরিয়ন।

–রিয়ননননননন।
ভয়ানক এক চিৎকার করে উঠে মিতা।

অরিয়ন মিতার কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকানোর পূর্বেই অরিয়নের মাথায় ইট দিয়ে কেউ একজন আঘাত করে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অরিয়ন। চোখের সামনে সব কিছু ক্ষণিকেই ঝাপসা হয়ে যায়। মিতার দিকে তাকাতেই অস্পষ্টভাবে লক্ষ্যকরে কয়েকজন মিলে মিতাকে ধরে রেখেছে।

র*ক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা অরিয়ন নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় মিতার দিকে।

–পরী!!
সাথে সাথে মাটিতে অরিয়নের হাত পড়ে যায়। জ্ঞান হারায় অরিয়ন।

চলবে…

#পারমিতা
#পর্ব_৫০
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–অরিয়ন?

–*******?

–অ*****?

আবছা আবছা কিছু শুনতে পেয়েই মিটমিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করে অরিয়ন।

কে কি বলছে তা কিছুই স্পষ্ট নয় অরিয়নের কাছে। চোখ খোলার চেষ্টা করতেই যেন প্রচন্ডরকমের ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো মাথায় ও চোখে।

–উফ…
মাথায় হাত দিয়ে গোংরানি দিয়ে উঠে অরিয়ন।

–অরিয়ন? কেমন লাগছে এখন?
আবারও কারো কন্ঠস্বর শুনতে পায় অরিয়ন। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে চোখ খুলতেই অরিয়নের মুখের কাছাকাছি দেখতে পায় আনিকা চৌধুরীকে।

–বাবা, কেমন লাগছে এখন? খারাপ লাগছে না তো তোর?
হঠাৎ করে আনিকা চৌধুরীকে কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগছে অরিয়নের কাছে। চোখে মুখে গ্লানি,চিন্তা,ক্লান্তি,বিষন্নতার ছাঁপ নাকি চোখের ভুল তা বুঝতে পারছে না অরিয়ন।অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আনিকা চৌধুরীর দিকে।

–সরুন, পেসেন্টকে দেখতে দিন।
আনিকা চৌধুরীর পিছন থেকে কারো কণ্ঠ ভেসে আসে।

সাদা এপ্রোনে ৩০/৩২ বছরের একজন মহিলা অরিয়নের নজরের সামনে আসতেই বুঝতে পারে হাসপাতালে আছে অরিয়ন। পরক্ষণেই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছু যেন ফ্ল্যাশব্যাক হতে লাগলো।

দ্রুত একবার পুরো রুমে মিতাকে খোঁজার চেষ্টা করে। যে অরিয়নকে হাসপাতালে এনেছে সে হয়তো মিতাকেও ছাড়িয়ে আনতে পেরেছে সেই আশায়। কিন্তু অরিয়নের আশায় যেন কেউ পানি ঢেলে দিলো। পুরো রুমে আনিকা চৌধুরী ছাড়া আর কেউ নেই।

–মা,পরী কোথায়? আর আমাকে এখানে কে আনলো?
ডাক্তারকে উপেক্ষা করেই আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–বিপি নর্মাল আছে। আপাতত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। র*ক্ত পড়া বন্ধ হওয়াতে তেমন কোনো মারাত্মক ক্ষতি হতে পারেনি।
আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে ডাক্তার।

–থ্যাংক ইউ, ডাক্তার।
জবাব দেয় আনিকা চৌধুরী।

–মা? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলে অরিয়ন।

হাসপাতালের রুমের জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করে। অনেকটা অন্ধকার হয়ে আছে বাইরে। ‘রাত নাকি সন্ধ্যা?’ মনে মনে ভাবে অরিয়ন। বুকের মধ্যে অজানা এক ভয় কাজ করতে শুরু করেছে অরিয়নের। ‘পরীকেও সাথে করে এনেছে’ মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে অরিয়ন।

–তোর বাবা নিয়ে এসেছে তোকে।
জবাব দেন আনিকা চৌধুরী।

–বাবা?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–হুম।
সায় দেন আনিকা চৌধুরী।

–বাবা কীভাবে গেলেন সেখানে? ওখানে তো আমার একার যাওয়ার কথা ছিলো?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–আর পরী? পরী কোথায়,ওকে দেখছি না কেন?
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–ঐ মেয়ে কোথায় আমি জানিনা।
জবাব দেন আনিকা চৌধুরী।

–কিহ?

–আমার সাথে পরীকে আনেনি ?
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে অরিয়ন।

–না।
জবাব দেন আনিকা চৌধুরী।

–বাবা কোথায়?

–তোকে হাসপাতালে রেখে কোথায় যেন গেছে। আর আসেনি।
উত্তর দেন আনিকা চৌধুরী।

–কোথায় যাচ্ছিস?

অরিয়ন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই জিজ্ঞেস করেন আনিকা চৌধুরী।

–অরিয়ন, কি করছিস তুই?
অরিয়ন হাত থেকে স্যালাইন খুলতেই দৌড়ে এগিয়ে যান।

–পরীকে খুঁজতে। ওকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে মা।
শার্ট পরতে পরতে বলে অরিয়ন।

–কিহ?
অবাক হয়ে বলেন আনিকা চৌধুরী।

–হ্যাঁ মা। তোমার মোবাইলটা আমাকে দেও। বাবা আসলে আমাকে এখানে কল করতে বলো।
আনিকা চৌধুরীর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় অরিয়ন।

আনিকা চৌধুরীর হঠাৎ করেই কেমন যেন দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বুকের মধ্যে অশান্তি লাগছে হঠাৎ করেই। মিতা চলে যাক এটাই সব সময় চেয়েছেন আনিকা চৌধুরী। তাই বলে এতোটাও খারাপ কিছু হোক তা তিনি চাননি।

–দোয়া করি ঠিক মতো বাসায় ফিরে আয়। তারপর আমার ছেলের জীবন থেকে দূরে চলে যাস।
বিরবির করে বলেন আনিকা চৌধুরী।

********************

মাথা নিচু করে বসে আছে মিতা। কোথায় আছে কিছুই জানেনা। লোকগুলো অরিয়নকে বেহুশ করতে সফল হলে মিতাকে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে উঠা মাত্রই চোখ বেধে ফেলা হয় মিতার। কতক্ষণ গাড়িতে ছিলো জানা নেই মিতার। তবে যখন চোখ খোলা হলো তখন মিতাকে একটি খালি রুমে নিয়ে আসা হয়েছে।

লোকগুলোদের মধ্যে থেকে একজন একটু পরেই কোথা থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসে। চেয়ারের সাথে বেধে ফেলে মিতাকে। সকালে বৃষ্টিতে ভিজেছিলো মিতা,সেই কাপড়েই এখনো বসে আছে চেয়ারে।

মিতাকে বাধা শেষ করেই একে একে সবাই বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ একা বসে থাকলেও একটু পর খেয়াল করে রুমটা একদম নতুন। মনে হচ্ছে কিছুদিন আগেই করা হয়েছে।

এখন কি বিকাল নাকি সন্ধ্যা নাকি রাত তার কিছুই বুঝতে পারছে না। আশেপাশে কোথাও থেকে আজানের আওয়াজও ভেসে আসছে না। “তাহলে কী আশেপাশে কোনো মানুষ নেই?” মনে মনে ভাবে মিতা।

মিতার কাপড়চোপড় প্রায় শুকিয়ে গেছে। হাবিব চৌধুরী, যাকে মিতা নিজের বাবার মতোই দেখেছে,যাকে মিতা সম্মান দিয়েছে, ভালোবেসেছে সেই নাকি মিতার বিশ্বাস ভঙ্গ করতে মরিয়া হয়ে গেছে। অরিয়ন যে এই সম্পর্কে কিছুই জানেনা আজ তা পরিষ্কার মিতার কাছে। অরিয়ন যেভাবে মিতাকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো তাতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো অরিয়ন নিরপরাধ।

হঠাৎ করেই মিতার বুকের মধ্যে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। এই ব্যাথাটা অরিয়নের সাথে অন্যায় করার কারণে, অরিয়নকে বিশ্বাস না করার কারণে। এবার আর মিতার জীবিত বাড়ি ফিরার আর কোনো উপায় নেই তা মিতা বুঝতে পারছে। এতোকিছুর মধ্যে অরিয়নকে শেষবারের জন্য বিদায় দিতে পারেনি মিতা। অরিয়ন থেকে নিজেও শেষ বিদায় নিতে পারেনি। কথাগুলো ভাবতেই হাসি ফুঁটলো মিতার ঠোঁটে তবে এই হাসি আনন্দের না, এই হাসি নিজের পোড়া কপাল নিয়ে, অরিয়নকে বিশ্বাস না করার আফসোস নিয়ে। ঠোঁটে হাসি ফুঁটলেও চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে যাচ্ছে মিতার।

–আমাকে ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা করে দিও।
বিরবির করে বলে মিতা।

–তোমার পরী তোমাকে খুব ভালোবাসে,রিয়ন। খুব বেশি।
কাঁদতে কাঁদতে বলে মিতা।

*********************

হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে সবার প্রথমে পার্কে যায় অরিয়ন। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে যে মিতাকে পাওয়া যাবে না তা জানা কথাই। তাও গিয়েছিলো অরিয়ন। আশে পাশের সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে বুঝতে পারে মিতাকে কালো রংয়ের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নারায়নগঞ্জ প্রবেশ করার পর গাড়িটির আর কোথাও দেখা যায় নি।

রাত ১২ টা করে অরিয়ন তাদের ঢাকার বাড়িতে প্রবেশ করে। পুলিশের সাহায্যে শেষবার গাড়ির অবস্থান জানতে পেরেছে অরিয়ন। এছাড়া গাড়ির নাম্বার দেখে কার গাড়ি তা কাল সকালের মধ্যে খুজে বের করবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ।

বাড়িতে আগে থেকেই অরিয়নের জন্য অপেক্ষা করছেন আনিকা চৌধুরী ও মায়া চৌধুরী । অরিয়নকে দরজার সামনে দেখা মাত্রই দ্রুত দুজনে এগিয়ে যান।

–কি হলো? কিছু জানতে পারলি? ওকে খুঁজে পেলি?
একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে আনিকা চৌধুরী।

–মিতার কী হলো? মিতাকে কে নিয়ে গেছে?
কান্নারত মায়া চৌধুরী দৌড়ে অরিয়নের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে।

–বাবা কোথায়? তোমাকে বলেছিলাম আমাকে কল করতে বলতে।
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–হাবিব কোথায় জানিনা। আমার সাথে আর কথা হয়নি।
বলে আনিকা চৌধুরী।

–আমার কল কেন ধরছেন না উনি? আর চাচ্চু কই?
বিরক্ত হয়ে বলে অরিয়ন।

–ওয়াহিদ আমাকে বাসায় দিয়েই বের হয়ে গেছে। চট্রগ্রাম থেকে বের হওয়ার সময় হাবিব ভাই কল করেছিলো।
বলে মায়া চৌধুরী।

–পুলিশ কী বললো?
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে আফরিন।

অরিয়ন কিছু বললো না। হাটতে হাটতে দিয়ে সোফায় বসলো। মাথার ব্যাথাটা কমছেই না।
দু হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো একটু টেনে ধরে।

–গাড়িটা কার জানতে পারলেই অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যাবে। তা ছাড়া আর কোনো কিছুই বলা যাচ্ছে না।
বলে অরিয়ন।

–আরিয়ান কোথায়? ইচ্ছে করছে আরিয়ানকে ধরে চড় মারতে। ও যদি এতোদিন সবকিছু না লুকাতো তাহলে আর এসব দেখতে হতো না।
বলে মায়া চৌধুরী।

–তার আগে তোমার মেয়ে কে মা*রো মায়া। ও না পালালে এরকম কিছুই হতো না। এসবের মধ্যে আবার আমার আরিয়ানকেও জড়িয়ে নিয়েছে।

–আনিকা ভাবি!!

–আপনারা একটু চুপ করুন। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া না করে কী করতে হবে তা ভাবুন।
সকলের উদ্দেশ্যে বলে আফরিন।

–আরিয়ান কোথায়?
সোফায় হেলান দিয়ে বলে অরিয়ন।

–বলতে পারিনা। চট্টগ্রামেই আছে হয়তো।
জবাব দেন আনিকা চৌধুরী।

–আমাদের সাথেও আসেনি।
বলে আফরিন।

–ওহ।
বলে অরিয়ন।

**********************

দরজা খোলার শব্দে চোখ খুলে মিতা। বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তা খেয়াল নেই। সামনের দাঁড়িয়ে আছে ৩ জন। যার মধ্যে ২ জনকে আগে দেখেনি। দুজন হেটে মিতার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। মিতার হাতের বাধণ খুলতেই দু হাত এক সাথে ঘষতে থাকে মিতা। এতো শক্ত করেই বেধে রেখেছিলো যে, হাতের র*ক্ত চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের হাত নিজেই অনুভব করতে পারছে না।

–দে।
যে লোকটা অরিয়নের মাথায় আঘাত করেছিলো সে হঠাৎ করেই বলে উঠে।

কি চাইলো তা দেখতে মাথা বাঁকা করে দেখার চেষ্টা করে মিতা। দুজনের মধ্যে একজনের হাতে কাগজ।

–এটাতে সাইন কর।
কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে লোকটি।

–কী এটা?

–ঐটা জানতে হবে না। চুপচাপ সাইন কর।
মিতার হাতের উপর কাগজ দিয়ে বলে লোকটি।

মিতা লোকটির দিকে একটু তাকিয়ে থাকলো। চেহারা টা কতই না ভয়ানক। পরণে তার একটা লুঙ্গি আর চেক শার্ট। মাঝে মাঝে শরীর থেকে ম*দের দুর্গন্ধ আসছে।

–কী দেখস? পছন্দ হইছে? বিয়া করবি?
কুৎসিত নজরে মিতার দিকে তাকিয়ে বলে লোকটি।

লোকটির কথা শুনতেই যেন বমি বমি ভাব লাগছে মিতার। লোকটির থেকে নজর সরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করে।

“আমি পারমিতা মেহেরিন চৌধুরী (১৯), পিতা: ওয়াসিম চৌধুরী, মাতা : সুমাইয়া রহমান, নিজের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সম্পূর্ণ হুশ থাকা অবস্থায় আমার বড় চাচা হাবিব চৌধুরীর নামে লিখিয়া দিচ্ছি। আমাকে কোনোরূপ জোর-জাবরদস্তি করা হয়নি।” কাগজের লিখাটা দেখে যেন পায়ের র*ক্ত মাথায় উঠে গেলো মিতার।

নিজের চাচা এতোটা বেঈমানী করবে তা ভাবতে পারেনি মিতা।

–আমি সাইন করবো না।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে মিতা।

–সোনামনি সাইন করবে না। সাইন না করতে চাইলে কী করা উচিৎ, সাব্বির?
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের উদ্দেশ্য বলে লোকটি।

–তাকে ডিম থেরাপি দেওয়া উচিৎ, জসিম ভাই।
বলে সাব্বির নামের লোকটি।

এদের কথা শুনে ক্রমাগত হাত পা ঠান্ডা হয়্র আসছে মিতার। কিন্তু হাবিব চৌধুরীকে কোনোভাবেই জিততে দিবে না মিতা। তাতে যদি মিতার মৃত্যুকে সাদরে গ্রহণ করতে হয় তাই করবে।

–শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করমু, সাইন করবি কি না?
বলে জসিম নামের লোকটি।

–না।
একনিষ্ঠভাবে বলে মিতা।

–খারায় আছস কেন, মা*গ*রে ধর।

জসিম কথাটা বলতেই দুজন এসে মিতার দু হাত ধরে ফেলে।

–না না না, ছাড় আমাকে।
চেঁচাতে থাকে মিতা।

দুজনে মিতার হাত শক্ত করে ধরতেই জসিম মিতার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি চামড়া ছিড়ে সব চুল চলে আসবে।

–ছাড় আমাকে, ছাড়।

–সাইন করবি কি না?

–না। ম*রে গেলেও করবো ন..

–ঠাসসসসসসসস।

মিতার গালে স্বজোরে থাপ্পড় মারে জসিম। সাথে সাথে মিতার ঠোঁট কেটে র*ক্ত বের হয়। এতো জোরেই থাপ্পড় মে*রেছে যার দরুন চোখে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে মিতার। চোখে পানি চলে এসেছে।

–সাইন কর।

–করবো না।
কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বলে মিতা।

–দেখ, সময় নষ্ট করাইস না। সাইন কর।

–করবো না আমি।

–ঠাসসসসসসসস।

–ঠাসসসসসসসস।

একের পর এক থাপ্পড়ের কারণে মিতার নাক আর ঠোঁট দিয়ে র*ক্ত পড়া শুরু হয়েছে। তাও যেন মিতার ইচ্ছাশক্তিকে হার মানাতে পারছে না কেউ।

–সাইন করবো না, করবো না, করবো না।
জসিমের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে মিতা।

–খা*কি মাগ*, তোরে তো…
কথাটা বলেই চেয়ারে লাথি মারে জসিম।

–আহহহহহ….রিয়নননননন।
সাথে সাথে মাটিতে পড়ে যায় মিতা। পাকা করা ফ্লোরে পড়তেই মাথায় আঘাত পায় মিতা।

–সামনে থেকে সর।
বাকি দুজনের উদ্দেশ্যে বলে মাটিতে পড়ে থাকা মিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় জসিম।

মিতার মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই সে উপরে পৌঁছে যাবে। “এভাবেই যদি ম*রণ লিখা ছিলো তবে কেন মিতার জীবনে অরিয়নকে আনা হলো? কেন অরিয়নের কোলে মাথা রেখে ম*রার সুযোগ পেলো না মিতা?” কথাগুলো ভাবতেই যেন আরও বেশি কান্না পাচ্ছে মিতার। “রিয়ন নিশ্চয়ই এখন ভালো আছে। হাবিব চৌধুরী তার ছেলেকে অবশ্যই সেখানে ফেলে রাখবেন না। তুমি ভালো থেকে,রিয়ন।” বিরবির করে বলতে থাকে মিতা।

জসিম মিতার সামনে যাওয়া মাত্রই পৈশাচিক এক হাসি দেয়। মিতার চোখেমুখে ভয় ফুঁটে উঠেছে। তাতে কি? ম*রে গেলেও হাবিব চৌধুরীকে সফল হতে দিবে না মিতা।

–সাইন করবি?
জিজ্ঞেস করে জসিম।

মাথা নাড়িয়ে না বলে মিতা।

–আয়ায়ায়ায়ায়ায়া।
মিতার পেটে লা*থি মারে জসিম। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে মিতা।

–সাইন করবি?
আবারও লা*থি মারে।

–নায়ায়ায়ায়ায়ায়া। নায়ায়ায়ায়ায়া।

–সাইন করবি?

–রিয়নননননন…আমাকে বাঁচাও রিয়ন।
কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে মিতা।

–সাইন কর, সাইন কর সাইন কর।
একই সাথে অনেক গুলো লা*থি মা*রে মিতার পেটে।

কাশতে কাশতে মিতার মুখ দিয়ে র*ক্ত পড়া শুরু হয়েছে। অনেকটা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে মিতা।

–জসিম ভাই ছাড়েন। বেশি মা*রলে ম*ইরা যাবে।

–তুই দেখ, কি খারাপের খারাপ এই মাইয়া। এতো মা*ইর খাইয়াও সাইন করলো না।
বলে জসিম।

–কালকে আইসা আবারও একটু ট*র্চার করলে তখন ঠিকি করবো। একসাথে এতো মারলে বাঁচবো না।
বলে সাব্বির।

–বা*ল। বসরে কী বলমু?
বলে জসিম।

–বলবেন মা*রতে মা*রতে অজ্ঞান করে দিছেন তাও রাজি হয় না। দুই/একদিন আরও সময় দিতে।

–আচ্ছা চল।

মাটিতে পড়ে থাকা মিতাকে সেভাবেই ফেলে রেখে চলে যায় সবাই।

–রি…রিয়ন।
কথাটা বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মিতা। পড়ে থাকলো মাটিতে।

চলবে……