পারমিতা পর্ব-৯+১০

0
102

#পারমিতা
#পর্ব_৯
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

নিজের রুমে বসে আছে পারমিতা। ডাইনিং রুম থেকে অরিয়ন উঠে চলে যাওয়ার পর শায়লাকে দিয়ে খাবার পাঠালেও তা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে অরিয়ন। নিজের রুমে আসার সময় ও অরিয়নের রুমের দিকে তাকালে লাইট অফ করা দেখতে পেয়েছে মিতা।

“তোমাকে এভাবে দেখলে কেনো আমার এতো কষ্ট হয়?” নিজের মনে মনে ভাবে মিতা।

আধা ঘণ্টা ধরে বিছানায় শুয়ে থাকলেও মিতার চোখে যেন ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। এপাশ-ওপাশ হয়ে নড়েচড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ মিতা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়ায় বেলকনিতে। নভেম্বরের শেষের দিকে রাত হলেই হালকা হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে। শরীরে শীতের পরশ অনুভব করতেই পরণের ওড়না দিয়ে নিজেকে যতোটা সম্ভব ঢেকে রাখার চেষ্টা করে মিতা।

চারপাশ পুরো অন্ধকার। এতো রাতে সকলেই ঘুমাতে ব্যস্ত কিন্তু ঘুম নেই মিতার চোখে, শান্তি নেই মনে। “অরিয়ন ভাইয়ার ও কি একই রকম অস্থিরতা কাজ করে?” হুট করেই ভাবে মিতা। ইদানীং মিতার সব চিন্তা ভাবনা যেন অরিয়ন থেকে শুরু আর অরিয়নেই শেষ হচ্ছে। কতক্ষণ এই ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে ছিলো মিতা তা জানেনা শুধু জানে এই রাতের আকাশটা কিছুটা হলেও মনটা শান্ত করেছে মিতার।
রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ফিরলেই দেখতে পায় অরিয়ন নিজের বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার হওয়াতে আশেপাশে না তাকিয়ে সরাসরি তাকিয়ে আছে অরিয়ন। হঠাৎ করে অরিয়নকে দেখেই যেন বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো মিতার।

নিজের বাম হাত মুখের কাছে নিয়ে লাইটার ধরাতেই বুঝতে পারছে নিকোটিনের ধোঁয়ায় নিজের অস্থিরতা কাটাতেই এসেছে অরিয়ন। সি*গারেট ধরিয়ে টানতে থাকা অরিয়ন লক্ষ্য করেনি দূর থেকে কেউ একজন সব কিছু দেখে যাচ্ছে। বেলকনির রেলিংয়ে নিজের হাত দিয়ে নিচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অরিয়ন। কিছু একটা ভেবে আকাশের দিকে তাকায়।
অরিয়নের আকাশের দিকে তাকানো দেখে মিতার বুকের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে।

“কি ভাবছো তুমি?” আগ্রহ নিয়ে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু এগিয়ে যায় মিতা। কিছু একটা ভেবে অরিয়ন রুমে যেতে নিতেই মিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়।

এই শীতের রাতে অন্ধকারে কারো সাথে কারো চোখাচোখি হলো না কিন্তু একে অপরের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো মিতা তা জানেনা। শুধু জানে হুট করেই রুমে চলে যায় অরিয়ন।

************

২ মাস পর।

আফরিন চলে যাওয়াতে অরিয়ন না যতটা কঠোর হয়েছিলো তার থেকে বেশি কঠোর হয়ে গেলো যখন হাবিব চৌধুরী মিতাকে অরিয়নের স্ত্রী হিসেবে মানিয়ে নিতে বললো।
এই দু মাসে অরিয়ন বাড়িতে মাঝেমধ্যে এসে থেকেছে অন্যসব দিন নিজের ফার্মহাউসে কাটিয়েছে। মিতার সাথে দেখা হয়েছে হাতে গুনা ৪/৫ বার।

এই দুই মাসে কেনো মিতা অরিয়নের ঐ কঠোর আর গম্ভীর চেয়ারাটা দেখে প্রতিরাত কান্না করেছে তা মিতা জানেনা। শুধু জানে বিছানায় নিজের গা এলিয়ে দিতেই চোখের সামনে শুধু অরিয়নের সেদিন আকাশের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকাই ভেসে উঠে।

***************

গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন গম্ভীর চেহারার হাবিব চৌধুরী। কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েন।

–অরিয়ন কোথায়??
কাজের ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন হাবিব চৌধুরী।

–স্যার নিজের রুমে।
মাথা নিচু করে জবাব দেয় ছেলেটি।

আর অপেক্ষা না করে সরাসরি অরিয়নের রুমের দিকে চলে যায় হাবিব চৌধুরী।

নিজের রুমে বসে নতুন প্রোজেক্ট এর কাজ করছিলো অরিয়ন। বাড়িতে যাওয়া হয় না আজ ৮ দিন। ৮ দিন ধরে ফার্মহাউসে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দিচ্ছে অরিয়ন। যদিও আনিকা চৌধুরী প্রতিদিন আসেন আর আবরার মাঝে মধ্যে তবুও যেই উদ্দেশ্যে অরিয়নের এই ডিসিশন নেওয়া সেই কাজটা সফল হলেই হলো।

–অরিয়ন!!
হাবিব চৌধুরী রুমে ঢুকেই চেচিয়ে উঠে।

হঠাৎ করে নিজের বাবাকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না অরিয়ন।

–জি?
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে অরিয়ন।

–এসব কতদিন চলবে?
গম্ভীর কন্ঠে বলে হাবিব চৌধুরী।

–কিসব?
হাবিব চৌধুরীর কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে অরিয়ন।

–কিসব মানে? তোমার এভাবে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমি কোনো দায়িত্ব এড়িয়ে যাই নি।
অনায়াসে বলে ফেলে অরিয়ন।

–মিতা তোমার দায়িত্ব।
রাগ হয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।

–না…ও আমার দায়িত্ব না। ও তোমাদের দায়িত্ব যা তোমরা আমার উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছো।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।

–ও তোমার স্ত্রী, অরিয়ন।

–যাকে আমি বিয়ে করতে চাইনি বাবা।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।

–অরিয়ন!
হাবিব চৌধুরী ও রেগে গিয়ে চেচিয়ে বলে উঠে।

–কি বাবা? তুমি কি দেখছো না? আমার সাথে সাথে পরীকেও তুমি এসবে জড়িয়ে নিয়েছো? ও মাত্র ১৮ বছরে পা দিয়েছে বাবা। ওর এখন নিজের জীবন উপভোগ করার সময়, অকে কেউ ভালোবাসবে এমন কারো সাথে অর বিয়ে হওয়া উচিত ছিলো..
হাবিব চৌধুরীর সামনে এগিয়ে গিয়ে কথাগুলো বলে থেমে যায় অরিয়ন।

–কিন্তু তুমি অকে আমার মতো একজন ভাঙ্গা আয়নার সাথে জড়িয়ে দিয়েছো,যেখানে ও নিজের চেহারা দেখতে পারলেও আমার ভাঙ্গা দাগটা অর মুখে সারাটা জীবন লেগে থাকবে।
আবারও বলতে শুরু করে অরিয়ন।

–তুমি ভালোই জানো কেনো বিয়ে দিয়েছি তোমার সাথে।
একটু শান্ত কন্ঠে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।

–আমি জানি…আমি জানি। বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো হয়ে গেছে এখন যা করার করো। এসব থেকে আমাদের মুক্তি দেও।
অনুরোধের সুরে বলে অরিয়ন।

–সবকিছু এতো সহজ না অরিয়ন। আর মিতার কথা একবার ভাব…

–পরীর কথা ভেবেই বলছি..আমি অকে মেনে নিতে পারবো না। শি ইজ এ ফা*কং চাইল্ড বাবা।

–ও বাচ্চা না অরিয়ন, ওর মধ্যে আফরিন থেকেও অনেক বেশি ম্যাচুরিটি আছে। আর সব থেকে বড় কথা ও…ও তোকে..
কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় হাবিব চৌধুরী।

–ও আমাকে??
কি বলতে চাচ্ছে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–ও তোর জন্য সব কিছু করতে পারে।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমি জানি বাবা, তাই বলে আমি তার ফায়দা লুটে নিবো তা তুমি ভেবো না।
জানিয়ে দেয় অরিয়ন।

–আগামীকাল আমার বন্ধু মাহফুজ আহমেদ এর ছেলে নোয়ার বিয়ে। আমাদের সবাইকে যেতে হবে।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–হুম।

–যেহেতু সবাই জানে তুমি আর মিতা স্বামী-স্ত্রী তাই তোমাদের এক সাথে যেতে হবে।
হাবিব চৌধুরীর কথা শুনে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হাবিব চৌধুরী আবারও বলে উঠে।

–ওখানে আমার অনেক বন্ধু, বিজনেস পার্টনার সবাই থাকবে, তাই তোমার আসাটা জরুরি। আশা করছি নিজের বাবার মাথা নিচু করতে দিবে না তুমি।
কথাটা বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে যায় হাবিব চৌধুরী।

রাগন্ত অরিয়ন ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে। দু হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে বলে উঠে –

–পরী।

***************

–বিয়েতে তুমি যাবা??
আবরারকে জিজ্ঞেস করে মিতা।

আবরার বিয়েতে কী পরে যাবে তা ঠিক করছে আর মিতা রুমে রাখা চেয়ারে বসে একটার পর একটা কথা জিজ্ঞেস করছে।

–আমার ইচ্ছার দাম থাকলে আমি তো যেতাম না কিন্তু তাও যেতে হবে।
বলে আবরার।

–ঐ পাগলা তোমাকে আবার মারবে না তো?
কথাটা বলেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করে মিতা।

–হাসবি না একদম মিতা।
রাগ হয়ে বলে আবরার।

–আচ্ছা,হাহাহাহাহহাহাহাহাহ।
বলে আবারও হাসতে থাকে মিতা।

–গতবার অকে ছোট ভেবে কিছু বলিনি।
ভ্রু কুচকে বলে আবরার।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি সব।
হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে মিতা।

–তুই বসে আছিস কেনো? রেডি হয়ে নে যা। দেরি হলে মা কিন্তু রাগ করবে।

–তাই তো, আমি যাচ্ছি বাই।
বলেই তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে যায় মিতা।

*************

সবাই রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছে আনিকা চৌধুরীর জন্য। আবরার সাদা পাঞ্জাবি পরেছে, হাবিব চৌধুরী কালো রং এর স্যুট পরেছে। মিতা কপার কালারের শাড়ি আর তার ম্যাচিং জুয়েলারি পড়েছে। কিছুক্ষণ পরেই আনিকা চৌধুরী নিচে নেমে আসেন। পরণে তার কালো শাড়ি।

–চলো তাড়াতাড়ি।
বলে আবরার।

–দাঁড়া, অরিয়নকে আসতে দে।
বলে আনিকা চৌধুরী।

–ভাইয়া? ভাইয়া বাসায়??
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–হুম।
জবাব দেয় হাবিব চৌধুরী।

অরিয়নের নাম শুনেই যেন হুট করেই হার্টবিট বেড়ে গেলো মিতার। নিজের অজান্তেই খোলা চুলগুলো আর শাড়িটা ঠিক করে নিলো মিতা।

একটু পরেই রুম থেকে বেড়িয়ে আসে অরিয়ন। সিড়ি দিয়ে নামতে থাকা অরিয়নকে দেখে যেন কিছুক্ষণের জন্য সব থেমে গেলো মিতার জন্য। কালো পাঞ্জাবি পরা অরিয়নের চুলগুলো জেল দিয়ে পেছনে সেট করা। ডান হাতে ঘড়ি পড়া। এক হাত দিয়ে পাঞ্জাবির অন্য হাতা ঠিক করতে থাকা অরিয়নকে দেখে মনে হচ্ছে সৌন্দর্যের সবটাই যেন অরিয়নকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরক্ষণেই ঘোর কাটে মিতার।
“কি আজেবাজে ভাবছি ” মনে মনে ভাবে মিতা।

–চলো।
সবার সামনে এসে বলে অরিয়ন।

আনিকা চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী আগে আগে হাটা শুরু করলেই পেছনে মিতার কাধে হাত রেখে হাটা শুরু করে আবরার। আবরার আর মিতার পেছন পেছন হাটছে অরিয়ন।

–আমরা এটায় যাচ্ছি, পিছনের গাড়িতে তোরা আয়।
বলে হাবিব চৌধুরী।

–ওকে বাবা।
বলে আবরার।

–আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।
কথাটা বলেই গাড়ি আনতে আবরার চলে যায়।

মিতা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। আড় চোখে একটু পর পর অরিয়নকে দেখছে। অরিয়ন কিছুক্ষণ মিতার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভেবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

–অরিয়ন ভাইয়া?
আমতা আমতা করে বলে উঠে মিতা।

অরিয়ন কোনো জবাব না দিয়ে মিতার দিকে তাকায়। মিতাও অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।

–তুমি কি আবার ফার্মহাউসে চলে যাবে?
কি ভেবে কথাটা জিজ্ঞেস করলো তা মিতাও জানেনা। হয়তো কথা বলার একটা বাহানা খুজছিলো মিতা।

–জানিনা।
আনমনে বলে উঠে অরিয়ন।

–ওহ।
অরিয়নের কথায় একটু হতাশ হয়ে বলে মিতা।

–তাড়াতাড়ি আসো, দেরি হলে বাবা রাগ করবে।
গাড়ি নিয়ে এসে বলে আবরার।

আবরারের কথা শুনে গাড়ির দিকে হাটা শুরু করে মিতা।

–পরী!
পেছন থেকে ডাক দেয় অরিয়ন।

–জ্বি?
অরিয়নের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে মিতা।

–সুন্দর লাগছে।
বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে কোনো কথা বললো না মিতা। মিষ্টি এক হাসি ফুটে উঠে ঠোঁটের কোণে।
হাসিমুখেই আবরারের সাথে গিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে মিতা।

গন্তব্য নোয়া আহমেদ এর বিয়েবাড়ি।

চলবে….

#পারমিতা
#পর্ব_১০
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

সামনের সিটে আবরারের সাথে বসেছে মিতা। আবরার ড্রাইভিং করছে। পেছনে বসে মোবাইল টিপতে ব্যস্ত অরিয়ন। মাঝে মধ্যে কলে বিজনেস নিয়ে কথা বলছে। শীতের সন্ধাটা আরও মনোরম করতে গাড়িতে গান চালু করে আবরার।

All I dream of is your eyes

All I long for is your touch

And darling something tells me that’s enough, mmm

You can say that I’m a fool

And I don’t know very much

But I think they call this love.

গানের সাথে ধীরে ধীরে গলা মিলিয়ে মাঝে মধ্যেই আড় চোখে মিতার দিকে তাকাচ্ছে আবরার। মিতার দিকে তাকাতেই যেন মুখে বিশাল এক হাসি ফুটে উঠলো আবরারের। মিতা বাইরের দিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। গানটা বাজতেই নিজের অজান্তেই আড় চোখে রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকায় মিতা। পেছনে বসে থাকা অরিয়নকে মিররে দেখা যাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল মিতা। হুট করে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতেই মিতার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় অরিয়নের। নিমিষেই চোখ নামিয়ে বাইরের দিকে তাকায় মিতা।

“কি হচ্ছে এসব? এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে অরিয়ন ভাইয়াকে দেখার কি আছে?” মনে মনে ভাবে মিতা।

“অরিয়ন তোমার স্বামী, ভাইয়া বলা বন্ধ করো” হাবিব চৌধুরীর কথাটা হুট করেই মনে পড়ে যায় মিতার।

“অরিয়ন” ধীরে বলে উঠে মিতা। নামটা নিতেই কেমন এক অজানা অনুভূতি অনুভব করছে মিতা। “রিয়ন” নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আছে কথাটা।

–কি বললি??
মিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবরার।

আবরারের প্রশ্ন শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় মিতা। কি আজে বাজে ভাবছিলো এতোক্ষণ। তার উপর রিয়ন কোথা থেকে মাথায় আসলো কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু আবরারের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও কিছুই ভালো করে শুনতে পায়নি।

–বলছি আর কতক্ষণ লাগবে??

–এই তো ৫ মিনিট।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলে আবরার।

***************

মিতার ভুল হয়েছে। মিতা ভেবেছিলো হয়তো বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে কিন্তু না, বিয়েটা হচ্ছে রেডিসন ব্লুতে। পুরো হোটেল সাজানো হয়েছে। যদিও উচ্চবিত্ত পরিবারের হওয়ার কারণে এসব কিছু মিতা ছোটকাল থেকেই দেখে আসছে।

গাড়ি পার্ক করতেই আবরার, মিতা আর অরিয়ন গাড়ি থেকে নেমে আসে। অরিয়ন মিতার কাছাকাছি এসে মিতার হাত ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।

–ভাইয়া কি করছিস?
হঠাৎ করে অরিয়নের এমন পদক্ষেপ দেখে প্রশ্ন করে আবরার।

–সবাই জানে পছন্দ করে বিয়ে করেছি তাহলে দূরে দূরে থাকা মানায় না।
কথাটা বলেই মিতাকে টেনে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসে অরিয়ন।

অরিয়নের শরীরের সাথে মিতার শরীর স্পর্শ করতেই যেন একদম লাল হয়ে গেলো মিতা। এক নজরে কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে আবার কিছুক্ষণ অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকলো মিতা।

“এমন তো না আজ প্রথম হাত ধরেছো, তাও কেনো এমন লাগছে আজ? অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে কেনো আজ তোমার জন্য রিয়ন?”অরিয়নের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে মিতা।

আবরার পেছন পেছন হাটছে। বয়সের পার্থক্য যেন কিছুই লাগছে না মিতা আর অরিয়নের সামনে বরং সব কিছু সহজ আর সুন্দর লাগছে। কথাটা ভাবতেই যেন বুকটা জ্বলে উঠলো আবরারের। মিতা আর অরিয়নের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল আবরার।

” একদিন এই অভিনয় শেষ হবে,শুরু হবে আমাদের নতুন কাহিনি। যেই গল্পে তুই আমার আর আমি তোর” মিতার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে আবরার।

–আরিয়ান ভাইয়া, তাড়াতাড়ি আসো।
পেছনে তাকিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে মিতা।

আবরার ও একটা হাসি দিয়ে তাড়াতাড়ি হেটে গিয়ে মিতার সাথে হাটতে থাকে।

****************

–মা।
মায়া চৌধুরীকে দেখে অরিয়নের হাত ছেড়ে দৌড়ে তার কাছে চলে যায় মিতা।

–মিতা।
মিতাকে জড়িয়ে ধরে বলে মায়া চৌধুরী।

–কেমন আছো তুমি??
মায়ের দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে মিতা।

–আমি ভালো আছি, তুই কেমন আছিস? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
নিজের হাত দিয়ে মিতার গাল ধরে বলে মায়া চৌধুরী।

–না মা, কোনো সমস্যা নেই। আমি ভালো আছি। বাবা কোথায়??
হাবিব চৌধুরীকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে মিতা।

–তোর বাবা তোর মাহফুজ আংকেলের সাথে কথা বলছে।
জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

–অহ..তুমি ক..

–মায়া।
মিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই ডাক দেয় আনিকা চৌধুরী।

–আনিকা আপা। কেমন আছেন?
জিজ্ঞেস করে মায়া চৌধুরী।

–এইতো ভালো, তোমার কি অবস্থা??
প্রশ্ন করে আনিকা চৌধুরী।

–ভালো আপা।
জবাব দেয় মায়া চৌধুরী।

–এখানে আসো তোমাকে মিসেস সুলতানার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
মায়া চৌধুরীর হাত ধরে বলে আনিকা চৌধুরী।

–চলেন আপা।
কথাটা বলেই আনিকা চৌধুরীর সাথে চলে যায় মায়া চৌধুরী।

টেবিলে বসে আছে আবরার,মিতা আর অরিয়ন। সামনেই বউ আর বর বসা।

–আপুটাকে কি সুন্দর লাগছে দেখো!
আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

বউ মানে রুপা সিদ্দিকী সামনেই বসে আছে আকাশী রঙের এক লেহেঙ্গা পড়ে। ভারী কাজের লেহেঙ্গায় মাঝখানে পিংক কালারের ফুল করা। সাধারণত বিয়েতে এই কালারের লেহেঙ্গা কেউ পড়েনা। রুপার পড়ার কারণ একটু পরেই বুঝতে পারে মিতা। বর মানে নোয়ার চোখের কালারের সাথে ম্যাচ করে লেহেঙ্গা কিনেছে রুপা। “কতটা ভালোবাসা দুজনের মধ্যে ” কথাটা ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যায় মিতার।

–তুই দেখ, আমার দেখার ইচ্ছা নেই।
জবাব দেয় আবরার।

–হাহাহাহাহাহহাহাহায়াহহাহা।
শব্দ করে হাসতে থাকে মিতা।

–একদম হাসবি না প..
নামটা বলতে গিয়েও বললো না আবরার। অরিয়নের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় অরিয়ন অপেক্ষা করছে আবরারের কথা শেষ হওয়ার।

–মিতা।
কথা কমপ্লিট করে আবরার। অরিয়ন আবারও মোবাইল টিপতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

–নোয়া ভাইয়া না তোমাকে পিটাইছিলো? হাহাহাহাহ…কারণ টা কি আরিয়ান ভাইয়া?
হাসতে হাসতে বলে মিতা।

–চুপ থাক একদম, না হয় এখন তোকে আমি পিটাবো।
গম্ভীর হয়ে বলে আবরার।

–দেখো না, বয়সের পার্থক্য এদের ভালোবাসায় বাধা হতে পারেনি।
রুপা আর নোয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে মিতা।

কথাটা বলতেই অরিয়ন মিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। মিতার চেহারা দেখে কিছু বুঝার চেষ্টা করছে।

স্টেজে বসে থাকা নোয়া রুপাকে রেখে ধীরে ধীরে হেটে আসে অরিয়নের টেবিলের দিকে।

–কি অবস্থা অরিয়ন ভাইয়া? ভালো আছেন?
অরিয়নের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে নোয়া।

–এইতো ভালো, তুই কেমন আছিস নোয়া??
নোয়ার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে অরিয়ন।

সামনে আবরার থাকলেও আবরারকে ইগনোর করে অরিয়নের কাছে গিয়ে কথা বলছে দেখে মিতা মিটমিট করে হাসতে থাকে আবরারের দিকে তাকিয়ে। আবরার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে মিতার দিকে।

–আজ ভাইয়া স্পেশাল দিনে লাইভ গানের ব্যবস্থা করেছে বাবা, আপনি কিন্তু গান শুনাবেন প্লিজ ভাইয়া।
অরিয়নকে রিকোয়েস্ট করে বলে অরিয়ন।

–আমি কিভাবে? এতো শিল্পী এনেছিস ওদের দিয়ে গাওয়া। আমি অন্যদিন গাইবো।
বলে অরিয়ন।

–না ভাইয়া, আপনার গান শোনাতেই হবে। আপনি য..
কথাটা বলতে যেয়েও থেমে যায় নোয়া।

স্টেজে বসে থাকা রুপার লেহেঙ্গা আর মেকআপ ঠিক করতে একজন মহিলার পাশাপাশি পুরুষ ও উঠেছে যে কিনা রুপার মুখের মেকআপ ঠিক করে দিচ্ছে। সেদিকে চোখ যেতেই কথা বন্ধ করে দেয় নোয়া।

–তুমি থাকো, আগে এই ফাক*র এর হাত ভেঙ্গে দিয়ে আসি আমি।
কথাটা বলেই এক মিনিট ও অপেক্ষা না করে চলে যায় নোয়া।

–পুরাই পাগল তাই না?
নোয়ার দিকে তাকিয়ে বলে মিতা।

–ভালোবাসায় মানুষ পাগলামি করে।
মিতার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় আবরার।

–অরিয়ন ভাইয়াকে তো কখনো এমন করতে দেখিনি।
হঠাৎ করেই বলে উঠে মিতা।

কথাটা বলতেই যেন ঘোর কাটলো মিতার। কথাটা মুখ ফোসকে বের হয়ে গেছে।

–সব ভালোবাসা এক রকম হবে তার কোনো কথা নেই।
জবাব দেয় অরিয়ন।

–আর এসবে মন না দিয়ে পড়ালেখায় মন দে।
আবারও বলে উঠে অরিয়ন।

–হুম।
সায় মিলায় মিতা।

*************

“কেনো যে শাড়ি পরেছিলাম” ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে মিতা। শাড়ির কুচি নিয়ে এক ঝামেলায় পড়েছে মিতা। এই পর্যন্ত কতবার উস্টা খেয়ে পরতে গিয়েও বেঁচেছে তার ঠিক নেই। এখন তো শাড়ি প্রায় খুলেই যাচ্ছে তাই শাড়ি ঠিক করতেই ওয়াশরুমে ঢুকেছে মিতা। শাড়ির কুচি ঠিক করে ওয়াশরুমে ঢুকে মিতা।

ফ্রেশ হয়ে একটু পরে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েকে দেখে চমকে যায় মিতা। মেয়েটা মিতাদের কলেজেই পড়ে। যেখানে মিতা সাইন্সের স্টুডেন্ট সেখানে মেয়েটা ব্যবসা শিক্ষার স্টুডেন্ট। কিন্তু যা মিতাকে চমকিয়ে দেয় তা মেয়েটা না। তা হলো মেয়েটা আয়নার সামনে নিজের জামার গলা ধরে অনেকটা নিচে নামিয়ে বুকের উপর থাকা কিছু একটা চেক করছে। মিতা হঠাৎ করে ওয়াশরুম থেকে বের হওয়াতেই মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যার কারণে জামাটা ঠিক করার ও সময় পায়নি।

ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে মিতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেয়েটার বুকের ডানপাশে স্পষ্টভাবে লেখা “সাদমান”। এমন না সেটা ট্যাটু করা। মনে হচ্ছে কেউ আঘাত করার উদ্দেশ্য ধারালো কিছু দিয়ে জোর করে লিখেছে নামটা।

–আর ইউ অলরাইট??
দু পা এগিয়ে গিয়ে বলে মিতা।

–ইয়েস।
কথাটা বলেই জামার গলা ঠিক করে মেয়েটা নিমিষেই বের যায় ওয়াশরুম থেকে।

–কি ভয়ানক।
কথাটা বলে নিজের হাত ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিতা।

*************

যারা যারা গান পারে তারা তারা শিল্পীদের গান শেষ হলেই গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন যে গান গাইছে তার গান গাওয়া শেষ হলেই অরিয়ন যাবে গান গাইতে।
নোয়ার রিকোয়েস্ট ফেলতে পারেনি অরিয়ন। এতো বছরের পরিচয়।

মিতার সাথে বসেছে মায়া চৌধুরী। মায়া চৌধুরীর পাশে আনিকা চৌধুরী ও হাবিব চৌধুরী বসেছে। হাবিব চৌধুরীর পাশে ওয়াহিদ চৌধুরী বসেছে। আবরার আর অরিয়ন বসেছে একসাথে।

–অল দা বেস্ট অরিয়ন ভাইয়া।
বলে মিতা।

–অল দা বেস্ট ভাইয়া।
বলে আবরার।

একটা হাসি দিয়ে স্টেজে উঠে মাইক নিয়ে বসে অরিয়ন। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুলে গাইতে শুরু করে।

Chehra jaise tasavur bhi tasveer bhi

Chehra ik khwab bhi chehra tabeer bhi

Chehra koi aliflailvi dastaan

Chehra ik pal yakeen chehra ik pal gumah

Chehra jaisa ke chehra kahin bhi nahi..

Mahrooh mahrooh mehjabin mehjabin

Husn-e-jaana ki tareef mumkin nahi

Husn-e-jaana ki tareef mumkin nahi

Afreen afreen afreen afreen

Tu bhi dekhe agar toh kahe humnashin

Afreen afreen afreen afreen

Usne jaana ki tareef mumkin nahi…

সামনে বসে থাকা অরিয়নের চেহারার ফুটে উঠেছে ডেস্পারেশন আফরিনের জন্য। এতোক্ষণ হাসতে থাকা মিতা গানটা শুনতেই যেন বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলো। অরিয়নের মুখ থেকে আফরিনের নামটা যেন ছু/রির মতো বের হয়ে সরাসরি মিতার বুকের মধ্যে গিয়ে আঘাত করছে। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা মিতার চোখ দিয়ে পানি পড়তেই নিজের হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করে মিতা। নিজের হাতে পানি দেখতেই তাকিয়ে থাকে অরিয়নের দিকে।

মায়া চৌধুরী ঠিকি লক্ষ্য করছে কীভাবে তার মেয়ের এক্সপ্রেশন ক্ষণিকের মধ্যেই চেঞ্জ হয়ে গেলো। নিজের হাত মিতার কাধে রেখে মিতাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে মায়া চৌধুরী।

–এসব কি শুরু করেছে তোমার ছেলে??
রাগ হয়ে আনিকা চৌধুরীকে বলে হাবিব চৌধুরী।

–যা কখনো শেষ হয়নি তা। এই দু দিনের আসা মেয়েকে পেয়ে অরিয়ন আফরিনকে ভুলে যাবে সেটা ভাবা তোমার পাগলামি হাবিব।
বলে আনিকা চৌধুরী।

–মুখ সামলে কথা বলো আনিকা। মিতা আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে হাবিব চৌধুরী।

–যেই মেয়ে নিজের মা বাপ কে খেয়েছে..যে মেয়ে আ…

–একদম চুপ আনিকা, একদম চুপ।
গম্ভীর হয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।

–আমাকে চুপ করিয়ে লাভ হবেনা হাবিব। এই মেয়েকে আমি আমার পরিবারের ত্রিসীমানায় থাকতে দিবো না।
কথাটা বলেই উঠে চলে যায় আনিকা চৌধুরী।

পাশে বসে থাকা মায়া চৌধুরী সব শুনলেও সিন ক্রিয়েট করতে চাইলেইন না বলেই চুপ করে রইলেন। মিতা সেই গান শুরুর থেকে অরিয়নের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরিয়নের নজর ও যেন অন্য কোথাও যাচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতার দিকে। মুখে ফুটে উঠেছে রাগের বহিঃপ্রকাশ।

❝অরিয়ন ভাইয়াকে তুমি কেনো ভালোবাসো আপু?❞
আফরিনকে প্রশ্ন করে মিতা।

❝আফনান এমন একজন মানুষ যাকে কেউ ভালো না বেসে থাকতেই পারবে না।❞
মিতার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে আফরিন।

“আপু, তোমার আফনানকে যে আমিও ভালোবেসে ফেলেছি”

চলবে….