#পারলে_ঠেকাও
#পর্বঃ২৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি
অক্ষর হাসপাতালে বেরিয়ে যাওয়ার পরই মধুজা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আজ অক্ষরকে নিজের ভালোবাসার কথা জানাবে মধুজা। সেই কারণেই আজ তার শ্বাস ফেলারও সময় নেই। সকালে উঠে রান্নাঘরে চলে এসেছে। অক্ষরের পছন্দের সব খাবারের নাম শুনেছে সে মমতা চৌধুরীর থেকে। সকাল থেকেই রান্নাঘরে পড়ে আছে। এক এক করে সব রান্না করে। অক্ষর ডাক্তার তাই তার খাবারও সেইরকম। অক্ষরের পছন্দের খাবারের মধ্যে আছে শাকসবজি। চর্বিজাতীয় খাবার একেবারেই পছন্দ করে না। মধুজা অক্ষরের জন্য সেভাবেই সবকিছু রান্না করে। যদিও রান্নাবান্নায় সেরকম অভিজ্ঞতা তার নেই। মমতা চৌধুরীর সাহায্য নিয়েই সব রান্না করে সে। রান্নাবান্নার কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ে নিজের কাজে। আজ সেরকম কোন কাজ তার নেই। শুধু ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে একটু পার্ক, চিড়িয়াখানায় ঘুরে বেড়িয়ে কাপলদের ইন্টারভিউ নিতে হবে। আর সেই নিউজগুলো সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
লাবিব এই ক’দিনে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। আজ থেকে কাজে যুক্ত হয়েছে। মধুজা তাই আজ লাবিবকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বিভিন্ন পার্কে ঘুরে অনেক কাপলের সাথে কথা বলে তারা। এরমাঝে একজন কাপলকে দেখে লাবিব বেশ অবাক হয়। পার্কের ব্রেঞ্চে বসে আছে সত্তোরোর্ধ এক যুগল। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। এই বয়সে একে অপরের হাত ধরে পার্কে বসে আছে।
লাবিবের কৌতুহল জন্মায়। সে মধুজাকে এই ব্যাপারে বলে। মধুজাও বেশ আগ্রহ নিয়ে তাদের সামনে যায়। গিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করে,
‘আপনাদের একসাথে খুব সুন্দর লাগছে। আমরা কি আপনাদের ইন্টারভিউ নিতে পারি?’
‘হ্যা নাও।’
‘আপনাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।’
বৃদ্ধা বলতে শুরু করে,
‘এই পার্কের সাথে আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। এখানে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের প্রথম দেখা হয়। আমার উনি প্রথম দেখাতেই আমার প্রেমে পড়ে যান। আমাদের সময় তো আর এখনকার মতো এতো ফোন, কম্পিউটার এসব ছিল না। তাই উনি আমাকে চিঠি লেখেন। চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে আমাদের প্রেম। এভাবে প্রেম থেকে পরিণয়। আজ সুদীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে আমাদের সংসার। বয়স হয়েছে ঠিক, তবে ভালোবাসা বদলায় নি।’
বৃদ্ধ বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় মধুজা। এগুলোই হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা। তাই তো এই বয়সে এসেও তারা একে অপরের হাত ধরে কত সুন্দরভাবে আছে তারা। অথচ আজকাল ভালোবাসা যেন লোক দেখানো বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন জিনিস গিফট দেওয়া, রিং দিয়ে প্রপোজ করা এসব দিয়ে কি সত্যিই ভালোবাসা পরিমাপ করা যায়?
মধুজা উত্তর পেয়ে গেল। বৃদ্ধ বৃদ্ধার থেকে বিদায় নিল। একটু সামনে এসে গোলাপ বিক্রেতাকে দেখে দুটো গোলাপ কিনে নেয়। লাবিবকে বিদায় দিয়ে রওনা দেয় অক্ষরের হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে।
৪৭.
মধুজা বাড়িতে ফিরে অক্ষরের অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় অক্ষরের আগমনের মধ্য দিয়ে। অক্ষর রুমে আসতেই মধুজা দৌড়ে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে। মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
‘ভালোবাসি আপনাকে পাগলা ডাক্তার। আপনাকে ভালোবাসা থেকে নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারিনি আমি। পারলে আপনি ঠেকিয়ে দেখান এখন। কারণ আমিও এখন আপনারই মতো নিয়ন্ত্রণহীন কাজ করতে যাচ্ছি।’
কথাটা বলেই অক্ষরের ওষ্ঠদ্বয় নিজের আয়ত্তে করে নেয় মধুজা। অক্ষরের চোখমুখে অবাক ভাব বয়ে যায়। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা কি হচ্ছে। মধুজা একটু দূরে সরে এসে গোলাপ ফুল হাতে অক্ষরের সামনে হাটু গেড়ে বসে বলে,
‘আই লাভ ইউ পাগলা ডাক্তার।’
‘কি বললে বুঝতে পারিনি। যা বলার স্পষ্ট বাংলায় বলো।’
‘আমি আপনাকে ঘৃণা করি। খুব খুব ঘৃণা করি। আপনি একটা খারাপ মানুষ। আই হেইট ইউ।’
অভিমানী সুরে কথাগুলো বলে ‘চল আসতে নেয় মধুজা। অক্ষর পেছন থেকে মধুজার হাত টেনে ধরে। মধুজাকে একপলকে নিজের কোলে তুলে নেয়।
‘আমাকে ঘৃণা করার কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না হানি। তোমার চোখে নিজের জন্য শুধু অফুরন্ত ভালোবাসাই আমার চোখে পড়ছে।’
‘জানেন যখন তাহলে আলাদা করে বলব কেন?’
‘আমার তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। তোমার মুখে ভালোবাসার কত শোনার জন্য আমি যে কতদিন থেকে তৃষ্ণাতুর ছিলাম। জানো তুমি যখন প্রথম আমাদের বিয়ে ঠিক হয় তখন আমি তোমাকে নিয়ে এত কিছু ভাবিনি। বিয়ে করার খুব একটা ইচ্ছাও ছিলনা।’
‘তাহলে বিয়ে করলেন কেন?’
‘বিয়ের দিন যখন জানলাম তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাওনা তখন রাগ,জেদ এগুলো আমায় বশ করে নিল। ছোট থেকেই প্রত্যাখ্যান আমি মেনে নিতে পারি না৷ আর তাই,,’
পুরো কথা শেষ করল না অক্ষর। মধুজার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তারপর বলল,
‘তোমাকে বিয়ের দিন আমি ভালো ভাবে দেখি। বিয়ের আগে যখন দেখতে এসেছিলাম সেদিন একপ্রকার জেদ থেকেই তোমার দিকে তাকাই নি। বিয়ের দিন তোমার মায়াবী মুখ দেখে আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি। তখন থেকে তুমি আমার হৃদয়ের রাণী।’
মধুজার ফর্সা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। অক্ষর তার প্রশংসা করছে এটা ভেবেও ভালো লাগছে। এদিকে অক্ষর উদগ্রীব হয়ে যাচ্ছে মধুজাকে গভীরভাবে স্পর্শ করার জন্য।
আজ মধুজা ও অক্ষরের মধ্যে আর কোন বাধা রইল না। দুজনে নিজের মনের কথা প্রকাশ করে দিয়েছে। একে অপরকে গভীরভাবে অনুভব করতে প্রস্তুত তারা। অক্ষর প্রথমে ঘরের লাইট বন্ধ করে দিয়ে আসল। নিজের শার্টের বোতাম খুলল। মধুজা একটু তটস্থ ছিল তাই তাকে স্বাভাবিক করতে কপালে বসিয়ে দিল ভালোবাসার স্পর্শ। ধীরে ধীরে এরে অপরের কাছে আসে তারা। ঘটে যায় তাদের দুজনের প্রথম মিলন।
৪৮.
আরহা ঘড়িতে সময় দেখছে। রাত ৮ টা বাজে। আজ একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল বিকেল ৪ টায়। সেই থেকে বসে থাকতে থাকতে ইন্টারভিউ শুরু হলো সন্ধ্যা ৭ টায়। যার কারণে তার আজ এত দেরি হয়ে গেল। আরহার নিজের উপর পরিহাস হচ্ছে। আজ ভালোবাসা দিবসে যেখানে তার অধিকাংশ বন্ধু বান্ধব স্বামী অথবা বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেখানে আরহা ছুটছে চাকরির পেছনে।
আরহা বিড়বিড় করে বলছিল,
‘একমাত্র মধুজাই গতবছর পর্যন্ত সিঙ্গেল ছিল। এখন তো সেও মিঙ্গেল হয়ে গেছে। আমারই ভাগ্য খারাপ। না হচ্ছে প্রেম, না হচ্ছে বিয়ে। সারাদিন শুধু চাকরির পেছনে ছোটাছুটি।’
আচমকা একটি বাইক এসে আরহার সামনে থামে। আরহা ভ্রু কুচকে তাকায়। বাইক চালক হেলমেট খুলতেই আরহার চোখে খুশির ঝলক দেখা যায়। কারণ সে বর্ণ। বর্ণ আরহাকে দেখেই গাড়ি থামিয়েছে। জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি এতরাতে এখানে দাড়িয়ে কি করছেন?’
‘আপনার আমাকে মনে আছে?’
‘আমার স্মৃতিশক্তি এত দূর্বল নয় যে ভুলে যাব। তাছাড়া আপনাকে তো ভোলা যায়না। এত বড় মেয়ে হয়েও রাস্তায় ছোট বাচ্চাদের মতো হাটাচলা করেন। তো এত রাতে এখানে কি করছেন?’
আরহা বলল,
‘কি করব বলুন। সিঙ্গেল লাইফ মানেই জ্বা’লা। মানুষ ১৪ই ফেব্রুয়ারী পার্কে, রেস্টুরেন্টে আর সিনেমা হলে যায় এদিকে আমায় দেখুন অফিসে অফিসে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। জীবনটাই তেজপাতা হয়ে গেছে।’
‘ওহ বুঝলাম। আপনার বাড়ি কোথায় বলুন আমি পৌছে দেব। আপনি যেভাবে রাস্তায় চলাচল করেন আপনার এভাবে এখানে থাকা ঠিক হবে না।’
‘নো থ্যাংকস৷ আরহা কারো সাহায্য নেয়না। আমি নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারি।’
‘এজ ইউ ইউশ।’
বলেই বর্ণ বাইক স্টার্ট দেয়। বর্ণ একটু দূরে যেতেই আরহা কপাল চাপড়াতে থাকে।
‘ধুর। এত বেশি বাড়াবাড়ি করার কি দরকার ছিল আরহা? আম্মু ঠিকই বলে তুই একটা গাধী। একটু বেশিই বুঝিস সবকিছু। বেশি ভাব দেখাইতে গিয়ে এত ভালো একটা সুযোগ মিস করে ফেললাম ধুর।’
আচমকা বর্ণ বাইক ঘুরিয়ে আবার আরহার সামনে আসে। বলে,
‘দ্বিতীয় এবং শেষ সুযোগ। উঠলে উঠুন না উঠলে থাকুন।’
দ্বিতীয় সুযোগ আর হারালো না আরহা। চট করে উঠে পড়ল বর্ণর বাইকে। বর্ণ বাইক স্টার্ট দিলো। আরহাকে বললো তাকে ধরে বসতে। আরহাও বর্ণকে শক্ত করে ধরে বসল। ভালোবাসার দিনে কি তাহলে এখান থেকেই সূচনা হলো নতুন একটি ভালোবাসার গল্প?
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨