পালাবদল
পর্ব ১
©️ Monkemoner dakbakso – আনিন্দিতা
দ্যাখো সুবর্ণা তোমার সঙ্গে সংসার করাটা আর সম্ভব হচ্ছে না| মিউচ্যুয়াল সেপারেশনে রাজি হলে ভাল নইলে লামিয়ার সঙ্গে লিভ টুগেদার করব| কোর্টে কেস ঝুলে থাকে থাকুক! আই ডোন্ট কেয়ার| ভালই বুঝতে পারছ তোমার প্রতি আর কোন ফিলিংস আমার অবশিষ্ট নেই, তাও কেন এই বাড়িতে পরে আছ বুঝতে পারছি না!
দ্যাখো রাত হয়েছে, ভুটকুনকে গল্প বলে খাওয়াতে হবে, রাতের খাবার গরম করা বাকি, তার মধ্যে এসব উল্টোপাল্টা কথা ভাল লাগছে না| কেন শুধু শুধু ইয়ার্কি কর বলতে পার? আমি কিন্তু আর সেই বোকা সুবুটি নেই, ফ্যাকাশে হেসে বলে ওঠে সুবর্ণা, সর তো বাপু, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার| আসন্ন ঝড়ের আভাস পেয়েও হাসির আড়ালে তা ঠেকাতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে| খরগোস যেমন গর্তের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থেকে ভাবে তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না অথচ ঠিক সময় শিয়াল এসে খ্যাঁক করে ঘাড় ধরে বাসায় নিয়ে যায়, সুবর্ণার হয়েছে এখন ঠিক সেই অবস্থা|
রাতের খাবার খেয়ে এসেছি| তুমি চাইলে ভুটকুনের যাবতীয় খরচ দিয়ে দেব| সেই সঙ্গে তোমার হাতখরচও| হাত জোড় করে বলছি, আমার জীবন থেকে বিদায় নাও তুমি, দয়া করে মুক্তি দাও আমায়| মুখে একরাশ বিরক্তি মাখিয়ে বলে ওঠে অর্ণব|
ঘরে ঘুমোচ্ছিল ভুটকুন| বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে সে দৌড়ে আসে| হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় বাবার কোলে ওঠার তাগিদে, কোতে দাও| বিরক্ত মুখে অর্ণব পা দিয়ে ছেলেকে ঠেলে দেয়| মাটিতে পড়ে কঁকিয়ে ওঠে ছোট্ট শিশু, তুলি খুম পতা, এলকুও আদল কলো না| অর্ণব রেগেই ছিল, ছোট্ট গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেয়, ব্যথা পেয়ে কাঁদতে থাকে ভুটকুন|
আর সহ্য করতে পারে না সুবর্ণা| মেঝ থেকে ভুটকুনকে কোলে তুলে বলে কালই চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে| থাকো তুমি নিজের মতো| আজ এই বলে যাচ্ছি, একদিন বুঝবে কি ভীষণ ভুল করেছিলে, কিন্তু সেইদিন হাজার কাঁদলেও না তোমার ছেলের অধিকার পাবে, না পাবে আমাকে ভালোবাসার অধিকার|
দরকার নেই, তোমার অমন ভালোবাসার আমার দরকার নেই| আমার জীবন জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে গেল| কি ভালোবেসেছিলাম না বুঝে, কিছুই পেলাম না| সারাজীবন বোঝা টানতে টানতে শেষ হয়ে গেলাম| কাল অফিস থেকে ফিরে যেন এ বাড়িতে আর তোমার মুখ না দেখতে হয়| সজোরে দরজা টেনে চটি পরে বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ণব| থম মেরে বসে থাকে সুবর্ণা| অত জোর শব্দ শুনে কেঁদে ওঠে ভুটকুন|
চোখের জলে ভেসে যায় বুক| বাবার বাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তো মিলবে কিন্তু খাওয়া? ভুটকুনের পড়াশোনার খরচ? একটা ছোট ছেলের খরচ তো কম নয়| বাবার পেনশনের টাকায় মা-বাবা দুজনের খাওয়া দাওয়া, ওষুধটুকুই ঠিকমতো কুলিয়ে ওঠে না|মাঝেমধ্যেই যেটুকু পারে অর্ণবকে লুকিয়ে সাহায্য করে সুবর্ণা| কিন্তু এবার? সব তো শেষ হয়ে গেল! তাকে কে সাহায্য করবে? কে পাশে দাঁড়াবে এইসময়? মা বাবার খেয়াল সেই বা রাখবে কোত্থেকে! ভুটকুনের ভবিষ্যতেরই বা কি হবে? ছেলের ভবিষ্যতের ভাবনা আজ থেকে তাকেই ভাবতে হবে| শেষপর্যন্ত ভবিষ্যত নষ্টের জন্য ভুটকুন তাকেই দায়ী করবে না তো?
বাবার হাতে যে মার খেয়েছে সে কথা কখন ভুলে গেছে ভুটকুন| মায়ের কোলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট ছেলেটা, আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আলমারি খুলে নিজের অল্প কয়েকটা গয়নাগাঁটি, পড়াশোনার যাবতীয় সার্টিফিকেট গুছিয়ে নিল সে| শ্বশুরবাড়ির দেওয়া গয়না থাকল আলমারির লকারেই| সুবর্ণা আজ দৃঢ়, যা সে সেদিন নিয়ে আসে নি তা সে আজ নিয়েও যাবে না| যাবে শুধু ভুটকুন, তার রক্ত, তার আত্মজ|
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে অর্ণব দেখল ঘর ফাঁকা| শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে| শেষপর্যন্ত তাহলে সুবর্ণা বিদায় হল? ভাবতেও পারে নি সে এত সহজে কাজ উদ্ধার হবে! খুশিমনে ডিনার অর্ডার করে লামিয়াকে ফোন করল, বাড়ি ফাঁকা, চলে এসো| আর কেউ ঝামেলা করতে আসবে না|
বিকেল বিকেল ভুটকুনকে নিয়ে বাপের বাড়ি পৌঁছাল সুবর্ণা| বড় ট্রলি হাতে সুবর্ণার সঙ্গে ছোট্ট ভুটকুনকে দেখে বিজয়া দেবীর মুখ শুকিয়ে গেল| তুই এখন কি ব্যাপার রে? ট্রলি নিয়ে এসেছিস দেখছি? কদিন থাকবি নাকি?
আজ থেকে এখানেই থাকব, মা| অর্ণব আর চায় না আমরা ওর সঙ্গে থাকি| জোর করে সম্পর্কটা আর টেনে নিয়ে যেতে পারলাম না| কম তো চেষ্টা করি নি টিকে থাকতে| খামোখা জোর করে কতদিনই বা সম্পর্ক টানা যায়?
কিছু মনে করিস না মা, তুই তো জানিস আমাদের দুজনেরই ঠিকমতো পেট চলে না, তারপর তুই আছিস, ভুটকুন আছে| একটা বাচ্চার খরচ কত তুই তো জানিস| পুষ্টিকর দামী খাবার দাবার, জিনিসপত্র| আমায় ভুল বুঝিস না মা, আমি বলি কি তুই স্বামীর সংসারে ফিরে যা| একটু মানিয়ে গুছিয়ে থাকার চেষ্টা কর| জন্মদাতা পিতা কি ছেলেকে অস্বীকার করতে পারে? কয়েকটা দিন থাক| তারপর না হয় ভেবেচিন্তে, তেমন হলে তোর বাবা জামাইকে ফোন করবে|
সেই চেষ্টাই তো এতদিন করলাম মা| মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা| ভাসতেই হয় যদি তাহলে আর অপেক্ষা কেন? আজ থেকেই না হয় ভাসার চেষ্টা করে দেখি| চল ভুটকুন, দেখি কোথায় আমাদের মায়ে-পোয়ের জায়গা মেলে|
ভেতরে আয় এখুনি| আমি ঘর থেকে সব কথা শুনেছি| কি হবে না হবে ভবিষ্যতে দেখা যাবে, গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন সুবর্ণার বাবা, সুবীর বাবু| কিছু একটা নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হবে|
( ক্রমশ )