#পালাবদল
#পর্ব_৩
দামী ধাতুর নামী গয়নার বিপণীর কথা বলছি না, আজকাল অনেক নতুন ধরণের ফিউশন গয়না বেরিয়েছে| যেমন কাঠ, স্টোন, কাপড়ের সঙ্গে রূপো, পেতল বা অন্য ধাতুর মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে গয়না| মেয়েরা ভালোবেসে আপনও করে নিচ্ছে| বোকারা, বিডসের গয়না এই সময় দাঁড়িয়ে কতটা পপুলার জানিস নিশ্চয়ই|কিছু গয়নায় যেমন এথেনিক টাচ থাকছে তেমনি বেশ কিছু গয়না তৈরি হচ্ছে মডার্ন লুক ক্যারি করার জন্য| মানে চাইলে তুই ভাইব্রান্ট শাড়ীর সঙ্গেও ক্যারি করতে পারিস আবার চাইলে আঁতেল আই মিন ইন্টেলেকচুয়াল লুকের সঙ্গেও ফাটাফাটি| কিছু মেয়েরা নিয়মিত এগুলো কেনে, তাদের পার্সোনালিটির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য| আমি মূলত এই বাজারটাই ধরতে চাইছি|
একটু অবাক হল সুবর্ণা, তুই তো স্কুলে টমবয় ছিলিস| ফুটবল খেলতিস, মেয়েদের গয়না, সাজসজ্জার বিষয় এতকিছু জানলি কোত্থেকে! পড়াশোনা ছাড়া কোনদিকে কখনো তাকাতে পর্যন্ত দেখিনি| খেলাধুলা বলতে ওই যা ফুটবল| যে কানে জীবনে রিং পর্যন্ত পরে নি, সে কিনা এথনিক, ইন্টেলেকচুয়াল লুক, ডিজাইনার আউটফিট, জাঙ্ক জুয়েলারি, স্টাইলিং, ডিজাইনিং নিয়ে কথা বলছে| আমি তো জাস্ট ভাবতেই পারছি না…
কাজ করতে গেলে কাজটাকে ভালোবাসতে হয় ম্যাডাম| কাজ করতে গিয়ে কাজটাকে ভালোবেসে ফেলেছি| করবি কাজ আমার সঙ্গে?
তোর সঙ্গে? কাজ? কি কাজ? হঠাৎ সুবর্ণার মনে হতে থাকে আজ নম্রতার সঙ্গে দেখা হওয়াটা হয়ত ঈশ্বরের দেওয়া সংকেত| বেশ কিছুদিন ধরেই কাজ খুঁজছিল সে, কিন্তু সামান্য একটা গ্ৰাজুয়েট ডিগ্ৰীতে কাজ মেলে না| হাজারো প্রশ্ন করে তারপর শুধুই নিরাশা| হতাশায় তলিয়ে যাওয়া সুবর্ণার কাছে নম্রতা যেন একা আশার আলো| সেই আলোই হয়ত ফিরিয়ে দেবে পায়ের নীচের হারানো মাটি| অর্থের অভাবে এতদিন তাকে যে কষ্ট সহ্য করে আসতে হয়েছে তার অবসান ঘটবে এবার| এই বাড়িতে এসে ওঠার জন্য মা যে সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকে তার ওপর, হয়ত এবার তার অবসান ঘটবে| বাবার জন্যও কিছু করতে পারবে সে| ভুটকুনকে দিতে পারবে পছন্দমতো খাবার, নতুন আশায় বুক বাঁধে সুবর্ণা|
আমায় একটা বুটিক আছে| ‘ নকশীকাঁথা ‘, বিভিন্ন প্রাদেশিক শাড়ির সংগ্ৰহ আমার বুটিকের ইউএসপি| কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম একটা নতুন সেগমেন্ট খুলব| কিন্তু ঠিকঠাক লোক পাচ্ছিলাম না| আমার বুটিক ঢাকুরিয়ায়, একদম প্রাইম লোকেশনে, কাস্টমার বেসও ভাল| দেখছি সম্প্রতি কাস্টমাররা শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং গয়না চাইছে, একই ছাদের নীচে| আসলে এদের টাকার তো কোন অভাব নেই! তুই চাইলে আমার বুটিকের গয়নার ডিজাইন দেখতে পারিস| কিন্তু একটা শর্ত আছে, যদি মানিস কাল থেকে কাজে আসতে পারিস|
সুবর্ণার মনে হল আশার ঝলকে মনের মাঝে যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠছিল তা যে কেউ এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিল| হঠাৎই নম্রতার হাতটা ধরে ফেলল সে, একটা কাজের বড্ড দরকার আমার| বল, তোর কি শর্ত?
ডিজাইন করবি তুই, কিন্তু নাম যাবে আমার, লোকে জানবে ‘ নকশীকাঁথা ‘ বুটিকের গয়নাগুলো নম্রতার ক্রিয়েশন| টাকাপয়সা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না, যা পাবি তাতে তোদের দুজনের ভালোভাবে চলে যাবে|
স্কুল কলেজ জীবনে খাতার পাতায় রকমারি গয়নার ডিজাইন সুবর্ণা করত ভালোবেসে, এসব নিয়ে তার আলাদা কোন প্যাশন ছিল না, তাহলে সে আর আপত্তি করবে কেন? তবুও নম্রতার কথা শুনে বুকের মাঝে নিজের কোন এক প্রিয় জিনিস হারিয়ে ফেলার অনুভূতি হল| কিন্তু সে অনুভূতিকে পাত্তা দিলে চলবে না সুবর্ণার, সামান্য থমকে বলল, আমি রাজি| মাসে কত করে দিবি?
বিশ হাজারে শুরু কর| তোর কাজ যদি কাস্টমাররা পছন্দ হয় তবে পরের মাস থেকে ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ| চলবে তো?
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এ টাকা তার কাছে রাজত্ব পাওয়ার সমান| কাজেই রাজি না হওয়ায় কোন কারণ ছিল না তার কাছে| রাজি হয়ে যায় সে, রাত জেগে ডিজাইন আঁকতে শুরু করে| নম্রতা তাকে কম্পিউটারে সড়গড় করতে থাকে| কাজের পাশাপাশি ক্যাডের ডিজাইনিং কোর্স করতে থাকে সুবর্ণা|
রাতারাতি না হলেও ধীরে ধীরে ‘ নকশিকাঁথা ‘ র গয়নার সেকশন ‘ সালাঙ্কারা ‘ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে| অনেকেই শাড়ি দেখতে এসে গয়নার সম্ভার দেখতে চায়| কিনেও ফেলে টুকটাক| শহরের অভিজাত মহলে ক্রমশই ‘ সালাঙ্করা ‘র পরিচিতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে| একটা সিনেমার প্রিমিয়ারেও ডাকা হয় ‘ সালাঙ্করা ‘ কে, সেখানকার চরিত্ররা সবাই সালাঙ্কারার গয়নায় সেজেছে| সুবর্ণা সেখানে যায় নম্রতার সেক্রেটারি হিসেবে| আজকাল শুধু ডিজাইন করে ছেড়ে দেয় না, হাতেকলমে কিছু ইউনিক কাজ করে| যা সালাঙ্কারার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেছে| সম্প্রতি নতুন স্টোর খোলার কথা চলছে| নাতিকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সম্প্রতি সুবীর বাবু নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন| মাঝেমধ্যেই বৃদ্ধ বিলাপ করেন কেন যে সেদিন তোকে নিজের পায়ে না দাঁড় করিয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম, তাহলে হয়ত আজ এইদিন দেখতে হত না| তোকে একা একা দায়িত্ব পালন করতে দেখে বড্ড কষ্ট হয় রে মা|
এখন আর তেমন একটা অভিযোগ শুনতে হয় না তাকে| ভুটকুনের পছন্দমতো জিনিসপত্র কিনে দিতে পারে, মাস গেলে মাকে কিছু হাতখরচাও দেয়, ফলে বাড়ির সবাই এখন খুশি| বাথরুমটাও নতুন করে সারিয়েছে সে, দরকার ছিল খুবই| একদিন হঠাৎ কাঁকড়াবিছে দেখে প্রবল ভয় পেয়ে গিয়েছিল ভুটকুন| এখন টাইলস বসিয়ে একেবারে ঝকঝকে তকতকে| মাসে মাসে কন্ট্রাক্টরের টাকা শোধ করছে সে| মধ্যিখানে একবার ভুটকুনকে মলে নিয়ে গিয়ে পছন্দমত জামা, জুতো কিনে দিয়েছে| খাইয়েছে মাটন বিরিয়ানি| মাঝেমধ্যে ফেরার সময় পছন্দের আইসক্রিম, খেলনা নিয়ে আসে| নম্রতাও ভুটকুনের জন্য মাঝেমধ্যেই দামী গিফট পাঠায়| মাইনেও বেড়েছে তার, সুবর্ণা বোঝে টাকা দিয়ে নম্রতা কিনে নিতে চায় তার শিল্পীসত্তাকে| নিজেকে বি ক্রি করে সবাইকে আরাম আয়েশ কিনে দেয় সে| আগে যেমন সবসময় বাবার কথা ভেবে মনখারাপ করত ভুটকুন আজকাল আর করে না| ধীরে ধীরে এই জীবনের সঙ্গে সে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে|
শুধু গভীর একাকী রাত্রিগুলো সুবর্ণাকে স্বস্তি দেয় না| তার শিল্পী সত্তা পাথরের দেওয়ালে মাথা কুটে হাহাকার করে মরে| কেউ জানে না, কত কষ্ট করে সে এক একটা গয়না ডিজাইন করে, আর তার সব কৃতিত্ব নিয়ে যায় নম্রতা ক্রিয়েশন| মাঝেমধ্যে সব ছেড়ে ছুড়ে দিতে ইচ্ছে জাগে, আজ সে বোঝে নম্রতা তাকে এক্সপ্লয়েট করছে| কিন্তু বিপদের দিনে যখন কেউ তার পাশে ছিল না, এই নম্রতাই এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল কিভাবে সুখের দিনে তাকে ছেড়ে আসে সে? তাছাড়া ভুটকুন, একবার চাকরি ছাড়লে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে| ছেলেটা সবে কটাদিন সুখের মুখ দেখেছে, আবার তাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে সুবর্ণা! তার চাইতে যা চলছে চলুক! সবই নিজের জায়গায় স্থির থাকে শুধু সুবর্ণার শিল্পী সত্তা একটু স্বীকৃতির জন্য হাহাকার করে মরে| একের পর এক ডিজাইন এঁকে চলে সে, নম্রতা ক্রিয়েশনের ‘ সালাঙ্কারা ‘র সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে…
( ক্রমশ )
©️ Monkemoner dakbakso – Anindita