#পালাবদল
#পর্ব_৪
দিন বদলায়| বড় হয় ভুটকুন| আগের থেকে এখন অনেক বুঝতে শিখেছে| অযথা বায়নাক্কা করে না, বয়সের তুলনায় ধীরস্থির| এতদিনে সেও বোধহয় বুঝে গেছে বাবার নতুন সংসারে সে অবাঞ্ছিত| সুবর্ণা যখন দেখেছে অর্ণব তাকে ছাড়াই ভাল আছে, সে মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স দিতে আপত্তি করে নি আর| লামিয়া ভালই রেখেছে অর্ণবকে, সুবর্ণা দিব্যি খবর পায়| আসলে এক শহরে থেকে কারুর খবর রাখতে না চাইলেও খবর রাখতে হয়| লোকে যেচে দায়িত্ব সহকারে খবর দিয়ে যায়| সময়ের গতি এগিয়ে চলে, সম্প্রতি লামিয়ার একটি মেয়ে হয়েছে, ভুটকুনের থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, ভুটকুনের নতুন বোন|
স্কুল থেকে খবরটা শুনে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল ভুটকুন | সে কোনো বোন চায় না| চায় না অমন বোন, যে বোন দাদাকে বাবার কাছ থেকে কেড়ে নেয়! কেড়ে নেয় আনন্দ, হাসি| অনেকদিন বাদে বাবার কথা মনে করে টেবিলে মাথা রেখে একা একা কাঁদছিল ভুটকুন, সুবর্ণা বাঁধা দেয় নি| চোখের জল বইলে খানিক, মন হাল্কা হয়|
আজ ভুটকুন আঠারো পেরোল| যাদবপুরে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ছে| কালের নিয়মে সুবর্ণার বাবা গত হয়েছেন, তবে সুবীর বাবুর অভাব প্রতিনিয়ত সে টের পায়| সেদিন যদি বাবা আশ্রয় না দিত, তবে হয়ত আজো শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়াতে হত তাদের| ভুটকুনের পড়াশোনাও কি হত? মাথা তুলে সমাজের বুকে আজ দাঁড়াতে পারত তারা! তবে বিজয়া দেবী আছেন এখনো, আজকাল প্রায়ই বলেন সেদিন অন্যায় করেছিলেন তিনি মেয়েকে অর্ণবের সঙ্গে আপোষ করতে বলে, ভাগ্যিস সুবর্ণার জেদ করেছিল| শুনে সে হাসে, আজকাল কারুর সঙ্গেই বেশি কথা বলতে ইচ্ছে জাগে না| কালের নিয়মে, মানসিক চাপে সেও হাঁপিয়ে উঠেছে, এখন শুধু একটাই আশা, কবে ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়াবে!
বদলেছে পরিস্থিতিও| ‘ নকশিকাঁথা ‘ বুটিকের গয়নার সম্ভার ‘ সালাঙ্কারা ‘ র ক্রিয়েটিভ হেড এখন দুজন, নম্রতা ও সুবর্ণা| বছর দশেক বাদে হঠাৎই একদিন নম্রতা এসে তাকে বলে যে এত সুন্দর সুন্দর গয়না বানিয়ে ক্রেতাদের হাতে তুলে দেয় তারও তো স্বীকৃতি পাওয়া উচিত, পাওয়া উচিত শিল্পীর প্রাপ্য সম্মান|
অবাক হয়েছিল সুবর্ণা| যে নম্রতা এতদিন তাকে ব্যবহার করেছে সে আজ এমন কথা বলছে প্রথমে বিশ্বাস হয় নি তার| মৃদু হেসে বলেছিল, স্বীকৃতি চাই না আমার, যখন বিপদে ভেসে যাচ্ছিলাম তখন তুই পাশে দাঁড়িয়েছিলি| সেদিন তুই পাশে না দাঁড়ালে হয়ত আমি আজকের আমি হয়ে উঠতে পারতাম না| তাই নাম হোক তোর, আমি নীরবে কাজ করেই খুশি|
কিন্তু নম্রতা সেদিন কোন কথা শোনে নি| হয়ত তার বাবার যন্ত্রণাদায়ক প্রয়াণ তাকে ভেতরে ভেতরে বদলে দিয়েছিল, দীর্ঘ পঁচিশ দিন হাসপাতালে ছিলেন ভদ্রলোক| শেষের দিকে এক ফোঁটা জলও খেতে পারতেন না| পাগলের মতো হাত- পা ছুঁড়তেন| তেমন তেমন অবস্থায় হাসপাতালে বিছানার সঙ্গে বেঁধে রাখতে হত| বাবা চলে যাওয়ার পর একাকী নম্রতার মনে হয়েছিল হয়ত সুবর্ণার অন্তঃস্থলের যন্ত্রণাই অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছিল তার বাবার ওপর! সেজন্যই অমন যন্ত্রণা পেয়ে যেতে হল তাঁকে! ” মরে পুত্র জনকের পাপে ” যদি হতে পারে, তবে কন্যার পাপের দায়ে কেন নেমে আসবে না পিতার ওপর? অভিশাপের যাতনা মাথায় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল তাকে! সেদিন থেকে ‘ নকশিকাঁথা ‘ বুটিকের গয়নার সেকশনের নাম বদলে গেছে, এখন তা কেবল নম্রতা’জ ক্রিয়েশন ‘ সালাঙ্কারা ‘ নয়, নম্রতা অ্যান্ড সুবর্ণা’জ ক্রিয়েশন, ‘ সালাঙ্কারা| ‘
ওপরে নিজের মনের ভাব না দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ খুশি হয়েছিল সুবর্ণা| একলা ঘরে লুকিয়ে কেঁদেছিল সারা রাত| এ কান্না আনন্দের, এ কান্না প্রাপ্তির, এ কান্না একজন শিল্পীর স্বীকৃতি লাভের| এ কান্না একজন শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে সৃজনে|
মা তোমাকে একটা জায়গায় যেতে হবে, যেতে হবে আজ আমার সঙ্গে| সপ্তাহের এই একটা দিনই ছুটি পায় সুবর্ণা| সেদিন সে বসে পড়ে ফাঁকা ক্যানভাসে, হাতে তুলে নেয় তুলি| মনের ইচ্ছেগুলো এলেমেলো হয়ে ফুটে ওঠে, শিশুর মতো খুশি হয় সুবর্ণা| এসময়টা তার নিজের একান্ত, রঙ-তুলিতে মগ্ন থাকে ছেলেবেলার মতো| তাই বোধহয় শুনতে পেল না ছেলের কথা, উচ্চস্বরে বলে উঠল ভুটকুন, আজ যে তোমার রঙ-তুলিকে খানিক বিশ্রাম দিতে হবে মা| যেতে হবে আমার সঙ্গে|
যেদিন থেকে অর্ণব তাকে ছেড়েছে, সেদিন থেকে প্রশ্ন করাও ছেড়েছে সুবর্ণা| সবটাই মেনে নিয়েছে ভাগ্যের হাতের খেলা বলে| আজো ছেলের কথায় কোন প্রশ্ন করল না, যেমনটি বলল ঠিক তেমনভাবেই তৈরি হয়ে এল সে|
” শিল্প আকর “… নামীদামী শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে হাজির হয়েছেন এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে| এদের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হবে সেরার সেরা শিল্পীকে| অবাক হয়ে দেখল সুবর্ণা স্পন্সরশিপের দায়িত্বে রয়েছে ‘ দ্য রিয়েল আর্টিস্ট মাইন্ড ‘, এতো অর্ণবের কোম্পানি, তবে কি অর্ণবও আজ এখানে হাজির হয়েছে? এ কি ঝামেলায় ফেলল তাকে ভুটকুন! টুকটাক ছবি আঁকা, সময় পেলে ছাঁচে ফেলে প্লাস্টার অব প্যারিসের মূর্তি বানানো ছাড়া ভুটকুনের যে আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটে উৎসাহ আছে তা তো সুবর্ণা কোনদিন জানতেই পারে নি| অবশ্য ছেলেটাকে দেখার সময়ই বা পেল কই! যে সময়টা বড় হচ্ছে ভুটকুন, সে সময় পাগলের মতো পরিশ্রম করছে সে, কিছু টাকার জন্য| সংসারের সচ্ছলতার জন্য| অপরের জন্য গয়না বানিয়েই সারাটা জীবন কেটে গেল তার| পাশেই বসে আছে ভুটকুন, ফিসফিসিয়ে বললেন সুবর্ণা তোর যে ক্রাফটস ওয়ার্ক এত ভাল লাগে আগে কখনো বলিস নি তো? আজ একেবারে সোজা আমাকে দেখাতে নিয়ে চলে এলি| এ বছর সেরা শিল্পীর পুরস্কার কে পাচ্ছে রে?
( ক্রমশ )
©️ Monkemoner dakbakso – Anindita