পালাবদল পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
256

#পালাবদল

#শেষ_পর্ব

হঠাৎ অর্ণবের দিকে চোখ গেল তার, উন্নতি হয়েছে এখন সে কোম্পানির কর্মকর্তা| কয়েকজনের অচেনা মুখের সঙ্গে স্যুট টাই পরে ঘুরছে| মাথা নামিয়ে নিল সে, দেখতে পেলে হয়ত আবার এগিয়ে আসবে| বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই তার নতুন করে ভদ্রতা দেখানোর| ইচ্ছে করছে এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে কিন্তু ভুটকুনটা যে অত আশা করে তাকে নিয়ে এল| কি বা করবে সুবর্ণা? থাকতে যে তার এক মুহূর্তও ভাল লাগছে না|

হঠাৎই হলের আলোগুলো মৃদু হয়ে এল| আর সুবর্ণা পেয়ে গেল তার ভালোবাসার রসদ| একের পর এক সুন্দর শিল্পের প্রদর্শনী| কি অপূর্ব কারুকার্য, কি নকশা, কি শিল্প নৈপুণ্য, শিল্পী যেন তাঁর সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে দিনরাত এক করে নিজের তৈরি জিনিসটিকে নয়নাভিরাম করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন| সুবর্ণার মনে হল চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে| এমন প্রদর্শনীতে কবে অংশ নিতে পারবে সে? আদৌ কি পারবে কোনদিন? বয়স হয়েছে তার, এখন তারা বাতিলের দলে!

একটা আয়নার চারপাশে কাঠের সুক্ষ্ম নকশা করা, দেখে যেন রাজকীয় বলে বোধ হয়| দেখে ভারী পছন্দ হয় তার, আহা শিল্পীর কি অপরূপ শিল্প নৈপুণ্য, কি অদ্ভুত পরিমিতি বোধ, নিখুঁত কাজ, একটুকুও কোথাও অতিরিক্ত বা কম কিছু নেই| যেখানে যেমনটা হওয়া দরকার, সেখানে ঠিক সেটাই রয়েছে| আয়নাটা পাওয়ার সুপ্ত বাসনা সুবর্ণার অন্তরে লালিত হতে থাকে| একজন শিল্পী পুতুলের পরিবার বানিয়েছেন কি যে নিখুঁত কাজ, এক নজরে দেখলে জীবন্ত বলে বোধ হয়| এমন এক অনুষ্ঠানে এতদিন সে আসে নি কেন, ভেবেই তার আফশোস হয়|

একটা সুন্দর গয়না পলকেই সুবর্ণার নজর কেড়ে নিল| কে এই শিল্পী? যেমন সুক্ষ তাঁর কাজ ধরণ তেমনিই পরিমিতি বোধ| রূপোর ওপর ছোট্ট ছোট্ট সেমি প্রেশাস স্টোন আর সরু তার জড়িয়ে এমন সুন্দর ফিলিগ্ৰির কাজ করেছে সে, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, নিজে গয়না শিল্পী সে, সুক্ষ কারুকাজ বোঝে, হাতেকলমে করেও থাকে|এই শিল্পীর তৈরি গয়নার সৌন্দর্য তাকেও মুগ্ধ করেছে| ভাগ্যিস ভুটকুন আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, তাই তো শিল্পীদের এমন সুন্দর সুন্দর কাজ দেখে চোখ সার্থক হল| এই গয়না শিল্পীর সঙ্গে যদি একবার আলাপ করা যায়, খুব ভাল হয়| ভুটকুন কি পারবে না আলাপ করিয়ে দিতে| নরম গলায় সুবর্ণা বলে উঠল, ভুটকুন, অ্যাই ভুটকুন, কে বানিয়েছে রে এটা? আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিবি?

কোন উত্তর আসে না, তবে কি ভুটকুনও তন্ময় হয়ে গেল? পাশের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় সুবর্ণা, কই গেল ভুটকুন? কখন পাশ থেকে উঠে চলে গেল সে?

শেষ শিল্পীর তৈরি ক্রাফটেরও প্রদর্শনী হয়ে গেল| ভুটকুনকে দেখতে না পাওয়ার পর থেকে শিল্পের প্রদর্শনে তেমন একটা মন দিতে পারল না সুবর্ণা| ফোনে ট্রাই করেছে কয়েকবার কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক দুর্বল| তাকে বসিয়ে রেখে কোথায় যে গেল ছেলেটা? কিচ্ছুটি আর ভাল লাঘছে না| ভাবলেন বেরিয়ে যাবেন| বাইরে বেরিয়ে ভুটকুনের মোবাইলে ট্রাই করবেন| মাঝেমধ্যে এমন এমন কান্ড ঘটায় না ছেলেটা মাথা গরম হয়ে যায়| ঘোষক এসেছেন মঞ্চে| আজকের অল ইন্ডিয়া ক্রাফট কম্পিটিশন অর্থাৎ ‘ শিল্প আকর ‘ প্রতিযোগিতার বিজয়ী হলেন তথাগত দত্তগুপ্ত| বড় স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে সেই সুন্দর গয়নার ছবি, যা দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিল সুবর্ণা| মনে মনে আলাপ করতে চেয়েছিল গয়না শিল্পীর সঙ্গে! কোথায় পেল এমন নকশার ভাবনা? কিন্তু এই শিল্পী যে তারই আত্মজ, তারই আত্মার দোসর জানতে পারে নি তো আগে! এত পড়াশোনার মাঝে গয়না নিয়ে ভাবার সময় কোথায় পেল ভুটকুন?

শুনতে পেল ঘোষক বলছেন, পুরস্কারের অঙ্কের চেক আর ট্রফি তথাগত দত্তগুপ্তের হাতে তুলে দেওয়ার আগে আমি চাইব তিনি যেন মঞ্চে এসে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য রাখেন| এমনিতে তথাগত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছেন, তারই ফাঁকে ফাঁকে শিল্পচর্চা করা তার হবি| কার কাছ থেকে তিনি এই শিল্পসত্তা পেয়েছেন? কে তাঁকে উৎসাহিত করেছে? জুগিয়েছে প্রেরণা?

ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তথাগত, তার ভুটকুন| সেদিকে তাকিয়ে সুবর্ণার চোখ দুটো ভরে এল জলে| মাইক হাতে নিয়ে বলতে শুরু করল, ছোটবেলা থেকে মাকে দেখতাম জুয়েলারি ডিজাইন করতে| রাতের পর রাত জেগে কাজ করত, ফুটিয়ে তুলত নকশা, নারী সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত হত মায়ের গয়না| মায়ের সে পরিশ্রম যথাযোগ্য স্বীকৃতি পায় নি| তবু মায়ের হাসিমুখ কখনো ম্লান হতে দেখিনি| আমার খুশিই ছিল সবচাইতে দামী সম্পদ| মনে হল একবার চেষ্টা করে দেখিই না যদি আপনাদের সবার সামনে মাকে উপস্থাপন করতে পারি, মায়ের পরিশ্রমের গল্প শোনাতে পারি| এই গয়নার নকশা আমার তৈরি হলেও, যাঁর কাছ থেকে এই কল্পনাশক্তি পেয়েছি আমি, পেয়েছি উৎসাহ, তিনি আর অন্য কেউ নন, আমার মা| আমি চাই আজকের পুরস্কার মাকে উৎসর্গ করতে|

প্রবল করতালির মধ্যে চোখের জলে ভেসে পুরস্কার হাতে নিল সুবর্ণা| তাকিয়ে দেখল দূরে, অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব| হাততালি দিচ্ছে| সে চোখে কি অনুশোচনায় ছবি? অতদূর কেন যে তার চোখে পড়ে না ছাই!

ছেলের হাত ধরে ধীরপায়ে মঞ্চ থেকে নেমে এল সুবর্ণা| অর্ণব এসে দাঁড়িয়েছে সামনে| করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, আমার ছেলে বলে কথা, জানতাম আজ তোমায় কেউ হারাতে পারবে না| আমায় ক্ষমা করো সুবর্ণা, আজ বুঝতে পেরেছি সেদিনের সাময়িক মোহে পড়ে কি অমূল্য জিনিস হারিয়েছি আমি| হারিয়েছি আমার পরিবার| আসলে তোমাকে বড় সহজভাবে নিয়েছিলাম, তাই বোধহয় জীবনভর তার প্রতিফল দিতে হল| তুমি নিশ্চয়ই জানো লামিয়া আর আমি এখন এক ছাদের নীচে থাকি না| পথ আলাদা হয়েছে অনেকদিন| তুমি চাইলে আবার আমরা একসঙ্গে…

এই বয়সে এসে না মায়ের নতুন করে স্বামীর দরকার আছে, না আমার বাবার| যেটুকু স্বীকৃতি মায়ে-পোয়ে পেয়েছি তাতেই আমরা খুশি| আপনি আমার জন্মদাতা, এটুকুই| এর বেশি কিছু আশা করবেন না| ছেলে আমি কেবলই আমার মায়ের, চলো মা| আর এখানে অপেক্ষা করার দরকার নেই|

ভীষণ কষ্ট হচ্ছে অর্ণবের, বুকের ভেতরটা যেন সাহারা মরুভূমির মতো শুকনো, ছেলেকে যদি একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারত তাহলে হয়ত এই অতৃপ্ত তৃষ্ণার নিবারণ হত| কিন্তু আজ যে তা আর সম্ভব নয়, সে নিজেই একদিন এই সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট করেছে| অতীত আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নতুন রূপে| গর্বিত ভঙ্গিতে ছেলের হাত ধরে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে সুবর্ণা| সেদিকে তাকিয়ে অর্ণবের মনে পড়ে গেল বহুকাল আগে বলা কথাগুলো, ” একদিন বুঝবে কি ভীষণ ভুল করেছিলে, কিন্তু সেইদিন হাজার কাঁদলেও না তোমার ছেলের অধিকার পাবে, না পাবে আমাকে ভালোবাসার অধিকার| ”

( সমাপ্ত )

©️ Monkemoner dakbakso – Anindita