#পাহাড়ের_কোল_ঘেঁষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ২
“আমি ট্যুরে যাবো।”
“কই?”
“কাশ্মীর!”
আমান আহমেদ রেগে গেলেন। তিনি বেশ কাট কাট কণ্ঠে জবাব দিলেন,
“কিছুতেই না। এতো দূরে এখন আর যাওয়ার দরকার নেই।”
“এটা আমার স্নাতকের শেষ ট্যুর, বাবা।”
“দরকার নেই। এখন তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আগের মতো চলাফেরা বন্ধ করো।”
“আগের মতো চলাফেরা মানে?”
“প্রতিটা বছর গিয়েছো। এইবার আর জিদ করো না।” বলেই আমান আহমেদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া কণ্ঠে শুধালেন,
“আসমা,মেয়েকে নিয়ে যাও। বেশি বা’ড় বেড়েছে।”
আসমা শেখ বলার আগেই পৃথা চুপচাপ রুম চলে গেল।
আসমা শেখ মেয়ের দিকে তাকালেন। চারবছর ধরে মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে। প্রতিবার কাশ্মীর গেলে উদভ্রান্ত হয়ে ফিরে। যেন কিছুর আশায় প্রতিবছর ছুটে যায়। মেয়েটার ওখানে কিসের এতো টান!
তিনি মেয়ের পিছু পিছু রুমে পা বাড়ালেন। রুমে ঢুকতেই দেখতে পান, পৃথা খাটে হাঁটুমুড়ে চুপচাপ বসে আছে।
আসমা শেখ এগিয়ে গেলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
“মা প্রতিবারই তো যাস। এইবার নাহয় না যা।”
“কেন যাবো না মা?এইবার কেন ভিন্ন হবে?”
“কারণ এইবার তফাৎ আছে। এইবারের সময়টা ভিন্ন। এইবার তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। যেখানে সেখানে যেতে নেই।”
“কেন যেতে নেই?মেয়েরা কেন বন্দী হয়ে থাকবে?”
“সেটা সমাজের নিয়মকেই জিজ্ঞেস কর। ”
“আমি যাবোই মা।”
“বারণ করছি।”
মায়ের কথায় পৃথা জবাব দিল,
“আমার বিয়ে ঠিক তোমরাই করেছো। একটা বার আমার মতামত নিতে পারলে না?”
“আর কতদিন এভাবে থাকবে!তোমার বাবার বয়স হচ্ছে। বিয়ে দিতেই হতো।”
“আমাকে জোর করলেও আমি যাবো।”
পৃথা নিজের কথায় এভাবে অনড় থাকতে দেখে আসমা শেখ তাকালেন। তিনি শক্ত কণ্ঠে শুধালেন,
“কিসের এতো টান তোমার?”
পৃথা মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। মুখে কোনো প্রতিত্তর দিতে না পারলেও সে আপনমনেই আওড়ালো, “টান তো অনেক। একটা মানুষের টান। যে মানুষটার সাথে শুধু ৫দিনের পরিচয়। কিসের জবাব দিব তোমাকে মা!”
——
পৃথা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। চারদিকে এখনো আঁধারে ঢাকা। ভোর হতে চললো সবে। পৃথা স্টেশনে এসেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এখনো ট্রেন ছাড়েনি। সবে সবাই এসে ভীড় জমাচ্ছে।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই শান্তি। অবশেষে সে যেতে চললো! পৃথার নিজেকে কেমন জানি হাল্কা হাল্কা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোনো যুদ্ধে যেন সে সফল হতে চলেছে। অথচ এ এক সামান্য ব্যাপার!
পৃথা তার জন্য ভরাদ্দকৃত ট্রেনের বগিতে বসতেই গা এলিয়ে দিল। জানালার পাশের সিট্ হওয়াতে বাহিরের দমকা হাওয়ার আবেশে চোখ বন্ধ করে নিল। সে জানে না, কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে তার!
কেউ পাশে হুলুস্তুল করে বসতেই পৃথা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে তাকালো। তাকাতেই দেখতে পেল ইরা তার চো’রা হাসি হেসে সিটের উপরে ব্যাগ রাখছে।
পৃথা অবাক হলো। ইরার তো যাওয়ার কথা ছিল না! প্রতিবার অন্য ট্যুরে পৃথাই নিয়ে যেত। তাও অনেকটা জোর করে। কারণ ইরার সেই সামর্থ নেই যে বেশ শখের সাথে ট্যুরে যাবে। কিন্তু এইবার পৃথা নিজের মতো করে একা যেতে চেয়েছিল বিধায় ইরাকে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেসও করেনি। কিন্তু এইবারই যে ইরা যাবে তা তো সে জানতো না!
পৃথার প্রশ্নবোধক চাহনী দেখে ইরা হাসলো।
“তুই যাবি সেটা তো আগে বলিসনি!”
পৃথার কথায় ইরা হেসে তার সিটে নড়েচড়ে বসলো। সে দৃষ্টি সরিয়ে অভিমানী ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে জানালো,
“তুই ডাকবি কিনা দেখেছিলাম। তাই বলিনি। কিন্তু তুই তো ডাকলি না। তাই নিজেই চলে আসলাম।”
ইরার কথায় পৃথার স’ন্দে’হ হলো। সে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“তুই নিজে থেকে ট্যুরে আসার মেয়ে তো নস।”
“আরে বাবা আসলাম তো।” বলেই ইরা পৃথার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সে তাকিয়ে আছে। পৃথার চোখে এখনো স’ন্দে’হ। ইরা চোখ সরিয়ে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টায় বলল,
“এভাবে কেন তাকাচ্ছিস? আমি নিজে থেকেই এসেছি। বিশ্বাস কর।”
“অবিশ্বাস তো করিনি কিন্তু বারবার একই কথা কেন বলছিস? কে পাঠিয়েছে তোকে?”
ইরা আমতা আমতা করে কথা ঘুরানোর চেষ্টায় বলল,
“আরে বাবা, কে পাঠাবে? কেউ তো নেই।”
“বাবা পাঠিয়েছে?”
ইরা আর কথা ঘুরাতে পারলো না। মেয়েটা ইদানিং সব বুঝে নিচ্ছে। ইরা সহজ সরল ভাবে “হ্যাঁ” বোধক মাথা নাড়লো।
পৃথা দৃষ্টি সরিয়ে নিল। সে জানতো এমনটা কিছু হবে। সে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে শান্ত কণ্ঠে জানালো,
“শোন ইরা। বাবা আমার খবর নিতে তোকে পাঠিয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু আমার কাছে বারবার আর কারোর ফোন নিয়ে বিরক্ত করতে আসবি না। আমি এজন্য ফোন বন্ধ করে দিয়েছি। এইবারের ট্যুর টা অন্তত শেষবারের মতো অনুভব করে নিই।”
“আর কারোর ফোন মানে?”
“সেটা তুই ভালো জানিস।”
“আহাদ?” বলতেই পৃথা ফিরে চাইলো। সাথে সাথে ইরা জি’ব্বা’য় দাঁ’তে’র কা’ম’ড় বসিয়ে নিজের কথা শুধরানোর চেষ্টায় জানালো,
“আহাদ ভাই। ভুলে এভাবে নাম ধরে ডেকে ফেলেছি। তোকে এভাবে জে’রা করতে দেখে আমার সবকিছু গো’ল’মা’ল হয়ে যাচ্ছে। আর পারি না।”
“তোর যা মনে হয় তা ডাক। কিন্তু আমাকে যাতে বিরক্ত না করিস।”
“তো ওরা ফোন করলে আমি কী করবো?”
“তোকে সহ বাইরে ছুঁ’ড়ে মারবো।”
পৃথার কথা শুনে ইরা বাধ্য মেয়ের মতো করে মাথা নাড়লো। সে জানে পৃথার রাগ। উল্টাপাল্টা হলে সত্যি সত্যি তাকে ফেলেই চলে যেতে পারে। পৃথার দ্বারা সব সম্ভব। এখন তো ভুলেও বিশ্বাস করা যাবে না।
——–
প্রকৃতির অপূর্ব রূপ লাবণ্যের জন্য কাশ্মীরে সারাবছর ভ্রমণপিপাসুদের ভীড় লেগে থাকে। এই ভীড় চোখে পড়ার মতো। পৃথা চারদিকে তাকালো। সব ভ্রমণপিপাসুদের চোখে তৃপ্তির উচ্ছাস। যেন বহুদিনের ইচ্ছে মিটাতে এসেছে। পৃথা হাসলো। সেও তো এমন। প্রতিবারই যেন সে এই জায়গাটার উপর নতুন নতুন করে প্রেমে পড়ে।
এলোমেলো হাওয়া বইছে। কাশ্মীরের এই বাতাস পৃথার বড্ড আপন লাগে। যতটুকু চোখ যায় ধোয়াশা। যেন কুয়াশার চাঁদরে সম্পূর্ণ জায়গাটাকে মুড়িয়ে রেখেছে। পৃথা ট্রেন থেকে নেমেই প্রাণপনে শ্বাস নিল। এই জায়গা! পরপর পাঁচবছর আসা হয়ে গিয়েছে। তবু কেন এতটা আপন লাগে তা সে জানে না! প্রতিবারই নতুনত্ব চোখে পড়ে। এবারই শেষ আসা তা ভাবতেই পৃথার চোখ ভরে জল গড়িয়ে পড়লো।
এইবারের পরে হয়ত আর কোনোদিন আসা হবে না। পৃথা চোখ মুছে নিয়ে আপনমনেই বিড়বিড় করে আওড়ালো, “এইবারের মতো শেষ। এইবার বিদায় নিয়ে আর কোনো পিছুটান রাখা হবে না। অনেক হয়েছে। এইবার বেরিয়ে যাওয়ার পালা।”
“এই পৃথা?”
পৃথা পাশ ফিরে তাকালো।
ইরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে শুধালো,
“কী যে হয় না তোর? এই জায়গায় আসলেই অন্যরকম হয়ে যাস। আমিও আর পারি না বাপু। আয় ফ্রেস হবি। সবাই যার যার রুমে চলে গেছে। আঙ্কেল আমার ঘাড়ে এক দায়িত্ব দিয়ে
গিয়েছে।”
পৃথা জবাব দিল না। সে এগিয়ে গেল হোটেলের দিকে। প্রত্যাশীত ভাবে সেই চারবছর আগের রুমটায় পৃথাদের জন্য বরাদ্দ হলো। পৃথা রুমের দিকে পা বাড়ালো। সে রুমে ঢুকেই চারদিকে তাকালো। চারটা বছর কত মানুষ এলো গেল! কতজন কত স্মৃতি মুড়িয়ে রেখে গিয়েছে! পৃথা দেয়ালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিল। অনেক পরিবর্তন এসেছে। ছোট জিনিস থেকে শুরু করে প্রতিটা জিনিসেরই নতুনত্ব! সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। শুধু পরিবর্তন আসেনি তার মনে। এইবার তারও আনার পালা।
#চলবে ইন শা আল্লাহ