পিঞ্জিরা পর্ব-০২

0
6

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_২
#জান্নাত_সুলতানা

সন্ধ্যায় মিরার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো।ভয় পেলো রোকেয়া। মেয়ের শরীরে হাত দিয়ে চমকে উঠলো।কমলা বেগম নাতনির গায়ে কাঁথা দিয়ে ডেকে রেখেছে। মিরা জ্বরের ঘোরে কেঁপে কেঁপে উঠছে ক্ষণেক্ষণে।
পাশের বাড়ির শাহনাজ এর মা এসে মিরা’র অবস্থা থেকে মিরা’র মাকে উপজেলায় হসপিটাল নিয়ে যেতে পরামর্শ দিলো।কমলা বেগম নাতনির জন্য কেঁদেকুটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। মিরা’র মা শাশুড়ী কে জিগ্যেস করতেই কমলা বেগম বললো,

-“যা করবার তাগদা কর বউ।
আমার বুবু কষ্ট পাইতাছে।”

রোকেয়া শাশুড়ী কে মিরা’র পাশে বসতে বলে শাহনাজ এর মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে গাড়ি আনতে।এখান থেকে পাঁচ মিনিট গেলে একটা মোড় আছে সেখানে চায়ের দোকান মুদি দোকান আছে। মানুষের আনাগোনা বেশি। গাড়িও থাকে মাঝেমধ্যে। তাই সেদিকে গেলো।
মোড়ে যেতেই প্রথমে নজরে আসে চিরপরিচিত সেই জিপগাড়ি টা।পাশের দোকানে তাকিয়ে দেখলো চায়ের দোকানে সামনের দাঁড়িয়ে আছে রিহান।অল্পস্বল্প ঠান্ডা বাহিরে। গায়ে তার কালো একটা জ্যাকেট।তার ভেতরে কি আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে একনজর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো। আর কাজল ইফাদ দু’জনে চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে আছে। হাতে তিন জনেরই চায়ের কাপ।রিহান প্রথমে রোকেয়া বেগম কে খেয়াল করে নি।কাজল খোঁচা মারতেই রিহান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো।অবাক হলো এতো রাতে ফুপি কে এখানে দেখে।কি হয়েছে কি কারণে এখানে এসছে বুঝতে পারে না।চিন্তিত মুখের ইফাদ এর দিকে তাকিয়ে কিছু ইশারা করতেই ইফাদ চায়ের কাপ রেখে রোকেয়া বেগম এর কাছে গেলো।ইফাদ গিয়ে রোকেয়া বেগম কে সালাম দিলো।রোকেয়া সালাম এর জবাব দিলো তাড়াহুড়ো সহিতে। ইফাদ চিন্তিত কণ্ঠে জানতে চাইলো,

-“চাচি এতো রাতে? কিছু প্রয়োজন?”

রোকেয়া ইতস্তত বোধ করলেন।কথা টা এখন তখন যেকোনো সময় রিহান এর কাছে পৌঁছবেই মিরা কে তিনি মেরেছে। আর সেটার জন্য মিরা’র জ্বর হয়েছে শুনলে রিহান নিশ্চয়ই ওনার সাথে একদফা চোখে চোখে যুদ্ধ করতে ছাড়বে না ছেলে টা।আমতা আমতা করে বলে,

-“আসলে হয়েছে কি একটা গাড়ি দেখতে এসেছিলাম।”

-“গাড়ি?”

-“ওই মিরা’র একটু জ্বর এসছে।হসপিটাল নিত,,ওই তো একটা গাড়ি।”

রোকেয়া বেগম সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই একটা গাড়ি দেখে সেটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো।শাহনাজ এর মাও গেলো।

ইফাদ তৎক্ষনাৎ এক দৌড়ে দোকানে গেলো।হাঁপাতে হাঁপাতে শুধু বললো,

-“রিহান মিরা মিরার জ্বর হয়েছে।”

রিহান মূহুর্তের মাঝে হাতের কাপ ছুঁড়ে ফেলে দিলো।সে কিছু টা হলেও আন্দাজ করেছিলো। মিরা নয়তো দাদি অসুস্থ। কিন্তু মিরা’র জ্বর কথা টা যেন কানে বারবার ঝংকার তুলছে।
অধর কাঁপছে পুরুষ টার।কোনো রকম দৌড় লাগাল উল্টো দিকে।ধুপধাপ শব্দে রোকেয়া বেগম এদিকে তাকাল।রিহান কে দৌড়ে নিজেদের বাড়ির দিকে যেতে দেখে ইফাদ এর দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলো।কৃত্রিম আলোয়ে ইফাদ মুখে হাত দিয়ে কাজল কে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“এই কাজল চল চল।”

ওরা দু’জন গাড়িতে বসলো।কাজল গাড়ি স্টার্ট করল। রোকেয়া বেগম আর শাহনাজ এর মা দ্রুত পায়ে হাঁটছে গাড়ি পায় নি তারা।ড্রাইভার রাজি হয় নি।সারাদিন রোডে ছিলো ড্রাইভার। তাই এখন সোজা বাড়ি যাবে। রোকেয়া বেগম অন্য দিকে যাচ্ছিল।তবে রিহান কে নিজের বাড়ির দিকে যেতে দেখে আর সেদিকে গেলো না।

কমলা বেগম মিরা’র মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। গায়ের কাপড় দিয়ে আবার একটু পরপর নিজের চোখের নাকের পানি এসে বিরক্ত করায় সেটা দিয়ে কাম সারছেন।বাড়ির গেইট বন্ধ আছে।মিরা কমলা বেগম এর রুমে আছে বর্তমানে। যদিও মিরা’র ঘুমানোর কোনো নিদিষ্ট স্থান নেই।নিজের এক্সট্রা রুম থাকা স্বত্তেও দাদি কিংবা মায়ের সাথে থাকে বেশিরভাগ সময়। কমলা বেগম এর রুমে জানলায় গ্রিল নেই।তিনি লাগাতে বারণ করেছিলো।এখান দিয়ে দক্ষিণা বাতাস আসে। ওনার ভালো লাগে ওখানে মোটা দেওয়াল টায় বসে বাতাস খেতে। পর্দা আছে। এদিকে তেমন মানুষের চলাচল নেই।বাড়ির পেছন দিকে।জানালার কপাট আটকাতে ভুলেছে তিনি। নাতনির শোকে।অল্পস্বল্প বাতাসে পর্দা দুলছে।
মিরা লাগাতার বিড়বিড় করে কিছু বলছে। কমলা বেগম নাতনির গায়ে হাত ঠেকিয়ে বসে আছে। হঠাৎ গেইটে ঠাশ ঠুশ করে শব্দ খুলে ধড়ফড়িয়ে কেউ রুমে এসে প্রবেশ করলো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটলো কমলা বেগম কিছু বোঝে উঠার আগেই লম্বা তাগড়া বলিষ্ঠ এক পুরুষ কক্ষে দেখে চমকে উঠলো। চোখে তিনি কিছু টা আবছা দেখেন।বয়স হয়েছে। তবে পুরুষ টা কাছে এসে ওনার পাশে দাঁড়াতেই ওনার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো,

-“রিহান দাদু ভাই!”

রিহান কমলা বেগম এর দিকে তাকানোর সময় পায় না।কিংবা এখন সেটা জরুরি না।তাই জিগ্যেস করলো,

-“কখন থেকে জ্বর?
ওর শরীর?”

বলতে বলতে মিরা কে কোলে তুলে। কমলা বেগম বুঝতে একটু বেগ পেতে হয়। তবে বাহিরে গাড়ির শব্দে তিনি বুঝতে পারে রিহান খবর পেয়ে গিয়েছে। আর হসপিটাল নিয়ে যেতে এসছে মিরা কে।
কমলা বেগম উত্তর দেয় না।কি বলবে?মিথ্যা? সেটা তো কিছুক্ষণের মধ্যেই রিহান ধরে ফেলবে।মেয়ে টার গায়ে যে মাইরের দাগ স্পষ্ট। তাই চুপ রইলো।পেছন পেছন দৌড়ে এলো।রিহান গাড়িতে পেছনে মিরা কে কোলে নিয়ে বসলো।কাজল গাড়ি স্টার্ট দিলো।মিরা ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে। শরীর আস্তে আস্তে শীতল হচ্ছে। রিহান মিরা কে নিজের কাঁধের উপর রেখে গায়ের জ্যাকেট খুলে।মিরা’র গায়ের উপর রাখে।
হসপিটাল পৌঁছে রিহান মিরা কে কোলে তুলে নিলো আবার।সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলো।হসপিটালের প্রায় সব কর্মচারী দৌড়াদৌড়ি করে যেভাবে পারে সাহায্য করলো।কেবিনে নেই।বাহিরে একটা স্ট্রেচারে শোয়াল।একজন নার্স মিরা’র জ্বর চেক করলো।একশো চার জ্বর।পুরো শরীর মারের দাগ দেখে রিহান এর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।রিহান কটমট করে তাকালো।নার্স কি ভাবছে রিহান মিরা কে মেরেছে? রিহান হয়তো বুঝতে পারে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

-“ও আমার ফুপিমণির মেয়ে।”

-“কিন্তু এভাবে কে মেরেছে ওকে?”

নার্স কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে।রিহান বিরক্ত হয়।আগে কখনো দেখে নি নার্স কে।হয়তো নতুন। তাই কথা টা একটু বেশি বলছে।রিহান বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,

-“আপনার জানতে হবে না। ডক্টর নেই আজ?”

-“আছে একজন।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।চলে আসবে। খবর পাঠানো হয়েছে।”

ডক্টর এলো।সব চেক করে বারবার রিহান এর দিকে তাকাল।কিছু বলার সাহস পেলো না। মিরা কে স্যালাইন দিতে হয়েছে।শরীরে ব্যাথা থেকে জ্বর এসছে।ব্যাথার ইনজেকশন দিয়ে তিনি কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।যাওয়ার আগে জানি গিয়েছে আজ পেসেন্ট এর জ্ঞান আর ফিরবে না।ইনজেকশনে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে।

মিরা’র মা সেই তখন থেকে বাহিরে বসে আছে। একমাত্র মেয়ে। ভালোবাসার মানুষ টার অংশ। শেষ চিহ্ন।মেয়ে কে রাগের প্রভাবে মারলেও রাগ পড়তেই একটুও শান্তি পায় নি।কষ্ট বুক চৌচির হয়ে আসছে।দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। কি করবে?অভিমান যে বড্ড খারাপ।বাবা-র উপর যে বড্ড অভিমান ওনার সেই ঊনিশ বছর আগে থেকে।
বাবা মা কেনো সন্তানের ভালোবাসা পছন্দ ভালো লাগা মেনে নিতে পারে না?তারা নিজেদের জেদ অহংকার কেনো সব সময় প্রাধান্য দেয়?কেনো গুরুত্ব দেয় না সন্তানের চাওয়া পাওয়া? তাদের মানসিক শান্তির কথা কেনো তারা ভাবে না?শুধু কি টাকা পয়সা সুখ মানসিক শান্তি থাকে?না শান্তি তখন লাগে যখন মানসিক শান্তি দেওয়ার মতো একটা মানুষ থাকে।অর্থসম্পদ এর চেয়ে ভালোবাসা থাকা টা জরুরি। যার মুখ দেখলে শত ক্লান্তির পরেও নিজের পরিশ্রম সারাদিনের কষ্ট মূহুর্তে গায়েব হয়ে যায়।যাকে দেখলে মনে হয় তারজন্য আমি সব করতে পারবো।
কিন্তু রমজান শেখ তো এসব ভাবে নি।মেয়ে কে বড় ঘরে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলো মেয়ের সুখ কোথায় কার সাথে মেয়ে সুখী হবে সে-সব ভাবে নি।জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকে বাবা-র উপর অভিমান শুরু হয়েছে রোকেয়ার।যা আজও চলমান। যদিও তিনি মাঝে বিরতি নিয়েছিলো।কিন্তু রমজান শেখ তখনো নিজের অহংকার দাম্ভিকতা নিয়ে থেকেছে। যতক্ষণে তিনি বুঝতে পারলো ততক্ষণে আর কিছু করার সময় ছিলো না।রোকেয়া মানে সে ভুল করেছে।সন্তান ভুল করলে বাবা মা সেটা শুধরে দেয়।ভুল করলে ক্ষমা করা যায়।তাহলে তার বাবা কেনো তার ভুল টা ক্ষমা করতে পারলো না? কেনো তার স্বামী জীবিত থাকতে তাদের মেনে নিলো না?মানলো তো কিন্তু আগে কেনো মেনে নিলো না?
রোকেয়া কথা গুলো ভাবতে ভাবতে এতো টা অন্যমনষ্ক ছিলো যে পাশে কেউ উপস্থিতি আছে টেরও পেলো না।
রিহান গম্ভীর। চোখ গুলো লাল।
সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই জিগ্যেস করলো,

-“কেনো মেরেছ ওকে?”

রোকেয়া চমকে ওঠে। পাশে তাকিয়ে রিহান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমথম খেলো। ফের দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দেওয়ালে তাকিয়ে রইলো। রিহান জানে তার ফুপিমণি কিছু বলবে না। তাই নিজে থেকে আবার বলে উঠলো,

-“আমার জন্য মেরেছ?
আমি চলে যাব কাল সকালে। মেয়ে কে সামলে রেখো।দ্বিতীয় বার ও স্বেচ্ছায় আমার সামনে এলে তোমায় কিন্তু আর ওর শরীরে আঘাত করার সুযোগ দেব না।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]