#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৩
#জান্নাত_সুলতানা
-“শাহনাজ আপা রিহান ভাই আসে নি?”
শাহনাজ মিরা’র ঔষধ আর প্রয়োজনীয় সব একটা পলিথিন ব্যাগে নিচ্ছে। ব্রেড এর প্যাকেট টা হাতে নিয়ে মিরা’র দিকে ফিরে তাকালো।মেয়ে টার শরীর জ্বরে এক দিনে কি অবস্থা হয়েছে। ঠোঁট গুলো শুঁকিয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো।মুখ টা কেমন মলিন দেখাচ্ছে।
শাহনাজ এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। মিরা’র বছর দুই এর বড়ো।শাহনাজ এর মা আর মিরা’র মায়ের মাঝে খুব ভালো বন্ডিং।কাল রাতে শাহনাজ মিরা’র দাদির সাথে ছিলো।আর শাহনাজ এর মা ছিলো রোকেয়ার সাথে। সকালে শাহনাজ এর মা বাড়ি চলে গিয়েছে। আর মিরা’র মা একটা কিন্ডারগার্টেনর শিক্ষক।মোটামুটি ভালোই বড় স্কুল টা।সকাল আটটা থেকে বেলা বারো টা পর্যন্ত সময় দিতে হয়।শাহনাজ আসার পর শাহনাজ কে মিরার কাছে রেখে তিনি স্কুলে গিয়েছে। মিরা তখন ঘুমে ছিলো।এখন বেলা দশ টা।মিরা কে রোকেয়া বেগম এর কাছে স্কুলে দিয়ে শাহনাজ ভার্সিটিতে যাবে। একটা ক্লাস আছে সাড়ে বারো টা বাজে।
শাহনাজ মিরা’র প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো নিজে প্রশ্ন করলো,
-“আসার কথা?”
মিরা’র মন খারাপ হয়।তার মানে আসে নি।কিন্তু ওর যে মনে হলো ও রিহান ভাই কে দেখেছে ছুঁয়েছে!তাহলে কি সে-সব স্বপ্ন ছিলো?শরীরে এখন ব্যাথা ততটা নেই।জ্বর কাল শেষ রাতে সেরে গিয়েছিল। মিরা আর কিছু বললো না। মন খারাপ করে মাথা টা নিচু করে রাখে।শাহনাজ মিটমিট করে হাসে।অতঃপর আবার কাজে মনোযোগ দিলো।কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ায় পর শাহনাজ স্বাভাবিক ভাবে নিজে থেকে বললো,
-“রিহান ভাইয়া তোকে হসপিটাল এনেছে কাল সন্ধ্যায়।”
মিরা অন্যমনষ্ক ছিলো। হঠাৎ কথা টা কানে প্রবেশ করলেও মস্তিষ্ক বিষয় টা বুঝতে সময় লাগলো।মিরা হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো।বিছানা ছাড়লো।মাথা চক্কর দেয়।কিন্তু সে-সব পাত্তা দেয় না।উত্তেজনায় দুই লাফে শাহনাজ এর কাছে এসে জিগ্যেস করলো,
-“এখন কোথায়?
বাহিরে?”
মিরা’র উচ্ছসিত মুখপানে তাকিয়ে শাহনাজ এর খারাপ লাগলো।আবেগের বয়স থেকে রিহান ভাই কে মিরা পছন্দ করে।বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবেগ মোহ,ভালো লাগা থেকে আস্তে আস্তে সেটা হয়তো ভালোবাসায় পরিণত হচ্ছে। মিরা যদিও মুখ ফুটে আজ অব্ধি শাহনাজ কে কিছু বলে নি।তবে শাহনাজ মিরা’র কথার দরুণ কিছু টা আন্দাজ করে মিরা রিহান ভাই কে ভালোবাসে। দুই পরিবার এর দন্ড ওর মনে সব সময় আতংক বিরাজ করে মেয়ে টার।শাহনাজ বুঝতে পারে না মিরা’র মা কেনো নিজের কষ্ট টা মেয়ে কে দিচ্ছে? দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে শাহনাজ। মলিন স্বরে উত্তর দিলো,
-“না রে।আজ ভোরে রিহান ভাইয়া আবার ঢাকা চলে গিয়েছে।”
মিরা’র মনঃক্ষুণ্ণ হলো।কেনো রিহান ভাই তাকে না দেখে চলে গেলো? কত মাস পরে এলো।ক’টা দিন কেনো থাকলো না গ্রামে? মিরা’র যে ওনাকে দেখার তৃষ্ণা একটুও মিটে নি।
শাহনাজ সব গুছিয়ে মিরা কে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো।সকালে মিরা’র মা সকল পেমেন্ট,ফর্মালিটি পূরণ করে গিয়েছে। তাই কোনো ঝামেলা হলো না। নিচ তলায় এসে মিরা অনেক খুশি হলো।তার দুই মামি নিচে বসে আছে। সাথে নানি।মিরা কে দেখে সবাই উঠে এগিয়ে এলো।মিরা খুশিতে সবাই কে একবার করে জড়িয়ে ধরে।
নানির সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উলটে মায়ের নামে নালিশ করলো,
-“নানু তোমার মেয়ে অনেক মেরেছে।
ব্যাথা পুরো শরীরে।”
নিনা বেগম নাতির কথা শুনে হু হু করে কান্না করে দিলো। জড়িয়ে ধরে নাতনি কে আদর করলো।মেয়ের রাগ একটু বেশি। তাই বলে এভাবে মারবে মেয়ে টাকে?লালচে দাগ গুলো শরীরে স্পষ্ট সাথে ফর্সা চামড়ায় বড্ড বেমানান লাগলো।আদর করে নাতনি কে স্বান্তনা দিলো।মেয়ে কে বকবে জানালো।যদিও সে-সব তিনি মেয়ে কে দেখলে কিছুই করতে পারবে না।মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। এতো অল্প বয়সে স্বামী মরে গেলো।জোর করে মেয়ের মন টায় তারা একটু বেশি আঘাত দিয়েছে একটা সময়। দিনের পর দিন মেয়ে কে স্বামীর আদেশে আঁটকে রাখতে হয়েছে। কিন্তু মা হয়ে মেয়ের কষ্ট চোখে দেখতে পারে নি।মেয়ের চাওয়া ভালোলাগা কে প্রাধান্য দিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলো মেয়ে কে।এটার জন্য অবশ্য ওনাকে কম খেসারত দিতে হয় নি।কত বকাঝকা খেয়েছে ছেলে স্বামী সবার কাছে। শুধু ছেলে বউয়েরা সাপোর্ট করেছে তাই তিনি ততটা ভেঙ্গে পড়ে নি।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্টে বসলো তারা।মিরা’র পছন্দের কত রকম খাবার অর্ডার করে যত্ন করে মিরা কে খাইয়ে দিলো। যদিও মিরা বেশি কিছু খেতে পারলো না। জ্বরে মুখে খাবার এর স্বাদ পেলো না।
গাড়ি করে এসছে সবাই।শেখ বাড়ি পর্যন্ত মিরা আর শাহনাজ কে নামিয়ে দিলো।বাকি পথ টা শাহনাজ আর মিরা হেঁটে পৌঁছাল। রোকেয়া বেগম ক্লাসে ছিলো।মিরা কে শাহনাজ অফিস কক্ষে বসিয়ে রোকেয়া বেগম কে বলে তারপর ভার্সিটিতে চলে গেলো।
রোকেয়া আজ এক ঘন্টা আগে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো।আজ সকালে রান্না করে নি।শাশুড়ী কে নাস্তা কিনে খাইয়ে স্কুল চলে এসছে। মন টা মেয়ের জন্য ছটফট করে বাড়িতে গিয়ে মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না করবে।তাই আসার সময় মা মেয়ে বাজার করে বাড়ি এলো।বাড়িতে এসে দেখলো কমলা বেগম চুলায় রান্না বসিয়েছে।রোকেয়া এসব দেখে একটু রেগে গেলো।কমলা বেগম এর হার্ট এর সমস্যা আছে আগুনের কাছে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ডক্টর। রোকেয়া শাশুড়ী কে উঠিয়ে নিজে রান্না করতে বসলো।কমলা বেগম ভাত আর ডাল রান্না করছে। সাথে আলু সিদ্ধ দিয়েছে। রোকেয়া বেগম সকালে কিছু খায় নি।স্কুল থেকে ফিরে রান্না করে খেতে হবে। অনেক দেরি হবে সেইজন্য ওনি আগে আগে রান্না বসিয়েছে।
কমলা বেগম নাতনি কে গোসল করতে সাহায্য করলো।নাতনীর কাপড় ধুয়ে দিলো।মিরা নিজে করতে চাইলে ধমকে ধামকি দিয়ে ঘরের ভেতর পাঠিয়ে দিলো।নিজে গোসল শেষ রোকেয়া বেগম এর হাতে হাতে সব গুছিয়ে নিলো।রোকেয়া সব গুছিয়ে নিজে গোসল করতে গেলো।মনে মনে শাশুড়ীর প্রতি শ্রদ্ধা আরো দিগুণ হলো।কত টা ভালোবাসে মানুষ টা দুই মা মেয়ে কে সেটা ভেবে চোখ ভিজে উঠে।
বিকেলে দু’টো নাগাদ খাবার খেলো সবাই। খাবার শেষ মিরা ঔষধ খেয়ে দাদির রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লো।রোকেয়া রাতের জন্য মেয়ের পছন্দ মতো বিরিয়ানি রান্না করতে ব্যাস্ত হলো।
——
মিরা মাগরিব এর আযান এর সময় ঘুম থেকে উঠলো।কেউ ডাকে নি।ইচ্ছে মতো ঘুমিয়েছে। রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের রুমে একবার উঁকি দিলো। দাদি আর মা এক সাথে নামাজ পড়ছে।মুগ্ধ হলো মিরা।কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চট করে ঘরের ওয়াশ রুমে গিয়ে ওজু করে এলো।দাদির পাশে দাঁড়িয়ে নিজেও নামাজ পড়লো।রোকেয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।বড্ড সরল তার মেয়ে টা।মন টা একদম নরম।মেয়ে টা অভিমান ব্যতিত আর কিচ্ছু করে না কখনো। রাগ কি জিনিস হয়তো জানেই না।এই যে মা তাকে এতো মারলো মায়ের সাথে একটু রাগ করলো না। কিংবা ক্রুদ্ধ নয়নে তাকলো পর্যন্ত না।কথাবার্তা সব ঠিক আছে। শুধু একটু অভিমান যে করেছে রোকেয়া বুঝতে পারে।
এশার নামাজের আগে খাবার খেয়ে নিলো সবাই। রোকেয়া মেয়ের জন্য একটা প্লেটে এক প্লেট বিরিয়ানি ঢেকে শাশুড়ির রুমে রেখে এলো।মেয়ে আজ দিনে ঘুমিয়েছে। রাতে যে জেগে থাকবে তা তিনি নিশ্চিত।
কমলা বেগম নামাজ পড়ে আর বসে থাকতে পারলো না। কাল সারারাত নাতনির চিন্তায় ঘুম হয় নি।ঘুম না হলে প্রেশার বেড়ে যায়। তাই একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিলো আজ।
মিরা একটা চার্জার লাইট লাগিয়ে পড়তে বসলো।কিছু দিন পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। মিরা টেস্টে ভালো রেজাল্ট করেছে।এখন ভালোই ভালোই ফাইনালে একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারলে হয়।কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছে না।মন টা বড্ড অস্থির অস্থির করছে।
রিহান নামক সুদর্শন পুরুষ টাকে একপলক দেখার জন্য মন টা কেমন উতলা হচ্ছে।আনমনে বই খাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন যে রাত এগারো টা বেজে গেলো বুঝতে পারলো না। দাদির ঘনঘন নিঃশ্বাস এর শব্দে মিরা বুঝতে পারে দাদি গভীর ঘুমে।এই ঘুম আর রাতে ভাঙ্গার নয়।মন চাইলো একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে দাদির মতো নাক ঢেকে ঘুমিয়ে থাকতে।
জানালার পর্দা দেওয়া। মিরা কপাটি লাগাতে গেলো।একটা কপাট লাগিয়ে আরেকটায় হাত রাখতেই মানুষের ফিসফিস আওয়াজ পেলো।ভয় ধরলো মনে। একটু উঁকি দিয়ে দেখলো রাস্তা বরাবর আবছা আলোয়ে দু’জন মানুষ সহ জিপগাড়ি টা।স্পষ্ট নয়।মিরা থমকে গেলো। অস্ফুটে স্বরে বলে উঠলো,
-“রিহান ভাই এর জিপগাড়ি। কাজল ভাইয়া আর ইফাদ ভাইয়া।ওনি কোথায়?”
ঠিক তক্ষুণি মিরার হাতের উপর একটা শক্ত হাতের স্পর্শ পেলো।এক ঝটকায় দূরে সরে আসতেই এক লাফে বলিষ্ঠ তাগড়া পুরুষ রিহান ভাই জানালা টপকে কক্ষে প্রবেশ করলো। মিরা চমকে উঠলো। নিজের অজান্তেই এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে।
রিহান ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে মিরা’র দেহ টা কে নিজের বুকে আগলে ধরলো।মিরা ফুপিয়ে উঠলো।রিহান ভড়কে গেলো।পাশের রুমে রোকেয়া বেগম। শুনলে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না। রিহান মিরা কে শান্ত হতে বললো।কিন্তু মিরা শুনলো না। রিহান কি করবে এই মূহুর্তে এই মেয়ের কান্না কি করে বন্ধ করবে কোনো উপায়ন্তর খোঁজে পেলো না।চট করে শুধু মনে হলো মুখ টা কোনো পদ্ধতি বন্ধ করা যাক।আর সেটাই করলো।মিরা শুধু চুপ করে সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা করলো।চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে চার্জার লাইট এর স্বল্প আলোর মাঝে রিহান ভাই এর গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ব্যতিত আর কিচ্ছু চোখে পড়লো না।
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]