#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৪
#জান্নাত_সুলতানা
মিরা স্তব্ধ। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অনুভূতি হলো না কোনো রকম।শুধু বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে। কি হলো একটু আগে?রিহান ভাই কি করলো এটা?এটা কিস?নাহ লিপ কিস।শাহনাজ আপার ফোনে দেখেছে সে।একদিন একটা ইংলিশ মুভিতে এমন করে নায়ক তার নায়িকা কে চুমু খেয়েছিলো।কিন্তু নায়ক নায়িকা তো দীর্ঘ সময় একে-অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে আবদ্ধ ছিলো।কিন্তু রিহান ভাই?পাঁচ সেকেন্ড? না-কি আরো একটু বেশি সময় ছিলো?মিরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জা ভয় না-কি অস্বস্তি মাথা তুলে তাকাতে পারে না। রিহান নিজেও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তার শেওলা রঙের জ্যাকেট।তার নিচে সবুজ রঙের গেঞ্জি।
মাথা ভর্তি ঘন চুল।খাঁড়া নাক।ছোট ছোট চোখ। মোটা ভ্রু জোড়া।সেগুলো আড়াআড়ি ভাবে কুঁচকে রেখেছে। তাকিয়ে আছে মিরা’র দিকে।মেয়ে টা কি রেগে গেলো?
রিহান মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলো।তবে মন বললো মেয়ে টা শকট। কোনো অনুভূতি নেই।নয়তো এতো সময় চুপ থাকার মেয়ে তো সামনে দাঁড়ানো কিশোরী নয়।রিহান কিছু বলবে হুট করে নজর পড়লো টেবিলের উপর রাখা প্লেটে।ঢেকে রাখা কি আছে বুঝতে অক্ষম। মিরা’র দিকে একবার তাকিয়ে ভাবলো এই মেয়ে কি খাবার খায় নি?রিহান গম্ভীর স্বরে জিগ্যেস করলো,
-“খাবার খেয়েছিস?”
মিরা মাথা নিচু রেখে শুধু ঘাড় নাড়ে। যার অর্থ খেয়েছে। রিহান ভ্রু কুঁচকে নেয়।মিরা চট করে মাথা উঁচু করে রিহান এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“আম্মা বিরিয়ানি রেঁধেছে রিহান ভাই।
আপনি বসুন না!”
রিহান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। কি অদ্ভুত মেয়ে। একটু আগে না লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলো না আর এখন? রিহান বসলো না।মিরা গিয়ে বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে এসে রিহান এর সামনে দাঁড়ালো। রিহান ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জিগ্যেস করলো,
-“মেডিসিন নিয়েছিস?”
-“হ্যাঁ।
আম্মা খাবার এর পর খাইয়ে দিয়েছে।”
মিরা জানালো।রিহান পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নেয়।টেবিলের উপর বই খুলে রাখা আছে। সেটা দেখে নিশ্চিত হলো মিরা তবে পড়তে বসে ছিলো।রিহান সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিরা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আর পড়তে হবে না।
ঘুমিয়ে পড়।”
মিরা’র মন খারাপ হয়।রিহান এর মুখ দেখে বুঝলো মানুষ টা ক্লান্ত।হঠাৎ মনে হলো মানুষ টা সকালে ঢাকা চলে গিয়েছিল। তবে এলো কখন? এখন? যদিও এমনটাই হয় তবে যে অনেক টা পথ জার্নি করে এসছে। নিশ্চয়ই কিছু খায় ও নি।মিরা মন খারাপ হয়।মন খারাপ করে জিগ্যেস করে,
-“আপনি বিরিয়ানি খাবেন না রিহান ভাই?”
-“আমি বলেছি খাব?”
রিহান ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো। মিরা থমথম খেলো। এভাবে বলার কি আছে? ও তো নিজে থেকে জিগ্যেস করেছে। এতো পেঁচানোর কি আছে ভেবে পেলো না। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই রিহান উলটো ঘুরে জানালার কাছে চলে গেলো। তারপর জানালা দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেলো।অবশ্য যাওয়ার আগে বলে গিয়েছে মিরা যেন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে।
মিরা মন খারাপ করে বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে খাওয়ার ঘরে ফ্রিজে রেখে এলো।একটু অভিমান জমা হলো মনে। কথা বলবে না আর পুরুষ টার সাথে। কিভাবে চলে গেলো এমন করে?একটু তো খেতে পারতো।আর যাবে না মানুষ টার সামনে। কথা বলবে না।জানলা বন্ধ করতে গিয়ে নজর পড়ে রিহান ভাই এর জীপগাড়ি তখনো দাঁড়িয়ে আছে।দু’জন গাড়িতে পেছনের সিটে বসা।মিরা বুঝতে পারে পেছনের দু’জন ইফাদ আর কাজল ভাই।আর গাড়ির সাথে দাঁড়িয়ে আছে রিহান ভাই। হাতে কিছু মিটমিট করে জ্বলছে। মিরা’র মস্তিষ্ক চট করে বুঝে গেলো সিগারেট খাচ্ছে রিহান ভাই। কিন্তু কেনো খায় এসব?কিসের অভাব? টাকাপয়সা ধনসম্পদ নিজের সুন্দর একটা পরিবার। মাথার উপর এখন গার্ডিয়ান হিসেবে দাদা বাবা চাচা রয়েছে। কিসের এতো টেনশন ওনার?তবে কি রিহান ভাই শখ করে সিগারেট খায়?দুঃখে নয়?সিগারেট এর মিটমিট আগুন এদিকে ঘুরতে দেখে মিরা ঝটপট জানালা বন্ধ করে। সরে আসে। বিছানায় শুয়ে গায়ে কাঁথা টেনে নিলো।চোখের কিনারে জমে থাকা জল মুছে নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
-“আমি কি আসতে বলেছি আপনাকে?না-কি আমি আপনার সামনে গিয়েছি?আপনি এসছেন কেনো?আর আসবেন না। আমিও যাব না।পাষাণ পুরুষ। একটু মায়া নেই মনে।”
—–
মিরা দু’দিন কলেজ যায় নি।আজ যাবে। সাথে যাবে রোকেয়া। মেয়ের ফাইনাল এক্সাম শুরু হতে বেশী সময় নেই।।হয়তো কিছু দিনের মধ্যে টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে।
পড়ালেখা নিয়ে সচেতন বেশ রোকেয়া।মেয়ে লেখা পড়া করবে। চাকরি করবে।নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এমনটাই চায় রোকেয়া বেগম।
রোকেয়া মেয়ে কে কলেজ দিয়ে তারপর নিজে স্কুল গেলো।অনেক টা উলটো ফিরে আসতে হলো।তাতেও কোনো সমস্যা নেই। মেয়ের জন্য সব করতে পারবে।
মিরা কলেজ যাওয়ার সময় অটোরিকশা থেকে চারপাশে নজর ঘুরিয়ে চুপিচুপি খুঁজল রিহান ভাই কে।কিন্তু কোথাও দেখতে পেলো না।সেদিন রাতের পর আর দেখা যায় নি পুরুষ টাকে।তবে কি চলে গিয়েছে আবার? কিন্তু শাহনাজ আপা যে বললো যায় নি!
ক্লাসে একটুও মন টা বসলো না মিরা’র।সারাক্ষণ মনের মধ্যে রিহান ভাই কে নিয়ে মাতামাতি হলো।একটা ক্লাসে অবশ্য অমনোযোগী ছিলো সেজন্য দশ মিনিট কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এতেও মিরা’র কোনো হেলদোল হলো না। এভাবে ক্লাস করলো।কলেজ ছুটির পর মিরা গেইট দিয়ে বেরিয়ে দেখলো রোকেয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছে গেইট এর বাহিরে। দূরে কাজল ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আজ কোথাও জিপগাড়ি নেই।তবে কি সত্যি রিহান ভাই ঢাকা চলে গেলো? রোকেয়া মেয়ে কে নিয়ে ফুচকা দোকানে গেলো।মা মেয়ে দু’জন মিলে ফুচকা খেলো।
অতঃপর অটোরিকশা করে বাড়ি ফিরলো।
—–
কমলা বেগম আর রোকেয়া। দুই বউ শাশুড়ী মিলে বাড়ির পেছনে দিকে যায়গায় অনেক রকম সবজি গাছ লাগিয়ে রেখেছে।তাতে করে সবজি টা বেশি কিনতে হয় না তাদের। বিশাল বড়ো এই বাড়িতে খালি যায়গা গুলো কিছু না কিছু সবজি ফল প্রয়োজনীয় গাছ লাগিয়ে ভরপুর করেছে। এই যে এখন শরৎকালীন অনেক রকম সবজি গাছ লাগিয়েছে এখানে। কমলা বেগম সেগুলো ঘাস পরিষ্কার করছে। সাথে মিরা নিজেও দাদি কে সাহায্য করছে।গাছে পানি দিচ্ছে।আসরের আযান পড়েছে অনেক টা সময় হলো।মিরা নামাজ পড়ে তবেই এসছে। কমলা বেগম হাতের কাজ টা শেষ করে মিরা কে বলে বাড়ির উঠোনের দিকে গেলো ওজু করে নামাজ পড়তে গেলো।।মিরা বালতি থেকে পানি নিয়ে মগ দিয়ে গাছে দিচ্ছে। মন টা বড্ড খারাপ। আজ পাঁচ দিন ধরে রিহান ভাই এর কোনো দেখা নেই। আজ বৃহস্পতিবার।কাল কলেজ বন্ধ। মনে মনে অভিমান জমে আছে সেই রাতের পর থেকে।কোনো পুরুষের অধর ছোঁয়া মেয়ে টার মন কেমন উতালপাতাল হয়ে আছে? এটা কেমন স্পর্শ ছিলো ভেবে পায় না মেয়ে টা।কেনো এমন করেছিলো রিহান ভাই?যদি ভালোবেসে কিছু করে থাকে তবে কেনো এই ক’দিন একবার ও এলো না?এবার যদি আসে মিরা কিছুতেই ওই লোকের সাথে কথা বলবে না।যাবেই না সামনে।হুঁ তখন ভালো হবে। তখন কি ওর মতো রিহান ভাই ও ছটফট করবে অস্থির হয়ে ছুটে আসবে? পরক্ষণেই ভাবে রিহান ভাই কেনো অস্থির হবে? সে কি মিরা কে ভালোবাসে?মটেও না।এই পাষাণ পুরুষ মিরা কে কিছুতেই ভালোবাসতে পারে না।হয়তো দুই পরিবার এর মাঝে মিমাংসা করার জন্য হুটহাট দেখা করে তার সাথে।
-“মিরা?”
হঠাৎ শাহনাজ এর কণ্ঠ শুনে মিরা কিছু টা চমকে উঠে।তবে নিজে কে ধাতস্থ করে হাতের মগ ফেলে এগিয়ে এলো শাহনাজ এর কাছে। শাহনাজ কেমন চারদিকে চোরের মতো উঁকিঝুঁকি মারছে।মিরা সে-সব ধ্যান নেই। সে দুই লাফে এগিয়ে এসে শাহনাজ এর সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেঁসে বললো,
-“শাহনাজ আপা।
তুমি এসছো ভালো হয়েছে। মা বলেছি চাচি কে ডাকার জন্য।”
শাহনাজ হাসার চেষ্টা করে। মিরা ভ্রু কুঁচকে নেয়।এভাবে তাকায় কেনো আপা?এমন কেনো করছে?মিরা জিগ্যেস করলো,
-“আপা তুমি অসুস্থ?”
-“আরে না।শোন তুই তোকে রিহান ভাইয় যেতে বলেছে আমাদের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে।অপেক্ষা করছে ওনি।”
শাহনাজ এর কথায় মিরা চুপ করে গেলো।মুখ গম্ভীর করে নিলো।একটা মন বললো মানুষ টাকে একপলক দেখার জন্য তো আরেক মন বলছে না।অভিমান করেছিস তুই যেতে পারবি না। মিরা ফিরে গেলো বালতির কাছে।মগ হাতে নিয়ে মরিচ গাছে পানি দেয়।শাহনাজ বুঝতে পারে মিরা যাবে না। কিন্তু রিহান ভাই যা মানুষ মেরেই ফেলবে মিরা যদি আজ না যায়।শাহনাজ এগিয়ে এলো মিরা’র পেছনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই মিরা বলে উঠলো,
-“আমি যাব না আপা।তুমি বাড়ি যাও।
ওনার সাথে যখন-তখন দেখা করার মতো কোনো সম্পর্ক আমাদের মাঝে নেই।ওনাকে বলে দিও।”
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]