পিঞ্জিরা পর্ব-০৮

0
11

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৮
#জান্নাত_সুলতানা

রমজান শেখ গম্ভী, রাগী স্বভাবের হলেও মন টা বেশ নরম।বয়স হয়েছে। তবে এখনো বেশ শক্তপোক্ত পুরুষ টা।রিহান দাদার কক্ষে এসে দরজায় দাঁড়ালো। দাদি নিনা বেগম রুমে নেই।রিহান সবাই কে লিভিং রুমে দেখে এসছে।রাত আটটা বাজে।খাওয়ার সময় হয়ে আসছে। তাই লিভিং রুমে সবাই এখন আড্ডা দিচ্ছে।

-“দাদাজান আসবো?”

রমজান শেখ ইজি চেয়ারে বসে ছিলো বই নিয়ে। রিহান কে দেখে বই রেখে চশমা খুলে বই সহ সেন্টার টেবিলের উপর রেখে চমৎকার হেঁসে বলে উঠলো,

-“আরে আমার দাদু ভাই যে!এসো এসো।”

রিহান ততক্ষণে রুমের ভেতরে চলে এসছে। একটা চেয়ার টেনে দাদুর এক পাশে বসলেন।জিগ্যেস করলো,

-“শরীর ভালো তোমার?”

-“সে-তো ভালো।কিন্তু তোমার উদাসীনতার কারণ কি দাদু ভাই?”

রমজান শেখ প্রথমে হাসি হাসি মুখে জানালেও পরে চিন্তিত কণ্ঠে রিহান কে প্রশ্ন করে। রিহান চুপ থাকে।রমজান শেখ নাতির গম্ভীরতা দেখে আর বেশি ঘাঁটল না তেমন।এড়িয়ে গেলো।বললো,

-“তোমার মামার সাথে কথা হয়েছে।
তোমায় প্রার্থী তালিকায় দিতে চাচ্ছে।”

-“আমি এ-সব করতে চাই না দাদাজান।
ব্যবসা তো এখন আমিই দেখি।”

রিহান নিজের মতামত প্রকাশ করে। সে নিশ্চিত দাদা জান বিষয় টা বুঝতে পারবে।তার সিদ্ধান্ত কেও সম্মান করবে।রমজান শেখ কিছু সময় চুপ করে থেকে ঘাড় নেড়ে বলে,

-“তা তো দেখবে।কিন্তু নিজে কিছু,,

-“মন দিয়ে বিজনেস টা করতে চাই।তোমাদের টা না হলে নিজের টা।”

রিহান এবারও আগের ন্যায় কণ্ঠে জানায়।রমজান শেখ হয়তো নাতির মনোভাব বুঝতে সক্ষম হয়।তাই সম্পূর্ণ খোলামেলা করে নিতে বিষয় টা জানতে চাইলো,

-“এটাই তোমার ফাইনাল ডিসিশন?”

-“তোমার ইচ্ছে থাকলে বলো।আমি নির্বাচনে দ,,,

রমজান শেখ নাতি কে সম্পূর্ণ কথা শেষ করে না দিয়ে মুচকি হেঁসে বলে উঠলো,

-“কখনো না।তোমার ইচ্ছে কে আমি সর্বদা সাপোর্ট করে মর্যাদা দিয়ে এসছি।এবারও দেবো।”

রিহান দাদার কথায় মৃদু হাসলো।রাগী হলেও মন বেশ নরম। আরো কিছু টুকটাক কথা বলে খাবার এর জন্য ডাক পড়ায় তারা ডাইনিং-এ এলো।

শেখ পরিবারে সদস্য সংখ্যা বর্তমানে নয় জন।ইফাদ, রিহান,রমজান শেখ ওনার স্ত্রী আর রিহান এর বাবা মা সাথে ইফাদ এর ছোট বোন ঈশিতা সহ বাবা মা।একান্নবর্তী পরিবার তাদের।আর শেখ বাড়ির বড়ো দুই মেয়ে কে অনেক আগেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

-“ঈশি পড়াশোনার কি অবস্থা?দিনকাল কেমন চলছে?”

রিহান খাবার খেতে খেতে জিগ্যেস করলো। ঈশিতা এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।ইফাদ বোনের মাথায় গাট্টা মেরে বোঝালো রিহান এর প্রশ্নের উত্তর দিতে।মূলত এটা করার কারণ হচ্ছে ঈশিতা চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। ভীষণ দুষ্ট। বাড়ির ছোট সদস্য হওয়ার দরুণ কমবেশি সবার আদরে আদরে বাঁদর হয়েছে। বাড়িতে কাউ কে যদি একটু ভয় পায় সেটা হচ্ছে বাবা ইব্রাহীম শেখ আর চাচাতো ভাই রিহান শেখ। ঈশিতা মিনমিন করে জনালো,

-“ভালো ভাইয়া।”

-“এক্সাম না সামনে?এক্সাম শেষ হলে ঢাকা নিয়ে যাব।শিরশির আপুর সাথে থাকবে।”

রিহান যেন সুযোগ বুঝে নিজের মতামত পেশ করে দিলো।সে জানে ঈশিতা গ্রামে থাকলে ডিঙি পানা করেই বেড়াবে।কাউ কে মানে না। তাই এটাকে এখন থেকে নাগাল ধরতে হবে।ঈশিতা অবশ্য খুশি হলো।শিশির আপু খুব ভালো এবার বাংলা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করছে।এক সাথে থাকতে পারবে ভেবেই আনন্দে আর কিছু বললো না। আর না বড়রা কেউ কিছু বললো।রিহান যে খারাপ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবে না সে ভরসা সবার আছে।
সবাই গল্প গুজব আড্ডায় খাবার শেষ করে রাতে ঘুমতে চলে গেলো।

—–

-“কাজল ভাই আপনার নাম টা মেয়ের নাম।কে রেখেছে বলুন তো?”

মিরা’র এমন প্রশ্নে কাজল সহ সবাই থমথম খেলো। ইফাদ ব্যতিত। সে হু হা করে হেঁসে উঠলো। কাজল অসহায় চোখে রিহান এর মুখের দিকে তাকালো।কাজল এর মা কারিরা বেগম। নাম টার অর্থ যেমন আনন্দিতা ঠিক মানুষ টাও তেমন হাসিখুশি আনন্দে থাকে সর্বক্ষণ।তারউপর আতিক চৌধুরী আরো সৌখিন মানুষ। স্ত্রী কে তিনি অনেক ভালোবাসা আর আদরে রেখেছে হয়তো এখনো রাখে।কারিরা বেগম এর বিয়ে হয়েছিল অল্প বয়সে। গ্রামের মেয়ে ছিলেন।তবে আতিক চৌধুরী স্ত্রী কে যথেষ্ট সময় দিয়েছে।লেখাপড়া করিয়েছে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই তিনি কনসিভ করেছিলেন। তখন প্রথম সন্তান। অনুভূতি আনন্দ সব একটু বেশি।শখ করে তখন আট মাস চলাকালীন তিনি নাম ঠিক করেছিলেন।ওনার ধারণামতে মেয়ে হওয়ার কথা। তবে হলো ছেলে।পরে এই নাম-ই রাখা হলো।বিশেষ করে আতিক চৌধুরী স্ত্রী ইচ্ছে কে প্রাধান্য দিয়েই এই নাম রেখেছে। যদিও কাজল শুনেছে তার মা নাম পরে বদলাতে চেয়েছিলেন তবে পরবর্তীতে সেটা আর করে নি।বড় হওয়ার পর কাজল অবশ্য প্রথম প্রথম নাম টা নিয়ে ট্রলের শিকার হলেও আস্তে আস্তে সেটা একদম শূন্যের কোঠায় এসে পড়েছে।কিন্তু কাজলের এই নাম নিয়ে কখনো কোনো খারাপ লাগা কাজ করে নি।আজ বহুদিন পর এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হলো কাজল।কাজল মৃদু হেঁসে মিরা কে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই রিহান তার আগেই গম্ভীর স্বরে মিরা’র প্রশ্নের উত্তরে বলে,

-“সেটা না হয় সময় মতো মামুনি কে জিগ্যেস করে নিস।”

মিরা মুখ ভেংচি কাটে।জীবনেও পুরুষ টা একটু ভালো করে কথা বললো না মিরা’র সাথে। মিরা দুঃখে দুঃখিত হতে আরো একটা খবর কাজল মিরা কে দিলো।

-“রিহান ঢাকা চলে যাবে আজ।আমিও থাকবো না। খুব তাড়াতাড়ি আসাও হবে না। পরীক্ষা না সামনে। মন দিয়ে পড়বে মিরা বেগম।”

মিরা’র মন টা খারাপ হয় নিমিষেই। রিহান ভাই এর দিকে তাকিয়ে দেখলো রিহান উলটো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। মিরা এটা দেখে আরো খারাপ লাগে।মানুষ টা আবার চলে যাবে।কবে আসবে আবার? মিরা’র জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু জিগ্যেস করলো না। মাথা নিচু করে বললো,

-“দেরি হচ্ছে কাজল ভাই। বাড়ি যাই।আম্মা চিন্তা করবে।”

কাঠফাটা রোদের মাঝে মিরা রাস্তায় উঠে হাঁটা ধরে।এতো সময় তারা মোড়ের দোকান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো।রিহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে গাড়িতে বসে।ভালোবাসা অদ্ভুত। এটা কিভাবে কখন হয়ে যাবে যে ভালোবাসবে সে নিজেও বুঝতে পারবে না।
ঠিক যেমন রিহান বুঝতে পারে নি।এক বছর আগেও না।যখন গ্রামে ছিলো তখন তো একদমই নয়।ঢাকা যাওয়ার পরেই না অনুভূতি বুঝতে সক্ষম হলো।কিন্তু এটা না বুঝলেই বুঝি ভালো হতো।বোঝার পরই না বুঝতে পারলো এটার পরিণয় দেওয়া যে খুব সহজ একটা হবে না।

——

শাহনাজ এর মা মাগরিবের নামাজ এর পর মিরাদের বাড়ি এলো।মিরা তখন দাদির সাথে দাদির রুমে। রোকেয়া নামাজ পড়ে জায়ের সাথে বাহিরে এসে বসলো।আবছা অন্ধকার। শাহনাজ এর মা রয়েসয়ে কিছু সময় আলাপ করে রোকেয়ার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে। রোকেয়া যে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে বুঝতে পেরে বললো,

-“আমার এক চাচাতো বোনের ছেলে আছে। বিদেশ থাকে। মেয়ে খুঁজে বিয়ের জন্য। আমাদের শাহনাজ এর জন্য বলেছিলো।কিন্তু শাহনাজ এর আব্বা রাজি না।”

-“সে কি কথা ভালো ছেলে পাওয়া গেলো রাজি হচ্ছে না কেনো?মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না!”

রোকেয়া বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বলে।শাহনাজ এর মা খুব বেশি কঠিন নয়।খুব সহজ সরল মনের মানুষ। স্বামী বিদেশ মেয়ে কে নিয়ে গ্রামে তাকে কেউ একটা খারাপ বলতে পারবে না।সবার সাথে কমবেশি মিশে।রোকেয়া জানে শাহনাজ এর মা হয়তো অন্য চিন্তা থেকে তার সাথে এসব বলছে।যদিও সংসারের খুঁটিনাটি সব বিষয় তিনি রোকেয়ার সাথে শেয়ার করে।শাহনাজ এর মা বললো,

-“যাগগে তিনি রাজি না হলে আমি আর কি করবো!তা বলছিলাম আমাদের মিরা তো দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেলো।বিয়ে টিয়ে ধরবা?তাহলে আমি আমার আপার সাথে কথা বলবো।”

মিরা এদিকে আসছিলো।কারেন্ট নেই। ঘরে চার্জার লাইট জ্বলছে।মানুষ দেখা যাচ্ছে না। মিরা শাহনাজ এর মায়ের কথা শুনে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলো।মায়ের উত্তর কি হবে ভেবেই মিরা’র গলা শুঁকিয়ে আসে। ত্বরিত রিহান ভাই এর কথা মনে পড়লো।দুরদুর বুক নিয়ে মায়ের উত্তর শোনার জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ করে দরজার পাশে গাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।

-“মিরা’র সামনে পরীক্ষা।”

রোকেয়া অকপট জানায়।কোনো ভাবনা চিন্তা নেই।মিরা নিশ্চিত হয় না।যদি রাজি হয়ে যায় তার মা?এমন নয় সে সুন্দরী নয় তাকে পাত্র কিংবা মানুষজন দেখলে পছন্দ হবে না। সে সুন্দরী। যথেষ্ট সুন্দরী। লম্বা, চেহারা, বডি ফিটনেস সব ভালো। যে কারোর নজরে পড়ার মতো সুন্দরী।তার মা রাজি হয়ে গেলো?
মিরা’র চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।হাত কচলাচ্ছে।শাহনাজ এর মা ফের বলে উঠলো,

-“এক্ষুণি দিতে হবে না-কি? ছেলে দেশে আসতে আরো মাস তিন এক লাগবে।তুমি শুধু বলো।আগে আগে সব ঠিক করে রাখবো।”

#চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]