পিঞ্জিরা পর্ব-০৯

0
5

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৯
#জান্নাত_সুলতানা

-“তোর মা রাজি হয়েছে?”

মিরা হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়,

-“নাহ।”

-“কি বললো?”

শাহনাজ ফের কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো। মিরা দাঁড়িয়ে গেলো এপর্যায়ে।আশপাশে তাকিয়ে মানুষ আছে কি না পর্যবেক্ষণ করে নিলো।এখানে তেমন মানুষ নেই।গ্রামে এদিকে তেমন বাড়ি নেই।পিচঢালা রাস্তার এক পাশ দিয়ে ছোটখাটো একটা খাল বয়ে গিয়েছে। আরেক পাশ দিয়ে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতে দূরে অবশ্য এক দুইজন মানুষজন দেখা যাচ্ছে। তবে তাদের এদিকে খেয়াল নেই। মিরা গায়ের ওড়না টা নিজের মায়ের মতো করে বড় একখানা ঘোমটা টানলো।ঠোঁটের কোণে হাসি হাসি ভাব নিয়ে রোকেয়া বেগম কে অনুকরণ করে বলে উঠলো,

-“না ভাবি।আমার মিরা কে বিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা এখন নেই। আমার মেয়ে লেখাপড়া করবে।এটা বলেছে।”

শেষের কথা টা বলতে গিয়ে ঠিক রোকেয়া বেগম এর মতো মুখ টা গম্ভীর করে নিলো।শাহনাজ উত্তর এরচেয়ে মিরা’র কথা বলার স্টাইল দেখে ফিক করে হেঁসে দিলো।মিরা ঠোঁট এলিয়ে নিজেও হাসে।শাহনাজ হাসি হঠাৎ থামিয়ে মিরা’র গাল টেনে দিয়ে বললো,

-“বেঁচে গেলি।মায়ের ওই বোনের ছেলে বাবা-র সাথে কাজ করে। বাবা-র থেকে একটু উপরের লেভেলের। ব্যবহার ভালো না।তাছাড়া বিদেশ যাওয়ার পর খারাপ হয়ে গিয়েছে।”

-“যাকগে সে-সব জেনে আমার কাজ নেই।”

মিরা হঠাৎ কিছু মনে পরে মন খারাপ হয়।শাহনাজ মিরা’র মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারলো হয়তো। বললো,

-“টেস্ট পরীক্ষা তো শেষ হয়ে গেলো।
তা রেজাল্ট কবে আসবে?”

-“পরশু দিয়ে দিয়েছে আপাহ।”

-“রেজাল্ট ভালো আসে নি?”

মিরা’র মুখ উত্তর দিতে হলো না। শাহনাজ মিরা’র মুখ দেখে বোঝে নিলো। এক হাত হাল্কা করে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“মন খারাপ করিস। মন দিয়ে পড়।ফাইনালে ভালো হবে ইনশাআল্লাহ।”

-“কি করে?
মন টা কিছুতেই পড়ায় দিতে পারছি না।আজ পয়তাল্লিশ দিন হয়ে গেলো। রিহান ভাই গ্রামে আসে না। কোনো খবর নেই মানুষ টার।ঠিক আছে কি-না কে জানে!”

শাহনাজ প্রায় অনেক দিন পর বাড়ি এসছে। মামাবাড়ি ছিলো এতো দিন। মাঝে অবশ্য গ্রামে এসেছিলো।তবে মিরাদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পায় নি।গতকাল বাড়ি ফিরেছে।আর আজ সকাল থেকে দু’জন একে-অপরের সাথে এতোদিন জমা সব কথা উগড়ে দিচ্ছে।

দুপুরে খাবার শাহনাজ মিরা’র সাথে খেয়েছে।প্রায় সময় এমন হয়।এরপর পরন্ত বিকেল দু’জন হাঁটতে বেরিয়েছে। এখনো গোধূলি শুরু হয় নি।শাহনাজ মিরা’র মন ভালো করার জন্য উপায় খুঁজে। পেয়েও গেলো।তবে বুঝতেই পারে না ভালো করতে গিয়ে দিগুণ খারাপ করে দিবে। বললো,

-“বানিজ্য মেলা বসেছে কলেজের পাশে বড়ো মাঠ টায়।কাল আসার সময় দেখলাম অনেক কিছু আছে। যাবি?”

আজ এক সপ্তাহ হয় মেলা বসেছে।রোকেয়া একদিন ও মেয়ে কে নিয়ে যায় নি। মিরা’র ইচ্ছে থাকলে মা’কে বলার সাহস পায় না।দাদীর শরীর টা ইদানীং ভালো যায় না।ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাবে। সেইজন্য টাকা জমাচ্ছে রোকেয়া। মিরা চায় না এখন আবার কোনো ফাউল খরচ হয়।আর মায়ের উপর চাপ পড়ে।মন খারাপ হতে গিয়েও মায়ের কষ্টের কথা মনে পড়ে মন খারাপ হয় না।মন শক্ত করে। লেখাপড়া করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে।মায়ের এতো পরিশ্রমের পারিশ্রমিক হিসেবে ভালো একটা চাকরি নিতে হবে। সাইন্স থেকে পড়লেও ডক্টর কিংবা অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিত অন্য কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেও তো অনেক টাকার প্রয়োজন।তাই সব দিক বিবেচনা করে যে করেই হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে। মিরাকে চুপ করে থাকতে দেখে শাহনাজ হয়তো কিছু টা বুঝতে পারে মিরা’র এমন নীরবতার কারণ। তাই এ-বিষয়ে আর কোনো কথা বলে না। কথা ঘুরিয়ে বললো,

-“মিরা চল।বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

মিরাও ঘাড় নেড়ে উলটো ঘুরে বাড়ির পথে হাঁটে। সরু রাস্তা।রাস্তার দুই পাশে গাছ।।অদ্ভুত সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে ধরণীতে। পরিবেশ মন মুগ্ধকর। শাহনাজ কথা বলছে।মিরাও সাথে তাল মেলাচ্ছে হাসছে। এদিকে দূর থেকে ধেয়ে আসা চিরপরিচিত জিপগাড়ি টা কারোর নজরে এলো না।
হঠাৎ যখন গাড়ির শব্দে দু’জন সামনে তাকালো তখন গাড়ি টা ঠিক ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। মিরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে শাহনাজ এর হাত খামচে ধরে।শাহনাজ প্রথমে ভয়ে পেলেও গাড়ি টা দেখে ভয় কেটে যায়।
মিরা’র হাত ধরে বলে উঠলো,

-“মিরা সামনে দেখ।”

মিরা ততক্ষণে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকিয়ে সামনে গাড়ি টা দেখে বিস্ময়। অস্ফুটে স্বরে বলে উঠলো,

-“রিহান ভাই!”

কাজল গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামে।গায়ে জড়ানো শার্ট এর তিন টা বোতাম খোলা থাকায় শার্ট এর একপাশ উড়ে।সুন্দর বুক খানায় কালো লোমশ উঁকিঝুঁকি মারে।সিল্কি চুল এলোমেলো হয়। কপাল পেরিয়ে ভ্রু স্পর্শ করে। চিকন ভ্রু জোড়ার নিচে চোখ গুলো যেন আনন্দ ভরে আছে। চাপদাড়ির ফাকে ঠোঁটে গুলো হাসির রেখা ঝুলছে। সেগুলো নেড়ে কাজল মিরা’র সাথে কথা বলতেই শাহনাজ মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে নেয়।

-“কেমন আছো মিরা বেগম?”

মিরা গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলো।রিহান ভাই কে দেখার চেষ্টা করছিলো।তারমধ্যে হঠাৎ কাজলের প্রশ্নে চমকে উঠে।অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো ভাইয়া।
আপনি কেমন আছেন?”

-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়ে গিয়েছে এখন।”

মিরা’র ভ্রু কুঁচকে আসে।কাজল শাহনাজ এর দিকে তাকিয়ে ছিলো।মিরা দৃষ্টি অনুসরণ করতেই শাহনাজ এর লজ্জা মাখা মুখ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খায়।
ফের ঘাড় ঘুরিয়ে কাজল এর দিকে তাকিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই থমকে গেলো। ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রিহান ভাই এর দিকে। দৃষ্টি আঁটকে যায় মিরা’র এই পুরুষ টাকে দেখলে।কথা ভুলে যায়। বুক ধুকপুক করে। কত সুন্দর মানুষ টা।কত টা নজরকাঁড়া তার চলাফেরা।মিরা’র এই পুরুষ টাকে দেখার বিতৃষ্ণা কোনো দিন আসবে না।বিড়বিড় করে বলেও ফেলে,

-“আপনাকে দেখার বিতৃষ্ণা আমার কোনো দিন জন্মাবে না।”

রিহান এসে ঠিক কাজল এর পাশে মিরা’র বরাবর দাঁড়ালো। গায়ে সাদা শার্ট।চোখে কালো রঙের একটা সানগ্লাস। যেটা আপাতত রিহান চোখ থেকে খুলে শার্ট এর বুক বরাবর বোতামে আঁটকে রাখলো। মিরা দৃষ্টি সরিয়ে গাড়ির দিকে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলো।গাড়ির সিটে কুচকুচে কালো একটা ব্লেজার।
মিরা’র মস্তিষ্ক তখন প্রশ্ন এলো রিহান ভাই কি তাদের বিশাল বড়ো অফিসে যায়? আজ পায়ে কালো কুচকুকে সু।সব সময় লোফার পায়ে থাকে।শার্ট বা গেঞ্জি যেটাই পরে সেটার উপর থাকে জ্যাকেট।কিন্তু আজ সব পরিবর্তন। তবে কি ঈশিতা যা বলেছে সব সত্যি? রিহান ভাই এখন অফিস করে?কত প্রশ্ন।কিন্তু উত্তর জানা হয়েও যেন অজানা।

-“ডিঙি মেয়েদের মতো এমন টই টই করে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ানোর কথা তোর মা জানে?”

রিহান এর গম্ভীর কণ্ঠে মিরা থমথম খেলো। সত্যি রোকেয়া বেগম জানে না ওরা এখানে এসছে। বলেছে বিকেল টা শাহনাজ আপাদের বাড়িতে থাকবে।তবে সেটা কথা নয়।কথা হচ্ছে রিহান ভাই ওকে ডিঙি মেয়ে কেনো বললো?সে কি সারাক্ষণ টই টই করে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ায়?মোটেও না।তবে কেনো রিহান ভাই এমন একটা অপবাদ দিলো তাকে?মিরা প্রতিবাদ করে। বললো,

-“আমি মোটেও পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াই না।আজ অনেক দিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।”

রিহান বিরক্তিকর চাহনিতে দেখে মিরা কে।কাজল এর দিকে তাকিয়ে বলে,

-গাড়িতে বস।”

-“সামনে?”

কাজল প্রশ্ন করে। রিহান শাহনাজ এর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে উঠলো,

-“দু’জনেই।”

কাজল শাহনাজ কে ইশারায় গাড়িতে বসতে বলে।শাহনাজ আঁড়চোখে মিরা’র দিকে তাকালো। সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করে,

-“কোথা যাব আমরা?”

-“বেশি দূরে না।আশেপাশে কোথাও।সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি পৌঁছে দেবো।”

কাজল আশ্বস্ত করে।শাহনাজ পেছনে বসে। কাজল সামনে বসলো।রিহান ড্রাইভিং সিটে বসে।মিরা দাঁড়িয়ে থাকে।রিহান এটা দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

-“এখনি কি তোকে বসার জন্য নিমন্ত্রণ পত্র দিতে হবে?না-কি কোলে তুলে গাড়িতে বসাতে হবে?”

#চলবে….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]