#পিঞ্জিরা
#পর্ব_১১
#জান্নাত_সুলতানা
-“কোথায় ছিলি তোরা?”
শাহনাজ মিরা দু’জনেই চমকে ওঠে। রোকেয়া মাত্র শাহনাজদের বাড়ির ভেতর থেকে এসেছে। পেছনে রয়েছে শাহনাজ এর মা।শাহনাজ এর হাত খামচে ধরে মিরা।ভয়ে মেয়ে টা অস্থির যদি মা কিছু বুঝে ফেলে তাহলে নিশ্চয়ই এবার মারতে মারতে হসপিটাল আবার।
শাহনাজ নিজেও ভয়ে আছে। মাথা নিচু করে কি জবাব দিবে সেটার ছক কষছিল। তবে হাতে নজর পড়তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ভাগ্য ভালো কাজল দুই টা চিপস আসার সময় কিনে দিয়েছে। শাহনাজ সেটা দেখিয়ে রোকেয়া বেগম কে বলে,
-“চাচি চিপস আনতে গিয়েছিলাম।তাই দেরি হয়ে গেলো। মিরাকে দিয়ে আসতাম এখন।আপনি কষ্ট করে আবার এলেন।দাদি অসুস্থ।”
-“আম্মা চিন্তা করছে।তিনি পাঠিয়েছে আমায়।
মিরা চল।”
রোকেয়া শেষ এর কথা টা মিরা’র হাত ধরে বলে।মিরা শাহনাজ এর দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলো।শাহনাজ একটা চিপস মিরা’র হাতে দিয়ে বাড়ি যাওয়ার ইশারা করে।শাহনাজদের বাড়ি থেকে এক মিনিট কি দুই মিনিট পরেই মিরাদের বাড়ি। রোকেয়া গেইট বন্ধ করে দিয়ে মিরা কে বলে,
-“ভেতরে যা।আমি ওজু করে আসছি।
নামাজ টা আজ আর পড়া হলো না।”
মিরা যায় না।দাঁড়িয়ে থাকে উঠোনে। রোকেয়া কলপাড়ে যায়।মিরা মায়ের পেছনে পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।রোকেয়া দেখে।কিন্তু আর কিছু বলে না।
মেয়ে তার বড্ড মা পাগল। আগে বাবার ছিলো।বাবা যাওয়ার পরই মায়ের পেছন পেছন ঘুরে। রমজান শেখ কতবার যে এসেছিলো তাকে নিতে। শুধু তাকে নয় সাথে মিরাকে ও।রোকেয়া তখন ভেবেছিলো হয়তো স্বামী মারা গিয়েছে সেইজন্য সংসার কিভাবে চলবে সেইজন্য বলে।কিন্তু না তিনি তো একবার রোকেয়া বেগম কে বলেও ছিলো বিয়ে দিতে চায় আবার মেয়ে কে।নাতনি কে নিজের কাছে রেখে দিবে।রোকেয়া তখন স্বামী হারিয়ে পাগল। বাবা যে মেয়ের জীবনের কথা চিন্তা করেই এমন সিদ্ধান্ত তাকে জানিয়ে ছিলো সেটা রোকেয়া বুঝতে পারলেও বাবা তার নিজের মেয়ের কথা ভাবলো কিন্তু মেয়ের মেয়ের কি হবে সেটা তো ভাবে নি। বাবা নেই। আবার মা-ও বিয়ে করে নিলে তার মেয়ের কি হবে? বাবার উপর সেই থেকে রাগ টা যেন প্রখর হলো আরো।ভালোবাসার মানুষের শেষ চিহ্ন আঁকড়ে ধরে বাঁচবে। অন্য কোনো ভাবনা তো তিনি মাথা তেও আনতে পারে নি কখনো।
ঘরে এসে দুই মা-মেয়ে কমলা বেগম এর রুমে গেলো।মিরা পড়তে বসলো।রোকেয়া শাশুড়ীর সাথে কতক্ষণ কথা বলে আযান দিলে নামাজ পড়তে গেলো।কিছু সময় পর কমলা বেগম ও চলে গেলো। মিরা তখন দুই লাফে নিজের রুমে এলো।দরজা হালকা ভিড়িয়ে নিজের রুমে থাকা ছোট ড্রেসিং টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা থেকে ওড়না সরিয়ে বস্তু টা পেছন দিক থেকে ঘুরিয়ে সামনে আনলো।একটা স্বর্নে চেইন।তাতে আবার একটা লকেট।সেটায় কি সুন্দর খোদাই করে রিহান মিরা লেখা। প্রথমে রিহান তার পর মিরা।ইংরেজিতে গুটিগুটি লেখা অক্ষর গুলো কি আকর্ষণীয় লাগছে মিরা’র বেশ পছন্দ হলো।তবে এটার দাম টা যে অনেক বেশি মিরা’র সে ব্যাপারে একটু সন্দেহ নেই।তার কারণ কিছু দিন আগে রোকেয়া শাশুড়ীর আগের জিনিস গুলো বেচে দিয়ে নতুন আর স্বর্ন তাতে যোগ করে দিয়ে বেশ বড়সড় করে এক জোড়া দুল গড়িয়ে দিয়েছে। তাতে সব মিলিয়ে চল্লিশ হাজার এর মতো লেগেছে। আর এটা তো তারচেয়ে ও অনেক বড় ভারী শক্ত-পোক্ত একটা চেইন সহ লকেট মিরা নিশ্চিত এটা লাখ টাকার জিনিস। কিন্তু এটা দিয়ে সে কি করবে? মা যদি দেখে ফেলে?মিরা একবার ভাবলো খুলে রাখবে।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে সেটা করলে মায়ের হাতে নিশ্চয়ই পড়বে।সুরক্ষিত স্থান থাকলেও রোকেয়া বেগম মাঝেমধ্যে মিরা’র ঘর গুছিয়ে দেন।আর তখন যদি এটা হাতে পড়ে মিরা কি জবাব দিবে?সুরক্ষিত স্থান যদি এই চেইনের জন্য হয়ে থাকে সেটা শুধু নিজের শরীর। গলায় পড়ে পিঠের দিকে দিয়ে রাখলে কারোর নজরে আসবে না।আর গায়ে ওড়না তো সব সময় থাকে।রোকেয়ার ডাকে মিরা’র ভাবনার ইতি ঘটে। দ্রুত চেইন জামার ভেতর রেখে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রাতে খাবার খেতে বসে মিরা’র অল্প গরম লাগলে ওড়না খুলে রাখে।কিন্তু আজ আর সেটা করা গেলো না। রোকেয়া মেয়ের পা থেকে মাথা অব্ধি সবটাই চিনে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো।তবে কিছু বললো না।খাবার শেষ আজ মিরা নিজের রুমেই গিয়ে শুয়ে পড়ে।রোকেয়া মেয়ের চালচলন যেন আজ ঠিক লাগলো না।যেই মেয়ে ভয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে যায় না আর আজ সেই মেয়ে আলাদা রুমে শুয়েছে।
আজ কিছু দিন ধরে মিরা’র ব্যবহার ও বেশি সুবিধার ঠেকাচ্ছে না।ভাবলো মেয়ে কে আরো চোখে চোখে রাখতে হবে।
—-
আজ দু’দিন হয়েছে কাজল আর রিহান দেশে নেই।ঈশিতা জানে না তারা কোন দেশে গিয়েছে। আশ্চর্য এর ব্যাপার এটা যে তাকে কেউ বলে না।ঈশিতা মা থেকে শুরু করে মামী কাউ কে বাদ রাখে নি জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু কেউ বলে না।শিশির লিভিং রুমে বসে আছে। হাতের নখে নেলপলিশ দিচ্ছে।গায়ের রং ধবধবে ফর্সা।চুল গুলো অল্প বাদামি রঙের।চোখ জোড়া টানাটানা। নাক টা সামন্য চেপটা। ঠোঁট চিকন।হাসলে গালে টোল পড়ে। তখন কি দারুণ মায়াবী লাগে। ঈশিতা তখন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।যেমন এখন তাকিয়ে আছে। ছিমছাম গড়নের শরীর টায় কালো একটা পাকিস্তানি থ্রি-পিস। হয়তো ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে এসছে।ঈশিতা সব ভাবনা বাদ রেখে আসল কথা জিজ্ঞেস করলো,
-“শিশির আপু কাজল ভাইয়া আর রিহান ভাইয়া কোন দেশে গেলো? বলছে না কেনো কেউ আমায়?”
শিশির মাথা তুলে একবার দেখল ঈশিতা কে।পরপরই মাথা নিচু করে নিজের কাজ করতে করতে বলে,
-“বাচ্চা মানুষদের এতো কিছু জানতে হয় না বাবু।তুই আম্মুর কাছে যা।তোর ফর্ম তুলতে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে রেডি হয়ে নে।”
ঈশিতা জেএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছে।রিহান এর কথা অনুযায়ী ঈশিতা কে ঢাকা আতিক চৌধুরীর বাড়িতে রাখা হয়েছে। রেজাল্ট দিয়েছে বেশ কিছু দিন হলো।বর্তমানে ভর্তির আবেদন টপকে ঈশিতা এখানকার একটা ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়ায় সুযোগ পেয়েছে।
আজ যাচ্ছে ভর্তি হতে।
সেই খুশিতে বেশি কথা বাড়াল না ঈশিতা। ঘাড় নেড়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো।যাওয়ার সময় অবশ্য একজন সার্ভেন্ট এর সাথে ধাক্কা খেলো।বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে চশমা ঠেলে চোখে দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
-“বাড়িতে এতো সার্ভেন্ট থাকলে তাদের সাথে দিনে দুই চারবার করে ধাক্কা খেয়ে পেট ভরে যাবে। খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হবে না।”
সার্জেন থমথম খেলো। শিশির ঈশিতার কথা টা শুনতে পেয়ে শব্দ করে হেঁসে উঠলো। রান্না ঘর থেকে কারিরা বেগম মেয়ের হাসির শব্দ শুনে ছুটে এলেন।ঈশিতা তখন বোকাবোকা চোখে তাকিয়ে আছে শিশির দিকে।
কারিরা বেগম প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। শিশির হাসি থামিয়ে কোনো রকম বললো,
-“তোমার মেয়ে চোখে দেখে না এখন যত দোষ সার্ভেন্ট এর।”
কারিরা বেগম মেয়ের কথা শুনে কিছু বুঝতে পারে না। তবে কথা বাড়ানোর সময় নেই।আতিক চৌধুরী বাড়ি আসছে আজ।অনেক দিন পর।তাই উনার জন্য রান্না সব কারিরা বেগম করছে।ঈশিতা কে টেনে ডাইনিং এ নিয়ে চলে গেলো।শিশির তখন হাসছে।লিভিং রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা। ইফাদ মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। আজ সে গ্রামে ফিরে যাবে।অনেক দিন হয় এখানে।যাওয়ার আগে একবার একটা মেয়ের সাথে দেখা করবে। অবশ্য মেয়ে বলা চলে না।এটা ইফাদ এর সতেরো নম্বর গার্লফ্রেন্ড। এটাকে পটিয়েছে আজ বারো দিন হয়।এটার সাথে একবারও দেখা হয় নি।আজ প্রথম দেখা করবে। তাই এক্কেবারে রেডি হয়ে নিচে এসে শিশির কে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো। কপালে ভাজ ফেলে শার্ট এর হাতা ফোল্ড করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
-“একা-একা এভাবে পেত্নীর মতো হাসছিস কেনো?”
-“তোমার আমাকে পেত্নী কোন দিক দিয়ে মনে হয়?আমার মতো সুন্দরী একটা মেয়ে কে তুমি এসব বলার সাহস কই পাও?জানো তুমি আমার পেছনে কত ছেলে ঘুরে?শুধু বাবার জন্য সাহস পায়।আর আগে এটা বলো তুমি এভাবে সাজুগুজু করে যাচ্ছ কোথায়?”
-“পেছনে ঘুরে সামনে তো আসার সাহস নেই।
আর আমি আজ গার্লফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। দো’আ কর ছবিতে যেমন সুন্দর দেখায় বাস্তবে যদি এমন হয় তাহলে রুম ডেট আজ ফাইনাল করেই আসবো।”
ইফাদ এর কথায় হটাৎ মন খারাপ হয় শিশির এর।বুকের ভেতর সুক্ষ্ম এক যন্ত্রণা অনুভব করে।কারণ জানা নেই। ছোট করে জবাবে শুধু “হাঁ” বলে সিঁড়ি বেয়ে উপর চলে গেলো। ইফাদ অবাক হলো।তবে বিশেষ পাত্তা দিলো না ব্যাপার টা।তার ভাবনায় এখন তার নতুন গার্লফ্রেন্ড।
——
শাহনাজ মিরা এক সাথে বসে আছে। কমলা বেগম বেগুন গাছের পাতা কাটছে।হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে তেমন সব পাতা ছাঁটাই করছে।মিরা দাদির দিকে অপল দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাজ দেখছে।শাহনাজ জানে মিরা উপরে উপরে নিজে কে যতই শক্ত দেখায় ভেতর মেয়ে টা ততটাই ভঙ্গুর।আজ পনেরো দিনের বেশি সময় হতে চলে রিহান কাজল কারোই কোনো খবর নেই।ইফাদ ভাই আজ বাড়ি ফিরবে শাহনাজ খবর পেয়েছে। মিরা কে বললো,
-“মিরা ইফাদ ভাই আজ গ্রামে ফিরবে।আমার সাথে কথা হয়েছে।”
-“ওহ।”
মিরা শান্ত কণ্ঠে বলে।শাহনাজ অবাক হয়।আবার বলে,
-“হয়তো কাজে বেশি ব্যস্ত রিহান ভাই। চিন্তা করিস না।দেখবি সময় করে দুই এক দিনের মধ্যে চলে আসবে।”
শাহনাজ এর কথা টা শেষ হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে মিরা ধরে আসা গলায় বলে উঠলো,
-“আসবে না।আসবে না।মিথ্যা বলেছে আমায়।সুইজারল্যান্ড চলে গেছে। দুই বছর। শিশির আপুর মামার বাসায়।সেখানে থাকবে।শিশির আপুর মামাতো বোন আছে অনেক সুন্দরী। ওই বিদেশীনি রিহান ভাই কে পছন্দ করে।আমাকে ঈশিতা বলেছে। যদি ওই মেয়ে কে ভালোবেসে আমাকে ভুলে যায় রিহান ভাই?”
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]