পিঞ্জিরা পর্ব-১২

0
4

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_১২
#জান্নাত_সুলতানা

-“মিরা রিহান ভাই। কথা বল।”

মিরা অসুস্থ চোখ জোড়া অনেক কষ্ট খুললো।পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো শাহনাজ এর দিকে।শাহনাজ এর বড়োই মায়া হয়।ভেতরে ভেতরে চাপা কষ্টে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো।কিছু দিন পর পরীক্ষা মেয়ে টার অথচ এমন একটা সময়ে মেয়ে টা অসুস্থ হয়ে গেলো।হলো তো হলো যেন-তেন অসুস্থ নয়।এক্কেবারে হসপিটাল ভর্তি হতে হলো।কাল রাতেই অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল। জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে ছিলো।রোকেয়া বেগম শাহনাজ এর কাছে ফোন করার পরই শাহনাজ নিজের মা কে নিয়ে মোড়ের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে গেলো।তারপর সরকারিতে নিয়ে এলে জ্বর কমার ইনজেকশন দিলো।সকালে রোকেয়া মেয়ে কে প্রাইভেট হসপিটাল এডমিট করিয়েছে। এখন স্যালাইন চলছে।রোকেয়া শাহনাজ কে দিয়ে স্কুল গিয়েছে ছুটি নিয়ে চলে আসবে বলেছে। মিরা ফোন ধরছে না।এদিকে রোকেয়া বেগম যখন-তখন চলে আসতে পারে। শাহনাজ এবার তাগাদা দিলো মিরা কে।বিদেশি একটা নাম্বার থেকে কল এসছে।শাহনাজ তক্ষুণি বুঝো ছিলো প্রেমিক পুরুষ কল করেছে। নিজের প্রেয়সীর খবর যে তার কান অব্ধি পৌঁছে গিয়েছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। রিহান কোনো কথা বলছে না।চুপ করে আছে। শাহনাজ মিরা’র কানে ধরলো ফোন টা।মিরা আলগোছে চোখ বন্ধ করে নেয়।পুরুষ টার ভারী নিঃশ্বাস এর শব্দ মিরা ফোনের এ-প্রান্তে থেকেও অনুভব করতে পারছে।কিন্তু কথা বলবে না। কেনো করলো এমন?দুই বছর তো একবার ও দেখা হবে না এমনটা সেদিন বলে নি কিংবা এতো দূর দেশে যে গেলে সেটাও তো একবার বলে গেলো না।
প্রণয় শুরু যেদিন হলো সেদিন তাদের শেষ দেখা হলো।মিরা’র চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। শাহনাজ একটা টিস্যু হাতে সেটা মুছে দিলো।মিরা’র ভালো হাত টা টেনে ফোন টার উপর রেখে ইশারায় কথা বলতে বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।মিরা ফোন কানে ধরে রইলো।কত সময় কাটলো কেউ হিসাব করলো না। শুধু গভীর নিঃশ্বাস এর প্রখরতা একে-অপরের শুনতে পেলো।রিহান অনেক সময় পর শান্ত স্বরে ডাকলো,

-“জান?”

ইশ!কি ছিলো এই ডাকে? মিরা’র যে বুকের ভেতর এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে বিঁধল।প্রনয়নের পর প্রেমিক পুরুষ প্রথমবারের ন্যায় তার প্রেয়সী কে কিছু বলে সম্মোধন করলো।মিরা’র বুকের ভেতর সুখানুভূতি হলো।কিন্তু মস্তিষ্ক বেঈমানী করলো।সারা দিলো না এতো মধুর ডাকে।রিহান ওপ্রান্তে থেকে কি বুঝলো তার প্রেয়সী অভিমান করেছে? দগ্ধ হয়েছে তার বক্ষ?কমল হৃদয় খানি আঘাত সে নিজে হাতেই করছে?অপরাধী সে।গোপনে রাখা প্রেম সেটা আবার নিবেদন করেই চলে এসছে।দেড় মাস কোনো যোগাযোগ করে নি।দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস টানে।যোগাযোগ করলে কি সে এতো সময় এখানে থাকতে পারত?উঁহু। কখনো না।এই তো এখন একটু নিঃশ্বাস তাকে পাগল করছে।ছুটে চলে আসতে চাইছে মন।অসুস্থ প্রেয়সী কে শক্ত করে বুকে আগলে নিতে হৃদয় ব্যাকুল হচ্ছে। পাগল প্রায় রিহান নিজে কে শান্ত করতে পারছে না।শেষ মিরা কে ধমক দিয়ে উঠলো।মিরা একটু ভয় পেলো না সেই ধমক। পাবে কি করে! ধমকে যে রোজকার ন্যায় সেই গম্ভীর রাগী ভাব ছিলো না। রিহান অবাক হলো না। সে পরাজিত সৈন্য’র ন্যায় মাথা নিচু করে। উদোম শরীরে দৃষ্টি পড়তেই বক্ষদেশে পীড়া অনুভব করে।এখানে একটা নারী থাকে।বুকের বা পাশ টায়।সেই নারী তো কিশোরী। আঠারো তো হয় নি এখন।যুবতী হলে রিহান ঘরে তলবে তাকে।রিহান রয়েসয়ে ফের জিজ্ঞেস করলো,

-“কথা বলবি না জান?”

মিরা জবাব দেয় না এবারেও।চুপ করে পুরুষ টার স্বর অনুভব করে।কতদিন পর শুনছে এই গম্ভীর কণ্ঠ। তৃষ্ণা এখনো মেটেনি। চোখ বন্ধ করে পড়ে রয়। রিহান এবার গম্ভীর হলো।মেয়ে টা কি বেশি বাড়াবাড়ি করছে না এবার? রাগ চড়ে মাথায়। গম্ভীর চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো,

-“অসুস্থ হওয়া কি খুব জরুরি ছিলো?”

মিরা মুখ খুলে এবার। পুরুষ টা নিজের কন্ট্রোল হারাচ্ছে। মিরা’র চোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ বন্ধ রেখেই বহু কষ্টে বললো,

-” তার অনুপস্থিতিতে আমার বুক তৃষ্ণায় ফেটে চৌচির। তার নৈঃশব্দ্যে বিদায়ে অসুস্থ আমার মন।তাপমাত্রা বাড়লো শরীরে এর।অথচ সবাই বললো আমার জ্বর হয়েছে। সত্যি কি আমার জ্বর হয়েছে?”

-“আমি এলে সুস্থ হবি?”

রিহান জিজ্ঞেস করলো। মিরা হাসলো।তাকে মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে পুরুষ টা।সে এলে নিশ্চিত মিরা সুস্থ হবে। কিন্তু যেই ধোঁকা টা দিয়েছে। মিরা’র মন অভিমানে টইটম্বুর।জবাব দিলো না কোনো রকম। রিহান হতাশার স্বরে আবার বলে,

-“এমনটা কথা ছিলো না জান।পড়ালেখা করবি মন দিয়ে বলেছিলি আমায়!”

-“আমার কিছু ভালো লাগে না রিহান ভাই। আপনি কেনো আমায় আগে বলেন নি আপনি সুইজারল্যান্ড চলে যাবেন?”

মিরা হু হু করে কান্না করে দেয়।তার কেনো পুরুষ টাকে এতো কাছে পেতে ইচ্ছে করে? সব সময় চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে মনে কয়?রিহান চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো। যেই কাজে গিয়েছিল মোটামুটি ভালো এগিয়েছে। যদি সম্ভব হয় দ্রুত ফিরে আসবে।
রিহান জানে মিরা যথেষ্ট ভালো স্টুডেন্ট। শুধু আবেগ, ভালোবাসা যা-ই হউক।মেয়ে টা চাপ টা সহ্য করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মন খুলে কথা বলার জন্য একটা ফ্রেন্ড। যাকে সব বলা যাবে। শাহনাজ এর কাছে মিরা সব বলে।কিন্তু কাছের কাউ কে বলতে পারলে মেয়ে টা সারাক্ষণ ভয়ে আতংকে থাকবে না। রিহান কি ভেবে প্রশ্ন করলো,

-“এক্সাম প্রিপ্রারেশন ভালো?”

-“সব কমপ্লিট।”

মিরা উত্তর দেয়।
সুইজারল্যান্ড এখন একদম সকাল।কাজল এখনো ঘুমিয়ে আছে।গায়ে পুরুষ টা কম্ফোর্টার জড়ায়।অতঃপর মিরা কে বললো,

-“মেডিসিন আর শরীর এর যত্ন নিবে।আমার মিরা কে আমি সুস্থ চাই।সেটা তুই কিভাবে আমার টা আমায় ফিরত দিবি আমার জানার প্রয়োজন নেই।”

রিহান কল কাটে মিরা চোখ বন্ধ করে আছে। ফোন কাটার পরে-ও মিরা ফোন কানে ধরে আছে।এই কথা বলায় যেন তৃষ্ণা মেটবার বদলে বাড়লো।চোখ বন্ধ করে পুরুষ টাকে অনুভব করার চেষ্টা করে হঠাৎ কিছু মনে পড়তে চমকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে গলায় হাত দিলো।একি?কোথায় সেই চেইন?নেই।মিরা অস্থির হয়।শোয়া থেকে কোনো রকম এক হাতের সাহায্যে উঠে বসে আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে খুঁজতে লাগলো।এমন সময় হঠাৎ রোকেয়া বেগম দরজায় দিয়ে কেবিনের ভেতর প্রবেশ করতে করতে শান্ত, স্বাভাবিক কণ্ঠে জানায়,

-“ওটা আমার কাছে। কাল রাতেই খুলে রেখেছি।”

মিরা থমথম খেয়ে চুপ করে বসে রইলো। টুঁশব্দ করে না।ভেতরে ভেতরে ভয়ে মরিয়া। মা এতো শান্ত? কিভাবে? একবারও জিজ্ঞেস করলো না এতো দামী একটা জিনিস মেয়ে পেলো কোথায়? মিরা চোখ তুলে দেখলো শাহনাজ পেছনে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোকেয়া বেগম বেড থেকে ফোন টা তুলে শাহনাজ এর হাতে দিয়ে বলে,

-“দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?বোস।”

শাহনাজ ভীতু চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।রোকেয়া মেয়ের হাতের স্যালাইন খুলে। শেষ হয়েছে। সেটা পাশের ঝুড়িতে রেখে সব গুছিয়ে একটা ব্যাগে নিলো।ঔষধ পত্র সব শাহনাজ এর কাছে দিয়ে মেয়ে কে ধরে বাহিরে নিয়ে এলো।বিল পে করে সিএনজি করে বাড়ি ফিরলো।মিরা পুরো টা সময় আতংকে রইলো।বাড়ি এসেও রোকেয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে মেয়ের গা মুছিয়ে দিলো। কাপড় পাল্টে দিয়ে মেয়ের জামাকাপড় ধুয়ে দিলো।অতঃপর মেয়ের জন্য আলুভাজি করতে গেলো।মিরা’র জ্বর হলেই ঝালঝাল আলুভাজি দিয়ে ভাত খেতে চায়।
মিরা’র কমল বেগম এর কাছে কত সময় বসে রইলো। শরীর দুর্বল তাই কমলা বেগম নাতনি কে ধরে রুমে দিয়ে নিজে বাহিরে এলো।বাড়িতে করা সব রকম সবজি দিয়ে তাদের মাসের পর মাস চলে।তরকারি খুব একটা কেনার প্রয়োজন হয় না।রোকেয়া বেগম কে বলে বলে মৌসুমে মৌসুমের সবজি গাছ কিনিয়ে এনে লাগায় কমলা বেগম।আর তা দিয়ে তাদের সংসার এর কাঁচা বাজার চলে।

—-

-“রিহান কি বললো?দেশে কবে আসবে?”

মিরা শুয়ে ছিলো।মায়ের প্রশ্নে এক ঝটকায় শোয়া থেকে বসে গেলো।রোকেয়া ভাতের প্লেট হাতে বিছানায় এসে বসলো।মিরা কিছু সময়ের জন্য ভাবলো সে ভুল শুনেছে।কিন্তু না রোকেয়া মিরা কে ভুল প্রমাণ করে আবার একই প্রশ্ন করলো,

-“কবে আসবে?বলছিস না কেনো?”

-“আম্মা,,,

মিরা’র চোখে স্পষ্ট ভয়।হয়তো বয়স কম সেইজন্য।রোকেয়া বেগম মেয়ের মুখে ভাত দেয়।মিরা বসে থাকে স্তব্ধ হয়ে।রোকেয়া বলে,

-“তোর বাবার আর আমার যখন সম্পর্ক। তখন এবছর এর বেশি হবে। তোর নানা জান জেনে গেলো।আমায় জিজ্ঞেস করার পর আমি বলেছিলাম। লজ্জায় অস্বস্তিতে বড় ভাবির কাছে কথাখানি শিকার করেছিলাম।”

রোকেয়া মেয়ের সরল চাহনি চোখের তাঁরায় তাকিয়ে থাকে। সরল এই চোখ জোড়ায় দুঃখ কষ্ট রোকেয়া কোনো দিন দেখতে চায় নি।মিরা’র বাবা যখন বেঁচে ছিলেন মিরা কে কোনো রাজকন্যার চেয়ে কম কিছু ভাবে নি।মেয়ে কাঁদলে পাগল হতো।মায়ের চেয়ে বেশি বাবা হয়ে তিনি মেয়ের যত্ন করেছেন। রোকেয়ার চোখের কোণে জল জমা হয়।কত সুন্দর না ছিলো তখন।হঠাৎ সব একটা মানুষের বিদায় সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছাড়ে রোকেয়া মেয়ের চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো,

-“কাউ কে ভালোবাসলে ভয় পাওয়া উচিৎ। সেটা শুধু ভালোবাসার মানুষ টাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এটা ব্যতিত অন্য কোনো কিছুতে ভয়ে পেলে নিজের ভালোবাসা হারাতে হবে নিশ্চিত।”

#চলবে….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]