#পিঞ্জিরা
#পর্ব_১৮
#জান্নাত_সুলতানা
ইফাদ এর ফোন অনবরত বেজেই চলেছে। কিন্তু ইফাদ এর সেদিকে হুঁশ নেই।ওয়াশ রুমে সেই যে গিয়েছে আসার আর খবর নেই।শিশির এসছিল ইফাদ এর কাছে একটা জিনিস দেখাতে। কিন্তু এসে এমন মহাবিপদ এর সম্মুখীন হবে ভাবে নি।ইফাদ কে ডেকে বলার পর-ই ইফাদ শিশির কে বললো কল এটা রিসিভ করতে কারণ এতো বার কল করছে কেউ জরুরি কিছু হতে পারে। তাই শিশির শেষমেশ বাধ্য হয়ে ফোন টা হাতে নিলো।
দেখলো হোয়াটসঅ্যাপে এসছে কল।যেখানে মেয়ের পিকচার দেওয়া একটা আইডি থেকে কল আসছে।মেয়ে টার ড্রেসআপ দেখে মেয়ে টার সম্পর্কে শিশির এর একটু হলেও ধারণা জন্মাল মেয়ে টা খুব বেশি একটা সুবিধার হবে না। হয়তো বড়োলোক বাবার বিগড়ে যাওয়া কোনো মেয়ে যেমন টা ইফাদ।
শিশির কল টা রিসিভ করলো না।এমন কারোর সাথে তার কথা বলার ইচ্ছে নেই।নাম্বার টার নিক-নাম টা দেখে শিশির আরো কনফার্ম হলো এটা ইফাদ এর নিউ গার্লফ্রেন্ড। সব কিছু যেমনতেমন শিশির এর এটা দেখে আরো কষ্ট হলো।যখন নজর পড়লো “মাই হানি” শিশির এর গা কেমন কাঁপন ধরলো।ফোন টা রেখে ল্যাপটপ হাতে নিজের রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ম্যাসেজ এর শব্দ পেয়ে থেমে গেলো।বিছানা থেকে ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো।মেয়ে টা হোয়াটসঅ্যাপে কিছু পিকচার পাঠিয়েছে। শিশির এর কৌতূহল হলো।লক নেই ফোন। কিন্তু কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে।কারোর প্রাইভেসি দেখা কোনো ভদ্রতার কাতারে পড়ে না। কিন্তু এক মূহুর্তের জন্য শিশির নিজে কে অভদ্রতা মেনে নিলো।হয়তো আজ কে সে নিজের জীবনের সঠিক একটা সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।এতো রাতে একটা মেয়ে একটা ছেলে কি দিতে পারে সেটার সম্পর্কে শিশির এর কিছু টা হলেও ধারণা আছে। তবে ধারণা দিয়ে তো আর দুনিয়া চলবে না।প্রমাণ টাও লাগবে।
শিশির কাঁপা কাঁপা তর্জনী আঙ্গুল টা নেড়ে ফোনের স্ক্রিনে টাচ করলো।মেয়ে টার ইনবক্সে যেতেই শিশির এর চোখমুখে একরাশ ঘৃণায় ভরে গেলো।ইফাদ খারাপ মেয়েদের সাথে ডেট করে শিশির এর জানা ছিলো।কিন্তু এতো টা ঘনিষ্ঠ হতে পারে বা হবে কোনো মেয়ের সাথে শিশির এর ধারণা ছিলো না।
শিশির হঠাৎ অনুভব করলো তার চোখের পাতা কাঁপছে। ভিজে উঠেছে চোখ। কিন্তু চোখ ছেড়ে জল গালে গড়ানোর আগেই শিশির চোখের জল টা মুছে নিলো। ফোন রেখে ম্যাসেজ আবার আনসিন করে ফোন রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বেরিয়ে এলো।নিজের রুমে যেতে যেতে বিড়বিড় করে আওড়াল,
-“তুমি কোনো দিন জানবে না।তুমিও আছো কারোর ভালোবাসা হয়ে ভালোবাসার পিঞ্জিরা। অনেক দূর, অনেক দূর চলে যাব তোমার কাছ থেকে ইফাদ ভাই।”
——
সকালে ঘুম ভেঙ্গে রিহান মিরা কে পাশে পেলো না।ভ্রু কুঁচকে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ ডলে এদিক-ওদিক পুরো রুমে নজর বুলিয়েও মিরা’র দেখা মিললো না।রিহান গা থেকে কাঁথা টা সরিয়ে উঠে দাড়ালো। গায়ের শুধু সাদা একটা টি-শার্ট। আর লুঙ্গি। লুঙ্গির দিকে নজর পড়ে রিহান এর কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেলো।
রিহান ঘুমানোর সময় ট্রাউজার নয়তো হাফ জিন্স প্যান্ট পড়ে ঘুমায়।কিন্তু এখানে আসার সময় তো সে কিছু আনে নি।আর না মিরা’র কোনো ভাই টাই আছে। অগত্যা ভেবেছিলো প্যান্ট পড়েই ঘুমিয়ে পড়বে আজকের রাত টা।আর শুয়েও পড়ে।আর মিরা ওয়াশ রুমে গিয়েছিল। কিন্তু ওয়াশ রুম থেকে ফিরে এসে রিহান এর হাতে লুঙ্গি দিয়ে মিনমিন করে বললো,
-“আম্মা দিয়েছে।”
রিহান আগে কখনো লুঙ্গি পড়ে নি।তবে দাদা রমজান শেখ পড়ে সব সময়। তাই এটা দেখে তেমন অবাক হলো না।কিন্তু সে এটা আদৌও পড়ে কমফোর্টেবল ফিল করবে তো?তারউপর শ্বশুর বাড়ি।কোনো অঘটন না ঘটে। রিহান দেখলো লুঙ্গি টা নতুন। কিন্তু সেটার গায়ে ভাঁজের দাগ বসেছে। সাদা লুঙ্গি।রিহান ভেবে নিলো মিরা’র দাদার।আর তার ধারণাই সত্যি হলো।মিরা বললো,
-“এটা দাদু ভাই এর।কিন্তু শুধু একদিন ব্যবহার করেছিলো।ঈদের নামাজে।এরপর আর পড়ার সুযোগ হয় নি।”
রিহান বুঝতে পারে মিরা ভেবেছে রিহান হয়তো এটা কার এটা ভেবেই পড়তে চাইবে না। অস্বস্তি দূর করতে এতো কিছু বলেছে।রিহান মৃদু হেঁসে বলে উঠলো,
-“আমার সমস্যা হবে না।”
রিহান রুমেই প্যান্ট চেঞ্জ করে নিলো।মিরা বাহানা দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে টেবিলে বই গোছাতে লাগলো। রিহান প্যান্ট চেয়ারে রেখে মিরা কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুঁতনি ঠেকিয়ে বললো,
-“বিয়ের পর বউয়ের সামনে ছেলেদের লজ্জা পেতে নেই।এতে করে বাবা হওয়া থেকে বঞ্চিত হতে হবে নয়তো।”
মিরা’র চোখ বড় বড় করে নিলো।রিহান ভাই নির্লজ্জ কথাবার্তা বলছে! অপ্রত্যাশিত ঘটনা। কিন্তু খুব অবাক করা কাণ্ড নয়।তবে হঠাৎ করে এতোটা লাগামহীন কথা মিরা’র মন মনে মনে রিহান কে একটা নাম উপাধি দিতে ভুলে না।ভুল করে মনের কথা মুখে বলে ফেলে,
-“নির্লজ্জ।”
রিহান তখন গম্ভীর। অধর কামড়ে ধরে। মিরা নিজে কে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁথা দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নিলো।
রিহান যা দেখে বাঁকা হাসলো।
আর সেই দৃশ্য মনে করে রাতের মতো আবারও এখন হাসে।মিরা মাত্রই রুমে এসছিলো।আর রিহান কে এমন হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো।রিহান মিরা কে দরজায় এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমথম খেলো। তবে সেটা মিরা কে বুঝতে না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় ছিলি তুই?”
-“আম্মার সাথে।আপনার কফি নেই।আম্মা ভালো দুধ চা বানায়।দেই?”
মিরা হাতের উপন্যাস এর বইটা টেবিলের উপর রেখে বললো।রিহান নিজের প্যান্ট হাতে নিয়ে মিরা কে নাকচ করে দিয়ে বললো,
-“রুমে দিতে হবে না।আমি ফ্রেশ হয়ে যাব।তুই বোস এখন।”
মিরা বসলো না।রিহান এর পেছন পেছন গিয়ে ওয়াশ রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো। হাতে একটা নতুন গামছা। রিহান ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো মিনিট পাঁচ এর মাথায়। চোখে মুখে পানি।ভ্রু জোড়ায় পানি।মুখে বিন্দু বিন্দু পানি কণা।
মিরা মাথা নিচু করে গামছা টা এগিয়ে দিলো।রাতের কথা মনে পড়ে একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো তাকে।ঘুরে উলটো দিকে বারান্দায় এলো।পেছন পেছন হাতমুখ মুছতে মুছতে রিহান ও আসে। বাহিরে শাহনাজ আর কমলা বেগম। মূলত তারা গাছের পরিচর্যায় আছে। রিহান বারান্দায় থাকা চেয়ারে বসলো।সামনে একটা টেবিল। রিহান বসতেই মিরা খাবার ঘর গেলো।ফিরে এলো ট্রে হাতে। পেছনে রোকেয়া আছে। দু’জনের হাতের নাস্তার প্লেট দিয়ে টেবিল ভরে গেলো।হরেকরকমের পিঠা ফলমূল মিষ্টি।দুধ ডিম। এগুলো রোকেয়া একদম ভোরে উঠে শাহনাজ এর মায়ের সাহায্য নিয়ে তৈরী করেছে। সাথে শাহনাজও ছিলো।রোকেয়া নাস্তা দিয়ে মিরা’র হাতে একটা পাখা দিয়ে বাহিরে রান্না ঘরে গেলো।
যাওয়ার আগে অবশ্য রিহান কে বেশ কয়েকবার করে খেতে বলে গেলো।আর সাথে এটাও জিজ্ঞেস করে গেলো আর কিছু খেতে ইচ্ছে করলে যেন উনাকে বলে।রিহান বিস্ময় কিছু বলতে ভুলে গিয়েছে। শুধু মিরা’র দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
-“সকালে আমি এতো খাবার খাব?তুই জানিস না!কেনো বারণ করিস নি ফুপিমণি কে?”
-“আম্মা শখ করে করেছে। আমি তাই কিছু বলতে পারি নি। আর আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই সব কাজ শেষ করে ফেলেছিলো।”
রিহান চোখ বন্ধ করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।শুধু একটা ডিম আর দুধ খেলো বসে। তারপর একটা আপেল নিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো।মিরা পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে নিজেও এলো।রিহান এসে সোজা রান্না ঘরে ঢুকলো।মিরা বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো। রোকেয়া সবেই পেঁয়াজ কাটতে বসেছিলো।রিহান কে দেখে রোকেয়া অস্থির হয়ে দা রেখে উঠে এলো।মুচকি হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিছু লাগবে? মিরা কে বল,,,
-“তুমি আমার সাথে আগের মতো কথা বলতে পারো না?তুমি করে কেনো বলো?”
-“পাগল ছেলে।বড় হয়েছিস না!তারউপর এখন আবার মেয়ে জামাই।”
-“অতশত টেনে লাভ নেই। আগের মতো করে কথা বলবে।আর হ্যাঁ মিরা কে শাড়ী পড়িয়ে রেডি করে দাও একটু।শিশির চলে যাবে ঢাকা।ওর সাথে দেখা করবে বললো।”
-“শেখ বাড়িতে যেতে হবে?”
রিহান মুচকি হেঁসে মাথা নেড়ে না জানালো।রোকেয়া বেরিয়ে এলো।হা-হুতাশ করলো এতো তাড়াতাড়ি জামাই চলে যাবে বলে।
রুমে এসে রিহান এর আনা কাল রাতের তিন টা কাপড় থেকে একটা কাপড় নিয়ে মেয়ে কে নিজের রুমে ডাকলো।মিরা আসতেই রোকেয়া মেয়ের হাতে ব্লাউজ পেটিকোট দিয়ে পড়ে নিতে বললো।মিরা জানে সব।তাই কিছু না বলে সব পড়ে নিলো।আকাশীরং এর একটা শাড়ী সাদা ব্লাউজ মিরা কে শাড়ী পড়িয়ে রোকেয়া নিজেই চমকালো।মনে মনে বেশ কয়েকবার মাশা-আল্লাহ আওড়াল। চুল গুলো মিরা নিজেই বিনুনি করে নিবে বলে নিজের রুমে এলো।রিহান টম কে খাবার দিচ্ছিল।শাড়ী পরিহিত মিরা কে দেখে হাত থেমে গেলো।টম নিজেও মিরা’র দিকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে। রিহান এর দিকে তাকিয়ে টম ম্যাও ম্যাও করে ডেকে উঠলো।রিহান এর হুঁশ নেই সেদিকে। টম এর যেন রাগ হলো।রিহান এর হাতে আঁচড় কাটতে রিহান এর হুঁশ এলো।দৃষ্টি এলোমেলো ঘুরিয়ে ফের মিরা’র দিকে তাকালো। মিরা আজ প্রথম শাড়ী পড়েছে। তাই সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিচের দিকে তাকিয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করছিলো সে।কিন্তু রিহান কে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিরা নিজেও থমথম খেলো। মুখ শুঁকিয়ে এইটুকুন হলো।ভাবলো খুব বাজে দেখাচ্ছে নিশ্চয়ই।
রিহান পিঠার বাটি টম এর সামনে রেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে মিরা’র সামনে দাঁড়ালো। এক হাতে দরজা টা সামান্য চাপিয়ে দিয়ে দু’জন কে আড়াল করে নিলো। বাইরে থেকে রুমের ভেতর টা দেখা গেলেও তাদের কে কেউ দেখতে পাবে না। রিহান নিজের বা হাত মিরা’র পেছনে দেয়ালে রেখে মিরা’র দিকে ঝুঁকে গেলো।ডান হাতে মিরা’র ঘাড়ে রেখে এগিয়ে আনলো মিরা’র মুখ। মাথা টা কাত করে মেয়ে টার বা কানের কাছে নিয়ে কানের লতিতে লাগিয়ে নিলো অধর।মেয়ে টার শরীর মৃদু কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে মিরা।রিহান ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-“আবার একটা নতুন রূপ। পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললে ভয়ংকর হবে তোর জন্য।নিজের ভালো চাইলে শাড়ী চেঞ্জ করে আয়।”
মিরা প্রথমে চমকে উঠলেও পরে চোখ খুলে ড্যাব ড্যাব করে রিহান এর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।আর ভাবলো এই কেমন লোক নিজেই একটু আগে বললো শাড়ী পড়ে রেডি হতে আবার এখন বলছে শাড়ী চেঞ্জ করতে!মিরা মনে হলো গিরগিটি ও বোধহয় এতো দ্রুত রং পরিবর্তন করে না যতদ্রুত রিহান ভাই এর মতিগতির পরিবর্তন হয়।
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]