#পিঞ্জিরা
#পর্ব_১৯
#জান্নাত_সুলতানা
-“পাগল করে ছাড়বে আমায় এই মেয়ে।”
রিহান কপালে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বিড়বিড় করে। মিরা হিজাব বাঁধছে।গায়ে একটা পাকিস্তানি থ্রি-পিস। এটা মিরা কে ওর মা গত ঈদে কিনে দিয়েছিলো।যদিও মিরা’র এটা নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। দাম টা বেশি হওয়ায়। কিন্তু মিরা’র মা মেয়ের অমতে গিয়ে মেয়ের মনের শখ পূরণ করেছে।
থ্রি-পিস টা হালকা বাদামী বর্ণের। থ্রি-পিস এর সাথে ম্যাচিং করে হিজাব। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক। তাও একদম হালকা করে দিয়েছে। যদিও রিহান নিষেধ করেছিলো।পরে মিরা কে মুখে মাস্ক পড়ে নিতে দেখে থমথম খেলো রিহান।যদি এমন মুখ ডেকেই বেরুবে তো এতো সাজার কি প্রয়োজন! কিন্তু পরক্ষণেই রিহান এর মনে হলো না তার ধারণা ভুল ছিলো এতো সময়। মেয়েরা কাউ কে দেখানোর জন্য সাজে না।তারা সাজতে পছন্দ করে। তাদের ভালো লাগা এটা।কাউ কে দেখাতে ইন্টারেস্ট নয় তারা।নিজেদের মনের শান্তির জন্য সাজে।মিরা সাজ কমপ্লিট করে এসে রিহান এর সামনে দাঁড়ালো। রিহান দেখলো।এখনো সুন্দর দেখাচ্ছে।রিহান মিরা’র কপালে চুমু খেলো।মুচকি হাসলো।মিরা’র দুনিয়া থমকে গেলো।অপলক তাকিয়ে রইলো রিহান এর হাস্যজ্বল মুখের দিকে।রিহান বউয়ের মুখ ঢাকা থাকার পরে-ও মিরা’র থমকে যাওয়া বুঝতে সক্ষম হলো।মাথা নিচু করে মিরা’র দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
-“মাশাআল্লাহ।
এভাবে হা করে তাকিয়ে থেকো না।তোমায় দেখলে আমি এলোমেলো হয়ে যাই। আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ।”
মিরা দূরে সরে গেলো। গলা শুঁকিয়ে আসার উপক্রম। রিহান এর কণ্ঠ অদ্ভুত নেশালো শোনালো। মিরা’র রক্ত কণিকায় অসহ্য শিহরণ হয়। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ওড়না এক হাতের মুঠোয় চেপে ধরে শ্বাস টানে।ওর হঠাৎ গরম লাগছে প্রচুর। শ্বাস-প্রশ্বাস ভারি হচ্ছে। তবুও অধর জোড়া কোনো রকম নেড়ে জানালো,,
-“শিশির আপু বসে আছে বাহিরে।”
রিহান দূরে সরে গেলো।এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে আরেক হাত মাথার পেছনে রেখে চুল খামচে ধরে বিড়বিড় করে আওড়াল,
-“কোথায় একটু বউয়ের সাথে রোমাঞ্চ করবো।সেই সুযোগ টাও নেই। আগে তো আমার রোমাঞ্চ এর শত্রু ছিলো টম।আর এখন তারই শাশুড়ী। বউ নিয়ে বাসর করতে বনবাস চলে যাব।সংসার সেখানে পাতবো।”
মিরা’র চোখ কপালে উঠার জোগাড়। গোল গোল আঁখি জোড়া তুলে রিহান এর দিকে তাকিয়ে রইলো। রিহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। মিরা ও বিস্ময় কাটিয়ে পেছন পেছন এলো। শাহনাজ, শিশির, কমলা বেগম, রোকেয়া বেগম, আরো কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। রিহান রোকেয়া বেগম আর কমলা বেগম এর কাছে বলে বাড়ি থেকে বেরুলো।রাস্তায় শাহনাজ এলো ওর পেছনে। আর বাকিরাও আছে। শাহনাজ এর চোখ মুখের অস্থিরতা দেখে রিহান গাড়িতে উঠে না। জিজ্ঞেস করলো,
-“রাজি হলে না?”
শাহনাজ একটু ও অবাক হয় না। কাজল কিছু দিন আগেই ওকে প্রপোজ করেছে। কিন্তু মেয়ে টা কোনো জবাব দেয় নি। এরপর কাজল বেশ কিছু দিন সময় দিয়েছে ওকে। কথা বলেছে। কিন্তু শাহনাজ কিছুই জানায়নি কাজল কে। এতে কাজল মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে। শাহনাজ এর থেকে কোনো জবাব না পেয়ে সে হয়তো ভেবেছে শাহনাজ ওকে ভালোবাসে না। কিন্তু শাহনাজ তো কাজল কে পছন্দ করে। শুধু নিজের মায়ের কথা ভেবে এসব করার সাহস পাচ্ছে না। তবে কখনো যদি কাজল কে নিজের করে পাওয়ার একটা সুযোগ সে পায় তাহলে সে যে করেই হোক মানুষ টাকে সারাজীবন এর জন্য নিজের করে পেতে সব রকম চেষ্টা করবে। শাহনাজ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। মলিন স্বরে বললো,
-“আম্মা জানলে মেরে ফেলবে।”
-“তাহলে ভুলে যাও ওকে।”
স্বাভাবিক ভাবে উপদেশ দিলো যেন রিহান। শাহনাজ অবাক হয়। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে রিহান এর মুখের দিকে। রিহান রোদচশমা পড়ে চোখে। গাড়িতে উঠে বসার জন্য উদ্যত হয়। মিরা চলে এসছে। শাহনাজ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে,
-“কথা বলতে চাই আমি উনার সাথে। কল দিতে বলবেন প্লিজ।”
করুণ শোনালো মেয়ে টার মিষ্টি স্বর টা। মিরা আগামাথা কিছু বুঝতে পারে না। রিহান ওকে গাড়িতে বসতে বলে। মিরা বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসে।শিশির এসে পেছনে বসে।রিহান যায়গা ফাঁকা হতে শাহনাজ এর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো,
-“ধৈর্য ধরো। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়।”
বলে উঠে বসে ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি স্টার্ট করবে তার আগেই রিহান এর জিপগাড়ি টা নিয়ে ইফাদ এসে থামলো ওদের গাড়ি টার সামনে।
রিহান বসে আছে। শিশির নিজেও অবাক। ইফাদ এসেই সোজা শিশির এর পাশের দরজা ধরে টানে। রিহান গাড়ি লক করে রেখেছে। তাই খুলতে পারলো না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে যখন সফল হলো না তখন রিহান এর কাছে গাড়ির কাঁচে নক করে অনুরোধ করে বললো,
-“প্লিজ লক টা খুলে দে।শিশির এর সাথে আমার ইম্পরট্যান্ট কথা আছে।”
-“আমার বোনের সাথে তোর কিসের কথা? কোনো কথা বলতে হবে না। আমাদের লেইট হচ্ছে।”
বলতে বলতে রিহান গাড়ি স্টার্ট করে দিলো। ইফাদ ডাকলো পেছন থেকে কিন্তু কোনো লাভ হলো না। প্রাইভেট কার টা শাঁই শাঁই করে চলে গেলো। ইফাদ পেছন থেকে আহত চোখে তাকিয়ে রইলো গাড়ি টা যতক্ষণ দৃষ্টি আড়াল না হয়।
এদিকে মিরা কিছুই বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। শিশির থম মেরে বসে আছে।
কাল রাতেই শিশির রিহান এর কাছে টেক্সট করে সব জানিয়ে দিয়েছে। ইফাদ কে শিশির পছন্দ করে এটা রিহান আগে থেকে জানতো। ভেবেছিলো ইফাদ হয়তো বুঝতে পারবে। নিজের ছন্নছাড়া জীবনে শিশির কে যায়গা দিয়ে নিজের জীবন টা গুছিয়ে নিবে। কিন্তু এর মাঝে রিহান কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছিল না রিহান। সেইজন্য ভেবেছিলো শিশির এর সাথে কথা বলে মুভ অন করতে বলবে মেয়ে টাকে। কিন্তু কাল রাতে মেয়ে টা হঠাৎ নিজে থেকে রিহান কে জানিয়েছে সে অনেক আগে জার্মানিতে পড়তে যাওয়ার জন্য যে তার বাবা-র সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। এখন সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশে ইংরেজিতে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সেই দেশের ভাষার দক্ষতা দরকার হতে পারে। বিশেষ করে জার্মানির মতো দেশে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ নিতে হলে জার্মান ভাষা জানতে হবে।
যেটা শিশির ভালোই নিজের আয়ত্তে করে নিয়েছে। তাই তেমন কোনো সমস্যা হবে না।
—–
শিশির ফ্লাইটে উঠে পড়েছে। এক ঘন্টা আগেই রিহান মিরা সবাই শিশির কে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর বাড়ি ফিরে ইফাদ কে বাড়িতে দেখে সবাই হতভম্ব। কারণ ইফাদ এর অবস্থা খুব বিধস্ত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। মিরা’র মায়া হয়। কাজল এর মা ইফাদ কে দেখে অস্থির হয়। ইফাদ কে ফ্রেশ হতে বলে নিজে রান্না ঘরের দিকে ছুটে। বাড়িতে এখন ইফাদ, মিরা, রিহান। আতিকুর চৌধুরী বাড়ি নেই।মেয়ে কে এয়ারপোর্ট ছেড়ে তিনি জরুরি কাজে বেরিয়ে গিয়েছে। আর কারিরা বেগম আছে। তিনি রান্না ঘরে যাওয়া মাত্র ইফাদ সোফায় বসা রিহান এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
-“শিশির কোথায়? প্লিজ বল না। পুরো বাড়িতে খুঁজেছি। পাচ্ছি না।”
ছেলে টার কণ্ঠনালী কাঁপছে। রিহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সোফায় বসে ফোন দেখছে। ইফাদ এর মন কু ডাকছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা খারাপ হচ্ছে তার সাথে। কাল রাতে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে সে নিজেও বুঝতে পেরেছিলো শিশির ওই মেয়ে টার সাথে ইফাদ এর ঘনিষ্ঠ হওয়ার পিকচার গুলো দেখে নিয়েছে। সেই থেকে কেনো জানি শুধু বারবার মনে হচ্ছিল শিশির ওকে নিশ্চয়ই খারাপ ভেবেছে। কিন্তু তাতে ওর কি আসে যায়! ও যেমন তেমন টাই তো ভাববে। কিন্তু সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে নি। শুধু শিশির এর মায়াবী চোখ আর মাথা ভর্তি হালকা বাদামী রঙের চুল গুলো চোখের সামনে ভাসছিলো। সকালে পিকচার এর ব্যাপার টা নিয়ে কথা বলবে ভেবে নিজে কে শান্ত করে ঘুমিয়ে পড়ে রাতে। কিন্তু সকালে সে উঠার আগেই শিশির শেখ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসছে।
রিহান কোনো উত্তর দিলো না। মূলত সে কিছু বলবে না এমনটাই হয়তো মনস্থির করে ছিলো। ইফাদ কে কিছু জানাবে না। কিন্তু সেটা আর হলো না। মিরা জানিয়ে দিলো,
-“কেনো আপনি জানেন না আপু তো জার্মানি চলে গিয়েছে ইফাদ ভাইয়া।”
মিরা অবাক হয়ে শুধালো। ইফাদ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে যাওয়ার পরই ইফাদ বিড়বিড় করে আওড়াল,
-“মিথ্যা! শিশির এমন করতে পারে না।”
বলে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। মিরা রিহান এর দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই রিহান চোখে দিয়ে ইশারা করে আশ্বস্ত করলো। কারিরা বেগম সার্ভেন্ট এর হাত দিয়ে খাবার নিয়ে এসে ইফাদ কে না দেখে অবাক হয়। এতো সময় লাগে ফ্রেশ হতে। মিরা’র দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস যে? বোস। আর ইফাদ কোথায়?”
রিহান এই ব্যাপার টা এভয়ড করে গেলো। মিরা কিছু বলার আগে রিহান বসা ছেড়ে দাঁড়িয়ে কারিরা বেগম কে বলে,
-“দুপুরে খাবার টা প্লিজ রুমে দিও মামণি। আমার মাথায় প্রচন্ড পেইন হচ্ছে।”
কারিরা বেগম রিহান কে রুমে যেতে বলে মিরা কে রেখে দিলো। নিজে হাতে একটা কফি বানিয়ে সেটা মিরা’র হাতে দিয়ে রিহান এর রুমে নিয়ে যেত বললো।
মিরা এর আগে কখনো এই বাড়িতে আসে নি। এতো বড়ো বাড়ি রিহান ভাই কোন রুমে আছে সেটা তো ও জানে না। কারিরা বেগম একজন সার্ভেন্ট কে বলে দিলো মিরা কে রিহান এর রুম দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।
মিরা রুমে এসে দেখলো রিহান খালি গায়ে বিছানায় শুয়ে আছে। মিরা’র কৌতূহল মন হঠাৎ লজ্জা এসে ভিড় করলো।
মিরা’র মন আকুপাকু করছিলো শিশির এর আর ইফাদ এর কাহিনি জানার জন্য। সাথে কাজল ভাই এর কি হয়েছে! শাহনাজ আপার সাথে কেনো তিনি কথা বলে না? মিরা এসব প্রশ্নো মনের ভেতর কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। বেচারি বুঝতে পারছিলো আজ এসব এর জবাব পাবে না। রিহান ভাই অসুস্থ এখন। তাই দ্রুত রিহান এর দিকে এগিয়ে যায়। রিহান নিজেও চোখ বন্ধ রেখে মিরা কে গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠে বললো,
-“কাছে আয়।”
মিরা কাছে গিয়ে পাশের ছোট টেবিল টায় কফির মগ টা রাখতেই রিহান চোখ খুলে মিরা কে হেঁচকা টানে নিজের উপর ফেলে দিলো। মিরা হিজাব খুলে নিয়েছে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠার পর। মূলত রিহান জোর করেই খুলে দিয়েছে। ভেপসা গরমের কারণে যা একটা অবস্থা।
মিরা দৃষ্টি এলোমেলো ঘুরিয়ে নিজে কে সামলে বললো,
-“কফি টা খেয়ে নিন। মাথা ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে। আমি নয়তো মাসাজ করে দেবো।”
রিহান মাদকাসক্ত চোখে তাকিয়ে আছে মিরা’র অধর এর দিকে। মিরা’র হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ছে। রিহান নিজের বা হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল টা দিয়ে মিরা’র ঠোঁটের কোণায় ঘষে।
-“এখানে আছে ঔষধ। আই ওয়ান্ট এ কিস।”
মিরা’র শরীর জুড়ে অসহ্য এক শিহরণ বয়ে গেলো।কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের অধর জোড়া রিহান ভাই এর আয়ত্তে আছে বুঝতে সক্ষম হয়। শ্বাস নিতে ব্যর্থ মেয়ে টা। শক্ত করে শুধু পুরুষ টার উদোম বুকে খামচে ধরে নখের গেঁথে গেলো সেখানে।
রিহান আরো উন্মাদ হলো মিরা’র আঘাতে। আরো ঘনিষ্ঠ করলো মেয়ে টাকে নিজের সাথে।
কিছু সময় পর ছেড়ে দিলো মিরা কে। মিরা ছাড়া পেয়ে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রিহান এই সুযোগে মিরা’র উপর উঠে গেলো। বুকের চির চির করে আসা রক্ত ফোঁটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“আই লাভ ইউ।এন্ড আই অল সো লাভ ইউর টাচ।”
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]