#পিঞ্জিরা
#পর্ব_২২
#জান্নাত_সুলতানা
রিহান এর ঘুম ভাঙ্গে বুয়ার ডাকে। রিহান আসছি বলে আগে নিজের উন্মুক্ত বুকের উপর শুয়ে থাকা নিজের বউ কে দেখলো। মেয়ে টার শরীরে শুধু একটা শার্ট। এলোমেলো চুল ঠিক করে দিয়ে বালিশে শুইয়ে ফ্লোর থেকে ফোন হাতে নিলো। কাল রাতে এটার খবর ছিলো না। কিছু পড়ার শব্দ রাতে হয়েছিলো। তখন রিহান হুঁশে ছিলো না। রিহান তখন উন্মাদ। মিরা বললেও পাত্তা দেয় নি তখন। অতঃপর ফোন চেক করলো। একশো প্লাস কল দেখে মাথা চক্কর দিলো। সাথে ঘড়ির কাঁটায় সময় সাড়ে ন’টা।
কল লিস্ট চেক করে দেখলো কেউ বাদ যায় নি তাকে কল করা থেকে। কাজল থেকে শুরু করে সবাই কল করেছে। রিহান ফোন রেখে মিরা কে মৃদু স্বরে ডাকলো। মিরা শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে। তাই উঠাতে বেশ বেগ পেতে হলো। দু’জন ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো। মিরা একটা পাকিস্তানি থ্রি-পিস পড়েছে যার হাতা গুলো বেশ বড়। আর ওড়না দিয়ে সুন্দর করে শরীর ঢেকে নিলো। বুয়া খাবার এর কথা বললেও রিহান নিষেধ করে দিলো। বউ কে নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। ইফাদ তার জিপগাড়ি রেখে গিয়েছে। একটা পাঁচ তারকা রেস্টুরেন্টের এর সামনে রিহান গাড়ি থামিয়ে মিরা কে নিয়ে ভেতরে গেলো। সেখানে নাস্তা করলো তারা। যদি ও সকাল আর এখন নেই। সাড়ে দশ টার মতো বাজে তখন। এরপর নাস্তা করে রিহান গ্রামের উদ্দেশ্যে ছুটলো। রাস্তায় একবার গাড়ি পুলিশে ধরলো। রিহান ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে আর ঝামেলা করে নি। তারপর একজন পুলিশ রিহান কে দেখে চিনে ফেললো। মেয়র এর ভাগ্নে। এরপর কিছুক্ষণ কথা বললো। রিহান বিরক্ত হলো। কোনো রকম তাড়া দেখিয়ে দ্রুত আবার ছুটলো। মিরা’র মাথায় কিছু ঢুকছে না। বাড়িতে একবার জিজ্ঞেস করেছে কারোর কিছু হয়েছে এতো কেনো তড়িঘড়ি করে বাড়ি যাচ্ছে রিহান? কিন্তু রিহান কিছু বলে নি। তারউপর মিরা’র শরীর টা খারাপ। তাই শুধু চুপচাপ সব দেখতে লাগলো।
প্রায় দুই ঘন্টা পর বারোটার দিকে ওরা এসে বাড়িতে পৌঁছাল। তবে মিরাদের নয় শেখ বাড়িতে। মানুষের হৈ-হুল্লোড়ের আর সাজসজ্জা দেখে মিরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। রিহান গেইটে এর কাছে গাড়ি থেকে নেমে দারোয়ান এর কাছে চাবি দিয়ে মিরা কে কোলে তুলে নিলো। মিরা চমকে উঠলো। চারদিকে মানুষ মিরা রিহান এর গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে রিহান এর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“কি করছেন কি রিহান ভাই? চারদিকে মানুষ। সবাই কি ভাববে?”
-“আই ডোন্ট কেয়ার।”
রিহান এর নির্লিপ্ত জবাব। মিরা’র অল্পস্বল্প রাগ হলো। এতো টা বেহায়া পরিচয় দেওয়া কি আছে বুঝে পেলো না। মিরা যখন বিরক্তিকর মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে তখন রিহান আবার বলে উঠলো,
-“গত রাতের পরেও তোর আমাকে দেখে ভাই ভাই ফিল হচ্ছে! আমি নিজেও কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি আসলে আমি তোর মামাতো ভাই না-কি জামাই!”
মিরা থমথম খেলো। দৃষ্টি এলোমেলো ঘুরিয়ে রিহান এর দিকে তাকিয়ে দেখলো রিহান সামনে তাকিয়ে হাঁটছে। রিহান সোজা মিরা কে নিয়ে লিভিং রুমে গেলো। বাড়ির ভেতর শেখ বাড়ির সবাই বসে আছে। মিরা কে নিচে নামিয়ে রিহান দাঁড়িয়ে রইলো মিরা’র পাশে। রমজান শেখ নাতির দিকে এতোক্ষণ তাকায় নি। এপর্যায়ে এসে তাকালো। গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
-“আরো আগে এলে ভালো হতো দাদু ভাই। তোমার ফুপিমণি আসে নি। আনতে যেতে হবে না!”
রিহান সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি রেডি?”
-“হ্যাঁ।”
-“তাহলে চলো।”
তারপর তারা বেরিয়ে গেলো। রিহান যাওয়ার আগে মিরা কে ইশারায় বলে গেলো জলদি ফিরবে। মিরা বুঝতে পারলো তার মাকে আনতে যাচ্ছে। তাই মন ভালো হয়ে গেলো।
তখন রেহনুমা বেগম এলো। ঈশিতা এসে মিরা কে জড়িয়ে ধরে। রেহনুমা বেগম মিরা’র কপালে চুমু খেলো। ঈশিতা কে বললো,
-“ওকে রুমে নিয়ে যা। মেয়ে গুলো কখন থেকে অপেক্ষা করছে।”
ঈশিতা সহ আরো দুই তিন জন মেয়ে মিরা কে নিয়ে উপরে চলে গেলো। মিরা এই নিয়ে চার বার এসছে শেখ বাড়ি। তাই সব জানা। ওরা সবাই মিরা কে নিয়ে ঈশিতার রুমে গেলো। সেখানে একজন মেক-আপ আর্টিস্ট ছিলো। মিরা যেতে শুরু হলো তাদের অত্যাচার। প্রথম ফ্রেশ হলো। এরপর শুধু লেহেঙ্গার উপরের পার্ট টা পড়ে টাওয়াল গায়ে দিয়ে বসলো। শরীরে বিভিন্ন অংশ লালচে হয়েছে কালকে রাতে রিহান এর পাগলামির ফলে। মিরা এতো সব আয়োজন দেখে বুঝতে সক্ষম হলো এইজন্য কাল কারিরা বেগম কে এরপর আর দেখতে পায় নি। সবাই আগে থেকে এসব প্ল্যানিং করে রেখেছিলো ভেবে মিরা খুশি হলো। তার সব স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষ টাকে পাওয়ার মতো ইচ্ছে আর কোনো কিছুতে থাকে না। তবে নিজের ভালোবাসার মানুষ টাকে পাওয়ার সাথে সাথে কিছু ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো পূরণ হলেও মন্দ হয় না।
——–
শেখ বাড়ি এতো সুন্দর করে সাজিয়েছে কোনো সেন্টার এর থেকে কম নয়। বরং আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। চারপাশে মানুষ ছড়িয়ে ছুটিয়ে আছে।
মিরা’র মা অনেক বছর পর নিজের বাবা-র বাড়িতে এসে একদম চুপ হয়ে গেলেন। শুধু চারদিক দেখতে লাগলেন। এই রিহান কে এক সময় রোকেয়া নিজের সন্তান এর মতো আগলে রেখেছে। ভালোবাসা আদর যত্ন সব দিয়েছে।
রোকেয়া বেগম কে সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে। কারিরা বেগম, রেহনুমা এবং রিহান এর কাকি, দাদি সবাই আহ্লাদ করছেন। কত কি যে বলছে দেখাচ্ছে। যেনো তাদের মাঝে গভীর সম্পর্ক। হ্যাঁ গভীর সম্পর্ক পূরোন সম্পর্ক তবে তাদের মাঝে বেশ কিছু বছর দূরত্ব ছিলো। রোকেয়া নিজের মাঝে জড়তা ধরে রাখতে পারলো না। স্বামীর জন্য খারাপ লাগলেও সবার সাথে স্বাভাবিক হলেন। শাহনাজ এর মা শাহনাজ এসছে। কমলা বেগম নিনা বেগম এর সাথে গল্প ব্যস্ত হলো। শাহনাজ উপরে গিয়ে মিরা’র সাথে কথা বললো। সাজ কমপ্লিট হতে অনেক সময় গড়ালো। পুরুষরা নামাজে গেলো। ফিরে এসে বিয়ে পড়াবে। তখন মিরা কে নিচে আনা হলো। মিরা নিজের মা’কে সবার মাঝে এমন হাসিখুশি বসে আড্ডা দিতে দেখে খুশিতে কেঁদে দিলো। রোকেয়া মেয়ের কান্নার খবর পেয়ে সেখান থেকে উঠে এলো। সবাই এলো পেছন পেছন। রোকেয়া মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিলো। ততক্ষণে সব পুরুষ চলে এসছে। মিরা কে ঘোমটা দিয়ে বর এর পাশের সোফায় বসানো হলো। মিরা লাল টকটকে দোপাট্টার আড়াল থেকে আঁড়চোখে পাশে বসা সাদা রঙের পাঞ্জাবি পাজামা পরিহিত নিজের ব্যক্তিগত পুরুষ টাকে একপলক দেখে মুগ্ধ হলো। বিয়ে তাদের হয়েছে তাই আর বিয়ে পড়ায় নি। শুধু নতুন করে রেজিস্ট্রার করে।
——
সব মানঅভিমান শেষ করে রোকেয়া নিজের শাশুড়ী কে নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে গেলো।
মিরা’র পুরো টা সময় ভালো কাটলেও মাকে বিদায় দিতে তার কষ্ট হলো। অদ্ভুত এক কষ্টে চোখ দিয়ে শুধু টপটপ করে জল পড়ে। রোকেয়া নিজের ও কষ্টে বুক ব্যথা হয়। চোখ জ্বলে। ভালোবাসার মানুষ প্রাণপ্রিয় স্বামী কে হারিয়ে একমাত্র মেয়ের মুখ চেয়ে তিনি সব ভুলে গিয়েছিলো। আজ যেন মেয়ে কে পড় করে দিয়ে সে-সব কষ্ট এসে বুকে আবার তাজা হলো।
সবার বোঝানোর পর মিরা কিছু টা শান্ত হয়। সব ফর্মালিটি শেষ করতে রাত সাড়ে আটটা বাজল। মিরা কিছু খেলো না। এমনি রুমে চলে গেলো। রিহান এর কাকি রেহনুমা কে বেশি জোর করতে বারণ করলেন। জানালেন রিহান এর কাছে খাবার দিয়ে দিবে। রিহান মাত্র বাইরে থেকে এসছিলো নিজের বন্ধুদের বিদায় দিয়ে। তখন রিহান মায়ের কাছে আসে। আর রেহনুমা বেগম বুয়া কে বলে একটা প্লেটে দু’জন এর জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে রিহান এর কাছে দিয়ে মিরা কে খাইয়ে দিয়ে নিজেও যেন খেয়ে নেয় বলে দিলো।
রিহান কোনো কিছু না বলে উপরে নিজের রুমে চলে এলো খাবার প্লেট নি।
ঈশিতা সহ কিছু মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রিহান রুমের দরজার সামনে রিহান বিনাবাক্যে নিজের ওয়ালেট ঈশিতার হাতে দিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“ইফাদ কোথায়?”
-“ভাইয়া ছাঁদে গিয়েছে একটু আগে।”
ঈশিতা ওয়ালেট পেয়ে খুশি হলেও নিজের ভাই এর কথা বলায় কিছু টা মনমরা হয়ে যায়। তার ভাই আগে প্লেবয় টাইপ ছিলো। কিন্তু এখন তার চালচলন দেখে মনে হচ্ছে বদলে গিয়েছে। কিন্তু তারপরও একটা সময় সে শিশির কে অবহেলা করেছে। মূল্য দেয় নি থাকতে। এখন হারানোর যন্ত্রণা তো উপলব্ধি তাকে করতে হবেই। রিহান এর কথায় ঈশিতার ভাবনা ছেদ ঘটে।
-“ওর দিকে নজর রাখবি। এখানে এনআইডি বাদে সব রেখে কাল সকালে ওয়ালেট ফেরত দিবি।”
রিহান কথা টা শেষ করে এক সেকেন্ড অপেক্ষা করে না। দরজা বন্ধ করে দিলো।
মিরা নিজের সব গহনা খুলছিলো। রিহান কে দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। তার মন টা খারাপ মায়ের জন্য। রিহান বুঝতে পারে। খাবার প্লেট রেখে মিরা কে সাহায্য করলো। মিরা সব গহন খুলে একটা থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশ রুম চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে সেই থ্রি-পিস পড়ে বেরিয়ে এলো। লেহেঙ্গা রিহান নিজে নিয়ে হ্যাঙারে রাখলো।
মিরা কে বললো,
-“তুই বস। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খাইয়ে দিচ্ছি।”
রিহান মিরা’র কথা শোনার অপেক্ষা না করে ওয়াশ রুম চলে গেলো একটা টাওয়াল হাতে। ফিরে এলো একদম শাওয়ার নিয়ে।
টাওয়াল বদলে ট্রাউজার আর গেঞ্জি পড়ে নিলো। মিরা আঁড়চোখে সব দেখলো। এরপর রিহান এসে মিরা’র পাশে বসে। মিরা নিজে ই রিহান কে খাইয়ে দিতে লাগলো। রিহান একটু অবাক হলো। তবে কিছু বললো না। খেয়ে নিলো চুপচাপ। এরপর খাওয়া শেষ মিরা হাত ধুয়ে আসতে রিহান ওর হাতে একটা রিং পড়িয়ে দিলো। মিরা মৃদু হাসলো। রিহান মিরা কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“মন খারাপ করার কিছু নেই জান। কাছেই তো যখন ভালো লাগে চলে যাবে। নয়তো মাকে এখানে এনে রেখে দিবে।”
-“কিন্তু রাতে কোথাও থাকা যাবে না।”
পরপর রিহান আবার সাবধান করে দিয়ে বলে। মিরা মুচকি হাসলো। রিহান ওর রিং পড়ানোর হাতের উলটো পিঠে চুমু খেলো। তখন ব্যালকনি থেকে টম ছুটে এলো। রিহান মিরা দু’জনে প্রথমে চমকে উঠলো। পরে মিরা টম কে দেখে খুশি হলো। আর রিহান বিরক্ত। মিরা টম এর কাছে গিয়ে হাঁটু ভাজ করে বসে ওকে টম কে আদর করতে লাগলো। রিহান কপালে তর্জনী আঙ্গুল ঘষে বিড়বিড় করে আওড়াল,
-“এই দেখো, উনি আমার রোমাঞ্চে বাগাড় দিতে হাজির।”
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]