পিঞ্জিরা পর্ব-২৪

0
254

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_২৪
#জান্নাত_সুলতানা

সকালে ঘুম ভেঙ্গে মিরা’র সর্বপ্রথম নজর পড়লো ঘুমন্ত রিহান ভাই এর মুখের দিকে। রিহান ভাই এর গতকাল রাতের করা পাগলামির কথা মনে পড়ে মেয়ে টা লজ্জায় লাল-নীল বর্ণ ধারণ করলো। রিহান কে ঠেলে সরিয়ে উঠে বসলো। পা টিপেটিপে বাহিরে ওয়াশ রুমে গেলো। সাথে নিয়ে গেলো নিজের জামাকাপড়। রিহান তখন ঘুমে বিভোর। মিরা একবারে গোসল দিয়ে ওজু করা তবেই এলো রুমে। কাপড় নিজের রুমে থাকা রশিতে মেলে দিয়ে রিহান কে ডাকলো। রিহান নড়েচড়ে উঠলো তো নাই উলটো মেয়ে টা কে নিজের বাহুতে নিয়ে বিছানায় ফেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“এতো সকালে উঠেছ কেনো?
আরো ঘুমাও। আমাকেও ঘুমতে দাও।”

মিরা’র হার্টবিট ফাস্ট চলছে। এতো গভীর সংস্পর্শ পেয়েও মেয়ে টা এখন নিজে কে সামলে নিতে পারে না। হিমশিম খায় একটু ছুঁয়ে দিলে।
রিনরিন স্বরে ডেকে উঠে বললো,

-“উঠুন প্লিজ। এক সাথে নামাজ টা অন্তত পড়ুন!”

রিহান পিটপিট করে তাকিয়ে উঠে বসলো। মিরা’র দিকে কত সময় অপলক তাকিয়ে রইলো। এদিকে দাদি উঠার সময় হয়ে যাচ্ছে মিরা রিহান কে তাগাদা দিলো। রিহান মিরা’র দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকালে। মিরা থমথম খেলো। রিহান বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠলো,

-“এক সাথে নামাজ টা অন্তত পড়ুন! কেনো যখন শাওয়ার নিতে গেলি তখন এই কথা টা বলা যায় নি?”

কথা টা বলে থামলো রিহান। এরপর আবার গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

-“এই কথা না বলার অপরাধে তোকে আবার এখন এই মূহুর্তে রিহান শেখ এর সাথে শাওয়ারে যেতে হবে।”

মিরা চমকে উঠলো। বিস্ময় চোখ জোড়া আপনা-আপনি বড় বড় আকৃতি ধারণ করলো। ছুটাছুটি করলো নিজে কে রিহান এর থেকে ছাড়ানোর কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো না। রিহান মিরা কে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে কাঁধে তুলে নিলো মেয়ে টাকে। মিরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে রিহান এর পিঠে নখরে আঁচড় কাটে। রিহান ব্যথা পায়। কিন্তু টুঁশব্দ করে না। বরং সে মিরা’র এই বাচ্চামো এনজয় করলো। অধর কামড়ে হাসে। ওয়াশ রুমে গিয়ে দরজা লক করে নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিরা কে নিজের পিঠ দেখিয়ে বললো,

-“রাক্ষসী। এভাবে করে কেউ?
জীবনে কারোর সামনে খালি গায়ে যাওয়ার পথ রাখে নি বেয়াদব।”

মিরা দাঁত কিড়মিড় করে। অসভ্য পুরুষ। নিজে এরচেয়ে বেশি করেছে। মিরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো যেন। আচমকাই নিজের গলার ওড়না সরিয়ে আঙ্গুল তুলে ক্ষতস্থান দেখিয়ে বললো,

-“আপনি কি করেছেন একবার ভালো করে দেখুন,,,”

রিহান তাকিয়ে আছে মিরা’র দিকে। যা দেখে থমথম খেয়ে চুপ করে গেলো মিরা।
রিহান এক পা দুই পা করে মিরা’র দিকে এগিয়ে গেলো। মিরা পিছিয়ে গেলো। রিহান একদম মিরা’র কাছে গিয়ে ঝর্ণা ছাড়ে। ঝিরিঝিরি করে পানি পড়ে দু’জন কে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো।

—–

দুপুরে খেয়েদেয়ে মিরা রিহান শেখ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পরন্ত বিকেল তখন। শীতের আগাম বার্তা পরিবেশ টা বেশ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হয়ে ধরা দিচ্ছে। টম মিরা’র কোলে বসে নাক ঢেকে ঘুমচ্ছে। মিরা ওর পিঠে আলতো চাপড় মারে। বজ্জাত বিড়াল। মালিকন যেমন ঠিক তেমন তার পোষা বিড়াল।
দু’জন একরকম। রিহান এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে। শেখ বাড়িতে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। মিরা কে নিচে রেখে রিহান নিজের রুমে চলে গেলো। এদিকে সবার সাথে মিরা গল্প মেতে উঠলো। ঈশিতা এখনো ঢাকা ফিরে যায় নি। মিরা শুনেছে এবার না-কি রিহান দের ফ্ল্যাটে উঠবে ওরা। চৌধুরী বাড়িতে থাকবে না আর। রিহান সেখান থেকে নিজের কোম্পানির যাতায়াত সুবিধা হবে।
মিরা’র যদিও যাওয়ার ইচ্ছে নেই শহরে এখন রিহান কে রাজি করাতে হবে।

——–

শিশির কাজল একটা ফ্ল্যাটে থাকছে। যদিও আগে তাদের মামার বাড়ি থাকতো। তবে কোনো অজানা কারণে এখন আর সেখানে থাকছে না দু’জন। রিহান যাওয়ার পরপরই কাজল আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছে। একজন কেয়ারটেকার আছে রান্নাবান্না বাসা গোছানো এবং ফ্ল্যাটে একটা রুমে তিনি থাকেন। মহিলা টা বাংলাদেশি। শিশির এর কাজল এর অনেক খেয়াল রাখে। বয়স মোটামুটি চল্লিশ ছাড়িয়েছ। সকাল আটটার মধ্যে শিশির নিজের ক্লাসের জন্য বেরিয়ে যায়। তার পরপরই কাজল। আবার মাঝেমধ্যে দুজনেই এক সাথে বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে রাতে। মাঝে আর কেউ আসে না। কিন্তু আজ হঠাৎ বেলা এগারো টা বাজে বাড়ির কলিং বেল বাজায় কেয়ারটেকার ভাবুক হয়। দরজা খুলে ইফাদ কে ভ্রু কুঁচকালেন। তবে হাবভাব দেখে কিছু টা আন্দাজ করে হয়তো কাজল এর কোনো রিলেটিভ হবে। আর পোশাকআশাক বাঙালী একটা স্টাইল রয়েছে। তাই বাংলাতে তিনি সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“কাকে চাই?”

-“আমি ইফাদ। কাজল আমার শালাবাবু।”

গম্ভীর স্বরে বললো ইফাদ। মহিলা তবুও কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। ইফাদ নিজের ফোন বেড় করলো। কল করলো কাজল এর নাম্বারে। ভাগ্য ভালো আসার আগে রিহান এর থেকে সিম কার্ড টা নিয়ে এসেছিলো। দুই বার রিং হতে কাজল রিসিভ করে। ইফাদ কিছু সময় কথা বলে রেখে এগিয়ে এসে মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

-“কাজল আসছে।”

মহিলা কি ভেবে ভেতরে আসতে বললো। দরজা খোলা রেখে কিচেনে গিয়ে পানি নিয়ে এলো। ইফাদ পানি খেয়ে গ্লাস রাখতে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো কাজল। কাছেই একটা কাজে এসছিলো কাজল। আর ইফাদ এসছে শুনে সব কাজটাজ ফেলে ছুটে এসছে।
ইফাদ কাজল কে দেখে বেশ খুশি হলো। এগিয়ে এসে হাগ করলো। কাজল থম মেরে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। ইফাদ এসছে। এই প্লে বয় সুইজারল্যান্ড চলে এসছে। বিশ্বাস হচ্ছে না।

প্রায় অনেক টা সময় লাগলো সব বিশ্বাস করতে। ইফাদ এর আপ্যায়ন যেনো কোনো রকম ত্রুটি না থাকে। সব বুঝিয়ে দিয়ে আবার কাজে চলে গেলো কাজল। ইফাদ বায়না ধরলো শিশির এর ভার্সিটির ঠিকানা বলতে। কিন্তু কাজল বুঝালো শিশির এখন ক্লাসে থাকবে তাই এখন গিয়েও কোনো লাভ হবে না।
ইফাদ মনঃক্ষুণ্ন হলেও বিশ্বাস করে নিলো কাজল এর কথা।

——-

মিরা শহরে যাচ্ছে না। রিহান কেও বাধ্য হয়ে রোজ অফিস শেষ আবার গ্রামে ফিরতে হচ্ছে। রিহান এর একটু জার্নি বেশি হয়। মিরা’র মায়া লাগে। তাই ঠিক করলো সামনে মাস থেকে রিহান এর সাথে চলে যাবে। আজ রিহান ফিরলে এব্যাপারে কথা বলবে। বাড়ির সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমতে চলে গিয়েছে। রেহনুমা বেগম এতো সময় বসে থাকলেও মিরা রাত সাড়ে এগারো টা বেজে যাওয়াতে ঠেলে ঠুলে রুমে পাঠালেন। এদিকে নিজে বসে রইলো। কিন্তু মন টা ছটফট করছে। এতো রাত কখনো করে না রিহান। মিরা লিভিং রুমে ঘড়ি দেখলো। বারো টার কোঠা ছাড়াতে মিরা কিছু টা অস্থির হলো। কল করলো বেশ কয়েকবার। ফোন টা বন্ধ দেখাচ্ছে। অথচ সাড়ে ন’টার দিকেও ফোন খোলাই ছিলো। রিহান কল করে মিরা’র সাথে কথা বলেছে।
আর হঠাৎ করে আবার এখন ফোন বন্ধ তাই টেনশনে পড়ে গেলো মেয়ে টা। ছটফটানি নিয়ে রাত বাড়তে লাগলো। একটা সময় রাত দেড় টা বেজে গেলো। মিরা না পেরে রেহনুমা বেগম কে ডাকলো। তিনি মিরা’র কাছে ঘটনা শুনে স্বামী কে কল লাগালো। এক-এক মিরা ছোট মামি ঈশিতা সবাই লিভিং রুমে এসে জড়ো হলো। রিয়াজ শেখ বাড়ি নেই। কোম্পানির কোনো এক কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছেন। উনার কাছে খবর পৌঁছানো পর আতিক চৌধুরী কল দিলো রেহনুমা বেগম এর কাছে। এরপর তিনি আশ্বস্ত করলেন সকালের আগে খোঁজ পাওয়া যাবে। পুলিশ কে ইনফর্ম করেছেন তিনি।
এভাবে ছটফট করতে করতে সকাল হয়ে গেলো। মিরা এলোমেলো হয়ে সোফায় বসে আছে। নিনা বেগম নাতনির এই অবস্থা দেখে দুঃখ প্রকাশ করছেন একটু পর পর। সকাল সাত টা বাজে ঈশিতা নিজের রুম থেকে ছুটে এলো। টিভি অন করে নিউজ চ্যালেন খুঁজতে লাগলো। ঈশিতার মা মেয়ের এমন কাজে রেগে গেলেন। তবে নিউজ চ্যানেলে নিউজ দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো । তাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। কোনো বডি শনাক্ত করতে পারে নি এখনো পুলিশ। তবে গাড়ি টা রিহান শেখ এর। আর তার ফোন ওয়ালেট গাড়ির ভেতর পাওয়া গিয়েছে। যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেখানে একটা বড় খাল রয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে এক্সিডেন্ট এর পর হয়তো বডি এই খালে পড়ে গিয়েছে।
মিরা যেন পাগল হলো। সোফায় ছেড়ে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো,

-“এটা আমার রিহান হতে পারে না। ঈশি টিভি বন্ধ করো এ-সব মিথ্যা কথা। তোমার ভাই এর কিছু হতে ই পারে না। আমাদের এখনো অনেক টা পথ এক সাথে চলা বাকি যে।”

#চলবে…..