#পিঞ্জিরা
#পর্ব_২৫
#জান্নাত_সুলতানা
-“আমি রিহান ভাই এর কাছে যাবো।
আম্মা একবার যাইতে দাও আমারে। আম্মা যাইতে দাও না প্লিজ।”
মিরা তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। আর একটু আগে যখন জ্ঞান ফিরলো তখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে সমানতালে সাথে করা পাগলামির কথা না-হয় বাদেই দেওয়া যায়।
রোকেয়া মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করে।
লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না এতে।
রোকেয়া নিজেও কাঁদছে। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন তিনি। সংসার ঠিকই করেছেন কিন্তু স্বামীর ভালোবাসা বেশিদিন ভাগ্যে জুটে নি। স্বামী মারা গিয়েছে তিনি সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে শাশুড়ী নিয়ে সংসারে থেকেছে। বাপ ভাই প্রভাবশালী হওয়াতে গায়ে লাগে নি তেমন কিছু। সামনা-সামনি না করলেও আড়ালে তাকে শেখ বাড়ির প্রতি টা সদস্য সাহায্য করেছেন। কিন্তু মেয়ের যে তেমন কিছু ই নেই। কি করে বাঁচবে মেয়ে এই হতভাগা জীবন নিয়ে!
মিরা কাঁদতে কাঁদতে আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
রোকেয়া বেগম মেয়ে কে শুয়ে দিলো। মাথায় তেল দিয়ে দিলো। কিন্তু চোখ দিয়ে তার পানি অঝোরে পড়ছে। বড্ড আফসোস হচ্ছে এটা ভেবে মেয়ে কি তবে তারই কপাল নিয়ে পৃথিবীতে এলো? খোদার দরবারে কি একটু ভিন্ন রকম চাইতে পারে নি? রোকেয়া বেগম অন্তরে যেন আজ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। স্বামী হারিয়ে তিনি পাথর ছিলেন আর আজ মেয়ের অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে দিশেহারা।
তিনি যখন এসব ভাবছিল তখন কেউ একজন রুমে এলো হন্তদন্ত হয়ে। এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো,
-“আপামণি রিহান বাবা-র পাওয়া গেছে।”
মিরা’র মায়ের কলিজা কাঁপছে। পাওয়া গিয়েছে শুধু এতটুকুতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারলো না। হ্যাঁ কথা টা খুবই অকৃতজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু সত্যি এটাই তিনি এতে খুশি হতে পারছে না। তার আরো একটু বেশি কিছু চাই।
আল্লাহর কাছে মনে মনে সেই চাওয়া খুব করে চাইলো। মনপ্রাণ দিয়ে মেয়ের জীবন টা তার মতো এমন না করার অনুরোধ করলো। জি’হ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চোখের জল মুছে নিলেন। খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় আছে ও?
ঠিক আছে?”
মনে মনে চাইলে উত্তর যেন পজিটিভ আসে। ভালো একটা খবর চাইছেন তিনি। এখন কতটুকু সেটা ভালো হবে আশংকা করতে পারছেন না।
ভয়ে আতংকে খিঁচে আছেন তিনি। বুয়া কিছু টা মলিন স্বরে জানালো,
-“হসপিটাল পাইছে হুনলাম। কিন্তু এর বেশি কিছু কইতে পারলাম না আপা মণি।”
রোকেয়া মেয়ের কাছে বুয়া কে বসতে বলে নিজে দ্রুত টলতে টলতে নিচে এলেন।
লিভিং রুমে তখন এক-এক একজন ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। ঢাকা থেকে কারিরা বেগম আতিক চৌধুরী সেই ভোরে চলে এসছে। আপাতত সবাই রিহান কে যে হসপিটাল আছে সেখানে যাচ্ছে। রোকেয়া আসতে রিহান এর বাবা রোকেয়া বেগম কে শর্টকাট করে খবর টা দিলো। এরপর মিরা’র খেয়াল রাখতে বলে সবাই হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। রোকেয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মেয়ের জীবন যেন তার জীবন এর মতো এমন অভিশপ্ত না হয় সেই কামনা করতে লাগলেন।
——-
গতকাল শিশির এর দেখা পেলো ইফাদ শিশির এর সাথে কথা বলার মতো সুযোগ টা পাচ্ছে না। গতকাল ইফাদ সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশির এর জন্য অপেক্ষা করে ছিলো। শিশির যখন বাসায় এলো তখন ইফাদ কে দেখে অবাক হলে-ও মেয়ে টা কোনো প্রতিক্রিয়া না করে নিজের রুমে গিয়ে সেই যে রুমের দরজা আটকেছে আর খুলে নি। বাহিরে ও আসে নি। ওই মহিলা টা রুমে খাবার দিয়েছে। ইফাদ তক্কে তক্কে আছে। এরমধ্যে একদম ভোরে বাংলাদেশ থেকে কল এসছে। আতিক চৌধুরী কাজল কে কল করেছে। যেহেতু ইফাদ কাজল এর সাথে রয়েছে সে-ও শুনতে পেলো রিহান এক্সিডেন্ট করেছে আর পুরো এগারো ঘন্টা পর তার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। কাজল অস্থির হলো। ইফাদ কে বলতে সে-ও অস্থির হয়ে কল লাগালে নিজের বাবা-র কাছে অবশেষে খবর পেলো রিহান এখন হসপিটাল রয়েছে তবে খবর খুব বেশি সুবিধার নয়। কাজল ইফাদ দু’জনেই বন্ধুর এমন মর্মান্তিক দশায় পাগলপ্রায়। এক সাথে সেই শৈশব থেকে। সুখ দুঃখে একে-অপরের পাশে থেকেছে। আর আজ বন্ধু তাদের মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে তারা সেটা কিভাবে এই সূদুর বসে দেখবে? অপেক্ষা তারা করতে পারবে না। প্রয়োজনে কাছে বসে থাকবে। কাজল নিজের বোন সহ ইফাদ এর ইমারজেন্সি বাংলাদেশ ব্যাক করার বন্দবস্ত করতে চললো। শিশির খবর পেয়ে অনেক টাই উতলা হয়ে পড়েছে। সবার কাছে একে একে ফোন করলো। মিরা’র খোঁজ নিলো। মিরা সকাল থেকে অজ্ঞান শুনে শিশির এর বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। মেয়ে টা নিশ্চিত এবার ভয় টা একটু বেশি পেয়েছে। বয়স কম। তারউপর পরপর এমন ঘটনা ঘটছে মেয়ে টার সাথে শিশির এর খারাপ লাগে মিরা’র জন্য। মনপ্রাণ দিয়ে চাইলো মেয়ে টার সাথে যেন খারাপ কিছু না হয়। আর তার ভাই কেও যেন আল্লাহ সুস্থতা দান করে।
———-
মিরা কে জ্ঞান ফিরতে না দেখে রোকেয়া মেয়ে কে হসপিটাল নিলো। ডক্টর জানালো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় মেয়ে টা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া গতকাল দুপুরের পর মেয়ে টা আর কিছু খায় নি। তারউপর এতো বড় একটা খবর পেয়ে নিজে কে শক্ত রাখা এই বয়সে! মিরা’র মা মেয়ের কাছে বসে রইলো। রিহান একই হসপিটালে রয়েছে। তবে তাকে ঢাকা নেওয়ার তোড়জোড় চলছে। রোকেয়া একপর্যায়ে এসে আবার চাইলো মেয়ের আজ জ্ঞান না ফিরুক। মেয়ের কষ্ট তার সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু এই দো’আ টা করে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না তার আগে মিরা’র জ্ঞান ফিরলো। আবার সেই পাগলামি। রিহান কে তখন কোনো রকম প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
আতিক চৌধুরী ভাগ্নে কে আকাশ পথে ঢাকা নিতে চাইলে ডক্টর এতে সাপোর্ট করলো না। জানালো অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়ার জন্য। এটার ব্যবস্থা করতে ও খুব বেশি সময় লাগলো না। রিহান কে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে মিরা পাগল হয়ে ছুটে এলো। কেঁদেকুটে মেয়ে টার অবস্থা নাজেহাল অবস্থা। শত বারণ করেও কেউ আটকাতে সক্ষম হলো না। তার এক কথা আমি রিহান ভাই এর সাথে যাবো। রোকেয়া মেয়ে কে অসুস্থ বলেও আটকাতে পারে না। মিরা’র জবাব আমি আর অসুস্থ হবো না আম্মা। রেহনুমা বেগম মিরা রিহান এর সাথে আর সামনে ড্রাইভার এর সাথে রিহান এর বাবা। দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে দ্রুত তারা হসপিটাল পৌঁছালো।
গাড়িতে মিরা ছটফট করেছে পুরো টা সময়। রিহান এর মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মিরা আসার সময় পুরো রাস্তা রিহান এর ব্যান্ডেজকৃত মাথায় হাত বুলিয়ে এসছে। হসপিটাল এসে ও মেয়ে টা একটুও কাঁদল না। রেহনুমা অবাক হলো। গতকাল রাত থেকে মেয়ে টা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছে অনেক বার। সেই মেয়ে টা হঠাৎ করে কেমন শক্ত হয়ে গেলো। তবে একটু ভালো লাগলো মেয়ে টা নিজে কে একটু হলে-ও সামলাতে পারছে। পরিস্থিতি যেমন হোক। সেটা বুঝতে পারা নিজে কে সামলে নেওয়া এটাই মুখ্য। ভেঙ্গে পড়া কোনো সমাধান নয়।
ঢাকা রিহান এর চাচি ঈশিতা আর রোকেয়া নিনা বেগম বাদে আর বাকিরা সবাই চলে এসছে।
দীর্ঘ তিন ঘন্টা অপেক্ষার পর ডক্টর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরুলো। এবং আতিক চৌধুরীর সাথে বললো সব ঠিকঠাক। এখন রাতের মধ্যে জ্ঞান ফিরলে তবেই আর কোনো ভয় থাকবে না।
এটুকু খবর পেয়ে সবাই শুকরিয়া আদায় করলো। কারণ রিহান কে যখন হসপিটাল আনা হয় তখন তার পালস ও না-কি খোঁজে পাওয়া ও যাচ্ছিলো না বলে ডক্টর রা তাকে মৃত ভেবেই নিয়েছিলো। দীর্ঘ সময় সে পানির নিচে ছিলো। তারউপর মাথায় আর বুকের হাড়ে আঘাত। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে রিহান বেঁচে গিয়েছে।
বেশ ভালো একটা কেবিন দেওয়া হয়েছে রিহান কে। সেখানে সোফায় চিন্তিত মুখে বসে ছিলো কেউ তো কেউ আবার দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখনো জ্ঞান ফিরবে রিহান এর।
মিরা বসে আছে রিহান এর বেড এর পাশের একটা টুলে। তখন একজন নার্স এসে স্যালাইন খুলে আবার একটা লাগালো। এরমধ্যে রিহান নাড়াচাড়া করতে লাগলো। নার্স ডক্টর ডাকলো। ডক্টর এসে চেক-আপ করে মুচকি হেঁসে বললো,
-“ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়েছেন। বাট বি কেয়ার ফুল। ডক্টর এর নির্দেশনা মেনে অবশ্যই চলাফেরা করতে হবে।”
রিহান তখন পিটপিট করে সবার মাঝে মূর্ছা যায় যায় করছে সেই মিরা’র দিকে তাকিয়ে আছে।
মিরা’র মুখ বেদনার ছাফ স্পষ্ট। কিন্তু চোখে ক্লান্তি। রিহান বুঝতে পারছে তারজন্য মেয়ে টা আবারও কষ্ট পেয়েছে। কত সময়? পুরো একদিন এক রাত। রিহান এর বুক ভারি হয়ে আসে। বুকের একপাশে ব্যান্ডেজ। টনটন করছে সেখানে। তবুও একটা হাত উঁচিয়ে মিরা কে ইশারায় কাছে ডাকলো। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে মিরা শাশুড়ীর আড়ালে দাঁড়ালো গিয়ে। রিহান বিস্ময় কোনো কিছু ভাবতে ভুলে গেলো। শুধু অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে মিরা’র বাহুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]