#পিঞ্জিরা
#পর্ব_২৬
#জান্নাত_সুলতানা
-“কাছে আয়!”
মিরা গেলো না। দাঁড়িয়ে রইলো ঠাঁই। রিহান চোখ বন্ধ করে ভালো হাত টার তর্জনী আঙ্গুল কপালে রেখে ফোলা অধর কামড়ে ধরলো। ব্যথিত শরীরে মেয়ে টার চোখের আড়ালে হাসে পুরুষ টা। চোখ বন্ধ রেখে ফের বলে উঠলো,
-“আসবি না?”
মিরা মাথা নাড়ে। যার অর্থ না। একটু আগে মেয়ে টা ফ্রেশ হয়েছে। শাড়ী চেঞ্জ করে থ্রি-পিস পড়েছে। রেহনুমা মিরা কে খাবার খাইয়ে দিয়ে তারপর রাত আটটার দিকে সবাই চৌধুরী বাড়ি চলে গিয়েছে। এখন হসপিটালে শুধু মিরা আর আতিক চৌধুরীর একজন এসিস্ট্যান্ট রয়েছে।
এসিস্ট্যান্ট বাহিরে রয়েছে। যেকোনো প্রয়োজনে সে হাজির থাকে। মিরা দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে রিহান এর দিকে। রিহান কেনো একটু সতর্ক হয় না। কেনো নিজের খেয়াল রাখে না। যদি লেইট হয়ে যাচ্ছিল। তাহলে কেনো আসতে হয়েছিল আবার ফিরে? থেকে গেলে কি হতো চৌধুরী বাড়িতে? আবার পরক্ষণেই অপরাধেও ভুগছে। যদি সে রিহান এর সাথে চলে যেতো তবে হয়তো প্রতিদিন এতো পথ জার্নি করে পুরুষ টাকে গ্রামে ফিরতে হতো না। আর না এমন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো। বোকা মিরা এটা ভাবছে না বিপদ যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে সেটা ঘরে বসে থাকলেও আসবে।
আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। কিন্তু বিপদে পড়লে মানবজাতি এটা ভুলে বসে। শুধু আফসোস আর আফসোস মুখে লেগেই থাকে। যেটা করা মোটেও ঠিক না। বিপদ যদি উপরআলা দিতে পারেন তাহলে সেই বিপদ থেকে ও তিনিই উদ্ধার করবেন। কিন্তু আমরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। আফসোস এর সুর তুলি।
মিরা’র হয়তো বর্তমান এমন অবস্থাই হয়েছে। রিহান এর ফোন কোথায় জানা নেই কারোর। মিরা’র ফোন শেখ বাড়িতে ছিলো। এটা আনা হয়েছে বিকালে। এখন এটা চার্জ দেওয়া। রিহান এর বেডে কাছে ফোন টা অনবরত বেজে চলছে। মিরা জানে রিহান কল ধরবে না। খুব সাবধানে গিয়ে ফোন টা রিসিভ করলো। কানে ধরতে রোকেয়া বেগম কথা বললো। খবর পেয়েছে মিরা নিজে কে দোষারোপ করছে রিহান এর এমন অবস্থার জন্য। যেটা করা একদম অনুচিত। কত কিছু বলে মেয়ে কে বোঝালো। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। এসব নিয়ে যেন নিজে কে দায়ী করে রিহান কে অবহেলা না করে।
মিরা মন দিয়ে শুনে। শুধু হুাঁ, হ্যাঁ করে ফোন রাখলো। রিহান তখন চোখ উলটে তাকিয়ে আছে মিরা’র দিকে। ব্যথা হচ্ছে চোখে তবুও তাকিয়ে আছে। মিরা থমথম খেলো। দুই কদম পেছনে এসে রিহান এর সামনে দাঁড়ালো। নিজের একটা হাত বুকের কাছে ব্যান্ডেজ টার উপর রাখে। গত পরশু এই বক্ষ একদম ভালো ছিলো। রাতের মধুময় মুহূর্ত শেষ সে এখানে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়েছে। প্রশান্তির ঘুম। কিন্তু এটা হয়তো আগামী এক মাস ও আর সম্ভব হবে না। মিরা’র বুকের ভেতর যন্ত্রণা হয়। চোখ জ্বলে। টলমল করে চোখে জলে। ঘন পাপড়ি ভিজে উঠেছে। গোলাপি অধর জোড়া কেমন ফ্যাকাসে হয়েছে। রিহান এর চোখে এতেও মেয়ে টা কে ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে।
মিরা ঠোঁট উলটে বললো,
-“আমি এখানে ঘুমতে পারবো না আর।”
-“কে বলেছে পারবি না? তুই দরজা টা আঁটকে আয়।”
রিহান ধীরে কণ্ঠে বললো।
মিরা দরজা বন্ধ করে এলো। রিহান পাশে ইশারা করে শুতে বললো মেয়ে টাকে। মিরা ঘাড় নাড়ে। রিহান জানে তার সমস্যা হবে ভেবে মেয়ে টা সেইজন্য সারারাত বসে থাকার প্ল্যান করেছে। যদিও চাইলে সোফায় শোয়া যাবে। কিন্তু মিরা যে সেখানে যাবে না ভালোই জানা রিহান এর।
অনেক্ক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো মিরা। রিহান শুধু তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। যা দেখে মিরা অপ্রস্তুত হচ্ছে। পায়ের জুতা খুলে উঠে বসে। দেহ ছিমছাম গড়নের হওয়ার সুবাদে খুব সহজে শুয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এদিক-ওদিক কোনো দিক হওয়ার চান্স নেই। যদি নড়াচড়া করতে হয় তবে রিহান এর দিকে চাপতে হবে। যেটা মিরা চাইছে না।
রিহান ভালো হাত টা দিয়ে মিরা’র মাথা টা কাত করে দিলো। এরপর নিজেও একটু আড় হয়ে শুয়ে তাকিয়ে রইলো মিরা’র মুখের দিকে। মিরা অল্প সময়ে চোখ বন্ধ করে লজ্জায়।
এতো দেখার কি আছে ভেবে পায় না মেয়ে টা।
——
আজ ভোরে এসে বাংলাদেশ পৌঁছেছে কাজল ইফাদ শিশির। সোজ হসপিটাল এসে পৌঁছালো সকাল আটটা বাজতে বাজতে। আজ রিহান কে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই এক সপ্তাহ হসপিটালে থেকে রিহান অতিষ্ঠ। সে নিজের রুমে থাকবে। নিজের বিছানায় থাকবে। তারমধ্যে অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে হসপিটালের মিরা খাবার খেতে পারে না। ঘুমায় না। মেয়ে টাকে কতবার করে সবাই জোর করে ও বাড়ি নেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারছে না। রিহান তাই বাড়িতে নিজেই চলে যাবে। এতে অবশ্য মিরা খুশি হয়েছে। হসপিটালের নার্স গুলো আরো বেশি ছোঁকছোঁক স্বভাবের। মিরা’র একদম ভালো লাগে না মেয়ে গুলো কে। ডিপ্লোমা করা তিন টা মেয়ে হয়তো ইন্টার্নিশিপ করে বর্তমানে। বয়স কম ডক্টর যখন চেক করতে আসে তখন ওরাও আসে আর তখন কেমন অসুস্থ রিহান কে চোখ দিয়ে গিলে খায়। তার সাথে লজ্জা যেনো একজন আরেকজন গুঁতাগুতি করে মিরা’র তখন রাগে দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছে করে। ওরা কি দেখে না পুরুষ টা বিবাহিত তার স্ত্রী আছে। এভাবে পরপুরুষ কে দেখার কি আছে ভেবে মিরা হতাশ। শুধু রিহান এর জন্য কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ যতক্ষণ ওরা থাকে ততক্ষণ একদম রিহান এর সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। বয়স্ক ডক্টর টা তখন মিরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে শুধু।
কিন্তু আজ শিশির এসে মিরা কে সাইডে নিয়ে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। ভালো করে দেখলো হা-হুতাশ করে দুঃখ প্রকাশ করে। এদিকে মিরা অসহায়। সে জানে এই আট দিনে তার অবস্থা খুব অবনতি হয়েছে। শরীর শুঁকিয়েছে। চাপা ভেঙ্গে গিয়েছে। চুল উসখুস। ফ্যাকাসে মুখ। ক্লান্তিত চোখ। দুর্বল শরীর। এদিকে ডক্টর যেতে একজন নার্স ইফাদ এর কাছে গেলো। শিশির বিষয় টা লক্ষ করে তাচ্ছিল্য হাসে। ইফাদ নার্স টার সাথে কথা বলে শিশির কে এভাবে তাকাতে দেখে থমথম খেলো। বিষয় টা বুঝতে এক সেকেন্ড সময় লাগলো। মেয়ে টা নিশ্চয়ই আবার তাকে ভুল বুঝচ্ছে। নার্স কে মেকি হেঁসে বিদায় দিয়ে দ্রুত কদম ফেলে এদিকে এলো। কেবিনে তখন কাজল রিহান এর সাথে কথা বলছে আর মিরা শিশির সোফার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ইফাদ ওদের কাছে গিয়ে ঝটফট বলে উঠলো,
-“আরে নার্স আমার কথা না রিহান এর ফোন নাম্বার চাইছ,,,,
বলতে গিয়ে মাঝপথে থামে ইফাদ। শিশির ভ্রু কুঁচকে নিলো। ইফাদ একবার শিশির তো একবার মিরা আবার রিহান এর দিকে তাকায়। রিহান বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে আর মিরা খুব শান্ত। ইফাদ হুট করে নিজের মুখের ভেতর তর্জনী আঙ্গুল ঢুকিয়ে দাঁত দ্বারা কামড়ে ধরলো। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উলটে বলে উঠলো,
-“উফ মিস্টেক। আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো।”
শিশির পিটপিট করে তাকায়। মিরা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। কথার অর্থ বুঝে না মেয়ে টা।
এরমধ্যে রিহান দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
-“হ্যাঁ একদম ঠিক ধরেছিস। ফাজিল।”
কাজল ইফাদ কে যেতে বলে। যেখানে যাবে শুধু ঝামেলা। ইফাদ কে রিসেপশনে গিয়ে সব ফর্মালিটি পূরণ করতে বলে সে রিহান এর হসপিটালের পোশাক বদলে দিতে নেয়। রিহান নাকচ করে দেয়। শিশির বাইরে যায়। কাজল ও ব্যাগ পত্র নিয়ে পেছনে আসে। মিরা রিহান কে সাহায্য করলো। আর লজ্জায় লাল নীল হলো। যদিও হতো না তবে রিহান বিরক্ত করে মেয়ে টাকে। পেটে হাত দেয়। চোখে ফু দেয়। ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে। মিরা মহা বিরক্ত। দাঁতে দাঁত চেপে কাজ শেষ করে রিহান কে নিজের এক কাঁধে ভর করে রুমের বাহিরে নিয়ে আসে। এরপর বাকি পথ কাজল নিলো গাড়ি পর্যন্ত।
———
ওরা শেখ বাড়ি চলে এসছে। রিহান কিছুতেই গেলো না চৌধুরী বাড়ি। মিরা এটা নিয়ে বেশি ঘাঁটল না। তারা বাড়িতে এসছে সেই এগারো টা বাজে। এসছে পরে মিরা কে কিছু ই করতে দিচ্ছে না রিহান এর মা চাচি। তারা নিজেরাই রিহান এর খেয়াল রাখছে। দুপুরে খাবার রিহান এর মা নিজে ছেলে কে খাইয়ে দিয়েছে আর ঔষধ সব কাজল। আর রোকেয়া নিজের মেয়ের খেয়াল রাখছে। যদিও রিহান এর ও সেবা সুযোগ পেলে করছে। তবে মেয়ে তার ভীষণ আদরের। ভালোবাসার মানুষ এর শেষ চিহ্ন। এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার মানুষ টার কথা ভেবে তার শেষ স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রূপ-যৌবন সব শেষ করে দিয়েছেন। সেই মেয়ে কে এক সপ্তাহ দেখতে পায় নি। ছুঁতে পারে নি। মায়ের মন অস্থির। পুরো বিকেল রোকেয়া মেয়ে কে গোসল খাওয়া চুল শুঁকিয়ে মাথায় তেল লাগিয়ে দেওয়া। সব করলো। এরপর রিহান এর ও খুঁজ নিলো। কিন্তু মিরা এলো না। রাতের খাবার নিয়ে এরপর সে রুমে এলো। রিহান এর চেপে রাখা ছটফটানি মেয়ে টাকে দেখে আরো কয়েকগুণ বাড়লো। মিরা খুব শান্ত। তবে মুখের ভাবভঙ্গি গম্ভীর। খাবার থেকে শুরু করে ঔষধ দেওয়া সব মেয়ে টা নীরব থেকে করলো। রিহান অস্থির। এখন দুই হাত ই ঠিক আছে তার। শুধু বুকের আর পায়ের প্লাস্টার রয়েছে। নয়তো আর কোনো আঘাত নেই। তাই খুব সহজে মিরা কে ধরতে পারে। দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বসা অবস্থায়। মিরা দাঁড়িয়ে আছে। পেটে মুখ গুঁজে রিহান বলে উঠলো,
-“রেগে আছে কেনো আমার জান?”
মিরা এই প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। বুকের ভেতর টিপটিপ শব্দ হয় রিহান এর কণ্ঠে। তাবে পরপরই নিজে অদ্ভুত প্রশ্ন করলো,
-“আপনি আর একটু অসুন্দর হলে কি এমন ক্ষতি হতো রিহান ভাই?”
-“কার কিসে ক্ষতি হয় জানি না। কিন্তু তুই যে আমাকে ভাই ডাকিস এতে আমার বিরাট ক্ষতি হয়। রোমান্টিক মুড নষ্ট করতে যথেষ্ট, বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।”
রিহান ধমক দিয়ে বলে। মিরা’র হাসি পায়। রিহান ওর কামিজ সরিয়ে উন্মুক্ত করে পেট। সেখানে কামড়ে ধরে দাঁত দিয়ে। মিরা ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
-“অহ।”
রিহান তখনো মুখ গুঁজে আছে সেখানে। মিরা মোচড়ামুচড়ি করে। লাভ হয় না। রিহান ওর কোমড় চেপে ঘনিষ্ঠ করলো আরো মেয়ে টাকে নিজের সাথে। এরপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“ভাই ডাকার শাস্তি। সুস্থ থাকলে তোর খবর ছিলো আজ। বেয়াদব।”
#চলবে….