#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৩১
#জান্নাত_সুলতানা
রিহান কেমন? খুব খারাপ? না-কি ভালো? মিরা’র মন ছটফট করে। তার মন এতো বছর ধরে পুরুষ টাকে ভালোবেসে একজন সুপুরুষ বলে ই জেনে এসছে। তবে কি তার জানার মধ্যে ভুল আছে? না তা কি করে হয়! অবশ্য সে জানার চেষ্টা ও তো করে নি। শুধু দেখেছে আর রোজ পুরুষ টার প্রেমে একটু একটু করে পড়েছে।
কিন্তু এখন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মিরা আনমনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। সবাই আজ ঢাকা যাচ্ছে। বাড়ির সবাই অলরেডি রওনা করেছে। কিন্তু রিহান মিরা বেরোয় নি। রিহান একটু আগে ঘুম থেকে উঠছে। সবাই এক সাথে তো যাওয়া যাবে না। তাই একটা গাড়ি অনেক আগে চলে গিয়েছে। ওরা রিহান এর ওই জিপগাড়ি দিয়ে যাবে। মিরা’র যদিও একটু মত নেই এতে। কতবার এক্সিডেন্ট হয়েছে ওটায় চড়ে। এখন এটা দেখলে মিরা’র ভয় লাগে। মিরা’র পায়ে নরম কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো কিছু টা। নিচে তাকিয়ে দেখলো টম পা সহ শাড়ী ঘেঁষে আছে। কোলে উঠবে সে। মিরা পেছনে থালা দেখে। খাবার দিয়েছিলো টম কে। খাওয়া শেষ। মিরা ওকে কোলে তুলে। ড্রেসিং টেবিলের উপর টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিলো। টম কে কোলে তুলে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দিতে দিতে বলে উঠলো,
-“কিছু কিছু কাজ যত সাবধানে ই করো না কেনো প্রমাণ ঠিকই থেকে যাবে।”
মিরা কথা টা এমনি এমনি বললেও পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রিহান এর নিকট কথা টার গভীরতা অনেক বেশি মনে হলো। সে ঘাড় এদিক-ওদিক বাঁকা করে। মোটেও সে কোনো কাজ প্রমাণ রেখে করে না। তবুও ইদানীং অস্থিরতায় ভুগছে নিজে। মনে হচ্ছে এই বাচ্চা মেয়ে টাকে ঠকানো হচ্ছে। সত্যি টা জানতে পারলে বেচারি অনেক কষ্ট পাবে। আবার এমনো হতে পারে মিরা তাকে ছেড়ে অনেক দূর চলে গেলো! না না এমন টা সে কোনো দিন মানতে পারবে না আর না এমন টা হতে দিবে।
-“শুনছেন? আপনি রেডি কখন হবেন?”
মিরা’র ডাকে রিহান এর ধ্যান ভাঙ্গে। রিহান হাতের টাওয়াল নাড়াচাড়া করে চুল মুছে এগিয়ে আসে মিরা’র কাছে। এরপর গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে টম কে নিজের কোলে নিয়ে বিছানায় রেখে দিলো। মিরা ভ্রু কুঁচকে আছে।
রিহান বিছানা থেকে সাদা রঙের শার্ট টা হাতে তুলে মিরা’র হাতে দিলো। এরপর দুই হাত দু’দিকে মেলে ধরে আদেশ স্বরে বললো,
-“পড়িয়ে দে।”
মিরা বিনাবাক্যে শার্ট পড়িয়ে দিতে লাগলো। বলিষ্ঠ শরীরে পিঠের কাছে গিয়ে থামে মিরা। পিঠের মাঝ বরাবর একটা ক্ষত-র চিহ্ন। মাস এক আগের এক্সিডেন্ট এর ক্ষত। শুঁকিয়েছে। তবে দাগ মিটে নি। মিরা সেখানে একবার আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
-“ব্যথা করে?”
-“ব্যথা করলে রাতে যে এতো এতো খামচি দিস সে-সব সহ্য করতে পারতাম না।”
মিরা থমথম খেলো। কি সাধারণ একটা প্রশ্ন করলো সে। আর পুরুষ টা সেটাকেও ঘুরিয়ে কোথায় নিয়ে উত্তর করলো। অদ্ভুত। মিরা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। এরপর শার্ট পড়িয়ে দিলো। বোতাম লাগিয়ে ব্লেজার গায়ে তুলে দিলো। আগে প্যান্ট পড়া ছিলো রিহান। এরপর টাই বেঁধে চুল ঠিকঠাক করে হাতে কালো রঙের দামী একটা ঘড়ি পড়ে গায়ে পারফিউম মেখে নিলো। কালো রঙের একজোড়া লোফার পায়ে নিজের সাজ কমপ্লিট করলো। মিরা অপলক দেখে গেলো শুধু। কত সুদর্শন পুরুষ টা। দেখলেই অন্তর জুড়িয়ে যায়।
মিরা’র পড়নে কালো রঙের একটা শাড়ি। সাথে সাদা ব্লাউজ। তাকে-ও দারুণ মায়াবী দেখাচ্ছে। রিহান বউয়ের কপালে চুমু খেলো। এরপর অধর পানে তাকিয়ে দুষ্ট হেঁসে বলে উঠলো,
-“শুধু লিপস্টিক নষ্ট করে তোর কাজ বাড়াতে চাচ্ছি না। রাতে উশুল করবো সব।”
মিরা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে শুধু রিহান কে। কিছু বলে না মুখ ফুটে।
——–
রিহান বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তার জলন্ত সিগারেট। একটু পর পর সেটা ঠোঁটের ভাঁজে চেপে ধরে ধোঁয়া ছাড়ছে। এখানে সে আজ আসতো না। কিন্তু একপ্রকার বাধ্য হয়ে আসতে হয়েছে। সে পুরনো জীবন টা ভুলে যেতে চায়। নতুন করে বাঁচতে চায়। লোভ হয় তার। একটা সাধারণ জীবনযাপন এর লোভ। ভালোবাসার মানুষ টার সাথে সহজসরল একটা সংসার এর লোভ। কিন্তু কিভাবে হবে আদোও কি সেটা সম্ভব হবে কি-না রিহান জানে না। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কোথায়! রিহান সিগারেট এর শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলো। বাড়ির ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা ফেলতে সামনে এসে দাঁড়ালো একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। রিহান বিরক্ত হলো। এই মানুষ গুলো জাস্ট জঘন্য। রিহান তবুও চুপ চাপ দাঁড়িয়ে গেলো। সামনে দাঁড়ানো পুরুষ টা প্রচুর রেগে আছে মনে হচ্ছে। রিহান এর এতে কোনো হেলদোল না দেখে পুরুষ টা আরো রেগে গেলো। কিছু টা উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
-‘একজন মানুষ কে মেরে হসপিটালে পাঠিয়ে এখানে রংতামাশা করতে লজ্জা করছে না তোমার?”
রিহান ভাব এমন করলো যেন সে খুব ভালো একটা কাজ করেছে। আর এতে সে গর্বিত। কোনো অপরাধ করে নি সে। ঘাড় এদিক-ওদিক নাড়াতে নাড়াতে জবাব দিলো,
-“একদম করছে না।”
রিহান এর জবাব মোটেও ভালো লাগে নি পুরুষ টার। আগুনে ঘি ঢালার মতোই কাজ হলো। একদম রেগে রিহান এর কলার ধরতে নিলে রিহান দুই পা পিছিয়ে গেলো। এতে করে হাতের নাগালের বাহিরে চলে গেলো সে। পুরুষ টা রাগে কটমট করতে লাগলো। রিহান যদিও প্রমাণ বা দোষ ছাড়া কাউ কে এভাবে মারার পাত্র নয় সেটা খুব ভালো করে জানে তিনি। তবুও জিজ্ঞেস করলো,
-“কেনো মারলে আমার ছেলে কে?”
রিহান প্যান্ট এর পকেটে দুই হাত গুঁজে নিলো। শরীর দুলিয়ে কঠিন স্বরে বলে উঠলো,
-“চরিত্র আর দৃষ্টি দুই টাই কন্ট্রোল করতে বলবেন আপনার গুণধর পুত্র কে। এবার হসপিটাল পাঠিয়েছি দ্বিতীয় বার এমন করলে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেবো। মাইন্ড ইট।”
-“আমার সাথে তুমি এভাবে কথা বলতে পারো আমার ছেলে কে আঘাত করে এতো বড় অন্যায়ের পরে কোন মুখে?”
রিহান হেঁসে উঠলো ইরফান এর বাবা-র এমন বেহুদা মার্কা কথা শুনে। এই পুরুষ টাও আতিক চৌধুরী পুষা গুলাম। ভালো একটা মুখোশ এর আড়ালে এরা জঘন্য কাজ করে। অবশ্য সে নিজেও মানুষ টা সাধু নয়। তবুও এদের মতো জঘন্য নয় সে। রিহান বাঁকা হাসে। রসাত্মক স্বরে বলে উঠলো,
-“আপনার ছেলে বুঝি খুব ন্যায় কাজ করছে অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিয়ে?”
ইরফান এর বাবা থতমত খেলো। রিহান সে-সব উপেক্ষা করে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
পেছনে দাঁড়িয়ে ফারুক সাহেব কটমট করতে লাগলো।
——-
শাহনাজ এই প্রথমবার পার্লারে সেজেছে। জীবনে প্রথম এতো ভারি মেক-আপে খারাপ লাগছে না মেয়ে টাকে। গোল্ডেন কালার লেহেঙ্গায় অসাধারণ লাগছিল। সারাদিন কাজল বউ কে চোখে চোখে রেখেছে আর দেখেছে। অনুষ্ঠান শেষ হতে যে যার মতো করে বিদায় নিলো। বাড়ি খালি হলো। শাহনাজ আর কাজল কাল গ্রামে যাবে। আজ মিরা কে ধরে বেঁধে সেইজন্য আজ এখানে রেখে দিয়েছে। রিহান থাকবে না এখানে। সে বউ কিছুতেই রেখে যাবে না এখানে। রাত আটটা বাজতেই রিহান বউ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। অতিরিক্ত অস্থিরতায় সে বিধস্ত। মিরা ভেবে পায় না কেনো এমন করছে রিহান। সুইজারল্যান্ড যাওয়ার আগে অব্ধি তো মানুষ টা আতিক চৌধুরীর ভক্ত ছিলো। প্রায় থাকতো এখানে তাদের বিয়ের আগে। তাহলে লাস্ট ছয় মাস ধরে কেনো এবাড়ি থাকে না? যখন মিরা কে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে উঠতে চেয়েছিলো তখন মিরা একটু অবাক হয়েছিলো। তবে ব্যাপার টা পাত্তা দেয় নি। ভেবেছিলো হয়তো নিজের বউ কে অন্যের বাড়িতে রাখতে চায় না সেইজন্য নিজেদের ফ্ল্যাটে রাখবে। কিন্তু তখন এটা স্বাভাবিক মনে হলে-ও এখন কেমন একটা লাগে।
ইদানীং রিহান এর ভাবসাব ও সুবিধার লাগে না। মামা আতিক চৌধুরীর সাথে তো সে কথাই বলে না। মিরা’র নজরে বিষয় গুলো ঠিকই পড়েছে কিন্তু সে তো তখন এতো তলায় নি।
মিরা আঁড়চোখে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করতে থাকা রিহান এর দিকে তাকায়। তারা প্রায় মেইন রোড ছেড়ে দিয়েছে। আর একটু এগিয়ে বাড়ির রাস্তা ধরবে। খোলামেলা উদোম জিপগাড়ি টায় ভালো ই ঠান্ডা লাগছে। মিরা শাড়ী ভালো করে পেঁচিয়ে রেখেছে। রিহান বিষয় টা লক্ষ্য করে গাড়ি থামালো ছোটো সরু রাস্তায়। নিজের গায়ের ব্লেজার খুলে মিরা কে পড়িয়ে দিলো। একটু এগিয়ে কপালে আলতো করে অধর ছুঁয়ে দিয়ে আলগোছে নিজের হাত মিরা’র গালে রাখলো। কেমন ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“আমার জান। অনেক বেশি ভালোবাসি।”
রিহান এর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে দুই টা গাড়ি এসে ওদের গাড়িটার পেছনে দাঁড়ালো। রিহান ভ্রু কুঁচকে নিলো। সে গাড়ি সাইডে পার্ক করেছে তাহলে? অন্ধকার। তবে ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয়ে গাড়ি দু’টো দেখে রিহান এর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।
মিরা গাড়ি থেকে কয়েকজন পুরুষ কে নামতে দেখে ভয়ে রিহান এর দিকে চেপে গেলো। রিহান তৎক্ষনাৎ নিজের কানের ব্লুটুথ চেপে মুখ টা ঘুরিয়ে কারোর সাথে কথা বলে নিলো। মিরা শুনতে পেলো না। কারণ কেউ একজন ততক্ষণে পেছন থেকে বলে উঠলো,
-“A গ্রুপের গ্যাংস্টার RS কি বউ কে নিয়ে পালাচ্ছে?”
মিরা কিছু ই বুঝতে পারে না কথার মানে। শুধু “গ্যাংস্টার” কথা টা মেয়ে টার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কানে ঝনঝন শব্দে কিছু ভাঙ্গছে যেন। রিহান নিজে ও শুনেছে। সে খুব স্বাভাবিক পরিস্থিতি যেমন ই হোক এটা কে ঠান্ডা মাথায় সামলে নেওয়া টা-ই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। রিহান খুব ভালো করে জানে এখন কি করতে হবে। সে নিজের টাই টা আগে ব্যাস্ত হাতে খুলে নিলো। এরপর সেটা দিয়ে মিরা’র হাত বেঁধে নিলো। এরপর একটা রুমাল বেড় করে প্যান্ট এর পকেট থেকে। সাথে টিস্যু। রুমাল দিয়ে মুখ সহ চোখ বেঁধে টিস্যু গুলো মিরা’র কানের ভেতর গুঁজে দিলো। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটছে মিরা কিছু ই বুঝে উঠতে পারে না। যতক্ষণে বুঝতে পারলো তখন থেকে ছটফট করেই যাচ্ছে। এই মূহুর্তে সবচেয়ে নিষ্ঠুর একজন মানুষ মনে হলো সামনে বসা পুরুষ টাকে। তবে রিহান একটু গাফলতি করলো না নিজের কাজে। মিরা’র বুকের ভেতর অজানা ভয়ে কাঁপছে। কলিজা চিনচিন করছে। চোখের জল রুমাল সহ ভিজে উঠেছে। রিহান বউয়ের কানে টিস্যু গুঁজে দেওয়ার আগে শুধু বললো,
-“আমি আমার একটা রূপ তোমার সামনে সর্বদা ঢেকে রেখেছে। আর ভবিষ্যতে ও ঢেকে রাখবো।”
এরপর পেছনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে গেলো।
#চলবে…..